Wednesday 21 October 2015

সুন্নাহ-ভিত্তিক ইসলামে তাসাউফের স্থান


মূল: শায়খ নূহ হা মিম কেলার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
 
[Bengali translation of Shaykh Nuh Ha Mim Keller’s Online article “The Place of Tasawwuf in Traditional Islam”]
 
উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ সৈয়্যদ মওলানা শাহ সূফী এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে………। 
 
বর্তমান যুগে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সঠিকভাবে জ্ঞান অর্জন করার সম্ভবতঃ সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ হচ্ছে সুন্নীপন্থী তথা ঐতিহ্যবাহী ইসলামী উলামাবৃন্দের অভাব। এ বিষয়ে ইমাম বোখারী (রহ:) সহীহ সনদে বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর একখানা হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান:

“নিশ্চয় আল্লাহতা’লা ঐশী জ্ঞান তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে অপসারণ করেন না, বরঞ্চ তা অপসারণ করেন ইসলামী উলামাবৃন্দের রূহ (আত্মা)-গুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে (বেসালপ্রাপ্তিতে), যতোক্ষণ একজন আলেম-ও আর অবশিষ্ট না থাকেন; এমতাবস্থায় লোকেরা অজ্ঞ-মূর্খদেরকে তাদের (ধর্মীয়) ইমাম মেনে নেয়, যাদেরকে প্রশ্ন করা হলে না জেনেই ধর্মীয় বিষয়ে তারা ফতোওয়া দেয়; ফলে তারা নিজেরাও গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হয়, মানুষকেও পথভ্রষ্ট করে।”  [‘ফাতহুল বারী, ১:১৯৪; হাদীস নং ১০০]

ওপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত প্রক্রিয়াটি এখনো সম্পন্ন হয়নি, তবে নিশ্চিতভাবে তার সূচনা হয়েছে। আর আমাদের এ জমানায় সুন্নীপন্থী উলামাবৃন্দের ঘাটতি, চাই তা ইসলামী বিধি-বিধান (ফেকাহ) ও হাদীস (মহানবীর বাণী) শাস্ত্রেই হোক, অথবা তাফসীর (কুরঅান ব্যাখ্যাকারক) শাস্ত্রেই হোক, তা ধর্ম সম্পর্কে এমনই এক বোধ জাগিয়ে তুলেছে যা এতদসংক্রান্ত বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণতা হতে বহু বহু দূরে, এবং কখনো কখনো সত্য হতেও বহু দূরে। উদাহরণস্বরূপ, আমি ইসলামী বিধি-বিধান (ফেকাহ)-বিষয়ক জ্ঞানার্জনকালে প্রাচ্যবিশারদ ও মুসলিম-সংস্কারক লেখনীসমূহ হতে প্রাথমিক ধারণা যেটি পাই, তাতে মনে হয়েছিল মযহাবের ইমাম-মণ্ডলী বুঝি ইসলামী সুন্নাহ’র সম্পূর্ণ বাইরের এক ঝাঁক নিয়মকানুন নিয়ে এসে কোনো না কোনোভাবে মুসলমানদের ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন আমি মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নীপন্থী উলামাবৃন্দের সাথে বসে বিস্তারিত জানতে চাইলাম, তখনই আমি কুরআন ও সুন্নাহ হতে আইনকানুন বের করার ভিত্তি সম্পর্কে জানতে পেরে ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফিরলাম।

অনুরূপভাবে, ‘তাসাউফের’ ক্ষেত্রেও এই শাস্ত্রের উলামাবৃন্দের সাথে আমার বৈঠকে আমি পশ্চিমা বিশ্বে যা দেখতে পেয়েছিলাম, তার থেকে ভিন্ন একটি চিত্রের দেখা পেয়েছি। আজ রাতে আমার এ প্রভাষণে ইনশা’আল্লাহতা’লা আল-কুরঅান ও সহীহ হাদীস হতে এবং সিরিয়া ও জর্দানের প্রকৃত তাসাউফ-শিক্ষকদের কাছ থেকে এতদসংক্রান্ত জ্ঞান ব্যাখ্যা করা হবে; এটি এ বিবেচনায় যে আমাদেরকে গতানুগতিক ধারণার ঊর্ধ্বে ওঠা প্রয়োজন, আর ইসলামী উৎসগুলো হতে বাস্তব তথ্য জানা দরকার, যাতে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর জানা যায় যে তাসাউফ কোত্থেকে এসেছে? দ্বীন-ইসলামে এর ভূমিকা কী? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এ জ্ঞান সম্পর্কে আল্লাহতা’লারই বা হুকুম কী?

‘তাসাউফ’ শব্দটির উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য অনেক ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রের মতোই এর নামটি প্রথম মুসলিম প্রজন্মের কাছে ছিল অপরিচিত। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন তাঁর ‘মোকাদ্দেমা’ গ্রন্থে এ বিষয়ে উল্লেখ করেন:
এই জ্ঞান ইসলামী ঐশী বিধানেরই একটি শাখা যার উৎপত্তি উম্মতের মধ্য হতে হয়েছে। সূচনালগ্ন হতেই এ ধরনের পুণ্যাত্মাবৃন্দের পথকেও সত্য ও হেদায়াতের রাস্তা, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), তাঁদের দ্বারা প্রশিক্ষিত তাবেঈন ও তৎপরবর্তী সময়ে আগত তাবে’ তাবেঈনের তরীকাহ হিসেবে বিবেচনা করতেন প্রাথমিক যুগের মুসলমান সমাজ ও বিশিষ্টজনেরা।

এটি মূলতঃ এবাদত-বন্দেগীতে নিবেদিত হওয়া, মহান আল্লাহতা’লার প্রতি পূর্ণ উৎসর্গিত থাকা, দুনিয়ার তাবৎ চাকচিক্য হতে নির্মোহ হওয়া, অধিকাংশ মানুষের অন্বেষিত আনন্দ-বিনোদন, ধনসম্পদ ও সুখ্যাতি  পরিহার করা, অন্যদের থেকে দূরে সরে একাকী এবাদত-বন্দেগী পালন ইত্যাদি রীতিনীতির সমষ্টি। এই ছিল মহানবী (দ:)-এর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের আচরিত সাধারণ/সার্বিক রীতি। কিন্তু ইসলামী দ্বিতীয় শতক হতে তৎপরবর্তী যুগগুলোতে মানুষের মাঝে যখন দুনিয়াবী মোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন যাঁরা এবাদত-বন্দেগীতে উৎসর্গিত হন তাঁদেরকে ‘সুফিয়্যা’ বা ‘মোতাসাউয়ীফ’ (তাসাউফপন্থী আলেম) নামে ডাকা হতো। [ইবনে খালদুন কৃত ‘আল-মোকাদ্দেমা’; মক্কা দারুল বা’য কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত ১৩৯৭ হিজরী/১৯৭৮ খৃষ্টাব্দ; ৪৬৭ পৃষ্ঠা]

ইবনে খালদুনের ভাষ্যমতে, “মহান আল্লাহতা’লার প্রতি পূর্ণ উৎসর্গিত থাকা” মর্মে ‘তাসাউফের’ সারকথা ছিল “মহানবী (দ:)-এর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের আচরিত সাধারণ/সার্বিক রীতি।” অতএব, এ পদটি প্রাথমিক যুগে অস্তিত্বশীল না থাকলেও আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে ইসলামী অনেক বিদ্যাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিদ্যমান ছিল; যেমন ‘তাফসীর’ (কুরআন-ব্যাখ্যামূলক জ্ঞান), কিংবা ‘এলম আল-জারহ ওয়া তা’দিল’ (হাদীস বর্ণনাকারীদের গ্রহণযোগ্যতায় প্রভাব বিস্তারকারক ইতিবাচক ও নেতিবাচক উপাদানসমূহ), অথবা ‘এলম আত্ তাওহীদ’ (ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসসংক্রান্ত জ্ঞান)। এসব জ্ঞানের শাখার সবগুলোই যে ধর্মের সঠিক সংরক্ষণ ও প্রসারে সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করেছে, তা আজ সপ্রমাণিত।

‘তাসাউফ’ শব্দটির উৎস হয়তো ‘সূফী’ শব্দ হতে, যা ওই পুণ্যাত্মাবৃন্দকে বোঝায় যাঁরা তাসাউফ অর্জন করেছেন। সূফী শব্দটির উৎপত্তি তাসাউফেরও আগে। কেননা, ইমাম হাসান বসরী (রহ:) যিনি ১১০ হিজরী সালে বেসালপ্রাপ্ত হন, তাঁর বক্তব্যে উভয় পদের মধ্যে সূফী শব্দটির উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায়। বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন, “আমি এক সূফীকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখে তাঁকে এক দিরহাম দিতে চাই। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।” অতএব, তাসাউফকে বুঝতে হলে সূফী কী তা জানতে চেষ্টা করাই মনে হয় সমীচীন হবে। আর হয়তো সূফী ও তাঁর পথ (তাসাউফ-তরীকত), যা এই বিদ্যাশাস্ত্রের বুযূর্গবৃন্দ বেশির ভাগ সময়ই উল্লেখ করে থাকেন, তার সবচেয়ে যথাযথ সংজ্ঞাটি পাওয়া যায় মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ থেকে, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান:
আল্লাহ পাক বলেন, “যে ব্যক্তি আমার ওলী (বন্ধু)-এর প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করে, তার বিরুদ্ধে আমি (অাল্লাহ) যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা আমার সান্নিধ্য অন্বেষণ করে আমারই পছন্দকৃত ফরয এবাদতের মাধ্যমে; অতঃপর সে আমার সান্নিধ্য লাভ করে নফল (তরীকতের রেয়াযত তথা সাধনা) এবাদত-বন্দেগী দ্বারা, যতোক্ষণ না আমি তাকে ভালোবাসি। আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, আমি তার শ্রবণশক্তি হই যা দ্বারা সে শোনে; তার দৃষ্টিশক্তি হই যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত হই যা দ্বারা সে কাজ করে; তার পা হই যা দ্বারা সে চলাফেরা করে। সে আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করলে নিশ্চয় (তৎক্ষণাৎ) আমি তা মঞ্জুর করি; সে আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে রক্ষা করি।” [ফাতহুল বারী, ১১:৩৪০-৪১, হাদীস নং ৬৫০২]

ওপরের এ হাদীসে কুদসী বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম বোখারী (রহ:), আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:), আল-বায়হাকী (রহ:) ও অন্যান্য আলেম-উলেমা, যা একাধিক অনুরূপ এসনাদ দ্বারা সহীহ প্রমাণিত। এ রেওয়ায়াত বা বর্ণনাটি তাসাউফের মৌলিক বাস্তবতা প্রকাশ করে, যা নির্ভুলভাবে বোঝায় ‘পরিবর্তন’; যে পরিবর্তনের পথকে সুন্নাহ’র সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মাশায়েখবৃন্দ সূফী’র সংজ্ঞা হিসেবে বলেন, “ফাকিহুন ‘আমিলা বি ’ইলমিহী ফা আওরাসাহুল্লাহু ‘ইলমা মা লাম এয়া’লাম” – অর্থাৎ, “শরয়ী বিধানে জ্ঞানী পুণ্যাত্মা যিনি যা জানেন তা-ই অনুশীলন করেছেন; অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এরই ফলশ্রুতিস্বরূপ দান করেছেন এমন জ্ঞান যা তিনি জানতেন না।”

স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বল্লে সূফী হচ্ছেন দ্বীনী জ্ঞানে আলেম-(এ-হক্কানী/রব্বানী)-বৃন্দ। কেননা ওপরের হাদীসে কুদসীটি ঘোষণা করে, “আমার বান্দা আমার সান্নিধ্য অন্বেষণ করে আমারই পছন্দকৃত ফরয এবাদতের মাধ্যমে”; জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই কেবল সূফী আল্লাহর আদেশ বা যা ফরয করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে পারেন; তিনি যা জানেন তা-ই অনুশীলন বা প্রয়োগ করেন, কারণ হাদীসে কুদসীটি আরও বলে তিনি ফরয এবাদতের মাধ্যমে কেবল আল্লাহর সান্নিধ্য অন্বেষণ করেন না, বরং “সে আমার সান্নিধ্য লাভ করে নফল (তরীকতের রেয়াযত তথা সাধনা) এবাদত-বন্দেগী দ্বারা, যতোক্ষণ না আমি তাকে ভালোবাসি।” আর এরই প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহতা’লা তাঁকে এমন জ্ঞান মঞ্জুর করেন যা তিনি জানতেন না। কেননা হাদীসে কুদসীটি আরও বলে, “আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, আমি তার শ্রবণশক্তি হই যা দ্বারা সে শোনে; তার দৃষ্টিশক্তি হই যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত হই যা দ্বারা সে কাজ করে; তার পা হই যা দ্বারা সে চলাফেরা করে।” এটি আসলে ‘তাওহীদ’ বা আল্লাহর একত্ব-সম্পর্কিত পূর্ণ সচেতনতাজ্ঞাপক একখানা রূপক, যেটি শ্রবণ, দর্শন, হাত দ্বারা কর্ম সম্পাদন ও পদচারণার মতো মানুষের কাজের প্রেক্ষিতে আল্লাহ সম্পর্কে আল-কুরআনে বিবৃত ওই বাণী উপলব্ধির সমষ্টিও, যে বাণী ঘোষণা করে – “অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও” [সূরা সোয়াফ-ফাত, ৯৬ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান (রহ:) কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]

বস্তুতঃ সূফী তরীকার উৎস নিহিত রয়েছে মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ’তে। আল্লাহতা’লার প্রতি একনিষ্ঠ বা নিবেদিত হওয়ার নিয়ম চালু ছিল প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মধ্যে। তাঁদের কাছে এটি ছিল নামবিহীন এক (আধ্যাত্মিক) অবস্থা। অন্যদিকে, মুসলমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যখন এই (আধ্যাত্মিক) অবস্থা থেকে দূরে সরে যান, তখন-ই এটি একটি স্বতন্ত্র বিদ্যাশাস্ত্রে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় পরবর্তী মুসলিম প্রজন্মগুলোর দ্বারা এ বিদ্যার্জনের জন্যে প্রয়োজন পড়ে এক পদ্ধতিগত প্রয়াসের। অধিকন্তু, প্রাথমিক প্রজন্মগুলোর পরবর্তীকালে ইসলামী পরিবেশে পরিবর্তনের কারণেই তাসাউফ নামের এ বিদ্যাশাস্ত্র অস্তিত্বশীল হয়।

কিন্তু যদি এটি-ই প্রকৃত উৎস হয়, তাহলে আরও তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন দাঁড়ায়: ধর্মের কতোখানি মৌলিক বিষয় এ তাসাউফশাস্ত্র? আর সামগ্রিকভাবে এটি  দ্বীন-ইসলামে কোথায় খাপ খায়? সম্ভবতঃ এ প্রশ্নের সেরা উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় মুসলিম শরীফের একটি রেওয়ায়াতে, যা’তে হযরত উমর ফারূক (রা:) বর্ণনা করেন:

“একদিন আমরা নবী করীম (দ:)-এর খেদমতে হাজির ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন, যাঁর কাপড় ধবধবে সাদা ও চুল গাঢ় কালো ছিল। তাঁর মধ্যে সফরের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছিলো না এবং আমাদের কেউ তাঁকে চিনতেও পারছিলাম না। অবশেষে তিনি হুযূর পাক (দ:)-এর কাছে গিয়ে বসলেন এবং নিজের হাঁটুযুগল রাসূল (দ:)-এর বরকতময় হাঁটুযুগলের সাথে লাগিয়ে দিলেন, অার নিজ হাত নিজ উরুর ওপর রাখলেন। অতঃপর (তিনি) আরয করলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।’ জবাবে নবী করীম (দ:) এরশাদ করলেন, ‘ইসলাম এই যে তুমি এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ (উপাস্য) নেই এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহর (প্রেরিত) রাসূল বা পয়গম্বর। অতঃপর নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযানের রোযা রাখবে, পবিত্র কা’বার হজ্জ্ব করবে, যদি সেখানে পৌঁছুতে পারো।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ আমরা তাঁর ব্যাপারে আশ্চর্যান্বিত হলাম এ কারণে যে তিনি হুযূর পূর নূর (দ:)-এর কাছে (প্রশ্ন) জিজ্ঞাসাও করেছেন এবং (এখন উত্তরের) সত্যায়নও করছেন। তিনি আবার আরয করলেন, ‘আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।’ হুযূর পাক (দ:) এরশাদ করলেন, ‘আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা-মণ্ডলী, (অাসমানী) কেতাবসমূহ, তাঁর রাসূলবৃন্দ এবং শেষ (বিচার) দিবসে বিশ্বাস করো। আর ভাল-মন্দ তাকদীরে বিশ্বাস করো।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ (তিনি) পুনরায় আরয করলেন, ‘আমাকে এহসান সম্পর্কে বলুন।’ মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমালেন, ‘অাল্লাহর এবাদত (আরাধনা) এভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে খেয়াল করো যে তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘কেয়ামত সম্পর্কে সংবাদ দিন।’ রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ করলেন, ‘তুমি যাঁর কাছে জিজ্ঞেস করছো, তিনি কেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারীর চেয়ে অধিক অবগত নন।’ (প্রশ্নকর্তা আবার) আরয করলেন, ‘কেয়ামতের কিছু নিদর্শন সম্পর্কে বলুন।’ এবার হুযূর পাক (দ:) এরশাদ করলেন, ‘দাসী নিজ মালিককে প্রসব করবে, খালি পা, উলঙ্গ শরীরবিশিষ্ট দরিদ্র এবং মেষ-রাখালদেরকে বড় বড় দালানে গর্ব করতে দেখবে।’ (বর্ণনাকারী হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন) অতঃপর ওই প্রশ্নকারী ব্যক্তি চলে গেলেন। আমি সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাকে সম্বোধন করে এরশাদ ফরমালেন, ‘হে উমর! তুমি কি জানো এই প্রশ্নকারী কে?’ আমি আরয করলাম, ‘আল্লাহ ও (তাঁর) রাসূল (দ:)-ই ভাল জানেন।’ তিনি এরশাদ করলেন, ‘তিনি জিবরীল (আ:); তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন’।” [মূল: মুসলিম শরীফ; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘মিরআত শরহে মিশকাত’ ১ম খণ্ড, ১৯ পৃষ্ঠা, ’ঈমান পর্ব’ হতে সংগৃহীত; অনুবাদক: মওলানা এম, এ, মান্নান, চট্টগ্রাম]

এটি সহীহ হাদীস, ইমাম নববী (রহ:) যেটিকে ইসলামের ভিত্তিস্বরূপ হাদীসগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ‘আতাকুম ইউ’আল্লিমুকুম দীনাকুম’ (জিবরীল তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন) – এই শেষ বাক্যটি ব্যক্ত করে যে দ্বীন ইসলাম হাদীসটিতে বর্ণিত তিনটি মৌলিক বিষয়ের সমষ্টি: ১/ ইসলাম, অর্থাৎ, আমাদের প্রতি আল্লাহর আদিষ্ট এতায়াত বা আনুগত্য; ২/ ঈমান, অর্থাৎ, আম্বিয়া (আ:) কর্তৃক প্রদত্ত অদৃশ্য বিষয়গুলোর সংবাদে বিশ্বাস স্থাপন; এবং ৩/ এহসান, অর্থাৎ, আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী এমনভাবে করা যেন কেউ তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন।
আল-কুরআনের সূরা মরিয়মে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন:

“নিশ্চয় আমি অবতীর্ণ করেছি এই কুরআন এবং নিশ্চয় আমি নিজেই সেটির সংরক্ষক।” [আয়াত নং ০৯; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেবের কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]

অতঃপর আমরা যখন আল্লাহতা’লার হেকমত তথা ঐশী জ্ঞান ও কৌশল সম্পর্কে চিন্তা করি এ মর্মে যে তিনি কীভাবে এই কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন, তখন আমরা দেখতে পাই যে (পুণ্যবান) সুন্নী উলেমাবৃন্দ দ্বারা তিনি এটি করেছেন; যাঁদেরকে তিনি (হাদীসটিতে উল্লেখিত) ধর্মের প্রতিটি স্তরে কাজ করতে পাঠিয়েছেন। ইসলামের ক্ষেত্রে শরীয়তের ইমামবৃন্দ (আইম্মায়ে মযাহিব); ঈমানের ক্ষেত্রে আকায়েদের ইমামবৃন্দ; এবং এহসান মানে “অাল্লাহর এবাদত (আরাধনা) এভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো”, এ বিদ্যার ক্ষেত্রে তাসাউফের ইমামবৃন্দ এ মহান দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘আল্লাহর এবাদত করো’ – হাদীসের এ বাণীটি নিজেই (ইসলামের) এই তিনটি মূল বিষয়ের (মানে ইসলাম, ঈমান ও এহসানের) আন্তঃসম্পর্ক আমাদের প্রদর্শন করে থাকে। কেননা, কীভাবে ‘এবাদত-বন্দেগী’ করতে হবে সে সম্পর্কে জানা যায় শুধু দ্বীন-ইসলামের প্রকাশ্য বিধি-বিধান থেকে; পক্ষান্তরে, এই আরাধনার গ্রহণযোগ্যতার পূর্বশর্ত হচ্ছে আল্লাহতা’লা ও ইসলামের ঐশী বিধানের প্রতি ঈমান তথা বিশ্বাস পোষণ, যেটি ছাড়া এবাদত স্রেফ শারীরিক কসরতে পরিণত হবে এবং ফলদায়ক বা গ্রহণযোগ্য হবে না; অপরদিকে, ‘যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো’ – এ কথাটি স্পষ্ট প্রতীয়মান করে যে এহসান একটি মানবিক পরিবর্তনের সূচনাকারী, কারণ এতে নিহিত রয়েছে এমন-ই এক অভিজ্ঞতা যা আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ সঞ্চয় করেননি। তাই তাসাউফ-শাস্ত্রকে বুঝতে হলে ইসলাম ও ঈমানের প্রেক্ষাপটে এ পরিবর্তনের প্রকৃতিকে আমাদের অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করতে হবে; আর আজ রাতে এটি-ই হবে আমার আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

ইসলামের পর্যায়ে আমরা বলেছিলাম যে ‘খোদায়ী আজ্ঞার প্রতি সমর্পণের’ মাধ্যমে তাসাউফের প্রয়োজন পড়ে দ্বীন-ইসলামকে; কিন্তু ইসলামেরও নিজস্ব প্রয়োজনে একইভাবে তাসাউফকে প্রয়োজন পড়ে। কেন? এটি এই সঙ্গত কারণে যে, মুসলমানদেরকে যে সুন্নাহ অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে, তা কেবল মহানবী (দ:)-এর বাণী ও কর্ম-ই নয়, বরং তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর অন্তরের আহওয়াল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থা, যেমন তাকওয়া বা খোদাভীরুতা, এখলাস বা নিষ্ঠা, তাওয়াককুল বা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, রাহমা বা করুণা, তাওয়াদু বা বিনয় ইত্যাদি গুণাবলী।

অধিকন্তু, ইসলামী নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষের কর্ম শুধু সঠিক ও ভুল, এ দু’টি ভাগে কিন্তু বিভক্ত নয়। বরঞ্চ তা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত, যা সেগুলোর পারলৌকিক জগতের ফলাফল মোতাবেক ক্রমানুসারে বিন্যস্ত। ওয়াজীব বা বাধ্যতামূলক আমল পালন পরলোকে আল্লাহতা’লা কর্তৃক পুরস্কৃত হবে, আর তা পালন না করলে শাস্তি পেতে হবে। মানদূব হচ্ছে সেসব আমল যেগুলো অনুশীলন করলে সওয়াব পাওয়া যাবে, না করলে গুনাহ হবে  না। মোবাহ হচ্ছে অনুমতিপ্রাপ্ত, সওয়াব বা শাস্তির সাথে তা (মূলতঃ) সম্পৃক্ত নয়। মাকরূহ বা কটু হচ্ছে সেসব বিষয় যার বর্জনকে পুরস্কৃত করা হবে, কিন্তু চর্চাকে শাস্তি দেয়া হবে না। হারাম (অবৈধ) বিষয়গুলোর বর্জনকে পুরস্কৃত করা হবে এবং চর্চাকে শাস্তি দেয়া হবে, যদি কেউ তা হতে তওবা না করে মারা যান।

কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ সরলভাবে আমাদের কাছে ব্যক্ত করে যে মানুষের অন্তরের অবস্থা এসব শিরোনামের প্রতিটিরই অন্তর্গত। তবু ফেকাহ বা ঐশী বিধি-বিধানের বইপত্রে এগুলো আলোচিত হয়নি; কেননা নামায, রোযা, যাকা’তের ব্যতিক্রম হিসেবে এগুলো পরিমাপ করা যায় না এ মর্মে যে কতোটুকু পরিমাণ এর অনুশীলন করতে হবে। গণনাযোগ্য না হলেও এগুলো প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। চলুন, কিছু উদাহরণের দিকে তাকানো যাক –

/ – আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা: আল-কুরঅানের সূরা বাকারায় আল্লাহ পাক তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপনকারীদেরকে দোষারোপ করেন; কারণ এরা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের উপাস্য মূর্তিকে ভালোবাসে। অতঃপর তিনি এরশাদ ফরমান:

“এবং ঈমানদারদের অন্তরে আল্লাহর মতো কারো ভালোবাসা নেই।” [২:১৬৫; তাফসীরে নূরুল এরফান]
এ আয়াতে মহান প্রভু (মুসলমানদের) ঈমানদারির শর্তারোপ করেছেন যে তাঁর চেয়ে বেশি কাউকে ভালোবাসা যাবে না।

/ – করুণা: আল-বোখারী (রহ:) ও মুসলিম (রহ:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “যে কেউ মানুষের প্রতি করুণাশীল না হলে আল্লাহ পাক-ও তার প্রতি করুণাশীল হবেন না।” [সহীহ মুসলিম, ৪:১৮০৯; হাদীস নং ২৩১৯] ইমাম তিরমিযী (রহ:)-ও বর্ণনা করেন হাসান সহীহ শ্রেণিভুক্ত একখানি হাদীস – “অভিশপ্ত ছাড়া কারো অন্তর থেকেই করুণা অপসারণ করা হয় না।” [আল-জামেউস্ সহীহ, ৪:৩২৩; হাদীস নং ১৯২৩]

/ – পারস্পরিক ভালোবাসা: ইমাম মুসলিম (রহ:) নিজ সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “শপথ আল্লাহর নামে, যাঁর হাতে আমার রূহ (আত্মা)! তোমাদের মধ্যে কেউই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না যতোক্ষণ না তোমরা ঈমান আনো, আর কেউই তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতোক্ষণ না তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসো….” [সহীহ মুসলিম, ১:৭৪; হাদীস নং ৫৪]

/ – নামাযে একাগ্রতা: ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) নিজ সুনান পুস্তকে বর্ণনা করেন যে হযরত আম্মার ইবনে এয়াসের (রা:) হুযূর পূর নূর (দ:)-কে বলতে শুনেছেন – “নিশ্চয় কোনো মানুষ (দুনিয়া) ত্যাগ করলে তার সালাত/নামাযের এক-দশমাংশ লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে; বা এক-নবমাংশ, কিংবা এক-অষ্টমাংশ, অথবা এক-সপ্তমাংশ, বা এক-ষষ্ঠাংশ, কিংবা এক-পঞ্চমাংশ, বা এক-চতুর্থাংশ, অথবা এক-তৃতীয়াংশ, বা অর্ধেক (লিপিবদ্ধ হয়)।” [সুনানে আবি দাউদ, ১:২১১; হাদীস নং ৭৯৬] তার মানে কারো এবাদত-বন্দেগী ততোক্ষণ কবূল হয় না, যতোক্ষণ তিনি আন্তরিকভাবে খোদাতা’লার সামনে হাজির না হন।

/ – নবী-প্রেম: ইমাম বোখারী (রহ:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না যতোক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, পুত্র ও সকল মানবের চেয়ে বেশি ভালোবাসার পাত্র হই।” [ফাতহুল বারী, ১:৫৮; হাদীস নং ১৫]

ওপরে বর্ণিত এসব দালিলিক প্রমাণ থেকে এটি স্পষ্ট যে করুণা, ভালোবাসা বা অন্তরের একাগ্রতা, এই (আধ্যাত্মিক) অবস্থাগুলোর কোনোটি-ই গাণিতিকভাবে পরিমাপযোগ্য নয়। কেননা, শরীয়ত সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে বলতে পারে না ‘করুণার দুটি একক অনুশীলন করো’, অথবা ‘হুযূরী কলব্ তথা অন্তরের একাগ্রতার তিনটি একক ধারণ করো’, ঠিক যেমনটি সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে নামাযের রাক’আতগুলোর বেলায়। তবু এগুলোর প্রতিটি-ই মুসলমানদের জন্যে ব্যক্তিগতভাবে বাধ্যতামূলক। কতিপয় হারাম তথা ‘কঠোরভাবে নিষিদ্ধ’ উদাহরণের দিকে নজর দিয়ে পুরো চিত্রটি এক্ষণে সম্পূর্ণ করা যাক:

/ – আল্লাহ ভিন্ন কাউকে ভয় করা: আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামের সূরা বাকারায় এরশাদ করেন:
“এবং আমার অঙ্গীকার পূরণ করো, আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করবো আর বিশেষ করে আমারই ভয় (অন্তরে) রাখো” [২:৪০; নূরুল এরফান]। আয়াতের শেষ বাক্যটি সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী বলেন, “এতে মহান আল্লাহ পাক ছাড়া আর কাউকেই ভয় না পেতে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।” [তাফসীর আল-ফখরুদ্দীন আল-রাযী, ৩:৪২]

/ – নৈরাশ্য: মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

“নিশ্চয় (কেউই) আল্লাহর দয়া থেকে নিরাশ হয় না, শুধু কাফেররা ছাড়া” [সূরা ইউসূফ, ৮৭]। এতে কুফর তথা অবিশ্বাসের মতো সম্ভাব্য সর্বনিকৃষ্ট (আত্মিক) অবস্থার সাথে অন্তরের এই অবৈধ অবস্থা (নিরাশা)-কে যোগ করার ইঙ্গিত রয়েছে।

/ – দম্ভ: ইমাম মুসলিম (রহ:) তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর একটি হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “কেউই জান্নাতে প্রবেশাধিকার পাবে না যতোক্ষণ তার অন্তরে এক অণুকণা পরিমাণ অহঙ্কার বিরাজ করবে।” [সহীহ মুসলিম, ১:৯৩; হাদীস নং ৯১]

/ – ঈর্ষা: অর্থাৎ, কারো নেয়ামত বা আশীর্বাদপ্রাপ্তিতে হিংসাবশতঃ তার আশীর্বাদের অবসান কামনা করা। ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “হিংসার ব্যাপারে সতর্ক হও, কেননা তা নেক আমল বিনষ্ট করে, যেমনিভাবে আগুন কাঠকে পুড়িয়ে খাক করে।” [সুনান-এ-আবি দাউদ, ৪:২৭৬; হাদীস নং ৪৯০৩]

/ – এবাদত-বন্দেগীর প্রদর্শনী: ইমাম আল-হাকিম (রহ:) সহীহ এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর একখানা হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “নেক আমলে তথা পুণ্যদায়ক কর্মের অনুশীলনে সামান্যতম প্রদর্শনীর মানে হলো আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তার অর্চনা করা…..।” [আল-মোস্তাদরাক ‘আলাল-সহিহাইন, ১:৪]

এ ধরনের হারাম আত্মিক অবস্থার বিবরণ ফেকাহ বা ইসলামী বিধি-বিধানের বইপত্রে পাওয়া যায় না, কারণ ফেকাহ-শাস্ত্র শুধু গাণিতিকভাবে পরিমাপযোগ্য ঐশী বিধানেরই বিবরণ দেয়। বরঞ্চ এসব (অবৈধ আত্মিক) অবস্থার কারণ ও সমাধান পাওয়া যায় ‘অন্তঃস্থিত ফেকাহ’ তথা তাসাউফের ইমামবৃন্দেরই বইপত্রে; যেমন – হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর ‘এহইয়াও উলূম-উদ্দীন’(ধর্মীয় জ্ঞানের উজ্জীবন), ইমাম-এ-রব্বানী হযরত আহমদ ফারূকী সেরহিন্দী (রহ:)-এর ‘মকতুবাত’ (পত্রাবলী), সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ:)-এর ‘আওয়ারিফুল মা’আরিফ’ (খোদা-জ্ঞানীদের জ্ঞান) ও অনুরূপ কালজয়ী ইসলামী লেখনীসমূহে, যেগুলো অভ্যন্তরীন জীবনের হাজারো নীতিগত প্রশ্ন সম্পর্কে আলোকপাত করে এবং তার সমাধানও দেয়। এসব বইপত্র শরীয়তেরই কেতাবাদি এবং এগুলোতে নিহিত প্রশ্নাবলী ঐশী বিধানসম্পর্কিত বিষয়-ই, যা নির্দেশ করে কোনো মুসলমানের জন্যে কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ আত্মিক অবস্থা অার এ ক্ষেত্রে তাঁর আহওয়াল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থা-ই বা কী হবে। অতএব, এসব বই আধ্যাত্মিক অবস্থা-সংক্রান্ত রাসূল (দ:)-এর সুন্নাহ’র অংশকেই সংরক্ষণ করেছে বটে।

এসব তথ্য কাদের জানা প্রয়োজন? বস্তুতঃ সকল মুসলমানেরই জানা প্রয়োজন, কেননা কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত ও সহীহ হাদীস শরীফ এ বাস্তবতাকেই কেবল নির্দেশ করে না যে মুসলমানদেরকে কিছু নির্দিষ্ট আমল পালন তথা ধর্মীয় অনুশীলনী চর্চা করতে হবে এবং কিছু নির্দিষ্ট কথা বা বাক্য আওড়াতে হবে, বরং এ-ও নির্দেশ করে যে তাঁদেরকে নির্দিষ্ট উন্নত  আধ্যাত্মিক অবস্থা অর্জন করতে হবে এবং (মন্দ) আত্মিক অবস্থাগুলো দূর করতে হবে। আমরা কি আল্লাহ ভিন্ন আর কাউকে ভয় পাই? আমাদের অন্তরে কি অহঙ্কারের এক অণুকণা-ও বিরাজমান? মহানবী (দ:)-এর প্রতি আমাদের মহব্বত (ভালোবাসা) কি অন্য যে কোনো মানুষের চেয়েও বেশি? আমাদের নেক আমল পালনে কি সামান্যতম প্রদর্শনীও বিদ্যমান?

কোনো মুসলমান ব্যক্তি আধ-মিনিটখানেক আত্মবিশ্লেষণাত্মক চিন্তা করলেই নিজ ধর্মের (ওপরোক্ত) এসব বিষয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে সক্ষম হবেন; আর তিনি এ-ও বুঝতে পারবেন কেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদেরকে এসব আধ্যাত্মিক মকাম (পর্যায়) অর্জনে সহায়তা করার কাজ আনাড়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি, বরং অন্তর-বিশেষজ্ঞ তথা তাসাউফের উলামাবৃন্দের হাতে তার দায়িত্বভার ন্যস্ত হয়েছিল। বেশির ভাগ মানুষেরই বদ-অভ্যাসগত কারণে, নিজেদের প্রবঞ্চিত করার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচের দরুন এ পরিবর্তন সাধন সহজ হয় না; তবে সর্বোপরি, আমাদের প্রত্যেকেরই মাঝে বিরাজ করছে এক একগুঁয়ে সত্তা, এক কুপ্রবৃত্তি, যাকে আরবীতে বলা হয় ‘আন্ নাফস্’ এবং যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আল্লাহ পাক সাক্ষ্য দেন সূরা ইউসূফে –

“ইন্নান্-নাফসা লাআম্মা-রাতুম্ বিস্ সূ-ই”; অর্থাৎ, নিশ্চয় (কু)-প্রবৃত্তি তো মন্দকর্মের বড় নির্দেশদাতা। [১২:৫৩; তাফসীরে নুরুল এরফান]

আপনাদের যদি ওপরোক্ত আয়াতে বিশ্বাস না হয়, তাহলে সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীস শরীফটি বিবেচনা করতে পারেন, যা’তে বিবৃত হয়:

পুনরুত্থান দিবসে প্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে, সে গযওয়ায় (ধর্মযুদ্ধে) নিহত একজন।

ওই লোককে আল্লাহর সামনে আনা হলে তাকে তিনি তাঁর প্রদত্ত নানা আশীর্বাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন এবং সে তা স্বীকারও করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা জিজ্ঞেস করবেন, “সেগুলোর ব্যাপারে তুমি কী করেছো?” ওই লোক তখন জবাবে বলবে, “আমি আপনারই খাতিরে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছি।”

আল্লাহতা’লা প্রত্যুত্তর দেবেন, “তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি যুদ্ধ করেছো যাতে বীর বলে তোমার (উচ্চসিত) প্রশংসা করা হয়, আর তা ইতোমধ্যেই করা হয়েছে।” এরপর তাকে দণ্ড দেয়া হবে এবং মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

অতঃপর আরেক লোককে হাজির করা হবে; সে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করেছিল, তা অন্যান্যদের শিক্ষাও দিয়েছিল এবং কুরআন তেলাওয়াত-ও করেছিল। আল্লাহ পাক তাকেও তাঁর উপহৃত ঐশী করুণাধারার কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন, আর সে তা স্বীকারও করবে। এরপর মহান প্রভু বলবেন, “সেগুলোর ব্যাপারে তুমি কী করেছো?” লোকটি জবাব দেবে, “আমি আপনারই খাতিরে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করেছি, তা শিক্ষা দিয়েছি এবং কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করেছি।”
আল্লাহতা’লা বলবেন, “তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি জ্ঞানার্জন করেছো যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়; কুরআন তেলাওয়াত করেছো যাতে তোমাকে ক্কারী বলা হয়; আর তা ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে।” এরপর ওই লোককে দণ্ড দেয়া হবে এবং মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এরপর আরেক লোককে সামনে হাজির করা হবে যাকে আল্লাহ পাক নানা ধরনের ধন-সম্পদ দ্বারা আশীর্বাদধন্য করেছিলেন। আল্লাহতা’লা তা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলে সে-ও তা স্বীকার করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ বলবেন, “সেগুলোর ব্যাপারে তুমি কী করেছো?” লোকটি উত্তর দেবে, “আপনি পছন্দ করেন এমন কোনো একটি ব্যয়-ও আমি বাদ রাখিনি, আর তা আপনারই খাতিরে খরচ করেছি।”

এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা বলবেন, “তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি তা করেছো যাতে তোমাকে দাতা বলা হয়, আর তা ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে।” এরপর ওই লোককে দণ্ড দেয়া হবে এবং মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সহীহ মুসলিম শরীফ, ৩:১৫১৪; হাদীস নং ১৯০৫]

এ বিষয়ে আত্মপ্রবঞ্চনার আশ্রয় নেয়া আমাদের উচিত হবে না, কেননা আমাদের তাকদীর বা ভাগ্য এর ওপরই নির্ভর করছে। শৈশবকালে আমাদের পিতামাতা প্রশংসা বা দোষারোপের সময়ে আমরা কীভাবে আচরণ করবো, তা আমাদের শিখিয়েছিলেন; আর এটি আমাদের অধিকাংশেরই কর্ম সংঘটনের পুরো প্রেষণাকে (কোনো একটি খাতে) প্রবাহিত ও রংয়ে রঙ্গীন করেছে। কিন্তু শৈশবশেষে যখন আমরা ইসলামী বিধান জারির বয়সে পৌঁছি, তখন ওপরোক্ত হাদীস শরীফ ও “নেক আমলে তথা পুণ্যদায়ক কর্মের অনুশীলনে সামান্যতম প্রদর্শনীর মানে হলো আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তার অর্চনা করা” – মহানবী (দ:)-এর উচ্চারিত এ বাণীর দ্বারা ইসলাম ধর্ম আমাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে অন্যান্যরা যেটিকে ভাল মনে করে তা আমাদের জন্যে যথেষ্ট নয়; আর এ-ও ব্যক্ত করে যে আমাদের প্রেরণার সামগ্রিক পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন; আর এ প্রেরণা অন্য কোনো কিছুর দ্বারা নয়, বরং একমাত্র আল্লাহরই রেযামন্দি হাসিলের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা হওয়া চাই। অতএব, ইসলামী বিধি-বিধান মুসলমানদের জ্ঞাত করে যে তাঁদের চিন্তাভাবনা ও প্রেরণার (চিরাচরিত) অভ্যেসকে পরিত্যাগ করা তাঁদের জন্যে বাধ্যতামূলক, কিন্তু তা কীভাবে করতে হবে সে কথা তাঁদেরকে তা জানায় না। এ বিষয়টি জানতে হলে মুসলমানদেরকে ওইসব আধ্যাত্মিক অবস্থার বিশেষজ্ঞ-উলামা তথা সূফী-দরবেশদের কাছে যেতে হবে, যেমনটি (ঐশী আজ্ঞার মাধ্যমে) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নবর্ণিত আয়াতে করীমায়:

“ফাস্আলূ আহলায্ যিকরি ইন্ কুনতুম লা তা’লামূন” – অর্থাৎ, “ওহে মানুষেরা, জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে।” [সূরা অান্ নাহল্, ৪৩ নং আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান]

নিঃসন্দেহে এই পরিবর্তন সাধন, অাত্মিক সততা ও নিষ্ঠা অর্জনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে পরিশুদ্ধকরণ হলো মহানবী (দ:)-এর অন্যতম প্রধান কর্তব্য; কেননা আল্লাহ পাক তাঁর কেতাবের সূরা আলে এমরানে ঘোষণা করেন:
“নিশ্চয় আল্লাহর মহা অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি (এ মর্মে) যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র/পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞান) শিক্ষা দান করেন।” [আল-কুরঅান, ৩:১৬৪, নূরুল এরফান]

ওপরের আয়াতে করীমায় নব্যুয়তের চারটি দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘ইউযাক্-কিহিম’, যার মানে ‘তাঁদেরকে পবিত্র বা পরিশুদ্ধ করেন’। এর আর অন্য কোনো অর্থ তাফসীরে নেই। অতএব, এ কথাও স্পষ্ট যে চিরস্থায়ী ঐশী বিধানের অংশ হিসেবে এই শিক্ষাদানের কাজটি মুসলমানদের প্রথম প্রজন্ম বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়নি, যে বাস্তবতাটি আল্লাহ পাক তাঁর মহাগ্রন্থের সূরা লোকমানে প্রদত্ত ঐশী আজ্ঞায় নিশ্চিত করেছেন:

“ওয়াত্তাবি’ সাবীলা মান্ আনা-বা ইলাইয়্যা” – অর্থাৎ, “আর তারই পথে চলো, যে আমার প্রতি প্রত্যাবর্তন করেছে।” [অাল-কুরআন, ৩১:১৫; নূরুল এরফান]

মুসলমানদের মাঝে যাঁরা ইসলামী বিধিবিধান প্রচার-প্রসার করার কাজে রত, এসব আয়াতে করীমা তাঁদের শিক্ষাদান ও (মুসলমানদের) রূপান্তরে ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করে; আর ওপরোল্লিখিত দ্বিতীয় আয়াতটিতে উদ্ধৃত ‘এত্তেবা’ শব্দটি, যেটি অধিকতর সার্বিক, সেটি কোনো (আধ্যাত্মিকতার পাঠদাতা) শিক্ষকের সোহবত তথা সান্নিধ্যে থাকার পাশাপাশি তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ-অনুকরণকেও ইঙ্গিত করে। এ কারণেই তাসাউফ-চর্চার ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, অসংখ্য এতদসংক্রান্ত তরীকাহ বা অনুশীলন-পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও এ দু’টি বিষয় কখনোই পরিবর্তিত হয়নি: ১/ কোনো শায়খ বা মোর্শেদের সান্নিধ্য লাভ; এবং ২/ তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ, ঠিক যেমনটি সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) মহানবী (দ:)-এর সোহবত দ্বারা ও তাঁরই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে আরোহণ ও আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করেছিলেন।

এ কারণেই কোনো নির্দিষ্ট সূফী শায়খের অধীনে থেকে তরীকাগুলো তাসাউফ-শাস্ত্রের সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসার করে আসছে। প্রথমতঃ এটি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর আচরিত (অন্তরসমূহ) পবিত্রকরণের সুন্নাহ, যা আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ইসলামী জ্ঞান কখনোই শুধুমাত্র লেখনীর মাধ্যমে প্রচারিত হয়নি, বরং উলামাবৃন্দের কাছ থেকে তাঁদের শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। তৃতীয়তঃ এ জ্ঞানের ধরন হচ্ছে ‘আহওয়াল’ তথা অন্তরের অবস্থাসংক্রান্ত এবং তা শুধু জানার সাথে সম্পর্কিত নয়; তাই এ জ্ঞানশিক্ষার পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবিত পীর-মোর্শেদবৃন্দের এমন এক পরম্পরা (সিলসিলা) থেকে তা গ্রহণ করা, যাঁরা মহানবী (দ:) পর্যন্ত ফেরত গিয়েছেন। কেননা, ওপরোল্লিখিত আয়াতে কার্যকরভাবে শর্তারোপকৃত স্রেফ অন্তরের আহওয়ালের ব্যাপ্তি ও সংখ্যা এতোই যে, তা (আধ্যাত্মিকতার পাঠদাতা)-শিক্ষকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ-অনুকরণকেই কার্যকরভাবে এক্ষেত্রে একমাত্র প্রচারের মাধ্যম করে দিয়েছে।

এ যাবত আমরা ইসলাম-ধর্মের প্রেক্ষিতে তাসাউফ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, যা কারো জীবনে ঐশী বিধি-বিধানের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্যে, কুরআন-হাদীসে দাবিকৃত অন্তরের আহওয়াল (অবস্থা) অর্জনের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় ইসলামী শরীয়তের এক বিদ্যাশাস্ত্র। মালেকী মযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালেক (রহ:)-এর বাণীতে শরীয়ত ও তাসাউফের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ব্যক্ত হয়েছে; তিনি বলেন, “ফেকাহ তথা শরীয়তের আইন-কানুন  শিক্ষা না করে যে ব্যক্তি তাসাউফ চর্চা করে, সে অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়; আর যে ব্যক্তি তাসাউফ চর্চা না করে ফেকাহ শিক্ষা করে, সে নিজেকে পথভ্রষ্ট করে। যে ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, সে-ই সত্যে উপনীত হয়।” এ কারণেই মালয়েশিয়া হতে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলমান দেশগুলোর মাদ্রাসাসমূহে পঠিত ঐতিহ্যবাহী পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে তাসাউফ-বিদ্যা শিক্ষা দেয়া হতো; আর এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ শরীয়ত-বিশেষজ্ঞ আলেম-উলামার অনেকেই ছিলেন সূফী-দরবেশ; আর গত শতাব্দীর শুরুতে ইসলামী খেলাফতের সমাপ্তি ও তৎপরবর্তী সময়ে মুসলমান রাজ্যগুলোর ওপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত লক্ষ্ণৌ হতে ইস্তাম্বুল ও মিসরে অবস্থিত উচ্চতর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাসাউফের শিক্ষকবৃন্দ পাঠদান করতেন।

কিন্তু তাসাউফের দ্বিতীয় আরেকটি দিক সম্পর্কে আমরা এখনো আলোকপাত করিনি। তা হলো, (হাদীসে জিবরীলে বর্ণিত) ধর্মের দ্বিতীয় বিষয় ‘প্রকৃত ঈমানের’ সাথে তারই সম্পৃক্ততা; ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রগুলোর প্রেক্ষাপটে এই ঈমান হচ্ছে ‘আকীদা-বিশ্বাসের’ সমষ্টি।

সকল মুসলমান আল্লাহ পাকে বিশ্বাস করেন; অর্থাৎ, এ আকীদা-বিশ্বাস রাখেন যে তিনি মানব-মস্তিষ্কের ধারণাতীত বা কল্পনারও উর্ধ্বে; কেননা মানবের জ্ঞান-বুদ্ধি তার নিজের ইন্দ্রিয় ও তৎনিঃসৃত চিন্তাভাবনার প্রণালীসমূহে আবদ্ধ, যেমন না-কি সংখ্যা, দিকসমূহ, স্থানের ব্যাপ্তি, সময়কাল ইত্যাদি। আল্লাহতা’লা এগুলোর সবকিছুরই উর্ধ্বে, যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান:

“তাঁর (অাল্লাহতা’লার) মতো কিছুই নেই।” [আল-কুরঅান, ৪২:১১; তাফসীরে নূরুল এরফান]

এ আয়াত সম্পর্কে এক মুহূর্ত চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই, মুসলিম শরীফের ওই হাদীসে উল্লেখিত ‘এহসান’ অনুসারে “আল্লাহতা’লার এবাদত-বন্দেগী এমনভাবে করো যেন তাঁকে দেখছো” – এই আদেশের অর্থ আমরা বুঝতে পারি যে ‘দেখা’ মানে চোখ দ্বারা দেখা নয়; কেননা চোখ শুধু তার নিজের মতোই পদার্থ বা বস্তু প্রত্যক্ষ করতে পারে; আর এর অর্থ মস্তিষ্ক-ও নয়, যেটি নিজের কল্পনার উর্ধ্বে ওঠে খোদায়ী তত্ত্ব উপলব্ধি করতে একেবারেই অক্ষম। বরঞ্চ এর অর্থ নিশ্চয়তাসূচক বিশ্বাস, ঈমানের নূর (জ্যোতি), যার সঠিক স্থান চোখ অথবা মস্তিষ্ক নয়, বরং ‘রূহ’ তথা আত্মা – যেটি আল্লাহ পাক আমাদের প্রত্যেকের মাঝে সৃষ্টি করে ফুঁকে দিয়েছেন, যেটির জ্ঞান-প্রজ্ঞা (খোদার) সৃষ্ট বিশ্বজগতের সীমা-পরিসীমা দ্বারা বাধাগ্রস্ত বা অবরুদ্ধ নয়। আল্লাহতা’লা এই রূহকে (ঐশী) রহস্যাবৃত রেখে এর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন; তিনি এরশাদ ফরমান:

“(হে রাসূল) বলুন, ‘রূহ আমার রব্ব (প্রভু)-এর আদেশ থেকে এক বস্তু’।” [আল-কুরআন, ১৭:৮৫; নূরুল এরফান]
এই রূহের (আত্মার) খোরাক হচ্ছে ‘যিকর’ বা ‘আল্লাহতা’লার স্মরণ’। কেন? কারণ আনুগত্যপূর্ণ কাজ-কর্ম নিশ্চয়তাসূচক বিশ্বাসের আলো ও রূহের মধ্যে ঈমানদারি বৃদ্ধি করে; আর যিকর ওই ধরনের আমলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, যা ইমাম আল-হাকীম নিশাপুরী (রহ:) কর্তৃক বর্ণিত এক সহীহ হাদীস দ্বারা সাবেত (প্রমাণিত) হয়; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

“আমি কি তোমাদের বলবো না তোমাদের সেরা আমল (অনুশীলন)-টি সম্পর্কে, যেটি তোমাদের প্রভুর দৃষ্টিতে সবচেয়ে খাঁটি/নির্মল, তোমোদের মর্যাদাবৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের, স্বর্ণ ও রৌপ্যদানের চেয়েও শ্রেয়, আর তোমাদের শত্রুদের মোকাবেলা ও তাদের ঘাড়ে আঘাত এবং তাদের দ্বারা তোমাদের ঘাড়ে প্রত্যাঘাতের (মানে জ্বেহাদের) চেয়েও শ্রেষ্ঠ?” সাহাবা (রা:)-বৃন্দ জিজ্ঞেস করেন, “এটি কী, এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)?” তিনি জবাবে বলেন, “যিকরুল্লাহি ‘আযযা ওয়া জাল্লা” মানে “সর্বশক্তিমান ও মহা-রাজকীয় খোদাতা’লার স্মরণ।” [আল-মোস্তাদরাক ’আলাল্ সহিহাইন, ১:৪৯৬]

নেক আমল (পুণ্যময় কর্ম) এবং বিশেষ করে যিকিরের মাধ্যমে ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি করা (মানে ঈমানকে সুদৃঢ় করা) ইসলাম ধর্ম ও সুন্নাহ-ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতার জন্যে বড় ধরনের এক উপলক্ষ। জনৈক অ-মুসলিম একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “খোদা যদি অস্তিত্বশীল হয়েই থাকেন, তবে কেন এই তালবাহানা? তিনি কেন প্রকাশ্যে এসে তা ঘোষণা দেন না?”

এর উত্তর হলো, এ জীবনে তাকলিফ তথা ‘নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য’ শুধু বাহ্যিক আমলের সাথেই সম্পৃক্ত নয়, বরং তা আমাদের আকীদা-বিশ্বাস ও তার দৃঢ়তার সাথেও সম্পৃক্ত। এ দুনিয়ায় যদি আল্লাহতা’লা ও চির সত্য বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপন অনায়াসে হতো, তাহলে আল্লাহতা’লার দ্বারা আমাদেরকে এর জন্যে দায়ী করার কোনো মানেই হতো না; এটি হতো অটোমেটিক বা আপনাঅাপনি, যেমন না-কি আমাদের বিশ্বাস লন্ডন শহরটি ইংল্যান্ডে অবস্থিত। 
এমতাবস্থায় বিশ্বাস না করার মতো অসম্ভব কোনো বিষয়ের জন্যে কাউকে দায়ী করাটা একেবারেই অর্থহীন হতো।

কিন্তু আল্লাহতা’লা যে দায়িত্ব আমাদের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন, তা হলো গায়ব তথা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন, যা এ দুনিয়ায় আমাদের জন্যে কুফর ও ঈমানের মধ্যে পাথর্ক্য করতে এক পরীক্ষাস্বরূপ; আর অবিশ্বাসী হতে বিশ্বাসীদের পার্থক্য করতে এবং সমস্ত মুসলমান হতে কতিপয় ঈমানদারকে উচ্চ মর্যাদা দিতেও এটি একটি পরীক্ষা বটে।

এ কারণে যিকরের মাধ্যমে ঈমান সুদৃঢ়করণ তাসাউফ-শাস্ত্রের জন্যে এতোটাই পদ্ধতিগত গুরুত্ব বহন করে; মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশ্বাস করতে আদেশ-ই শুধু দেয়া হয়নি, বরং তাতে পূর্ণ নিশ্চিয়তাসূচক আস্থা রাখতে আদেশও করা হয়েছে। আমাদের দেখা আশপাশের জগতটি আলো ও আঁধারের পর্দাসমূহের সমষ্টি; বিভিন্ন ঘটনার উদ্ভব হয়ে আমাদের কারো কারো ঈমান হারিয়ে যায়। আর আল্লাহতা’লা ধর্মের চিরসত্য বিষয়গুলোতে আমরা কতোটুকু নিশ্চিত বা সুদৃঢ় ঈমান রাখি, তার মাত্রা জনে জনে পরিমাপ করে থাকেন। তাই এই অর্থেই হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) বলেছিলেন, “যদি হযরত আবূ বকর (রা:)-এর ঈমান গোটা উম্মতের ঈমানের মোকাবেলায় (পাল্লায়) পরিমাপ করা হতো, তবুও তাঁর ঈমান ভারী হতো।”

সুন্নী আকীদা-বিশ্বাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো ‘ওয়াহদানীয়্যাত’ বা সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার ‘একত্ব ও অনন্য বৈশিষ্ট্য’। এর মানে তাঁর পবিত্র সত্তা অথবা গুণাবলী কিংবা কর্মে কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের বিশৃঙ্খল ও উদ্দাম লড়াইয়ে এই অন্তর্দৃষ্টি ধরে রাখার সামর্থ্য হচ্ছে অন্তরের এয়াকীন (নিশ্চিত বিশ্বাস)-ভিত্তিক শক্তি বা বলেরই একটি কাজ। আল্লাহ পাক তাঁর নবী (দ:)-কে আল-কুরআনে বলেন:

“হে রাসূল (দ:)! আপনি বলুন, ‘আমি আমার নিজের ভাল-মন্দের মধ্যে খোদ-মোখতার (স্বাধীন) নই, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন (সে ঐশী ক্ষমতাবলে ক্ষমতাবান)।’ [সূরা আ’রাফ, ১৮৮ আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান গ্রন্থে লিপিবদ্ধ শানে নুযূল দেখুন, যা’তে রাসূলুল্লাহ (দ:) আধ্যাত্মিক জ্ঞান দ্বারা হারিয়ে যাওয়া নিজ উটনীর খবর বলে দেন।]

তবু আমরা নিজেদের ওপর এবং আমাদের পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করি, আর আকীদা-বিশ্বাসের বাস্তবতা সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে এ কথা ভুলে যাই যে আমাদের পরিকল্পনাগুলোর কোনো কার্যকারিতা-ই নেই এবং আল্লাহতা’লা একাই সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছেন।

আপনি এ ব্যাপারে পরীক্ষা নিতে চাইলে এমন কারো কাছ থেকে সাহায্য নিতে চেষ্টা করুন যার (সমাজে বা রাষ্ট্রে) বড় বড় যোগাযোগের মানুষ আছে, যাদের সাহায্য আপনার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; ওই ধরনের ক্ষমতাবানদের কাছে ভালভাবে তদবির করার জন্যে তাকে বলার মুহূর্তে নিজ বিবেকের দিকে খেয়াল করুন এবং দেখুন আপনি কার ওপর নির্ভর করছেন। আমাদের অধিকাংশের মতোই যদি অাপনি হয়ে থাকেন, মানে আল্লাহ আপনার চিন্তার অগ্রভাগে না থাকেন, যদিও বাস্তবতা হলো তিনি-ই সমস্ত বিষয়ের নিয়ন্তা, তাহলে এটি কি আপনার আকীদা-বিশ্বাসের ঘাটতি নয়? অন্ততঃ আপনার নিশ্চিত বিশ্বাসের মধ্যে এটি কমতি নয় কি?

তাসাউফ প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে আল্লাহর প্রতি এয়াকীন তথা নিশ্চিত বিশ্বাস ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করে এ ধরনের ঘাটতি মেটায় বা সংশোধন করে। আকীদা-বিশ্বাসের দাবিকৃত এয়াকীন অর্জনে তাসাউফের প্রধান দুটো মাধ্যম হলো মোযাকারা তথা ইসলামী বিশ্বাসের সুন্নাহ-ভিত্তিক মূলনীতিমালা শিক্ষা করা এবং যিকির তথা আল্লাহতা’লার স্মরণ দ্বারা নিশ্চিত বিশ্বাসের সুদৃঢ়ীকরণ। এটি আমাদের ঈমানেরই অংশ, যেমনটি আল-কুরআনে এরশাদ হয়েছে:

“অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও।” [সূরা সোয়ফ্-ফা-ত, ৯৬ নং অায়াত; নূরুল এরফান]

তবু আমাদের কয়জনের জন্যে এ ব্যাপারটি প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাস্বরূপ বিদ্যমান? যেহেতু তাসাউফ তা’লিম (পাঠদান) ও যিকিরের এক নিয়মবদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান দেয় এবং ঈমানী দুর্বলতা দূর করে, সেহেতু ঐতিহ্যগতভাবেই ধর্মের এই স্তম্ভটির (মানে ঈমানের) জন্যে এ বিদ্যাশাস্ত্রকে ব্যক্তি পর্যায়ে বাধ্যতামূলক বলে বিবেচনা করা হয়েছে; আর এ শাস্ত্র ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই নিজের যোগ্যতা বা যথার্থতা প্রমাণ করে এসেছে।

আজ রাতে আমাদের আলোচনায় শেষ যে প্রশ্নটির প্রতি আমরা দৃষ্টি দেবো তা হলো: আমাদের জানা ইসলামী শিক্ষার খেলাফ বা পরিপন্থী কর্ম-সংঘটনকারী ’সূফী’দের ব্যাপারে কী ফায়সালা?

এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে সূফী বলতে দুটো অর্থ: প্রথমটি “নিজেকে সূফী মনে করে এমন যে কেউ।” এটি সূফীতত্ত্বের প্রাচ্য-বিশারদ ইতিহাসবিদ ও জনপ্রিয় লেখকদের অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের পর প্রতিষ্ঠিত এক পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া, যারা ’সূফী’ বলতে ‘উলামা’দের বিরোধী কাউকে বোঝান। আমি মনে করি, আজ রাতে প্রকৃত তাসাউফের পরিধি ও পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা যেসব কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ উল্লেখ করেছি, তা পরিস্ফুট করেছে কেন সূফীর নিম্নবর্ণিত সংজ্ঞা আমাদের কাছে প্রাধান্য পাবে: “শরয়ী বিধানে জ্ঞানী পুণ্যাত্মা যিনি যা জানেন তা-ই অনুশীলন করেছেন; অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এরই ফলশ্রুতিস্বরূপ দান করেছেন এমন জ্ঞান যা তিনি জানতেন না।”

ধর্মীয় জ্ঞানে শিক্ষিত একজন সূফী প্রথম যে জিনিসটি জানেন তা হলো, ইসলামী শরীয়ত ও আকীদা-বিশ্বাস সকল মানবের উর্ধ্বে। যে কেউ এ বিষয়টি না জানলে তিনি কখনোই সূফী হতে পারবেন না; তবে ব্যতিক্রম শুধু প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিতে এ শব্দটির অর্থ, যার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কেউ কোনো স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে দামী স্যূট-টাই পরে ব্রিফকেস্ হাতে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যেন সবাই মনে করেন তিনি একজন স্টক-ব্রোকার। কিন্তু প্রকৃত স্টক-ব্রোকার হওয়াটা একেবারেই আলাদা একটা ব্যাপার।

যেহেতু এই পার্থক্য আজকাল মুসলমান সমাজ এতদ্ভিন্ন সদ্ভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও অবহেলা করেন, সেহেতু এ কথাটি অহরহ ভুলে যাওয়া হয় যে আলেমদের মধ্যে যারা সূফীদের সমালোচনা করেছিলেন, যেমন ইবনুল জাওযী নিজ ‘তালবিসে ইবলিস’ (শয়তানের ধোকা) পুস্তকে, কিংবা ইবনে তাইমিয়্যা তার ফতোওয়ার বিভিন্ন স্থানে, অথবা ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা, তারা সবাই কিন্তু শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যাশাস্ত্রের শাখা হিসেবে তাসাউফের সমালোচনা করেননি। এর প্রমাণ হলো ইবনে জাওযীর প্রণীত পাঁচ খণ্ডের ‘সিফাতুস্ সাফওয়া’ শিরোনামের বইটি; এতে বিধৃত হয়েছে সেই একই সূফীদের জীবনী, যাঁদের সম্পর্কে ইমাম আল-কুশায়রী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত তাসাউফের কেতাব ‘রেসালা-এ-কুশায়রীয়্যা’-তে লিখেছিলেন। ইবনে তাইমিয়্যা নিজেকে কাদেরীয়্যা সিলসিলার সূফী মনে করতো, আর তার রচিত ৩৭ খণ্ডে সমাপ্ত ‘মজমু’আয়ে ফাতাওয়া’ গ্রন্থের ১০ম ও ১১তম খণ্ডগুলো তাসাউফের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। আর ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা ৩ খণ্ডের ‘মাদারিজ আস্ সালেকীন’ গ্রন্থটি লেখে আবদুল্লাহ আনসারী আল-হারাউয়ী’র সূফী তরীকার বিভিন্ন আধ্যাত্মিক মকাম-বিষয়ক ‘মানাযিল আল-সা’য়েরীন’ শীর্ষক বইয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হিসেবে। এসব লেখনী পরিস্ফুট করে যে এগুলোর লেখকদের কৃত সমালোচনা মূল তাসাউফশাস্ত্রের প্রতি ছিল না, বরং তাদের সময়কার নির্দিষ্ট কিছু দলের প্রতি-ই ছিল। আর ওই সমালোচনাকে ওর (খাস্) অর্থেই গ্রহণ করতে হবে।

অন্যান্য ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে, ঠিক তেমনি তাসাউফের ইতিহাসেও ভুলত্রুটি হয়েছে; এগুলোর বেশির ভাগই হয়েছে সবার ওপরে শরীয়ত ও অাকীদা-বিশ্বাসের প্রাধান্য উপলব্ধি করতে না পারায়। কিন্তু এসব ভুল-ভ্রান্তি নীতিগতভাবে ভিন্ন ছিল না সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে, যা ঘটেছিল, উদাহরণস্বরূপ, তাফসীর-শাস্ত্রে অনুপ্রবিষ্ট ইসরাঈলীয়্যা (বনূ ইসরাঈল-সম্পর্কিত বানোয়াট কাহিনি)-এর ক্ষেত্রে, কিংবা হাদীস-শাস্ত্রে অনুপ্রবিষ্ট মওদু’আত (জাল হাদীস)-এর বেলায়। কিন্তু তাফসীর-শাস্ত্র মন্দ বা হাদীস-শাস্ত্র বিচ্যুতিমূলক হওয়ার প্রমাণ হিসেবে এসব ভুলকে পেশ করা হয়নি, বরং প্রতিটি শাস্ত্রের বেলায়ই ওই শাস্ত্রবিদ ইমামবৃন্দ ভুল-ভ্রান্তি শনাক্ত করে ওগুলোর ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেন; কেননা উম্মাহকে এর থেকে রেহাই দেয়া জরুরি ছিল। আর এ ধরনের সংশোধনী-ই আমরা ইমাম কুশায়রী (রহ:)-এর ‘রেসালা’, ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর ‘এয়াহইয়া’ এবং সূফী মতাদর্শের অন্যান্য বইপত্রে দেখতে পাই।

ওপরে আমাদের উল্লেখিত সমস্ত কারণেই তাসাউফকে এ উম্মতের উলামাবৃন্দ ইসলাম ধর্মের অত্যাবশ্যক অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এর জাজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছেন তাসাউফেরই উচ্চতর জ্ঞানে জ্ঞানী ইসলামী শরীয়তের অন্যান্য বিদ্যাশাস্ত্রের আলেম-উলেমাবৃন্দ; এঁদের মধ্যে রয়েছেন সর্ব-ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (রহ:), আল-রাযী, আহমদ ফারূকী সেরহিন্দী (রহ:), যাকারিয়্যা আনসারী, ইযয ইবনে আব্দিস্ সালাম (রহ:), ইবনে দাকিক আল-ঈদ, ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহ:), শাহ ওলীউল্লাহ, আহমদ দারদির, ইবরাহীম আল-বাজুরী, আবদুল গনী নাবলুসী (রহ:), আন্ নববী (রহ:), তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:), আস্ সৈয়ুতী (রহ:) প্রমুখ।

সূফী-মণ্ডলী যাঁরা ইসলামের খেদমতে কলমের পাশাপাশি তরবারিও ব্যবহার করেছেন, তাঁদের সম্পর্কে ‘উমদাত আস্ সালেক’ (খোদার পথের পথিকবৃন্দের ভরসা/শায়খ নূহ হা মিম কেলার অনূদিত Reliance of the Traveler) শীর্ষক পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে:

এ ধরনের পুণ্যাত্মাবৃন্দ হলেন নকশবন্দী (সিলসিলার) শায়খ শামিল দাগেস্তানী (রহ:), যিনি ১৯ শতকে ককেশাস্ অঞ্চলে রুশদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেছিলেন; সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সোমালী, সালেহীয়্যা সিলসিলার শায়খ যিনি ১৮৯৯ হতে ১৯২০ সাল পর্যন্ত বৃটিশ ও ইতালীয়দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; কাদেরীয়্যা তরীকার শায়খ উসমান ইবনে ফদী, যিনি ১৮০৪ হতে ১৮০৮ সাল পর্যন্ত ইসলামী অাইন প্রতিষ্ঠার জন্যে উত্তর নাইজেরিয়ায় জ্বেহাদ পরিচালনা করেছিলেন; কাদেরীয়্যা সিলসিলার শায়খ আবদুল কাদের জাযা’ইরী, যিনি ১৮৩২ হতে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আলজেরীয়দের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; দারকাউয়ী (সিলসিলার) ফকীর আলহাজ্জ্ব মোহাম্মদ অাল-অাহরাশ, যিনি ১৭৯৯ সালে মিসরে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন; তিজানী (সিলসিলার) শায়খ আলহাজ্জ্ব উমর তাল, যিনি গিনী, সেনেগাল ও মালি অঞ্চলে ১৮৫২ হতে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত ইসলামী জ্বেহাদ পরিচালনা করেছিলেন; এবং কাদেরী (সিলসিলার) শায়খ মা’অাল-আয়নাঈন অাল-ক্কালক্কামী, যিনি ১৯০৫ হতে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত উত্তর মৌরিতানিয়া ও দক্ষিণ মরক্কোয় ফরাসীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

ধর্ম প্রচারের দ্বারা গোটা অঞ্চলসমূহকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন যে সকল পুণ্যাত্মা, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সানুসিয়্যা সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা শায়খ মোহাম্মদ আলী সানুসী, ১৮০৭ হতে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত যাঁর প্রচেষ্টা ও জ্বেহাদ দ্বারা লিবিয়ার মরু এলাকা ও আফ্রিকী সাব-সাহারা অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়; আরও রয়েছেন শাযিলী (সিলসিলার) শায়খ মোহাম্মদ ফারূক ও কাদেরী শায়খ উবায়স অাল-বারাউয়ী, যাঁদের প্রচেষ্টায় পূর্ব আফ্রিকী উপকূল এলাকা হতে পশ্চিম দিকে এবং সমুদ্র-দূরবর্তী অঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসার হয়। [Reliance of the Traveler, ৮৬৩ পৃষ্ঠা]

এ সকল পুণ্যাত্মার দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্ট হয় কোন্ ধরনের (মহান) মুসলমানবৃন্দ সূফী ছিলেন; অর্থাৎ, (তাঁরা) সব ধরনেরই (ছিলেন), আর তাঁরা সবার এবং সব কিছুর ওপরই প্রভাব ফেলেছিলেন – আর তাসাউফ তাঁদের সাধ্যানুযায়ী ইসলামের খেদমতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

অতএব, আজ রাতে আমার প্রভাষণের সার-সংক্ষেপ হলো: প্রথমে তাসাউফ ও শরীয়তের দিকে নজর দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি যে অনেক কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ মুসলমানদেরকে নিজেদের অন্তরের হারাম অবস্থা (আহওয়াল) যেমন – দম্ভ, হিংসা, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে ভয় করা ইত্যাদি দূর করতে আদেশ দেয়; পক্ষান্তরে, করুণা, মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক মহব্বত ও স্নেহ-মমতা, নামাযে অন্তরের একাগ্রতা এবং মহানবী (দ:)-এর প্রতি ভালোবাসার মতো অন্তরের আহওয়াল (অবস্থা) অর্জনের জন্যেও তা আদেশ করে। আমরা দেখতে পেয়েছি যে এসব অন্তরের অবস্থার বর্ণনা ফেকাহ’র বই-পুস্তকে খুঁজে পাওয়া যায় না, যেগুলোর উদ্দেশ্য-ই হলো (শুধু) শরীয়তের বাহ্যিক ও পরিমাপযোগ্য বিষয়সমূহ সুনির্দিষ্ট করা। অথচ এই আহওয়ালের জ্ঞান প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এ কারণেই এটি এহসান-বিশারদ তথা তাসাউফের শিক্ষকদের অধীনে শেখা হয়েছে ইসলামী ইতিহাসের সকল অধ্যায়েই – বর্তমান শতকের প্রারম্ভ অবধি।

অতঃপর আমরা ঈমানের পর্যায়ে নজর দিয়েছি এবং দেখেছি, যদিও এ জগতে আল্লাহতা’লা একাই সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেন বলে মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস রয়েছে, তবুও দৈনন্দিন জীবনে এ কথা মনে রাখাটা মানব সচেতনতার অর্পিত কোনো কিছু নয় (মানে মানুষ সজ্ঞানে এটি মনে রাখতে অক্ষম), বরং এটি মুসলমানের এয়াকীন তথা নিশ্চিত বিশ্বাসেরই একটি ক্রিয়া। আর আমরা দেখতে পেয়েছি আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যার শাখা হিসেবে তাসাউফ-শাস্ত্র মোযাকারা তথা ‘আকীদা-বিশ্বাস শিক্ষাদান’ ও যিকর তথা ‘আল্লাহ পাকের স্মরণ’ – এই উভয় পন্থায় ওই এয়াকীনের (নিশ্চিত বিশ্বাসের) সুশৃঙ্খল বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে থাকে; আর তা দিয়ে থাকে মহানবী (দ:)-এর উচ্চারিত এহসান-সম্পর্কিত বাণীর সাথে সঙ্গতি রেখেই, যেমনটি তিনি এরশাদ করেন, “আল্লাহতা’লার এবাদত এমনভাবে করো যেন তুমি তাঁকে দেখছো।”

সবশেষে, আমরা দেখতে পেয়েছি, ইবনে আল-জাওযী ও ইবনে তাইমিয়্যার মতো আলেম-উলেমা তাসাউফের প্রতি যে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন, তা নীতিগতভাবে তাসাউফের প্রতি ছিল না, বরং তা ছিল তাদের সময়কার কিছু নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তির প্রতি উদ্দেশ্যকৃত, যার প্রমাণ ওই একই লেখকদের অন্যান্য বইপত্রে বিধৃত, যেখানে তারা তাসাউফকে শরীয়তেরই একটি জ্ঞানের শাখা হিসেবে স্বীকার করেছেন।

আজ রাতে আমার প্রভাষণ যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তাতে ফিরে গিয়ে বলতে হয়, এই উম্মতের মধ্য হতে (প্রকৃত) ইসলামী উলামাদের হারিয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে তাসাউফের দু’টি একদম ভিন্ন চিত্রের উদয় হয়েছে। গত শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা সুন্নী ইসলামের অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলার পরবর্তীকালে লিখিত বইপত্র পড়লে আমরা দেখতে পাই মস্ত বড় এক ধোকা তাতে বিদ্যমান, অার তা হলো: আধ্যাত্মিকতাবিহীন ইসলাম ও তাসাউফ-হীন শরীয়ত। কিন্তু যদি আমরা ইসলামী বিদ্বানদের সনাতন বা ঐতিহ্যবাহী পুরোনো বইপত্র পড়ি, তাহলে তা থেকে আমরা জানতে পারি যে ইসলামের ইতিহাসজুড়ে তাফসীর, হাদীস বা অন্যান্য শাস্ত্রের মতোই শরীয়তের একটি বিদ্যাশাস্ত্র হিসেবে বিরাজমান ছিল তাসাউফ। আমাদের রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান:

“নিশ্চয় আল্লাহ পাক তোমাদের বাহ্যিক আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও কর্ম।” [সহীহ মুসলিম, ৪:১৩৮৯; হাদীস নং ২৫৬৪]

আর এটি-ই সবচেয়ে বড় আশার বাণী ইসলাম বর্তমান আধুনিক বিশ্বকে শোনাতে পারে, যে আধুনিক জগত বস্তুবাদ ও নাস্তিবাদের দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইসলাম প্রকৃতপ্রস্তাবেই ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ধর্ম হিসেবে বাহ্যতঃ একদিকে যেমন পারলৌকিক মুক্তির আশা, অপরদিকে তেমনি তা অাত্মিকভাবে সরাসরি খোদায়ী মহব্বত তথা ঐশীপ্রেম ও উদ্ভাসনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাও।

  *সমাপ্ত*