Thursday 28 March 2024

*ইসলামী ইলম্/জ্ঞান: (১) আধ্যাত্মিক ও (২) প্রকাশ্য*


- এডমিন বিশিষ্ট তাবেঈ ও আলেমে হক্কানী-রব্বানী তথা সূফী-দরবেশ হযরত ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন -

وَعَن الْحسن قَالَ: «الْعِلْمُ عِلْمَانِ فَعِلْمٌ فِي الْقَلْبِ فَذَاكَ الْعلم النافع وَعلم على اللِّسَان فَذَاك حُجَّةُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى ابْنِ آدَمَ». رَوَاهُ الدَّارمِيّ

অর্থ: হযরত ইমাম হাসান আল-বসরী (রহঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, ’ইলম দুই প্রকার। এক প্রকার ’ইলম হলো অন্তরে, যা উপকারী ’ইলম। আর অপর প্রকার ’ইলম হলো মুখে মুখে, আর এটা হলো আল্লাহর পক্ষে বনী আদমের প্রতি আরোপিত প্রামাণিক দলিল। [দারিমী, ৩৬৪; মিশকাতুল মাসাবিহ, কিতাবুল ইলম অধ্যায়; বর্ণনার মান-সহীহ/বিশুদ্ধ]

ব্যাখ্যা:

হযরত ইমাম বসরী (রহ.) ইসলামী প্রথম তিন প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত, যাঁদের সম্পর্কে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন। ইমাম সাহেবের (রহ.) এ কথায় শরঈ ইলম/জ্ঞান সম্পর্কে গভীর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বস্তুতঃ এ জ্ঞান দু ভাগে বিভক্ত। মুখে মুখে তথা জিহ্বা দ্বারা যা প্রকাশ্যে বিবৃত হয়েছে, তা আল্লাহতায়ালার জাহেরী বা প্রকাশ্য বিধান (ফিকাহ)। আর ক্বলব্ তথা অন্তরের বাতেনী বা অপ্রকাশ্য ইলম্ হচ্ছে ইসলামের আধ্যাত্মিকতা (তাসাউফ/সূফীতত্ত্ব তথা ইলমে মা’রেফত)। এ জ্ঞানই সূফী-বুযূর্গমণ্ডলী চর্চা করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

সিদ্ধান্ত:

ফিক্বাহ-শাস্ত্র ও তাসাউফ-শাস্ত্র পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরিপূরক। এটা অনেকটা দুনিয়ার বিদ্যালয়গুলোর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আরম্ভ করে কলেজ পর্যন্ত পড়াশুনাকে জাহেরী শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করাকে বাতেনী শিক্ষা বলে ধরে নিলে বোঝা যাবে যে, মানুষের জীবনে বাতেনী বা মারেফতী জ্ঞান অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভই চূড়ান্ত লক্ষ্য। স্রেফ ফিক্বাহ চর্চায় যে খোদাপ্রাপ্তি সম্ভব নয়, তা ইমামুল আযম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর কথায় স্পষ্ট হয়েছে। তিনি সারা জীবন ইজতিহাদ ও ফিক্বাহশাস্ত্র চর্চা করার পর শেষ ২ বছর সূফী ইমাম হযরত জা’ফর সাদিক্ব (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর দরবারে উপস্থিতি দ্বারা খেদমতে ব্যয় করেন। অতঃপর তিনি বলেন -

لولا السنتان لهلك النعمان

অর্থ: আমি নু’মান (বিন সাবিত তথা ইমাম আবূ হানীফাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি) যদি ওই দুই বছর ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর সান্নিধ্যে না থাকতাম, তাহলে ‘হালাক’ বা বিনাশ হয়ে যেতাম।

তাসাউফ বিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে আমার অনূদিত ‘তাসাউফ প্রবন্ধ সমগ্র’ পুস্তকে। পিডিএফ লিঙ্ক: https://drive.google.com/file/d/1jhdpeWPSlZsHimBCYVxJiyyPZX6d0E26/view?usp=drive_link

আল্লাহতায়ালা সবাইকে বোঝার তৌফীক্ব দিন, আমীন।

*সমাপ্ত*

ছবি - ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মাযার শরীফ, বাগদাদ, ইরাক।



Saturday 17 June 2023

প্রিয়নবী (ﷺ)-এর রেসালাতে বিশ্বাস যে নাজাত তার দলিল


-এডমিন

মিশকাতুল মাসাবীহ হাদীসগ্রন্থ, ঈমান অধ্যায়: প্রিয়নবী (দ.) ঘোষণা করেন -

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَا يسمع بِي أحدق مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلَا نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَّا كَانَ من أَصْحَاب النَّار» . رَوَاهُ مُسلم -

হযরত আবূ হুরায়রাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে প্রতিপালকের হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর কসম! এ উম্মাতের যে কেউই, চাই ইয়াহূদী হোক বা খ্রীষ্টান, আমার রিসালাত ও নুবূওয়্যাত মেনে না নিবে ও আমার প্রেরিত শারী’আতের উপর ঈমান না এনেই মৃত্যুবরণ করবে, সে নিশ্চয়ই জাহান্নামী। (মুসলিম) - হাদীসের মান: সহীহ। লিঙ্কে ১০ নং হাদীস - https://www.hadithbd.com/hadith/detail/?book=24&section=623

ওপরের হাদীসে স্পষ্ট হয় যে (তদানীন্তন) ইহুদী ও খ্রীষ্টান মানুষেরা, যদিও তাঁরা এক খোদায় বিশ্বাস করতেন (সর্ব-পয়গাম্বর মূসা ও ঈসা আলাইহিমাস্ সালামের কিতাব অনুযায়ী), তবুও তাঁদের সেই তওহীদ পরকালীন নাজাত/মুক্তির উৎস হবে না (যদি তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতে বিশ্বাস স্থাপন না করেন)।

*সমাপ্ত*

Tuesday 23 May 2023

*আফযালীয়্যাত তথা শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে এক বাহুল্য তর্ক ও তার জবাব*


- এডমিন ইদানীং ফেইসবুকে এক বাহুল্য তর্ক আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কতিপয় ফেইসবুকার ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চাচ্ছেন যে প্রথম দু জন ইসলামী খলীফা সর্ব-হয়রত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ফযীলতের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ (আংশিক ক্ষেত্রে হোক বা সামগ্রিক)। কেউ কেউ আবার তাঁকে ‘বেলায়াতের সম্রাট’ও আখ্যা দিচ্ছেন। এই বিতর্ক এক প্রকার বেয়াদবি বলে আমার মনে হয়। কেননা সাহাবীয়্যত, বিশেষ করে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান সাহাবা (রা.)-বৃন্দের সাহাবীয়্যত মানে বেলায়াত নয়, এমন ভ্রান্ত ও গোস্তাখিমূলক ধারণা কোনো প্রকৃত মুসলমান পোষণ করতে পারেন না (যেহেতু আল-কুর’আনের সূরাহ ইঊনুস ৬২ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘আউলিয়া’র প্রথম উদ্দিষ্ট প্রজন্ম হলেন সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম; এরপর পরবর্তী প্রজন্মসমূহ)। তাই স্রেফ অসৎ এজেন্ডাধারী ও তাদের ধোঁকায় পতিত অজ্ঞ লোকেরাই এ রকম ভ্রান্ত ও অপব্যাখ্যামূলক ধারণা অন্তরে লালন করতে পারে। চলুন, এই বিষয়ে খোদ হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) কী সাক্ষ্য দিয়েছেন তা জানতে চেষ্টা করি। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর প্রণীত ‘মুসনাদ’ কিতাবে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন, যা’তে বিবৃত হয়: عن عبد خير قال: قال علي لما فرغ من أهل البصرة: " إن خير هذه الأمة بعد نبيها صلى الله عليه وسلم أبو بكر، وبعد أبي بكر عمر، وأحدثنا أحداثا يصنع الله فيها ما شاء ". অর্থ: হযরত আবদু খায়র (রা.) হতে বর্ণিত; ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) বসরাবাসীদের থেকে ফারেগ/অবসর হওয়ার সময় বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ জন হলেন হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); অতঃপর শ্রেষ্ঠ হযরত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)।” [মুসনাদে ইমাম আহমদ রহ:, হাদীস নং ১০৩১ (মান: সহীহ - লিঙ্ক: https://hadithprophet.com/hadith-5570.html] একইভাবে, ইমাম ইবনু কুদামা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর রচিত ‘লুম’আতুল ই’তিক্বাদ’ পুস্তিকায় ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর আরেকটি বাণী উদ্ধৃত করেন: خير هذه الأمة بعد نبيها أبو بكر ثم عمر ولو شئت سميت الثالث. অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে এই উম্মতের মাঝে সেরা হলেন হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); অতঃপর সেরা হলেন হযরত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); আর আমি যদি চাইতাম, তবে তৃতীয় জনের (নাম) উল্লেখ করতাম। [বাংলা সংস্করণ, ৭৪-৭৫ পৃষ্ঠা; পিডিএফ লিঙ্ক: https://docs.google.com/document/d/1BCgaCePj0VwwnnuspX0rNoSizDqUzfRByMKrDw_pqOE/edit?usp=share_link] উক্ত পুস্তিকায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে অনুরূপ আরেকটি বর্ণনা এসেছে। তাতে এই মহান সাহাবী (রা.) বলেন: روى عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال: كنا نقول والنبي صلى الله عليه وسلم حي: أفضل هذه الأمة بعد نبيها أبو بكر ثم عمر ثم عثمان ثم علي فيبلغ ذلك النبي صلى الله عليه وسلم فلا ينكره . অর্থ: আমরা এ কথা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর (যাহেরী) হায়াতে জিন্দেগীতে বলতাম: “প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে এই উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন হয়রত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); এরপর হয়রত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); এরপর হযরত উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); এরপর হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনোই এ কথাকে নিষেধ করেননি। [আল-বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কৃত ‘মানা’ক্বিব, ৩৪৬৮; সুনানে আবী দাউদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), কিতা’বুস্ সুন্নাহ, ৪৬২৭, ৪৬২৮, ৪৬২৯; ইবনে মাজাহ (عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي عضوا عليها بالنواجذ), ‘মোক্বাদ্দমা’, ১০৬; সুনানে তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), ‘মানা’ক্বিব’, ৩৭০৭ এবং ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), ১:১১৪; ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন] অতএব, চূড়ান্ত কথা হলো এসব বিশুদ্ধ বর্ণনার আলোকে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর নেই। তাঁর কথাই এক্ষেত্রে শিরোধার্য! তিনি যখন ব্যক্ত করেছেন এ সহজ-সরল কথা, তখন এর বাইরে গিয়ে তাঁর কোনো আশেক্ব ও সিলসিলাধারী দাবিদার ব্যক্তির পক্ষে টুঁ শব্দ করা তাঁর শানে বেয়াদবি বলে আমি মনে করি। বিষয়টি আরো গুরুতর হয়ে যায় যখন দেখি, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এরও এই সিদ্ধান্তের প্রতি মৌন সমর্থন রয়েছে (হযরত ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা অনুসারে সুন্নাতে তাক্বরীরী)। আশা করি, মুসলমান সাধারণ এ ব্যাপারে সতর্ক হবেন এবং অসৎ এজেন্ডাধারীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। আল্লাহ সবাইকে হেদায়াত দিন, আমীন। লিঙ্ক: https://docs.google.com/document/d/1BCgaCePj0VwwnnuspX0rNoSizDqUzfRByMKrDw_pqOE/edit?usp=sharing


*অনলাইনে ধর্মনীতির অনুসরণ, না এজেন্ডার বাস্তবায়ন?*

কতিপয় ফেইসবুকারকে দেখছি পোষ্টের এ বিষয়টিকে কোনোক্রমেই মেনে নিতে নারাজ। তাঁরা দাবি করছেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এ মর্মে কোনো স্পষ্ট বাণী নেই। তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে নিম্নোক্ত হাদীসই তাঁদের ওই দাবিকে সমূলে উৎপাটিত করেছে। মনে রাখবেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ তিন প্রকার: (১) তাঁর বাণী যা সুন্নাতে কওলী; (২) তাঁর কাজ যা সুন্নাতে ফে’লী; এবং (৩) সুন্নাতে তাকরীরী যা তাঁর সামনে করা হয়েছে, কিন্তু তিনি নিষেধ করেননি। অতএব, এর পক্ষে স্পষ্ট দলিল হচ্ছে নিম্নের রওয়ায়াত/বর্ণনা -

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন:

روى عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال: كنا نقول والنبي صلى الله عليه وسلم حي: أفضل هذه الأمة بعد نبيها أبو بكر ثم عمر ثم عثمان ثم علي فيبلغ ذلك النبي صلى الله عليه وسلم فلا ينكره .

অর্থ: আমরা এ কথা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর (যাহেরী) হায়াতে জিন্দেগীতে বলতাম: “প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে এই উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন হয়রত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); এরপর হয়রত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); এরপর হযরত উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু); এরপর হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনোই এ কথাকে নিষেধ করেননি। [আল-বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কৃত ‘মানা’ক্বিব, ৩৪৬৮; সুনানে আবী দাউদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), কিতা’বুস্ সুন্নাহ, ৪৬২৭, ৪৬২৮, ৪৬২৯; ইবনে মাজাহ (عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي عضوا عليها بالنواجذ), ‘মোক্বাদ্দমা’, ১০৬; সুনানে তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), ‘মানা’ক্বিব’, ৩৭০৭ এবং ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি), ১:১১৪; ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন]

বি.দ্র. এতদসংক্রান্ত দলিলসমৃদ্ধ আমার পূর্ববর্তী লেখাটি তাই আবার শেয়ার করলাম। তরুণ সুন্নী অনলাইন এ্যাকটিভিষ্টদের বলবো, এজেন্ডাধারীদের চিহ্নিত করে রাখুন এবং সবাইকে তাদের ব্যাপারে সতর্ক করুন, যাতে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে না পারে।


*বিশেষ জ্ঞাতব্য*

একটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। সাহাবা (রা.)-মণ্ডলীর মধ্যে কাউকে বড় করা এবং অপর কাউকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এসব লেখায় আমার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা হতে আমি বিরত থেকেছি। বরং ইসলামী দলিলাদি হতে যা প্রকাশিত হয়েছে, তাই তুলে ধরা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্লাহতায়ালা ও প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুস্পষ্ট বাণী, সংশ্লিষ্ট সাহাবা (রা.)-বৃন্দের ভাষ্য ও পূর্ববর্তী সুন্নী ইমামমণ্ডলীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। যেহেতু অনলাইনে সক্রিয় কতিপয় এজেন্ডাধারী ভ্রান্ত মতবাদী ইতর লোক ফেইসবুকে দলিলাদির অপব্যাখ্যা দ্বারা এদেশের সুন্নী মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে, সেহেতু এই আলোচনা করতে আমি বাধ্য হয়েছি। এতে আমার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত হয়নি।


*প্রিয়নবী (ﷺ) কর্তৃক হযরত আবূ বকর (রা.)-কে নামাযে ইমামতির নিয়োগ দান ছিলো প্রতীকী*

সম্প্রতি আমার লেখা প্রথম দুই খলীফা (রা.)-এর ‘আফযালীয়্যাত’/শ্রেষ্ঠত্ব-সংক্রান্ত পোষ্টগুলো এজেন্ডাধারীদের মাঝে বেশ অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। তাঁরা অনেক অপযুক্তি ও অস্পষ্ট বিষয়াদি উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো, প্রিয়নবী (ﷺ) কর্তৃক আপন বেসাল শরীফের আগে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে নামাযে ইমামতির নিয়োগ দানের মাধ্যমে তাঁকে পরবর্তী খলীফা মনোনয়নে এমন আর কী ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে? এ রকম ইমামতির জন্যে নিয়োগ তো বর্তমানে হরহামেশাই ঘটছে! মসজিদ কমিটি তো হাফেজে কুর’আনকেও নামায পড়াবার জন্যে নিয়োগ দিচ্ছে! নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!

এই অপযুক্তির খণ্ডনে শুধু এতোটুকু বলবো, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে যিনি আপন বেসাল শরীফের আগে ইমামতির দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, আল্লাহতায়ালার মাহবূব, সরকারে দো জাহান, রহমতুল্লিল আলামীন, সাইয়্যেদুল মুরসালীন হযরতে নবী মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি আর আমাদের যুগের মসজিদ কমিটি এক সমান হলো? বস্তুতঃ তাঁর এই নিয়োগ দান ছিলো প্রতিনিধিত্বের প্রতীকস্বরূপ - তাঁরই খেলাফত ও বেলায়াতের প্রথম প্রতিনিধিস্বরূপ, যার সাথে অন্য কারো তুলনা করা স্রেফ বেয়াদবি! যে বা যারা এ রকম তুলনা করছে সে বা তারা গোস্তাখে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তারা অবশ্যঅবশ্য ইসলামের শত্রুদের মদদপুষ্ট হয়ে শত্রুতার এজেন্ডা বাস্তবায়নে অপতৎপর।

পুনশ্চ: আরেকটি অপযুক্তি পেশ করা হয়েছে যে ইমাম মাহদী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও পয়গাম্বর ঈসা (আলাইহিস সালাম) যখন আসবেন, তখন পয়গাম্বর ঈসা (আলাইহিস সালাম) ইমাম মাহদী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইমামতিতে নামায পড়বেন। এতে তিনি কি ছোট হয়ে যাবেন না? এর উত্তর হলো, যিনি (দ.) হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইমামতি দিয়ে মনোনীত করেছিলেন, সেই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই ইমাম মাহদী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে রূহের জগতে কর্তৃত্বদান (অথরাইজ) করেছেন, আর তিনি তা হাদীস শরীফে ঘোষণা করেছেন। তাঁর হুকুমই আমাদের শিরোধার্য।


*সাহাবা (রা.)-বৃন্দের প্রতি মন্দ ধারণা রাখার বিষয়টি কবরের প্রশ্নোত্তরে প্রভাব ফেলবে কি-না?*

সম্প্রতি সুন্নী ঘরানা হতে উৎপন্ন জনৈক সুবক্তা আলেম বলেছেন যে কোনো সাহাবী (রা.)-এর ব্যাপারে কী ধারণা রাখা হয়েছিলো তা কবরে ফেরেশতাদের প্রশ্নোত্তরের সময় জিজ্ঞেস করা হবে না। তিনি আলোচ্য হাদীসটির কিয়দংশ উদ্ধৃত করেছেন মাত্র, কিন্তু আসল অংশ করেননি। সেটা আরো বিবৃত করে - “তোমার নবী কে?” এরই সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি রওয়ায়াতে এসেছে - مَا كُنْتَ تَقُولُ فِي هَذَا الرَّجُلِ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم؟ - অর্থ: “এই যে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সম্পর্কে তুমি কী বলতে” [বুখারী, ১৩৩৮]? ওই সময় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরে হাজির থাকবেন এবং তাঁকে দেখিয়েই ফেরেশতাবৃন্দ এই প্রশ্নটি করবেন। যে ব্যক্তি তাঁর সাহাবী (রা.)-এর প্রতি অপবাদ দিতো, গালমন্দ করতো, তার প্রতি যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসন্তষ্ট থাকবেন, তা তো বিভিন্ন হাদীসে তিনি ব্যক্ত করেই দিয়েছেন। ফলে কবরের সওয়াল-জওয়াব যে গালমন্দকারী ব্যক্তির পক্ষে যাবে না, তা তো সহজেই অনুমেয়। প্রশ্নোত্তর চলাকালীন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সন্তুষ্ট ও কোমল সুন্দর অবয়বে দেখতে পারার ওপরই পরীক্ষাদাতার সাফল্য নির্ভর করবে। যাদের মনে বক্রতা বিরাজমান, কোনো রকম আকীদাগত ত্রুটি বিদ্যমান, তারা তাঁকে সেই সন্তুষ্ট সুরতে দেখতে সক্ষম হবে না।


*হিজরতকালে শত্রুপরিবেষ্টিত গুহার ভেতরে হযরত আবূ বকর (রা.) নিজের জন্যে দুঃখ করেছিলেন কি?*

আফসোস, শিয়ালের দল যেমন বিভিন্ন দিক হতে ‘হুক্কা হুয়া’ রবে ডেকে উঠে, ঠিক তেমনি দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী সাহাবা (রা.)-বিদ্বেষী শিয়াচক্রও তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ফেইসবুকের বিভিন্ন কোণা থেকে আকস্মিক চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। অতি সম্প্রতি এরকম একটি পোষ্ট আমার নজরে পড়েছে, যেখানে হিজরতকালে শত্রুপরিবেষ্টিত গুহায় আশ্রয়গ্রহণকারী প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁরই সাহাবী হযরতে আবূ বকর সিদ্দীক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘটনা বর্ণনা করতে যেয়ে মূল লিপির বিকৃতি সাধন করা হয়েছে এবং তা দ্বারা হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে এ মর্মে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তিনি নাকি ওই সময় নিজের জন্যে দুঃখিত হয়েছিলেন। নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!
চলুন, আল-কুর’আনের মূল লিপিতে কী বলা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা যাক এবং তাফসীরকারের ভাষ্যও তুলে ধরা যাক। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন:

لاَ تَحْزَنْ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَا.

অর্থ: (যখন তাঁরা উভয়ই গুহার মধ্যে ছিলেন), যখন আপন সঙ্গীকে (নবী পাক) ফরমাচ্ছিলেন, ‘দুঃখিত হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। [আল-কুর’আন, ৯/৪০; নূরুল ইরফান]

হাকিমুল উম্মত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই আয়াতের তাফসীরে লেখেন:

“আমার জন্যে দুঃখ কোরো না (لاَ تَحْزَنْ)।” কেননা সিদ্দীক্বে আকবর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর মনে নিজের জন্যে দুঃখ ছিলো না। নিজেকে তো (গুহার ভেতরে) সাপ দিয়ে দংশন করিয়েছিলেন (যাতে নবী পাককে সেটা দংশন না করে)। হুযূরের (দ.) প্রতি উৎসর্গ হয়েছিলেন। যদি নিজের জন্যে দুঃখ থাকতো, তবে হুযূরকে (দ.) কাঁধের উপর উঠিয়ে এগারো মাইল অতিক্রম করে পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করতেন না। আর একাকী অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করতেন না। সাপ দ্বারা নিজেকে দংশন করাতেন না। তাঁর এ দুঃখও ইবাদত ছিলো। বস্তুতঃ তাঁকে হুযূরের (দ.) সান্ত্বনা দেওয়াও ইবাদত। সুতরাং মহান রব/প্রভু ওই দুই মহান ব্যক্তিত্বকে মাকড়সার জাল ও মাদী-কবুতরের ডিম দ্বারা রক্ষা করেছেন। [সূরাহ তওবাহ, ৪০ আয়াত, ১১৩ নং টীকা; নূরুল ইরফান]

এর সাথে আমি আরো যোগ করবো, মক্কার কুফফার প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্যে ১০০টি উট পুরস্কারস্বরূপ ঘোষণা করেছিলো। হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এই বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্যেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ, কোনো এক জিহাদে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তাঁবু রাতে পাহারা দেওয়ার কথা সাহাবা (রা.)-বৃন্দ আলোচনায় আনার সাথে সাথে অতি ক্ষিপ্রতা সহকারে হযরতে আবূ বকর সিদ্দীক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তরবারি হাতে উঠে দাঁড়ান এবং প্রহরাস্থলে অবস্থান নেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-মণ্ডলী তাঁর তেজস্বিতা ও সাহসিকতা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। এগুলো ইতিহাসের ঘটনা যা বিভিন্ন বইয়ে লিপিবদ্ধ রয়েছে। অতএব, কিছু গণ্ডমূর্খ লোকের ফেইসবুক পোষ্টে এ ব্যাপারে কুৎসা রটনা করা হলে সুন্নী মুসলমান সমাজ তাতে বিভ্রান্ত হবেন না।


*হযরত আবূ বকর (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব*

হযরত ইবনুল হানাফীয়্যা (রা.)-এর বর্ণনায় ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু.)-এর প্রদত্ত ভাষ্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে “প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে” খায়র (خَيْر) তথা সেরা (ব্যক্তিত্ব) হলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। [রেফারেন্স: ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ (হযরতে ইমামে আলী ইবনু আবি তালিবের পুত্র) থেকে বর্ণিত হয়েছে - (قلت لأبي أي الناس خير بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ قال: أبو بكر، قلت ثم من؟ قال: ثم عمر، وخشيت أن يقول عثمان، قلت ثم أنت؟ قال: ما أنا إلا رجل من المسلمين) رواه البخاري 3671 - “আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পর মানুষের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? তিনি উত্তরে বললেন, 'আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)।' আমি প্রশ্ন করলাম, 'তারপর কে?' তিনি জবাবে বললেন, 'তারপর 'উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)।' আমি ভয় পেয়েছিলাম যে তিনি 'উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে আপনি কী?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি মুসলমানদের মধ্যে একজন মাত্র’। আল-বুখারী, ৩৬৭১]

‘খায়র’ শব্দটি ব্যাখ্যা করা দরকার। কেননা মহাভ্রান্ত শিয়াচক্র এর ব্যাপক অর্থকে ধামাচাপা দিয়ে দাবি করে থাকে যে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ‘খায়র’ শব্দটি ব্যবহার করে স্রেফ উত্তম বুঝিয়েছেন, কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বকে উদ্দেশ্য করেন নি। বস্তুতঃ এটা তাদের অপব্যাখ্যা ও খণ্ডিত চিত্র প্রদর্শন ছাড়া কিছু নয়। এর দলিল হচ্ছে হযরত হুযায়ফাহ ইবনে ইয়ামান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীস - قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا كُنَّا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللَّهُ بِهَذَا الْخَيْرِ - “আমি (মানে হুযায়ফাহ) বল্লাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), নিশ্চয় আমরা ছিলাম অজ্ঞতা ও মন্দের (তথা অকল্যাণের) মধ্যে (নিমজ্জিত), অতঃপর আল্লাহতায়ালা আমাদের এনে দিয়েছেন এই খায়র/কল্যাণ তথা দ্বীন-ইসলাম (জ্ঞান যা অজ্ঞতা ও মন্দের বিপরীত)” [মুসলিম শরীফ, ৪৬৭৯]। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেন - مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِخَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ - “আল্লাহ্ যার খায়র/কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন” [বুখারী শরীফ, ৭৩১২]। এখানে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে খায়র ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্যকৃত।
সারবস্তু হলো, এই খায়র-বরকত প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে সর্বোচ্চ পরিমাণে হযরতে আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ই ধারণ করেন! এ তো স্বয়ং ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর ভাষ্য! দুঃখিত শিয়াচক্র, তাঁর কথা না মানাটা তাঁরই প্রতি স্রেফ বেয়াদবি ছাড়া কিছু নয়। আমরা সুন্নীরা এখানে লাচার। ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর এই কথাই আমাদের শিরোধার্য! তিনি তাঁর কথা না মানলে (ভীতিকর) প্রহারের হুমকিও দিয়েছেন একটি বর্ণনায়! অতএব, (আখেরাতে) তাঁর উত্তম-মধ্যমের জন্যে তৈরি থেকো, ওহে শিয়া গোষ্ঠী!


[বি.দ্র. বেশির ভাগ তরীকতের সিলসিলাহ হযরতে ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে এসেছে বলে তাঁকে শিয়াচক্র শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে চায়। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পছন্দকে তারা অবজ্ঞা করে চলেছে। সাহাবীয়্যত যে বেলায়াতের সর্বোচ্চ স্তর, এ কথা তারা বিস্মৃত হয়। যদি তাই না হবে, তবে গাউছে পাক বড়পীর সাহেব কেবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি কেন হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মোকাবিলায় নিজেকে এতো ক্ষুদ্র বিবেচনা করলেন? অতএব, তরীকতের কথা বলার সময় আদব বজায় রাখুন! ফেইসবুকে ইদানীং কতোগুলো এজেন্ডাওয়ালা বেয়াদবের আনাগোনা দেখতে পাচ্ছি।]

Monday 21 November 2022

জওয়া‘হিরুল কুর’আন

 মূল: হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্বালী (রহ.)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[ইংরেজি অনুবাদক মুহাম্মদ আবূল ক্বা’সেম কর্তৃক ভূমিকা ও টীকা-টিপ্পনীসহ]


বঙ্গানুবাদকের আরয


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

নাহমাদু ওয়া নসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম

আম্মা বা’দ।


হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহ)-এর লেখনীর প্রতি আমার তরুণ বয়সকাল থেকেই ঝোঁক ছিলো। সেই ১৯৭৬ সালে তাঁর লেখা ‘মিনহাজুল আবেদীন,’ ‘কিমিয়ায়ে সা’আদত’ ও ‘এহইয়াও উলূমিদ্দীন’ পড়ার সুযোগ হয়েছিলো। পরবর্তীকালে ‘মুকাশাফাতুল ক্বুলূব’ ও ‘এক্বতেসা’দ ফীল-এ’তেক্বাদ’ বইগুলো পড়েছি। কিন্তু তাঁর ‘জওয়াহিরুল ক্বুর’আন’ বইটিতে ক্বুর’আন মজীদের মাঝে লুকোনো রত্নভাণ্ডার নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এ বই সম্পর্কে আমার পীর ও মুর্শীদ সৈয়দ মওলানা শাহ সূফী এ,জেড,এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) আমার মামা জনাব নাঈমুল আহসানকে বলেছিলেন, যদিও আমাকে সরাসরি বলেননি। অতঃপর শাইখ (রহ.)-এর বেসালপ্রাপ্তির ১১ বছর পরে এ বইটির ইংরেজি সংস্করণ নাঈমুল আহসান মামা মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করেন এবং আমাকে হস্তান্তর করেন। আমি এর আরবী সংস্করণও অনলাইন থেকে ডাউনলোড করেছি। এই দুটো সংস্করণের সমন্বয়ে অনুবাদ করার আশা রাখি, ইন-শা-আল্লাহ। আল্লাহ পাক আমার মুর্শীদ কেবলা (রহ.)-এর অসীলায় এ বইটি অনুবাদ করার তৌফিক আমায় মঞ্জুর করুন, আমীন। [বি.দ্র. বইটির সর্বশেষ ইংরেজি সংস্করণ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালের প্রথম সংস্করণটিও অনলাইন থেকে ডাউনলোড করা হয়েছে। হযরত ইমাম (রহ.)-এর ‘এক্বতেসা’দ ফীল-এ’তেক্বাদ’ বইটির বঙ্গানুবাদও এর পাশাপাশি অব্যাহত রাখার আশা আমি রাখি, মওলার মর্জি।]


আল্লাহতায়ালার পবিত্র বাণী:


إِنَّ هَـٰذَا ٱلْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱلَّذِينَ يَعْمَلُونَ ٱلصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْراً كَبِيراً، وأَنَّ ٱلَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِٱلآخِرَةِ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَاباً أَلِيماً.


 অর্থ: নিশ্চয় এ ক্বুর’আন ওই পথ দেখায়, যা সর্বাপেক্ষা সোজা এবং সুসংবাদ দেয় ওই ঈমানদারদেরকে, যারা সৎকর্ম করে - ‘তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার।’ এবং এই যে, যেসব লোক আখিরাতের ওপর ঈমান আনে না, আমি তাদের জন্য বেদনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। [সূরা বনী ইসরাঈল, ৯-১০ নং আয়াত, নূরূল ইরফান] 


সূচিপত্র:


(ক) ইংরেজি অনুবাদকের ভূমিকা;

(খ) পুস্তকের বিস্তারিত বিষয়বস্তু;


প্রথম খণ্ড: পরিচায়ক বিষয়াদি

  

১/ আল-ক্বুর’আন: জহরত-রত্নভাণ্ডারের এক মহাসাগর;

২/ ক্বুর’আনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মূল্যবান হীরে-জহরত;

৩/ ক্বুর’আনের ৬টি লক্ষ্যের একটি ব্যাখ্যা;

৪/ ক্বুর’আন-শাস্ত্রের বিভাগসমূহ;

৫/ ক্বুর’আন হতে প্রাচীন ও আধুনিক বিদ্যাশাস্ত্র;

৬/ ক্বুর’আন সম্পর্কে রূপকবর্ণনার ব্যাখ্যা;

৭/ দৃশ্যমান জগতের মাধ্যমে অদৃশ্য জগৎ;

৮/ অদৃশ্য ও দৃশ্যমান জগতের মধ্যকার সংযোগ;

৯/ ক্বুর’আন বর্ণনায় রূপকের অর্থ;

১০/ ক্বুর’আন মজীদে রূপক প্রয়োগের ফায়দা;

১১/ ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর মাহাত্ম্য-শ্রেষ্ঠত্বে ভিন্নতা;

১২/ সূরাহ ফাতিহার গোপন রহস্যাবলী;

১৩/ সূরাহ ফাতিহা: বেহেশতের দরজাগুলোর চাবিকাঠি;

১৪/ আয়াতুল কুরসী;

১৫/ সূরাহ ইখলাস: ক্বুর’আনের এক-তৃতীয়াংশ;

১৬/ সূরাহ ইয়া-সীন: ক্বুর’আন মজীদের হৃৎপিণ্ড;

১৭/ আয়াতুল কুরসী ও সূরাতুল ফাতিহার গুণগত বৈশিষ্ট্য;

১৮/ (সূফী) আ‘রেফীনের হালত-অবস্থা;

১৯/ ক্বুর’আনের জহরত ও মণি-মুক্তার মালা গাঁথন;


দ্বিতীয় খণ্ড: লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য 


১/ ক্বুর’আনের হীরে-জহরত;

২/ ক্বুর’আনের মণি-মুক্তা;


আয়াতগুলোর দুইটি শ্রেণিবিষয়ক উপসংহার।      


ইংরেজি অনুবাদকের ভূমিকা


وَنُنَزِّلُ مِنَ ٱلْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَزِيدُ ٱلظَّالِمِينَ إَلاَّ خَسَاراً.


অর্থ: এবং আমি ক্বুর’আনের মধ্যে অবতীর্ণ করি ওই বস্তু, যা ঈমানদারদের জন্য আরোগ্য ও রহমত; এবং এ থেকে যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়। [আল-ক্বুর’আন, ১৭/৮২; নূরুল ইরফান]


ইসলাম ধর্মের পবিত্র ঐশীগ্রন্থ আল-ক্বুর’আন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি তাঁরই (প্রকাশ্য) জীবনের আনুমানিক ২৩ বছর (৬১০-৬৩২ খ্রীষ্টাব্দ) যাবৎ মক্কা ও মদীনায় ওহী-বাহক ফেরেশতা জিবরীল আমিন (আলাইহিস্ সালাম)-এর মাধ্যমে নাযিল হয়। নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় দানকারী সত্তর কোটি মানুষ এটাকে আল্লাহতায়ালার চূড়ান্ত ঐশীগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন, যা মানব ও জ্বিন - এই দুটো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জাতির প্রতি ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে অর্পণ করে অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলমানবৃন্দ কেবল নিজেদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে হেদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে আল-ক্বুর’আন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন করেন না, বরং অন্যান্য উদ্দেশ্যেও তেলাওয়াত করেন; যেমন - আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব লাভের আশায় এবং এই ঐশী বাণী উচ্চারণ দ্বারা আগত বরকত-প্রাপ্তির লক্ষ্যে। এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ক্বুর’আন তেলাওয়াত করা হয় বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন উপলক্ষে; যথা - সকাল, সন্ধ্যা, প্রতি ওয়াক্ত নামাযশেষে, খুতবা ও ওয়াযের প্রারম্ভে, অনুষ্ঠানাদিতে এবং পবিত্র মাহফিলে। অতএব, ক্বুর’আন মজীদ বাস্তবিকই কোনো মুসলমানের জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি বিষয়। অনেক অমুসলমান ব্যক্তিও ক্বুর’আন মজীদের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন এবং এটাকে একটা মহান ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন; তবে অন্য ধর্মের শাস্ত্রলিপির প্রতি তাঁদের এই আগ্রহের কারণগুলো নিশ্চিতভাবে মুসলমানদের (কারণগুলোর) অনুরূপ নয়।


আল-ক্বুর’আন সম্পূর্ণরূপে ঐশী একটি গ্রন্থ, কিন্তু এর উপলব্ধি পুরোপুরি মানবসংশ্লিষ্ট; এই মন্তব্যটি বরেণ্য মুসলমান আলেম-উলামা অহরহ উচ্চারণ করে থাকেন। ক্বুর’আন মজীদের উপলব্ধি কেবল এর আয়াতগুলোর অর্থ ও তাৎপর্যের সাথে জড়িত নয়, বরং সামগ্রিকভাবে এর ব্যাপক আকৃতির জটিল বিষয়াদির সাথেও সংশ্লিষ্ট। উলামাবৃন্দ কখনো কখনো আল-ক্বুর’আনের কিছু বিষয়ের উপলব্ধি নিয়ে পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেন। অমুসলমান ব্যক্তিবৃন্দ মুসলমানদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন মূলতঃ এ শাস্ত্রলিপির নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে; যেমন - এর কর্তৃত্ব, উৎস, এবং মানবের মাঝে এর আবেদনের প্রকৃতি এ মর্মে যে, এর এ আবেদন সর্বজনীন না মনুষ্যকুলের বিশেষ কোনো অংশের মাঝে সীমাবদ্ধ; আর তাঁরা মুসলমানদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন মূলতঃ যেহেতু তাঁদের ধর্ম ও আদর্শগত বিশ্বাস আলাদা। মুসলমান আলেম-উলামার নিজেদের মাঝেও বেশ কিছু ধরনের আয়াতের অর্থ ও (সেগুলোর) প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে মতপার্থক্য হয়েছে; আর আল-ক্বুর’আনের নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক জটিল বিষয়ের উপলব্ধির ক্ষেত্রেও ভিন্নমত দেখা দিয়েছে; যথা - ক্বুর’আন ক্বাদিম/চিরন্তন, না মাখলুক্ব/সৃষ্ট, আর এতদসংক্রান্ত বিষয় উপলব্ধির পদ্ধতিসমূহ। ফলশ্রুতিতে সুন্নী, শিয়া, মো’তাযেলা, আশ’আরী, আক্ষরিক/বাহ্যিক অর্থ গ্রহণকারী গোষ্ঠী, সূফী, দার্শনিক এবং আধুনিকতাবাদী দল ও সম্প্রদায়গুলো আল-ক্বুর’আনের তাফসীর তথা ব্যাখ্যার বেলায় এবং কিছু ক্বুর’আনী জটিল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে সবসময় একমত হতে পারেন না। ক্বুর’আন মজীদ উপলব্ধির ক্ষেত্রে তাঁদের পারস্পরিক মতপার্থক্য অন্যান্য বিষয়গত মতপার্থক্য হতেই উদ্ভূত হয়েছে।


নেতৃস্থানীয় মুসলমান চিন্তাবিদদের অন্যতম, যিনি প্রধানত আঁকড়ে ধরেছেন সুন্নী মতাদর্শ, আশ’আরী আকীদা-বিশ্বাসগত মাযহাব ও সূফীমণ্ডলীকে এবং যিনি শিয়া, মো’তাযেলী, আক্ষরিক/বাহ্যিক অর্থগ্রহণকারী ও তাঁর সমসাময়িক দার্শনিকদের তত্ত্বের অংশবিশেষের ঘোর বিরোধী ছিলেন, তিনি হলেন ইমাম আবূ হামিদ আল-গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহি - বেসাল: ৫০৫ হিজরী/১১১১ খ্রীষ্টাব্দ)। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে তাঁকে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তি বলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে কখনো কখনো প্রশংসা করা হয়েছে; আর এ উচ্চমর্যাদার অযোগ্য তিনি কোনোক্রমেই নন। মুসলমান সমাজ তাঁকে হুজ্জাতুল ইসলাম (ইসলামের প্রমাণ) ও যাইনউদ্দীন (ধর্মের অলঙ্কার) উপাধিগুলো দ্বারা বিভূষিত করেছেন। তাঁর কৃতিত্ব প্রসারিত হয়েছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ইসলামী ফিক্বহ (ধর্মীয় বিধানশাস্ত্র), ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, তাসাউফ/সূফীতত্ত্ব ও ক্বুর’আন-শাস্ত্র/তাফসীর। পরিণত বয়সে তিনি যখন ইতোমধ্যেই এসব ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রের ওপরে অসংখ্য বইপত্র রচনা করেছিলেন এবং যখন ইতোমধ্যেই সূফী পথ পাড়ি দেয়া সুসম্পন্ন করেছিলেন, আর ইতোমধ্যেই বৃদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন, তখন ‘জওয়াহিরুল কুর’আন’ শীর্ষক একখানা গ্রন্থ প্রণয়নের মাধ্যমে কুর’আন সম্পর্কে তাঁর আপন উপলব্ধি তিনি ব্যক্ত করেছেন। এই বইটিরই ইংরেজি ভাষান্তর করে The Jewels of the Qur’an শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, যা এখানে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে পেশ করা হবে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: আমরা মূল আরবী সংস্করণের সমন্বয়ে এটা বাংলায় ভাষান্তর করবো, ইন-শা-আল্লাহ।]


আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-ক্বুর’আন সম্পর্কে ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহ)-এর নিজস্ব মতামতের ব্যাপারে আমরা যতোটুকু জানি তারই অধিকাংশের উৎস (source) হচ্ছে এই বইটি। এটা অবশ্যই তাফসীর শব্দটির সাধারণ ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে ক্বুর’আন মজীদের কোনো তাফসীরগ্রন্থ নয়, যদিও এটা বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু সূরাহ ও আয়াতের প্রসঙ্গে মন্তব্য ব্যক্ত করেছে। এতে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে ক্বুর’আন মজীদের কিছু মৌলিক জটিল প্রশ্নের ব্যাপারে ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহ)-এর আপন উপলব্ধি। মুসলিম ও অমুসলিম উভয় শিক্ষার্থীদের মাঝে ঐশী শাস্ত্রলিপিগত এসব প্রশ্ন সম্পর্কে একই কৌতূহল বিদ্যমান। এ বই জুড়ে রয়েছে একটি তাকিদ - জোর তাকিদ, যা লেখকের বিবেচনায় পবিত্র গ্রন্থের সমঝদারিতে গৃহীত সঠিক পদ্ধতির প্রয়োগসংশ্লিষ্ট; অর্থাৎ, ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর স্রেফ প্রকাশ্য/বাহ্যিক অর্থের প্রতি সন্তুষ্ট না থেকে এর অন্তঃস্থ, গোপন অর্থের গভীরে প্রবেশ করা, ঠিক যেমনটি কোনো ডুবুরি অতল মহাসাগরে লুকোনো মণি-মুক্তা ও রত্নভাণ্ডার তুলে বের করে আনার জন্য ডুব দেন। আল-ক্বুর’আনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (মাক্বা’সিদ) সম্পর্কে একটি অত্যন্ত স্পষ্ট ও পূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব এই পুস্তকে প্রদান করা হয়েছে; এই তত্ত্বকে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করা হয়েছে এবং ইমাম সৈয়ূতী (রহমতুল্লাহি আলাইহ - বেসাল: ৯১১ হিজরী) ও পরবর্তীকালের অন্যান্য ক্বুর’আন তাফসীরকারক উলামাবৃন্দ ঘনঘন এটাকে উদ্ধৃত করেছেন। এই তত্ত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত আছে আরেকটি তত্ত্ব, যা’তে ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহ) প্রদর্শন করেছেন যে বিভিন্ন ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রের শাখা আল-ক্বুর’আনের মূলকাণ্ড থেকে প্রসারিত হয়েছে; সব ধরনের ইসলামী জ্ঞানের শাখার একমাত্র উৎস আল-ক্বুর’আন মর্মে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন এটা। কতিপয় সূরাহ যে অন্যান্য সূরাহ’র চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ, সে সম্পর্কে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীর সত্যতা প্রকাশেরও প্রয়াস এই বইটি। যেমন তাঁর (দ.) বাণী - “সূরা ইয়াসিন ক্বুর’আনের অন্তর;” “আয়াতুল কুরসী হচ্ছে ক্বুর’আনের সকল আয়াতের প্রধান;” “সূরাহ ইখলাস গোটা আল-ক্বুর’আনের ফযীলতের এক-তৃতীয়াংশের সমান;” “সূরাহ ফাতিহা বেহেশতের দরজাসমূহের চাবিকাঠি” ইত্যাদি। বইয়ের দ্বিতীয়াংশ আমাদের সামনে পেশ করেছে সকল ‘হীরে-জহরত’ আয়াত ও ‘মণি-মুক্তা’ আয়াত, যেগুলো পবিত্র গ্রন্থের ছয়টি মূলনীতির মধ্যে দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি নিয়ে ব্যাপৃত। অন্যান্য আয়াত যেগুলো অবশিষ্ট ক্বুর’আনী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপৃত, সেগুলো হতে এসব আয়াতের পৃথকীকরণ ক্বুর’আন-তাফসীরশাস্ত্রের ইতিহাসে পূর্ব-নজিরবিহীন এবং এটাকে (তাই) ক্বুর’আন অধ্যয়ন ও গবেষণায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান হিসেবে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। এই বইতে এসব মূল প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে। এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ছোটখাটো অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের প্রতিও আলোকপাত করা হয়েছে, যার একটি হলো দৃশ্যমান জগতের সাথে অদৃশ্য জগতের (পারস্পরিক) সম্পর্ক; এই সম্পর্কটি গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর সুপরিচিত আকৃতিতত্ত্বের স্মৃতিবহ - যার কারণে ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহ)-এর শিক্ষার (অধ্যয়নকারী) শিষ্যবৃন্দ কখনো কখনো তাঁর ওপরে প্লেটোর প্রভাব পড়েছে মর্মে চিন্তায় জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখান।


এই বইয়ের প্রথম খণ্ড অধিকাংশই রূপক বর্ণনা; আল-ক্বুর’আনের সুউচ্চ ও মহৎ প্রকৃতির প্রকাশ তথা প্রদর্শন সহজ করার জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োগকৃত মুখ্য রূপকগুলোর অন্তর্নিহিত সত্য সম্পর্কে এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং কখনো কখনো পৃথক অনুচ্ছেদ এ কাজে উৎসর্গিত হয়েছে; তথাপিও এখানে-সেখানে অ-ব্যাখ্যাকৃত রূপক খুঁজে পাওয়া যাবে, যা সেগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে পাঠকের নিজস্ব প্রয়াস দাবি করেছে। বইটির বর্ণনা গুরুগম্ভীর, সুগভীর, অন্তর্ভেদী ও সর্বোপরি এতোখানি যৌক্তিক যে একটি অধ্যায় অপরটিকে আপনাআপনি ও স্বচ্ছন্দে অনুসরণ করে থাকে। বিষয়বস্তুর এই যৌক্তিক বিন্যাস ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহ)-এর স্বভাবসিদ্ধ রচনাপদ্ধতির সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।


যেহেতু বইয়ের এ ইংরেজি সংস্করণ মূল আরবীগ্রন্থের অনুবাদ, সেহেতু এ কাজে প্রয়োগকৃত পদ্ধতিগুলোর উল্লেখ প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। এটা মূলের আক্ষরিক কোনো অনুবাদ নয়, বরং সহজ আধুনিক ইংরেজিতে মূল আরবীগ্রন্থের অর্থের উপস্থাপন মাত্র। তবে এই অর্থ উপস্থাপনের সময় মূলের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো কখনো অর্থ স্পষ্ট (তথা ব্যাখ্যা) করার জন্য বিবরণ যুক্ত করা হয়েছে এবং এগুলোকে স্কোয়ের ব্র্যাকেটের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে। মূল আরবী বইয়ের কোনো অভিব্যক্তি যেখানে এর পাঠের প্রবাহে বিঘ্ন ঘটানোর সম্ভাবনাময়, সেখানে ওই অভিব্যক্তিকে গোল ব্র্যাকেটের ভেতরে রাখা হয়েছে। সকল পাদটীকা ইংরেজি অনুবাদক কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে, যাতে কখনো কখনো বুঝতে কঠিন তত্ত্ব, বাক্য ও শব্দগুলোকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, আবার কখনো কখনো পাঠকদের সামনে প্রাসঙ্গিক তথ্যও দেয়া যায়। ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর ক্রমিক নম্বরগুলো এই বইতে লিপিবদ্ধ করার সময় আল-ক্বুর’আনের মিসরীয় সংস্করণকে অনুসরণ করা হয়েছে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এতে ব্যবহৃত বাংলা ক্বুর’আনের সংস্করণ হলো মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন (রহ.)-এর রচিত ‘নূরুল ইরফান’]


মুহাম্মদ আবূল কাসেম

বি,এ, স্নাতক, এম,এ, ও পিএইচডি (এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়), কামিল (DAC)

সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ, ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি অফ মালয়েশিয়া।


’জওয়াহিরুল ক্বুুর’আন’ 

(গ্রন্থের বিস্তারিত সূচি)


بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ.


আল্লাহর নামে আরম্ভ যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।


الحمد لله رب العالمين، وصلاته وسلامه على نبيه محمدٍ وآله وأصحابه أجمعين [وبعد]:


সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি জগতসমূহের প্রভু। তাঁর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁরই নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি এবং রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আ’ল/পরিবারসদস্যবৃন্দের ও আসহাব/সাথী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীর প্রতিও। আম্মা বা’আদ।


এই ফস্বল বা অনুচ্ছেদে রয়েছে আমাদের ‘জওয়াহিরুল ক্বুর’আন’ শিরোনামের বইটির বিস্তারিত সূচিপত্র। 


إعلم هداك الله، أنَّا رتَّبنا هذا الكتاب على ثلاثة أقسام:


জেনে রাখুন - আল্লাহ আপনাকে হেদায়াত দান করুন - এই মর্মে যে, আমরা এ বইটিকে তিনটি বিভাগে বিন্যস্ত করেছি। 


١ ـ قسم في المقدمات والسوابق. ٢ ـ وقسم في المقاصد. ٣ ـ وقسم في اللواحق.


প্রথম ভাগ পরিচায়ক বিষয়াদি-সংক্রান্ত; দ্বিতীয়টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য; এবং তৃতীয়টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি।


প্রথম ভাগ যা পরিচায়ক বিষয়াদি-সংক্রান্ত তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ঊনিশটি অধ্যায়:


১/ - ক্বুর’আন মজীদ এক মহাসাগর [সদৃশ] যার গভীরে নিহিত বিভিন্ন ধরনের জহরত ও মহামূল্যবান (মুক্তার) রত্নভাণ্ডার। 

২/ - ক্বুর’আন মজীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও তার রত্নভাণ্ডারকে ছয়টি ভাগে সীমিতকরণ, যার তিনটি ভাগ গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা নিয়ে গঠিত এবং (অবশিষ্ট) তিনটি সেগুলোকে অনুসরণ করে আর সেগুলোকে পূর্ণতাও দেয়।

৩/ - ছয়টি ভাগের একের পর এক ব্যাখ্যাকরণ। সেগুলো (বিভিন্ন) শাখায় বিভক্ত হয়ে দশটি ভাগে পরিণত হয়।

৪/ - এই দশটি ভাগ হতে সকল বিদ্যাশাস্ত্রের (বিভিন্ন) শাখায় বিভক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া। ক্বুর’আন-শাস্ত্রীয় জ্ঞানকে বহিঃখোসা/খোলগত বিদ্যা এবং অন্তর্নিহিত জহরতের জ্ঞানে বিভক্তকরণ। উলূম তথা জ্ঞানের স্তর সম্পর্কে বয়ান/ব্যাখ্যা।

৫/ - ক্বুর’আন মজীদ হতে পূর্ববর্তীদের জ্ঞান ও পরবর্তীদের জ্ঞান (বিভিন্ন) শাখায় কীভাবে বিভক্ত হয় (তার ব্যাখ্যা)।         

৬/ - ক্বুর’আন মজীদে লাল গন্ধক/সালফার (الكبريت الأحمر), সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক, সুগন্ধি কস্তুরী এবং অন্যান্য সব রত্ন ও মুক্তার সমষ্টি মর্মে বিবৃতির অর্থ। এটা কেবল ওই ব্যক্তিরই জ্ঞাত যিনি দৃশ্যমান জগৎ (عَالَم الشَّهادة) ও অদৃশ্য জগৎ (عَالَم المَلكوت)-এর মধ্যকার সম্পর্ক জানেন।

(৭) - ক্বুর’আন মজীদে অদৃশ্য জগতের অস্তিত্বশীল সত্তা/বস্তুগুলোকে দৃশ্যমান জগৎ হতে গৃহীত উপমা দ্বারা সাব্যস্ত করার কারণসমূহ।

(৮) - দৃশ্যমান জগৎ ও অদৃশ্য জগতের মধ্যকার অস্তিত্বশীল সম্পর্কের ব্যাপারে উপলব্ধি।

(৯) -  লাল গন্ধক/সালফার (الكبريت الأحمر), সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক (الترياق الأكبر), সুগন্ধি কস্তুরী (المسك الأذفر), ঘৃতকুমারী কাঠ (العُود), চুনি ও নীলকান্তমণি (اليَواقيت), মুক্তা (الدُرر) ইত্যাদির অন্তর্নিহিত রূপকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।

(১০) - এসব রূপক (الرموز) প্রয়োগের ফায়দা।

(১১) - গোটা ক্বুর’আন মজীদ আল্লাহর বাণী হওয়া সত্ত্বেও কিছু আয়াত কীভাবে অন্যান্য আয়াতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ (তার ব্যাখ্যা)।

(১২) - সূরা ফাতিহার (الفاتحة) গোপন রহস্যসমূহ এবং কীভাবে এটা আল-ক্বুর’আনের দশ ধরনের মহামূল্যবান রত্নের মধ্যে আট কিসিম ধারণ করেছে (তার ব্যাখ্যা)। সৃষ্ট জীব-জগতের প্রকৃতির সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে ’পরম দয়ালু’ (الرحمٰن), ‘চির করুণাময়’ (الرحيم)-এর অর্থের অংশবিশেষের বিবরণ। [নোট: সূরাহ ফাতিহা হচ্ছে ক্বুর’আনের প্রথম সূরাহ]

(১৩) - বেহেশতের আটটি দরজা সূরাহ ফাতিহা দ্বারা খোলা হয় এবং এ সূরাহ সবগুলো দরজারই চাবিকাঠি।

(১৪) - কেন ‘আয়াতুল কুরসী’ (ক্বুর’আন, ২/২৫৫)-কে ক্বুর’আন মজীদের সমস্ত আয়াতের সাইয়্যেদ তথা সরদার বিবেচনা করা হয় এবং কেন এটা ‘আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেছেন’ (৩/১৮ - شَهِدَ ٱللهُ), ‘আপনি বলুন, তিনি আল্লাহ, তিনি এক’ (১১২/১ - قُلْ هُوَ ٱللهُ أَحَدٌ), ‘সূরাহ হাদীদের সূচনা’ (৫৭/১-৬, أول الحديد), সূরাহ হাশরের শেষাংশ (৫৯/২২-২৪, آخير الحشر) এবং অন্যান্য সকল আয়াতের চেয়ে আশরাফ/অধিক মর্যাদাপূর্ণ (তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ)।

১৫/ - সূরা ইখলা’স (আল-ক্বুর’আন, ১১২)-এর (মূল্যমান) কেন ক্বুর’আন মজীদের এক-তৃতীয়াংশের সমান, তার একটি তাহকীক/গভীর মূল্যায়ন।

১৬/ - কেন সূরাহ ইয়াসিন (ক্বুর’আন, ৩৬)-কে ক্বুর’আন মজীদের ক্বলব/অন্তর বিবেচনা করা হয়।                  

১৭/ - কেন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরাহ ফাতিহা’কে ক্বুর’আনের সেরা (আফযাল) সূরাহ এবং কেন আয়াতুল কুরসীকে ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর সাইয়্যেদ/সরদার বলেছেন, আর কেনই বা এটা (মানে বিন্যাস) এর বিপরীতের চেয়ে শ্রেয়তর (তার ব্যাখ্যা)।

১৮/ - আরেফীন (العَارفين) তথা খোদা সম্পর্কে জ্ঞানী সূফী-দরবেশবৃন্দের হালত-অবস্থা; এই দুনিয়ায় তাঁরা আছেন “এমন বেহেশতে যার প্রশস্ততায় সমস্ত আসমান ও জমিন এসে যায়” [আল-ক্বুর’আন, ৩/১৩৩]; তাঁদের বর্তমান জান্নাতের “ফলের গুচ্ছ ঝুঁকে পড়েছে (সংগ্রহের জন্য)” [ক্বুর’আন, ৬৯/২৩]; আর এগুলো “না নিঃশেষ হবে, না নিষিদ্ধ করা হবে” [ক্বুর’আন, ৫৬/৩২-৩৩]।

১৯/ - ক্বুর’আন মজীদের হীরে-জহরতকে এক মালায় গাঁথার এবং মণি-মুক্তাকে অপর মালায় গাঁথার গোপন কারণ।


উপরোল্লিখিত এই ১৯টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত হয়েছে বইয়ের প্রথম খণ্ড।


দ্বিতীয় খণ্ড লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপৃত এবং এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ক্বুর’আন মজীদের আয়াতসমূহের সারাংশ, যা দুই কিসিমের: প্রথম ধরন হলো হীরে-জহরত (الجواهر) আয়াতগুলো, যেগুলো বিশেষ করে অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহতায়ালার যাত/সত্তা মোবারক সম্পর্কে; আর তাঁর খাস্ তথা সুনির্দিষ্ট সিফাত/গুণগত বৈশিষ্ট্য ও আফ’আল/ক্রিয়াসমূহ সম্পর্কেও। এটা জ্ঞান-সম্বন্ধীয় কিসিম (القسم العلميّ)। দ্বিতীয় কিসিমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মণি-মুক্তা (الدُّرَرُ) আয়াতগুলো, যেগুলো ‘সিরা’তুল মুসতাকীম’ (الصراط المستقيم) তথা সোজা পথের বিবরণসম্বলিত এবং যেগুলোতে মানুষকে উক্ত পথের ওপরে চলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা অনুশীলনের কিসিম (القسم العملي)।


আল-ক্বুর’আনের আয়াতগুলো কেন এই পুরো যোগফলে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে একটি অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। [অনুবাদকের নোট: এখানে মূল আরবী সংস্করণের ৩৪টি লাইন অনুবাদ করা হয়নি, কেননা এগুলোতে ‘জওয়াহিরুল ক্বুর’আন’ গ্রন্থের সূচি সম্পর্কে বর্ণনা নেই, বরং ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহ)-এর রচিত ‘কিতাবুল আরবাঈন ফী উসূলিদ্-দীন’ পুস্তকের সূচিপত্র দেয়া হয়েছে]


প্রথম খণ্ড: পরিচায়ক বিষয়াদি


[এই খণ্ডে আল-ক্বুর’আনের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু জটিল বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে রয়েছে ঊনিশটি অধ্যায়, যেগুলোর কয়েকটি একদিকে গোটা ক্বুর’আন মজীদের জটিল বিষয়াদি নিয়ে ব্যাপৃত, অপর দিকে কয়েকটি অধ্যায় এর সুনির্দিষ্ট কিছু অংশের ব্যাখ্যাও করেছে। ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কর্তৃক এসব অধ্যায় এমন যৌক্তিক ও ধারাক্রমে সাজানো হয়েছে যে একটি অধ্যায় পাঠককে আপনাআপনি ও স্বচ্ছন্দে অপর অধ্যায়ের দিকে পরিচালিত করে]


بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ.


الفصل الأول في أن القرآن هو البحر المحيط وينطوي على أصناف الجواهر والنفائس


প্রথম অধ্যায়: ক্বুর’আন মজীদ এক মহাসাগর [সদৃশ] যার গভীরে নিহিত বিভিন্ন ধরনের জহরত ও মহামূল্যবান (মুক্তার) রত্নভাণ্ডার


[অনুবাদকের নোট - أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ ٱلْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَآ - “তবে কি তারা ক্বুর’আন সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করে না (এর গভীর অর্থ উপলব্ধির উদ্দেশ্যে)? নাকি কোনো কোনো অন্তরের উপর সেগুলোর তালা লেগেছে?” (তাফসীর নূরুল ইরফান, ৪৭/২৪)]


أما بعد حمد الله الذي هو فاتحة كل كتاب، والصلاة على رسله التي هي خاتمة كل خطاب.


মহান আল্লাহর পবিত্র নাম উল্লেখের পরে আমি তাঁর প্রশংসা করি, যা দ্বারা প্রতিটি পুস্তকের সূচনা হওয়া উচিত। তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষিত হোক তাঁরই রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের প্রতি, যা (দুআ’ হিসেবে) প্রতিটি খুতবা/বক্তৃতার সমাপ্তি ঘোষণা করা উচিত।


অতঃপর আমি আপনাকে আপনার ঘুম থেকে জাগ্রত করতে ইচ্ছুক। ওহে ক্বুর’আন মজীদের গভীর পর্যায়ের তেলাওয়াতকারী, যিনি এর অধ্যয়নকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, এবং যিনি আত্মভূত/আত্মস্থ করেছেন এর কিছু বাহ্যিক অর্থ ও (আক্ষরিক) বাক্য [অনুবাদকের নোট: ইমাম গাজ্বালী (রহ.) এই অধ্যায়ে মানুষকে বলছেন পুরোপুরিভাবে তেলাওয়াতে নিজেকে একান্ত-নিয়োজিত না হতে, আবার পাশাপাশি বলছেন এর বাহ্যিক অর্থের উপলব্ধি নিয়েও তুষ্ট না থাকতে; বরং তিনি চাইছেন মানুষ যেনো ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালান ক্বূর’আনী আয়াতগুলোর মাঝে লুকোনো গভীর অর্থগুলো জানার ক্ষেত্রে। ক্বুর’আন হলো একটি মহাসাগরের মতো। মহাসাগরের তলদেশে যেমন মুক্তা লুকোনো থাকে, তেমনি ক্বুর’আনের আয়াতগুলোর আড়ালেও লুকোনো রয়েছে বিস্ময়কর সব অর্থ। এসব অর্থ জানা প্রত্যেক মুসলমানেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তিনি ব্যর্থ হলে নিজ কর্ম ও আচরণের জন্য তাঁর লজ্জা করা উচিত]। ক্বুর’আনী অর্থের অত্যাশ্চর্যসমূহের প্রতি চোখ বন্ধ রেখে আপনি কতোকাল আর সাগর-সৈকতে ঘুরোঘুরি করবেন? এটা কি আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিলো না এসব (ক্বুর’আনী) অর্থের অতল মহাসাগরের মাঝখানে জলযাত্রা করা, যাতে এগুলোর অত্যাশ্চর্য (বিষয়াদি) প্রত্যক্ষ করা যায়; যাতে এ মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করে সেগুলোর সেরা ফসল (ঘরে) তোলা যায়; যাতে এ মহাসাগরের গভীরে ডুব দিয়ে রত্নভাণ্ডার অর্জনের দ্বারা ধনী হওয়া যায়? আপনি কি সাগর-সৈকত ও বাহ্যিক আকারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা অবস্থান নিয়ে এসব মণি-মুক্তা ও হীরে-জহরত হতে বঞ্চিত হওয়ার জন্য লজ্জা বোধ করছেন না?


আপনি কি জানেন না যে আল-ক্বুর’আন মহাসাগরসদৃশ এবং এই ক্বুর’আন মজীদ হতেই পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের বিভিন্ন বিদ্যাশাস্ত্র (علم الأولين والآخرين) শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়েছে, ঠিক যেমনটি সাগর-সৈকত হতে নদ-নদী শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে থাকে? [অনুবাদকের নোট: এখানে উলূমুল আউয়ালীন/পূর্ববর্তীদের জ্ঞান এবং উলূমুল আখেরীন/পরবর্তীদের জ্ঞান বলতে বুঝিয়েছে সকল ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রকে, যেগুলো ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে আরম্ভ করে ইমাম গাজ্বালী রহমতুল্লাহি আলাইহির সময়কাল পর্যন্ত অস্তিত্বশীল হয়েছিলো। এসব শাস্ত্র কীভাবে ক্বুর’আন হতে সকাণ্ড হয়েছে তা প্রদর্শিত হয়েছে এই পুস্তকের চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় দুটোতে। এতে ব্যবহৃত ‘উলূম’/বিদ্যাশাস্ত্র শব্দটি জ্ঞান, অধ্যয়ন অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক পাঠের বিষয়কে বুঝিয়েছে; এটা কলা বিভাগের বিপরীতে বিজ্ঞানকে বোঝায় নি। ‘আউয়ালীন’ ও ‘আখেরীন’ হাদীসশাস্ত্র থেকে নেয়া হয়েছে, যেখানে এগুলো অস্তিত্বশীল। দেখুন- ইবনে মাজাহ (রহ.) কৃত ‘সুনান,’ ‘ফিতান’ অধ্যায়, ২০]। আপনি কেন সেসব পুণ্যাত্মাকে অনুসরণ-অনুকরণ করে আশীর্বাদধন্য হচ্ছেন না, যাঁরা (ওই মহাসাগরের) ঢেউয়ের জলে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং ফলশ্রুতিতে লাল গন্ধক (الكبريت الأحمر) অর্জন করেছেন [নোট: এ ধরনের রূপকগুলো সূচিপত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে]; যাঁরা মহাসাগরের গভীরে ডুব দিয়ে লাল চুনি (الياقوت الأحمر), চকচকে মুক্তা (الدر الأزهر) এবং নীলাভ-সবুজ পান্না (الزبرجد الأخضر) আহরণ করেছেন; যাঁরা সাগর-সৈকতগুলো চষে বেড়িয়ে সংগ্রহ করেছেন ধূসর তৃণমণি (العنبر) ও তাজা প্রষ্ফুটিত হচ্ছে এমন ঘৃতকুমারী কাঠ (العُود الرطب الأنضر); যাঁরা মহাসাগরের দ্বীপগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ফলশ্রুতিতে সেগুলোর প্রাণিকুল থেকে আহরণ করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক (الترياق الأكبر) ও সুগন্ধি কস্তুরী (المسك الأذفر)? লক্ষ্য করুন, (ইসলামী) ভ্রাতৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য পূরণ করে এবং আল্লাহর দরবারে আপনার দুআ’র বরকত দ্বারা আমি এক্ষণে আপনাকে এরশাদ/পথপ্রদর্শন করতে চাই ওই সকল পুণ্যাত্মার যাত্রার দিকে, তাঁদের (সাগরে) ডুব ও সাঁতারের পন্থা/পদ্ধতির দিকে।


الفصل الثاني في حصر مقاصد القرآن ونفائسه


দ্বিতীয় অধ্যায়: ক্বুর’আনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং এর রত্নভাণ্ডার ছয় কিসিমের


আল-ক্বুর’আনের গোপন রহস্য, এর সারাংশ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে আহ্বান করা (সেই) আল্লাহতায়ালার দিকে, যিনি মহাপরাক্রমশালী এবং দুনিয়া ও আখেরাতের রব্ব/প্রভু (৫৩/২৫ - فَلِلَّهِ ٱلآخِرَةُ وٱلأُولَىٰ); যিনি আসমান ও (তার) নিচে জমিনের স্তরগুলোর এবং এ দু’য়ের (মানে আসমান ও জমিনের) মধ্যবর্তী যা কিছু আছে আর আর্দ্র মাটির নিচে যা কিছু আছে এসব কিছুর স্রষ্টা (২০/৬ - لَهُ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ ٱلثَّرَىٰ)। এই কারণে ক্বুর’আনী সূরাহ ও এর আয়াতগুলো ছয় কিসিমে বিভক্ত, যার পূর্ববর্তী তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উসূল তথা নীতিমালা, এবং পরবর্তী তিনটি কিসিম সেগুলোকে অনুসরণ করে, সমৃদ্ধ করে, আর সুসম্পন্নও করে।


أما الثلاثة المُهِمَّة فهي: (١) تعريف المدعو إليه. (٢) وتعريف الصراط المستقيم الذي تجب ملازمته في السلوك إليه. (٣) وتعريف الحال عند الوصول إليه.


অর্থ: পূর্ববর্তী তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে রয়েছে: (১) আল্লাহর (পরিচিতিমূলক) জ্ঞান, যাঁর প্রতি মানুষকে আহ্বান করা হয়; (২) সহজ-সঠিক পথ-সম্পর্কিত জ্ঞান, আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য যে পথের ওপরে থাকতে সাধনা/অধ্যবসায় প্রয়োজন; এবং (৩) আল্লাহকে পাওয়ার সময়ে হালত-অবস্থার জ্ঞান।


وأما الثلاثة المُُغْنِيَة المُتِمَّة: فأحدها تعريف أحوال المجيبين للدعوة ولطائف صنع الله فيهم؛ وسِرُّهُُ ومقصوده التشويق والترغيب، وتعريف أحوال الناكبين والناكلين عن الإجابة وكيفية قمع الله لهم وتنكيله لهم، وسِرُّهُ ومقصوده الاعتبار والترهيب.  


অর্থ: আর পরবর্তী যে তিনটি বিভাগ (পূর্ববর্তী) বিভাগগুলোকে সমৃদ্ধ ও সুসম্পন্ন করে, সেগুলোর একটি বর্ণনা করে সে সকল পুণ্যাত্মার আহওয়াল তথা হালত-অবস্থা যাঁরা আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেন; আর এটা এও বর্ণনা করে আল্লাহ কর্তৃক তাঁদের প্রতি কোমল ব্যবহার (সম্পর্কে), যার অন্তর্নিহিত রহস্য ও উদ্দেশ্য হলো (অন্যদের) মাঝে (এসব হালত-অবস্থা অর্জনের) স্পৃহা জাগ্রত করা এবং এর প্রতি আকৃষ্ট করা। এতে আরো বর্ণনা করা হয়েছে সেসব ব্যক্তির অবস্থা, যারা ওই আহ্বানে সাড়া দেওয়া হতে সঙ্কুচিত হয় এবং (এরই ফলশ্রুতিতে) আল্লাহ কর্তৃক তাদের প্রতি প্রদত্ত শাস্তির প্রকৃতি, যার রহস্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বিচার-বিবেচনা ও খোদাভীরুতা জাগিয়ে তোলা। 


وثانيها: حكاية أحوال الجاحدين، وكَشْفُ فضائحهم وجهلهم بالمجادلة والمحاجة على الحق، وسِرُّه ومقصوده في جنب الباطل الإفضاح والتنفير وفي جنب الحق الايضاح والتثبيت والتقهير.


অর্থ: দ্বিতীয় বিভাগটি বর্ণনা করে খোদাদ্রোহী তথা আল্লাহকে অস্বীকারকারী লোকদের (গ্লানিকর) অবস্থা ও তাদের বেইজ্জতি সম্পর্কে এবং সত্যের বিরুদ্ধে তাদের মতভেদ ও তর্ক করা সম্পর্কেও। এসবের রহস্য ও উদ্দেশ্য হলো, মিথ্যের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে (তা) প্রকাশ করা এবং বিমুখতা সৃষ্টি করা, আর সত্যের ব্যাপারে স্পষ্ট আশঙ্কা, নিশ্চিতকরণ ও বাধ্যগত করা।


وثالثها: تعريف عمارة منازل الطريق، وكيفية أخذ الزاد والأهبة والاستعداد.


অর্থ: তৃতীয় বিভাগটি ব্যাখ্যা করে আল্লাহ তায়ালার পথের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে এবং এ পথের জন্য নেওয়া সম্বল ও প্রস্তুতি সম্পর্কেও। 


فهذه ستة أقسام.


এগুলোই ছয়টি কিসিম/বিভাগ।


الفصل الثالث في شرح مقاصد القرآن

القسم الأول في تعريف المدعو إليه


তৃতীয় অধ্যায়: আল-ক্বুর’আনের ছয়টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা


ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর প্রথম কিসিম ব্যাপৃত আল্লাহ তায়ালার মা’রেফত তথা (রহস্যময়) জ্ঞানের ব্যাখ্যা নিয়ে, যে পবিত্র মহান সত্তার দিকে মানুষকে আহ্বান করা হয়; আর এটা লাল গন্ধক (الكبريت الأحمر)। এই মা’রেফতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:


(١) معرفة ذات الحق تبارك وتعالى، (٢) ومعرفة الصفات، (٣) ومعرفة الأفعال.


অর্থ: (১) হক্ব তাবারাকা ওয়া তায়ালার সত্তা মোবারকের জ্ঞান; (২) তাঁর সিফাত তথা গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলীর জ্ঞান; এবং (৩) তাঁর ক্রিয়াসমূহের জ্ঞান। আর এই তিনটিকে বলা হবে লাল চুনি (الياقوت الأحمر), কেননা এগুলো লাল গন্ধক হতে প্রাপ্ত ফায়দাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিশেষত্বপূর্ণ। 


চুনির যেমন বিভিন্ন স্তর (درجات) রয়েছে - সেগুলোর কিছু লাল, কিছু নীলাভ-ধুসর ও হলুদ, কিছু রত্ন অন্যান্য রত্নের চেয়েও দামী - ঠিক তেমনি এই তিন ধরনের জ্ঞানের স্তরও এক নয়। পক্ষান্তরে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে আল্লাহর যাত/সত্তা মোবারকের জ্ঞান, আর তাই এটাকে লাল চুনি (الياقوت الأحمر) বলা উচিত হবে। এর পরবর্তী স্তর হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সিফাত তথা গুণাবলীর জ্ঞান, আর এটা নীলাভ-ধুসর চুনি (الياقوت الأكهب)। এর পরবর্তী স্তর হচ্ছে আল্লাহতায়ালার ক্রিয়ার জ্ঞান, আর এটা হলুদ চুনি (الياقوت الأصفر)। 


(১) এসব চুনির মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবানটি যেমন সবচেয়ে সেরা ও খুঁজে পাওয়ার বেলায় সর্বাধিক বিরল - আর যেহেতু এর দুর্লভতার ফলে (এমন কী) রাজা-বাদশাহও এর যৎসামান্য পরিমাণের অধিকারী হন যদিও তাঁরা এর চেয়ে নিকৃষ্ট স্তরের রত্নের অধিক পরিমাণ পেয়ে থাকতে পারেন - ঠিক তেমনি আল্লাহর যাত/সত্তা মোবারক-সংক্রান্ত জ্ঞানেরও পরিধি সবচেয়ে সরু, অর্জনের বেলায় সবচেয়ে কঠিন, চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ধাঁধাময় এবং আলোচনায় গ্রহণ হতে সবচেয়ে দূরে। এ কারণেই ক্বুর’আন মজীদে শুধু এই জ্ঞানের ইশারা ও ইঙ্গিত বিদ্যমান; আর এর উদ্ধৃতি দেয়ার মানে দাঁড়াবে (ক) পরম পবিত্রকরণের উল্লেখ/স্মরণ, যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী - لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ - “তাঁর মতো কিছুই নেই” [ক্বুর’আন, ৪২/১১; নূরুল ইরফান] ও সূরা ইখলাস [ক্বুর’আন, ১১২]; এবং (খ) তাঁর বাণীর পরম শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি সম্মান - سُبْحَٰنَهُ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يَصِفُونَ بَدِيعُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلأَرْضِ - “তিনি পবিত্র এবং ওইসব কথাবার্তার ঊর্ধ্বে, যেগুলো তারা বলে থাকে; কোনো নমুনা ব্যতিরেকেই আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা” [ক্বুর’আন, ৬/১০০-১০১; নূরুল ইরফান]।


(২) আল্লাহর সিফাত তথা গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলীর বেলায় (বলবো), এগুলোর পরিধি প্রশস্ততর, আর এতদসংক্রান্ত বাচনের ক্ষেত্রও বিস্তৃত। এই কারণেই ঐশী জ্ঞান, শক্তি/ক্ষমতা, (চির)-জীবন/হায়াত, কালাম/বাচন, হিকমত/প্রজ্ঞা, শ্রবণ, দর্শন প্রভৃতি বর্ণনাকারী আয়াতের সংখ্যা অসংখ্য (وأما الصفات فالمجال فيها أفسح ونطاق النطق فيها أوسع ولذلك كثرت الآيات المشتملة على ذكر العلم والقدرة والحياة والكلام والحكمة والسمع والبصر وغيرها)।


(৩) আল্লাহর ক্রিয়াসমূহ (الأفعال) হলো মহাসাগরসদৃশ, যার সৈকত বিস্তীর্ণ এবং যার সীমারেখা অনুসন্ধানের দ্বারা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। বরঞ্চ আল্লাহ ও তাঁর ক্রিয়া ছাড়া কোনো কিছু অস্তিত্বশীল নয়। তাঁকে ছাড়া আর যা অস্তিত্বশীল তা একমাত্র তাঁরই ক্রিয়াসমূহ; তবে ক্বুর’আন মজীদে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দৃশ্যমান জগতে (عالم الشهادة) বিরাজমান সেসব ক্রিয়ার স্পষ্ট নিদর্শনাবলী, যেমন - আসমানসমূহ, তারকারাজি, দুনিয়া/জমিন, পাহাড়-পর্বত, গাছ-গাছালি, জীব-জন্তু/প্রাণি, সাগর-মহাসাগর, উদ্ভিদ, (মেঘমালা হতে) মিঠাজল বর্ষণ এবং উদ্ভিদ ও বিভিন্ন ধরনের প্রাণির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মাধ্যমগুলোর উল্লেখ। এসব ঐশী কার্য ইন্দ্রিয় দ্বারা স্পষ্ট অনুভব করা যায়। (কিন্তু) তাঁর কর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আশরাফ/সম্মানিত, মহাবিস্ময়কর ও তাঁরই মহিমার দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিতবহ হচ্ছে সেগুলো, যেগুলো ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না; বরঞ্চ যেগুলো অদৃশ্য জগতে (عالم الملكوت) বিরাজমান। তা হচ্ছে ফেরেশতাকুল, রূহানী/আধ্যাত্মিক জগৎ (الروحانيات), রূহ/আত্মা (الروح), ক্বলব তথা মানব-অন্তর যা আল্লাহকে জানে (القلب أعني العارف بالله تعالى); এই শেষোক্ত দুটিও অদৃশ্য জগৎ ও মালাকুত (عالم الغيب والملكوت)-এর পুরো যোগফলের অন্তর্গত, আর এগুলো আলমে মালাকূত ও (ইন্দ্রিয়ানুভূতির) দৃশ্যমান জগতের বাইরে অবস্থিত। ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করার মতো নয় এমন ঐশী ক্রিয়ার মধ্যে রয়েছেন পার্থিব জগতের ফেরেশতাবৃন্দ, যাঁরা মানব (সেবাযত্নের) দায়িত্বপ্রাপ্ত; আর এঁরাই পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)-কে সেজদা করেছিলেন। এছাড়াও রয়েছে শয়তানবর্গ যাদেরকে মানবকুলের (ক্ষতিসাধনের) সামর্থ্য দেওয়া হয়েছে, আর এরাই পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)-কে সেজদা করতে অস্বীকার করেছিলো। আরো রয়েছেন আসমানী ফেরেশতাকুল (الملائكة السماوية), যাঁদের মধ্যে পদমর্যাদায় সেরা হলেন কারূবিইঊন (الكروبيون) এবং যাঁরা বেহেশতে নিভৃতে আছেন (حظيرة القدس) এবং মানবের প্রতি কোনো মনোযোগ তাঁদের নেই; বরঞ্চ তাঁরা আল্লাহতায়ালা ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রতি মনোনিবিষ্ট হন না স্রেফ এ কারণে যে, তাঁরা তাঁরই সৌন্দর্য ও মহিমা দর্শনে বিমোহিত; তাঁদের চাহনি একমাত্র আল্লাহরই দিকে নিবদ্ধ; তাঁরা অক্লান্তভাবে দিন-রাত তাঁরই মহিমা গান [ক্বুর’আন, ২১/২০ - يُسَبِّحُونَ ٱلَّيلَ وَٱلنَّهَارَ لاَ يَفْتُرُونَ]। এ ব্যাপারটি কখনোই অসম্ভাব্য বিবেচনা করবেন না যে আল্লাহর বান্দাবৃন্দের মাঝে কারো মনোযোগ হয়তো আল্লাহরই মহিমা (جلال الله) পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) ও তাঁর বংশের (মানে মানবকুলের) দিক হতে সরিয়ে নিয়েছে। মানব কখনোই এই পর্যায়ে নিজেকে সম্মানিত করতে সক্ষম নয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন:


إِنَّ لِلهِ تَعَالَى أَرْضاً بَيْضَاءَ، مَسِيرَةُ اَلشَّمْسِ فِيهَا ثَلاَثُونَ يَوْماً، هِيَ مِثْلُ أَيَّامِ اَلدُّنْيَا ثَلاَثُونَ مَرَّةً، مَشْحُونَةً خَلْقاً لاَ يَعْلَمُونَ أَنَّ اَللهَ عَزَّ وَ جَلَّ يُعْصَى فِي اَلْأَرْضِ، وَلاَ يَعْلَمُونَ أَنَّ اَللهَ تَعَالَى خَلَقَ آدَمَ وَإِبْلِيسَ.


অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহর রয়েছে একটি সাদা দুনিয়া, যা’তে সূর্যের যাত্রা এ দুনিয়ার ত্রিশ দিনের মতো; সেটা এ দুনিয়ার চেয়ে ত্রিশ গুণ বেশি সৃষ্টি দ্বারা পূর্ণ, যেসব সৃষ্টি জানে না দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করা হয়, আর তারা এও জানে না আল্লাহতায়ালা আদম (আলাইহিস্ সালাম) ও ইবলীসকে সৃষ্টি করেছেন।” এই হাদীস বর্ণনা করেছেন হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। [تخريج: أعلام الدين في صفات المؤمنين، الجزء۱، الصفحة۲۸۰] আল্লাহতায়ালার রাজত্ব প্রসারিত হোক!


জেনে রাখুন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আল্লাহর ক্রিয়াগুলো সম্পর্কে অনবধান, বিশেষ করে সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ ও মর্যাদাময় ক্রিয়াগুলো। বরঞ্চ তাদের উপলব্ধি ইন্দ্রিয়ের জগৎ ও কল্পনার (عالم الحس والتخييل) মাঝে সীমাবদ্ধ, যা অদৃশ্য জগতের (عالم الملكوت) ফলাফলের শেষাংশ নিয়ে গঠিত এবং যা সর্বাধিক খাঁটি তরুমজ্জা থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী বাকল। যে ব্যক্তি এ পর্যায়/স্তর অতিক্রম করতে পারেনি, সে যেমনটি হওয়ার কথা, (দুর্ভাগ্যবশতঃ) ডালিমের কিছুই দেখতে পায়নি ছাল ছাড়া; অথবা মানবের বিস্ময়কর দিকগুলোও দেখতে পায়নি তারই বাহ্যিক আকার-আকৃতি ছাড়া। অতঃপর এগুলো দ্বারা গঠিত হয়েছে ক্বুর’আনী সূরাহ ও আয়াতসমূহের প্রথম কিসিমের পুরো যোগফল; আর এগুলোতেই উপস্থিত বিভিন্ন ধরনের চুনি (রত্ন)। এসব রত্ন-সংক্রান্ত নাযিলকৃত আয়াতে করীমাগুলো আমরা সহসা আপনার কাছে তেলাওয়াত করবো [নোট: ২য় খণ্ড, ১ম অধ্যায়]; কেননা বিশেষ করে এগুলো হলো আল-ক্বুর’আনের নির্যাস, এর অন্তর, এর তরুমজ্জা এবং এরই রহস্য।


القسم الثاني: في تعريف طريق السلوك إلى الله تعالى


দ্বিতীয় কিসিমটি ব্যাপৃত আল্লাহ তায়ালার দিকে অগ্রসরমান রাস্তার সংজ্ঞা নিয়ে। এটা নিজেকে আল্লাহর খেদমতে উৎসর্গের মাধ্যমে করতে হবে, যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান - وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلاً - “আর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহরই দিকে মনোনিবেশ করুন” [ক্বুর’আন, ৭৩/৮; নূরুল ইরফান]। তাঁর প্রতি ভক্তি ও মনোনিবেশ অর্জন করা যায় তাঁরই দিকে অগ্রসর হওয়ার এবং তিনি ছাড়া অন্যান্য বস্তু হতে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে; আর এ কথা ব্যক্ত হয়েছে কালামুল্লাহ শরীফে - لاَ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ فَٱتَّخِذْهُ وَكِيلاً - “তিনি ছাড়া কোনো মা’বূদ নেই; সুতরাং আপনি তাঁকেই আপন কর্ম-বিধায়ক হিসেবে গ্রহণ করুন” [ক্বুর’আন, ৭৩/৯; নূরুল ইরফান]। আল্লাহর রাস্তায় অগ্রসর হওয়া কেবল তাঁরই যিকর তথা স্মরণের সাধনা দ্বারা অর্জন সম্ভব; আর (একই সময়ে) তিনি ছাড়া অন্য সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কার্যকর করা সম্ভব শুধু যাবতীয় কামনা-বাসনা ও দুনিয়ার লোভ-লালসা হতে নিজের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে। এই পরিশুদ্ধির ফল হচ্ছে আখিরাতের কল্যাণ/সমৃদ্ধি [নোট: ইমাম গাজ্বালী রহমতুল্লাহি আলাইহির পারলৌকিক কল্যাণ-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি জানতে দেখুন অনুবাদক এম,এ, কাসেমের রচিত ‘Al-Ghazali’s Conception of Happiness’ বইটি], যেমনটি আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন - قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّىٰ  وَذَكَرَ ٱسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّىٰ - “নিশ্চয় লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত পৌঁছেছে, যে পবিত্র হয়েছে, এবং আপন রবের নাম নিয়ে নামায পড়েছে” [ক্বুর’আন, ৮৭/১৪-১৫; নূরুল ইরফান]। 


অতএব, এ পথ/তরীক্ব দুটো আজ্ঞা দ্বারা সমর্থিত: ঐকান্তিক প্রয়াস/সাধনা (الملازمة) এবং বিরোধিতা/মুখ ফেরানো (المخالفة)। অর্থাৎ, আল্লাহর স্মরণে ঐকান্তিক সাধনা এবং তাঁর দিক থেকে ফিরিয়ে রাখে বা বিচ্যুত করে এমন বিষয়/বস্তুর বিরোধিতা। এটাই আল্লাহর দিকে যাত্রা (সফর)। [নোট: এটা সূফী মতবাদ বা দর্শনের পরিভাষা। এর অর্থ এবং তরীক্বত/পথ, মুসাফির/সালিক ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দের ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে হযরত ইমাম (রহ.)-এর ‘এহইয়াও উলূমিদ্ দীন’ পুস্তকে, বৈরুত, ৫ম খণ্ড, ১৫-১৬ পৃষ্ঠা]


আল্লাহর রাস্তায় এই সফরে মুসাফিরের পক্ষ থেকে কোনো নড়াচড়া যেমন নেই, যাঁর দিকে তিনি সফররত তাঁরও তেমনি কোনো নড়াচড়া নেই। কেননা তাঁরা একে অপরের সান্নিধ্যে আছেন। আপনি কি শোনেন নি আল্লাহতায়ালার বাণী - وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ ٱلْوَرِيدِ - “এবং আমি হৃদয়ের শিরা অপেক্ষাও তার অধিক নিকটে আছি” [ক্বুর’আন, ৫০/১৬; নূরুল ইরফান]


বাস্তবতা হলো, অন্বেষণকারী (الطالب) ও অন্বেষণকৃতের (المطلوب) মিসাল তথা উপমাটি কোনো আয়নায় উপস্থিত সূরতের মতোই; কিন্তু ছবিটি এতে প্রকাশিত নয় আয়নার ওপরে মলিনতা থাকার কারণে; তবে আপনি যখন দর্পণটি (পরিষ্কারের দ্বারা) উজ্জ্বল করবেন তখনই ছবিটি তাতে ফুটে উঠবে; আর এটা আয়নার দিকে ছবির স্থানান্তর অথবা ছবির দিকে আয়নার স্থানান্তর দ্বারা হবে না, বরং পর্দার অপসারণ দ্বারাই হবে (لا بارتحال الصورة إلى المرآة، ولا بحركة المرآة إلى الصورة ولكن بزوال الحجاب)। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা প্রকাশিত হন আপন যাত/সত্তা মোবারক দ্বারা এবং তিনি গোপন নন। কেননা নূর তথা জ্যোতি গোপন করা অসম্ভব, আর যা কিছু গোপন তা জ্যোতি দ্বারা যাহের/প্রকাশিত হয়; এবং “আল্লাহ নূর আসমানসমূহ ও জমিনের” (ক্বুর’আন, ২৪/৩৫; নূরুল ইরফান - ٱللهُ نُورُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلأَرْضِ)। চক্ষুতারা হতে এই নূরের গোপন থাকার কারণ কেবল নিম্নের দুটো বিষয়ের মধ্যে যে কোনো একটি: হয় চক্ষুতারার মাঝে ঝাপসা দৃষ্টি (كدورت), নতুবা দুর্বলতাহেতু মহা তীক্ষ্ণ আলোকরশ্মি সহ্য করতে অক্ষমতা; ঠিক যেমনটি বাদুড়ের চোখ সূর্যকিরণ সহ্য করতে অসমর্থ। অতঃপর আপনার প্রতি কিছুই বিধেয় নয় স্রেফ এতোটুকু ছাড়া যে, ক্বলব/অন্তঃচক্ষুর ঝাপসা দৃষ্টি অপসারণ এবং সেটার চক্ষুতারার দৃষ্টিক্ষমতা দৃঢ়ীকরণ। এরকম ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা সেটার (মানে ক্বলবের) মাঝে থাকবেন, ঠিক যেমনটি ছবি আয়নার মধ্যে থাকে - যাতে আল্লাহ পাক অকস্মাৎ নিজেকে আপনার ক্বলবের আয়নায় প্রকাশ করলে আপনি উদ্যোগী হয়ে বলেন, তিনি সেটার মধ্যে আছেন আর মানব প্রকৃতি ধারণ করেছে ঐশী প্রকৃতিকে (وقلت انه فيه وقد تدرع باللاهوت ناسوتي) [নোট: এটা যীশু খ্রীষ্টের মাঝে ঐশী প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির সংমিশ্রণ হয়েছে মর্মে খ্রীষ্টান বিশ্বাসের প্রতি ইমাম গাজ্বালী রহমতুল্লাহি আলাইহি’র সমালোচনা]; যতোক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহতায়ালা আপনার কাছে সাবেত/প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর কালাম (আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখেন ঈমানদারদেরকে শাশ্বত বাণীতে - ক্বুর’আন ১৪/২৭, নূরুল ইরফান - يُثَبِّتُ ٱللهُ ٱلَّذِينَ آمَنُواْ بِٱلْقَوْلِ ٱلثَّابِتِ), যাতে আপনি উপলব্ধি করতে পারেন যে ছবিটি (প্রকৃতপক্ষে) আয়নার মধ্যে (অবস্থিত) নয়, বরং (স্রেফ) আয়নাতে প্রতিফলিত মাত্র। যদি ছবিটি কোনো একটি দর্পণের মধ্যে অবস্থান করতো, তাহলে এটা একই সময়ে অসংখ্য আয়নায় প্রতিফলনের ব্যাপারটি অচিন্তনীয় হতো; বরং (ব্যাপারটি হতো) ওই সময় কোনো আয়নার মধ্যে তা অবস্থান নিলে অপর কোনো আয়না থেকেই তা স্থানান্তরিত হয়েছিলো। তবে এটা কোনোক্রমেই বাস্তবতা নয়, কেননা আল্লাহতায়ালা একই সময়ে আরেফীন/খোদা-জ্ঞানী তথা সূফী-দরবেশবৃন্দের কাছে নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। হ্যাঁ, এটা সত্য যে তিনি কিছু (আরেফীনের ক্বলবের) আয়নায় সবচেয়ে নিখুঁত, সবচেয়ে প্রকাশ্য, সবচেয়ে সরাসরি এবং সবচেয়ে সুস্পষ্ট রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন; আর কিছু (আরেফীনের ক্বলবের আয়নায়) প্রকাশ হন সবচেয়ে গোপন ও পরোক্ষভাবে এবং এই পার্থক্য (ক্বলবে) আয়নার স্বচ্ছতা, এর উজ্জ্বলতা, এর নিখুঁত আকৃতি এবং এর পৃষ্ঠের সঠিক প্রস্থ দ্বারা। এ কারনেই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন - إن الله يتجلى للناس عامة ولأبي بكر خاصة - “নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা নিজেকে মানুষের কাছে আ’ম তথা সাধারণ/সার্বিকভাবে প্রকাশ করে থাকেন; তবে খাস্ তথা বিশেষভাবে (প্রকাশ) করে থাকেন আবূ বকরের কাছে” [এহইয়াও উলূম]।                                      


আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়ার জ্ঞান এবং খোদাপ্রাপ্তি (الوصول) উভয়ই ক্বুর’আন মজীদের সাগরগুলো হতে (আগত) এক অতল/গভীর সাগরের মতো। আমরা সহসা আপনার জন্যে আয়াতে করীমাগুলো একত্রিত করবো, যেগুলো আল্লাহর দিকে অগ্রসর হবার রাস্তায় আপনাকে পরিচালিত করবে, যাতে আপনি ওগুলোকে সামষ্টিকভাবে নিয়ে আপনার ভাবনায় প্রতিফলন করতে পারেন [২য় খণ্ড, ২য় অধ্যায় দ্রষ্টব্য]। হয়তো যা উন্মুক্ত হওয়া উচিত, তা আপনার জন্যে উন্মুক্ত হবে। অতঃপর এই (ক্বুর’আনী সূরাহ ও আয়াতগুলোর) কিসিম গঠন করেছে চকচকে মণি-মুক্তা (রত্নভাণ্ডার)।


القسم الثالث في تعريف الحال عند ميعاد الوصال


তৃতীয় ‍কিসিমটি আল্লাহতায়ালাকে পাওয়ার সময় মানব-রূহ তথা আত্মার আহওয়াল বা (আত্মিক) হালত-অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর অনুভূত শান্তি ও খুশির উল্লেখ। সকল ধরনের সুখ-শান্তির সামগ্রিক অর্থজ্ঞাপক শব্দটি হলো জান্নাত; আর এগুলোর মধ্যে পরম সুখ হলো আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পাওয়া। এতে (আরো) উল্লেখিত রয়েছে সেসব লোকের অপমান ও শাস্তিপ্রাপ্তির বর্ণনা, যা বিবৃত করে তাদের (আল্লাহর দিকে অগ্রসরমান) পথ পরিক্রমণের প্রতি অবহেলার দরুন আল্লাহ হতে (পর্দার) আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়ার ঘটনা। সব ধরনের শাস্তিভোগের সামগ্রিক অর্থজ্ঞাপক শব্দটি হলো দোযখ/জাহান্নাম, আর এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টের কারণ (আল্লাহ হতে) পর্দা (الحجاب) এবং দূরত্বে অপসারণ (الإبعاد); আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন (আমীন)। এ কারণেই আল্লাহ পাক প্রথমে তাঁর পবিত্র বাণীতে এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন:


كَلاَّ إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوبُونَ. ثُمَّ إِنَّهُمْ لَصَالُواْ ٱلْجَحِيمِ.


অর্থ: হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয় ওই দিন তারা স্বীয় রবের সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত; অতঃপর নিশ্চয় তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। [ক্বুর’আন, ৮৩/১৫; নূরুল ইরফান]


এই কিসিমে আরো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ওপরে উল্লেখিত দুটো দলের (মানে বেহেশতী ও দোযখীদের) আহওয়াল সম্পর্কে আলোচনা। এসব হালত-অবস্থা ব্যক্ত হয়েছে নিম্নের কথা দ্বারা - হাশর/পুনরুত্থান (الحشر), নশর/মৃতদের উত্থাপন (النشر), হিসাব (الحساب), মীযান/পাল্লা (الميزان) এবং পুল-সীরাত (الصراط)। এগুলোর অবশ্য যাহেরী তথা প্রকাশ্য অর্থ বিদ্যমান, যা’তে পরিব্যাপ্ত সাধারণ মানুষের জন্য খোরাকের স্থান; (আবার) এগুলোতে রয়েছে অস্পষ্ট রহস্যসমূহ, যা’তে পরিব্যাপ্ত বিশেষ বান্দাদের জন্য জীবনের স্থান। ক্বুর’আন মজীদের এক-তৃতীয়াংশ আয়াত ও সূরাহগুলো এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে ব্যাপৃত। আমরা এগুলোকে এ বইতে সংকলন করতে চাই না, কেননা এগুলোর সংখ্যা গণনাতীত হওয়ায় সংকলন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এগুলোতে গভীর চিন্তাভাবনা ও অনুসন্ধান নিহিত রয়েছে। এই তৃতীয় কিসিমটি গঠন করেছে সবুজ পান্না (الزمرد الأخضر)।


القسم الرابع: في أحوال السالكين والناكبين


ক্বুর’আনী সূরাহ ও আয়াতগুলোর চতুর্থ কিসিম পরিব্যাপ্ত হয়েছে (আল্লাহর পথে পরিক্রমণকারী) সালিকীন-বৃন্দের আহওয়াল নিয়ে, আর আল্লাহকে অস্বীকারকারী ও তাঁর পথ হতে বিচ্যুত লোকদের দুরবস্থা নিয়েও। প্রথমোক্ত (পুণ্যাত্মা) শ্রেণির আহওয়াল/হালত-অবস্থা ব্যক্ত হয়েছে সর্ব-পয়গাম্বর আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা, হারূন, যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া, ঈসা, মরিয়ম, দায়ূদ, সুলাইমান, ইঊনুস, লূত, ইদরীস, খিযির, শু’আইব, ইলিয়াস (আলাইহিমুস্ সালাম), মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), জিবরীল, মিকাঈল ও অন্যান্য ফেরেশতা (আলাইহিমুস্ সালাম) প্রমুখের কাহিনীতে। আল্লাহকে অস্বীকারকারী ও তাঁর পথ হতে বিচ্যুত লোকদের দুরবস্থার কাহিনীগুলো হলো নমরূদ, ফেরাউন, আ’দ গোত্র, লূত (আলাইহিস্ সালাম)-এর জাতি, তুব্বা’আ জাতি, আসহাবে আয়কাহ (উপবনের সাথীবর্গ), মক্কার কুফফার, মূর্তিপূজারী গোষ্ঠী ও ইবলীস-শয়তানচক্রের। এই কিসিমের ফায়দা নিহিত রয়েছে খোদাভীরুতা জাগ্রত করা, সতর্কীকরণ এবং সুবিবেচনা উৎসাহিত করার মধ্যে। এতে আরো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে (খোদার) রহস্যাবলী, উপমা ও ইশারা/ইঙ্গিত, যার জন্য আবশ্যক সুগভীর দীর্ঘ চিন্তাভাবনা। (পুণ্যাত্মাবৃন্দ ও দুরাত্মাদের) এই দুটি দলের যথাক্রমিক হালত-অবস্থা ও দুরবস্থার বর্ণনায় পাওয়া যায় ধূসর অম্বর (العنبر الأشهب) এবং তাজা প্রস্ফুটিত ঘৃতকুমারী কাঠ (العود الرطب الأنضر)। এই দুটো দলের ব্যাপারে অবতীর্ণ আয়াতে করীমার সংখ্যা এতো অগণিত যে সেগুলো খোঁজা এবং একত্রিত করার কোনো প্রয়োজনই নেই।


القسم الخامس: في محاجة الكفار ومجادلتهم وإيضاح مخازيهم بالبرهان الواضح وكشف


ক্বুর’আনী সূরাহ ও আয়াতসমূহের পঞ্চম কিসিম ব্যাপৃত রয়েছে সত্যের বিরুদ্ধে কাফেরদের অপযুক্তি উপস্থাপন, সংশয়াতীত প্রমাণ দ্বারা তাদের অপমানের স্পষ্ট ব্যাখ্যাকরণ এবং তাদের মিথ্যে ও আত্মপ্রবঞ্চনার স্বরূপ উন্মোচন নিয়ে। তাদের মিথ্যেগুলো তিন প্রকার:

 

أحدها: ذكر الله تعالى بما لا يليق به من أن الملائكة بناته وأن له ولدا وشريكا وأنه ثالث ثلاثة.


প্রথমতঃ আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলা যা তাঁর (মান-মর্যাদার) উপযুক্ত নয়; যেমন - ফেরেশতাকুল তাঁরই কন্যা [নোট: তখনকার মক্কাবাসী আরবীয় কুফফার-বর্গের মাঝে বিরাজমান একটা ভ্রান্ত ধারণা এটা; দেখুন - ক্বুর’আন, ১৭/৪০; ৪৩/১৯; ৫২/২৭ (وَجَعَلُواْ ٱلْمَلاَئِكَةَ ٱلَّذِينَ هُمْ عِبَادُ ٱلرَّحْمَـٰنِ إِنَاثاً أَشَهِدُواْ خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ)]; আল্লাহর একজন সন্তান রয়েছেন, এবং তাঁর শরীক রয়েছেন, আর তিনি ‘তিন খোদার মধ্যে একজন।’ [নোট: এটা খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের ত্রিত্ব মতবাদ; দেখুন - ক্বুর’আন, ৫/৭৩; ৪/১৭১ (لَّقَدْ كَفَرَ ٱلَّذِينَ قَالُوۤاْ إِنَّ ٱللهَ ثَالِثُ ثَلاَثَةٍ)]


والثاني: ذكر رسول الله بأنه ساحر وكاهن وكذاب وإنكار نبوته وأنه بشر كسائر الخلق فلا يستحق أن يتبع.


দ্বিতীয়তঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জাদুকর, গণক ও মিথ্যুক বিবেচনা করা, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, আর এ কথা বলা যে তিনি অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো, তাই অনুসরণের হকদার নন।


وثالثها: إنكار اليوم الآخر وجحد البعث والنشور والجنة والنار وإنكار عاقبة الطاعة والمعصية. 

  

তৃতীয়তঃ শেষ বিচার দিবস, পুনরুত্থান, নশর/মৃতদের উত্থাপন, বেহেশ্ত, দোযখ এবং আল্লাহর আনুগত্য ও অবাধ্যতার ফরাফল অস্বীকার করা। কুফফারদের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রামাণিক দলিলসমর্থিত যুক্তিতে উপস্থিত রয়েছে সূক্ষ্ম জ্ঞান ও বাস্তবতা, যার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় এক মহৌষধ। এই (পঞ্চম) কিসিম-সংক্রান্ত আয়াতে করীমাগুলোও অবধারিতভাবে অসংখ্য।


القسم السادس: في تعريف عمارة منازل الطريق وكيفية التأهب للزاد والاستعداد بإعداد السلاح الذي يدفع سراق المنازل وقطاعها


ক্বুর’আনী সূরাহ ও আয়াতসমূহের ষষ্ঠ কিসিম (আল্লাহর দিকে অগ্রসরমান) তরীক্ব/পথের মানযিল তথা পর্যায়গুলোতে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন এবং সহায়-সম্বল গ্রহণের পদ্ধতি আর ওই পথের পর্যায়গুলোতে অবস্থানরত (রাহাজানিতে লিপ্ত) দস্যুদের রুখে দেবার মতো অস্ত্রসজ্জার প্রস্তুতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা পেশ করে। এর ব্যাখ্যা হলো এই যে, দুনিয়া আল্লাহর দিকে সায়ের তথা সফরকারীদের একটি মানযিল আর দেহ বা শরীর একটি বাহন/মারকাব। যে ব্যক্তি মানযিল/পর্যায় (المنزل) ও মারকাব/বাহনের (المركب) তদবীর তথা ব্যবস্থাপনাকে অবহেলা করে, সে তার সফর পুরো করতে পারে না। সে দুনিয়াবী জীবনের কার্যক্রম যতোক্ষণ পর্যন্ত নিয়মবদ্ধ করতে না পারছে, ততোক্ষণ আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের দায়িত্ব-কর্তব্য, যা আল্লাহর দিকে অগ্রসরমান রাস্তা পরিক্রমণসদৃশ, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে, এই আনুগত্য সম্পূর্ণ হতে পারে না, যতোক্ষণ না তার শরীর সুস্থ থাকে এবং তার নসল/বংশ জারি থাকে। এই দুটোই পূর্ণতা পায় সেগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার মাধ্যমগুলো দ্বারা এবং সেগুলোকে বিনষ্ট ও বিনাশ করতে পারে এমন বস্তুর প্রতিহতকরণ দ্বারা।


শরীরের সুস্থতা রক্ষা ও বংশধারার রক্ষণাবেক্ষণ, এ দুটোর মাধ্যম (وأما أسباب الحفظ لوجودهما) হলো পানাহার, যা শরীরকে টিকিয়ে রাখে এবং বংশবৃদ্ধির জন্য স্ত্রী-সহবাস জারি রাখে। খাদ্যকে সৃষ্টি করা হয়েছে হায়াত তথা জীবন ধারণের একটি মাধ্যমস্বরূপ, আর নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির বংশধারা বজায় রাখার মাধ্যমস্বরূপ। কিন্তু খাদ্য কিছু ভক্ষণকারী এবং নারী কিছু পুরুষের জন্য সহজাতভাবে খাস্ তথা সুনির্দিষ্ট নয়। তাদেরকে (কেবল কারো জন্যে) খাস্ তথা নির্দিষ্টকরণের কানুন ব্যাখ্যা না করে ব্যাপারটি ছেড়ে দিলে মানুষেরা এর প্রতি অবহেলা করতো এবং পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হতো, আর এর দরুন তারা আল্লাহর (দিকে অগ্রসরমান) পথ পরিক্রমণ হতে বিচ্যুত হতো; নিশ্চয় এটা তাদের বিনাশ সাধন (هلاك) করতো। তাই ক্বুর’আন মজীদ এই সুনির্দিষ্টকরণের কানুন ব্যাখ্যা করেছে সম্পদবিষয়ক বিভিন্ন আয়াতে, যা পরিবৃত করেছে বিক্রয় (المبايعات), সুদ (الربويات), ধারকর্জ (المداينات), উত্তরাধিকার (বণ্টন) বিভাজন (قسم المواريث), বকেয়া ব্যয়ের খাত (مواجب النفقات), গনীমতের মালামাল বিভাজন (قسمة الغنائم), দান-খয়রাত (الصدقات), বিবাহ (المناكحات), গোলামের মুক্তিদান (العتق), কিতাবাহ [الكتابة - নোট: আক্ষরিক অর্থে লেখাকে বোঝায়; তবে ইসলামী আইনে বোঝায় গোলাম কর্তৃক নিজকে অর্থসম্পদের বিনিময়ে মুক্তকরণ; এই চুক্তিভিত্তিক মুক্তি প্রক্রিয়ায় গোলাম তার মালিককে দুই কিংবা তিন কিস্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বা সমপরিমাণ সম্পদ পরিশোধ করে থাকে; মালিক হলো মুকা’তিব আর গোলাম মুকা’তাব; কেবল শেষোক্তজন চাইলেই চুক্তি বাতিল করতে পারে। দেখুন - ক্বুর’আন, ২৪/৩৩], গোলামের মালিকানা (الاسترقاق) এবং ধর্মযুদ্ধে বন্দী আটক (السبي)। অধিকন্তু, ক্বুর’আনে করীম ব্যাখ্যা করেছে সম্পদের সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি সম্পর্কেও যা’তে অন্তর্ভুক্ত তা আহরণের সময়কাল, মৌখিক ঘোষণা, শপথ ও সাক্ষ্য (وعرف كيفية ذلك التخصيص عند الاتهام بالاقراريات وبالإيمان والشهادات)। নারীদের খাস্/সুনির্দিষ্ট বিষয়াদি বর্ণিত হয়েছে সেসব আয়াতে করীমায়, যা’তে পরিবৃত রয়েছে বিবাহ (النكاح), তালাক (الطلاق), তালাক হতে ফিরে আসা/প্রত্যাহার (الرجعة), ইদ্দত [العدة - নোট: তালাক হওয়া নারীর পুনর্বিবাহের আগে অপেক্ষার সময়কাল], খুল’ [الخلع - নোট: হানাফী মাযহাব অনুসারে স্ত্রী স্বামীকে অর্থ পরিশোধ করে তালাক নিতে পারে, বিশেষ করে দেনমোহরের টাকা দিয়ে, যেটা সে স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিলো তার বিয়েতে; এটাকে খুল’ বলে; এটা বিচারালয়ের বাইরে বিবাহ-বিচ্ছেদ রীতি যার কোনো বিচারিক রায় প্রয়োজন নেই; তবে যেহেতু এটা সমঝোতামূলক ব্যবস্থা, সেহেতু স্বামীর স্বেচ্ছায় সম্মতি এতে আবশ্যক; এটার পক্ষে ক্বুর’আনী ভিত্তি দেখুন ২/২২৯ - অতঃপর যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে তারা উভয়ে ঠিকভাবে ওই সীমারেখাগুলোর ওপর থাকবে না, তবে তাদের কোনো গুনাহ নেই এর মধ্যে যে, কিছু বিনিময় দিয়ে স্ত্রী নিষ্কৃতি গ্রহণ করবে - فَإِنْ خِفْتُمْ أَلاَّ يُقِيمَا حُدُودَ ٱللهِ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا ٱفْتَدَتْ بِهِ], দেনমোহর (الصداق), ইলা’ [الايلاء - নোট: এক প্রকার তালাক যা’তে স্বামী তার স্ত্রী-সহবাস হতে অন্যূন চার মাস বিরত থাকার শপথ করে; দেখুন - জুরজানী কৃত আত্ তা’রিফা’ত, সম্পাদক- জি, ফ্লুজেল, লীপজিগ, ১৮৪৫ ইং, ৪২ পৃষ্ঠা; ক্বুর’আন, ২/২২৬; সহীহ বুখারী, তালাক্ব, ২১; ইবনে মাজাহ, সুনান, তালাক্ব, ২৪], যিহা‘র [الظهار - নোট: এক প্রকার তালাক নিম্নের ফর্মূলা অনুসারে - انتِ عليّ كظهر أمّي - ‘তুমি আমার কাছে আমার মায়ের পিঠের মতো’ বাক্যটি উচ্চারণ দ্বারা হয়; এটা প্রাক-ইসলামী যুগের প্রথা; দেখুন - ক্বুর’আন, ৫৮/২; সহীহ বুখারী, তালাক্ব, ২৩; ইবনে মাজাহ, সুনান, তালাক্ব, ২৫], লিআ’ন [اللعان - নোট: এক প্রকার তালাক যা নিম্নবর্ণিত পরিস্থিতিতে হয়: স্বামী তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ সত্ত্বেও চারজন সাক্ষী দ্বারা প্রমাণ না করলে তাকে অবশ্যঅবশ্য শপথ করতে হবে সে সত্য বলেছে এবং এ কথা যোগ করতে হবে - ‘আমি মিথ্যেবাদী হলে আল্লাহর লা’নত আমার প্রতি অবতীর্ণ হোক।’ স্ত্রী এরপর বলে, ‘আমি শপথ করছি আমার স্বামী মিথ্যুক।’ সে আরো যোগ করে, ‘এই ব্যক্তি সত্য বল্লে আল্লাহর লা’নত আমার ওপরে পড়ুক।’ এরপর এ তথ্যবলে তালাক্ব হয়ে যায়। দেখুন - ক্বুর’আন, ২৪/৬; সহীহ বুখারী, তালাক্ব, ৪, ২৫, ২৭-৩৬; ইবনে মাজাহ, সুনান, তালাক্ব, ২৭]; এ ছাড়াও পরিবৃত রয়েছে সেসব আয়াতে, যেগুলো রক্তের সম্পর্ক, স্তন্যপান, ও বিবাহের সূত্রে নিষিদ্ধ নারীবিষয়ক।


শারীরিক সুস্থতা ও বংশধারা জারি রাখা উভয়ের বিনষ্টকারী বিষয়/বস্তু প্রতিরোধ করার মাধ্যমসমূহ হচ্ছে সেসব শাস্তি যা মানুষকে এই বিষয়/বস্তু হতে বিরত রাখে। এসব শাস্তি কুফফার ও (অন্যায়কারী) বিদ্রোহী লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তার প্রতি উৎসাহ দানের মতো; শাস্তি, ক্ষতিপূরণ, তিরস্কার, কাফফারা, দিয়্যাত তথা হত্যার দায় মোচনে অর্থ পরিশোধ এবং কিসাস বা বদলার মতো। (কারো) প্রাণ নাশ বা অঙ্গহানি করার চেষ্টা কেউ যাতে না করে তার প্রতিরোধকস্বরূপ ক্বিসাস ও দিয়্যাত বিধান করা হয়েছে। চুরি ও রাহাজানির শাস্তি বিধান করা হয়েছে যাতে জীবনধারণের মাধ্যম সম্পদ-সম্পত্তি নষ্টকে প্রতিরোধ করা যায়। যিনা (অবৈধ যৌনাচার), সমকামিতা ও মিথ্যে অভিযোগ উত্থাপনের প্রতিরোধকস্বরূপ শাস্তি বিধান করা হয়েছে, কেননা এগুলো বংশধারা ও খান্দানের বিষয়াদিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং মানবজাতি ও পরবর্তী প্রজন্মের ধারাবাহিকতাকে ত্রুটিযুক্ত করে। কুফফার-বর্গের সাথে জ্বিহাদ করার বিধান করা হয়েছে সত্য অস্বীকারকারীদের দ্বারা মুসলমানবৃন্দের জীবনধারণ ও আল্লাহ-প্রাপ্তির মাধ্যম ইবাদত-বন্দেগী উভয় ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টির প্রতিরোধকল্পে। আর বাগী তথা অন্যায়কারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বিধান করা হয়েছে সেই নৈরাজ্য প্রতিরোধকল্পে, যা দায়িত্বপ্রাপ্ত দ্বীনদার ও ন্যায়পরায়ণ শাসক যিনি আল্লাহর রাস্তায় পরিক্রমণকারীদের সুরক্ষা/প্রহরা দেন এবং রাব্বুল আলামীনের রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর না’য়িব তথা প্রতিনিধিস্বরূপ ধার্মিকদের সমর্থন দেন, তাঁর নিয়ন্ত্রণ হতে অবাধ্য লোকগুলো ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখা দেবে [নোট: ইমাম গাজ্বালী (রহ.)-এর মতে, আদর্শ ইসলামী সমাজে শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যা ধর্মচর্চা ও মানুষের নৈতিকতার বিকাশ ঘটায়; ফলে রাজনীতি নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মের ওপর ভিত্তিশীল; শাসক ধার্মিক ও সূফী-দরবেশবৃন্দকে সুরক্ষা ও সমর্থন দেন; তিনি নবী পাক (দ.)-এর প্রতিনিধিস্বরূপ কাজ করেন; ইসলাম ধর্মে শাসক ঐশী দায়িত্বপ্রাপ্ত]। এতদসংক্রান্ত বিষয়াদিতে অবতীর্ণ আয়াতে করীমাগুলো আপনার থেকে গোপন নয়। এগুলোর আওতাধীন হচ্ছে মৌলিক নীতিমালা, সুবিধাদি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও ফায়দা, যার সবগুলোই সে ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারেন, যিনি প্রকাশিত শরঈ বিধিবিধানের সৌন্দর্যের ওপর (ভাবনার) প্রতিফলন করেন - যে ঐশী বিধান এ (দুনিয়ার) জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তের সীমাগুলোর বর্ণনা দেয়। (ক্বুর’আনী আয়াতের) এই ষষ্ঠ কিসিমে আরো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হালাল ও হারাম বিষয়াদি এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। এই কিসিমের আওতাভুক্ত আয়াতে করীমাগুলোতেই পাওয়া যাবে সুগন্ধি কস্তুরী (المسك الأذفر)। 


অতঃপর এই (ছয় কিসিম) একত্রিত হয়ে সেসব শিক্ষা গঠন করেছে যা ক্বুর’আনের বিভিন্ন সূরাহ ও সেগুলোর আয়াতে করীমায় বিধৃত হয়েছে। আপনি যদি এসব কিসিম সেগুলোর উদ্দিষ্ট শাখাসমূহ সহকারে সুতোর একটি মালায় গাঁথেন, তাহলে দেখতে পাবেন তাতে দশ ধরনের বিষয়ের উল্লেখ বিদ্যমান: খোদার সত্তা সম্পর্কে উল্লেখ (ذكر الذات), তাঁর গুণাবলীর উল্লেখ (ذكر الصفات), ঐশী ক্রিয়ার উল্লেখ (ذكر الأفعال), আগমনকারী পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে উল্লেখ (ذكر المعاد), সহজ-সরল/সঠিক পথ সম্পর্কে উল্লেখ (ذكر الصراط المستقيم), আত্মার পরিশুদ্ধি ও শোভা বর্ধন (أعني جانبي التزكية والتحلية), আউলিয়া কেরাম (রহ.)-বৃন্দের হালত-অবস্থার উল্লেখ (ذكر أحوال الأولياء), আল্লাহর শত্রুদের অবস্থার উল্লেখ (ذكر أحوال الأعداء), (আল্লাহর পেশকৃত) কুফফার-বর্গের প্রতি যে যুক্তি-প্রমাণ, তার উল্লেখ (ذكر محاجة الكفار), এবং (সবশেষে) ঐশী বিধিবিধানের সীমার উল্লেখ (ذكر حدود الأحكام)।


الفصل الرابع في كيفية انشعاب العلوم الدينية كلها عن الأقسام العشرة المذكورة 


চতুর্থ অধ্যায়: ক্বুর’আনের দশটি বিভাগ হতে সকল দ্বীনী জ্ঞানের শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি এবং জ্ঞানের শ্রেণিসমূহের ব্যাখ্যা 


আমি ধারণা করি, আপনি এক্ষণে (ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর) এই দশটি কিসিম হতে সকল দ্বীনী জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃতির ধরন এবং সেগুলোর উদ্দিষ্ট নৈকট্য ও দূরত্বের ক্ষেত্রে সেগুলোর বিভিন্ন শ্রেণি সম্পর্কে জানতে গভীরভাবে আগ্রহী। অতএব, জেনে রাখুন, আমরা যে সমস্ত বাস্তবতার দিকে ইশারা করেছি, সেগুলোর রয়েছে নানা রহস্য ও হীরে-জহরত; সেগুলোর (আরো) রয়েছে (সামুদ্রিক) শামুকের খোসা (أصداف); আর এই খোসা-ই প্রথমে দৃশ্যমান হয়। অতঃপর কিছু লোক যারা ওই খোসার কাছে পৌঁছে, তারা (কেবল) সেটাকেই চেনে ও জানে। অপরদিকে, অন্যরা শামুকের খোসাগুলো ভেঙ্গে (অভ্যন্তরে লুক্কায়িত) মণি-মুক্তা সযত্নে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। অনুরূপভাবে, আল-ক্বুর’আনের হীরে-জহরতের খোসা ও এর বস্ত্র (كسوته) হচ্ছে আরবী ভাষা। এই খোসা থেকে শাখা বিস্তার করেছে পাঁচটি (দ্বীনী) বিদ্যাশাস্ত্র, যা আল-ক্বুর’আনের বাকল, খোসা ও বস্ত্রের জ্ঞান। এরই ফলশ্রুতি: (১) ক্বুরআনের কথা থেকে বিস্তৃত হয়েছে আরবী ভাষার জ্ঞান (إذ انشعب من ألفاظه علم اللغة); (২) এ’রাব দ্বারা বাক্য-গঠন থেকে আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রের শাখা বিস্তৃত হয়েছে (ومن إعراب ألفاظه علم النحو); (৩) আল-ক্বুর’আনের বিভিন্ন (এ’রাব দ্বারা) বাক্য-গঠন থেকে ক্বের’আত পাঠশাস্ত্রের বিস্তৃতি হয়েছে (ومن وجوه إعرابه علم القراءات); (৪) ক্বুর’আনী অক্ষরগুলোর উচ্চারণের ধরন থেকে বিস্তৃত হয়েছে অক্ষরসমূহের নির্গমনবিষয়ক শাস্ত্র। এটা এই কারণে যে, কথনের অর্থ যেসব অংশ দ্বারা গঠিত হয়, তার প্রথমটি-ই হচ্ছে স্বর/আওয়াজ; এরপর আকৃতি লাভ করা আওয়াজ পরিণত হয় অক্ষরে; আর অক্ষরগুলো জমা বা একত্রিত হয়ে গঠন করে শব্দ; জমাকৃত কিছু অক্ষরের নির্দিষ্টকরণ দ্বারা আরবী ভাষার উৎপত্তি হয়েছে; অতঃপর অক্ষর-বিন্যাস পদ্ধতি এতে যোগ করেছে (এ’রাব দ্বারা) বাক্য-গঠনের গুণ; এরপর বিভিন্ন (এ’রাব দ্বারা) বাক্য-গঠন পদ্ধতির একটিকে নির্দিষ্টকরণ এমন এক পঠন-পদ্ধতির উৎপত্তি করেছে যা সাতটি মানসম্মত পঠন-পদ্ধতির প্রতি আরোপিত হয়েছে; অতঃপর যখন কোনো সংজ্ঞাবাচক আরবী শব্দে এ’রাব দ্বারা বাক্যগঠন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তখন তা কোনো অর্থের সূচক হয় (ومن كيفية التصويت بحروفه علم مخارج الحروف، إذْ أول أجزاء المعاني التي منها يلتئم النطق هو الصوت، ثم الصوت بالتقطيع يصير حرفا، ثم عند جمع الحروف يصير كلمة، ثم عند تَعَيُّنِ بعض الحروف المجتمعة يصير لغة عربية، ثم بكيفية تقطيع الحروف يصير معربا، ثم بِتَعَيُّن بعض وجوه الإعراب يصير قراءة منسوبة إلى القراءات السبع)। (৫) অতঃপর এটা বাহ্যিক তাফসীর তথা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাবি করে, আর এটাই পঞ্চম জ্ঞানের শাখা। এগুলোই হচ্ছে আল-ক্বুর’আনের (শামুকের)-খোসা ও বাকলের বিদ্যাশাস্ত্র (ثم إذا صار كلمة عربية صحيحة مُعْرَبَةً صارت دالة على معنى من المعاني فَتَتَقَاضَى للتفسير الظاهر وهو العلم الخامس)।                          

ثم يليه عِلْمُ القِراأت وهو ما يُعرَف به وجوهُ الإعراب وأصنافُ هيئاتِ التصويت، وهو أخصُّ بالقرآن من اللغة والنَّحو، ولكنه من الزوائد المُستَغْنَى عنها دون اللغة والنحو فإنهما لا يُستغنَي عنهما. فصاحب علم اللغة والنحو أرفع قدراً ممن لا يعرف إلا علم القراأت، وكلهم يدورون على الصَّدف والقِشر وإن اختلفت طبقاتهم.


অতঃপর (এ’রাব বিদ্যাশাস্ত্রের) সাথে নিকটবর্তী হলো ক্বের’আত তথা ক্বুর’আন পাঠের বিদ্যা। এটা এমন বিদ্যা যা দ্বারা এ’রাবের (সহায়তায়) বিভিন্ন বাক্য-গঠন প্রক্রিয়া ও উচ্চারণের নানা পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়। এটা লোগাত/ভাষাতত্ত্ব ও নাহু/ব্যাকরণের বাক্য-গঠন পদ্ধতিগুলোর চেয়ে ক্বুর’আনের জন্য অধিকতর খাস বা সুনির্দিষ্ট, কিন্তু এটা বাহুল্য বিষয়গুলোর মধ্যে একটা; অথচ ভাষাবিদ্যা ও বাক্য-গঠনবিদ্যা মানুষের জন্য (অতীব) প্রয়োজনীয় জ্ঞানের শাস্ত্র। অতঃপর ভাষাতত্ত্ববিদ ও ব্যাকরণবিদ (দু’জন) শুধু ক্বের’আত-পাঠবিদের চেয়ে মর্যাদায় উচ্চতর। তবে এ সকল ব্যক্তি আল-ক্বুর’আনের খোসা ও বাকলের চারপাশ ঘিরেই আবর্তমান, যদিও তাঁদের তবকা তথা স্তর বিভিন্ন।


ويليه علمُ التفسير الظاهر، وهو الطبقة الأخيرة من الصَّدفة القريبة من مُمَاسَّة الدُّرّ، ولذلك يشتد به شَبَهُهُ حتى يظن الظَانُّون أنه الدُّرّ وليس وراءَه أنفسُ منه، وبه قنع أكثر الخلق، وما أعظمَ غُبْنَهُم وحِرمانَهم، إذ ظنوا أنه لا رتبة وراء رُتبتهم، ولكنهم بالإضافة إلى من سواهم من أصحاب علوم الصدف على رتبة عالية شريفة، إذ علم التفسير عزيزٌ بالنسبة الى تلك العلوم، فإنه لا يراد لها بل تلك العلوم تُراد للتفسير.


ক্বুর’আনের ক্বির’আত-পাঠবিদ্যার (সাথে) নিকটবর্তী হলো এর যাহেরী/প্রকাশ্য তাফসীর তথা ব্যাখ্যা-শাস্ত্র। এটা ক্বুর’আন মজীদের খোসার শেষ স্তর, যা (মণি)-মুক্তার স্পর্শের নিকটবর্তী। এ কারণেই (মণি)-মুক্তার সাথে এর সাযুজ্য শক্তিশালী হয়েছে, যার দরুন কিছু লোক ধারণা করেছে যে এটা বুঝি (খোদ) মণি-মুক্তা এবং এরপর এর চেয়ে মূল্যবান আর কোনো কিছুই নেই। এই ধারণা নিয়ে তারা তৃপ্ত/তুষ্ট। কতোই না বড় ধোঁকা ও বঞ্চনা তাদের জন্য (নসীব হয়েছে), কেননা তারা ধারণা করে নিয়েছে যে তাদের মর্যাদার স্তরের চেয়েও উঁচু কোনো স্তর নেই! [নোট: ইমাম গাজ্বালী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেসব তাফসীরবিদের গুরুত্ব এখানে কমিয়ে দিয়েছেন, যারা ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর যাহেরী/প্রকাশ্য অর্থের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। তিনি সে সকল তাফসীরবিদের উচ্চ-মূল্যায়ন করেছেন যাঁরা ক্বুর’আন মজীদের সুগভীর ও গোপন অর্থগুলো বের করে আনার প্রচেষ্টারত - এমন অর্থ যেগুলোকে তিনি অতল মহাসাগরের তলায় লুকিয়ে থাকা ওই (মণি)-মুক্তার সাথে তুলনা করেছেন]। তবে ক্বুর’আনের খোসার (অন্যান্য) বিদ্যাশাস্ত্রগুলোতে পারদর্শী ও জ্ঞানের অধিকারীদের চাইতে তাঁরা (মানে উক্ত মহান তাফসীরবিদবৃন্দ) উচ্চতর ও মহত্তর স্তরের অধিকারী; কেননা তাফসীরশাস্ত্র ক্বুর’আনের খোসার অন্যান্য বিদ্যাশাস্ত্রের তুলনায় শক্তিশালী। নিশ্চয় এই শাস্ত্র সেই শাস্ত্রগুলোর জন্যে উদ্দেশ্যকৃত নয়, বরঞ্চ সেগুলোই এই শাস্ত্রের জন্যে উদ্দেশ্যকৃত। 


وكل هؤلاء الطبقات إذا قاموا بشرط علومهم فحفظوها وأَدَّوْها على وجهها، فيشكرُ الله سعيَهم ويُنَقِّي وجوهَهم كما قال رسول الله صلى عليه وسلم: ((نضَّرَ اللهُ ٱمرأً سمع مَقالتي فوعاها فأدَّاها كما سمعها، فَرُبَّ حاملِ فقهٍ إلى غير فقيه، وَرُبَّ حاملِ فقهٍ إلى من هو أفقَه منه))؛ وهؤلاء سمعوا وأَدَّوْا، فلهم أجرُ الحمل والأداء، أَدَّوْها إلى من هو أفقه منهم أو إلى غير فقيه. والمفسر المقتصر في علم التفسير على حكاية المنقول سامع ومُؤَدٍّ، كما أن حافظ القرآن والأخبار حامل ومُؤَدٍّ.  


এই পাঁচ স্তরের মানুষ যখন তাঁদের বিদ্যাশাস্ত্রের (আরোপিত) শর্তাবলী পূরণ করেন, তা সংরক্ষণ করেন আর পূর্ণরূপে (অন্যদের) পৌঁছে দেন, তখন আল্লাহ পাক তাঁদের প্রচেষ্টাকে মূল্যায়ন করবেন এবং তাঁদের চেহারা পরিশুদ্ধ করবেন, যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দোয়ায় বলেছিলেন, “আল্লাহ তায়ালা সে ব্যক্তিকে এক সহজ/সরল জীবন দান করুন, যে আমার কথা শুনেছে, অতঃপর তা গ্রহণ করে যেভাবে শুনেছে সেভাবেই (অন্যদের) পৌঁছে দিয়েছে। এটা হতে পারে ফিক্বহ-জ্ঞানের কোনো বাহক ফেক্বাহ-শাস্ত্রে অজ্ঞ কারো কাছে তা বহন করে নিয়ে যেতে পারে। (আবার) এও হতে পারে সে তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী কারো কাছে এই জ্ঞান বহন করে নিয়ে যেতে পারে” [ইবনে মাজাহ, সুনান, মুকাদ্দমা, ১৮; মানা’সিক, ৭৬; আহমদ বিন হাম্বল, মুসনাদ, ৪র্থ খণ্ড, ৮০, ৮২ পৃষ্ঠা]। তাঁরা (তথা উল্লেখিত পাঁচ স্তরের আলেম-উলামা) শ্রবণ করেছেন এবং পৌঁছে দিয়েছেন, আর এরই ফলশ্রুতিতে তাঁরা পুরস্কৃত হবেন (তাঁদেরই শ্রুত) জ্ঞান বহন করার এবং তাঁদের চেয়ে জ্ঞানী ও কম জ্ঞানীদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ক্বুর’আনের তাফসীর-শাস্ত্রে যে তাফসীরবিদ তাঁর প্রতি বর্ণিত/নকলকৃত (আল-মানক্বূল) জ্ঞান প্রচারে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন, তিনি তেমনই একজন (জ্ঞানের) বহনকারী ও প্রচারক, ঠিক যেমনটি বহনকারী ও প্রচারকারী হলেন ক্বুর’আনের হাফিয এবং আখবার তথা হাদীসের বাহক। 


وكذلك علم الحديث يتشعب إلى هذه الأقسام سوى القراءَةِ وتصحيحِ المخارج، فدرجةُ الحافظ الناقل كدرجة معلم القرآن الحافظ له، ودرجةُ من يعرف ظاهر معانيه كدرجة المُفَسِّر، ودرجةُ من يعتني بعلم أسامي الرجال كدرجة أهل النحو واللغة، لأن السَّنَدَ والرِّوَاية آلة النقل، وأحوالهم في العدالة شرط لصلاح الآلة للنقل، فمعرفتهم ومعرفة أحوالهم ترجع إلى معرفة الآلة وشرط الآلة، فهذه علوم الصدف.


অনুরূপভাবে, হাদীসশাস্ত্রও এই (একই) শাখাগুলোতে বিভক্ত, ব্যতিক্রম শুধুমাত্র পঠন ও শুদ্ধ উচ্চারণ (ধ্বনি নির্গমন)-বিদ্যা। হাদীস/নকলকৃত বর্ণনাসমূহ যে পণ্ডিত হেফয তথা মুখস্থ করেন এবং বর্ণনা করেন, তাঁর মর্যাদা ক্বুর’আন-শিক্ষাদানকারী ও হেফযকারীর মতোই। এসব হাদীসের (কেবল) যাহেরী/বাহ্যিক অর্থ যিনি জানেন, তিনি একজন তাফসীরবিদের মর্যাদাসম্পন্ন। হাদীস-বর্ণনাকারীদের নাম-সম্পর্কিত বিদ্যায় ব্যাপৃত আলেমের মর্যাদা ব্যাকরণবিদ বা ভাষাতত্ত্ববিদের মর্যাদার মতো। এটা এ কারণে যে, রওয়ায়াত তথা বর্ণনাসমূহের সনদ ও রওয়ায়াত/বর্ণনাসমূহ (সেগুলোর আমাদের কাছে পৌঁছুবার বেলায়) হাতিয়ারস্বরূপ; আর বর্ণনাকারীদের ন্যায়পরায়ণতা/সত্যনিষ্ঠার হালত-অবস্থা বর্ণনাসমূহের হাতিয়ারের বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে শর্তস্বরূপ। অতএব, বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জানা এবং তাঁদের হালত-অবস্থা সম্পর্কে জানা হাতিয়ার সম্পর্কে জ্ঞান এবং হাতিয়ারের শর্ত-সংক্রান্ত জ্ঞানের কারণ বটে। অতঃপর এগুলোই ক্বুর’আনের বিভিন্ন বিদ্যাশাস্ত্রের খোসা।

                                               

দ্বিতীয় কিসিম হলো (আল-কুর’আনের) তরুমজ্জার জ্ঞান (علوم اللباب)। এর রয়েছে দুটো তবকা তথা স্তর। নিম্নস্তরটি (কুর’আনী) তিনটি বিভাগের জ্ঞান, যেগুলোকে আমরা সংজ্ঞায়িত করেছি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগের অনুসরণ ও সম্পূর্ণকারী হিসেবে [নোট: ১ম অধ্যায় দেখুন]। এসব নিম্নস্তরের জ্ঞান নিম্নরূপ:


فالقسم الأول: معرفةُ قَصص القرآن، وما يتعلق بالأنبياء، وما يتعلق بالجاحدين والأعداء، ويتكفل بهذا العلم القُصَّاص والوُعَّاظ وبعض المُحَدِّثين، وهذا علم لا تَعُمُّ إليه الحاجة.


প্রথম কিসিম ব্যাপৃত রয়েছে আল-কুর’আনে (বর্ণিত) বিভিন্ন ঘটনার কাহিনি-সংক্রান্ত জ্ঞান নিয়ে এবং সেই সাথে যা বর্ণিত হয়েছে আম্বিয়া কেরাম (আলাইহিমুস সালাম)-বৃন্দের প্রতি, আল্লাহর অস্বীকারকারীদের প্রতি এবং আল্লাহর শত্রুদের প্রতি তা নিয়েও। এ ধরনের জ্ঞানের দায়িত্ব বহন করেন (কুর’আনী) কাহিনি বর্ণনাকারী, ওয়ায়েযীন এবং কিছু মুহাদ্দেসীন। এরকম জ্ঞানের চাহিদা সর্বজনীন নয়।


والقسم الثاني: هو مُحاجَّةُ الكفار ومجادلَتُهم، ومنه يتشعب علم الكلام المقصود لردِّ الضَلالاتِ والبِدَع، وإزالة الشُّبُهَات، ويتكفل به المُتَكَلِّمون، وهذا العلم قد شرحناه على طبقتين، سمينا الطبقة القريبة منهما ((الرسالة القُدْسِيَّة))؛ والطبقة التي فوقها ((الاقتصاد في الاعتقاد)). ومقصود هذا العلم حراسة عقيدةِ العَوَامّ عن تشويش المُبتَدِعَة، ولا يكون هذا العلم مَليًّا بكشف الحقائق، وبجنسه يتعلق الكتاب الذي صنفناه في ((تهافُت الفلاسفة)) والذي أوردناه في الرد على الباطنِيَّة في الكتاب الملقبُ ((المُستَظْهِري)) وفي كتاب ((حُجَّةُ الحَقّ وقَواصِمُ الباطنية)). وكتاب ((مُفَصَّل الخلاف في أصول الدين)). ولهذا العلم آلة يَعرفُ بها طريق المجادلة بل طرق المُحاجَّة بالبرهان الحقيقي، وقد أَوْدعناه كتاب ((محكُّ النظر)) وكتاب ((معيارُ العلم)) على وجه لا يُلْفَى مثله للفقهاء والمتكلمين، ولا يثق بحقيقة الحُجَّة والشُّبهة من لم يُحِط بهما علماً.


দ্বিতীয় কিসিমটি কুফফার-বর্গের সাথে আল্লাহর যুক্তিতর্ক ও তাদের সাথে তাঁরই বিরোধ-সংক্রান্ত। এই বিভাগ হতে শাখা বিস্তার করেছে ইলমুল কালাম তথা ধর্মতত্ত্বীয় জ্ঞান, যার উদ্দেশ্য (ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাসে প্রবিষ্ট) ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি/গোমরাহী প্রতিরোধ ও তৎসংশ্লিষ্ট সন্দেহ/সংশয় অপসারণ। মুতাকাল্লিমূন তথা কালাম শাস্ত্রবিদমণ্ডলী এই জ্ঞানের দায়িত্ব বহন করেন। আমরা এই জ্ঞান দুটি স্তরে ব্যাখ্যা করেছি। নিম্নতর স্তরটি ব্যাখ্যা করেছি ‘আর্ রিসালাতুল কুদসীয়্যাহ’ পুস্তিকায় [নোট: এটা ইমাম গাজ্বালী (রহ.) জেরুসালেম নগরীতে রচনা করেন। তাঁর এ পবিত্র স্থানে অবস্থান ছিলো দশ বছরের নির্জন বাসের অংশবিশেষ, যখন তিনি কঠিন সূফী সাধনায় নিমগ্ন হন। তিনি প্রতিদিন জেরুসালেমে অবস্থিত ‘কুব্বাতুস্ সাখরা (Dome of the Rock) চত্বরে ঢুকে নিজেকে আবদ্ধ করতেন।  এই রিসালা/পত্রটি তিনি পরবর্তীকালে তাঁর ‘এহইয়া’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় কিতাবে অন্তর্ভুক্ত করেন। পত্রে বিধৃত কলেমা-বাক্যগুলো নিম্নস্তরটি গঠন করে, কেননা এগুলোর সাথে যুক্ত রয়েছে এগুলোর সাধারণ প্রমাণসমূহ]। আর উচ্চস্তরটি আমি ব্যাখ্যা করেছি ‘আল-ইকতিসাদ ফীল-ই’তিকাদ’ পুস্তকে [নোট: এ বইটি আল-গাজ্বালী (রহ.)-এর প্রাক-সূফী জীবনে রচিত হয়েছে বাগদাদ নগরীতে। এতে কলেমা-বাক্যগুলো বিধৃত হয়েছে এগুলোর গভীরতর বাস্তবতা ও জটিল দালিলিক প্রমাণসহ, যা’তে জড়িত রয়েছে সুগভীর অনুসন্ধান, সূক্ষ্ম প্রশ্ন ও সমস্যার সমাধান। এ বইটি কায়রোতে প্রকাশিত হয়]। এই বিদ্যাশাস্ত্রের উদ্দেশ্য গোমরাহ-পথভ্রষ্টদের সৃষ্ট বিভ্রান্তি হতে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান হেফাযত করা। কিন্তু এ জ্ঞান কাশফ তথা হাকীকত বা বাস্তবতাবিষয়ক (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের প্রতি আলোকপাত করে না। এ ধরনের জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট (ক) দার্শনিকদের অসঙ্গতিসমূহের ওপর লেখা আমাদের বই ‘তাহাফুতুল ফালা’সিফা’ [নোট: হযরত ইমাম (রহ.)-এর ‘তাহাফুতুল ফালা’সিফা’ গ্রন্থটি ১০৯৫ খ্রীষ্টাব্দে লেখা হয়, যখন তিনি সূফী ছিলেন না। এতে তিনি কলেমা-বাক্যগুলোর (প্রতি অরোপিত) নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন; মানে বাস্তবে যেসব বিশ্বাস সামগ্রিক বা আংশিকভাবে অনৈসলামী ছিলো কিন্তু তাঁর সমসাময়িক মুসলিম দার্শনিকবর্গ যেগুলোকে পুরোপুরি ইসলামী বলে বিবেচনা করতো]; (খ) বাতিনী মতবাদের রদকল্পে আমাদের লেখা বইটি যার শিরোনাম ‘মুসতাযহিরী’ এবং অপর একটি বই ‘হুজ্জাতুল হক্ক ওয়া কওয়াসিমুল বাতিনীয়া’ [নোট: বাতিনী মতবাদ শিয়া ইসমাঈলী শাখার অনুরূপ। মূলস্রোত সুন্নী মুসলিম জনগোষ্ঠী শিয়া মতবাদকে গোমরাহী হিসেবে জানেন। ইমাম গাজ্বালী (রহ.) বাতেনী মতবাদ খণ্ডনকল্পে অনেকগুলো গোটা বা আংশিক বই লেখেন যা’তে তিনি তাদের বিভ্রান্তিকর মতবাদের মিথ্যে প্রকাশ করে দেন; খলীফা মুসতাযহির যিনি ১০৯৪ সালের ফেবরুয়ারী মাসে ক্ষমতায় আরোহণ করেন, তাঁর অনুরোধে হযরত ইমাম (রহ.) ‘মুসতাযহিরী বইটি ১০৯৫ সালে প্রণয়ন করেন। ওই সময় তিনি সূফী ছিলেন না; এটা বাতিনী বা তা’লিমীদের খণ্ডনে রচিত এবং খলীফার প্রতি উৎসর্গিত। আর ‘হুজ্জাতুল হক্ক’ বইটি তিনি বাগদাদে লিখেছিলেন তাঁর প্রতি তা’লিমীদের সমালোচনার জবাবে]; এবং (গ) ’মুফাসসালুল খিলাফি ফী উসূলিদ্ দীন’ শিরোনামের বইটিও [নোট: এ বইটি হারিয়ে গেছে। তাঁর প্রতি তা’লিমীদের সমালোচনার জবাবে তিনি এটা হামাদানে লিখেছিলেন]। এই জ্ঞানের শাখায় একটি হাতিয়ার বিদ্যমান, যা দ্বারা কেউ বিতর্কের পদ্ধতি, বরঞ্চ বাস্তবতাপূর্ণ দালিলিক প্রমাণের সাহায্যে বিতর্ক-পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারেন [নোট: এই হাতিয়ার বলতে বোঝায় আল-গাজ্বালী (রহ.)-এর সমসাময়িক দার্শনিক, বিশেষ করে আল-ফারাবী ও ইবনে সীনা প্রমুখের দ্বারা মুসলিম জাহানে বর্ণিত এরিস্টটেলীয় যুক্তি। হযরত ইমাম (রহ.) যুক্তি অনুমোদন করতেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী মুসলমান ধর্মতত্ত্ববিদদের চেয়েও ব্যাপক আকারে এর ব্যবহার করেছিলেন। ‘আল-কিসতাসুল মুসতাকীম’ পুস্তকে তিনি কুর’আন মজীদের রেফারেন্সের আলোকে যুক্তিতর্কের নীতিমালার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করেন]। এগুলো সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি আমাদের ‘মিহাক্কুন নজর’ ও ‘মিয়্যারুল ইলম’ গ্রন্থ দুটোতে; আর তা এমনই এক পন্থায় যা ফিক্বাহবিদ/ধর্মীয় বিধানশাস্ত্রজ্ঞ ও ধর্মতত্ত্ববিদমণ্ডলীর বইপত্রে পাওয়া যায় না [নোট: মিহাক্কুন্ নজর বইটি তাঁর সূফী মতবাদে দীক্ষার পর রচিত হয়। ধর্মশাস্ত্রে ব্যবহৃত যুক্তিবিদ্যা এতে বিধৃত। এটা কায়রোতে প্রকাশিত হয়। মিয়্যারুল ইলম পুস্তকটি তাঁর সূফী হবার আগের; এটাও যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত। তাহাফুত গ্রন্থে ব্যবহৃত পরিভাষা সম্পর্কে এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কায়রোতে ১৩২৯ সালে এটা প্রকাশিত হয়]; আর যে ব্যক্তি এই দুটো বইয়ের সাথে পরিচিত নয়, সে যুক্তিতর্ক ও সন্দেহের আসল প্রকৃতি বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে পারবে না।


والقسم الثالث: علم الحدود الموضوعة للاختصاص بالأموال والنساء، للاستعانة على البقاء في النفس والنسل، وهذا العلم يتولاَّه الفقهاء، ويشرح الاختصاصات المالية رُبْعُ المعاملات من الفقه، ويشرح الاختصاصات بمحل الحراثة أعني النساء ربعُ النكاح؛ ويشرح الزَّجْرَ عن مفسدات هذه الاختصاصات ربعُ الجنايات، وهذا علم تعمُّ إليه الحاجة لتعلقه بصلاح الدنيا أولاً، ثم بصلاح الآخرة، ولذلك تميز صاحب هذا العلم بمزيد الاشتهار والتَّوقير، وتقديمهِ على غيره من الوُعَّاظ والقُصَّاص ومن المتكلمين، ولذلك رُزِقَ هذا العلمُ مزيدَ بحثٍ وإطناب على قدر الحاجة فيه، حتى كَثُرَت فيه التصانيف، لا سيما في الخِلافِيَّات منه، مع أن الخلافَ فيه قريب، والخطأَ فيه غيرُ بعيد عن الصواب، إذ يَقْرُبُ كل مجتهد من أن يُقال له مُصيب، أو يُقال إن له أجراً واحداً إن أخطأ ولصاحبه أجران، ولكن لما عَظُمَ فيه الجاهُ والحِشمة، تَوَفَّرت الدواعي على الإفراط في تفريعه وتشعيبه، وقد ضيعنا شطراً صالحاً من العمر في تصنيف الخلاف منه، وصرفنا قدراً صالحاً منه إلى تصانيف المذهب وترتيبه إلى ((بسيط)) و((وسيط)) و ((وجيز)) مع إيغالٍ وإفراطٍ في التَّشعيب والتفريع، وفي القدر الذي أودعناه كتاب ((خلاصة المختصر)) كفاية، وهو تصنيف رابع وهو أصغر التصانيف، ولقد كان الأولون يُفتون في المسائل وما على حفظهم أكثر منه، وكانوا يُوَفَّقون للإصابة أو يتوقفون ويقولون لا ندري، ولا يستغرقون جملةَ العمر فيه، بل يشتغلون بالمهم ويُحيلون ذلك على غيرهم، فهذا وجهُ ٱنْشِعاب الفقه من القرآن، ويتولَّد من بين الفقه والقرآن والحديث علم يسمى أصول الفقه، ويرجع إلى ضبط قوانين الاستدلال بالآيات والأخبار على أحكام الشريعة.  


তৃতীয় কিসিমটি সম্পদ ও মহিলাদের ব্যাপারে (বিধানগত) সীমা নির্ধারণে বিশেষায়িত জ্ঞান-সংক্রান্ত, যা দ্বারা (মানব) জীবন ও বংশপরম্পরা জারি রাখার ক্ষেত্রে সাহায্য অন্বেষণ করা যায়। ফিক্বাহশাস্ত্রবিদদের প্রতি এই দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। ফিক্বাহ’র ওই এক-চতুর্থাংশ যা পরিচিত ‘রুব’উল মু’আমালাত’ (رُبْعُ المعاملات) হিসেবে, তা একজন ব্যক্তির অন্যদের সাথে সম্পদের লেনদেন-সংক্রান্ত বিশেষায়িত জ্ঞানের ব্যাখ্যা দেয়। ‘রুব’উন্ নিকাহ’ (ربعُ النكاح) তথা বিবাহবিষয়ক ফিক্বহ’ জ্ঞানের এক-চতুর্থাংশ মানবজাতির নসল্ বা বংশবৃদ্ধির মাধ্যম নারীসম্পর্কিত বিশেষায়িত বিদ্যার ব্যাখ্যা প্রদান করে। ‘রুব’উজ্ জিনায়াত’ (ربعُ الجنايات) বা অপরাধবিষয়ক এক-চতুর্থাংশ ফিক্বহ বিদ্যা (পূর্বোক্ত) ওই দুটি জ্ঞানের ক্ষেত্রে যারা বিশৃঙ্খলা নিয়ে আসে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ/দমন করার ব্যাপারে ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই ধরনের জ্ঞানের চাহিদা সর্বজনীন; কেননা এটা প্রথমতঃ দুনিয়াবী পরিশুদ্ধি বা কল্যাণের সাথে জড়িত; আর এরপর এটা পারলৌকিক কল্যাণের সাথেও জড়িত। এ কারণেই এই জ্ঞান দ্বারা যিনি ভূষিত, তিনি মহাসম্মান ও সুপরিচিতির অধিকারী এবং অন্যদের চেয়েও তাঁর কদর বেশি; যেমন - ধর্মপ্রচারক (ওয়ায়েযীন), (কুর’আনী ঘটনাবলী) বর্ণনাকারী (القُصَّاص), এবং ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ (মুতাকাল্লিমীন)। এই একই কারণে এতদসংক্রান্ত জ্ঞানের ওপর এমনই পর্যাপ্ত গবেষণা করা হয়েছে যে, এটা প্রয়োজনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এরই ফলশ্রুতিতে এ বিষয়ে অসংখ্য বইপত্র রচিত হয়েছে, বিশেষ করে এর এখতেলাফী/মতপার্থক্যসূচক মাস’য়ালাগুলোতে, যদিও মতপার্থক্য সত্যের নিকটবর্তী এবং ভুলভ্রান্তি সত্য থেকে দূরে নয়। প্রত্যেক মুজতাহিদ তথা স্বাধীনভাবে গবেষণায় সক্ষম আলেমকে তাঁর গবেষণায় সঠিক হবার নিকটবর্তী বলা হয়েছে, অথবা তিনি ভুল করলে একটি সওয়াব পাবার কথা বলা হয়েছে, যেখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী (সঠিক হবার কারণে) দুটি সওয়াব পাবার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু মহা প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সুখ্যাতি এই জ্ঞানের দ্বারা অর্জিত হয়, সেহেতু এ জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা বের করার উদ্দেশ্যের মাত্রাও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আমরা (নিজেরাও) আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ এর মতপার্থক্যগত বিষয়াদিতে অপচয় করেছি; আর আমরা জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছি মাযহাব ও তার তরতীব রচনায় আমাদের নিম্নলিখিত বইপত্রে: “আল-বাসীত” (নোট: অপ্রকাশিত; দেখুন - ইবনে খাল্লিকানের ‘ওয়াফায়্যাতুল আ’য়্যান ওয়া আম্বা’ আবনা’ আয্ যামান’, কায়রো, ১২৯৯ হিজরী, ২য় খণ্ড, ২৪৫ পৃষ্ঠা; এটা ইমামুল হারামাঈনের ‘নিহায়াত আল-মাতলাব’ গ্রন্থের একটা সারসংক্ষেপ); ‘ওয়াসীত’ (নোট: এ বইটিও অপ্রকাশিত; এটা ‘আল-বাসীত বইটির সারবত্তা; দেখুন - ইবনে খাল্লিকানের ‘ওয়াফায়্যাত’, ২য় খণ্ড, ২৪৬ পৃষ্ঠা); এবং ‘আল-ওয়াজীয’ (নোট: কায়রোতে প্রকাশিত ১৩১৭ হিজরী সালে; দু ভাগে বিভক্ত: প্রতিটি ২৯৬ পৃষ্ঠাসম্বলিত, সূচি ছাড়া; সূচি যথাক্রমে ১০ ও ৯ পৃষ্ঠা; এটা শাফেঈ ফিকহ’র ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ); এটা আমরা করেছি শাখা-প্রশাখা বের করার এবং তার ফলশ্রুতির অতিরঞ্জন ও মাত্রাধিক্য সত্ত্বেও। আমাদের ‘খুলাসাতুল মুখতাসার’ গ্রন্থে পেশকৃত আলোচনাই পর্যাপ্ত হবে (নোট: বইটি হারিয়ে গেছে; এটা হুজ্জাতুল ইসলাম কর্তৃক আবূ ইবরাহীম ইসমাঈল বিন ইয়াহইয়া আল-মুযানী রচিত ‘আল-মুখতাসারুস্ সগীর’ বইটিরই পুনর্বিন্যাস ছিলো; আবূ ইবরাহীমের বইটি বুলাক-এ ১৩২১-২৬ হিজরীতে প্রকাশিত হয়; দেখুন - হযরত ইমামের ‘এহইয়া’ ১/৪০)। এটা এতদসংক্রান্ত বিদ্যায় আমাদের চতুর্থ বই এবং এ সকল কিতাবের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। আউয়ালূন তথা প্রাথমিক যুগের প্রজন্মগুলো বিভিন্ন মাস’য়ালার ওপর ফতোয়া দিতেন, কিন্তু তাঁরা এ বইটির চেয়ে বেশি হেফাযত করতেন না। তাঁরা আল্লাহর অনুগ্রহে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতেন, কিংবা সিদ্ধান্ত দিতেন এই বলে, “আমরা জানি না।” তাঁরা নিজেদের সারা জীবন এতে ব্যয় করতেন না। বরঞ্চ এর উল্টো তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ (জ্ঞানের) বিষয় নিয়ে নিমগ্ন থাকতেন, এবং তাঁরা এটা অন্যদের কাছে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অতঃপর এ উপায়ে আল-কুর’আন থেকে ফিক্বহ বিদ্যার শাখা বিস্তার লাভ করেছে। ফিক্বহ, কুর’আন ও হাদীসশাস্ত্র হতে উৎপত্তি হয়েছে আরেকটি জ্ঞানের শাখা যার নাম উসূল-এ-ফিক্বহ (ফিক্বাহর নীতিমালা)। কুর’আনী আয়াত ও হাদীস হতে শাস্ত্রীয় বিধিবিধান বের করার নিয়মকানুন এটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ثم لا يخفى عليك أن رتبة القُصَّاص والوُعَّاظ دونَ رتبة الفقهاء والمتكلمين ما داموا يقتصرون على مجرد القَصَص وما يَقْرُب منها، ودرجٰة الفقيه والمتكلم متقاربة، لكن الحاجة إلى الفقيه أعم، وإلى المتكلم أشدُّ وأشدّ، ويُحتاج إلى كِلَيْهما لمصالح الدنيا، أما الفقيه فَلحفظ أحكام الاختصاصاتِ بالمآكلِ والمنَاكِح؛ وأما المتكلم فلدفع ضرر المُبتَدِعة بالمُحاجَّة والمجادلة، كيلا يستطيرَ شَرَرُهم ولا يعمَّ ضَرَرُهم، أما نسبتهم إلى الطريق والمقصد فنسبة الفقهاء كنسبة عُمَّار الرِّباطات والمصالح في طريق مكة إلى الحج، ونسبة المتكلمين كنسبة بَدْرَقَةِ طريق الحج وحارسه إلى الحجاج، فهؤلاء إن أضافوا إلى صناعتهم سلوكَ الطريق إلى الله تعالى بقطع عَقَبَات النفس، والنُّزوعِ عن الدنيا، والإقبالِ على الله تعالى، فَفَضْلُهم على غيرهم كفضل الشمس على القمر؛ وإن اقتصروا فدرجتهم نازلةٌ جداً.


আপনার কাছ থেকে এ ব্যাপারটি গোপন থাকা উচিত নয় যে (কুর’আনী) ঘটনাবলীর কাহিনি বর্ণনাকারী (القُصَّاص) ও ওয়ায়েযীন (الوُعَّاظ) বা ওয়াযকারীদের মর্তবা তথা স্তর ঠিক ততোক্ষণ ফকীহ-উলামা ও মুতাকাল্লিমীন বা ধর্মশাস্ত্রজ্ঞদের নিচে অবস্থিত, যতোক্ষণ পর্যন্ত প্রথমোক্ত দলটি স্রেফ কিস্সা-কাহিনি ও অনুরূপ বিষয়াদি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন। ফকীহ-উলামা ও মুতাকাল্লিমীনবৃন্দের মর্যাদা (একে অপরের) কাছাকাছি; তবে ফকীহ-মণ্ডলীর চাহিদা অধিকতর আ’ম তথা সর্বজনীন, আর মুতাকাল্লিমীনবৃন্দের চাহিদা আরো বেশি শক্তিশালী, এবং তাঁরা উভয়ই দুনিয়ার পরিশুদ্ধি/কল্যাণের জন্যে প্রয়োজনীয়। ফকীহ-উলামার প্রয়োজন হয় (হালাল) খাবার ও (নারীদের সাথে) বিয়ে-শাদীর বিশেষায়িত ক্ষেত্রে (শরঈ) সিদ্ধান্ত হেফাজতকরণ তথা সংরক্ষণে। মুতাকাল্লিমীন তথা ধর্মশাস্ত্রজ্ঞবৃন্দের প্রয়োজন হয় বিদ’আতীদের সংঘটিত ক্ষতিগুলোকে যুক্তি ও তর্ক দ্বারা দূর করার জন্যে, যাতে তাদের মন্দ (বিদ’আত) প্রসারিত হতে না পারে এবং তাদের ক্ষতি সর্বসাধারণ্যে ছড়াতে না পারে। আল্লাহর পথে ফকীহ-মণ্ডলী ও মুতাকাল্লিমীনবৃন্দের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এর উদ্দেশ্য (নিম্নরূপ): ফকীহবৃন্দের সম্পর্ক হলো সে সব মানুষের অনুরূপ, যাঁরা মক্কা মোয়াযযমায় হজ্জ্বের (সময়) পথের ওপর আশ্রয়মূলক ঘর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং সুবিধাদি প্রদান করেন। আর মুতাকাল্লিমীনবৃন্দের সম্পর্ক হলো হজ্জ্বের রাস্তায় অপব্যয়িত বস্তুসমূহের সাথে এবং হাজ্বীদের তা (সংঘটন) হতে পাহারা দেওয়ার সাথে। যদি তাঁরা (মানে ফুকাহা ও মুতাকাল্লিমীন) আল্লাহতায়ালার পথে চলাকে নিজেদের কাজের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করেন এবং নফসের তাড়না হতে বিরত থেকে আল্লাহতায়ালার দিকে ধাবিত হন, তাহলে তাঁদের ফযীলত তথা শ্রেষ্ঠত্ব অন্যদের ওপরে এমনটি হবে যেমনটি চাঁদের ওপরে সূর্যের শ্রেষ্ঠত্ব। আর যদি তাঁরা (কেবল) নিজেদের কাজেই সীমাবদ্ধ থাকেন, তাহলে তাঁদের দরজাত তথা স্তর অত্যন্ত নিচে পড়ে রইবে।


ب ـ الطبقة العُليا من علوم اللُّبَاب

وأما الطبقة العليا من نَمَطِ اللُّباب فهي السوابقُ والأصولُ من العلوم المُهِمَّة، وأشرَفُها العلمُ باللهِ واليوم الآخر لأنه علم المَقْصِد، ودونَهُ العلم بالصراط المستقيم وطريق السلوك، وهو معرفةُ تزكية النفس، وقطعُ عقبات الصفات المُهلِكات، وتَحْلِيَتُها بالصفات المُنَجِّيَات، وقد أودعنا هذه العلوم بِكُتُب ((إحياء علوم الدين)) ففي رُبْعِ المُهلِكات ما تجب تزكية النفس منه، من الشَّرَهِ والغضب، والكِبر والرِّياءِ والعجب، والحسد وحب الجاه وحب المال وغيرها، وفي رُبع المُنجيات يظهر ما يتحلَّى به القلب من الصفات المحمودة كالزهد والتوكل والرضا والمحبة والصدق والإخلاص وغيرها.

وبالجملة يشتمل كتاب ((إلاحياء)) على أربعين كتاباً يرْشدك كل كتاب إلى عَقَبةٍ من عقبات النفس، وأنها كيفَ تُقْطَع وإلى حجابٍ من حُجُبِهَا، وأنه كيف يُرْفَع، وهذا العلم فوقَ علم الفقه والكلام وما قبله، لأٰنه علم طريق السلوك، وذلك علم آلة السلوك وإصلاح منازله ودفع مُفسداته كما يظهر، والعلم الأعلى الأشرفُ عِلمُ معرفة الله تعالى، فإن سائر العلوم تُرادُ له ومن أجله وهو لا يُراد لغيره، وطريق التدريج فيه التَّرَقِّي من الأفعال إلى الصفات، ثم من الصفات إلى الذات.


অর্থ: (আল-কুর’আনের) তরুমজ্জাগত জ্ঞানের উচ্চতর তবকা তথা স্তরটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাশাস্ত্রে, যেগুলো (ইতিপূর্বে উল্লেখিত তিনটি জ্ঞানের শাখার) উসূল বা উৎসমূল। এই উচ্চস্তরের বিদ্যাগুলোর মধ্যে আশরাফ বা সর্বোৎকৃষ্ট হলো আল্লাহতায়ালা-সম্পর্কিত জ্ঞান ও আখেরাত দিবসের জ্ঞান; কেননা এই জ্ঞানই (আল্লাহ কর্তৃক) উদ্দিষ্ট হয়েছে। এর পরের স্তরে রয়েছে সিরাতুল মুস্তাকীম তথা সহজ-সরল/সঠিক রাস্তার জ্ঞান (العلم بالصراط المستقيم) এবং তা পরিক্রমণের উপায় (طريق السلوك)। এই জ্ঞান হচ্ছে (ক) নফস/একগুঁয়ে (জীব) সত্তা পরিশুদ্ধকরণ ও ক্ষতিকর ত্রুটি অপসারণ-সংক্রান্ত; এবং (খ) আত্মাকে পরিত্রাণের গুণাবলী দ্বারা সুশোভিতকরণ-বিষয়ক। আমরা এ সকল জ্ঞান ‘এহইয়াও উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থের (চল্লিশটি) কিতাবে আলোচনা করেছি [নোট: এহইয়া গ্রন্থটি চারটি ভাগে বিভক্ত, যার প্রতিটিকে ‘রুবউ’ তথা এক-চতুর্থাংশ বলা হয়; প্রতিটি রুবউ আবার দশটি ভাগে বিভক্ত, যার প্রতিটিকে কিতাব/পুস্তক বলা হয়। এহইয়া কেন চারটি ভাগে বিভক্ত, তা জানতে দেখুন - এহইয়া, ১ম খণ্ড, ৩-৪ পৃষ্ঠা; নাবিহ আমীন ফারিস কৃত The Ihya Ulum al-Din of al-Ghazzali, Proceedings of the American Philosophical Society, LXXI (1959), 15-19]। অতঃপর গ্রন্থটির ‘রুবউল্ মুহলিকাত’ (رُبْع المُهلِكات) বা বিনাশক এক-চতুর্থাশে সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যেগুলো থেকে আত্মার পরিশুদ্ধি অত্যাবশ্যক; এগুলো হচ্ছে লোভ-লালসা, ক্রোধ, দম্ভ/আত্মম্ভরিতা, রিয়া/প্রদর্শনী, হাসদ/হিংসা, ক্ষমতার লোভ, ধনসম্পদের লোভ ইত্যাদি। রুবউল মুনজিয়াত তথা পরিত্রাণের এক-চতুর্থাংশে রয়েছে প্রশংসাযোগ্য গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী, যা দ্বারা কলব্ তথা অন্তরাত্মাকে সুশোভিত করতে হবে; এগুলো হচ্ছে যুহদ/কৃচ্ছ্রব্রত, তাওয়াক্কুল/আল্লাহর ওপর আস্থা, খোদার সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টি, তাঁর প্রতি এশক-মহব্বত, সত্যবাদিতা, ইখলাস/নিষ্ঠা ইত্যাদি। সংক্ষেপে, এহইয়া গ্রন্থে চল্লিশটি কিতাব বিদ্যমান, যার প্রতিটি আপনাকে নফসের এক-একটি বাধা অতিক্রমে পথপ্রদর্শন করবে এবং এর পাশাপাশি তা অপসারণের পন্থাও বাতলে দেবে; অধিকন্তু, নফসের এক-একটি পর্দা অতিক্রমেও পথপ্রদর্শন করবে এবং এর পাশাপাশি ওই পর্দা উত্তোলনের পন্থাও দেখিয়ে দেবে। এই বিদ্যাশাস্ত্রটি ফিক্বাহ/ধর্মীয় বিধানশাস্ত্র, কালাম/ধর্মশাস্ত্র ও এগুলোর পূর্ববর্তী যাবতীয় বিদ্যার চেয়েও উচ্চস্তরের, কেননা এই জ্ঞানের শাখাটি (খোদ) আল্লাহর (দিকে অগ্রসরমান) পথে চলার উপায়/পন্থা (لأٰنه علم طريق السلوك); অথচ অন্যান্য জ্ঞানের শাখাগুলো হচ্ছে (স্রেফ) পথটি অতিক্রমের হাতিয়ার ও পথের পর্যায়গুলোতে সংশোধন সাধনের পন্থা এবং তাতে দূষণকারী দেখা দিলে তাদেরকে প্রতিহতকরণ। সবচেয়ে উঁচুস্তরের ও মহত্তম জ্ঞান হচ্ছে আল্লাহতায়ালাকে জানা; কেননা অন্যান্য সকল ধরনের জ্ঞান এই জ্ঞানান্বেষণের খাতিরেই করা হয়ে থাকে, অথচ এই জ্ঞান অন্য কোনো কিছুর খাতিরে অন্বেষণ করা হয় না। এ জ্ঞানের দিকে অগ্রগতির পদ্ধতি/পন্থা হলো ঐশী ক্রিয়া হতে ঐশী সিফাত বা গুণাবলীর দিকে অগ্রসর হওয়া, এরপর ঐশী সিফাত হতে খোদার যাত তথা সত্তা মোবারকের দিকে অগ্রসর হওয়া।


فهي ثلاث طبقات: أعلاها علم الذات، ولا يحتملها أكثر الأفهام، ولذلك قيل لهم ((تفكَّروا في خلق الله ولا تفكَّروا في ذات الله)). وإلى هذا التدريج يشير تَدَرُّج رسولِ الله صلى الله عليه وسلم في ملاحظته ونَظَرِهِ حيث قال: ((أعوذُ بِعَفْوِكَ من عقابك)) فهذه ملاحظة الفعل؛ ثم قال: ((وأعوذُ برضاكَ من سَخَطِك)) وهذه ملاحظة الصفات؛ ثم قال: ((وأعوذُ بك منك)) وهذه ملاحظة الذات؛ فلم يزل يترقَّى إلى القُرب درجةً درجة، ثم عند النهاية اعترف بالعجز فقال: ((لا أُحصِي ثناءً عليكَ أنتَ كما أثنَيْتَ على نفسك)) فهذا أشرف العلوم.


অর্থ: অতঃপর এর রয়েছে তিনটি তবকা/স্তর: সর্বোচ্চ স্তর হলো আল্লাহর মোবারক যাত/সত্তার জ্ঞান; আর তা অধিকাংশ মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা অসম্ভব। এ কারণেই তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে - “আল্লাহর সৃষ্টিকুল নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন হও, তাঁর যাত মোবারক নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন হয়ো না” [নোট: অজ্ঞাত সূত্র - ((تفكَّروا في خلق الله ولا تفكَّروا في ذات الله))]। এই অগ্রগতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনার ক্ষেত্রে, যখনই তিনি বলেছিলেন, “ (হে আল্লাহ) আমি আপনার শাস্তি থেকে আপনারই ক্ষমার (মাঝে) আশ্রয় চাই” [নাসাঈ কৃত ‘সুনান, ‘ইস্তিয়া’যাহ,’ ৬২ - ((أعوذُ بِعَفْوِكَ من عقابك))]। এটাই আল্লাহর ঐশী ক্রিয়া সম্পর্কে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পর্যবেক্ষণ। অতঃপর তিনি ফরমান, “আমি আপনার অসন্তুষ্টি হতে আপনারই রেযামন্দি/সন্তুষ্টির (মাঝে) আশ্রয় চাই” [((وأعوذُ برضاكَ من سَخَطِك))]। এটা খোদায়ী সিফাত/গুণের পর্যবেক্ষণ। অতঃপর তিনি বলেন, “আমি আপনার থেকে আপনারই (কাছে) আশ্রয় চাই” [((وأعوذُ بك منك))]। এটা খোদায়ী যাত/সত্তা মোবারক সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ। ফলে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর নৈকট্যের দিকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তিনি চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরে (ভাষায় প্রকাশে) তাঁর অক্ষমতা ব্যক্ত করেন এই বলে, “(হে আল্লাহ) আমি আপনার সানা-সিফাত (প্রশংসাস্তুতি) বুঝতে অক্ষম, আপনি তা-ই যা আপনি নিজেই নিজের সম্পর্কে প্রশংসাস্তুতি ব্যক্ত করেছেন” [সহীহ মুসলিম, সালাত, ২২২; তিরমিযী, সুনান, দা’ওয়াত, ৭৫, ১১২; নাসাঈ, সুনান, তহারাহ, ১১৯; আবূ দাউদ, সুনান, সালাত, ১৪৮; ইবনে মাজাহ, সুনান, ইক্বামাহ, ১১৭ - ((لا أُحصِي ثناءً عليكَ أنتَ كما أثنَيْتَ على نفسك))]।


ويتلوه في الشَّرف عِلُم الآخرة وهو علم المَعَاد كما ذكرناه في الأقسام الثلاثة وهو متصل بعلم المعرفة، وحقيقته معرفة نسبة العبد إلى الله تعالى عند تحقُّقِهِ بالمعرفة، أو مصيرهِ محجوباً بالجهل. وهذه العلوم الأربعة، أعني (١) علم الذات (٢) والصفات (٣) والأفعال (٤) وعلم المعاد، أَودَعنا من أوائله ومَجامِعِهِ القدرَ الذي رُزِقنا منه، مع قِصَرِ العُمر وكثرة الشَواغل والآفات، وقلة الأَعوان والرُفقاء، بعضَ التَّصانيف لكنا لم نُظهره، فإنه يَكَلُّ عنه أكثرُ الأفهام، ويَسْتَضِرُّ به الضعفاء، وهم أكثر المُتَرَسِّمينَ بالعلم، بل لا يصلح إظهاره إلا على من أتقنَ علم الظاهر، وسلك في قَمع الصفات المذمومة من النفس وطُرقِ المجاهدة، حتى ٱرتَاضَت نفسُهُ واستقامت على سواء السبيل، فلم يبقَ له حظٌ في الدنيا، ولم يبق له طلبٌ إلاّ الحق، ورُزِقَ مع ذلك فطنة وَقَّادة، وقريحةً مُنقادَة وذكاءً بليغاً، وفهماً صافياً، وحرام على من يقع ذلك الكتاب بيده أن يُظهره إلاَّ على من ٱستَجْمَعَ هذه الصفات، فهذه هي مجامع العلم التي تتشعب من القرآن ومراتبها.


অর্থ: এটা (মানে আল্লাহকে জানা) সকল জ্ঞানের মধ্যে সেরা, আর এর পরের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে পরকালীন জীবনসম্পর্কিত জ্ঞানের, যা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তনের জ্ঞান, যেমনটি আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি (আল-কুর’আনের) তিন কিসিমের শাখাবিষয়ক আলোচনায় [দেখুন-সূচিপত্রে]। এই জ্ঞানটি ইলমুল মা’রিফাত তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাথে জড়িত; আর এটার প্রকৃত মানে আল্লাহতায়ালার সাথে বান্দার সম্পর্কের জ্ঞান, তা (ঠিক) ওই সময়কালে যখন তিনি জ্ঞানের মাধ্যমে তাঁর প্রতি ঘনিষ্ঠ হন; অথবা অজ্ঞতার দরুন (আল্লাহ হতে) পর্দাবৃত থাকেন। এই চার ধরনের জ্ঞান নিম্নরূপ: (১) আল্লাহর যাত তথা সত্তা মোবারকের জ্ঞান; (২) তাঁর সিফাত বা গুণাবলীর জ্ঞান; (৩) তাঁর ক্রিয়ার জ্ঞান; এবং (৪) ভবিষ্যত/পরকালীন জীবনের জ্ঞান - আর এগুলোর একত্র প্রবহন ওই জ্ঞানের মাপকাঠি যা আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে রিযিক্কস্বরূপ আমাদেরই এ সংক্ষিপ্ত জীবন সত্ত্বেও; (পাশাপাশি) অনেক কাজ ও দুর্যোগ (অথচ) স্বল্প সংখ্যক সাহায্যকারী ও সাথীবৃন্দ নিয়ে আমরা আমাদের কিছু কর্ম আরম্ভ করেছি, কিন্তু তা প্রকাশ করিনি [নোট: এটা মনে হয় হুজ্জাতুল ইসলাম রহিমাহুল্লাহ’র ‘আল-মাদনূন বিহি ‘আলা গায়রি আহলি’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রতি ইঙ্গিত করেছে, যা কায়রোতে প্রকাশিত হয় ১৩০৯ হিজরী সালে। এ বইটি ‘এহইয়া’ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করে এবং খোদ ‘চল্লিশটি পুস্তক’ শিরোনামের বইয়ে উল্লেখিত হয়েছে]। (এই প্রকাশ না করার কারণ) অধিকাংশ মানুষের উপলব্ধি ক্ষমতা এর দ্বারা হয়রান হয়ে যাবে; আর দুর্বল যারা ‘মুতারাসসিমীন বিল ইলম’ (المُتَرَسِّمين بالعلم) তথা জ্ঞানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে চিরাচরিত (ধাঁচের), তারা এটা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিশ্চয় এর প্রকাশ তাঁর জন্যেই কেবল উপকারী হতে পারে, যিনি তাঁর ইলমুয্ যাহির তথা বাহ্যিক (শরঈ) জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ করেছেন; আর নিজের নফসানী মন্দ আকাঙ্ক্ষাগুলো অপসারণ করে এবং রিপুদমনের পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে আল্লাহর দিকে (অগ্রসরমান) রাস্তার অনুসরণ করেছেন - তা এমনই পর্যায়ে যে এর ফলে তাঁর নফস প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছে এবং সহজ-সরল রাস্তার ওপরে তা উত্তম অবস্থায় আছে, যার দরুন দুনিয়ার (দূষণীয় দিকগুলোতে) তাঁর মোহ নেই এবং তিনি একমাত্র হক্কতায়ালার অন্বেষণে ব্যাপৃত। অধিকন্তু, তাঁকে মঞ্জুর করা হয়েছে আলোকিত বিচক্ষণতা, প্রকৃতিগত গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, তীক্ষ্ণ ধীশক্তি ও স্পষ্ট উপলব্ধি। যেসব মানুষের ওই বইটি হস্তগত হয়, তাঁদের জন্যে তা (সবার কাছে) প্রকাশ করা হারাম/অবৈধ কেবল সেই ব্যক্তির ব্যতিক্রম ছাড়া, যিনি এসব গুণগত বৈশিষ্ট্যের সমাহার নিজের মধ্যে ঘটাতে পেরেছেন।


অতঃপর এই বিদ্যাগুলোর সমষ্টি আল-কুর’আন ও তার মর্তবা/স্তরগুলো হতে বিস্তৃত হয়েছে।


الفصل الخامس: في ٱنْشِعَابِ سائر العلوم من القرآن

পঞ্চম অধ্যায়: কুর’আন হতে বিস্তৃত প্রাচীন ও আধুনিক বিদ্যাসমূহ


আপনি হয়তো বলবেন: (আমায় বলুন, আপনি কেন জ্ঞান/বিদ্যাসমূহকে স্রেফ এগুলোতে সীমাবদ্ধ করেছেন, যেখানে) এগুলোর পাশাপাশি আরো অনেক বিদ্যা বিরাজমান; যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র, সৌর বা নক্ষত্ররাজির বিদ্যা, জগতের আকার-আকৃতিবিষয়ক জ্ঞান, প্রাণির আকার ও শারীরিক গঠনতন্ত্র বিদ্যা, আর জাদুবিদ্যা ও তাবীজ ইত্যাদি (ولعلَّكَ تقول: إن العلوم وراءَ هذه كثيرة، كعلم الطب والنجوم وهيئة العالم، وهيئة بَدَنِ الحيوان وتشريح أعضائه، وعلم السِّحر والطَّلَّسْمات وغير ذلك)। [নোট: উলূম/জ্ঞানসমূহ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে; সূচিপত্রে সমন্বয় সাধন করা হবে] 


فاعلم: أنَّا إنما أشرنا إلى العلوم الدينية التي لا بد من وجود أصلها في العالم، حتى يتيسر سلوكُ طريق الله تعالى والسفر إليه. أما هذه العلوم التي أشرتُ إليها فهي علوم، ولكن لا يتوقف على معرفتها صلاح المَعَاش والمَعَاد، فلذلك لم نذكرها، ووراءَ ما عَدَدْتهُ علومٌ أُخرَ يُعلَم تَراجِمُها ولا يخلو العالم عمن يعرفها، ولا حاجة إلى ذكرها.


অর্থ: (জিজ্ঞাসার উত্তর হিসেবে) জেনে রাখুন, আমরা কেবল ধর্মীয় বিদ্যাশাস্ত্রগুলোরই প্রতি ইঙ্গিত করেছি, যেগুলোর অস্তিত্বের উৎস এ জগতে বিরাজ করা অত্যাবশ্যক, যাতে আল্লাহর দিকে (অগ্রসরমান) পথটি অতিক্রম এবং তাঁরই দিকে সফর করা সহজ হয়। আপনি যেসব বিদ্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন সেগুলো বিদ্যাশাস্ত্র বটে; কিন্তু ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের মঙ্গল সেসব জ্ঞানের শাখার ওপর নির্ভর করে না। আর এ কারণেই আমরা সেগুলোর উল্লেখ করিনি। আপনি যেসব বিদ্যার হিসেব দিয়েছেন, সেগুলো ছাড়াও (আরো) অন্যান্য বিদ্যা বিরাজমান, যেগুলোর অর্থ জ্ঞাত এবং যাঁরা তা জানেন এ জগৎ তাঁদের অস্তিত্ব হতে শূন্য নয়; আর সেগুলো সম্পর্কে উল্লেখেরও কোনো প্রয়োজন নেই।


بل أقول: ظهر لنا بالبصيرة الواضحة التي لا يُتَمَارَى فيها أن في الإمكان والقوة أصنافاً من العلوم بعد لم تخرج من الوجود، وإن كان في قوة الآدَمِيِّ الوصول إليها؛ وعلومٌ كانت قد خرجت إلى الوجود وٱنْدَرَسَت الآن، فَلَنْ يوجد في هذه الأعصار على بسيط الأرض من يعرفها؛ وعلومٌ أُخَر ليس في قوة البشر أصلاً إدراكُها والإحاطة بها، ويحظَى بها بعضُ الملائكة المُقَرَّبين، فإن الإمكان في حق الآدَمِيِّ محدود، والإمكانَ في حق المَلَك محدود إلى غاية في الكمال بالإضافة، كما أنه في حق البهيمة محدود إلى غاية في النقصان، وإنما الله سبحانه هو الذي لا يَتَنَاهَى العلمُ في حقه، ويفارق عِلمَناَ عِلْمُ الحقِّ تبارك وتعالى في شيئين: أحَدُهما انتفاءُ النهاية عنه، والآخَرُ أن العلوم ليست في حقه بالقوة والإمكان الذي يُنْتَظَرُ خروجُه بالوجود، بل هو بالوجود والحُضُور، فكل مُمْكِنٍ في حقه من الكمال فهو حاضرٌ موجود.


অর্থ: বরঞ্চ আমি বলবো: সন্দেহমুক্ত পরিষ্কার অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে সম্ভাব্যতা ও সক্ষমতায় এমন সব বিদ্যা রয়েছে যা এখনো অস্তিত্বশীল হয়নি, যদিও তা মানুষের বোধগম্য হবার সামর্থ্যে রয়েছে। এমনও অন্যান্য বিদ্যা রয়েছে যা (এক সময়) অস্তিত্বশীল হয়েছিলো, কিন্তু বর্তমানে যা বিলুপ্ত হয়েছে, যার দরুন যে ব্যক্তি এ বিদ্যা জানতেন তাঁকেও এ দুনিয়ার বুকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। (অধিকন্তু) এমনও অন্যান্য বিদ্যা রয়েছে, যেগুলোর উপলব্ধি ও অর্জন ক্ষমতা মানুষের আয়ত্তে নেই, বরং যেগুলো কতিপয় (মুকার্রাবীন) ফেরেশতার অধিকারে রয়েছে যাঁরা (আল্লাহর) নিকটবর্তী; কেননা মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা সীমিত, অথচ ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে এটা আপেক্ষিক সর্বোচ্চ কামালাত তথা পূর্ণতার গণ্ডিভুক্ত [নোট: আল্লাহর সৃষ্টিকুলে কেবল ফেরেশতা, মানুষ ও জ্বিন জাতি বুদ্ধি-বিবেচনা দ্বারা আশীর্বাদধন্য; (সাধারণ) মানুষের অবস্থান ফেরেশতাদের নিচে, যাঁদের গুণাবলী অর্জনের চেষ্টা মানুষকে করতে হয়। দেখুন - আল্ গাজ্বালী বিরচিত ‘এহইয়া’ ১ম খণ্ড, ২৩৬ পৃষ্ঠা]; আর প্রাণির ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে অপূর্ণতার মাঝে সীমিত। শুধু আল্লাহই হন সে পবিত্র সত্তা, যাঁর জ্ঞানের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই; আর আমাদের জ্ঞান দুটো ক্ষেত্রে হক্ক-তায়ালার জ্ঞান থেকে পৃথক হয়ে যায়: প্রথমটি এর সর্বোচ্চ মাত্রার (ক্ষেত্রে) নাকচ দ্বারা; আর দ্বিতীয়টি আল্লাহর ক্ষেত্রে জ্ঞানের সম্ভাব্যতা ও সক্ষমতা অস্তিত্ব পাবার জন্যে অপেক্ষমান নয়; বরঞ্চ সেগুলো ইতোমধ্যেই অস্তিত্বশীল ও উপস্থিত (بل هو بالوجود والحُضُور) - আল্লাহর ক্ষেত্রে পূর্ণতার প্রতিটি সম্ভাবনাই উপস্থিত ও অস্তিত্বশীল (হাজির ও মওজূদ)।


ثم هذه العلوم ما عددناها وما لم نعدها ليست أوائِلُها خارجةً عن القرآن، فإن جميعها مُغْتَرَفَةٌ من بحر واحد من بحار معرفة الله تعالى، وهو بحرُ الأفعال، وقد ذكرنا أنه بحرٌ لا ساحلَ له، وأن البحر لو كان مداداً لكلماته لنَفِدَ البحر قبل أن تَنْفَد. فمن أفعال الله تعالى وهو بحرُ الأفعال مثلاً الشفاء والمرض، كما قال الله تعالى حكايةً عن إبراهيم عليه السلام: ((وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ)). وهذا الفعل الواحد لا يعرفه إلا من عرف الطِبَّ بكماله، إذ لا معنى للطب إلا معرفةُ المرضِ بكماله وعلاماته، ومعرفةُ الشفاء وأسبابه، ومن أفعاله تبارَكَ وتعالى تقديرُ معرفة الشمس والقمر ومنازِلِهما بِحُسبان، وقد قال الله تعالى: ((ٱلشَّمْسُ وَٱلْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ))؛ وقال: ((وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُواْ عَدَدَ ٱلسِّنِينَ وَٱلْحِسَابَ))؛ وقال: ((وَخَسَفَ ٱلْقَمَرُ وَجُمِعَ ٱلشَّمْسُ وَٱلْقَمَرُ))؛ وقال: ((يُولِجُ ٱلْلَّيْلَ فِي ٱلنَّهَارِ وَيُولِجُ ٱلنَّهَارَ فِي ٱلْلَّيْلِ))؛ وقال: ((وَٱلشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَـا ذَلِكَ تَقْدِيرُ ٱلْعَزِيزِ ٱلْعَلِيمِ)). ولا يعرف حقيقة سَيْر الشمسِ والقمرِ بِحُسبان، وخُسوفِهما وَوُلُوجِ الليلِ في النهار، وكيفيةَ تَكَوُّرِ أحدهما على الآخر، إلا من عرف هيئاتِ تركيبِ السَّموَات والأرض، وهو علم برأسه.


অর্থ: আমরা যেসব জ্ঞানের হিসেব দিয়েছি এবং যেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করিনি, সেগুলোর নীতিমালা আল-কুর’আনের বাইরে নয়; কেননা এ সকল বিদ্যা আল্লাহতায়ালারই জ্ঞানের সমুদ্রগুলোর একটি হতে নিষ্কোষিত হয়েছে, আর তা হলো তাঁরই ক্রিয়াসমূহের জ্ঞান। আমরা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি যে আল-কুর’আন হচ্ছে এমন এক সাগর যার কোনো সৈকত নেই; আর এও বলেছি কুর’আনী ভাষায় - “(হে রাসূল বলে দিন), যদি সমুদ্র আমার রবের বাণীসমূহ লেখার জন্যে কালি হয়, তবে অবশ্যই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে আর আমার রবের বাণীসমূহ শেষ হবে না” [আল-কুর’আন, ১৮/১০৯; নূরুল ইরফান]। আল্লাহতায়ালার কাজগুলো, যা সমুদ্রতুল্য বিশালতাসম জ্ঞান বলে আখ্যাদানকৃত, তার মধ্যে রয়েছে উদাহরণস্বরূপ, আরোগ্য/শিফা ও রোগব্যাধি, যেমনটি আল্লাহতায়ালা পয়গাম্বর ইবরাহীম (আলাইহিস্ সালাম)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, “এবং আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন” [আল-কুর’আন, ২৬/৮০; নূরুল ইরফান]। এই একটি কাজ কেবল এমন একজনের পক্ষে জানা সম্ভব, যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে পুরোপুরি জ্ঞানী। কেননা এই বিদ্যার মানে আর কিছু নয়, স্রেফ রোগ-ব্যাধির সকল দিক ও তার পাশাপাশি সেগুলোর লক্ষণ, আর সেগুলোর নিরাময় ও নিরাময়ের মাধ্যম/কারণসমূহ। আল্লাহতায়ালার ক্রিয়ার মধ্যে (আরো) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সূর্য ও চন্দ্র এবং সেগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাপারে (মানবের) জ্ঞান নির্ধারণ, যেমনটি তিনি ঘোষণা করেছেন, “সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব (নিয়ম) অনুসারে রয়েছে” [আল-কুর’আন, ৫৫/৫; নূরুল ইরফান]। তিনি আরো ঘোষণা করেছেন, “(আল্লাহই হন তিনি), যিনি চাঁদের জন্যে ‘মানযিল/পর্যায়গুলো’ নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছরগুলোর গণনা ও হিসাব জানতে পারো” [আল-কুর’আন, ১০/৫; নূরুল ইরফান]। তিনি আরো ঘোষণা করেছেন, “এবং চাঁদে গ্রহণ লাগবে, আর সূর্য ও চাঁদকে একত্রিত করা হবে; সেদিন মানুষ বলবে, পলায়ন করে কোথায় যাবো” [আল-কুর’আন, ৭৫/৮-১০; নূরুল ইরফান]। আল্লাহ আরো ফরমান, “(তিনি) রাতকে প্রবেশ করান দিনের অংশে এবং দিনকে প্রবেশ করান রাতের অংশে” [আল-কুর’আন, ৩৫/১৩; নূরুল ইরফান]। উপরন্তু, তিনি বলেন, “এবং সূর্য ভ্রমণ করে থাকে আপন এক অবস্থানের দিকে; এটা হচ্ছে নির্দেশ (মহা) পরাক্রমশালী, জ্ঞানময়ের” [আল-কুর’আন, ৩৬/৩৮; নূরুল ইরফান]। সূর্য ও চন্দ্রের নির্ধারিত কক্ষপথে পরিক্রমণ ও উভয়ের গ্রহণ, আর রাতকে দিনের সাথে একত্রিকরণ ও পরস্পরের মাঝে মোড়ানোর প্রকৃতিবিষয়ে জ্ঞানের আসল মানে স্রেফ সেই ব্যক্তির পক্ষেই জানা সম্ভব, যিনি আসমান ও জমিনের গঠনপ্রকৃতি সম্পর্কে জানেন; আর এটা নিজেই একটা বিদ্যা (জ্যোতির্বিজ্ঞান)। 


ولا يعرف كمالَ معنى قوله تعالى: ((يٰأَيُّهَا ٱلإِنسَٰنُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ ٱلْكَرِيمِ ٱلَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ فِيۤ أَيِّ صُورَةٍ مَّا شَآءَ رَكَّبَكَ)) إلا من عرفَ تشريحَ الأعضاء من الإنسان ظاهراً وباطناً، وعددَها وأنواعَها وحكمتَها ومنافِعَها، وقد أشار في القرآن في مواضِعَ إليها، وهي من علوم الأوَّلين والآخِرين، وفي القرآن مَجامِعُ علم الأوَّلين والآخِرين.


وكذلك لا يعرف كمالَ معنى قوله تعالى ((سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي)) مَنْ لم يعلم التَّسْوِيَة والنَّفْخَ والرُّوح، وَوراءَها علومٌ غامضة يغفل عن طلبها أكثرُ الخلق، وربما لا يفهمونها إن سمعوها من العالِمِ بها، ولو ذهبتُ أُفَصِّل ما تدل عليه آيات القرآن من تفاصيل الأفعال لَطال، ولا تمكن الإشارة إلا إلى مَجَامِعها، وقد أشرنا إليه حيث ذكرنا أن من جملة معرفة الله تعالى معرفة أفعاله، فتلك الجملة تشتمل على هذه التفاصيل، وكذلك كل قسم أجملناه لو شُعِّبَ لٱنشَعَبَ إلى تفاصيلَ كثيرة، فتفكَّر في القرآن والتمس غرائِبَه، لِتصادف فيه مَجامِع علم الأَوَّلين والآخرين، وجملةَ أوائله، وإنما التفكر فيه للتوصل من جملته إلى تفصيله وهو البحر الذي لا شاطىءَ له.


অর্থ: অনুরূপভাবে, “হে মানুষ! তোমাকে কোন্ জিনিস ধোঁকা দিয়েছে (ভুলিয়ে রেখেছে) আপন করুণাময় রব থেকে? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন, অতঃপর সুসমঞ্জস করেছেন, যে আকৃতিতেই চেয়েছেন, তোমাকে গঠন করেছেন” [৮২/৬-৮; নূরুল ইরফান] - আল্লাহতায়ালার এ বাণীর সম্পূর্ণ মানে কেবল সে ব্যক্তিই জানতে পারেন, যিনি মানবের হাত-পা, অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও সেগুলোর সংখ্যা, সেগুলোর প্রকারভেদ, সেগুলোতে অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা এবং সেগুলোর ব্যবহার ইত্যাদি শারীরিক গঠনতন্ত্র সম্পর্কে সম্যক অবগত। আল্লাহতায়ালা এগুলো সম্পর্কে আল-কুর’আনের অনেক স্থানে ইঙ্গিত করেছেন; আর এতদসংক্রান্ত জ্ঞান প্রাচীন ও আধুনিকদের বিদ্যাশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত [নোট: ‘প্রাচীন ও আধুনিকদের বিদ্যাশাস্ত্র’ বাক্যটি সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোকপাত করা হয়েছে]। (বস্তুতঃ) কুর’আন মজীদে প্রাচীন ও আধুনিকদের বিদ্যাশাস্ত্রের একত্র প্রবহন নিহিত। 


একইভাবে, “আমি সেটাকে (মানে আদমের কায়াকে) ঠিক করে নিই এবং সেটার মধ্যে আমার নিকট থেকে বিশেষ সম্মানিত রূহ ফুৎকার দিই” [আল-কুর’আন, ১৫/২৯; নূরুল ইরফান] - আল্লাহতায়ালার এ বাণীর সম্পূর্ণ মানে ততোক্ষণ জানা যাবে না, যতোক্ষণ না (কায়ার) আকৃতি, নিঃশ্বাস ও আত্মা সম্পর্কে জানা যায়। এগুলোর পেছনে এমন সব অস্পষ্ট বিদ্যাশাস্ত্র আছে, যার কাজ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই গাফেল/উদাসীন; কখনো কখনো তারা এমন কী এসব বিদ্যাশাস্ত্র উপলব্ধি করতেও ব্যর্থ হয়, যদি তারা এগুলো সম্পর্কে জ্ঞানী কারো কাছ থেকেও শুনতে পায়। কুর’আন মজীদের আয়াতসমূহ যে ঐশী ক্রিয়াগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে, আমি সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গেলে দীর্ঘ সময় নেবে। (এখানে) সেগুলোর একত্র প্রবহনের স্রেফ একটি ইঙ্গিত (দেয়া) সম্ভব, আর আমরা এটা করেছি যেখানে আমরা উল্লেখ করেছি যে ঐশী ক্রিয়ার জ্ঞান আল্লাহতায়ালার জ্ঞানের পুরো যোগফলের অন্তর্গত (অংশ)। ওই পুরো যোগফলে এসব বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে, আমরা সংক্ষিপ্তভাবে প্রতিটি বিভাগের যে বর্ণনা দিয়েছি, সেগুলোকে আরো বিভক্ত করলে অনেকগুলো বর্ণনার শাখায় বিস্তৃত হবে। অতঃপর কুর’আন মজীদের প্রতি গভীর চিন্তাভাবনা করুন এবং এর চমৎকার অর্থগুলো অন্বেষণ করুন, যাতে সৌভাগ্যক্রমে আপনি সাক্ষাৎ পেতে পারেন প্রাচীন ও আধুনিকদের বিদ্যার একত্র প্রবহন এবং সেগুলোর সূচনার পুরো যোগফল। কুর’আন পাক সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনার উদ্দেশ্যই কেবল এসব বিদ্যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হতে এগুলোর বিস্তারিত জ্ঞানে পৌঁছুনো, যা একটি সৈকতহীন মহাসাগরসদৃশ।


الفصل السادس: في وَجْهِ التَّسْمِيَة بالأَلْقَاب التي لُقِّبَ بها أقسامُ القرآن

ষষ্ঠ অধ্যায়: কুর’আন মজীদে অন্তর্ভুক্ত লাল গন্ধক, সেরা প্রতিষেধক, সবচেয়ে শক্তিশালী কস্তুরী ও অন্যান্য সকল কিসিমের রত্নভাণ্ডার মর্মে বক্তব্যের ব্যাখ্যা


ولعلك تقول: أشرتَ في بعض أقسام العلوم إلى أنه يوجد فيها التِّرياقُ الأكبر، وفي بعضها المسك الأَذْفَر وفي بعضها الكبريت الأحمر، إلى غير ذلك من النفائس، فهذهِ ٱستِعَارات رسمية تحتها رُموز وإشارات خفية.


আর হয়তো আপনি বলবেন: আপনি (মানে হুজ্জাতুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহি) বিদ্যাসমূহের কিছু কিসিমে (ইতিমধ্যে ৩য় অধ্যায়ের আলোচনায়) ইঙ্গিত করেছেন যে সেগুলোর কিছু কিছুতে পাওয়া যায় সেরা প্রতিষেধক (التِّرياقُ الأكبر), অন্যগুলোতে সবচেয়ে শক্তিশালী কস্তুরী (المسك الأَذْفَر), (আবার) আরো কিছুতে লাল গন্ধক (الكبريت الأحمر) ও অন্যান্য রত্ন; এগুলো হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী রূপক (ٱستِعَارات رسمية), যা’তে অন্তর্নিহিত রয়েছে লুকোনো চিহ্ন ও গোপন ইশারা/ইঙ্গিত। [এগুলো আমার বোঝার খাতিরে অনুগ্রহ করে উন্মুক্ত করুন]


فاعلم: أن التَكَلُّف والتَرَسُّم ممقوت عند ذوي الجد، فما كلمة طَمْسٍ إِلا وتحتها رُموز وإشارات إلى معنى خفيّ، يدركها من يدرك الموازنة والمناسبة بين عالَمِ المُلْكِ وعالَمِ الشهادة وبين عالَمِ الغَيْبِ والمَلَكُوت، إذْ ما مِن شيء في عَالَمِ المُلْكِ والشَّهادة إلا وهو مِثال لأمرٍ روحاني من عالَمِ المَلكوت كأنه هو في روحه ومعناه، وليس هُوَ هُوَ في صورته وقالبه، والمِثال الجِسماني من عالَم الشهادة مُنْدَرِج إلى المعنى الروحاني من ذلك العالم، ولذلك كانت الدنيا منزلًا من منازل الطريق إلى الله ضرورياً في حق الانس، إِذ كما يستحيل الوصول إلى اللُبِّ إلا من طريق القِشر فيستحيل التَرَقِّي إلى عالم الأرواح إلا بمثال عالَمِ الأجسام، ولا تُعَرف هذه الموازنة إلا بمثال، فانظروا إلى ما ينكشف للنائم في نَومه من الرؤيا الصحيحة التي هي جزء من ستة وأربعين جزأً من النبوة، وكيف ينكشف بأمثلة خيالية، فمن يُعلِّم الحكمةَ غيرَ أهلِها يرى في المنام أنه يُعلق الدُرَّ على الخنازير. ورأى بعضهم: أنه كان في يده خاتم يختم به فروجَ النساء وأفواهَ الرجال، فقال له ٱبنُ سيرين: أنت رجل تؤذن في رمضان قبل الصبح، فقال: نعم. ورأى آخر: كأنه يَصُبُّ الزَيت في الزيتون، فقال له: إن كان تحتك جارية فهي أمك، قد سُبِيَتْ وَبيعَت وٱشتريتَها أنتَ ولا تعرف، فكان كذلك.


জেনে রাখুন, (প্রদর্শনীপূর্ণ) অনুভূতি ও ঐতিহ্যবাদ ঐকান্তিক প্রয়াসী মানুষদের কাছে ঘৃণিত। ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্যে রয়েছে লুকোনো গোপন অর্থের চিহ্ন ও ইঙ্গিত যা সেই ব্যক্তির কাছে বোধগম্য, যিনি পার্থিব জগৎ ও প্রত্যক্ষকরণের জগৎ এবং গায়ব/অদৃশ্যের জগৎ ও (প্রভুর) রাজত্বের জগতের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবন করতে পারেন; কেননা পার্থিব জগৎ ও প্রত্যক্ষকরণের জগতের সব কিছুই অদৃশ্য জগতে কেবল আধ্যাত্মিক কোনো কিছুর আকার/আকৃতি; এ যেনো পার্থিব জগৎ ও প্রত্যক্ষকরণের জগতে যে জিনিস রয়েছে তা অদৃশ্য জগৎ ও (প্রভুর) রাজত্বের জগতেও একই - এটা আত্মা ও অর্থের ক্ষেত্রে এবং আকার ও আকৃতির ক্ষেত্রে নয় যদিও। প্রত্যক্ষকরণের জগতের বাহ্যিক আকৃতি ওই জগতের আধ্যাত্মিক অর্থের মাঝে অন্তর্ভুক্ত। এই কারণেই এ (পার্থিব) জগতটি আল্লাহর পথের একটি পর্যায় গঠন করেছে, যে পর্যায়/স্তর মানবের জন্য অপরিহার্য; কেননা তরুমজ্জায় বাকলের পথ ছাড়া পৌঁছুনো যেমন অসম্ভব, ঠিক তেমনি আত্মার তথা আধ্যাত্মিক জগতের দিকে অগ্রসর হওয়াও শারীরিক জগতের আকৃতি ছাড়া সম্ভব নয়। এই সম্পর্কটি কেবল একটি উদাহরণ দ্বারা জানা যেতে পারে। যেমন - কোনো নিদ্রাগত মানুষের কাছে (স্বপ্নে) যা প্রকাশিত হয় তা নুবুয়্যতের ৪৬ ভাগের ১ ভাগ হওয়া এবং কল্পনার আকারে কীভাবে তাঁর কাছে তা প্রকাশিত হওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনা করুন [নোট: সহীহ আল-বুখারী, তা’বীর, ২, ৪, ২৬; সহীহ মুসলিম, রুয়্যা, ৭, ৮, ৯]। যে ব্যক্তি জ্ঞান-প্রজ্ঞা ওর অযোগ্য লোকদের মাঝে শিক্ষা দেন, তিনি স্বপ্নে দেখেন যে তিনি মুক্তার মালা শূকরের গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন। কোনো এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখেন যে তাঁর হাতে একটা আঁকড়া রয়েছে, যা দ্বারা তিনি নারীদের যৌনাঙ্গ ও পুরুষদের মুখ সীলগালা করে দিচ্ছিলেন। ইমাম ইবনে সীরীন [নোট: বেসাল - ১১০ হিজরী/৭২৮ খ্রীষ্টাব্দ; তাবেঈ; বিখ্যাত স্বপ্ন তা’বীরকারী; মহান মুহাদ্দীস, ফক্বীহ ও বসরার সূফী সিদ্ধপুরুষ; স্বপ্ন তা’বীরকারী হতে হাদীসবিদ হিসেবেই বেশি গুরুগম্ভীর ছিলেন, যদিও শেষ বয়সে বেশি খ্যাতি লাভ করেন] ওই ব্যক্তিকে (ব্যাখ্যায়) বলেন, “আপনি সেই ব্যক্তি যিনি রমজান চাঁদের মাসে ফজরের আযান দেন।” ওই ব্যক্তি উত্তরে বলেন, “জি, হ্যাঁ।” আরেক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখেন তিনি জলপাইয়ের তেলে তেল ঢালছেন। ইবনে সীরীন (রহ.) তাঁকে বলেন, “আপনার একজন দাসী আছেন যিনি (আসলে) আপনারই মা; তাঁকে একটি যুদ্ধে আটক ও বিক্রি করা হয়; আর আপনি (তাঁর সাথে এ সম্পর্কের কথা) না জেনেই তাঁকে খরিদ করেছেন।” এটাই ছিলো প্রকৃত ঘটনা।


فٱنْظُر خَتْمَ الأفَواه والفروج بالخاتم مُشَارِكاً للأَذان قبل الصبح في روح الخاتم وهو المنع وإن كان مخالفاً في صورته، وقس على ما ذكرته ما لم أذكره.


অতঃপর লক্ষ্য করুন যে, একটি আঁকড়া দ্বারা (পুরুষদের) মুখ ও (নারীদের) যৌনাঙ্গ সীলগালা করার উপমাটি ফজরের আযান দেয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা আঁকড়ার মর্ম মানে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; যদিও পূর্ববর্তীটি পরবর্তীটি হতে আকৃতিগতভাবে ভিন্ন। এক্ষণে আমাদের দ্বারা ওপরে উল্লেখিত অপর দুটি স্বপ্নকে এর সাথে তুলনা করুন।


واعلم: أن القرآنَ والأخبارَ تشتمل على كثير من هذا الجنس، فانظر الى قوله ﷺ ((قلبُ المؤمن بين أُصْبُعَيْن من أَصَابع الرَّحْمن)) فإن روح الأُصْبُع القدرةُ على سرعة التقليب، وإنما قلبُ المؤمن بين لَمَّةِ المَلَك وبين لَمَّةِ الشيطان، هذا يُغويه، وهذا يَهديه، والله تعالى بهما يُقلِّب قلوبَ العباد كما تُقَلِّب الأشياءَ أنت بأُصْبُعَيْك، فانظر كيف شارك نسبة المَلَكَيْن المُسَخَّرَيْن إلى الله تعالى أُصْبُعَيْكَ في روح أُصْبُعَيْه وخالفا في الصورة. وٱستخرج من هذا قولَه ﷺ ((إن الله تعالى خلق آدم على صورته)) وسائرَ الآيات، والأحاديث المُوهِمَة عند الجهلة للتشبيه، والذكي يكفيه مثال واحد، والبليد لا يزيده التكثير إلا تَحَيُّراً،


জেনে রাখুন, কুর’আন মজীদ ও খবর/হাদীসসমূহে এ ধরনের অনেক (দৃষ্টান্ত) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিবেচনা করুন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী, “একজন ঈমানদারের ক্বলব্ তথা অন্তর দয়ালু আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝখানে নিহিত” [সহীহ মুসলিম, কদর, ১৭; ইবনু মাজাহ, সুনান, দুআ’, ২; আহমদ বিন হাম্বল, মুসনাদ, ৬/২৫১, ৪/১৮২]। এখানে আঙ্গুলের মর্ম হচ্ছে দ্রুত গতিময়তা; ঈমানদারের অন্তর হচ্ছে নিশ্চিতভাবে ফেরেশতা ও শয়তানের সাক্ষাতের স্থান। শয়তান তাঁকে বিভ্রান্ত/বিচ্যুত করে আর ফেরেশতা তাঁকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন; এই দুইয়ের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা বান্দার অন্তর পরিবর্তন করেন, ঠিক যেমনটি আপনি দুই আঙ্গুলের মাধ্যমে কোনো কিছু পরিবর্তন করেন। অতঃপর লক্ষ্য করুন, আল্লাহতায়ালার সাথে এই দুই সত্তার সম্পর্ক আপনারই দুই আঙ্গুলের সাথে আল্লাহর দুই আঙ্গুলজ্ঞাপক অর্থের সম্পর্ক কীভাবে মিলে যায়; যদিও সেগুলো আকারে ভিন্ন। এ থেকে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিম্নোক্ত বাণীর (আধ্যাত্মিক মানে) বের করুন, “নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)-কে আপন সুরতে সৃষ্টি করেছেন” [সহীহ বুখারী, ইস্তি’যান, ১; সহীহ মুসলিম, বির্র, ১১৫; জান্নাহ ২৮], আর এর পাশাপাশি সে সমস্ত আয়াতে করীমা ও হাদীসসমূহের (আধ্যাত্মিক) মানেও বের করুন, যেগুলোকে (আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার) সাযুজ্য/সাদৃশ্যবোধক বলে কল্পনা করে থাকে অজ্ঞ লোকেরা। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্যে একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট হবে; আর এতে অধিক উদাহরণ বোকা লোকদের বিভ্রান্তিই কেবল বৃদ্ধি করবে।


ومتى عرفتَ معنى الأصبع، أمكنك التَرَقِّي إلى القلم واليد واليمين والوجه والصورة، وأخذَت جميعُها معنى روحانياً لا جِسمانياً، فتعلمَ أن روحَ القلم وحقيقتَه التي لا بد من تحقيقها إذا ذكرتَ حدَّ القلم: هو الذي يُكتَبُ به، فإن كان في الوجود شيء يتَسَطَّر بواسطته نقش العلوم في ألواح القلوب، فأخْلِقْ به أن يكون هو القلم، فإن الله تعالى علَّمَ بالقلم، علَّمَ الإنسانَ ما لم يَعلم، وهذا القلم روحاني إذ وُجِدَ فيه روح القلم وحقيقته، ولم يُعْوِزْهُ إلا قالبه وصورته، وكَون القلم من خشب أو قَصَب ليس من حقيقة القلم، ولذلك لا يوجد في حَدِّه الحقيقي، ولكل شيء حَدٌّ وحقيقة هي روحُه، فإذا ٱهْتَديْتَ إلى الأَرواح صِرْتَ روحانياً، وفُتِحَت لك أبوابُ المَلَكُوت، وأُهِّلْتَ لمرافقة الملأ الأعلى، وحَسُنَ أولئك رفيقاً، 


অর্থ: আপনি যখন খোদায়ী/ঐশী আঙ্গুলের মানে জানতে পারবেন, তখন ঐশী কলম, হাত, ডান হাত, মুখ/চেহারা ও আকৃতির ( উপলব্ধির) দিকে অগ্রসর হওয়াও আপনার পক্ষে সম্ভব হবে। আপনি যখন এগুলোর অর্থ রূহানী তথা আধ্যাত্মিক হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং জিসমানী বা শারীরিক অর্থে করবেন না, তখন আপনি জানবেন যে আপনার দ্বারা কলমের সংজ্ঞা উল্লেখকালে কলমের রূহ ও তার হাকীকত বা বাস্তবতা-সংক্রান্ত গবেষণা (কেবল) তা দিয়ে (কোনো কিছু) লেখার মধ্যেই নিহিত। অতঃপর যদি এমন কিছু অস্তিত্বশীল থাকে যার মাধ্যমে মানবের রূহ তথা আত্মার ফলকে (ঐশী) জ্ঞানের বিভিন্ন আকার অঙ্কন করা যেতে পারে, তাহলে এরকম সবচেয়ে উপযুক্ত জিনিস (বলতে) হবে কলম; কেননা অবশ্যঅবশ্য আল্লাহতায়ালা কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানবকে যা সে জানতো না [আল-কুর’আন, ৯৬/৪-৫]। এই কলমটি রূহানী, যেহেতু কলমের রূহ ও তার বাস্তবতা এতে পাওয়া যায়, আর এতে স্রেফ কলমের ছাঁচ ও আকৃতিরই ঘাটতি। যে কলম কাঠ বা নল দ্বারা তৈরি, তা কলমের বাস্তবতার অন্তর্ভুক্ত নয়, আর এ কারণেই কলমের প্রকৃত সংজ্ঞায় এটাকে পাওয়া যায় না। সবকিছুরই রয়েছে একটি সংজ্ঞা, একটি বাস্তবতা, যা তার রূহ; যখন আপনি রূহকে খুঁজে পাবেন, তৎক্ষণাৎ আপনি আধ্যাত্মিক স্তরে উপনীত হবেন; আর অদৃশ্য জগতের দরজাগুলোও আপনার সামনে খুলে দেয়া হবে, এবং আপনি তখন ‘আল-মালাউল আলা’ তথা (আসমানী) ফেরেশতাবৃন্দের সর্বোচ্চ সভার সঙ্গী হওয়ার যোগ্য হবেন [আল-কুর’আন, ৩৭/৮; ৩৮/৬৯]; এই ফেরেশতাবৃন্দ প্রকৃতপ্রস্তাবেই উত্তম সঙ্গী।


ولا يُستبعَد أن يكون في القرآن إشارات من هذا الجنس، وإن كنتَ لا تقوى على احتمال ما يقرع سمعَك من هذا النَّمط، ما لم تَسنُد التفسير إلى الصحابة، فإن كان التقليدُ غالباً عليك، فٱنظُر إلى تفسير قولهِ تعالى كما قاله المُفَسِّرون: ((أَنَزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءً فَسَالَتْ أَوْدِيَةٌ بِقَدَرِهَا فَٱحْتَمَلَ ٱلسَّيْلُ زَبَداً رَّابِياً وَمِمَّا يُوقِدُونَ عَلَيْهِ فِي ٱلنَّارِ ٱبْتِغَآءَ حِلْيَةٍ أَوْ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِّثْلُهُ)) الآية، وأَنه كيف مَثَّل العلمَ بالماء، والقلوبَ بالأودية، والينابيعَ والضَّلالَ بالزَّبد، ثم نبهك على آخرها فقال: ((كَذٰلِكَ يَضْرِبُ ٱللَّهُ ٱلأَمْثَالَ))؛ ويكفيك هذا القدر من هذا الفن فلا تطيق أكثر منه. وبالجملة فٱعلم: إنَّ كل ما يحتمله فهمُك فإن القرآن يُلقيه إليك على الوجه الذي لو كنتَ في النوم مُطالِعاً بروحك اللوحَ المحفوظ لتمثل ذلك لك بمثال مناسب يحتاج إلى التعبير. واعلم أن التأويل يجري مجرَى التَّعبير، فلذلك قلنا يدور المُفَسِّرُ على القشر، إذ ليس من يترجم معنى الخاتم والفروج والأفواه كمن يدرك أنه أذان قبل الصبح.


অর্থ: এ ধরনের ইশারা/ইঙ্গিত আল-কুর’আনে উপস্থিত থাকা অসম্ভাব্য নয়, যদিও এ প্রকারের বিষয় আপনি সহ্য করতে অক্ষম, যেটা আপনার শ্রুতিকে আঘাত করে যতোক্ষণ না এর তাফসীর/ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবা (রা.)-মণ্ডলীর প্রতি আরোপ করা হয়। যদি অন্ধ তাকলীদ/অনুসরণ আপনার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে, তাহলে আল্লাহতায়ালার (নিম্নোক্ত) বাণী বিবেচনা করুন, যেমনিভাবে মুফাসসেরীন বা তাফসীরবিদবৃন্দ ব্যাখ্যা করেছেন - “তিনি (আল্লাহ) আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। ফলে উপত্যকাগুলো আপন আপন উপযুক্ততা মোতাবেক প্রবাহিত হলো। অতঃপর জলস্রোত সেটার উপরিভাগে ভেসে উঠা ফেনা বহন করে নিয়ে এলো; এবং গয়না অথবা অন্যান্য আসবাবপত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে, সেটার উপর আগুন প্রজ্বলিত করে তা থেকেও অনুরূপ ফেনা উঠে” [আল-কুর’আন, ১৩/১৭; নূরুল ইরফান]। লক্ষ্য করুন, আল্লাহতায়ালা কীভাবে তুলনা করেছেন জ্ঞানকে পানির সাথে, অন্তরসমূহকে উপত্যকা ও জলের প্রস্রবণের সাথে, আর পথভ্রষ্টতাকে ফেনার সাথে। অতঃপর তিনি আপনাকে আয়াতের শেষাংশ সম্পর্কে সচেতন করেছেন এ কথা বলে - “আল্লাহ এভাবে উপমাসমূহ বর্ণনা করেন” [প্রাগুক্ত ১৩/১৭; নূরুল ইরফান]। এই বিষয়ে এ গভীর আলোচনা আপনার জন্যে যথেষ্ট হবে। আপনি এর চেয়ে বেশি বুঝতে অক্ষম।


সংক্ষেপে জেনে রাখুন, যা  কিছু আপনার বোধগম্য হওয়া সম্ভব, তা আল-কুর’আন আপনার কাছে পেশ করেছে এমন এক উপায়ে যে আপনি যদি ঘুমে আপনার রূহ দ্বারা লওহে মাহফুযের অধ্যয়নও করেন, তবে তা এমন একটি উপযুক্ত উপমায় আপনার কাছে বর্ণনা করা হতো যার তা’বীর বা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। জেনে রাখুন, কুর’আনের তাউয়ীল/ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ স্বপ্নের তা’বীরের স্থান দখন করে আছে। এ কারণেই আমরা ইতিপূর্বে বলেছিলাম যে কুর’আন মজীদের কোনো মুফাসসির বা ব্যাখ্যাকারী পবিত্রগ্রন্থের বাকল নিয়ে ব্যাপৃত; কেননা যে ব্যক্তি (অর্থাৎ ব্যাখ্যাকারী) আঁকড়া, যৌনাঙ্গ ও মুখের বাহ্যিক অর্থের অনুবাদ করেন, তিনি ওই ব্যক্তির মতো নন যিনি (এর) প্রকৃত মানে ফজরের নামাযের আযান বলে বুঝে থাকেন।


الفصل السابع: في سَبَبِ التَّعبير عن معاني عَالَمِ المَلَكُوتِ في القرآن بأَمثِلَةٍ من عَالَمِ الشّهادة

সপ্তম অধ্যায়: ক্বুর’আন মজীদে অদৃশ্য জগতের অস্তিত্বশীল সত্তা/বস্তুগুলোকে দৃশ্যমান জগৎ হতে গৃহীত উপমা দ্বারা সাব্যস্ত করার কারণসমূহ


ولعلك تقول: لِمَ أبرزتَ هذه الحقائق في هذه الأمثلة ولم تكشف صريحاً، حتى ارتبك الناس في جَهالة التَّشبيه وضَلالة التَّخيِيل؟


فاعلم: أن هذا تعرفه إذا عرفتَ أن النائم لم ينكشف له الغَيبُ من اللوح المحفوظ، إلا بالمثال دون الكشف الصريح كما حكيتُ لك المثل، وذلك يعرفه من يعرف العلاقة الخَفيَّة التي بين عالم المُلْكِ والملكوت. ثم إذا عرفتَ ذلك عرفتَ أنك في هذا العالم نائم وإن كنتَ مستيقظاً، فالناس نيام فإذا ماتوا انتبهوا، فينكشف لهم عند الانتباهِ بالمَوت حقائق ما سَمِعوه بالمثال وأرواحها، ويعلمون أن تلك الأمثلة كانت قُشوراً وأصْدافاً لتلك الأرواح، ويَتَيَقَّنون صدقَ آياتِ القرآن وقولِ رسول الله ﷺ، كما تَيَقَّن ذلك المؤذنُ صدقَ قولِ ٱبنِ سيرين وصحةَ تعبيرهِ للرؤيا، وكل ذلك ينكشف عند اتِّصال المَوت، وربما ينكشف بعضُهُ في سَكَراتِ الموت، وعند ذلك يقول الجاحِدُ والغافِل: ((يٰلَيْتَنَآ أَطَعْنَا ٱللَّهَ وَأَطَعْنَا ٱلرَّسُولاَ)) وقوله: ((هَلْ يَنظُرُونَ إِلاَّ تَأْوِيلَهُ يَوْمَ يَأْتِي تَأْوِيلُهُ يَقُولُ ٱلَّذِينَ نَسُوهُ مِن قَبْلُ قَدْ جَآءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِٱلْحَقِّ فَهَل لَّنَا مِن شُفَعَآءَ فَيَشْفَعُواْ لَنَآ أَوْ نُرَدُّ فَنَعْمَلَ غَيْرَ ٱلَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ)) الآية؛ ويقول: ((يَٰوَيْلَتَىٰ لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَناً خَلِيلاً)) ((يٰلَيْتَنِي كُنتُ تُرَاباً)) ((يٰحَسْرَتَا عَلَىٰ مَا فَرَّطَتُ فِي جَنبِ ٱللَّهِ)) ((يٰحَسْرَتَنَا عَلَىٰ مَا فَرَّطْنَا فِيهَا)) ((رَبَّنَآ أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَٱرْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحاً إِنَّا مُوقِنُونَ))؛ والى هذا يشير أكثرُ آياتِ القرآن المتعلقة بشرح المَعادِ والآخِرة التي أضفنا إليها الزَّبَرْجَدَ الأخضر.


فَافْهَم من هذا أَنَّكَ ما دمتَ في هذه الحياة الدنيا فأنتَ نائم، وإنما يقظَتُكَ بعد الموت، وعند ذلك تصيرُ أهلاً لمشاهدةِ صريحِ الحقِّ كِفاحاً، وقبل ذلك لا تحتملُ الحقائقَ إلا مَصبوبةً في قالب الأمثال الخَياليَّة، ثم لجمود نظرِكَ على الحِسّ تظنُّ أنه لا مَعنَى له إلا المُتَخَيَّل، وتغفلُ عن الروح كما تغفلُ عن روحِ نفسِكَ ولا تدرك إلا قالبك.


হয়তো আপনি (আমাকে) জিজ্ঞেস করবেন: আপনি কেন এসব বাস্তবতাকে এই সকল মিসাল বা উপমা দ্বারা আলোকপাত করেছেন এবং কেন স্পষ্টভাবে তা প্রকাশ করেননি, যার ফলশ্রুতিতে মানুষ হয়তো আপনাকে ’আত্ তাশবীহ’ তথা ‘সাদৃশ্যের’ অজ্ঞতা ও ‘খেয়ালের’ (কল্পনার) বশবর্তী পথভ্রষ্টতায় পতিত বলে সন্দেহ করতে পারেন?


(এ প্রশ্নের উত্তরে) জেনে রাখুন, আপনি এটা বুঝতে পারবেন যখন জানবেন যে গায়ব তথা অদৃশ্য বিষয়াদি লওহে মাহফূয হতে কোনো নিদ্রাগত ব্যক্তির কাছে কেবল মিসালের মাধ্যমেই প্রকাশ করা হয় এবং প্রকাশ্য ওহীর মাধ্যমে হয় না, ঠিক যেমনটি আমি একটি উদাহরণ দ্বারা ইতিপূর্বে আপনার কাছে বর্ণনা করেছি [পূর্ববর্তী অধ্যায় দ্রষ্টব্য]। এটা এমন এক বিষয় যা ওই ব্যক্তি জানেন যিনি ‘মুলক্’ বা দৃশ্যমান পার্থিব জগৎ ও ‘মালাকূত’ তথা অদৃশ্য জগতের মধ্যকার গোপন সম্পর্কের বিষয়ে বুঝতে পারেন। অতঃপর আপনি যখন এটা জানবেন তখন উপলব্ধি করবেন যে এই দুনিয়ায় আপনি নিশ্চয় নিদ্রাগত, যদিও আপনি হন জাগ্রত। “মানুষেরা নিদ্রাগত; যখন ইন্তিকাল হয়ে যায় তখনই জাগ্রত হয়” - আল্ হাদীস [নোট: ইমাম গাজ্বালী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই প্যারাগ্রাফ ও পরবর্তীগুলোতে এটা ব্যাখ্যা করেছেন; তবে রওয়ায়াতটি শনাক্ত নয়; মুহাদ্দীস আল-আজালানী তাঁর ‘কাশফুল খুফা’ (২/৩১২) গ্রন্থে বলেন, এটা হযরতে ইমামে আলী ইবনে আবী তালিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাণী - قال العجلوني في كشف الخفاء: هو من قول علي ابن ابي طالب (كشف الخفاء للعجلوني ٣١٢/٢]। ইনতিকাল দ্বারা জাগ্রত হবার সময় মিসাল/উপমার মাধ্যমে এ (পার্থিব) জীবনে তারা যে প্রকৃত অর্থ ও তার আত্মাসমূহ শুনেছিলো তা-ই তাদের কাছে প্রকাশ করা হবে, আর (তখন) তারা জানবে ওই উপমা হলো এই আত্মাসমূহেরই বাকল ও খোল/খোসা, আর তারা নিশ্চিতভাবে কুর’আনী আয়াতগুলোর এবং প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীর সত্যতা সম্পর্কেও (তখন) জানবে, ঠিক যেমনটি ওই মু’য়াযযিন ব্যক্তির ওয়াক্তিয়া নামাযের আযান ঘোষণার মতো, যিনি হযরত ইবনে সীরীন (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর কথার সত্যতায় ও তাঁর প্রদত্ত স্বপ্নের নির্ভুল তা’বীরে বিশ্বাস করেছিলেন (ইতিপূর্বে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে)। এসবই ইন্তিকাল আসার আগে এবং কখনো কখনো এগুলোর কিছু কিছু সাকারাতুল মওত তথা ইন্তিকাল-কালীন কষ্টের সময় প্রকাশিত হবে। এসব মুহূর্তে আল্লাহকে অস্বীকারকারী ও গাফেল লোকেরা বলবে, “হায়, কোনো মতে যদি আমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করতাম! এবং রাসূলের নির্দেশ মান্য করতাম (কুর’আন, ৩৩/৬৬; নূরুল ইরফান)!” আল্লাহ আরো ঘোষণা করেন, “তারা কিসের পথ দেখছে? কিন্তু সেটারই যে এ কিতাবের বর্ণিত পরিণাম সম্মুখে আসবে। যেদিন ওটার বর্ণিত পরিণাম সংঘটিত হবে, সেদিন বলে উঠবে ওই সব লোক, যারা ওটার কথা পূর্বে ভুলে গিয়েছিলো, ‘নিশ্চয় আমাদের রবের রাসূলবৃন্দ সত্য বাণী নিয়ে এসেছিলেন; সুতরাং আমাদের কি কোনো সুপারিশকারী আছে, যারা আমাদের পক্ষে সুপারিশ করবে? অথবা আমাদেরকে কি পুনরায় ফিরে যেতে দেয়া হবে, যেনো আমরা পূর্বের কৃতকর্মের বিপরীত কাজ করি (প্রাগুক্ত নূরুল ইরফান, ৭/৫৩)?” আল্লাহ আরো উদ্ধৃত করেন, “হায়, দুর্ভোগ আমার! হায়, কোনো মতে আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম (প্রাগুক্ত, ২৫/২৮)!” আল্লাহ আরো উদ্ধৃত করেন, “হায়, যদি আমি কোনো প্রকারে মাটি হয়ে যেতাম (প্রাগুক্ত নূরুল ইরফান, ৭৮/৪০)!” আল্লাহ আরো উদ্ধৃত করেন, “হায়, আফসোস! ওই সব অপরাধের জন্যে, যেগুলো আমি আল্লাহ সম্পর্কে করেছি (প্রাগুক্ত, ৩৯/৫৬)।” আল্লাহ আরো উদ্ধৃত করেন, “হায় আফসোস আমাদের! এ জন্যে যে,তা মেনে নেয়ার বিষয়কে আমরা কম গুরুত্ব দিয়েছি (প্রাগুক্ত, ৬/৩১)।” আল্লাহ আরো উদ্ধৃত করেন, “হে আমাদের রব! এখন আমরা দেখেছি এবং শুনেছি; আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ করো, যাতে আমরা সৎকাজ করি, আমাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস এসে গেছে (প্রাগুক্ত নূরুল ইরফান, ৩২/১২)।” আখিরাতের জীবনের ব্যাখ্যাসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কুর’আনী আয়াতে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত রয়েছে, যেসব আয়াতকে আমরা (ইতিপূর্বে) সবুজ মণি আখ্যা দিয়েছি। 


অতঃপর এ থেকে অনুধাবন করুন যে, আপনি যতোক্ষণ এই দুনিয়ার জীবনে আছেন ততোক্ষণ নিদ্রাগত, আর আপনার জেগে ওঠা কেবল ইন্তেকালেরই বাদে যখন আপনি সত্যের মুখোমুখি হয়ে তা দর্শনের সামর্থ্য লাভ করবেন। ওই সময়ের আগে আপনার পক্ষে বাস্তবতা সম্পর্কে জানা অসম্ভব, স্রেফ সেগুলোকে খেয়ালজনিত উপমার ছাঁচে প্রাপ্তি ব্যতিরেকে। আপনার দৃষ্টির মনোযোগ ইন্দ্রিয়ভিত্তিক হওয়ায় আপনি মনে করছেন যে শুধু ইন্দ্রিয়গতেরই খেয়াল বা কল্পনামূলক অর্থ বিদ্যমান; ফলে আপনি এর রূহ/আত্মার প্রতি গাফিল তথা উদাসীন হয়ে পড়েছেন, ঠিক যেমনটি আপনি নিজ আত্মার প্রতি গাফিল হয়েছেন এবং শুধু আপনার দেহকেই জেনেছেন-বুঝেছেন।       


الفصل الثامن: في الطريق الذي ينكشِفُ به للإنسان وجهُ العلاقة بين العالَميْن


অষ্টম অধ্যায়: অদৃশ্য ও দৃশ্যমান জগতের মধ্যকার সংযোগের উপলব্ধি


لعلَّك تقول: فٱكشِف عن وجه العلاقة بين العالَمَيْن، وأنَّ الرُّؤيا لِمَ كانت بالمِثَال دون الصريح، وأنَّ رسول الله ﷺ لِمَ كان يرى جبريلَ كثيراً في غير صورته، وما رآه في صورته إلا مَرَّتَين.


فاعلم: أنك إن ظننتَ أن هذا يُلْقَى إليك دفعةً، من غير أن تُقَدِّم الاستعداد لقبوله، بالرياضة والمجاهدة، وإطِّراحِ الدنيا بالكلية، والانحيازِ عن غِمَار الخلق، والاستغراقِ في محبة الخالق وطلب الحق، فقد استكبرتَ وعَلَوْتَ عُلُوًّا كبيراً، وعلى مِثلكَ يُبْخَل بمثله، ويُقال: 


جِئْتُمانِي لِتَعْلَمَا سِرَّ سَعْدِي :: تَجِدَاني بِسِرِّ سَعْدي شَحِيحا


فٱقْطَعْ طمَعَكَ عن هذا بالمكاتبة والمراسلة، ولا تطلُبْهُ إلا من باب المجاهدة والتقوَى، فالهداية تَتْلُوها وتُثَبِّتُها كما قال الله تعالى ((وَٱلَّذِينَ جَاهَدُواْ فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا))؛ وقال ﷺ ((من عَمِلَ بما عَلِمَ أَوْرَثَهُ اللهُ عِلمَ ما لا يُعلم)).  


হয়তো আপনি (আমায়) বলবেন: অতঃপর (দৃশ্যমান ও অদৃশ্য) দুটি জগতের মধ্যকার অস্তিত্বশীল সম্পর্ক প্রকাশ করুন এবং (এও প্রকাশ করুন) কেন কোনো স্বপ্ন মিসাল তথা উপমার মাধ্যমে হয় এবং স্পষ্ট ঐশী প্রত্যাদেশের মাধ্যমে হয় না; আর কেনই বা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম) ফেরেশতা জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম)-কে অহরহ তাঁর আপন সুরতে দেখতেন না, ব্যতিক্রম কেবল দু বার তিনি ওই ফেরেশতাকে আপন সুরতে দেখেছিলেন। [সহীহ বুখারী, বাদ’আল খালক্ব, ৭; সহীহ মুসলিম, ঈমান, ২৮২, ২৮৭; মুসনাদে ইমাম আহমদ হাম্বল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৩৬, ২৪১] 


(আপনার প্রশ্নের উত্তরে) জেনে রাখুন, যদি আপনি ধারণা করে থাকেন যে এই জ্ঞান আপনাকে একবারেই প্রদান করা হবে এটাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আপনার পূর্বপ্রস্তুতি ব্যতিরেকে - যা হয়ে থাকে নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম, দুনিয়ার (দূষণীয় বস্তু) পুরোপুরি পরিত্যাগ, সৃষ্টিকুল নিয়ে ডুবে থাকা হতে (নিজকে) দূরে অপসারণ, আর স্রষ্টা খোদাতায়ালার ভালোবাসায় বিভোর হয়ে ওই প্রকৃত মহান সত্তাকে অন্বেষণের মাধ্যমে - তাহলে আপনার তাকাব্বরি তথা দম্ভ সর্বোচ্চ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় আপনার মতো ব্যক্তির কাছ থেকে ওই (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান আটকানো হবে, আর বলা হবে:


আমার এ গোপন সৌভাগ্য জানতে পেরেছো তোমরা দু জনা,

কিন্তু এ গোপন সৌভাগ্য প্রকাশে তোমরা আমায় পাবে ধীর-মনা। (ভাবানুবাদ)

[বঙ্গানুবাদকের নোট: ‘দু জনা’ বলতে সম্ভবতঃ রূহ ও নফসকে বোঝানো হয়েছে]


অতএব, (পত্র) লেখালেখির মাধ্যমে এ জ্ঞান অর্জনে আপনার উচ্চাভিলাষ ত্যাগ করুন এবং আত্মসংযম (মুজাহিদা) ও ধার্মিকতার (তাকওয়ার) দরজা দিয়ে তা অন্বেষণ করুন। এরপর (ঐশী) হেদায়াত অর্থাৎ সত্য পথপ্রদর্শন তা অনুসরণ করবে এবং তাকে শক্তিশালী করবে, ঠিক যেমনটি আল্লাহতায়ালা ফরমান:


”এবং যারা আমার পথে প্রচেষ্টা চালায় অবশ্য আমি তাদেরকে আপন রাস্তা দেখাবো।” [আল-কুর’আন, ২৯/৬৯; নূরুল ইরফান]


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেন: “যে ব্যক্তি তার জ্ঞান অনুযায়ী আমল তথা ধর্ম অনুশীলন করে, আল্লাহতায়ালা তাকে সে যা জানতো না ওই জ্ঞান দান করবেন।” [শনাক্ত নয়]    


واعلم يقيناً: أن أسرار المَلَكُوت محجوبَةٌ عن القلوب الدَّنِسَةِ بحُبِّ الدنيا، التي استغرقَ أكثرَ هِمَمِهَا طلبُ العاجلة، وإنما ذكرنا هذا القدر تشويقاً وترغيباً، وَلِنُنَبِّهَ به على سرٍّ من أسرار القرآن، مَنْ غفل عنه لم تُفْتَح له أصدافُ القرآن عن جواهره ٱلبَتَّة، ثم إن صَدَقَتْ رغبتُك شمَّرتَ للطَّلب، وٱستعنتَ فيه بأهل البصيرة، واستمدَدْتَ منهم، فما أراك تُفلح لو استبدَدْتَ فيه برأيك وعقلك، وكيف تفهم هذا وأنت لا تفهم لسان الأحوال، بل تظنُّ أنه لا نُطْقَ في العالم إلا بالمقَال، فلم تفهم معنى قوله تعالى ((وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلاَّ يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ)) ولا قوله تعالى ((قَالَتَآ أَتَيْنَا طَآئِعِينَ)) ما لم تُقَّدِرْ للأرض لساناً وحياة؛ ولا تفهم أنَّ قولَ القائل: قال الجدارُ لِلوتد: لم تنقُبُنِي؟ قال: ((سَلْ من يَدُقُّني فلم يترُكْنِي، ورأى الحجر الذي يَدُقُّني)) ولا تدري أن هذا القولَ صِدْقٌ وأصحُّ من نُطْق المقال، فكيف تفهم ما وراء هذا من الأسرار؟


ইয়াকীন তথা নিশ্চিতভাবে জানুন যে অদৃশ্য জগতের ভেদের রহস্যগুলোকে সেসব অন্তর থেকে (পর্দার) আড়ালে রাখা হয়, যেগুলো দুনিয়ার মহব্বতে কলুষিত এবং যেগুলোর বেশির ভাগ শক্তিই ইহ-জগতের অন্বেষণে মগ্ন। আমরা (ভেদের রহস্য সম্পর্কে) স্রেফ এতোটুকুই উল্লেখ করেছি যাতে এগুলোর প্রতি আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয় এবং এগুলোর প্রতি উৎসাহিত করা যায়; আর যাতে কুর’আন মজীদের গোপন রহস্যগুলোর একটিকে সেই ব্যক্তির কাছে জ্ঞাত করানো যায়, যে এর প্রতি উদাসীন এবং যার কাছে কুর’আনে পাকের খোসাগুলো তার আপন হীরে-জহরত প্রকাশের জন্যে মোটেও উন্মুক্ত নয়। অতঃপর যদি আপনার আকাঙ্ক্ষা সত্যনিষ্ঠ হয় তাহলে আপনি এসব গোপন রহস্য অন্বেষণে সাধনারত হবেন এবং এসব বিষয়ে (আধ্যাত্মিক) অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন (বুযূর্গ)-বৃন্দের কাছে সহায়তা চাইবেন; আর আপনি তাঁদের কাছ থেকে সাহায্যও পাবেন। তবে আমি মনে করি না যে আপনি এ প্রচেষ্টায় সফল হবেন যদি কেবল নিজের সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করেন। আপনি কেমন করে এসব (অদৃশ্য জগতের রহস্য) সম্পর্কে বুঝতে সক্ষম হবেন, যখন এর আহওয়াল তথা হালত-অবস্থার ভাষাই জানেন না? বরঞ্চ আপনি ধারণা করে বসে আছেন যে জগতে শুধু (বাকশক্তিপূর্ণ) ভাষাই বিরাজমান। এ কারণে আল্লাহতায়ালার বাণীর মর্ম আপনি বোঝেননি, যা’তে তিনি ঘোষণা করেছেন: “আর (আসমান-জমিনে) এমন কোনো বস্তু নেই যা আল্লাহর প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা ঘোষণা করে না” [নূরুল ইরফান, ১৭/৪৪]। আপনি আল্লাহতায়ালার এই বাণীর মর্মও উপলব্ধি করতে পারেননি, যেখানে তিনি ফরমান - “(আসমান ও জমিন) উভয়ে আরজ করলো, আমরা সাগ্রহে (আপনার দরবারে) হাজির হলাম” [নূরুল ইরফান, ৪১/১১] - যতোক্ষণ না আপনি বুঝতে পারছেন দুনিয়ার জমিনের একটি ভাষা ও জীবন রয়েছে। আর আপনি বক্তার ওই কথাও অনুধাবন করতে অক্ষম যা’তে তিনি বলেন - “দেয়াল কীলক/পেরেককে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি আমায় বিদীর্ণ করলে কেন?’ পেরেক বল্লো, ‘তাঁকে জিজ্ঞেস করো যিনি আমায় (হাতুড়ির) বাড়ি মারছেন এবং আমায় ছেড়ে যাচ্ছেন না; আমার পেছনেই রয়েছে পাথর যা বাড়ি দিচ্ছে’ [নোট: এই কথপোকথন আয্ যামাখশারীও উদ্ধৃত করেছেন সামান্য ভিন্নতা সহকারে। আলোচ্য কুর’আনী আয়াতটির ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাখ্যা ইমাম গাজ্বালী (রহ.)-এরই অনুরূপ। দেখুন - যামাখশারী কৃত তাফসীরে কাশশাফ, মিসরীয় সংস্করণ ১৩৮৫ হিজরী/১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দ, ৩য় খণ্ড, ৪৪৬ পৃষ্ঠা]।” আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন না যে এই কথাটি সত্য এবং বাকশক্তিসমৃদ্ধ ভাষার চেয়েও বেশি সঠিক। তাহলে এর পেছনে লুকোনো গোপন রহস্যগুলো আপনি কীভাবে অনুধাবন করবেন?


الفصل التاسع: في التَّنْبيهِ على الرُّموز والإشارات التي يشتمل عليها القُرآن


নবম অধ্যায়: [লাল গন্ধক, সেরা প্রতিষেধক, সবচেয়ে শক্তিশালী মেশক (সুগন্ধি), ঘৃতকুমারী কাঠ, চুনি/নীলকান্তমণি ও মুক্তার রূপক]


لعلك تطمع في أن تُنَبَّهَ على الرَّموز والإشارات المودَعة تحت الجواهر الذي ذكرنا اشتمال القرآن عليها. فاعلم أن الكبريت الأحمر عند الخَلق في عالَم الشهادة، عبارة عن الكيمياء التي يُتَوصَّل بها إلى قلب الأعيان من الصفات الخَسِيسَة إلى الصفات النفيسة، حتى ينقلب به الحجر ياقوتاً، والنحاس ذهباً إبريزاً، ليتوصَّلَ به إلى اللَّذات في الدنيا مكدَّرةً مُنَغَّصةً في الحال، مُنْصَرِمَةً على قرب الاستقبال، أفترى أن ما يقلُبُ جواهرَ القلب من رَزالةِ البهيمة وضلالةِ الجهل إلى صفاءِ الملائكة وروحانِيَّتها، ليترقى [القلبُ] من أسفل السَّافلين إلى أعلى عِلِّيِّين، ويُنَالُ به القُرب من ربِّ العالمين والنظرُ إلى وجهه الكريم أبداً دائماً سَرْمَداً، هل هو أولى باسم الكبريت الأحمر أم لا؟ فلهذا سميناه الكبريت الأحمر. فتأمَّل وراجع نفسك وأنْصِفْ: لِتَعلمَ أن هذا الاسمَ بهذا المعنى أحق، وعليه أصدق، ثم أنفس النفائس التي تُستَفَاد من الكيمياء اليواقيت، وأعلاها الياقوت الأحمر، فلذلك سميناه معرفة الذات.


হয়তো আপনি আমাদের দ্বারা ইতিপূর্বে উল্লেখিত হীরে-জহরতের অধীনে জমাকৃত ইশারা-ইঙ্গিত সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে ইচ্ছুক হবেন (দেখুন - ১ম ও ৩য় অধ্যায়গুলো), যা কুর’আন মজীদে অন্তর্ভুক্ত। তাই (আমি বলি), জেনে রাখুন, আলমে শাহাদাত তথা দৃশ্যমান জগতের মানুষের কাছে লাল গন্ধক (الكبريت الأحمر) মানে হচ্ছে ওই রসায়ন/কিমিয়া যা দ্বারা তারা বিভিন্ন বস্তুকে সেগুলোর নিচু গুণগত মান থেকে মহামূল্যবান মানে পরিণত করতে সক্ষম হয়; এর দরুন পাথর (الحجر) রূপান্তরিত হয় চুনি/নীলকান্তমণিতে (اليَواقيت) এবং তামা (النحاس) হয় খাঁটি স্বর্ণে (ذهباً إبريزاً); আর এগুলোর মাধ্যমেই তারা (মানুষেরা) দুনিয়ার আনন্দ-ফুর্তি লাভ করে, যা (বাস্তবে) তৎক্ষণাৎ এলোমেলো/অশান্ত ও উপদ্রুত থাকে এবং তা অদূর ভবিষ্যতে অতিক্রান্ত হবে। তাহলে আপনি কি বিবেচনা করবেন না (নিম্নের) প্রশ্নটি: ওই বস্তু যা রূহের সত্তাকে জানোয়ারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অজ্ঞতার ভ্রান্তি থেকে ফেরেশতাকুলের পুতঃপবিত্রতায় ও তাঁদের আধ্যাত্মিকতায় পরিণত করে, যার দরুন রূহ সর্বনিম্ন স্তর হতে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পারে এবং তা দ্বারা গোটা জগতসমূহের প্রভু আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জন করতে পারে আর তাঁর চেহারা মোবারকের দিকে সর্বদা ও চিরকাল তাকিয়ে থাকতে পারে - তা কি লাল গন্ধক ( الكبريت الأحمر) নামটি পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যোগ্য নয়? এ কারণেই আমরা এর নাম দিয়েছি লাল গন্ধক। অতএব, গভীরভাবে চিন্তা করুন, নিজের (বিবেকের) সাথে পরামর্শ করুন এবং ন্যায়পরায়ণ হোন, যাতে আপনি উপলব্ধি করতে পারেন যে এই নামটি এ অর্থের জন্যে সবচেয়ে যোগ্য এবং সবচেয়ে সঠিকভাবে প্রয়োগেরও যোগ্য। অতঃপর কিমিয়া/রসায়নের মাধ্যমে অর্জিত সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হচ্ছে চুনি/নীলকান্তমণি (اليَواقيت) যার সেরা ধরন হচ্ছে লাল চুনি (الياقوت الأحمر)। এ কারণেই আমরা এর নাম দিয়েছি (ঐশী) জাত বা সত্তাগত জ্ঞান (معرفة الذات)।                               

         


(চলবে)