Monday 12 October 2020

আখেরী চাহার সোম্বা

খুশির দিন বা পবিত্র দিন

মূল: সৈয়দ নুরুজ্জামান হাশেমী
সম্পাদনা: আলহাজ্ব মুফতী এস এম সাকীউল কাউছার


পবিত্র আখেরি চাহার সোম্বা অর্থাৎ চন্দ্র মাস সফরের শেষ বুধবার।

ফারসী ভাষায় চাহার সোম্বা বলা হয় বুধবারকে।

আর আখের মানে শেষ, তা হলে আখেরী চাহার সোম্বা মানে হল শেষ বুধবার।

এ দিনে মহানবী (صلى اللّٰه عليه وسلم) জ্বরমুক্ত হয়ে সর্বশেষ গোসল করেন।

গোসল শেষে নাতিদ্বয় হযরত ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه), হযরত ইমাম হোসাইন (رضي اللّٰه عنه) এবং মা ফাতেমা (رضي اللّٰه عنها)’কে ডেকে এনে তাদের সাথে সকালের নাস্তা করেন।

হুজুরে পুর নুর (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর পাগল সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দ এ খবর পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। যে যাঁর মত দান সদকা করতে লাগলেন।

হযরত বেলাল (رضي اللّٰه عنه) এবং সুফফাবাসীবৃন্দ বিদ্যুৎ বেগে এ সুসংবাদ মদিনার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেন। এ সুসংবাদে সাহাবায়ে কেরামের (رضي اللّٰه عنهم) মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। তাঁরা বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো দলে দলে এসে হুজুর (صلى اللّٰه عليه وسلم)-কে এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। হুজুর (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর রোগমুক্তিতে সাহাবায়ে কেরাম (رضي اللّٰه عنهم) এতটাই খুশী হয়েছিলেন যে, হযরত আবুবকর সিদ্দিক (رضي اللّٰه عنه) তৎকালের ৫ হাজার দিরহাম গরীবদের মধ্যে বিলিবণ্টন করেছিলেন।

হযরত ওমর (رضي اللّٰه عنه) দান করেন ৭ হাজার দিরহাম।

হযরত ওসমান (رضي اللّٰه عنه) দান করেছিলেন ১০ হাজার দিরহাম ও হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) দান করেছিলেন ৩ হাজার দিরহাম। ধনী ব্যবসায়ী হযরত আবদুর রহমান (رضي اللّٰه عنه), ইবনে আউফ (رضي اللّٰه عنه) ১০০ উট আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেন।

রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর সামান্য আরামবোধের কারণে সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم) কীভাবে জান-মাল উৎসর্গ করতেন, এটাই তার সামান্য নমুনা। সুবহান-আল্লাহ! 

রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর সামান্য রোগমুক্তির দিবস আখেরি চাহার সোম্বার দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে পারস্যসহ এশিয়ার পাক-ভারত উপমহাদেশে অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে এ দিনটি পালন করা হয়। যারা এ দিবস পালনকে বিদ’আত বলে অপপ্রচার করে, তারা এ ঘটনাকে মুসলমানদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলার জন্যই তা করে। এটা সাহাবায়ে কেরামের (رضي اللّٰه عنهم) বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

ওই লোকেরা কেন এটাকে বিদয়াত বলে?

অথচ এখানে নিহিত রয়েছে রাসুল পাকের (صلى اللّٰه عليه وسلم) প্রতি সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দের মহব্বত, গোটা উম্মতেরই মহব্বত।

আমরা মানুষেরা ফেরাউনের ঘটনা, হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)’এর অগ্নিতে নিক্ষেপ ও মুক্তির পবিত্র ঘটনা স্মরণ করে হেদায়েতের আলো লাভ করে থাকি।

আখেরি চাহার সোম্বা’র দিনে অর্থাৎ আরবি সফর মাসের শেষ বুধবারে (সেদিন ৩০শে সফর ছিলো) গোসল শেষে শোকর গোজার হিসেবে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় শেষে রোগ থেকে শেফার দোয়া ও দান-খয়রাত হচ্ছে বুজুর্গানে দ্বীনের আমল। আখেরি চাহার সোম্বার দিনে বিভিন্ন দরবার, মাজার, খানকায় ওয়াজ-নসীহত, জিকির-আজকার, মিলাদ, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

বর্ণিত আছে, রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم) এই দিন রোগ থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং গোসল করেন।

এ দিনের পর তিনি আর গোসল করেননি। এরপর তাঁর রোগ বৃদ্ধি পায়। অতঃপর ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে বেসালপ্রাপ্ত হন।

এই দিনটিতে মুসলমানবৃন্দ গোসল করেন, নতুন পোশাক পরিধান করেন এবং খোশবু লাগান। [ফারহাঙ্গ-ই-আসফিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৬]।

দ্বিতীয় হিজরী সালের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হিজরী/৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) বলেন, রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم) যে অসুস্থতায় বেসালপ্রাপ্ত হন, তা শুরু হয়েছিল সফর মাসের কয়েক রাত বাকি থাকতে। [আস সিরাহ আন নববীয়্যাহ: ইবনু হিশাম]।

সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দ যদি প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর আরোগ্যতে খুশি হয়ে দিবসটি পালন করে থাকেন, এরপর ১৫০ হিজরীতেও যদি এটা পালিত হয়ে থাকে, তাহলে আজকে এরা কারা, যারা এই দিনে নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর উম্মতকে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে নিষেধ করছে?

আপনি কেন খুশি হবেন? কারণ, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (صلى اللّٰه عليه وسلم) সফর মাসের শেষ বুধবার ভোর বেলায় উম্মুল মোমেনীন হযরত বিবি আয়েশা সিদ্দীকা (رضي اللّٰه عنها)’কে ডেকে বলেন, বিবি আমার কাছে আসেন। তখন মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها) তাঁর কাছে আসলে তিনি ফরমান: “হে আয়েশা সিদ্দিকা, আমার মাথা ব্যথা যেন দূর হয়ে গেছে। শরীর হাল্কা মনে হচ্ছে। আমি আজকে সুস্থ বোধ করছি।” এই কথা শ্রবণ করে বিবি আয়েশা (رضي اللّٰه عنها) অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তাড়াতাড়ি পানি দ্বারা হযরত রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর শির মোবারক ধুয়ে দেন এবং সমস্ত শরীরে পানি ঢেলে ভালোভাবে গোসল করান।

এই গোসলের ফলে হুজুর পাকের (صلى اللّٰه عليه وسلم) শরীর মোবারক হতে বহুদিনের রোগজনিত ক্লান্তি ও অবসাদ বহুলাংশে দূর হয়ে যায়। তখন তিনি বিবি আয়েশা (رضي اللّٰه عنها)’কে ঘরে কোনো খাবার আছে কি না জিজ্ঞাসা করেন। হযরত আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها) উত্তর দেন, জি, ঘরে রুটি পাকানো আছে। রাসুল (صلى اللّٰه عليه وسلم) বলেন, ওগুলো নিয়ে এসো এবং মা ফাতেমাকে খবর দাও, দুই পুত্র হাসান ও হোসাইনকে নিয়ে আমার কাছে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে। বিবি আয়েশা (رضي اللّٰه عنها) হযরত মা ফাতেমা (رضي اللّٰه عنها)’কে খবর দেন এবং ঘরে যে খাবার ছিল তা এনে রাসুলল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর সামনে হাজির করেন।

হযরত বিবি ফাতেমা (رضي اللّٰه عنها) আসার পর হযরত রাসূলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم) মেয়েকে আদর করেন এবং নাতি দুই জনের কপালে চুমু খেয়ে তাঁদের নিয়ে খেতে বসেন। খবর শুনে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যান্য বিবি ও ঘনিষ্ঠ সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’মণ্ডলী হাজির হন।

অতঃপর রাসূল (صلى اللّٰه عليه وسلم) মসজিদে নববীতে গমন করেন এবং নামাজের ইমামতি করেন। হযরত (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর শরীরের উন্নতি দেখে সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم) অত্যন্ত আনন্দিত হন। দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর সুস্থ দেহে হযরত (صلى اللّٰه عليه وسلم) মসজিদে নববীতে এসে ইমামতি করেন।

এই অপার আনন্দে সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করতে থাকেন। 

আপনারা বলুন তো ওই দিন কি আবু জেহেল খুশি হয়েছিল? আজকে যারা খুশি হয় না তাদের কী বলে অভিহিত করবেন?

হে মো’মেন মুসলমানবৃন্দ,

আসুন, এই সফর মাসের শেষ বুধবার, যে দিনে হযরত মুহাম্মদ (صلى اللّٰه عليه وسلم)-সহ সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)’মণ্ডলীর খুশির এই দিনে দরূদ, এবাদত-বন্দেগী করে দয়াময় আল্লাহ পাকের দরবারে আমরা দোয়া করি। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের দেশ, জাতি ও সারা বিশ্বের মুসলমানদেরকে শান্তি ও মঙ্গল দান করেন, আমীন।

কিছু লোক বলে বেড়ায়, রাসুলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর (যাহেরী/প্রকাশ্য) জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন; শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সাজদায় অবনত হয়েছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীবৃন্দ (رضي اللّٰه عنهم)-ও আনন্দিত হয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময়ে সেই দিন বা মুহূর্তকে তাঁরা বাৎসরিক ‘আনন্দ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেননি। এজন্য রাসুলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর নির্দেশ বা সাহাবী (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দের কর্ম ছাড়া এইরূপ কোনো দিন বা মুহূর্ত পালন করা বা এইগুলিতে বিশেষ ইবাদতকে বিশেষ সওয়াবের কারণ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
 
প্রশ্ন জাগে, প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم) কি ১৭ই রমজান বদর দিবস পালন করেছিলেন? ওই আপত্তি উত্থাপনকারীরা কিন্ত করে।

নবী পাক (صلى اللّٰه عليه وسلم) কি সিরাতুন্নাবী (দ:) দিবস পালন করেছিলেন? ওরা কিন্ত পালন করে!

নবী করীম (صلى اللّٰه عليه وسلم) কি হুদায়বিয়া দিবস, মক্কা বিজয় দিবস, খতমে বুখারী, দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করেছিলেন? এরা কিন্ত তা করে।

এর উত্তরে তারা বলে, না, নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’মণ্ডলী শোম্বা পালন করেছেন একদিন, প্রতি বছর তো করেননি!

তাই ওরা খুঁজে খুঁজে বের করে বলে, ইমাম ইবনে হাজর (رحمة اللّٰه عليه) বলেছেন যে রাসুল পাক (صلى اللّٰه عليه وسلم) বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার ৫ দিন আগে হয়েছিলো সোম্বা [ইবনু হাজর, ফাতহুল বারী ৮/১৪২]। মানে ১২ই রবিউল আউয়াল বেসাল শরীফ হলে তা ঘটেছিল ৮ই রবিউল আউয়াল তারিখে।

এটা শুধু ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة اللّٰه عليه)’এর মত।
যারা ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বিবৃত নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم) নূর, তিনি এলমে গায়েব সম্পর্কে অবগত ও হাজির-নাজির মেনে নেয় না, তারাই আজ ’ফাতহুল বারী‘ গ্রন্থের শরণাপন্ন হওয়াটা মুনাফিকি নয় কি?

নবী পাক (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর কোনো দুশমন তো তাঁর সুস্থতায় আনন্দ করবে না! কিন্ত একজন মু‘মিনের কাছে রাসুল পাক (صلى اللّٰه عليه وسلم) অসুস্থতা থেকে সুস্থ হওয়ার চেয়ে বেশি আর কি কোন আনন্দের দিন থাকতে পারে?

আপত্তিকারীরা কেন বলে নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم) করেননি, তাই প্রতি বছর আমাদের এই দিবস পালন করার দরকার নাই?

কারণ, প্রতি বছর এই কাজটা করলে মানুষের মনে নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর প্রতি মহব্বত কমবে না, বরং বেড়ে যাবে। মানুষ নবী পাক (صلى اللّٰه عليه وسلم)’কে ভুলে যাবেন না; আরো বেশি মনে রাখবেন। তাই এ ফতওয়া - ‘এটা বিদয়াত!’

যে ব্যক্তি আখেরী চাহার শোম্বার দিনে চার রাকআত নফল নামাজ পাঠ করবেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রক্ষা করবেন এবং হেফাজতে রাখবেন। [খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (رحمة اللّٰه عليه) কৃত ’রাহাতিল কুলূব,’ পৃষ্ঠা-১৩৯]

আজ যারা আখেরী চাহার শোম্বাকে বিদয়াত বলছে, তাদের এ কথা হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (رحمة اللّٰه عليه)’এর মোকাবিলায় কতোখানি গুরুত্ব বহন করে?

কর্জমুক্ত হবার দুআاللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ، وَقَهْرِ الرِّجَالِ- উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযান, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিনাল-‘আজযি ওয়াল-কাসাল, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিনাল-বুখলি ওয়াল-জুবন, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিন গালাবাতিত দায়নি ওয়া কহরির- রিজাল।

Friday 21 August 2020

একান্ত ভাবনা: আলা হযরত চেতনা!

 

📌📌📌📌📌📌📌📌📍📍📌📌📌📍📍
মুফতী আল্লামা আবুল ফজল সাইফুল্লাহ (মাঃজিঃআঃ)

মসলক শব্দের অর্থ রীতি আদর্শ, মতবাদ। মসলকে আ'লা হযরত অর্থ, মওলানা আহমদ রেজা বেরলবী নামক এক জন মওলানা তথা ধর্মীয় পণ্ডিত ব্যক্তির মতবাদ/আদর্শকে যারা অনুসরণ করে, তাদের মসলকে আলা হযরতের অনুসারী বলা হয়।

প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর খোলফায়ে রাশেদার যুগ হতে চার মাজহাবের শেষ ইমাম আজম আবু হানিফা (রহমতুল্লাহে আলাইহে) পর্যন্ত অসংখ্য মুজতাহিদ ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম), তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) প্রমুখ বড় বড় জ্ঞানীবৃন্দ ইজতিহাদ করেছেন। এঁদের অনেকে নিজেই নিজের ইজতিহাদের অনুসারী ছিলেন নতুবা নিজের চাইতে বড় জ্ঞানী কারো অনুসরণ করতেন। যেমন, সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, উম্মুহাতুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর তাকলীদকে অপরাপর সাহাবী (রা:)’মণ্ডলী অনুসরণ করতেন। কিন্তু খাইরুল করণের পর এ তাকলীদি ইজতিহাদ আর বেশি দূর এগোয়নি। শেষ অবধি শাফেয়ী মালেকী হাম্বলী ও হানাফী মাযহাবে তাকলিদী ইজতিহাদ’কে সমসাময়িক উলামায়ে আহলে সুন্নাহ’বৃন্দের ইজমা বা ঐকমত্যে সীমাবদ্ধকরণ হয়। উসূলে দ্বীনের ভিত্তি চারটি। কুরআন, সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মাহ ও কিয়াস। চার মাজহাব চার উসূলে দ্বীনেরই সমন্বিত নাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত। এজন্য ইজমায়ে উম্মাতের মাধ্যমে উসুল চতুষ্টয়ের ধারায় আজকের দিনে পঞ্চম কোনো মাজহাব গড়ার সুযোগ নেই। পঞ্চম মতবাদ, হোক সে লা মাজহাবী বা ভিন্ন নামে কোন মসলক, তা নিশ্চিত বিভ্রান্তি নয়তো গোমরাহী। চার মাজহাবের সন্মিলিত নাম মসলকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত। যদি কেউ লা-মাজহাবীদের মতো চার মাজহাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইজমায়ে উম্মাহ’কে অস্বীকার করে চুনের পানি দুধের ঘোলা বলে, তাহলে সাবধান! পানকারীর জিভে সেটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করবে। সূফীয়ায়ে কেরাম (রহ:)’মণ্ডলীর মধ্যে চিন্তাধারার ভিত্তিতে একেক জনের একেক ধরনের দর্শন দেখা যায়। তাই বলে সব মানতে হবে, বা একজন আরেক জনের সাথে চিন্তার বৈপরীত্য থাকার কারণে তাঁকে ভ্রষ্ট বলার রেওয়াজ কখনো ছিলনা, এখনো নেই। চার মাজহাবে উসূল তথা মৌলনীতিগতভাবে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত, আর ফুরূয়ি তথা কিছু ছোটখাটো বা আনুষঙ্গিক মাসআলায় বৈপরীত্যও দেখা যায়। তাই বলে অনুসারীদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্বও নেই।

সম্প্রতি একজন হুজূর নিজের পছন্দের মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার প্রতি কয়েকটি আপত্তি দেখা দিয়েছে। যেমন -

👉 আলা হযরতের মসলক অনুসরণ না করলে যদি সুন্নি না হয়, তাহলে আলা হযরত সাহেবের পূর্বেকার আলেম-উলামা, যথা - শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দেস দেহলভী, শাহ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী, আবদুল গনী নাবলুসী, ইসমাইল নাবহানী, খাজা গরীব নওয়াজ, মাহবূবে ইলাহী, ডঃ ইকবাল, ইমাম গাজ্জালী, মওলানা রুমী, শেখ সাদী, আমির খসরু, গাউসে পাক বড় পীর সাহেব (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-সহ সু্ন্নী সূফী-দরবেশবৃন্দ কি সবাই আপনার আলা হযরতের অনুসরণকারী? কারো সাথে সব মিল তো নাই, বরং এঁদের সাথে আলা হযরতের অনেক বিষয়ে দ্বিমত আছে। এমতাবস্থায় এ সকল হযরতে কেরাম (রহ:)’কে সুন্নী বলতে অস্বীকার করার অধিকার কে দিল?

👉 হযরত আবূল হাসান আশয়ারী ও হযরত আবুল মনসুর মাতরুদী (রহমতুল্লাহে আলায়হিমা) সময়কালীন সকল বদ মাজহাব ও আকায়েদকে খণ্ডন-পূর্বক আকায়েদে আহলে সুন্নাহকে মুসলিম মিল্লাতে উপস্থাপন করেন; তাই সর্বসন্মতিক্রমে এ দুজন-ই ইমামুল আক্বায়েদ ফী আহলে সুন্নাতে ওয়াল জামাত। এ ইমাম দুজনের আকায়েদে বিশ্বাসীদের সুন্নী বলা হয়, আলা হযরতের মসলক না মানলে সুন্নী নয় বলাটা সহস্রাধিক বছরের সর্বজনস্বীকৃত আকায়েদে আহলে সুন্নাহকে অস্বীকার করার নামান্তর নয় কি?

👉বাগদাদ শরীফ, আজমীর শরীফ, ছরোয়ার শরীফ, মিশরে শাজলী, বদবী-সহ বিভিন্ন ত্বরীকার দরবারসমূহে আপনাদের আলা হযরতের মসলককে মান্য করা তো দুরের কথা, এসকল সূফী দরবারসমুহের ত্বরীকতের কার্যক্রমের সাথে রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব! তাই বলে এঁরা সুন্নী নয় কি? সুন্নী কি শুধু আপনারাই?

👉 আপনারা কি দ্বীনের ঠিকাদারী নিয়েছেন যে যাকে ইচ্ছা সুন্নী বানাবেন? আবার যে ব্যক্তি আপনাদের তালে নৃত্যরত হবেন না, তাঁকে সুন্নীয়ত থেকে বের করে দেবেন, এ দায়িত্ব আপনাদের কে দিলো?

👉বাংলাদেশে কাদ্বেরী, চিশতী, নকশবন্দী, কলন্দরী, আশরাফী, মুজাদ্দিদী, সোহরাওয়ার্দী, রেফায়ী, মাইজভাণ্ডারীসহ এমন অসংখ্য তরীকার দরবার রয়েছে, যে সব হক তরীকাহ ও দরবারের সাথে আপনাদের নতুন পঞ্চম মাজহাব তথা মসলকের সাথে ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। এই সকল দরবার হতে আপনার কাছে এ বিষয়ে কেউ ফতোয়া তলব করেছেন কি?

👉আপনাদের সাথে বসা নকশবন্দী, মির্জাখীল, জোহ্হাদীয়া, কানু শাহ দরবারী অনেক আওলাদ-বৃন্দ উপস্থিত ছিলেন, এঁদের কাছে জিজ্ঞেস করুন এঁরা মসলকে আলা হযরতের ওপর (ভিত্তি করে) দরবার পরিচালনা করেন কি-না?

👉আলা হযরত নামক নতুন আমদানীটা এদেশে আসছে মাত্র ২০ বছর আগে, এর আগে কি এদেশে কোন সুন্নী ছিলেন না?

👉পূর্ববর্তীগণ যদি সুন্নী না হন, তাহলে আপনাদের মতো নতুন সুন্নীর প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু?

👉আপনারা আলা হযরতের মসলক কতটুকু মান্য করেন? চলুন, একটু দেখা যাক -

★ আলা হযরত মসলক মতে, মহিলাদের দ্বারা মাজার জিয়ারত নিষেধ।

👉আপনাদের পীর সাহেব হুজুর তশরীফ আনলে হাজার হাজার মহিলা খানকায় হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। বিশেষ ব্যবস্থায় মহিলা বায়াত করানো হয়।

👉আলা হযরত মসলকে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে বালেগা (প্রাপ্ত বয়স্কা) মহিলা লেখাপড়া হারাম।

★ আপনাদের মেয়েরা কেউ ভার্সিটিতে, কেউ মেডিকেলে লেখাপড়া করে। যিনি ফিৎনাযুক্ত বক্তব্য দিয়েছেন তাঁর দুই মেয়ে ডাক্তারী লেখাপড়া করেছে।

👉 এসব মসলকে আলা হযরত বিরোধী নয় কি?

★আলা হযরত মসলক মতে, কোরআন খতম, বুখারী শরীফ খতম, কন্ট্রাক্ট করে ওয়াজে টাকা নেয়া হারাম।

👉 আপনারা কি ওয়াজ খতমের টাকায় পকেট পুরো করেন না?

★আলা হযরত ফতোয়া মতে, বর্তমান ব্যাংকিং লেনদেন হারাম।

👉আপনাদের কার ব্যাংক একাউন্ট নাই?

★আলা হযরত মসলক মতে, সামা’ তথা (আধ্যাত্মিক) গান-বাজনা হারাম।

👉 সূফী মিজান সাহেবের বাসায় টাকার বান্ডিলের জন্য নির্লজ্জের মতো সবাই লাইনবদ্ধ হয়ে ’ইয়া মিজান বাবা! ইয়া মিজান বাবা!’ বলে সামা’ শুনেন। ভিডিও ছবিগুলি অনলাইনে ভাইরাল।

👉তখন মসলকে আলা হযরত কোথায় থাকে?

আর বলতে চাইনা, বাকিটা ইতিহাস!

সময় থাকতে মুখে লাগাম লাগান! মসলকে আলা হযরত দাবিদার কিছু আলেম আছেন - আপনাদের কথাবার্তা, নীতি, আদর্শ আর চেহারা-শরীরের ভঙ্গিমা রাস্তার টোকাইদের মতো। তা সংশোধন করুন। নইলে পথে ঘাটে অপদস্থ আর অপমানিত হবেন।

আলা হযরত জিন্দাবাদ!

*সমাপ্ত*

Saturday 15 August 2020

এদেশে আউলিয়া (রহ:)’এর অবদান ও ‘মসলক’

লেখক: এডমিন


মুসলমান তরুণদের একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝতে হবে। আমাদের দেশটি আউলিয়া কেরাম (রহ:) আবাদ করেছেন। তাঁরা আমাদের বাপ-দাদাকে কলেমা পাঠ করিয়ে মুসলমান বানিয়েছেন। তাঁরা তাসাউফ-তরীক্বতপন্থী ছিলেন, যে পথ ও মত ক্বুরবাতে এলাহী তথা আল্লাহর নৈকট্য এনে দেয়। এটা আধ্যাত্মিক লাইন, যা নফস (আত্ম) দমন ও মা’রেফত অর্জন ছাড়া হয় না; যা ওয়ায করে অথবা বইপত্র লিখে শরীয়তের শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমেও অর্জন করা যায় না। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিভিন্ন তরীক্বতের মাশায়েখ (রহ:)’বৃন্দ শরীয়তের জ্ঞানে নিপুণ ও দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও সেটার শিক্ষা প্রচারে কতোখানি ওয়ায করেছেন এবং কতোগুলো বইপত্র লিখেছেন? হযরত খিযির (রা:) কতোগুলো বই লিখেছেন? তাঁকে কয় জনে চেনেন? অতএব, শরীয়তের বইপত্র লিখলেই আউলিয়া কেরাম (রহ:) হওয়া যায় না! আউলিয়া (রহ:)’এর কারামত দেখে মুসলমান হয়েছেন এদেশের মানুষ। মুসলমান হওয়ার পরেই শরীয়তের মৌলভীবর্গ ‘মসলক’-এর তা’লিম দিতে এসেছেন! অতএব, আমার সামনে বিষয়টি পরিষ্কার। আউলিয়া কেরাম (রহ:) যখন দ্বীন প্রচার করছিলেন, তখন কোনো শরীয়তের মৌলভী ‘মসলকের’ তা’লিম দিচ্ছিলেন না। কোনো ‘মসলকের’ অস্তিত্বই তখন ছিলো না। তাহলে কি ওই সকল আউলিয়া (রহ:) অ-সুন্নী? অধিকন্তু, শরীয়তের স্রেফ যাহেরী জ্ঞান ও ’মসলক’ নফস (কুপ্রবৃত্তি) দমনে সহায়ক নয়। নতুবা মৌলভী সাহেবদের মধ্যে এতো নফসানী খায়েশ ও ঝগড়া-বিবাদ কেন? বিশেষ করে ইদানীং যা ঘটছে তাতে আহলে সুন্নাতের আক্বীদাহ-বিশ্বাসই নিশ্চিহ্ন হবার দশা! এ এক মহা সঙ্কটকাল বটে!


ইমাম আহমদ রেযা (রহ:) স্রেফ একজন ইসলামী শরীয়তের গবেষক, আমাদের দেশের সর্ব-হযরত শাহ্ জালাল (রহ:), শাহ আলী (রহ:), বদর শাহ (রহ:), মোহসিন আউলিয়া (রহ:), গরীবউল্লাহ শাহ (রহ:), খাঁন জাহান আলী (রহ:), মখদুম শাহ (রহ:), সুলতান মাহী সওয়ার (রহ:), ক্বমরউদ্দীন রূমী (রহ:), শাহ জামাল (রহ:), শরফুদ্দীন চিশ্তী (রহ:), আমানত শাহ (রহ:), শাহ পরাণ (রহ:), মুহাম্মদ শাহ গৌরী (রহ:) প্রমুখের মতো উচ্চ মক্বামের আউলিয়া নন। আল্লাহর দৃষ্টিতে দুটি ক্যাটেগরীর পার্থক্য মুসলমান সাধারণের বুঝতে হবে। সুন্নী উলামাদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেছেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত মানেই মসলকে ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রহ:)।’ কথাটা সঠিক নয়। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়া জামাআত একটা ব্যাপক টার্ম। এতে অনেক শরীয়তের ইমামের ‘মসলক’ অন্তর্ভুক্ত, যেখানে ইমাম আহমদ রেযা (রহ:)’এর মসলক একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। অর্থাৎ, যাঁরা তাঁর ফিক্বহী (ইসলামী বিধানশাস্ত্রীয়) সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেন, স্রেফ তাঁদের জন্যেই ওই মসলক। অতএব, ওই মসলক সামগ্রিক আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত (সমাজবদ্ধ সুন্নীপন্থী মনুষ্যকুল) নয়। অন্যান্য ইমামমণ্ডলীর অনুসারীবৃন্দ সেটার অনুসারী নন, হতে পারেন না! তাই এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি মুসলিম সমাজে ফিতনা-ফাসাদের জন্ম দিতে বাধ্য! আমরা সবাইকে বাড়াবাড়ি পরিহার করার উদাত্ত আহ্বান জানাই।