Tuesday 15 April 2014

তাকলীদ

[Bengali translation of the article 'Taqleed' at alahazrat.net]

মূল: আলা হযরত.নেট
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[আমার পীর ও মুরশেদ চট্টগ্রাম আহলা দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি সৈয়দ মওলানা (আলহাজ্জ্ব) এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে উৎসর্গিত]



তাকলীদ

তাকলীদের সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে এভাবে যে, কোনো মুজতাহিদের ফতোওয়া (সিদ্ধান্ত)-কে তাঁর রেফারেন্স বা দলিল ছাড়া-ই মেনে নেয়া বা গ্রহণ করা হচ্ছে তাকলীদ। [ইমাম নববী কৃত ‘তাহযীব’ ও কাযী শওকানী প্রণীত ‘এরশাদুল ফাহূল’]

শরীয়তের বিষয়গুলোতে চার মযহাবকে অনুসরণ করার ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মাঝে এজমা তথা ঐকমত্য হয়েছে। যথা -

* সে সকল বিষয়ে যেগুলোতে শরীয়তের উৎসগুলোতে দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্ট অর্থ ব্যক্ত হয় নি;
*সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর মাঝে কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য বিরাজ করলে ইমাম সাহেবগণ তাঁদের মধ্যকার সাযুজ্য তুলে ধরেছেন;

আমরা তাকলীদ পালন করি শুধুমাত্র ফেকাহর ক্ষেত্রে, আমাদের আকীদার ক্ষেত্রে নয়। আল্লাহতা’লার একত্ব, মহানবী (দ:)-এর সর্বশেষ নবী হওয়ার বিষয়, শেষ বিচার দিবস ইত্যাদি হলো আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপার, আর তাই এগুলো তাকলীদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।

কেউ কেউ বলেন, এ ধরনের অন্য কারো তাকলীদ গ্রহণ আল্লাহর সাথে শেরক (অংশীবাদ)-এরই নামান্তর। উপরন্তু, কোনো এক নির্দিষ্ট ইমামকে অনুসরণ করা বেদআত। তারা আরও বলেন, সকল ইমামের দলিলপত্র অধ্যয়ন করে বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার যাতে শক্তিশালী দলিলগুলো গ্রহণ করা যায় এবং দুর্বলগুলো বাদ দেয়া সম্ভব হয়।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের এতদসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি হলো, কোনো সাধারণ মুসলমানের পক্ষে সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকে আইন-কানুন বের করা অসম্ভব। এটি এই কারণে যে, ইসলামী জ্ঞানের এই উৎসগুলোর মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যা অস্পষ্ট; ফলে এগুলোকে বোঝার জন্যে সহায়ক আরও অন্যান্য উৎস ও তাদের প্রয়োগ-পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। এটি করতে হলে কোনো ব্যক্তির জন্যে ইসলাম সম্পর্কে সুগভীর ও ব্যাপক উভয় জ্ঞান অর্জন করা-ই জরুরি, যা একজন (সাধারণ) মুসলমানের পক্ষে অবাস্তব এবং অবশ্য কর্তব্য-ও নয়। আল্লাহতা’লা সকল মুসলমানকে বিদ্বান হতে দেখতে চান না, বরঞ্চ তিনি তাঁদেরকে জ্ঞানীদের পরামর্শ নিতে আদেশ করেছেন। নিচের আয়াতে করীমাটি বিবেচনা করুন:

”সুতরাং হে লোকেরা! জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে” [সূরা নাহল ৪৩ আয়াত]।

এ ছাড়া সূরা নিসায় এরশাদ হয়েছে:

“অার যদি সেক্ষেত্রে (তারা) সেটি (তাদের কাছে আগত প্রশান্তি বা শঙ্কার বার্তা) রাসূল (দ:) ও নিজেদের ‘উলীল আমর’ (আদেশদাতা)-দের গোচরে আনতো, তবে নিশ্চয় তাঁদের কাছ থেকে ওর বাস্তবতা সম্পর্কে তারা-ই জানতে পারতো, যারা পরবর্তী (তথ্য অনুসন্ধানের জন্যে) সচেষ্ট” [আল-কুরঅান ৪:৮৩]।

যে সকল আলেম-ব্যক্তির প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত পূরণের যোগ্যতা ছিল, অর্থাৎ, উলূম অাল-কুরআন, আহাদীস ও সেগুলোর উসূল, আকায়েদ, ফেকাহর উসূল, তাফসীর ও তার উসূল এবং আল-জারহু ওয়াত্ তা’দীল (হাদীস বর্ণনাকারী-বিষয়ক জ্ঞান) ইত্যাদি জ্ঞানের শাখায় যাঁরা ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন, শুধু তাঁদেরকেই শরীয়ত থেকে আহকাম তথা আদেশ-নিষেধ খুঁজে বের করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এই ধরনের আলেমকে বলা হয় ‘মুজতাহিদ’। তবে এজতেহাদ (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) প্রয়োগ করার সামর্থ্যবান অনেক বড় বড় আলেম ইমামবৃন্দকে অনুসরণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম কাজী আবূ ইউসূফ, ইমাম মোহাম্মদ শায়বানী ও ইমাম যুফার প্রমুখ নিজেরাই এজতেহাদ প্রয়োগের যোগ্যতা রাখতেন, কিন্তু তবু তাঁরা ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর অভিমত গ্রহণ করতেন।

হাদীসসমূহের অনেক প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন মোতাওয়াতের (সর্বত্র জনশ্রুত), সহীহ (বিশুদ্ধ), অ-বিশুদ্ধ, দুর্বল (যয়ীফ) ও জাল (মওযু)। কিছু আছে মানসূখ, যার মানে প্রথমাবস্থায় অনুমতি ছিল, ‍কিন্তু পরে তা রহিত হয়ে যায়। যথা - আগে নামাযে কথা বলা যেতো, কিন্তু পরে তা অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এই কারণে তাকলীদ একটি জরুরাত - উলেমাবৃন্দ ওপরের সব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই এই সিদ্ধান্ত জারি করেন।

তাকলীদের প্রত্যাখ্যানকারী

হাফেয ইবনে তাইমিয়ার মতো যে সব লোক তাকলীদকে প্রত্যাখ্যান করার অপচেষ্টা করেছিল, তারা ব্যর্থ হয়। সে অবশ্য সাধারণ মুসলমানদের মতো ’মুকাল্লিদ’ (তাকলীদকারী) ছিল না। তার লেখনীতে হাম্বলী মযহাবের প্রভাব বিদ্যমান। সে তার ফতোওয়াগুলোকে ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ:)-এর ফতোওয়ার চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে পছন্দ করতো। তার অনুসারীরা দাবি করে থাকে যে তারা মুকাল্লিদ নয় এবং তাকলীদ হলো বেদআত। কিন্তু তারা সব সময়ই হাফেয ইবনে তাইমিয়ার তাকলীদ করে থাকে এবং তার বই থেকেই ফতোওয়াসমূহ উদ্ধৃত করে। এ ধরনের একটি উদাহরণ নিচে দেয়া হলো:

শায়খ বিন বা’আয (প্রয়াত সউদী সরকারি মোল্লা) মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরুদ্ধে একটি এবং মহানবী (দ:)-এর রওযা শরীফ  সফর করে যেয়ারত করার বিরুদ্ধে আরেকটি ফতোওয়া জারি করেছিল। সে লিখে, মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন বেদআত, কেননা হাফেয ইবনে তাইমিয়ার গবেষণায় একে বিদআত বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে, সে মহানবী (দ:)-এর রওযা শরীফ যেয়ারতকে অনুমতিপ্রাপ্ত নয় বলেছে, যেহেতু এটি ইবনে তাইমিয়ার অভিমত। [শায়খ বিন বা’আয কৃত মীলাদুন্নবী (দ:) ও যেয়ারতে রওযা শরীফ]

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সউদী শায়খ অন্ধভাবে হাফেয ইবনে তাইমিয়ার তাকলীদ করেছে এবং এর পাশাপাশি সে হাফেয ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা, হাফেয ইবনে কাসীর, ইবনুল হাদী, শওকানী ও নাসির আলবানীর-ও তাকলীদ করেছে।

এটি সত্যি হতভম্ব হবার মতো ব্যাপার! এ সকল লোকেরা তাদের ইমামদেরকে অনুসরণ করে, অথচ দাবি করে যে তারা অন্ধ অনুসারী নয়; অপর দিকে তারা আয়েম্মা-এ-মযাহীব (চার মযহাবের ইমামবৃন্দ)-এর অনুসারীদেরকে অন্ধ অনুসারী বলে সম্বোধন করে। বাস্তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে তাকলীদ করে থাকে। কেউ অনুসরণ করেন ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-কে, আর কেউ অনুসরণ করে হাফেয ইবনে তাইমিয়াকে। অধিকন্তু, তাদেরকে যখন বলা হয় কোনো একটি হাদীস দুর্বল, বিশুদ্ধ কিংবা জাল, তখন তারা নিজেরা গবেষণা না করেই তা গ্রহণ করে নেয়। ফলে তারা ইমাম বোখারী (রহ:), ইবনে আবি হাতেম, হাফেয মিযাঈ, হাফেয আসকালানী (রহ:), হাফেয যাহাবী এবং হাফেয মাকদাসী প্রমুখকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে থাকে। প্রকৃত ঘটনা হলো, এই সব লোকেরা নিজেদের গবেষণা নিজেরা করে না, বরং তাদের আলেমদের গবেষণাকেই ‘অন্ধভাবে’ অনুসরণ করে।

তাকলীদের প্রত্যাখ্যানকারীরা যখন কোনো হাদীসকে সহীহ, যয়ীফ বা মওযু বলে খেতাব দেয়, তখন আসলে তারা সে সকল মোহাদ্দেসীন (হাদীসবেত্তাবৃন্দ)-কেই অনুকরণ করে, যাঁরা ইতিপূর্বে আহাদীসগুলোকে ওপরের শ্রেণীভুক্ত করেছিলেন। উপরন্তু, বিভিন্ন শ্রেণীর আহাদীসকে বর্ণনা করতে প্রাথমিক যুগের উলেমাবৃন্দ যে সব সংজ্ঞা ব্যবহার করেন, যেমন মুরসাল, মু’যাল, শাদ, মোয়াল্লাল, আযীয ও গরীব, তা কুরআন ও সুন্নাহ’র কোথাও উল্লেখিত হয় নি। এই সব সংজ্ঞার সদ্ব্যবহারও এক ধরনের তাকলীদ। অনুরূপভাবে, হাদীস ও তাফসীরের উসূল (মৌলনীতি)-কে গ্রহণ করা এবং কুরআন ও সুন্নাহকে এই মৌলনীতির আলোকে ব্যাখ্যা করা আর কিছু নয়, যে সকল ইমাম এগুলো প্রণয়ন করেছেন তাঁদেরকেই অনুসরণ করামাত্র। যে সব মানুষ ইমামদেরকে অনুসরণ করে না, তাদের উচিৎ সরাসরি কোনো হাদীসের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা; এতে কোনো ইমামের শরণাপন্ন তারা হতে পারবে না। এছাড়াও তাদের উচিৎ হাদীসের সংজ্ঞা হিসেবে মুরসাল, শায়ায ইত্যাদির মতো নতুন কোনো সংজ্ঞা খুঁজে বের করা। তাদের উচিৎ হাদীস ও তাফসীরের উসূলের মতো নতুন উসূল প্রণয়ন করা এবং তারপর সেই উসূলের আলোকে কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যয়ন করা। তবেই তারা (তাদের মতানুযায়ী) শেরক ও বেদআত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে!

তাকলীদের প্রতি আপত্তিকারীদের উত্থাপিত সন্দেহ   

তাকলীদের বিরোধিতাকারীরা যুক্তি দিয়ে থাকে যে কোনো নির্দিষ্ট ইমামকে অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত গবেষণা দ্বারা আশা করে যে তারা সর্বাপেক্ষা সঠিক মত পোষণকারী ইমামের দেখা পেয়ে যাবে। তারা যদি মনে করে যে কোনো ইমামের মত সঠিক নয়, তবে তারা অপর ইমামের শরণাপন্ন হয়। এভাবে তারা শেষমেশ চারজন ইমামেরই দ্বারস্থ হয় এবং সবাইকেই অনুসরণ করে। আমরা বলি, এটি সম্ভব নয়। কেননা, ইমামবৃন্দ ইসলামী জ্ঞানের উৎসসমূহের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই ব্যাপক গবেষণা করেছেন এবং সঠিক মতটি বের করতে নিজেদের মৌলনীতির সদ্ব্যবহার করেছেন। তাই আপনাদেরকে কেবল একজন ইমামেরই মৌলনীতি অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায়, আপনারা নিজেদের উসূল প্রয়োগ করতে চেষ্টারত হবেন, আর তা হবে আপনাদেরই খায়েশের অধীন, যা (আপনাদের পক্ষে) সহজে প্রয়োগযোগ্য।

নিচে কিছু উদাহরণ পেশ করা হলো: ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর মতে, কোনো মহিলার স্পর্শ লাগলে ওযু ভেঙ্গে যায়; অথচ ইমাম অাবূ হানিফা (রহ:)-এর মতানুযায়ী তাতে ওযু ভাঙ্গে না। অধিকন্তু, ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর ব্যতিক্রমস্বরূপ ইমাম শাফেয়ী (রহ:) ’মুরসাল’ হাদীসকে গ্রহণ করেন নি (তাঁর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তে)। মহানবী (দ:)-এর কওল (বাণী)-সম্বলিত হাদীস ও তাঁর ফে’ল (ক্রিয়া)-সম্বলিত হাদীসের মতো দুটো দলিল যেখানে বিদ্যমান, সেখানে ইমাম আবূ হানিফা (রহ:) বাণীসম্বলিত হাদীসটিকে কর্তৃত্বমূলক বিবেচনা করেছেন। অথচ ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর মতে আচরিত প্রথার কর্তৃ্ত্ব এ ক্ষেত্রে বেশি। এ সব নজির থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে উভয় ইমামকে অনুসরণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব, এক সাথে চার বা ততোধিক ইমামকে কীভাবে অনুসরণ করা যায়?

হাফেয ইবনে তাইমিয়া বলে, কোনো ব্যক্তি যদি একজন নির্দিষ্ট ইমামকে অনুসরণ করার মাঝখানে অপর কোনো ইমামের অনুসরণ করে, তবে সে প্রকৃতপক্ষে নিজের (নফসানী) খায়েশকেই (ইচ্ছাকেই) অনুসরণ করে, অপর ইমামকে নয়; আর এটি (ইসলামে) হারাম। মহান উলামাবৃন্দ কখনো ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর ফেকাহ, আবার (সুবিধামতো) কখনো ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর ফেকাহকে অনুসরণ করতে বারণ করেছেন। [ফতোওয়া-এ-ইবনে তাইমিয়া, ২০তম খণ্ড, তাকলীদ অধ্যায়]

হাফেয ইবনে তাইমিয়ার ফতোওয়া থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে কেবল একজন ইমামেরই তাকলীদ করা যায় এবং তাকলীদ পালন করা অত্যাবশ্যক।

কতিপয় আপত্তি

চার মযহাবের ইমামবৃন্দ যেখানে আমাদের বলেন নি তাঁদেরকে অনুসরণ করতে, সেখানে কেন আমরা তাঁদেরকে অনুসরণ করবো?

আইম্মা-এ-মযাহীব (চার মযহাবের ইমামমণ্ডলী)-কে অনুসরণ করার সমর্থনসূচক কোনো হাদীস যেখানে অনুপস্থিত, সেখানে আমরা কেন তাঁদেরকে অনুসরণ করবো?

জবাব

আমরা কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করি সাত ‘কুররাআ’-এর পদ্ধতিতে; তারা আমাদের বলে নি ‘আমাদের অনুসরণ করো’। আহাদীসগুলোও আমাদের আদেশ দেয় নি তাদেরকে অনুসরণ করতে হবে। মহানবী (দ:) কি বলেছেন শুধু বোখারী ও মুসলিমকে অনুসরণ করতে হবে? তিনি কি বলেছেন কুরআন মজীদের পরে বোখারী শরীফ হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইসলামী জ্ঞানের উৎস?

’আমাদের অনুসরণ করো না’, এ কথার দ্বারা চার মযহাবের ইমামবৃন্দ যা বুঝিয়েছেন তা হলো, ‘আমাদের বাণীর অনুসরণ করো না।’ আমরা মুসলমানরা তাঁদের বাণীর অনুসরণ করি না, বরং কুরআন-সুন্নাহ থেকে কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে বের করা তাঁদের ফতোওয়ার (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) অনুসরণ করে থাকি। এই কথা বলে তাঁরা আমাদেরকে তাঁদের রায় মান্য করার ক্ষেত্রে উৎসাহ জুগিয়েছেন, যে রায় নিঃসন্দেহে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বের করা হয়েছে। এমন কি ইমাম মুসলিম (রহ:) এবং ইমাম বুখারী (রহ:)-ও আমাদের নির্দেশ দেন নি এই মর্মে যে তাঁদেরকে অনুসরণ করতে হবে। তাঁরা আমাদের কখনোই বলেন নি শুধু তাঁদের বইতে উদ্ধৃত আহাদীসগুলো গ্রহণ করতে হবে।

আপত্তি: সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর সময় কি চার মযহাবের ইমামবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন?

জবাব: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের এই চার ইমাম ইসলামের প্রথম প্রজন্ম সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর সময়ে উপস্থিত ছিলেন না, যেমনিভাবে ছিলেন না আল-বোখারী (রহ:) এবং ইমাম মুসলিম (রহ:)-ও। তবে ওই প্রাথমিক যুগে এমন কয়েকজন সাহাবী (রা:) ছিলেন, যাঁরা গভীর ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন; তাই তাঁদেরকে উলেমা বা ইমাম বলা যেতে পারে। ইসলামী বিষয়াদিতে মুসলমান সমাজ তাঁদের কাছে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা চাইতেন। সর্বাগ্রে যে উলেমাবৃন্দ ছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল চার যা নিচে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অবশ্য তাঁদেরকে সেরা প্রথম তিন প্রজন্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাসূলুল্লাহ (দ:) এ সম্পর্কে বলেন, “আমার এবং সাহাবীদের জমানা-ই সেরা; অতঃপর সেরা তাদের যুগ যারা আমাদের পরে আসবে; এরপর সেরা হলো ওর পরবর্তী প্রজন্মের সময়কাল।”

হাফেয ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা লিখেছে যে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর যুগে চারজন ইমাম ছিলেন। সে লিখে, “মক্কা মোযাযযমায় ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:), মদীনা মোনাওয়ারায় হযরত যায়দ বিন সাবেত (রা:), বসরা নগরীতে হযরত আনাস বিন মালেক (রা:) এবং কুফা শহরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:)। তাঁদের বেসালের (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার) পরে তাবেঈনদের মধ্যেও ছিলেন বিখ্যাত চার ইমাম। এরা হলেন মদীনা মোনাওয়ারায় হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রহ:), মক্কা মোয়াযযমায় হযরত আতা ইবনে রাব’আ (রহ:), ইয়েমেনে হযরত তাউস্ (রহ:) এবং কুফায় হযরত ইবরাহীম (রহ:)। এছাড়াও অনেক ইমাম ছিলেন, তবে ওই চারজনই ছিলেন সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।” [হাফেয ইবনে কাইয়্যেম কৃত ‘আলা’ম-উল-মোওয়াকিয়ীন’, ১০ পৃষ্ঠা]

এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের চার ইমামের আগে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর জমানায়ও ইমাম ছিলেন, যাঁরা ধর্মীয় জ্ঞানের উৎস বা আধার ছিলেন। এ সব ফতোওয়া বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ আছে ‘কিতাব-এ-মোসান্নেফ-এ-আব্দির্ রাযযাক’ এবং ‘মোসান্নেফ-এ-ইবনে আবি শায়বা’ গ্রন্থগুলোতে।

হাফেয ইবনে কাইয়্যেম আরও বলে যে ওই সময় অনেক সাহাবী (রা:) থাকলেও সর্ব-হযরত যায়দ বিন সাবেত (রা:), আনাস বিন মালেক (রা:), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত এবং তাঁরা প্রচুর ফতোওয়া জারি করতেন। [ইবনে কাইয়্যেম প্রণীত ‘আলা’ম-উল-মোওয়াকিয়ীন’, কেয়াস অধ্যায়]

ঐতিহ্যবাহী চার মযহাবের ইমামবৃন্দের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা; এঁরা হলেন সর্ব-ইমাম আবূ হানিফা (রহ:), মালেক (রহ:), শাফেঈ (রহ:) এবং আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)। তাঁদের সময়েও অনেক মোহাদ্দেসীন ও উলেমা ছিলেন, কিন্তু চার মযহাবের ইমামবৃন্দ-ই ছিলেন সর্বাধিক প্রসিদ্ধ; গভীর ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন ও আস্থাভাজন হওয়ার দরুন মানুষেরা তাঁদেরই শরণাপন্ন হতেন।

আপত্তি: এই চার মযহাবের ইমামদের মধ্যেও অনেক মতপার্থক্য ছিল; এমতাবস্থায় আমরা কেন তাঁদেরকে অনুসরণ করবো?

জবাব: ইমাম বোখারী (রহ:) ও ইমাম মুসলিম (রহ:)-এর মধ্যেও দ্বিমত ছিল। মুসলিম শরীফের প্রথম খণ্ডে ইমাম মুসলিম ইমাম বোখারী (রহ:)-এর সমালোচনা করেছেন। সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর মাঝেও অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। তাঁদের নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্য থাকার কারণে আমরা কি এতে করে হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), সর্ব-ইমাম বোখারী (রহ:) ও মুসলিম (রহ:)-কে অনুসরণ বন্ধ করে দেবো?

আপত্তি: আল-বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আহাদীস (হাদীসসমূহ) অনুসরণ করলেই তো চলে; চার মযহাবের ইমামবৃন্দের অনুসরণ বন্ধ করবো না কেন?

জবাব:

/ - যদি আমরা আল-বোখারী ও মুসলিম শরীফের ওপরই কেবল নির্ভর করি এবং চার মযহাবের ইমামবৃন্দের অনুসরণ বাদ দেই, তাহলে ওই দুই হাদীসবেত্তা কেন ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর মযহাব অনুসরণ করেছিলেন?

ইমাম ইবনে আসীর লিখেছেন যে ইমাম বোখারী (রহ:) ও ইমাম মুসলিম (রহ:) শাফেয়ী ছিলেন। [ইবনে আসীর কৃত ‘জামেউল উসূল’, উভয় মোহাদ্দেসীনের জীবনী]

তাজউদ্দীন সুবকী (ইমাম তকীউদ্দীন সুবকীর পুত্র) ইমাম বোখারী (রহ:)-এর নাম শাফেয়ী মযহাবের তালিকায় উল্লেখ করেছেন। [ইমাম ২য় সুবকী কৃত ‘তাবাকাত আল-শাফেঈ’]

নওয়াব সিদ্দীক হাসান খানও ইমাম বোখারী (রহ:)-এর নাম শাফেয়ী উলেমাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।  [নওয়াব রচিত ‘আবজাদ-উল-উলূম]

উল্লেখিত দুই হাদীসবেত্তার জন্যে যদি বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ নামের হাদীসগ্রন্থ দুটো যথেষ্ট না হয়, তাহলে সাধারণ মুসলমানদের জন্যে সেগুলো যথেষ্ট বা পর্যাপ্ত হবে কী করে?

/ - ইমাম বোখারী (রহ:) ও ইমাম মুসলিম (রহ:) সমস্ত সহীহ হাদীস তাঁদের দুই বইয়ে সংকলন করেন নি। বহু সহীহ হাদীস বাদ পড়ে গিয়েছিল।

ইমাম বোখারী (রহ:) এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি বোখারী শরীফে অনেক সহীহ হাদীস সংকলন করি নি। কেননা, এতে বইটি বিশালাকৃতি ধারণ করতো।” [হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী প্রণীত ‘মুকাদ্দামাহ ফাতহুল বারী, ৯ পৃষ্ঠা]

হাফেয ইবনে কাসীর বলে যে ইমাম বোখারী (রহ:) ও ইমাম মুসলিম (রহ:) সমস্ত সহীহ আহাদীস সংকলন করেন নি (তাঁদের বই দুটোতে)। বাদ পড়া কিছু কিছু রওয়ায়াত (বর্ণনা) তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাজাহ শরীফ, নাসাঈ শরীফ ও আবূ দাউদ শরীফ নামের হাদীস-গ্রন্থগুলোতে বর্তমানে বিরাজমান। উপরন্তু, ইমাম বোখারী (রহ:) স্বয়ং বলেন যে তিনি এমন আরও দুই লক্ষাধিক হাদীস সম্পর্কে জানেন যেগুলো মুসনাদ (সনদবিশিষ্ট তথা সহীহ)। [ইবনে কাসীর রচিত ‘উলূমে আহাদীস’ এবং ‘তারীখে ইবনে কাসীর’, ইমাম বোখারীর জীবনী]

/ - বোখারী ও মুসলিম শরীফ অনুসরণ করার বেলায় মোটেও অতো সহজ কোনো বই নয়, যেহেতু হাফেয আসকালানী (রহ:) আল-বোখারীর ওপর ১৭ খণ্ডবিশিষ্ট ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন, আর মুসলিম শরীফের ওপর ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহ:) লেখেন অনুরূপ ২৫ খণ্ডবিশিষ্ট বই। তথাপিও এই মহান ব্যাখ্যাকারী দুই আলেম বেশ কিছু হাদীসের অর্থ বুঝতে পারেন নি। এমতাবস্থায় আমরা কীভাবে বোখারী ও মুসলিম শরীফ সরাসরি অনুসরণের জন্যে মুসলমান সর্বসাধারণকে উৎসাহ দিতে পারি?

/ - আমাদেরকে শুধু বোখারী ও মুসলিম শরীফ অনুসরণ করলেই চলবে না; নতুবা আমরা সে বইগুলোর অন্ধ অনুসারীতে পরিণত হবো এবং শত শত হাদীসগ্রন্থের অবজ্ঞাকারী হবো, যে হাদীসগ্রন্থগুলো লেখার সময় এমন কি ইমাম বোখারী (রহ:) এবং ইমাম মুসলিমও জন্মগ্রহণ করেন নি!  

/ - শুধু সর্ব-ইমাম বোখারী (রহ:) ও মুসলিম (রহ:)-কে অনুসরণ করাই যদি জরুরি হতো, তবে ইমাম বোখারী (রহ:) কেন নিজেই নিজের বর্ণিত হাদীসের অনুসরণ করেন নি?

() হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) লিখেন এবং ইবনে কাসীরও লিখেছে যে মানুষেরা যখন ইমাম বোখারী (রহ:)-কে কষ্ট দিচ্ছিল তখন তিনি দোয়া করেন যেন আল্লাহতা’লা তাঁর জীবনাবসান করেন [ইমাম আসকালানী কৃত ‘তাহযিব আত্ তাহযিব’ এবং ইবনে কাসীর রচিত ‘তারীখে ইবনে কাসীর’, ইমাম বোখারীর জীবনী]। অথচ তিনি-ই রাসূলে করীম (দ:)-এর একটি হাদীস বর্ণনা করেন যা’তে এরশাদ হয়েছে কোনো মুসলমান যেন আল্লাহর কাছে নিজের জীবনাবসান কামনা না করেন। [বোখারী শরীফ, আল-মারদা]

() সর্বজন জ্ঞাত ঘটনা এই যে ইমাম বোখারী (রহ:) রমযান মাসের এক রাতেই পুরো কুরআন খতম করেন। অথচ, তাঁরই সংকলিত এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে কুরআন মজীদ ৫-৭ দিনে খতম করতে হবে। [বোখারী শরীফ, ’ফযায়েলে কুরআন’ অধ্যায়]

আপত্তি: চার মযহাবের ইমাম সাহেবগণ কি বলেন নি “তোমরা যদি আমাদের কথার পরিপন্থী কোনো সহীহ হাদীস পাও, তবে আমাদের কথা না মেনে তার অনুসরণ করো?”

জবাব: এ বিষয়টি সঠিক যে, কোনো ইমাম সাহেব সহীহ হাদীসের পরিপন্থী কথা বল্লে আমাদেরকে তা বাদ দিয়ে ওই হাদীস অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু ‘সহীহ হাদীস’ বলতে আসলে এখানে কী বোঝানো হয়েছে? এটি কি সেই হাদীস যা কেবল বোখারী ও মুসলিম শরীফে লিপিবদ্ধ আছে? নাকি তা এমন এক হাদীস যা সহীহ হাদীসের মাপকাঠি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে? নাকি এমন এক হাদীস যাকে মোহাদ্দেসীন (হাদীসবেত্তাবৃন্দ) সহীহ বলেছেন? [অনুবাদকের নোট: মুজতাহিদবৃন্দের এই নির্দেশ ছিল তাঁদের শিষ্যবৃন্দের প্রতি যাঁরা নিজেরাও মুজতাহিদ ছিলেন। এটি আমাদের মতো সর্বসাধারণের জন্যে নয়]

যদি আমরা বিশ্বাস করি যে সহীহ হাদীস শুধু সেগুলোই যা বোখারী ও মুসলিম শরীফে লিপিবদ্ধ আছে, তবে আমরা সর্ব-ইমাম বোখারী (রহ:) ও মুসলিম (রহ:)-এর অন্ধ অনুসারীতে রূপান্তরিত হবো। আমরা যদি বলি, সহীহ হাদীস হলো সে সমস্ত হাদীস যেগুলো হাদীসের উসূল বা মূলনীতিমালার শর্তসমূহ পূরণ করতে সক্ষম, তবে ওই শর্ত যে সকল উলেমা আরোপ করেছেন, আমরা তাঁদেরকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করবো বটে। উপরন্তু, আমরা যদি বলি যে সহীহ হাদীস হচ্ছে সে সমস্ত হাদীস যেগুলোকে মুহাদ্দেসীনবৃন্দ সহীহ বলে দাবি করেছেন, তাহলেও আমরা তাঁদেরকে ‘অন্ধভাবে’ অনুসরণ করবো।

শেষমেশ এই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, ওপরের যে কোনো একটি মত পোষণ করলেই আমরা কারো না কারো তাকলীদ করছি।

হাফেয ইবনে তাইমিয়া লিখে, ইমামবৃন্দের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না যিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সুন্নাহর বিরোধিতা করেছিলেন। আমরা যখন কোনো ইমামের এমন কথা পাই যা সুন্নাহ’র পরিপন্থী, তখন (সিদ্ধান্ত নেই) ওই ইমামের আরোপিত সহীহ হবার শর্ত পূরণে আলোচ্য হাদীসটি অপারগ। কেননা, প্রত্যেক ইমামেরই নিজস্ব নীতিমালা ছিল যা দ্বারা কোনো হাদীস সহীহ না যয়ীফ তা তিনি নির্ধারণ করতেন। তাই এক ইমামের কাছে যে হাদীস সহীহ হিসেবে গৃহীত, সেটি অপর ইমামের কাছে সহীহ না-ও হতে পারে। [হাফেয ইবনে তাইমিয়া কৃত ‘রাফ’উল মালা’ম’, ১৫-১৬ পৃষ্ঠা]

ইমাম আবূ হানিফা (রহ:) তাঁর শিক্ষক সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)-দের কাছ থেকে যে আহাদীস পেয়েছেন, সেগুলোর দিকে লক্ষ্য করে একটি উদাহরণ পেশ করা যায়। যেহেতু এই আহাদীস সরাসরি তাঁর শিক্ষক সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)-দের থেকে তাঁর কাছে এসেছে, সেহেতু এগুলোর সহীহ হবার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় না। কিন্তু যখন এই একই আহাদীস পরবর্তী প্রজন্মের উলেমাবৃন্দের কাছে অন্য বর্ণনাকারীদের সূত্রে পৌঁছেছে, তখন তাতে অ-নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর এসনাদ বা সূত্র থাকতে পারে। কেউ এমন অ-নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস অধ্যয়ন করে যদি বলে যে ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর কোনো একটি ফতোওয়া এই অ-নির্ভরযোগ্য হাদীসের ওপর ভিত্তিশীল হওয়ার কারণে সুন্নাহ’র পরিপন্থী, তাহলে তার এই সিদ্ধান্ত অন্যায্য।

দ্বিতীয়তঃ চার মযহাবের ইমাম সাহেববৃন্দ যা বলেছেন তা চূড়ান্ত। তাঁরা তাঁদের সারা জীবন যে নতুন নতুন তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। অধিকন্তু, তাঁরা বেসালপ্রাপ্ত তথা পরলোকে খোদাতা’লার সাথে মিলিত হবার পর তাঁদের শিষ্যবৃন্দ নিজ নিজ ইমামের কাজগুলো যাচাই-বাছাই ও সংস্কার করেছেন নতুন তথ্যাদি সন্নিবেশের উদ্দেশ্যে। পরবর্তীকালে তাঁদের শিষ্যরাও এই একই পদ্ধতি বজায় রাখেন। এটি-ই ফেকাহ’র ‘মযহাব’ নামে পরিচিত।

কোনো নির্দিষ্ট মযহাবের একটি ফতোওয়া বোখারী ও মুসলিম শরীফের কোনো সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হলে এর মানে এই নয় যে ফতোওয়াটি সুন্নাহ-বিরোধী; কেননা, ওই মযহাব অন্য কোনো সহীহ হাদীসকে অনুসরণ করেই ফতোওয়া জারি করেছে, আর তাই তা সুন্নাহ-বিরোধী নয়।

অন্ধ অনুসরণের দু’টি নমুনা

/ - নাসিরুদ্দীন আলবানী লিখেছে, মহানবী (দ:)-এর প্রতি আরোপিত হাদীস যা’তে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত ঈসা (আ:) ও ইমাম মাহদী (রহ:) একই ব্যক্তি, তা একেবারেই অসত্য। যদিও সর্ব-ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ:), হাকিম (রহ:), আবদুল বারর (রহ:) এবং অন্যান্য ইসলামী উলেমা এই হাদীসটি নিজেদের বইপত্রে উল্লেখ করেছেন, তথাপি এটি জাল হবার কারণ এই যে, সর্ব-ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহ:) ও বায়হাকী (রহ:) উভয়েই লিখেছেন এর বর্ণনাকারী (রাবী) মোহাম্মদ বিন খালেদ অপরিচিত ব্যক্তি। অধিকন্তু, ইমাম যাহাবী-ও এই হাদীসকে মওযু (জাল) মনে করেন। ইমাম সাগানী বলেন যে এটি বানোয়াট। ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) বলেন যে মানুষেরা এটি বানিয়েছিল। ইমাম কুরতুবী (রহ:) এই বর্ণনাকে দুর্বল বিবেচনা করেন। [ নাসিরুদ্দীন আলবানী কৃত ’সিলসিলা-এ-আহাদীস যয়ীফা’, ৭৭ নং হাদীস]

ওপরের বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায় কীভাবে আলবানী উল্লেখিত ইমামবৃন্দের রায়কে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছে। উপরন্তু, ইমাম যাহাবী হাদীসটিকে জাল বলায় সে-ও তাকে জাল বলেছে। কাযী শওকানী এটিকে বানোয়াট বলায় সে-ও বানোয়াট বলেছে। আলবানীর এই গবেষণা সম্পর্কে কী বলা যায়? সে কি কুরআন ও সুন্নাহকে অনুসরণ করছে, না ইমামবৃন্দকে? কেউ তার বইপত্র পড়লে দেখবেন, সে প্রতিনিয়ত ইমামদেরকেই অনুসরণ করেছে। আলবানী যদি তাকলীদ এড়াতে না পারে, তাহলে সাধারণ মুসলমানদের জন্যে আইম্মায়ে মযাহীব (মযহাবের চার ইমাম)-এর মধ্যে কারো একজনের তাকলীদ মানা অবশ্য কর্তব্য।

আলবানী যখন ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাসীর, শওকানী, যাহাবী, ইমাম আসকালানী (রহ:) কিংবা ইবনে আবি হাতেমকে ইমাম মেনে অনুসরণ করে, তখন তাকে একজন বড় মাপের পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি বিবেচনা করা হয়। অথচ যখন মানুষেরা ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-কে অথবা বাকি তিন ইমামের কাউকে অনুসরণ করেন, তখন তাঁদেরকে অজ্ঞ-মূর্খ বেদআতী (নতুন প্রথা প্রবর্তনকারী) বিবেচনা করা হয়। অতএব, এতদ্দর্শনে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বাধ্য যে, এক দল লোকের জন্যে এক ধরনের নীতি, এবং অপর দলের জন্যে আরেক ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে (অর্থাৎ, দ্বৈত নীতি - double standards)।

/ - নাসিরুদ্দীন আলবানী ইমাম দারিমী (রহ:)-এর একটি রওয়ায়াতকে উদ্ধৃত করে, যা’তে বর্ণিত হয়েছে যে মদীনা মনোওয়ারায় একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়; মানুষেরা হযরত আয়েশা (রা:)-এর কাছে আরযি দেন এ থেকে পরিত্রাণের জন্যে। তিনি তাঁদেরকে বলেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা শরীফের ছাদে একটি ছিদ্র করতে। তাঁরা এ কাজ করার পরে বৃষ্টি নামে। এতে ফলে-ফসলে মাঠ-প্রান্তর ভরে ওঠে এবং উট হৃষ্টপুষ্ট হয়। মানুষেরা ওই বছরটিকে ‘ফসলের বছর’ নামে আখ্যায়িত করে। আলবানী বলে, এই বর্ণনা ভুয়া, কেননা এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে সাঈদ ইবনে যায়ীদ দুর্বল। ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহ:)-এর মতে এই রওয়ায়াত সহীহ নয়। ইমাম যাহাবী-ও সাঈদ ইবনে যায়ীদের বর্ণনাকে দুর্বল বলেছেন। ইমাম সা’আদী তাকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী হিসেবে বিবেচনা করেন নি। ইমাম নাসাঈ (রহ:) বলেন যে সাঈদের জ্ঞান কম; তবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) তাকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন, আর এই রওয়ায়াতের অপর বর্ণনাকারী মোহাম্মদ বিন ফযল-ও নির্ভরযোগ্য বলে সর্বজনবিদিত। কিন্তু, ইবনে ফযল জীবনের শেষাংশে স্মৃতিবিলোপ রোগে ভুগেছিলেন। আমরা জানি না ইমাম দারিমী (রহ:) এই রওয়ায়াত (বর্ণনা) তাঁর স্মৃতি বিলুপ্ত হবার আগে না পরে তাঁর কাছ থেকে নিয়েছিলেন। তাই আমরা এই বর্ণনাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না; আর হাফেয ইবনে তাইমিয়া-ও ওপরোক্ত এই বর্ণনাকে অস্বীকার করেছে। ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘আল-রাদ আল-বাকারী পুস্তকে লিখেছে যে হুযূর পাক (দ:)-এর রওযার ছাদে বাতায়ন হযরত আয়েশা (রা:)-এর হায়াতে জিন্দেগীর সময়কালে অস্তিত্বশীল ছিল না। এই বাতায়ন খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দিল মালেকের (উমাইয়া) শাসনামলে 
অস্তিত্ব পায়। আর তাই এই বর্ণনাটি মিথ্যে। হযরত আয়েশা (রা:) যে মানুষদেরকে রওযা শরীফের ছাদে ফুটো করতে বলেছিলেন তা তাঁর ব্যক্তিগত মত; এ কারণে তা গ্রহণযোগ্য নয়। [নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রণীত ‘আত্ তাওয়াসসুল ১ম খণ্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা]

ওপরের এই উদ্ধৃতিতে আবারো পরিলক্ষিত হলো যে আলবানী ইমামদের ওপর নির্ভরশীল এবং সে কতোটুকু অন্ধভাবে হাফেয ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করে। এখন আমরা ওই সব লোক, যারা আমাদেরকে ইমাম আবূ হানিফা (রহ:) বা ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর তাকলীদ মানার অভিযোগে অভিযুক্ত করে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারি যে কেন নাসির আলবানী শুধুমাত্র ইমাম যাহাবী, ইমাম আসকালানী (রহ:), হাফেয ইবনে তাইমিয়া ও শওকানীকে অনুসরণ করে? আলবানীর দ্বারা যদি ইমামদের অনুসরণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে আইম্মা-এ-মযাহীবদের কোনো একজনের অনুসরণ কেন দূষণীয় হবে?

ইমাম দারিমী (রহ:)-এর ওপরোক্ত রওয়ায়াতের ব্যাপারে নাসির আলবানীর চারটি বিষয় নিয়ে গবেষণাকে আমরা এক্ষণে যাচাই করবো।

আলবানীর গবেষণার প্রথম জবাব হলো এই যে, সে শুধু ওই সকল উলেমার উদ্ধৃতি দিয়েছে যারা বর্ণনাকারী হিসেবে সাঈদ ইবনে যায়ীদকে অ-নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেছেন। এর কারণ হলো, যদি সে ওই বর্ণনাকারীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ অন্যান্য সকল উলেমার উদ্ধৃতি দিতো, তবে তাকে তাঁদের বর্ণনা স্বীকার করে নিতে হতো। এটি আলবানীর নিজের এবং তার ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ধ্যান-ধারণার খেলাফ ছিল। সাঈদ ইবনে যায়ীদ সম্পর্কে এক্ষণে আমরা অন্যান্য উলেমাদের মতামত বিবেচনায় নেবো।

ইমাম বোখারী (রহ:) সাঈদ ইবনে যায়ীদকে সত্যবাদী ও হাদীসশাস্ত্রে জ্ঞানী ব্যক্তি বলে অভিহিত করেন। [ইমাম বোখারী কৃত ‘তারিক আল-কবীর’, সাঈদ ইবনে যায়ীদের জীবনী]

হাফেয ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাসীর একমত যে ইমাম বোখারী (রহ:) সারা দুনিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ হাদীসশাস্ত্রজ্ঞ ও রওয়ায়াত-বিশারদ। [ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘ফাতাওয়া-এ-ইবনে তাইমিয়া, ৩য় খণ্ড, ২০০ পৃষ্ঠা এবং ইবনে কাসীর কৃত ইমাম বোখারীর জীবনী]

ইমাম ইবনে হাতেম বলেন, ইমাম আবূ যোহরার মতে সাঈদ ইবনে যায়ীদ একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি। [ইবনে হাতেম প্রণীত ‘জারহু ওয়া’ তায়াদিল’, সাঈদ ইবনে যায়ীদের জীবনী]

হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) লিখেন, ইয়াহইয়া বিন মুঈনের মতে সাঈদ ইবনে যায়ীদ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। এছাড়া, ইমাম আজল, ইমাম আবূ যাহরাহ বলেন যে তিনি আস্থাভাজন। ইমাম নাবায়ান বিন হিলাল বলেন যে সাঈদ ছিলেন হাদীসশাস্ত্রজ্ঞ। কিন্তু ইমাম দারু কুতনী তাঁকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেন। [হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) রচিত ‘তাহযিব আত্ তাহযিব’, সাঈদ ইবনে যায়ীদের জীবনী]

সাঈদ ইবনে যায়ীদ সম্পর্কে ওপরোক্ত উলেমা-এ-কেরামের দৃষ্টিভঙ্গি কেন আলবানী প্রত্যাখ্যান করেছে তা দেখে আমরা আশ্চর্য হই। এর কারণ হতে পারে এই যে, ইমাম বোখারী (রহ:) ও ইয়াহইয়া বিন মুঈন (রহ:) কর্তৃক প্রদত্ত সাঈদের নির্ভরযোগ্যতার স্বীকৃতিকে মেনে নিলে সাঈদ এবং ওই হাদীসের গ্রহণযোগ্যতাকেও আলবানীর মেনে নেয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। স্মর্তব্য যে, তার দুই ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাসীর উভয়েই হাদীসশাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে ইমাম বোখারী (রহ:)-এর বিশ্বসেরা হবার বিষয়টি সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করেছে।

এই বর্ণনাটি সম্পর্কে আলবানীর দ্বিতীয় যে আপত্তি তা হলো, হাদীসটির বর্ণনাকারী মোহাম্মদ বিন ফযল জীবনের শেষদিকে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ইমাম দারিমী (রহ:) তাঁর কাছ থেকে হাদীসটি তাঁর স্মৃতি হারাবার আগে না পরে সংগ্রহ করেন তা জানা যায় না। তাই আলবানী এই রওয়ায়াত মেনে নিতে নারাজ।

ওপরের আপত্তির প্রতি জবাব হলো, মোহাম্মদ ইবনে ফযল ইমাম বোখারী (রহ:) ও ইমাম মুসলিম উভয়েরই শিক্ষক। ইমাম বোখারী (রহ:) তাঁর থেকে বহু হাদীস সংগ্রহ করেন। আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য অভিমত আছে যে ইমাম সাহেব তাঁর কাছ থেকে হাদীস সংকলন করেন তাঁরই অসুখের আগে। অধিকন্তু, ইমাম দারিমী (রহ:)-ও ইমাম বোখারী (রহ:)-এর মতোই একজন হাদীসশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন এবং তিনি বুঝতে ও বিচার-বিবেচনা করতে সক্ষম ছিলেন কখন কোনো হাদীস বর্ণনাকারীর কাছ থেকে রওয়ায়াত গ্রহণ করতে হবে।

স্মৃতি বিলুপ্ত হওয়া রাবী (বর্ণনাকারী)-দের কাছ থেকে হাদীস সংগ্রহের অভ্যেস ইমাম দারিমী (রহ:)-এর মধ্যে ছিল এমন কোনো তথ্য পাওয়া গেলে আলবানীর অভিযোগ সত্য বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু এর পক্ষে কোনো প্রমাণ-ই নেই।

আলবানী যদি এই দাবিতে অনড় থাকে যে ইমাম দারিমী (রহ:) মোহাম্মদ বিন ফযলের স্মৃতি বিলুপ্ত হওয়ার পরে তাঁর কাছ থেকে হাদীস সংকলন করেছেন, তাহলে অপরাপর যে কেউ এই দাবিও উত্থাপন করতে পারে যে ইমাম বোখারী (রহ:)-ও তাঁর কাছ থেকে একইভাবে তাঁর স্মৃতি বিলুপ্ত হওয়ার পরে হাদীস সংগ্রহ করেছেন। কেননা, তিনি কবে থেকে স্মৃতি হারিয়েছিলেন তার কোনো ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত নেই।

হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) স্বরচিত ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেন যে ইমাম বোখারী (রহ:) মোহাম্মদ ইবনে ফযল থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন তাঁর স্মৃতি বিলুপ্ত হওয়ার আগেই। তবে হাফেয ইবনে হাজর (রহ:) স্মৃতি-বিলোপের সময়কাল উল্লেখ করেন নি; অথবা তিনি এও বলেন নি ইমাম বোখারী (রহ:) যে ইবনে ফযল থেকে হাদীস সংগ্রহ করতেন তা তিনি (ইবনে হাজর) কীভাবে জেনেছিলেন। এমতাবস্থায় আমরা হতবাক হয়েছি এটি দেখে যে কীভাবে আলবানী ইমাম দারিমী (রহ:)-কে এই রওয়ায়াতের ব্যাপারে সন্দেহ করেছে। এতে অন্যরাও ইমাম বোখারী (রহ:)-এর ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়তে পারে।

/ - এই বর্ণনাটির প্রতি আলবানীর তৃতীয় আপত্তি হলো, উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ বিন মালেকের শাসনামলে হযরত আয়েশা (রা:)-এর ঘর, যা’তে মহানবী (দ:)-কে দাফন করা হয়, তা পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং তাতে একটি বাতায়নও স্থাপন করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে বাতায়নটি হযরত আয়েশা (রা:)-এর নির্দেশে করা হয় নি। অতএব, আলবানীর মতে, হযরত আয়েশা (রা:)-এর বাতায়ন নির্মাণের আদেশসম্বলিত বর্ণনাটি বানোয়াট।

তবে খলীফা ওয়ালিদ যখন হযরত আয়েশা (রা:)-এর ঘর পুনর্নির্মাণ করেন, তখন ওই বাতায়ন-ও ‍পুনরায় নির্মাণ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চিত নই যে ওই ঘর পুনঃনির্মাণের আগে বাতায়নটির অনস্তিত্ব ছিল।

ইমাম ইবনে জারীর তাবারী নিজ ‘তারীখ’ গ্রন্থে লিখেন এবং হাফেয ইবনে কাসীর-ও তার ‘তারীখ’ পুস্তকে লিখে যে খলীফা ওয়ালিদের শাসনামলে মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ করা হয় এবং এই সময় হযরত আয়েশা (রা:)-এর ঘরটি (রওযা মোবারক) মসজিদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বইগুলো কোনো বাতায়নের কথা উল্লেখ করে নি। অতএব, বাতায়ন-সম্পর্কিত এই রওয়ায়াত সহীহ নয়, এমন কথা কীভাবে বলা যায়?

নাসির আলবানী বলে ইবনে তাইমিয়া কখনােই এই বর্ণনাকে স্বীকার করে নি। অথচ হাফেয ইবনে তাইমিয়া অন্যত্র এটিকে স্বীকার করে নিয়েছে।

হাফেয ইবনে তাইমিয়া লিখে যে হযরত আয়েশা (রা:)-এর জীবদ্দশায় মদীনা মোনাওয়ারায় একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তিনি তাঁর ঘর, যেখানে মহানবী (দ:)-এর রওযা বিদ্যমান, সেটির ছাদ উম্মুক্ত করেন। এটি এ কারণে করা হয় যে বৃষ্টি হলো আল্লাহতা’লার নেয়ামত (আশীর্বাদ), আর তা রাসূলে আকরাম (দ:)-এর রওযার ওপর বর্ষিত হবে। [হাফেয ইবনে তাইমিয়া কৃত ‘একতেদা আস্ সেরাত আল-মোস্তাকীম’, ৩৩৮ পৃষ্ঠা]

এই বর্ণনা সহীহ না হলে হাফেয ইবনে তাইমিয়া এটি প্রত্যাখ্যান করতো। কিন্তু সে তা করে নি। তাই এই সহীহ রওয়ায়াত গ্রহণযোগ্য।

/ - আলবানী দাবি করে যে এটি হযরত আয়েশা (রা:)-এর ব্যক্তিগত অভিমত।

এর জবাব হলো এই বাস্তবতা যে, ওই সময় হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) সবাই হায়াতে জিন্দেগীতে ছিলেন এবং তাঁরা হযরত আয়েশা (রা:)-এর কাজে বাদ সাধেন নি। অতএব, তিনি এবং সাহাবাবৃন্দ (রা:) এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। এটি-ই গোটা উম্মতের জন্যে প্রামাণ্য দলিল, ব্যতিক্রম শুধু আলবানী।

পরিশেষে বলবো, আলবানীর যদি সর্ব-ইমাম যাহাবী, আসকালানী (রহ:), আবূ হাতেম, ইবনে আদী, হাফেয ইবনে তাইমিয়া ও শওকানীর ‘তাকলীদ’ প্রয়োজন হয়, তবে মুসলমান সর্বসাধারণের পক্ষে চার মযহাবের সর্ব-ইমাম আবূ হানিফা (রহ:), মালেক (রহ:), শাফেঈ (রহ:) ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) সাহেববৃন্দের ‘তাকলীদ’ মানা জরুরি।

দ্বিতীয়তঃ আলবানীর গবেষণা নির্ভরযোগ্য নয়, কেননা সে যে সব মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে সেগুলোকে সে উপেক্ষা করে।

এই লেখককে যে কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা সাহায্য করেছিল -

একবার এক তরুণ আমার কাছে এসে আমায় বলে কেন আমি কেবল বোখারী ও মুসলিম মানি না; সে আমায় কোনো ইমামকে না মেনে শুধু বই দুটো অনুসরণের তাকিদ দেয়। আর ’বেদআতী’ হতে মানা’(বারণ) করে।

আমি তার জবাবে দুটো হাদীস প্রদর্শন করি এবং তাকে বলি সে এই দুটোর অর্থ কী বোঝে। একটি হাদীস বোখারীর, অপরটি মুসলিমের। ওই তরুণ দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল সে এটি প্রমাণ করবে যে তার ব্যাখ্যা সর্ব-ইমাম আবূ হানিফা (রা:) ও মালেক (রহ:)-এর চেয়ে শ্রেয়তর। কেননা, তাঁদের জমানায় কোনো কম্পিউটার ছিল না যে তাঁরা আহাদীসের ডাটাবেজ তৈরি করবেন!

ওই দুটো হাদীস হলো:

/ - ইমাম বোখারী (রহ:) বর্ণনা করেন, হযরত আমর বিন মায়মূন (রা:) বলেন: আমি একটি বানরকে দেখলাম যেটি সদ্য অপর এক বানরীর সাথে সহবাস করেছে, আর অন্যান্য বানরগুলো তাদেরকে পাথর মারছে; এমতাবস্থায় আমিও তাদেরকে পাথর মারা আরম্ভ করলাম। [বোখারী শরীফ, ‘আইয়ামুল জাহেলীয়্যাহ’ অধ্যায়]

/ - হযরত আনাস (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ:) হযরত আলী (ক:)-কে আদেশ করেন এক মুসলমান-ব্যক্তিকে হত্যা করতে, যার বিরুদ্ধে মানুষেরা এক দাসীর সাথে অবৈধ যৌনাচারের অভিযোগ এনেছিল। হযরত আলী (ক:) তাকে একটি হ্রদে গোসল করতে দেখেন। তিনি তাকে কাছে ডাকলে সে উঠে আসে, তবে তার পরণে কোনো কাপড় ছিল না। হযরত আলী (ক:) তাকে ছেড়ে দেন, কারণ তিনি দেখতে পান যে এই লোক খোজা হওয়ার দরুন যেনা করতে অক্ষম। [মুসলিম শরীফ, ‘তওবা’ অধ্যায়]

ওই তরুণ এই দু’টি হাদীসের ব্যাখ্যায় বলে:

বোখারীর এই রওয়ায়াত দ্বারা পরিষ্কার যে, ইসলামী বিধান মোতাবেক জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে বিয়ে-শাদী দেয়া উচিৎ; আর যদি তারা অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের জীবনকে আরও সভ্য করার জন্যে মানুষের মতোই শাস্তির বিধান করা চাই। উপরন্তু, দ্বিতীয় হাদীসটির বেলায় বলা যায়, কেউ কোনো নারীর সাথে অবৈধ যৌনাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে তাকে মেরে ফেলা উচিত; তবে মারার আগে পরীক্ষা করতে হবে, সে খোজা কি-না।

যে সব লোক ইমামবৃন্দের তাকলীদ বাদ দিয়ে বোখারী ও মুসলিম শরীফের শরণাপন্ন হবার পরামর্শ দেয়, তাদের দ্বারা প্রয়োগকৃত ‘এজতেহাদের’ একটি নমুনা এটি।

                                      ---সমাপ্ত---