Wednesday 21 October 2015

সুন্নাহ-ভিত্তিক ইসলামে তাসাউফের স্থান


মূল: শায়খ নূহ হা মিম কেলার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
 
[Bengali translation of Shaykh Nuh Ha Mim Keller’s Online article “The Place of Tasawwuf in Traditional Islam”]
 
উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ সৈয়্যদ মওলানা শাহ সূফী এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে………। 
 
বর্তমান যুগে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সঠিকভাবে জ্ঞান অর্জন করার সম্ভবতঃ সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ হচ্ছে সুন্নীপন্থী তথা ঐতিহ্যবাহী ইসলামী উলামাবৃন্দের অভাব। এ বিষয়ে ইমাম বোখারী (রহ:) সহীহ সনদে বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর একখানা হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান:

“নিশ্চয় আল্লাহতা’লা ঐশী জ্ঞান তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে অপসারণ করেন না, বরঞ্চ তা অপসারণ করেন ইসলামী উলামাবৃন্দের রূহ (আত্মা)-গুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে (বেসালপ্রাপ্তিতে), যতোক্ষণ একজন আলেম-ও আর অবশিষ্ট না থাকেন; এমতাবস্থায় লোকেরা অজ্ঞ-মূর্খদেরকে তাদের (ধর্মীয়) ইমাম মেনে নেয়, যাদেরকে প্রশ্ন করা হলে না জেনেই ধর্মীয় বিষয়ে তারা ফতোওয়া দেয়; ফলে তারা নিজেরাও গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হয়, মানুষকেও পথভ্রষ্ট করে।”  [‘ফাতহুল বারী, ১:১৯৪; হাদীস নং ১০০]

ওপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত প্রক্রিয়াটি এখনো সম্পন্ন হয়নি, তবে নিশ্চিতভাবে তার সূচনা হয়েছে। আর আমাদের এ জমানায় সুন্নীপন্থী উলামাবৃন্দের ঘাটতি, চাই তা ইসলামী বিধি-বিধান (ফেকাহ) ও হাদীস (মহানবীর বাণী) শাস্ত্রেই হোক, অথবা তাফসীর (কুরঅান ব্যাখ্যাকারক) শাস্ত্রেই হোক, তা ধর্ম সম্পর্কে এমনই এক বোধ জাগিয়ে তুলেছে যা এতদসংক্রান্ত বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণতা হতে বহু বহু দূরে, এবং কখনো কখনো সত্য হতেও বহু দূরে। উদাহরণস্বরূপ, আমি ইসলামী বিধি-বিধান (ফেকাহ)-বিষয়ক জ্ঞানার্জনকালে প্রাচ্যবিশারদ ও মুসলিম-সংস্কারক লেখনীসমূহ হতে প্রাথমিক ধারণা যেটি পাই, তাতে মনে হয়েছিল মযহাবের ইমাম-মণ্ডলী বুঝি ইসলামী সুন্নাহ’র সম্পূর্ণ বাইরের এক ঝাঁক নিয়মকানুন নিয়ে এসে কোনো না কোনোভাবে মুসলমানদের ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন আমি মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নীপন্থী উলামাবৃন্দের সাথে বসে বিস্তারিত জানতে চাইলাম, তখনই আমি কুরআন ও সুন্নাহ হতে আইনকানুন বের করার ভিত্তি সম্পর্কে জানতে পেরে ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফিরলাম।

অনুরূপভাবে, ‘তাসাউফের’ ক্ষেত্রেও এই শাস্ত্রের উলামাবৃন্দের সাথে আমার বৈঠকে আমি পশ্চিমা বিশ্বে যা দেখতে পেয়েছিলাম, তার থেকে ভিন্ন একটি চিত্রের দেখা পেয়েছি। আজ রাতে আমার এ প্রভাষণে ইনশা’আল্লাহতা’লা আল-কুরঅান ও সহীহ হাদীস হতে এবং সিরিয়া ও জর্দানের প্রকৃত তাসাউফ-শিক্ষকদের কাছ থেকে এতদসংক্রান্ত জ্ঞান ব্যাখ্যা করা হবে; এটি এ বিবেচনায় যে আমাদেরকে গতানুগতিক ধারণার ঊর্ধ্বে ওঠা প্রয়োজন, আর ইসলামী উৎসগুলো হতে বাস্তব তথ্য জানা দরকার, যাতে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর জানা যায় যে তাসাউফ কোত্থেকে এসেছে? দ্বীন-ইসলামে এর ভূমিকা কী? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এ জ্ঞান সম্পর্কে আল্লাহতা’লারই বা হুকুম কী?

‘তাসাউফ’ শব্দটির উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য অনেক ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রের মতোই এর নামটি প্রথম মুসলিম প্রজন্মের কাছে ছিল অপরিচিত। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন তাঁর ‘মোকাদ্দেমা’ গ্রন্থে এ বিষয়ে উল্লেখ করেন:
এই জ্ঞান ইসলামী ঐশী বিধানেরই একটি শাখা যার উৎপত্তি উম্মতের মধ্য হতে হয়েছে। সূচনালগ্ন হতেই এ ধরনের পুণ্যাত্মাবৃন্দের পথকেও সত্য ও হেদায়াতের রাস্তা, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), তাঁদের দ্বারা প্রশিক্ষিত তাবেঈন ও তৎপরবর্তী সময়ে আগত তাবে’ তাবেঈনের তরীকাহ হিসেবে বিবেচনা করতেন প্রাথমিক যুগের মুসলমান সমাজ ও বিশিষ্টজনেরা।

এটি মূলতঃ এবাদত-বন্দেগীতে নিবেদিত হওয়া, মহান আল্লাহতা’লার প্রতি পূর্ণ উৎসর্গিত থাকা, দুনিয়ার তাবৎ চাকচিক্য হতে নির্মোহ হওয়া, অধিকাংশ মানুষের অন্বেষিত আনন্দ-বিনোদন, ধনসম্পদ ও সুখ্যাতি  পরিহার করা, অন্যদের থেকে দূরে সরে একাকী এবাদত-বন্দেগী পালন ইত্যাদি রীতিনীতির সমষ্টি। এই ছিল মহানবী (দ:)-এর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের আচরিত সাধারণ/সার্বিক রীতি। কিন্তু ইসলামী দ্বিতীয় শতক হতে তৎপরবর্তী যুগগুলোতে মানুষের মাঝে যখন দুনিয়াবী মোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন যাঁরা এবাদত-বন্দেগীতে উৎসর্গিত হন তাঁদেরকে ‘সুফিয়্যা’ বা ‘মোতাসাউয়ীফ’ (তাসাউফপন্থী আলেম) নামে ডাকা হতো। [ইবনে খালদুন কৃত ‘আল-মোকাদ্দেমা’; মক্কা দারুল বা’য কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত ১৩৯৭ হিজরী/১৯৭৮ খৃষ্টাব্দ; ৪৬৭ পৃষ্ঠা]

ইবনে খালদুনের ভাষ্যমতে, “মহান আল্লাহতা’লার প্রতি পূর্ণ উৎসর্গিত থাকা” মর্মে ‘তাসাউফের’ সারকথা ছিল “মহানবী (দ:)-এর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের আচরিত সাধারণ/সার্বিক রীতি।” অতএব, এ পদটি প্রাথমিক যুগে অস্তিত্বশীল না থাকলেও আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে ইসলামী অনেক বিদ্যাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিদ্যমান ছিল; যেমন ‘তাফসীর’ (কুরআন-ব্যাখ্যামূলক জ্ঞান), কিংবা ‘এলম আল-জারহ ওয়া তা’দিল’ (হাদীস বর্ণনাকারীদের গ্রহণযোগ্যতায় প্রভাব বিস্তারকারক ইতিবাচক ও নেতিবাচক উপাদানসমূহ), অথবা ‘এলম আত্ তাওহীদ’ (ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসসংক্রান্ত জ্ঞান)। এসব জ্ঞানের শাখার সবগুলোই যে ধর্মের সঠিক সংরক্ষণ ও প্রসারে সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করেছে, তা আজ সপ্রমাণিত।

‘তাসাউফ’ শব্দটির উৎস হয়তো ‘সূফী’ শব্দ হতে, যা ওই পুণ্যাত্মাবৃন্দকে বোঝায় যাঁরা তাসাউফ অর্জন করেছেন। সূফী শব্দটির উৎপত্তি তাসাউফেরও আগে। কেননা, ইমাম হাসান বসরী (রহ:) যিনি ১১০ হিজরী সালে বেসালপ্রাপ্ত হন, তাঁর বক্তব্যে উভয় পদের মধ্যে সূফী শব্দটির উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায়। বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন, “আমি এক সূফীকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখে তাঁকে এক দিরহাম দিতে চাই। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।” অতএব, তাসাউফকে বুঝতে হলে সূফী কী তা জানতে চেষ্টা করাই মনে হয় সমীচীন হবে। আর হয়তো সূফী ও তাঁর পথ (তাসাউফ-তরীকত), যা এই বিদ্যাশাস্ত্রের বুযূর্গবৃন্দ বেশির ভাগ সময়ই উল্লেখ করে থাকেন, তার সবচেয়ে যথাযথ সংজ্ঞাটি পাওয়া যায় মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ থেকে, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান:
আল্লাহ পাক বলেন, “যে ব্যক্তি আমার ওলী (বন্ধু)-এর প্রতি শত্রুতাভাব পোষণ করে, তার বিরুদ্ধে আমি (অাল্লাহ) যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা আমার সান্নিধ্য অন্বেষণ করে আমারই পছন্দকৃত ফরয এবাদতের মাধ্যমে; অতঃপর সে আমার সান্নিধ্য লাভ করে নফল (তরীকতের রেয়াযত তথা সাধনা) এবাদত-বন্দেগী দ্বারা, যতোক্ষণ না আমি তাকে ভালোবাসি। আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, আমি তার শ্রবণশক্তি হই যা দ্বারা সে শোনে; তার দৃষ্টিশক্তি হই যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত হই যা দ্বারা সে কাজ করে; তার পা হই যা দ্বারা সে চলাফেরা করে। সে আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করলে নিশ্চয় (তৎক্ষণাৎ) আমি তা মঞ্জুর করি; সে আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে রক্ষা করি।” [ফাতহুল বারী, ১১:৩৪০-৪১, হাদীস নং ৬৫০২]

ওপরের এ হাদীসে কুদসী বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম বোখারী (রহ:), আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:), আল-বায়হাকী (রহ:) ও অন্যান্য আলেম-উলেমা, যা একাধিক অনুরূপ এসনাদ দ্বারা সহীহ প্রমাণিত। এ রেওয়ায়াত বা বর্ণনাটি তাসাউফের মৌলিক বাস্তবতা প্রকাশ করে, যা নির্ভুলভাবে বোঝায় ‘পরিবর্তন’; যে পরিবর্তনের পথকে সুন্নাহ’র সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মাশায়েখবৃন্দ সূফী’র সংজ্ঞা হিসেবে বলেন, “ফাকিহুন ‘আমিলা বি ’ইলমিহী ফা আওরাসাহুল্লাহু ‘ইলমা মা লাম এয়া’লাম” – অর্থাৎ, “শরয়ী বিধানে জ্ঞানী পুণ্যাত্মা যিনি যা জানেন তা-ই অনুশীলন করেছেন; অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এরই ফলশ্রুতিস্বরূপ দান করেছেন এমন জ্ঞান যা তিনি জানতেন না।”

স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বল্লে সূফী হচ্ছেন দ্বীনী জ্ঞানে আলেম-(এ-হক্কানী/রব্বানী)-বৃন্দ। কেননা ওপরের হাদীসে কুদসীটি ঘোষণা করে, “আমার বান্দা আমার সান্নিধ্য অন্বেষণ করে আমারই পছন্দকৃত ফরয এবাদতের মাধ্যমে”; জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই কেবল সূফী আল্লাহর আদেশ বা যা ফরয করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে পারেন; তিনি যা জানেন তা-ই অনুশীলন বা প্রয়োগ করেন, কারণ হাদীসে কুদসীটি আরও বলে তিনি ফরয এবাদতের মাধ্যমে কেবল আল্লাহর সান্নিধ্য অন্বেষণ করেন না, বরং “সে আমার সান্নিধ্য লাভ করে নফল (তরীকতের রেয়াযত তথা সাধনা) এবাদত-বন্দেগী দ্বারা, যতোক্ষণ না আমি তাকে ভালোবাসি।” আর এরই প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহতা’লা তাঁকে এমন জ্ঞান মঞ্জুর করেন যা তিনি জানতেন না। কেননা হাদীসে কুদসীটি আরও বলে, “আর আমি যখন তাকে ভালোবাসি, আমি তার শ্রবণশক্তি হই যা দ্বারা সে শোনে; তার দৃষ্টিশক্তি হই যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত হই যা দ্বারা সে কাজ করে; তার পা হই যা দ্বারা সে চলাফেরা করে।” এটি আসলে ‘তাওহীদ’ বা আল্লাহর একত্ব-সম্পর্কিত পূর্ণ সচেতনতাজ্ঞাপক একখানা রূপক, যেটি শ্রবণ, দর্শন, হাত দ্বারা কর্ম সম্পাদন ও পদচারণার মতো মানুষের কাজের প্রেক্ষিতে আল্লাহ সম্পর্কে আল-কুরআনে বিবৃত ওই বাণী উপলব্ধির সমষ্টিও, যে বাণী ঘোষণা করে – “অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও” [সূরা সোয়াফ-ফাত, ৯৬ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান (রহ:) কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]

বস্তুতঃ সূফী তরীকার উৎস নিহিত রয়েছে মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ’তে। আল্লাহতা’লার প্রতি একনিষ্ঠ বা নিবেদিত হওয়ার নিয়ম চালু ছিল প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মধ্যে। তাঁদের কাছে এটি ছিল নামবিহীন এক (আধ্যাত্মিক) অবস্থা। অন্যদিকে, মুসলমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যখন এই (আধ্যাত্মিক) অবস্থা থেকে দূরে সরে যান, তখন-ই এটি একটি স্বতন্ত্র বিদ্যাশাস্ত্রে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় পরবর্তী মুসলিম প্রজন্মগুলোর দ্বারা এ বিদ্যার্জনের জন্যে প্রয়োজন পড়ে এক পদ্ধতিগত প্রয়াসের। অধিকন্তু, প্রাথমিক প্রজন্মগুলোর পরবর্তীকালে ইসলামী পরিবেশে পরিবর্তনের কারণেই তাসাউফ নামের এ বিদ্যাশাস্ত্র অস্তিত্বশীল হয়।

কিন্তু যদি এটি-ই প্রকৃত উৎস হয়, তাহলে আরও তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন দাঁড়ায়: ধর্মের কতোখানি মৌলিক বিষয় এ তাসাউফশাস্ত্র? আর সামগ্রিকভাবে এটি  দ্বীন-ইসলামে কোথায় খাপ খায়? সম্ভবতঃ এ প্রশ্নের সেরা উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় মুসলিম শরীফের একটি রেওয়ায়াতে, যা’তে হযরত উমর ফারূক (রা:) বর্ণনা করেন:

“একদিন আমরা নবী করীম (দ:)-এর খেদমতে হাজির ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন, যাঁর কাপড় ধবধবে সাদা ও চুল গাঢ় কালো ছিল। তাঁর মধ্যে সফরের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছিলো না এবং আমাদের কেউ তাঁকে চিনতেও পারছিলাম না। অবশেষে তিনি হুযূর পাক (দ:)-এর কাছে গিয়ে বসলেন এবং নিজের হাঁটুযুগল রাসূল (দ:)-এর বরকতময় হাঁটুযুগলের সাথে লাগিয়ে দিলেন, অার নিজ হাত নিজ উরুর ওপর রাখলেন। অতঃপর (তিনি) আরয করলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।’ জবাবে নবী করীম (দ:) এরশাদ করলেন, ‘ইসলাম এই যে তুমি এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ (উপাস্য) নেই এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহর (প্রেরিত) রাসূল বা পয়গম্বর। অতঃপর নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযানের রোযা রাখবে, পবিত্র কা’বার হজ্জ্ব করবে, যদি সেখানে পৌঁছুতে পারো।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ আমরা তাঁর ব্যাপারে আশ্চর্যান্বিত হলাম এ কারণে যে তিনি হুযূর পূর নূর (দ:)-এর কাছে (প্রশ্ন) জিজ্ঞাসাও করেছেন এবং (এখন উত্তরের) সত্যায়নও করছেন। তিনি আবার আরয করলেন, ‘আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।’ হুযূর পাক (দ:) এরশাদ করলেন, ‘আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা-মণ্ডলী, (অাসমানী) কেতাবসমূহ, তাঁর রাসূলবৃন্দ এবং শেষ (বিচার) দিবসে বিশ্বাস করো। আর ভাল-মন্দ তাকদীরে বিশ্বাস করো।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ (তিনি) পুনরায় আরয করলেন, ‘আমাকে এহসান সম্পর্কে বলুন।’ মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমালেন, ‘অাল্লাহর এবাদত (আরাধনা) এভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে খেয়াল করো যে তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘কেয়ামত সম্পর্কে সংবাদ দিন।’ রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ করলেন, ‘তুমি যাঁর কাছে জিজ্ঞেস করছো, তিনি কেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারীর চেয়ে অধিক অবগত নন।’ (প্রশ্নকর্তা আবার) আরয করলেন, ‘কেয়ামতের কিছু নিদর্শন সম্পর্কে বলুন।’ এবার হুযূর পাক (দ:) এরশাদ করলেন, ‘দাসী নিজ মালিককে প্রসব করবে, খালি পা, উলঙ্গ শরীরবিশিষ্ট দরিদ্র এবং মেষ-রাখালদেরকে বড় বড় দালানে গর্ব করতে দেখবে।’ (বর্ণনাকারী হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন) অতঃপর ওই প্রশ্নকারী ব্যক্তি চলে গেলেন। আমি সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাকে সম্বোধন করে এরশাদ ফরমালেন, ‘হে উমর! তুমি কি জানো এই প্রশ্নকারী কে?’ আমি আরয করলাম, ‘আল্লাহ ও (তাঁর) রাসূল (দ:)-ই ভাল জানেন।’ তিনি এরশাদ করলেন, ‘তিনি জিবরীল (আ:); তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন’।” [মূল: মুসলিম শরীফ; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘মিরআত শরহে মিশকাত’ ১ম খণ্ড, ১৯ পৃষ্ঠা, ’ঈমান পর্ব’ হতে সংগৃহীত; অনুবাদক: মওলানা এম, এ, মান্নান, চট্টগ্রাম]

এটি সহীহ হাদীস, ইমাম নববী (রহ:) যেটিকে ইসলামের ভিত্তিস্বরূপ হাদীসগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ‘আতাকুম ইউ’আল্লিমুকুম দীনাকুম’ (জিবরীল তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন) – এই শেষ বাক্যটি ব্যক্ত করে যে দ্বীন ইসলাম হাদীসটিতে বর্ণিত তিনটি মৌলিক বিষয়ের সমষ্টি: ১/ ইসলাম, অর্থাৎ, আমাদের প্রতি আল্লাহর আদিষ্ট এতায়াত বা আনুগত্য; ২/ ঈমান, অর্থাৎ, আম্বিয়া (আ:) কর্তৃক প্রদত্ত অদৃশ্য বিষয়গুলোর সংবাদে বিশ্বাস স্থাপন; এবং ৩/ এহসান, অর্থাৎ, আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী এমনভাবে করা যেন কেউ তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন।
আল-কুরআনের সূরা মরিয়মে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন:

“নিশ্চয় আমি অবতীর্ণ করেছি এই কুরআন এবং নিশ্চয় আমি নিজেই সেটির সংরক্ষক।” [আয়াত নং ০৯; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেবের কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]

অতঃপর আমরা যখন আল্লাহতা’লার হেকমত তথা ঐশী জ্ঞান ও কৌশল সম্পর্কে চিন্তা করি এ মর্মে যে তিনি কীভাবে এই কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন, তখন আমরা দেখতে পাই যে (পুণ্যবান) সুন্নী উলেমাবৃন্দ দ্বারা তিনি এটি করেছেন; যাঁদেরকে তিনি (হাদীসটিতে উল্লেখিত) ধর্মের প্রতিটি স্তরে কাজ করতে পাঠিয়েছেন। ইসলামের ক্ষেত্রে শরীয়তের ইমামবৃন্দ (আইম্মায়ে মযাহিব); ঈমানের ক্ষেত্রে আকায়েদের ইমামবৃন্দ; এবং এহসান মানে “অাল্লাহর এবাদত (আরাধনা) এভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো”, এ বিদ্যার ক্ষেত্রে তাসাউফের ইমামবৃন্দ এ মহান দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘আল্লাহর এবাদত করো’ – হাদীসের এ বাণীটি নিজেই (ইসলামের) এই তিনটি মূল বিষয়ের (মানে ইসলাম, ঈমান ও এহসানের) আন্তঃসম্পর্ক আমাদের প্রদর্শন করে থাকে। কেননা, কীভাবে ‘এবাদত-বন্দেগী’ করতে হবে সে সম্পর্কে জানা যায় শুধু দ্বীন-ইসলামের প্রকাশ্য বিধি-বিধান থেকে; পক্ষান্তরে, এই আরাধনার গ্রহণযোগ্যতার পূর্বশর্ত হচ্ছে আল্লাহতা’লা ও ইসলামের ঐশী বিধানের প্রতি ঈমান তথা বিশ্বাস পোষণ, যেটি ছাড়া এবাদত স্রেফ শারীরিক কসরতে পরিণত হবে এবং ফলদায়ক বা গ্রহণযোগ্য হবে না; অপরদিকে, ‘যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো’ – এ কথাটি স্পষ্ট প্রতীয়মান করে যে এহসান একটি মানবিক পরিবর্তনের সূচনাকারী, কারণ এতে নিহিত রয়েছে এমন-ই এক অভিজ্ঞতা যা আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ সঞ্চয় করেননি। তাই তাসাউফ-শাস্ত্রকে বুঝতে হলে ইসলাম ও ঈমানের প্রেক্ষাপটে এ পরিবর্তনের প্রকৃতিকে আমাদের অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করতে হবে; আর আজ রাতে এটি-ই হবে আমার আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

ইসলামের পর্যায়ে আমরা বলেছিলাম যে ‘খোদায়ী আজ্ঞার প্রতি সমর্পণের’ মাধ্যমে তাসাউফের প্রয়োজন পড়ে দ্বীন-ইসলামকে; কিন্তু ইসলামেরও নিজস্ব প্রয়োজনে একইভাবে তাসাউফকে প্রয়োজন পড়ে। কেন? এটি এই সঙ্গত কারণে যে, মুসলমানদেরকে যে সুন্নাহ অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে, তা কেবল মহানবী (দ:)-এর বাণী ও কর্ম-ই নয়, বরং তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর অন্তরের আহওয়াল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থা, যেমন তাকওয়া বা খোদাভীরুতা, এখলাস বা নিষ্ঠা, তাওয়াককুল বা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, রাহমা বা করুণা, তাওয়াদু বা বিনয় ইত্যাদি গুণাবলী।

অধিকন্তু, ইসলামী নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষের কর্ম শুধু সঠিক ও ভুল, এ দু’টি ভাগে কিন্তু বিভক্ত নয়। বরঞ্চ তা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত, যা সেগুলোর পারলৌকিক জগতের ফলাফল মোতাবেক ক্রমানুসারে বিন্যস্ত। ওয়াজীব বা বাধ্যতামূলক আমল পালন পরলোকে আল্লাহতা’লা কর্তৃক পুরস্কৃত হবে, আর তা পালন না করলে শাস্তি পেতে হবে। মানদূব হচ্ছে সেসব আমল যেগুলো অনুশীলন করলে সওয়াব পাওয়া যাবে, না করলে গুনাহ হবে  না। মোবাহ হচ্ছে অনুমতিপ্রাপ্ত, সওয়াব বা শাস্তির সাথে তা (মূলতঃ) সম্পৃক্ত নয়। মাকরূহ বা কটু হচ্ছে সেসব বিষয় যার বর্জনকে পুরস্কৃত করা হবে, কিন্তু চর্চাকে শাস্তি দেয়া হবে না। হারাম (অবৈধ) বিষয়গুলোর বর্জনকে পুরস্কৃত করা হবে এবং চর্চাকে শাস্তি দেয়া হবে, যদি কেউ তা হতে তওবা না করে মারা যান।

কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ সরলভাবে আমাদের কাছে ব্যক্ত করে যে মানুষের অন্তরের অবস্থা এসব শিরোনামের প্রতিটিরই অন্তর্গত। তবু ফেকাহ বা ঐশী বিধি-বিধানের বইপত্রে এগুলো আলোচিত হয়নি; কেননা নামায, রোযা, যাকা’তের ব্যতিক্রম হিসেবে এগুলো পরিমাপ করা যায় না এ মর্মে যে কতোটুকু পরিমাণ এর অনুশীলন করতে হবে। গণনাযোগ্য না হলেও এগুলো প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। চলুন, কিছু উদাহরণের দিকে তাকানো যাক –

/ – আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা: আল-কুরঅানের সূরা বাকারায় আল্লাহ পাক তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপনকারীদেরকে দোষারোপ করেন; কারণ এরা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের উপাস্য মূর্তিকে ভালোবাসে। অতঃপর তিনি এরশাদ ফরমান:

“এবং ঈমানদারদের অন্তরে আল্লাহর মতো কারো ভালোবাসা নেই।” [২:১৬৫; তাফসীরে নূরুল এরফান]
এ আয়াতে মহান প্রভু (মুসলমানদের) ঈমানদারির শর্তারোপ করেছেন যে তাঁর চেয়ে বেশি কাউকে ভালোবাসা যাবে না।

/ – করুণা: আল-বোখারী (রহ:) ও মুসলিম (রহ:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “যে কেউ মানুষের প্রতি করুণাশীল না হলে আল্লাহ পাক-ও তার প্রতি করুণাশীল হবেন না।” [সহীহ মুসলিম, ৪:১৮০৯; হাদীস নং ২৩১৯] ইমাম তিরমিযী (রহ:)-ও বর্ণনা করেন হাসান সহীহ শ্রেণিভুক্ত একখানি হাদীস – “অভিশপ্ত ছাড়া কারো অন্তর থেকেই করুণা অপসারণ করা হয় না।” [আল-জামেউস্ সহীহ, ৪:৩২৩; হাদীস নং ১৯২৩]

/ – পারস্পরিক ভালোবাসা: ইমাম মুসলিম (রহ:) নিজ সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “শপথ আল্লাহর নামে, যাঁর হাতে আমার রূহ (আত্মা)! তোমাদের মধ্যে কেউই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না যতোক্ষণ না তোমরা ঈমান আনো, আর কেউই তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতোক্ষণ না তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসো….” [সহীহ মুসলিম, ১:৭৪; হাদীস নং ৫৪]

/ – নামাযে একাগ্রতা: ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) নিজ সুনান পুস্তকে বর্ণনা করেন যে হযরত আম্মার ইবনে এয়াসের (রা:) হুযূর পূর নূর (দ:)-কে বলতে শুনেছেন – “নিশ্চয় কোনো মানুষ (দুনিয়া) ত্যাগ করলে তার সালাত/নামাযের এক-দশমাংশ লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে; বা এক-নবমাংশ, কিংবা এক-অষ্টমাংশ, অথবা এক-সপ্তমাংশ, বা এক-ষষ্ঠাংশ, কিংবা এক-পঞ্চমাংশ, বা এক-চতুর্থাংশ, অথবা এক-তৃতীয়াংশ, বা অর্ধেক (লিপিবদ্ধ হয়)।” [সুনানে আবি দাউদ, ১:২১১; হাদীস নং ৭৯৬] তার মানে কারো এবাদত-বন্দেগী ততোক্ষণ কবূল হয় না, যতোক্ষণ তিনি আন্তরিকভাবে খোদাতা’লার সামনে হাজির না হন।

/ – নবী-প্রেম: ইমাম বোখারী (রহ:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না যতোক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, পুত্র ও সকল মানবের চেয়ে বেশি ভালোবাসার পাত্র হই।” [ফাতহুল বারী, ১:৫৮; হাদীস নং ১৫]

ওপরে বর্ণিত এসব দালিলিক প্রমাণ থেকে এটি স্পষ্ট যে করুণা, ভালোবাসা বা অন্তরের একাগ্রতা, এই (আধ্যাত্মিক) অবস্থাগুলোর কোনোটি-ই গাণিতিকভাবে পরিমাপযোগ্য নয়। কেননা, শরীয়ত সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে বলতে পারে না ‘করুণার দুটি একক অনুশীলন করো’, অথবা ‘হুযূরী কলব্ তথা অন্তরের একাগ্রতার তিনটি একক ধারণ করো’, ঠিক যেমনটি সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে নামাযের রাক’আতগুলোর বেলায়। তবু এগুলোর প্রতিটি-ই মুসলমানদের জন্যে ব্যক্তিগতভাবে বাধ্যতামূলক। কতিপয় হারাম তথা ‘কঠোরভাবে নিষিদ্ধ’ উদাহরণের দিকে নজর দিয়ে পুরো চিত্রটি এক্ষণে সম্পূর্ণ করা যাক:

/ – আল্লাহ ভিন্ন কাউকে ভয় করা: আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামের সূরা বাকারায় এরশাদ করেন:
“এবং আমার অঙ্গীকার পূরণ করো, আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করবো আর বিশেষ করে আমারই ভয় (অন্তরে) রাখো” [২:৪০; নূরুল এরফান]। আয়াতের শেষ বাক্যটি সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী বলেন, “এতে মহান আল্লাহ পাক ছাড়া আর কাউকেই ভয় না পেতে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।” [তাফসীর আল-ফখরুদ্দীন আল-রাযী, ৩:৪২]

/ – নৈরাশ্য: মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

“নিশ্চয় (কেউই) আল্লাহর দয়া থেকে নিরাশ হয় না, শুধু কাফেররা ছাড়া” [সূরা ইউসূফ, ৮৭]। এতে কুফর তথা অবিশ্বাসের মতো সম্ভাব্য সর্বনিকৃষ্ট (আত্মিক) অবস্থার সাথে অন্তরের এই অবৈধ অবস্থা (নিরাশা)-কে যোগ করার ইঙ্গিত রয়েছে।

/ – দম্ভ: ইমাম মুসলিম (রহ:) তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর একটি হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “কেউই জান্নাতে প্রবেশাধিকার পাবে না যতোক্ষণ তার অন্তরে এক অণুকণা পরিমাণ অহঙ্কার বিরাজ করবে।” [সহীহ মুসলিম, ১:৯৩; হাদীস নং ৯১]

/ – ঈর্ষা: অর্থাৎ, কারো নেয়ামত বা আশীর্বাদপ্রাপ্তিতে হিংসাবশতঃ তার আশীর্বাদের অবসান কামনা করা। ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “হিংসার ব্যাপারে সতর্ক হও, কেননা তা নেক আমল বিনষ্ট করে, যেমনিভাবে আগুন কাঠকে পুড়িয়ে খাক করে।” [সুনান-এ-আবি দাউদ, ৪:২৭৬; হাদীস নং ৪৯০৩]

/ – এবাদত-বন্দেগীর প্রদর্শনী: ইমাম আল-হাকিম (রহ:) সহীহ এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন হুযূর পূর নূর (দ:)-এর একখানা হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “নেক আমলে তথা পুণ্যদায়ক কর্মের অনুশীলনে সামান্যতম প্রদর্শনীর মানে হলো আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তার অর্চনা করা…..।” [আল-মোস্তাদরাক ‘আলাল-সহিহাইন, ১:৪]

এ ধরনের হারাম আত্মিক অবস্থার বিবরণ ফেকাহ বা ইসলামী বিধি-বিধানের বইপত্রে পাওয়া যায় না, কারণ ফেকাহ-শাস্ত্র শুধু গাণিতিকভাবে পরিমাপযোগ্য ঐশী বিধানেরই বিবরণ দেয়। বরঞ্চ এসব (অবৈধ আত্মিক) অবস্থার কারণ ও সমাধান পাওয়া যায় ‘অন্তঃস্থিত ফেকাহ’ তথা তাসাউফের ইমামবৃন্দেরই বইপত্রে; যেমন – হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর ‘এহইয়াও উলূম-উদ্দীন’(ধর্মীয় জ্ঞানের উজ্জীবন), ইমাম-এ-রব্বানী হযরত আহমদ ফারূকী সেরহিন্দী (রহ:)-এর ‘মকতুবাত’ (পত্রাবলী), সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ:)-এর ‘আওয়ারিফুল মা’আরিফ’ (খোদা-জ্ঞানীদের জ্ঞান) ও অনুরূপ কালজয়ী ইসলামী লেখনীসমূহে, যেগুলো অভ্যন্তরীন জীবনের হাজারো নীতিগত প্রশ্ন সম্পর্কে আলোকপাত করে এবং তার সমাধানও দেয়। এসব বইপত্র শরীয়তেরই কেতাবাদি এবং এগুলোতে নিহিত প্রশ্নাবলী ঐশী বিধানসম্পর্কিত বিষয়-ই, যা নির্দেশ করে কোনো মুসলমানের জন্যে কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ আত্মিক অবস্থা অার এ ক্ষেত্রে তাঁর আহওয়াল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থা-ই বা কী হবে। অতএব, এসব বই আধ্যাত্মিক অবস্থা-সংক্রান্ত রাসূল (দ:)-এর সুন্নাহ’র অংশকেই সংরক্ষণ করেছে বটে।

এসব তথ্য কাদের জানা প্রয়োজন? বস্তুতঃ সকল মুসলমানেরই জানা প্রয়োজন, কেননা কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত ও সহীহ হাদীস শরীফ এ বাস্তবতাকেই কেবল নির্দেশ করে না যে মুসলমানদেরকে কিছু নির্দিষ্ট আমল পালন তথা ধর্মীয় অনুশীলনী চর্চা করতে হবে এবং কিছু নির্দিষ্ট কথা বা বাক্য আওড়াতে হবে, বরং এ-ও নির্দেশ করে যে তাঁদেরকে নির্দিষ্ট উন্নত  আধ্যাত্মিক অবস্থা অর্জন করতে হবে এবং (মন্দ) আত্মিক অবস্থাগুলো দূর করতে হবে। আমরা কি আল্লাহ ভিন্ন আর কাউকে ভয় পাই? আমাদের অন্তরে কি অহঙ্কারের এক অণুকণা-ও বিরাজমান? মহানবী (দ:)-এর প্রতি আমাদের মহব্বত (ভালোবাসা) কি অন্য যে কোনো মানুষের চেয়েও বেশি? আমাদের নেক আমল পালনে কি সামান্যতম প্রদর্শনীও বিদ্যমান?

কোনো মুসলমান ব্যক্তি আধ-মিনিটখানেক আত্মবিশ্লেষণাত্মক চিন্তা করলেই নিজ ধর্মের (ওপরোক্ত) এসব বিষয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে সক্ষম হবেন; আর তিনি এ-ও বুঝতে পারবেন কেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদেরকে এসব আধ্যাত্মিক মকাম (পর্যায়) অর্জনে সহায়তা করার কাজ আনাড়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি, বরং অন্তর-বিশেষজ্ঞ তথা তাসাউফের উলামাবৃন্দের হাতে তার দায়িত্বভার ন্যস্ত হয়েছিল। বেশির ভাগ মানুষেরই বদ-অভ্যাসগত কারণে, নিজেদের প্রবঞ্চিত করার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচের দরুন এ পরিবর্তন সাধন সহজ হয় না; তবে সর্বোপরি, আমাদের প্রত্যেকেরই মাঝে বিরাজ করছে এক একগুঁয়ে সত্তা, এক কুপ্রবৃত্তি, যাকে আরবীতে বলা হয় ‘আন্ নাফস্’ এবং যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আল্লাহ পাক সাক্ষ্য দেন সূরা ইউসূফে –

“ইন্নান্-নাফসা লাআম্মা-রাতুম্ বিস্ সূ-ই”; অর্থাৎ, নিশ্চয় (কু)-প্রবৃত্তি তো মন্দকর্মের বড় নির্দেশদাতা। [১২:৫৩; তাফসীরে নুরুল এরফান]

আপনাদের যদি ওপরোক্ত আয়াতে বিশ্বাস না হয়, তাহলে সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীস শরীফটি বিবেচনা করতে পারেন, যা’তে বিবৃত হয়:

পুনরুত্থান দিবসে প্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে, সে গযওয়ায় (ধর্মযুদ্ধে) নিহত একজন।

ওই লোককে আল্লাহর সামনে আনা হলে তাকে তিনি তাঁর প্রদত্ত নানা আশীর্বাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন এবং সে তা স্বীকারও করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা জিজ্ঞেস করবেন, “সেগুলোর ব্যাপারে তুমি কী করেছো?” ওই লোক তখন জবাবে বলবে, “আমি আপনারই খাতিরে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছি।”

আল্লাহতা’লা প্রত্যুত্তর দেবেন, “তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি যুদ্ধ করেছো যাতে বীর বলে তোমার (উচ্চসিত) প্রশংসা করা হয়, আর তা ইতোমধ্যেই করা হয়েছে।” এরপর তাকে দণ্ড দেয়া হবে এবং মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

অতঃপর আরেক লোককে হাজির করা হবে; সে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করেছিল, তা অন্যান্যদের শিক্ষাও দিয়েছিল এবং কুরআন তেলাওয়াত-ও করেছিল। আল্লাহ পাক তাকেও তাঁর উপহৃত ঐশী করুণাধারার কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন, আর সে তা স্বীকারও করবে। এরপর মহান প্রভু বলবেন, “সেগুলোর ব্যাপারে তুমি কী করেছো?” লোকটি জবাব দেবে, “আমি আপনারই খাতিরে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করেছি, তা শিক্ষা দিয়েছি এবং কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করেছি।”
আল্লাহতা’লা বলবেন, “তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি জ্ঞানার্জন করেছো যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়; কুরআন তেলাওয়াত করেছো যাতে তোমাকে ক্কারী বলা হয়; আর তা ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে।” এরপর ওই লোককে দণ্ড দেয়া হবে এবং মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এরপর আরেক লোককে সামনে হাজির করা হবে যাকে আল্লাহ পাক নানা ধরনের ধন-সম্পদ দ্বারা আশীর্বাদধন্য করেছিলেন। আল্লাহতা’লা তা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলে সে-ও তা স্বীকার করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ বলবেন, “সেগুলোর ব্যাপারে তুমি কী করেছো?” লোকটি উত্তর দেবে, “আপনি পছন্দ করেন এমন কোনো একটি ব্যয়-ও আমি বাদ রাখিনি, আর তা আপনারই খাতিরে খরচ করেছি।”

এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা বলবেন, “তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি তা করেছো যাতে তোমাকে দাতা বলা হয়, আর তা ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে।” এরপর ওই লোককে দণ্ড দেয়া হবে এবং মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সহীহ মুসলিম শরীফ, ৩:১৫১৪; হাদীস নং ১৯০৫]

এ বিষয়ে আত্মপ্রবঞ্চনার আশ্রয় নেয়া আমাদের উচিত হবে না, কেননা আমাদের তাকদীর বা ভাগ্য এর ওপরই নির্ভর করছে। শৈশবকালে আমাদের পিতামাতা প্রশংসা বা দোষারোপের সময়ে আমরা কীভাবে আচরণ করবো, তা আমাদের শিখিয়েছিলেন; আর এটি আমাদের অধিকাংশেরই কর্ম সংঘটনের পুরো প্রেষণাকে (কোনো একটি খাতে) প্রবাহিত ও রংয়ে রঙ্গীন করেছে। কিন্তু শৈশবশেষে যখন আমরা ইসলামী বিধান জারির বয়সে পৌঁছি, তখন ওপরোক্ত হাদীস শরীফ ও “নেক আমলে তথা পুণ্যদায়ক কর্মের অনুশীলনে সামান্যতম প্রদর্শনীর মানে হলো আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তার অর্চনা করা” – মহানবী (দ:)-এর উচ্চারিত এ বাণীর দ্বারা ইসলাম ধর্ম আমাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে অন্যান্যরা যেটিকে ভাল মনে করে তা আমাদের জন্যে যথেষ্ট নয়; আর এ-ও ব্যক্ত করে যে আমাদের প্রেরণার সামগ্রিক পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন; আর এ প্রেরণা অন্য কোনো কিছুর দ্বারা নয়, বরং একমাত্র আল্লাহরই রেযামন্দি হাসিলের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা হওয়া চাই। অতএব, ইসলামী বিধি-বিধান মুসলমানদের জ্ঞাত করে যে তাঁদের চিন্তাভাবনা ও প্রেরণার (চিরাচরিত) অভ্যেসকে পরিত্যাগ করা তাঁদের জন্যে বাধ্যতামূলক, কিন্তু তা কীভাবে করতে হবে সে কথা তাঁদেরকে তা জানায় না। এ বিষয়টি জানতে হলে মুসলমানদেরকে ওইসব আধ্যাত্মিক অবস্থার বিশেষজ্ঞ-উলামা তথা সূফী-দরবেশদের কাছে যেতে হবে, যেমনটি (ঐশী আজ্ঞার মাধ্যমে) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নবর্ণিত আয়াতে করীমায়:

“ফাস্আলূ আহলায্ যিকরি ইন্ কুনতুম লা তা’লামূন” – অর্থাৎ, “ওহে মানুষেরা, জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে।” [সূরা অান্ নাহল্, ৪৩ নং আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান]

নিঃসন্দেহে এই পরিবর্তন সাধন, অাত্মিক সততা ও নিষ্ঠা অর্জনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে পরিশুদ্ধকরণ হলো মহানবী (দ:)-এর অন্যতম প্রধান কর্তব্য; কেননা আল্লাহ পাক তাঁর কেতাবের সূরা আলে এমরানে ঘোষণা করেন:
“নিশ্চয় আল্লাহর মহা অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি (এ মর্মে) যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র/পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞান) শিক্ষা দান করেন।” [আল-কুরঅান, ৩:১৬৪, নূরুল এরফান]

ওপরের আয়াতে করীমায় নব্যুয়তের চারটি দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘ইউযাক্-কিহিম’, যার মানে ‘তাঁদেরকে পবিত্র বা পরিশুদ্ধ করেন’। এর আর অন্য কোনো অর্থ তাফসীরে নেই। অতএব, এ কথাও স্পষ্ট যে চিরস্থায়ী ঐশী বিধানের অংশ হিসেবে এই শিক্ষাদানের কাজটি মুসলমানদের প্রথম প্রজন্ম বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়নি, যে বাস্তবতাটি আল্লাহ পাক তাঁর মহাগ্রন্থের সূরা লোকমানে প্রদত্ত ঐশী আজ্ঞায় নিশ্চিত করেছেন:

“ওয়াত্তাবি’ সাবীলা মান্ আনা-বা ইলাইয়্যা” – অর্থাৎ, “আর তারই পথে চলো, যে আমার প্রতি প্রত্যাবর্তন করেছে।” [অাল-কুরআন, ৩১:১৫; নূরুল এরফান]

মুসলমানদের মাঝে যাঁরা ইসলামী বিধিবিধান প্রচার-প্রসার করার কাজে রত, এসব আয়াতে করীমা তাঁদের শিক্ষাদান ও (মুসলমানদের) রূপান্তরে ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করে; আর ওপরোল্লিখিত দ্বিতীয় আয়াতটিতে উদ্ধৃত ‘এত্তেবা’ শব্দটি, যেটি অধিকতর সার্বিক, সেটি কোনো (আধ্যাত্মিকতার পাঠদাতা) শিক্ষকের সোহবত তথা সান্নিধ্যে থাকার পাশাপাশি তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ-অনুকরণকেও ইঙ্গিত করে। এ কারণেই তাসাউফ-চর্চার ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, অসংখ্য এতদসংক্রান্ত তরীকাহ বা অনুশীলন-পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও এ দু’টি বিষয় কখনোই পরিবর্তিত হয়নি: ১/ কোনো শায়খ বা মোর্শেদের সান্নিধ্য লাভ; এবং ২/ তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ, ঠিক যেমনটি সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) মহানবী (দ:)-এর সোহবত দ্বারা ও তাঁরই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে আরোহণ ও আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করেছিলেন।

এ কারণেই কোনো নির্দিষ্ট সূফী শায়খের অধীনে থেকে তরীকাগুলো তাসাউফ-শাস্ত্রের সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসার করে আসছে। প্রথমতঃ এটি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর আচরিত (অন্তরসমূহ) পবিত্রকরণের সুন্নাহ, যা আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ইসলামী জ্ঞান কখনোই শুধুমাত্র লেখনীর মাধ্যমে প্রচারিত হয়নি, বরং উলামাবৃন্দের কাছ থেকে তাঁদের শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। তৃতীয়তঃ এ জ্ঞানের ধরন হচ্ছে ‘আহওয়াল’ তথা অন্তরের অবস্থাসংক্রান্ত এবং তা শুধু জানার সাথে সম্পর্কিত নয়; তাই এ জ্ঞানশিক্ষার পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবিত পীর-মোর্শেদবৃন্দের এমন এক পরম্পরা (সিলসিলা) থেকে তা গ্রহণ করা, যাঁরা মহানবী (দ:) পর্যন্ত ফেরত গিয়েছেন। কেননা, ওপরোল্লিখিত আয়াতে কার্যকরভাবে শর্তারোপকৃত স্রেফ অন্তরের আহওয়ালের ব্যাপ্তি ও সংখ্যা এতোই যে, তা (আধ্যাত্মিকতার পাঠদাতা)-শিক্ষকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ-অনুকরণকেই কার্যকরভাবে এক্ষেত্রে একমাত্র প্রচারের মাধ্যম করে দিয়েছে।

এ যাবত আমরা ইসলাম-ধর্মের প্রেক্ষিতে তাসাউফ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, যা কারো জীবনে ঐশী বিধি-বিধানের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্যে, কুরআন-হাদীসে দাবিকৃত অন্তরের আহওয়াল (অবস্থা) অর্জনের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় ইসলামী শরীয়তের এক বিদ্যাশাস্ত্র। মালেকী মযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালেক (রহ:)-এর বাণীতে শরীয়ত ও তাসাউফের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ব্যক্ত হয়েছে; তিনি বলেন, “ফেকাহ তথা শরীয়তের আইন-কানুন  শিক্ষা না করে যে ব্যক্তি তাসাউফ চর্চা করে, সে অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়; আর যে ব্যক্তি তাসাউফ চর্চা না করে ফেকাহ শিক্ষা করে, সে নিজেকে পথভ্রষ্ট করে। যে ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, সে-ই সত্যে উপনীত হয়।” এ কারণেই মালয়েশিয়া হতে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলমান দেশগুলোর মাদ্রাসাসমূহে পঠিত ঐতিহ্যবাহী পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে তাসাউফ-বিদ্যা শিক্ষা দেয়া হতো; আর এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ শরীয়ত-বিশেষজ্ঞ আলেম-উলামার অনেকেই ছিলেন সূফী-দরবেশ; আর গত শতাব্দীর শুরুতে ইসলামী খেলাফতের সমাপ্তি ও তৎপরবর্তী সময়ে মুসলমান রাজ্যগুলোর ওপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত লক্ষ্ণৌ হতে ইস্তাম্বুল ও মিসরে অবস্থিত উচ্চতর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাসাউফের শিক্ষকবৃন্দ পাঠদান করতেন।

কিন্তু তাসাউফের দ্বিতীয় আরেকটি দিক সম্পর্কে আমরা এখনো আলোকপাত করিনি। তা হলো, (হাদীসে জিবরীলে বর্ণিত) ধর্মের দ্বিতীয় বিষয় ‘প্রকৃত ঈমানের’ সাথে তারই সম্পৃক্ততা; ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রগুলোর প্রেক্ষাপটে এই ঈমান হচ্ছে ‘আকীদা-বিশ্বাসের’ সমষ্টি।

সকল মুসলমান আল্লাহ পাকে বিশ্বাস করেন; অর্থাৎ, এ আকীদা-বিশ্বাস রাখেন যে তিনি মানব-মস্তিষ্কের ধারণাতীত বা কল্পনারও উর্ধ্বে; কেননা মানবের জ্ঞান-বুদ্ধি তার নিজের ইন্দ্রিয় ও তৎনিঃসৃত চিন্তাভাবনার প্রণালীসমূহে আবদ্ধ, যেমন না-কি সংখ্যা, দিকসমূহ, স্থানের ব্যাপ্তি, সময়কাল ইত্যাদি। আল্লাহতা’লা এগুলোর সবকিছুরই উর্ধ্বে, যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান:

“তাঁর (অাল্লাহতা’লার) মতো কিছুই নেই।” [আল-কুরঅান, ৪২:১১; তাফসীরে নূরুল এরফান]

এ আয়াত সম্পর্কে এক মুহূর্ত চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই, মুসলিম শরীফের ওই হাদীসে উল্লেখিত ‘এহসান’ অনুসারে “আল্লাহতা’লার এবাদত-বন্দেগী এমনভাবে করো যেন তাঁকে দেখছো” – এই আদেশের অর্থ আমরা বুঝতে পারি যে ‘দেখা’ মানে চোখ দ্বারা দেখা নয়; কেননা চোখ শুধু তার নিজের মতোই পদার্থ বা বস্তু প্রত্যক্ষ করতে পারে; আর এর অর্থ মস্তিষ্ক-ও নয়, যেটি নিজের কল্পনার উর্ধ্বে ওঠে খোদায়ী তত্ত্ব উপলব্ধি করতে একেবারেই অক্ষম। বরঞ্চ এর অর্থ নিশ্চয়তাসূচক বিশ্বাস, ঈমানের নূর (জ্যোতি), যার সঠিক স্থান চোখ অথবা মস্তিষ্ক নয়, বরং ‘রূহ’ তথা আত্মা – যেটি আল্লাহ পাক আমাদের প্রত্যেকের মাঝে সৃষ্টি করে ফুঁকে দিয়েছেন, যেটির জ্ঞান-প্রজ্ঞা (খোদার) সৃষ্ট বিশ্বজগতের সীমা-পরিসীমা দ্বারা বাধাগ্রস্ত বা অবরুদ্ধ নয়। আল্লাহতা’লা এই রূহকে (ঐশী) রহস্যাবৃত রেখে এর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন; তিনি এরশাদ ফরমান:

“(হে রাসূল) বলুন, ‘রূহ আমার রব্ব (প্রভু)-এর আদেশ থেকে এক বস্তু’।” [আল-কুরআন, ১৭:৮৫; নূরুল এরফান]
এই রূহের (আত্মার) খোরাক হচ্ছে ‘যিকর’ বা ‘আল্লাহতা’লার স্মরণ’। কেন? কারণ আনুগত্যপূর্ণ কাজ-কর্ম নিশ্চয়তাসূচক বিশ্বাসের আলো ও রূহের মধ্যে ঈমানদারি বৃদ্ধি করে; আর যিকর ওই ধরনের আমলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, যা ইমাম আল-হাকীম নিশাপুরী (রহ:) কর্তৃক বর্ণিত এক সহীহ হাদীস দ্বারা সাবেত (প্রমাণিত) হয়; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

“আমি কি তোমাদের বলবো না তোমাদের সেরা আমল (অনুশীলন)-টি সম্পর্কে, যেটি তোমাদের প্রভুর দৃষ্টিতে সবচেয়ে খাঁটি/নির্মল, তোমোদের মর্যাদাবৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের, স্বর্ণ ও রৌপ্যদানের চেয়েও শ্রেয়, আর তোমাদের শত্রুদের মোকাবেলা ও তাদের ঘাড়ে আঘাত এবং তাদের দ্বারা তোমাদের ঘাড়ে প্রত্যাঘাতের (মানে জ্বেহাদের) চেয়েও শ্রেষ্ঠ?” সাহাবা (রা:)-বৃন্দ জিজ্ঞেস করেন, “এটি কী, এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)?” তিনি জবাবে বলেন, “যিকরুল্লাহি ‘আযযা ওয়া জাল্লা” মানে “সর্বশক্তিমান ও মহা-রাজকীয় খোদাতা’লার স্মরণ।” [আল-মোস্তাদরাক ’আলাল্ সহিহাইন, ১:৪৯৬]

নেক আমল (পুণ্যময় কর্ম) এবং বিশেষ করে যিকিরের মাধ্যমে ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি করা (মানে ঈমানকে সুদৃঢ় করা) ইসলাম ধর্ম ও সুন্নাহ-ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতার জন্যে বড় ধরনের এক উপলক্ষ। জনৈক অ-মুসলিম একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “খোদা যদি অস্তিত্বশীল হয়েই থাকেন, তবে কেন এই তালবাহানা? তিনি কেন প্রকাশ্যে এসে তা ঘোষণা দেন না?”

এর উত্তর হলো, এ জীবনে তাকলিফ তথা ‘নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য’ শুধু বাহ্যিক আমলের সাথেই সম্পৃক্ত নয়, বরং তা আমাদের আকীদা-বিশ্বাস ও তার দৃঢ়তার সাথেও সম্পৃক্ত। এ দুনিয়ায় যদি আল্লাহতা’লা ও চির সত্য বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপন অনায়াসে হতো, তাহলে আল্লাহতা’লার দ্বারা আমাদেরকে এর জন্যে দায়ী করার কোনো মানেই হতো না; এটি হতো অটোমেটিক বা আপনাঅাপনি, যেমন না-কি আমাদের বিশ্বাস লন্ডন শহরটি ইংল্যান্ডে অবস্থিত। 
এমতাবস্থায় বিশ্বাস না করার মতো অসম্ভব কোনো বিষয়ের জন্যে কাউকে দায়ী করাটা একেবারেই অর্থহীন হতো।

কিন্তু আল্লাহতা’লা যে দায়িত্ব আমাদের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন, তা হলো গায়ব তথা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন, যা এ দুনিয়ায় আমাদের জন্যে কুফর ও ঈমানের মধ্যে পাথর্ক্য করতে এক পরীক্ষাস্বরূপ; আর অবিশ্বাসী হতে বিশ্বাসীদের পার্থক্য করতে এবং সমস্ত মুসলমান হতে কতিপয় ঈমানদারকে উচ্চ মর্যাদা দিতেও এটি একটি পরীক্ষা বটে।

এ কারণে যিকরের মাধ্যমে ঈমান সুদৃঢ়করণ তাসাউফ-শাস্ত্রের জন্যে এতোটাই পদ্ধতিগত গুরুত্ব বহন করে; মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশ্বাস করতে আদেশ-ই শুধু দেয়া হয়নি, বরং তাতে পূর্ণ নিশ্চিয়তাসূচক আস্থা রাখতে আদেশও করা হয়েছে। আমাদের দেখা আশপাশের জগতটি আলো ও আঁধারের পর্দাসমূহের সমষ্টি; বিভিন্ন ঘটনার উদ্ভব হয়ে আমাদের কারো কারো ঈমান হারিয়ে যায়। আর আল্লাহতা’লা ধর্মের চিরসত্য বিষয়গুলোতে আমরা কতোটুকু নিশ্চিত বা সুদৃঢ় ঈমান রাখি, তার মাত্রা জনে জনে পরিমাপ করে থাকেন। তাই এই অর্থেই হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) বলেছিলেন, “যদি হযরত আবূ বকর (রা:)-এর ঈমান গোটা উম্মতের ঈমানের মোকাবেলায় (পাল্লায়) পরিমাপ করা হতো, তবুও তাঁর ঈমান ভারী হতো।”

সুন্নী আকীদা-বিশ্বাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো ‘ওয়াহদানীয়্যাত’ বা সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার ‘একত্ব ও অনন্য বৈশিষ্ট্য’। এর মানে তাঁর পবিত্র সত্তা অথবা গুণাবলী কিংবা কর্মে কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের বিশৃঙ্খল ও উদ্দাম লড়াইয়ে এই অন্তর্দৃষ্টি ধরে রাখার সামর্থ্য হচ্ছে অন্তরের এয়াকীন (নিশ্চিত বিশ্বাস)-ভিত্তিক শক্তি বা বলেরই একটি কাজ। আল্লাহ পাক তাঁর নবী (দ:)-কে আল-কুরআনে বলেন:

“হে রাসূল (দ:)! আপনি বলুন, ‘আমি আমার নিজের ভাল-মন্দের মধ্যে খোদ-মোখতার (স্বাধীন) নই, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন (সে ঐশী ক্ষমতাবলে ক্ষমতাবান)।’ [সূরা আ’রাফ, ১৮৮ আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান গ্রন্থে লিপিবদ্ধ শানে নুযূল দেখুন, যা’তে রাসূলুল্লাহ (দ:) আধ্যাত্মিক জ্ঞান দ্বারা হারিয়ে যাওয়া নিজ উটনীর খবর বলে দেন।]

তবু আমরা নিজেদের ওপর এবং আমাদের পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করি, আর আকীদা-বিশ্বাসের বাস্তবতা সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে এ কথা ভুলে যাই যে আমাদের পরিকল্পনাগুলোর কোনো কার্যকারিতা-ই নেই এবং আল্লাহতা’লা একাই সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছেন।

আপনি এ ব্যাপারে পরীক্ষা নিতে চাইলে এমন কারো কাছ থেকে সাহায্য নিতে চেষ্টা করুন যার (সমাজে বা রাষ্ট্রে) বড় বড় যোগাযোগের মানুষ আছে, যাদের সাহায্য আপনার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; ওই ধরনের ক্ষমতাবানদের কাছে ভালভাবে তদবির করার জন্যে তাকে বলার মুহূর্তে নিজ বিবেকের দিকে খেয়াল করুন এবং দেখুন আপনি কার ওপর নির্ভর করছেন। আমাদের অধিকাংশের মতোই যদি অাপনি হয়ে থাকেন, মানে আল্লাহ আপনার চিন্তার অগ্রভাগে না থাকেন, যদিও বাস্তবতা হলো তিনি-ই সমস্ত বিষয়ের নিয়ন্তা, তাহলে এটি কি আপনার আকীদা-বিশ্বাসের ঘাটতি নয়? অন্ততঃ আপনার নিশ্চিত বিশ্বাসের মধ্যে এটি কমতি নয় কি?

তাসাউফ প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে আল্লাহর প্রতি এয়াকীন তথা নিশ্চিত বিশ্বাস ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করে এ ধরনের ঘাটতি মেটায় বা সংশোধন করে। আকীদা-বিশ্বাসের দাবিকৃত এয়াকীন অর্জনে তাসাউফের প্রধান দুটো মাধ্যম হলো মোযাকারা তথা ইসলামী বিশ্বাসের সুন্নাহ-ভিত্তিক মূলনীতিমালা শিক্ষা করা এবং যিকির তথা আল্লাহতা’লার স্মরণ দ্বারা নিশ্চিত বিশ্বাসের সুদৃঢ়ীকরণ। এটি আমাদের ঈমানেরই অংশ, যেমনটি আল-কুরআনে এরশাদ হয়েছে:

“অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও।” [সূরা সোয়ফ্-ফা-ত, ৯৬ নং অায়াত; নূরুল এরফান]

তবু আমাদের কয়জনের জন্যে এ ব্যাপারটি প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাস্বরূপ বিদ্যমান? যেহেতু তাসাউফ তা’লিম (পাঠদান) ও যিকিরের এক নিয়মবদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান দেয় এবং ঈমানী দুর্বলতা দূর করে, সেহেতু ঐতিহ্যগতভাবেই ধর্মের এই স্তম্ভটির (মানে ঈমানের) জন্যে এ বিদ্যাশাস্ত্রকে ব্যক্তি পর্যায়ে বাধ্যতামূলক বলে বিবেচনা করা হয়েছে; আর এ শাস্ত্র ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই নিজের যোগ্যতা বা যথার্থতা প্রমাণ করে এসেছে।

আজ রাতে আমাদের আলোচনায় শেষ যে প্রশ্নটির প্রতি আমরা দৃষ্টি দেবো তা হলো: আমাদের জানা ইসলামী শিক্ষার খেলাফ বা পরিপন্থী কর্ম-সংঘটনকারী ’সূফী’দের ব্যাপারে কী ফায়সালা?

এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে সূফী বলতে দুটো অর্থ: প্রথমটি “নিজেকে সূফী মনে করে এমন যে কেউ।” এটি সূফীতত্ত্বের প্রাচ্য-বিশারদ ইতিহাসবিদ ও জনপ্রিয় লেখকদের অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের পর প্রতিষ্ঠিত এক পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া, যারা ’সূফী’ বলতে ‘উলামা’দের বিরোধী কাউকে বোঝান। আমি মনে করি, আজ রাতে প্রকৃত তাসাউফের পরিধি ও পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা যেসব কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ উল্লেখ করেছি, তা পরিস্ফুট করেছে কেন সূফীর নিম্নবর্ণিত সংজ্ঞা আমাদের কাছে প্রাধান্য পাবে: “শরয়ী বিধানে জ্ঞানী পুণ্যাত্মা যিনি যা জানেন তা-ই অনুশীলন করেছেন; অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এরই ফলশ্রুতিস্বরূপ দান করেছেন এমন জ্ঞান যা তিনি জানতেন না।”

ধর্মীয় জ্ঞানে শিক্ষিত একজন সূফী প্রথম যে জিনিসটি জানেন তা হলো, ইসলামী শরীয়ত ও আকীদা-বিশ্বাস সকল মানবের উর্ধ্বে। যে কেউ এ বিষয়টি না জানলে তিনি কখনোই সূফী হতে পারবেন না; তবে ব্যতিক্রম শুধু প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিতে এ শব্দটির অর্থ, যার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কেউ কোনো স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে দামী স্যূট-টাই পরে ব্রিফকেস্ হাতে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যেন সবাই মনে করেন তিনি একজন স্টক-ব্রোকার। কিন্তু প্রকৃত স্টক-ব্রোকার হওয়াটা একেবারেই আলাদা একটা ব্যাপার।

যেহেতু এই পার্থক্য আজকাল মুসলমান সমাজ এতদ্ভিন্ন সদ্ভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও অবহেলা করেন, সেহেতু এ কথাটি অহরহ ভুলে যাওয়া হয় যে আলেমদের মধ্যে যারা সূফীদের সমালোচনা করেছিলেন, যেমন ইবনুল জাওযী নিজ ‘তালবিসে ইবলিস’ (শয়তানের ধোকা) পুস্তকে, কিংবা ইবনে তাইমিয়্যা তার ফতোওয়ার বিভিন্ন স্থানে, অথবা ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা, তারা সবাই কিন্তু শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যাশাস্ত্রের শাখা হিসেবে তাসাউফের সমালোচনা করেননি। এর প্রমাণ হলো ইবনে জাওযীর প্রণীত পাঁচ খণ্ডের ‘সিফাতুস্ সাফওয়া’ শিরোনামের বইটি; এতে বিধৃত হয়েছে সেই একই সূফীদের জীবনী, যাঁদের সম্পর্কে ইমাম আল-কুশায়রী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত তাসাউফের কেতাব ‘রেসালা-এ-কুশায়রীয়্যা’-তে লিখেছিলেন। ইবনে তাইমিয়্যা নিজেকে কাদেরীয়্যা সিলসিলার সূফী মনে করতো, আর তার রচিত ৩৭ খণ্ডে সমাপ্ত ‘মজমু’আয়ে ফাতাওয়া’ গ্রন্থের ১০ম ও ১১তম খণ্ডগুলো তাসাউফের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। আর ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা ৩ খণ্ডের ‘মাদারিজ আস্ সালেকীন’ গ্রন্থটি লেখে আবদুল্লাহ আনসারী আল-হারাউয়ী’র সূফী তরীকার বিভিন্ন আধ্যাত্মিক মকাম-বিষয়ক ‘মানাযিল আল-সা’য়েরীন’ শীর্ষক বইয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হিসেবে। এসব লেখনী পরিস্ফুট করে যে এগুলোর লেখকদের কৃত সমালোচনা মূল তাসাউফশাস্ত্রের প্রতি ছিল না, বরং তাদের সময়কার নির্দিষ্ট কিছু দলের প্রতি-ই ছিল। আর ওই সমালোচনাকে ওর (খাস্) অর্থেই গ্রহণ করতে হবে।

অন্যান্য ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে, ঠিক তেমনি তাসাউফের ইতিহাসেও ভুলত্রুটি হয়েছে; এগুলোর বেশির ভাগই হয়েছে সবার ওপরে শরীয়ত ও অাকীদা-বিশ্বাসের প্রাধান্য উপলব্ধি করতে না পারায়। কিন্তু এসব ভুল-ভ্রান্তি নীতিগতভাবে ভিন্ন ছিল না সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে, যা ঘটেছিল, উদাহরণস্বরূপ, তাফসীর-শাস্ত্রে অনুপ্রবিষ্ট ইসরাঈলীয়্যা (বনূ ইসরাঈল-সম্পর্কিত বানোয়াট কাহিনি)-এর ক্ষেত্রে, কিংবা হাদীস-শাস্ত্রে অনুপ্রবিষ্ট মওদু’আত (জাল হাদীস)-এর বেলায়। কিন্তু তাফসীর-শাস্ত্র মন্দ বা হাদীস-শাস্ত্র বিচ্যুতিমূলক হওয়ার প্রমাণ হিসেবে এসব ভুলকে পেশ করা হয়নি, বরং প্রতিটি শাস্ত্রের বেলায়ই ওই শাস্ত্রবিদ ইমামবৃন্দ ভুল-ভ্রান্তি শনাক্ত করে ওগুলোর ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেন; কেননা উম্মাহকে এর থেকে রেহাই দেয়া জরুরি ছিল। আর এ ধরনের সংশোধনী-ই আমরা ইমাম কুশায়রী (রহ:)-এর ‘রেসালা’, ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর ‘এয়াহইয়া’ এবং সূফী মতাদর্শের অন্যান্য বইপত্রে দেখতে পাই।

ওপরে আমাদের উল্লেখিত সমস্ত কারণেই তাসাউফকে এ উম্মতের উলামাবৃন্দ ইসলাম ধর্মের অত্যাবশ্যক অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এর জাজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছেন তাসাউফেরই উচ্চতর জ্ঞানে জ্ঞানী ইসলামী শরীয়তের অন্যান্য বিদ্যাশাস্ত্রের আলেম-উলেমাবৃন্দ; এঁদের মধ্যে রয়েছেন সর্ব-ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (রহ:), আল-রাযী, আহমদ ফারূকী সেরহিন্দী (রহ:), যাকারিয়্যা আনসারী, ইযয ইবনে আব্দিস্ সালাম (রহ:), ইবনে দাকিক আল-ঈদ, ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহ:), শাহ ওলীউল্লাহ, আহমদ দারদির, ইবরাহীম আল-বাজুরী, আবদুল গনী নাবলুসী (রহ:), আন্ নববী (রহ:), তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:), আস্ সৈয়ুতী (রহ:) প্রমুখ।

সূফী-মণ্ডলী যাঁরা ইসলামের খেদমতে কলমের পাশাপাশি তরবারিও ব্যবহার করেছেন, তাঁদের সম্পর্কে ‘উমদাত আস্ সালেক’ (খোদার পথের পথিকবৃন্দের ভরসা/শায়খ নূহ হা মিম কেলার অনূদিত Reliance of the Traveler) শীর্ষক পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে:

এ ধরনের পুণ্যাত্মাবৃন্দ হলেন নকশবন্দী (সিলসিলার) শায়খ শামিল দাগেস্তানী (রহ:), যিনি ১৯ শতকে ককেশাস্ অঞ্চলে রুশদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেছিলেন; সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সোমালী, সালেহীয়্যা সিলসিলার শায়খ যিনি ১৮৯৯ হতে ১৯২০ সাল পর্যন্ত বৃটিশ ও ইতালীয়দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; কাদেরীয়্যা তরীকার শায়খ উসমান ইবনে ফদী, যিনি ১৮০৪ হতে ১৮০৮ সাল পর্যন্ত ইসলামী অাইন প্রতিষ্ঠার জন্যে উত্তর নাইজেরিয়ায় জ্বেহাদ পরিচালনা করেছিলেন; কাদেরীয়্যা সিলসিলার শায়খ আবদুল কাদের জাযা’ইরী, যিনি ১৮৩২ হতে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আলজেরীয়দের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; দারকাউয়ী (সিলসিলার) ফকীর আলহাজ্জ্ব মোহাম্মদ অাল-অাহরাশ, যিনি ১৭৯৯ সালে মিসরে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন; তিজানী (সিলসিলার) শায়খ আলহাজ্জ্ব উমর তাল, যিনি গিনী, সেনেগাল ও মালি অঞ্চলে ১৮৫২ হতে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত ইসলামী জ্বেহাদ পরিচালনা করেছিলেন; এবং কাদেরী (সিলসিলার) শায়খ মা’অাল-আয়নাঈন অাল-ক্কালক্কামী, যিনি ১৯০৫ হতে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত উত্তর মৌরিতানিয়া ও দক্ষিণ মরক্কোয় ফরাসীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

ধর্ম প্রচারের দ্বারা গোটা অঞ্চলসমূহকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন যে সকল পুণ্যাত্মা, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সানুসিয়্যা সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা শায়খ মোহাম্মদ আলী সানুসী, ১৮০৭ হতে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত যাঁর প্রচেষ্টা ও জ্বেহাদ দ্বারা লিবিয়ার মরু এলাকা ও আফ্রিকী সাব-সাহারা অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়; আরও রয়েছেন শাযিলী (সিলসিলার) শায়খ মোহাম্মদ ফারূক ও কাদেরী শায়খ উবায়স অাল-বারাউয়ী, যাঁদের প্রচেষ্টায় পূর্ব আফ্রিকী উপকূল এলাকা হতে পশ্চিম দিকে এবং সমুদ্র-দূরবর্তী অঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসার হয়। [Reliance of the Traveler, ৮৬৩ পৃষ্ঠা]

এ সকল পুণ্যাত্মার দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্ট হয় কোন্ ধরনের (মহান) মুসলমানবৃন্দ সূফী ছিলেন; অর্থাৎ, (তাঁরা) সব ধরনেরই (ছিলেন), আর তাঁরা সবার এবং সব কিছুর ওপরই প্রভাব ফেলেছিলেন – আর তাসাউফ তাঁদের সাধ্যানুযায়ী ইসলামের খেদমতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

অতএব, আজ রাতে আমার প্রভাষণের সার-সংক্ষেপ হলো: প্রথমে তাসাউফ ও শরীয়তের দিকে নজর দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি যে অনেক কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ মুসলমানদেরকে নিজেদের অন্তরের হারাম অবস্থা (আহওয়াল) যেমন – দম্ভ, হিংসা, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে ভয় করা ইত্যাদি দূর করতে আদেশ দেয়; পক্ষান্তরে, করুণা, মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক মহব্বত ও স্নেহ-মমতা, নামাযে অন্তরের একাগ্রতা এবং মহানবী (দ:)-এর প্রতি ভালোবাসার মতো অন্তরের আহওয়াল (অবস্থা) অর্জনের জন্যেও তা আদেশ করে। আমরা দেখতে পেয়েছি যে এসব অন্তরের অবস্থার বর্ণনা ফেকাহ’র বই-পুস্তকে খুঁজে পাওয়া যায় না, যেগুলোর উদ্দেশ্য-ই হলো (শুধু) শরীয়তের বাহ্যিক ও পরিমাপযোগ্য বিষয়সমূহ সুনির্দিষ্ট করা। অথচ এই আহওয়ালের জ্ঞান প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এ কারণেই এটি এহসান-বিশারদ তথা তাসাউফের শিক্ষকদের অধীনে শেখা হয়েছে ইসলামী ইতিহাসের সকল অধ্যায়েই – বর্তমান শতকের প্রারম্ভ অবধি।

অতঃপর আমরা ঈমানের পর্যায়ে নজর দিয়েছি এবং দেখেছি, যদিও এ জগতে আল্লাহতা’লা একাই সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেন বলে মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস রয়েছে, তবুও দৈনন্দিন জীবনে এ কথা মনে রাখাটা মানব সচেতনতার অর্পিত কোনো কিছু নয় (মানে মানুষ সজ্ঞানে এটি মনে রাখতে অক্ষম), বরং এটি মুসলমানের এয়াকীন তথা নিশ্চিত বিশ্বাসেরই একটি ক্রিয়া। আর আমরা দেখতে পেয়েছি আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যার শাখা হিসেবে তাসাউফ-শাস্ত্র মোযাকারা তথা ‘আকীদা-বিশ্বাস শিক্ষাদান’ ও যিকর তথা ‘আল্লাহ পাকের স্মরণ’ – এই উভয় পন্থায় ওই এয়াকীনের (নিশ্চিত বিশ্বাসের) সুশৃঙ্খল বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে থাকে; আর তা দিয়ে থাকে মহানবী (দ:)-এর উচ্চারিত এহসান-সম্পর্কিত বাণীর সাথে সঙ্গতি রেখেই, যেমনটি তিনি এরশাদ করেন, “আল্লাহতা’লার এবাদত এমনভাবে করো যেন তুমি তাঁকে দেখছো।”

সবশেষে, আমরা দেখতে পেয়েছি, ইবনে আল-জাওযী ও ইবনে তাইমিয়্যার মতো আলেম-উলেমা তাসাউফের প্রতি যে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন, তা নীতিগতভাবে তাসাউফের প্রতি ছিল না, বরং তা ছিল তাদের সময়কার কিছু নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তির প্রতি উদ্দেশ্যকৃত, যার প্রমাণ ওই একই লেখকদের অন্যান্য বইপত্রে বিধৃত, যেখানে তারা তাসাউফকে শরীয়তেরই একটি জ্ঞানের শাখা হিসেবে স্বীকার করেছেন।

আজ রাতে আমার প্রভাষণ যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তাতে ফিরে গিয়ে বলতে হয়, এই উম্মতের মধ্য হতে (প্রকৃত) ইসলামী উলামাদের হারিয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে তাসাউফের দু’টি একদম ভিন্ন চিত্রের উদয় হয়েছে। গত শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা সুন্নী ইসলামের অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলার পরবর্তীকালে লিখিত বইপত্র পড়লে আমরা দেখতে পাই মস্ত বড় এক ধোকা তাতে বিদ্যমান, অার তা হলো: আধ্যাত্মিকতাবিহীন ইসলাম ও তাসাউফ-হীন শরীয়ত। কিন্তু যদি আমরা ইসলামী বিদ্বানদের সনাতন বা ঐতিহ্যবাহী পুরোনো বইপত্র পড়ি, তাহলে তা থেকে আমরা জানতে পারি যে ইসলামের ইতিহাসজুড়ে তাফসীর, হাদীস বা অন্যান্য শাস্ত্রের মতোই শরীয়তের একটি বিদ্যাশাস্ত্র হিসেবে বিরাজমান ছিল তাসাউফ। আমাদের রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান:

“নিশ্চয় আল্লাহ পাক তোমাদের বাহ্যিক আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও কর্ম।” [সহীহ মুসলিম, ৪:১৩৮৯; হাদীস নং ২৫৬৪]

আর এটি-ই সবচেয়ে বড় আশার বাণী ইসলাম বর্তমান আধুনিক বিশ্বকে শোনাতে পারে, যে আধুনিক জগত বস্তুবাদ ও নাস্তিবাদের দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইসলাম প্রকৃতপ্রস্তাবেই ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ধর্ম হিসেবে বাহ্যতঃ একদিকে যেমন পারলৌকিক মুক্তির আশা, অপরদিকে তেমনি তা অাত্মিকভাবে সরাসরি খোদায়ী মহব্বত তথা ঐশীপ্রেম ও উদ্ভাসনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাও।

  *সমাপ্ত*





 









 

 







 
 













      
    

 


    

           

       

Thursday 6 August 2015

তাসাউফ - আত্মপরিশুদ্ধিসম্পর্কিত ইসলামী জ্ঞান

মূল: শায়খ হিশাম কাব্বানী (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[Bengali translation of Shaykh Hisham Kabbani's article 'Tasawwuf - the Islamic Science of Perfection of Character' (As-Sunnah Foundation of America); translator: K.S. Hossain]

আমার শ্রদ্ধেয় পীর ও মোর্শেদ হযরত মওলানা শাহ সূফী সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী অাল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে উৎসর্গিত।  - অনুবাদক

ভূমিকা

শায়খ এম, আদলী সাহেব ইন্টারনেটের এমএসএ-নেট মারফত আমাদের কাছে ছয়টি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। (এই নিবন্ধ সেসব প্রশ্নের ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে।)

’এলমে তাসাউফ - সূফীতাত্ত্বিক জ্ঞান
তাসাউফ-বিষয়ক ছয়টি প্রশ্নের ব্যাখ্যা
লেখক: শায়খ মোহাম্মদ হিশাম কাব্বানী

উৎসর্গ: আমাদের ভাই শায়খ আদলী ও তাঁর নিবন্ধে উল্লেখিত নও-মুসলিমবৃন্দ এবং তাসাউফের বিষয়ে সংক্ষেপে জানতে আগ্রহী সবার প্রতি.....।

সূচনা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

প্রিয় দ্বীনী ভাই ও বোনেরা,

আমরা আপনাদের ইসলামী অভিবাদনসূচক ’সালাম’ জানাই। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, ‘ওয়া ইযা হুইয়্যী-তুম বিতাহিয়্যাতিন ফাহাইয়্যু বিআহসানা মিনহা...’ (সূরা নিসা, ৮৬); অর্থাৎ, ‘এবং যখন তোমাদেরকে কেউ কোনো বচন দ্বারা সালাম করে, তখন তোমরা তার চেয়েও ভাল কোনো বচন জবাবে বলো, কিংবা অনুরূপ-ই বলো। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়/বস্তুর হিসেব গ্রহণকারী।’ (মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেবের ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’)

অতএব, আমরা আপনাদেরকে ’তাহইয়্যাত আল-ইসলাম’স্বরূপ ’আস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ দ্বারা অভিবাদন জানাই, আর আশা করি আপনারাও আমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম বা অনুরূপ সম্ভাষণ জানাবেন; অধিকন্তু, কোনো রকম বৈরিভাব বা অভিযোগ মনে রাখবেন না। কেননা, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইন্টারনেটে সীমা-ছাড়া অন্যায়ের ঘটনা ঘটছে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। আর এই অবিচার একতরফা ঘটছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমরা যা-ই বলি না কেন, কিছু লোক আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেই চলেছে এবং তারা যা বলছে তা-ই গৃহীত বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।

ইসলামে মতপার্থক্য সমাধানের উপায়

আমরা নিজেদের মনগড়া মতামত ব্যক্ত করছি না, বরং অসংখ্য, অসংখ্য মুসলমান যে পথ ও মত গ্রহণ করেছেন, তা-ই প্রকাশ করছি। এতে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখতেলাফ তথা মতপার্থক্যের সূত্রপাত হয়েছে। কখনো কখনো ইসলাম ধর্মে এখতেলাফ হতে পারে, আর এটি ‘এজতেহাদ’গত মতপার্থক্যের কারণেই হতে পারে। এই কারণেই কতিপয় উলামার মতে, বাবুল এজতেহাদ তথা এজতেহাদের দরজা এখনো উম্মুক্ত। বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করার সময় এখন নয়; কিন্তু যারা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, তাদের কাছে তা উম্মুক্ত এ কারণে যে চার মযহাবের ইমামবৃন্দের পরবর্তীকালে আগত ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির গভীর জ্ঞানী আলেমবৃন্দ নতুন এজতেহাদ প্রয়োগ করতে পারবেন। [এটি চার মযহাবের অন্তর্গত হয়েই করতে হবে। - অনুবাদক]

অতএব, মুসলমানবৃন্দ যখন পরস্পর ভিন্নমত পোষণ করেন, তখন একে অপরকে যেন দোষারোপ না করেন। কেননা, তা ইসলামী আদব বা শিষ্টাচারের খেলাফ হবে। তাদের জন্যে যে কাজটি যথাযথ হবে তা হলো, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ না করে আলোচ্য বিষয়ে উভয় মতের প্রতিনিধিত্বকারী আলেমমণ্ডলী কী লেখেছেন, তা গভীরভাবে অধ্যয়ন করা। তাই আমরা বলি, ‘ইসলামী উলেমাবৃন্দের অনেকে বিগত ১৪০০ বছরের ইসলামী ইতিহাসে কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা  যেভাবে করেছেন, তা কেউ না জেনে থাকলে সেই বিষয়গুলো জানতে এবং ইসলামী উলামাদের ব্যাখ্যাকৃত এতদসংক্রান্ত অন্যান্য সকল দৃষ্টিভঙ্গি ও অত্যাবশ্যক নীতিমালার বিবেচনামূলক স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে তার অবশ্যই বিদ্যমান বইপত্র পড়া উচিত।’

আমরা আজ যে বিষয়টি ইন্টারনেটে প্রকাশ করছি, তা সকল উলামা-এ-কেরাম-ই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এতে তাঁরা মহাজ্ঞানের ভাণ্ডার আহরণ করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেফহাল ছিলেন যে এর শিকড় দ্বীন ইসলামের গভীরেই প্রোথিত রয়েছে। উপরন্তু, তাঁরা মতামত ব্যক্ত করেছিলেন যে প্রকৃত তাসাউফ মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ ও শরীয়তানুগ বিষয়, কেননা তা সুন্নাহ ও শরীয়তের অন্তঃস্থল হতেই নিঃসৃত।

তাসাউফ - একটি পারিভাষিক শব্দ

তাসাউফ হলো একটি পারিভাষিক শব্দ, যা প্রসিদ্ধ হাদীসে জিবরীল-এ উল্লেখিত ‘এহসান’ অবস্থাকে ব্যক্ত করে এবং পবিত্র কুরঅান মজীদে উল্লেখিত ‘তাযকিয়্যাত অান্ নফস্’ তথা আত্মপরিশুদ্ধির প্রক্রিয়াকেও বর্ণনা করে। এটি দ্বীন ইসলামে গ্রহণযোগ্য, যতোক্ষণ পর্যন্ত তাতে ‘শাওওয়াযা’ তথা কুসংস্কার না থাকে। আমরা বহুবার বলেছি, আমরা কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না, তার অনুসরণ-ও করি না। আমরা তাযকিয়্যাত আন্ নফস্ ও অন্তর পরিশুদ্ধিমূলক এহসান অবস্থাকে গ্রহণ করি, কেননা তা মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ’র এবং কুরআনী শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা তাসাউফের সংজ্ঞা মেনে চলি, যা ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা ও ইবনে কাসীর এবং ইসলামী শরীয়তের চার মযহাবের অন্যান্য সকল উলেমাবৃন্দ স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

অতএব, এই বিষয় সম্পর্কে আমাদের মুসলমান ভাই ও বোনদের মধ্যে কেউ কেউ অবগত না হওয়ার মানে এই নয় যে বিষয়টির অস্তিত্ব নেই। তাসাউফ শব্দটি নিজে নিজেই একটি সংজ্ঞা, যা অন্য কোনো যথাযথ/উপযুক্ত সংজ্ঞার সাথে অদলবদলযোগ্য। তাযকিয়্যাত আন্‌ নফস্এহসান  সম্পর্কে ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্যেই এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কেউ নিজেকে সূফী বলাটা অনেকটা ‘আমি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তীর্ণ বলে আযহারী’ বলার মতোই ব্যাপার। এটি একটি টাইটেল তথা খেতাব কিংবা বিশেষণের ব্যবহারমাত্র। এতে এর ব্যবহারকারীরা মুসলমান না হওয়ার মতো কোনো কিছু বোঝায় না। ‘আযহারী’ শব্দটি কুরআন বা হাদীসে কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এই শব্দটি একটি ধারণাকে দ্রুত চিহ্নিত করার জন্যেই ব্যবহৃত হয়।

কারো ‘তাসাউফ’ শব্দটি পছন্দ না হলে তা তার ব্যবহার করা উচিত নয়। তিনি অন্যান্য বেশ কিছু সমার্থক শব্দের মধ্য থেকে কোনো একটি ব্যবহার করতে পারেন, যে শব্দগুলো আমরা শায়খ আদলীর প্রশ্নগুলোর জবাবে পেশ করবো। কিন্তু আধুনিকতাবাদী ও প্রাচ্যবিদ্যাবিদদের দ্বারা আরোপিত কিছু নেতিবাচক ধারণার দরুন কেউ যদি তাসাউফ শব্দটিকে পছন্দ না করেন, তাতে এর অর্থ এই দাঁড়াবে না যে মহান উলেমাবৃন্দ এই শব্দটিকে ইসলামী জ্ঞানের শাখা এবং ধর্মের অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করেননি। ইবনে তাইমিয়া-ও তার প্রণীত ‘মজমুয়ায়ে ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া’ (ইবনে তাইমিয়ার ফতোওয়া সমগ্র) শীর্ষক পুস্তকের ১০ম খণ্ডে (এলম আস্ সুলূক) ও ১১তম খণ্ডে (আত্ তাসাউফ) ব্যাখ্যা করেছে। আমরা যেহেতু সবাই মুসলমান, আর এও জানি যে ইবনে তাইমিয়া আলেম (মুফতী) ছিল, সেহেতু তাসাউফ-কে অস্বীকার করার মানে হবে ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্য আলেমমণ্ডলী এই বিষয়ে যা বলেছিলেন তাকে অস্বীকার করা। ইবনে তাইমিয়্যার এতদসংক্রান্ত শিক্ষাকে আমরা শ্রদ্ধা করি, যেমনটি করেন পাঠকদের অনেকেই। আর তাই তার এতদসংক্রান্ত বিস্তারিত মতামত জানা এক্ষণে জরুরি। তবে এই বিষয়ে তার ১৪০০ পৃষ্ঠার বিশাল ফতোওয়াটি অনুবাদ করা বড় কঠিন একটি কাজ; এই কাজ সময়সাপেক্ষ-ও। ইনশা’আল্লাহ আমাদের সাধ্যানুযায়ী আমরা সময়-সুযোগমতো এতদসংক্রান্ত সেসব অর্থ, ধারণা ও সংজ্ঞা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবো।

আমি (শায়খ হিশাম কাব্বানী) আরবীয় হওয়ার দরুন আমার পক্ষে তাসাউফ-সম্পর্কিত বিভিন্ন সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও শব্দের অনুবাদ করা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আপনারা আমাকে মাফ করবেন। কেননা, এই কাজে তাড়াহুড়ো করা যায় না এবং উল্টাপাল্টা উত্তর দেয়াও যায় না। বরঞ্চ আমরা শায়খ আদলী’র প্রশ্নের উত্তর দেয়ার খাতিরে কুরআন-হাদীসের আলোকে তাসাউফ (সূফীতত্ত্ব)-কে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছুক। আমরা তাসাউফ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করার আশা রাখি ইনশা’আল্লাহ, যে শব্দটির সাথে ‘তাযকিয়্যাত আন্ নুফূস’ বা ‘এহসান’ শব্দগুলোর অর্থের দিক থেকে কোনো পার্থক্য-ই নেই। ‘এহসান’ হলো অন্তরের এমন এক অবস্থা যা কুরআন ও হাদীস পাঠের সময় চোখে পানি আনে; দুনিয়ার মোহে সময় অপচয় করার জন্যে কারো মনে অনুতাপের সঞ্চার করে; অার তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ও পরকালীন জীবনের আশীর্বাদপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষী করে তোলে।

কোনো কোনো লেখকের একটি বই লেখার জন্যে প্রয়োজন হয় দুই বা তিন বছর। এই বিশাল বিদ্যাশাস্ত্র যেটি ব্যাখ্যা করতে বই লেখাই বিহিত, সেটি সম্পর্কে এতো স্বল্প পরিসরে আমাদের কাছ থেকে একখানি সুন্দর ব্যাখ্যা কোনো যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারার মানুষ আশা করেন বলে আমি মনে করি না। তথাপিও আমরা ধীরে ধীরে ইবনে তাইমিয়্যা ও ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যার সূফীতত্ত্ববিষয়ক উদ্ধৃতিগুলো, ‘এলম আস্ সুলূক’, ‘এত্তেহাদ’, ‘ফানা’, মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা, শাফায়াতের ব্যাপারগুলো এবং অন্যান্য অসংখ্য বিষয় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হবো; এগুলো ইবনে তাইমিয়্যা, ইবনে কাইয়্যেম ও ইবনে কাসীরের বইপত্রে উল্লেখিত হয়েছিল। মুসলমান ভাই ও বোনেরা অনেকেই এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনবধান রয়েছেন, কেননা এগুলো শুধু আরবী ভাষায় বিদ্যমান এবং অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়নি।

এ যাবত আমরা ইবনে তাইমিয়্যা, ইবনে কাসীর ও ইবনে কাইয়্যেম ছাড়া আর কারো বই অনুবাদ করিনি। আমরা এখনো ব্যাখ্যা করিনি ইসলামের অন্যান্য উলামাবৃন্দ কীভাবে এই সব শব্দকে বিশ্লেষণ করেছেন। কেননা, একদিন না একদিন এই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে, কিন্তু ইসলামী শিক্ষার অবসান হবে না। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:

(হে রাসূল) আপনি বলে দিন, যদি সমুদ্র আমার রব্বের বাণীসমূহ লেখার জন্যে কালি হয়, তবে অবশ্যই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে আর আমার রব্বের বাণীসমূহ শেষ হবে না; যদিও আমি অনুরূপ আরো (সমুদ্র) এর সাহায্যার্থে নিয়ে আসি। [সূরা কাহাফ, ১০৯; মুফতী আহমদ এয়ার খান প্রণীত ‘নূরুল এরফান’]

ওপরোক্ত সূরা কাহাফে উল্লেখিত খোদাতা’লার জ্ঞান হচ্ছে এক অতল মহাসাগরসদৃশ। এ কারণেই ইবনে কাসীর ও সাইয়্যেদ কুতূবের মতো মোফাসসিরীন (কুরআন ব্যাখ্যাকারীরা) পবিত্র কুরআন মজীদের বহু ব্যাখ্যামূলক বড় বড় বই লেখেছে। এই আলেমরা যা লিখেছে, তা কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই বের করা বিষয়, যদিও সর্বসাধারণ সেগুলো পড়ে মর্মোদ্ধারে অক্ষম।

কুরআন ও হাদীসে নিহিত জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা

কুরআন মজীদ আনুমানিক ৫০০ পৃষ্ঠায় ধারণকৃত। বোখারী ও মুসলিম শরীফে গৃহীত হাদীসের সংখ্যা মোটামুটি ৫০০০ থেকে ৭০০০ হবে। তবু আমরা দেখতে পাই যে এই কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ ব্যাখ্যা করতেই হাজার হাজার বইপত্র লেখা হয়েছে। আমরা যদি একজন ব্যক্তিকে, অর্থাৎ, ইবনে তাইমিয়্যাকে উদ্ধৃত করি, যা আমরা করতে চাই, তাহলে আমরা দেখবো যে তার শুধু ৩৭টি পুস্তকই আছে স্রেফ ফতোওয়ার, যেগুলো এমন কি ব্যাখ্যাও নয়। এমতাবস্থায় কারো পক্ষে এ কথা বলা কীভাবে সম্ভব যে ‘এটি কুরআন ও হাদীসে কোথায় আছে?’

ইসলামী উলামাবৃন্দ-ই প্রণয়ন করেছিলেন ‘এলম আন্ নাহু’ (আরবী ব্যাকরণগত জ্ঞান), ’এলম আল-আজায’, ‘এলমুল কালাম’ (কুরআনের অলৌকিক প্রাঞ্জল ভাষা ব্যাখ্যামূলক জ্ঞান), ‘এলম আত্ তাওহীদ’ (আল্লাহর একত্ববিষয়ক জ্ঞান), ’এলম আল-আকীদাহ’ (ইসলামী বিশ্বাসসংক্রান্ত জ্ঞান), ‘এলম আল-কুরআন’ (কুরঅান-সম্পর্কিত জ্ঞান), ‘এলম আল-ফেকাহ’ (ইসলামের প্রায়োগিক বিধানসংক্রান্ত জ্ঞান), ’এলম আল-হাদীস’ (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বাণীসম্পর্কিত জ্ঞান), ‘এলম আস্ সীরাহ’ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের জীবনচরিতবিষয়ক জ্ঞান), ‘এলম আস্ সরফ’ (আরবী ভাষা বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞান), ‘এলম আল-বয়ান’ (ব্যাখ্যামূলক জ্ঞান), ‘এলম আত্ তাফসীর’ (আল-কুরআনের ব্যাখ্যামূলক জ্ঞান), ‘এলম আত্ তাজবীদ’ (সাদৃশ্যপূর্ণ তথা মিলিয়ে পঠনপদ্ধতিগত জ্ঞান), ‘এলম আত্ তারতীল’ (পরিবর্তনশীল পঠনপদ্ধতিগত জ্ঞান), ‘এলম আত্ তাসাউফ’ বা ’এলমুল এহসান’ (আত্মপরিশুদ্ধিমূলক জ্ঞান যা চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনমূলক জ্ঞান নামেও সুপরিচিত) এবং ’এলম-উল-মেরাস্’ (উত্তরাধিকারবিষয়ক জ্ঞান)। এসব জ্ঞান বা এগুলোর পরিভাষার কিছুই মহানবী (দ:)-এর যুগে ছিল না। কিন্তু এগুলোর হাকীকত বা বাস্তবতা বিদ্যমান ছিল; আর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) পরবর্তী যে কোনো প্রজন্মের চেয়ে এগুলোর চর্চা আরও ভালভাবে করেছিলেন।

আল্লাহ পাক ‘তাযকিয়্যাহ’ (পরিশুদ্ধি)-এর কথা উল্লেখ করেছেন

কুরআন মজীদে তাসাউফ-সম্পর্কিত জ্ঞান বা আত্মপরিশুদ্ধিমূলক জ্ঞানের কথা উল্লেখিত হয়েছে:

“তিনি-ই (খোদা), যিনি উম্মী লোকদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল (দ:) প্রেরণ করেন যেন তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান দান করেন; আর নিশ্চয় নিশ্চয় তারা ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে ছিল।” [সূরা জুমু’আহ, ২-৩ নং আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব কৃত ‘নূরুল এরফান’]

এই আয়াতে আমরা চারটি অত্যাবশ্যকীয় মূলনীতি দেখতে পাই। এই চারটির একটি পরিশুদ্ধি (তাযকিয়্যাহ)-কে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে - ‘ওয়া ইউযাক্কিহিম’। এর মানে সকল প্রকার শেরক (আল্লাহর সাথে অংশীবাদ), কুফরী (অবিশ্বাস) ও পাপ হতে ঈমানদারবৃন্দের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে ‘এহসান’ অর্জনের জন্যে প্রস্তুত করা। এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনে কাসীর অনেক পৃষ্ঠা লিখেছে। ‘তাযকিয়্যা’ অর্থ ‘পবিত্র করা’, যার মানে হলো কাউকে বস্তুবাদী বা দুনিয়ার মোহাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে মুক্ত করে অন্তরের পবিত্র অবস্থায় তথা আধ্যাত্মিক পর্যায়ে উন্নীত করা।

’এহসান’ অবস্থাটি তাসাউফ-বিদ্যার দ্বিতীয় অংশ, যেটি মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ’তে উল্লেখিত হয়েছে। এই পরিভাষা হাদীসে জিবরীল (আ:) নামের রেওয়ায়াতে বিবৃত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (দ:) যখন তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর মাঝে বসেছিলেন, তখন হযরত জিবরীল (আ:) আবির্ভূত হয়ে ‘ইসলাম’ (ধর্মের মৌলভিত্তি), ‘ঈমান’ (মৌলিক বিশ্বাস) ও ‘এহসান’ (চারিত্রিক পূর্ণতালাভের অনুশীলনপদ্ধতি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন; এগুলোর পারিভাষিক অর্থ জানতে চান। এই বিষয়টি আমরা আপাততঃ এক নজর বুলিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের জবাব সম্পর্কে পাঠকদের আগ্রহের কারণে শায়খ আদলীর প্রশ্নের যে জবাব আমরা বর্তমানে তৈরি করছি, তাতে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে আরও বিস্তারিত লেখা হবে।

আমাদের দ্বারা ওপরে বর্ণিত জ্ঞানের শাখাগুলো এবং যে জ্ঞানের শাখাগুলো আমরা উল্লেখ করিনি সেগুলো-ও পাঁচ থেকে সাত হাজার হাদীস এবং আনুমানিক ৫০০ পৃষ্ঠাসম্বলিত কুরআন মজীদ হতে নিঃসৃত হয়েছে। এ তথ্যের সূত্রে আমরা বলতে পারি, ‘কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফের ব্যক্তিগত (মানে আপন আপন) পঠন বা অধ্যয়ন থেকে উলেমাবৃন্দ হাজার হাজার বইপত্র লেখেছেন, যেসব পুস্তকের ভিত্তিমূল হলো কুরআন ও হাদীস; তাঁরা ওই দুই উৎস থেকে (কোনোভাবেই) বিচ্যুত হননি, বরং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যুক্ত করেছেন মাত্র

ইবনে তাইমিয়্যার ‘মজমুয়া-এ-ফাতাওয়া’ ৩৭ খণ্ডের; ইবনে কাসীরের ‘তাফসীর’ ২০ খণ্ডের; সাইয়্যেদ কুতূবের ‘কুরআন মজীদের ছায়ায়’ শীর্ষক তাফসীরগ্রন্থ বিশাল। এমতাবস্থায় ‘কুরআনের আয়াত বা হাদীস শরীফে স্পষ্টভাবে কোনো বিষয় সম্পর্কে বর্ণিত না হলে তা ইসলামে নেই’, কিছু লোকের এমন বক্তব্য বুদ্ধিমান কোনো মানুষের উপলব্ধির সাথে খাপ খায় না।

আমরা এমন কথা বলছি না যার কোনো ভিত্তি ইসলাম ধর্মে, কুরআন মজীদে বা সুন্নাহ’তে নেই। যেমন, শায়খুল ইসলাম পদের অধিকারী ইবনে কাসীর আজীবন মানে শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কুরআন ও হাদীস হেফয করতে ব্যয় করেছিল। স্রেফ ‘দলীল কোথায়’ বলে আমরা তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে প্রত্যাখ্যান বা বাদ দিতে পারবো না। কেননা তা কুরআন ও হাদীস থেকে আহরিত এ সকল আলেমের জ্ঞানের বাস্তবতার পরিপন্থী হবে।

অধিকন্তু, আমাদেরকে বলতে হবে যে ‘এলমুম্ মিনাল ‘উলূম’ তথা সকল জ্ঞানের শাখার মধ্যে প্রতিটি শাখা, যা আমরা ওপরে উল্লেখ করেছি, তার ভিত্তি অবশ্যই থাকতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ’তে। এর পরিপন্থী কোনো কিছু হতে পারবে না। আর আমাদের তথা মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজেদের মাঝে কোনো কুসংস্কার, (ভিন্ন কোনো) দর্শন বা আদর্শকে গ্রহণ করা উচিত হবে না। আমরা তা গ্রহণও করি না; আমরা শুধু কুরআন-হাদীসে যা আছে তা-ই গ্রহণ করি। মুসলমান ভাইদের মধ্যে কেউ কেউ অবগত না থাকার মানে এই নয় যে আমরা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়েছি। বরং এর মানে হলো, আমাদেরকে সুন্নাহ ও শরীয়তবিরোধী বলে অভিযুক্ত না করে তাদেরকে এ সকল উৎস অধ্যয়ন ও যাচাই-বাছাই করার ক্ষেত্রে আরও গভীরে যেতে হবে।

আমরা খোদাতা’লার পাপী-তাপী বান্দা। এমন কি মহানবী (দ:) যিনি সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আল্লাহর হাবীব, তিনিও দোয়া করতেন এভাবে, “হে আল্লাহ, আমাকে আমার ’নফস’ (একগুঁয়ে সত্তা)-এর কাছে এক চোখের পলকের তরেও ছেড়ে যাবেন না।” আমরা তো রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মতো পূর্ণতাপ্রাপ্ত নই; আর আমরা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এরও মতো নই, বোযুর্গ উলামাবৃন্দ-ও নই। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে আমরা দীন-হীন বান্দা, যারা মহানবী (দ:) ও সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে অনুকরণ ও অনুসরণ করতে সচেষ্ট। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। অতঃপর আমরা ইন্টারনেটে সকলকে সাক্ষী রেখে পুনর্ব্যক্ত করছি ইসলামী বিশ্বাসের সেই কলেমা-বাক্য - ‘আশহাদু আন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মোহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ’ - যার অর্থ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ভিন্ন আর অন্য কোনো উপাস্য প্রভু নেই এবং হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হলেন তাঁর প্রেরিত পয়গম্বর।’ আমরা এও বলি যে আমরা শুধু আল্লাহতা’লারই এবাদত-বন্দেগী করি, আর তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-এর উচ্চসিত প্রশংসা করে আত্মিক সুখ-ও লাভ করি।

শায়খ আদলীর প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা কিছু সময় নেবো। কিন্তু আমরা মুসলমান ভাই ও বোনদেরকে বলবো, ‘অনুগ্রহ করে বিভিন্ন পাঠাগারে বিদ্যমান ইসলামী ভাবধারার সূফীতত্ত্ববিষয়ক বইপত্র খুঁজে বের করে পড়ুন; কিন্তু কুসংস্কারাচ্ছন্ন বইপত্র নয়। ভণ্ড তাপসবর্গ যা করে তা আমাদের প্রতি আরোপ করবেন না। বরঞ্চ ইবনে তাইমিয়্যা তাসাউফ সম্পর্কে যা বলেছে, তা-ই দিয়ে আমাদেরকে যাচাই করুন।’

’এলম আল-’এরস্’ (উত্তরাধিকারবিষয়ক জ্ঞান) সম্পর্কে ঘোষণা এসেছে আল-কুরআনের ৩-৪ পৃষ্ঠায়। তথাপি এ সকল আয়াত থেকে এই বিষয়ে হাজার হাজার (ব্যাখ্যামূলক) বই লেখা হয়েছে। আর ‘এলম আত্ তাওহীদ’ তথা আল্লাহতা’লার একত্ববিষয়ক জ্ঞান, যেটি সম্পর্কে বহু কুরআনের আয়াত ও হাদীসে বলা হয়েছে, সেটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে বিভিন্ন আলেম-উলামা বিভিন্ন মত ব্যক্ত করে সহস্র সহস্র বইপত্র লেখেছেন।

এলম আত্ তাওহীদ (আকীদা-বিশ্বাসসম্পর্কিত জ্ঞান) 

আকীদা-বিশ্বাসসম্পর্কিত জ্ঞানের কথাই ধরা যাক। “আর্ রাহমান আলাল্ আরশিস-তাওয়া”- কুরআন মজীদের এই আয়াত (২০:০৫), যার অর্থ “তিনি পরম করুণাময়, তিনি অারশের ওপর ইস্তিওয়া তথা সমাসীন হন, যেমনটি তাঁর মর্যাদার সাথে শোভা পায়”, যা আল্লাহতা’লার আরশে সমাসীন হওয়া সংক্রান্ত, সেটি ব্যাখ্যা করতে ইবনে তাইমিয়্যার যুগের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)-বৃন্দের পরবর্তী প্রজন্মের উলেমাবৃন্দ সহস্র সহস্র বই লেখেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সর্ব-ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:), আস্ সৈয়ুতী (রহ:) ও ইবনে হাজর হায়সামী মক্কী (রহ:)।

উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে বহু গ্রন্থপ্রণেতা ইবনে তাইমিয়্যাও তার পূর্ববর্তী অনেক প্রসিদ্ধ আলেমের পাশাপাশি তার সময়কার আলেমদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিল। ওই একটি আয়াতের ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার বইপত্র অস্তিত্ব পায়। তাহলে রাসূলুল্লাহ (দ:) যে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাকিদ দিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘তাযকিয়ায়ে নফস্’ (আত্মপরিশুদ্ধি) ও ‘এহসান’ অবস্থা অর্জনের পদ্ধতিগুলোর ব্যাপারে কী ফায়সালা হবে? এগুলোর জন্যে কি সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী উলামা তথা বুযূর্গানে দ্বীনের লিখিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসম্বলিত সহস্র সহস্র গ্রন্থের প্রয়োজন পড়বে না?

পারিভাষিকভাবে এই জ্ঞান ‘তাসাউফ’ নামে সুপরিচিত। উদাহরণস্বরূপ, ’হাদীস’ শব্দটির অর্থ যদি আমরা অভিধানে তালাশ করি, তাহলে দেখতে পাবো ‘কাদীম তথা প্রাচীনের বিপরীত, জাদীদ (নতুন)’ অথবা বিকল্পস্বরূপ ‘কথিত কোনো কিছু।’ অথচ পারিভাষিক শব্দ ‘হাদীস’-এর সার্বিক সমঝ পেতে গেলে এর অর্থ আমরা দেখতে পাই - ‘মহানবী (দ:)-এর রীতি-নীতি, ঐতিহ্য কিংবা এতদসংক্রান্ত জ্ঞান।’ আর যদি আমরা ‘সুন্নাহ’ শব্দটি অভিধানে তালাশ করি, তাহলে দেখতে পাই যে এর পারিভাষিক সংজ্ঞা হচ্ছে ‘তরীকত’, যার মানে ‘পথ।’ অতএব, আমরা যখন ‘তরীকত’ (পথ) শব্দটি উচ্চারণ করি, উলামা-এ-কেরাম তৎক্ষণাৎ বুঝে যান যে এর অর্থ সুন্নাহ। আমরা যখন বলি ‘হাদীস্’, ইসলামী পণ্ডিতবৃন্দ বুঝতে পারেন এর অর্থ ‘নতুন।’ কিন্তু মহানবী (দ:)-এর পরবর্তী সময়ে এ শব্দটির প্রতি আরোপিত অর্থ হচ্ছে তাঁর বাণী, কর্ম, আচার-আচরণ, শিষ্টাচার ইত্যাদি। ’হাদীস’ শব্দটি আজকে যেমন ’সার্বিকভাবে’ ব্যবহৃত হয়, হুযূর পাক (দ:)-এর সময়ে তা ‘কদাচিৎভাবে’ ব্যবহৃত হতো। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেসালের (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির) পরেই সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর যুগে এটি সার্বিকভাবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। ওই সময় এটি পারিভাষিক শব্দে পরিণত হয়, যা দ্বারা বোঝানো হয় রাসূলুল্লাহ (দ:) সাহাবা (রা:)-বৃন্দকে কী বলতেন, তাঁদের সাথে কী রকম আচরণ করতেন, তাঁর এবং তাঁদের মধ্যকার বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ, এবং মহানবী (দ:)-এর সময়ে কী কী বিদ্যমান ছিল তার বিবরণও।

’হাদীস’ শব্দটির অর্থ   

রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, “আলাইকুম বি-সুন্নাতী ওয়া সুন্নাতে খুলাফায়ে মিম্ বা’দী”; যার মানে হলো “আমার সুন্নাতের অনুসরণ করো এবং আমার পরে আগত খলীফাদের সুন্নাতেরও অনুসরণ করো।” তিনি এ কথা বলেননি, “আলাইকুম বি-হাদিসী ওয়া হাদিসে খুলাফায়ে মিম্ বা’দী।” তিনি বলেননি, “তোমরা আমার হাদীস বা আমার পরে আগত খলীফাবৃন্দের হাদীসের অনুসরণ করো।” পারিভাষিকভাবে তিনি যা বলেছেন তা হলো, “আমার তরীকত অনুসরণ করো এবং আমার খলীফাদের তরীকত-ও অনুসরণ করো।” মহানবী (দ:)-এর ব্যবহৃত শব্দটি হচ্ছে ‘সুন্নাহ।’ এতে প্রতীয়মান হয় ‘হাদীস’ শব্দটি, যাকে বর্তমানে সার্বিকভাবে বোঝা হয়, তা কীভাবে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বেসালের পরে ওই রূপ পরিগ্রহ করে, যে অর্থটি বিবৃত করে: “মহানবী (দ:) সম্পর্কে এবং তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত সামগ্রিক জ্ঞানের শাখা তথা বিদ্যা।” আপনারা এখানে একে এভাবে দেখতে পারেন, ‘এলমুল হাদীস’ বিদ্যার প্রবর্তন এমন এক জ্ঞানের কথা বলে যার অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যুগে ছিল না, কিন্তু যেটি ইসলামী উলামা-এ-কেরাম (রহ:) প্রণয়ন করা জরুরি বিবেচনা করেছিলেন, যাতে করে ইসলাম ধর্মের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর বাণী, আমল তথা আচরিত রীতিনীতি ও কর্মসম্পর্কিত জ্ঞানকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

এ কারণেই আমরা দেখতে পাই সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর পরে এবং হাদীস লিপিবদ্ধ হওয়ার যুগশেষে মোহাদ্দীসমণ্ডলী হাদীস শ্রেণীবিন্যাসকরণ ও সংরক্ষণের নিয়মকানুন ও পদ্ধতি তৈরি করা আরম্ভ করেন। আমরা আরও দেখতে পাই যে বিভিন্ন শ্রেণীর হাদীস বর্ণনা করতে নানা পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ‘এলম আল-হাদীস’ শাস্ত্রে আমরা হাদীসের বিভিন্ন শ্রেণীবিন্যাস পাই। এগুলোর একটি হলো ‘সহীহ’, যার অর্থ করা হয়েছে, ‘ভুলের বিপরীত।’ এই ‘সহীহ’ শব্দটির ব্যাখ্যা করতে একটি গোটা গ্রন্থ লেখার প্রয়োজন হবে। ‘হাদীসে হাসান’ শব্দটির ব্যাখ্যা করতেও আরেকটি পুরো বই লেখতে হবে।

আহাদীসের শ্রেণীবিন্যাস

এই শ্রেণীবিন্যাসের পরবর্তী ধাপ/পর্যায় হলো ’হাদীস যয়ীফ’। এরপর ক্রমানুসারে ‘হাদীস মারফু’, ’হাদীস মুসনাদ’, ‘হাদীস মুত্তাসিল’, ‘হাদীস মওকুফ’, ’হাদীস মাকতু’, ‘হাদীস মুনকাতী’, ’হাদীস মু’আদল’, ’হাদীস মুরসাল’, ’হাদীস মু’আলাক’, ‘হাদীস মুসালসাল’, ‘হাদীস গরীব’, ‘হাদীস আযীয’, ‘হাদীস মাশহুর’, ‘হাদীস মুতাওয়াতের’, ‘হাদীস মু’আনা’আন’, ‘হাদীস মুবহাম’, ‘হাদীস মুদাল্লাস্’, ‘হাদীস আশ্ শায়ায’, ‘হাদীস মাহফূয’, ‘হাদীস মুনকার’, ‘হাদীস মা’রুফ’, ‘হাদীস আলিই ওয়ান-নাযিল’, হাদীস মুদাররাজ’, ’হাদীস মুদ্দাবাজ’, ‘হাদীস মুত্তাফফাক’, ‘হাদীস মুফতারাক’, ‘হাদীস মু’তালিফ’, ‘হাদীস মুখতালিফ’, ‘হাদীস মাকলুব’, ‘হাদীস মুদতারিব’, ‘হাদীস মু’আল্লাল’, ‘হাদীস মাতরুক’, এবং সবশেষে ‘হাদীস মাওযু’

অতএব, আমরা পেলাম হাদীসের ৩৫টি সুনির্দিষ্ট শ্রেণীবিন্যাস, যা উলেমাবৃন্দ হাদীস অধ্যয়নের সময় ব্যবহার করেন এবং যা দ্বারা তাঁরা হাদীসের শ্রেণীবিন্যাস করেন। এভাবেই ইসলামী পণ্ডিতমণ্ডলী জানতে পারেন কোন্ হাদীস গ্রহণযোগ্য, আর কোনটি গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে একটি যৌক্তিক প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে আর তা হলো, “কুরআন বা সুন্নাহ’তে আক্ষরিকভাবে কোথায় এই শব্দগুলো পাওয়া যায়?” আর এরই ধারাবাহিকতায় আরও একটি যৌক্তিক প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই জ্ঞানের বা বিদ্যার শাখা সৃষ্টির এবং এই শ্রেণীকরণ ও শব্দগুলো প্রবর্তনের অনুমতি কখন এলো? কেননা, এ তো মহানবী (দ:) করেননি।

বস্তুতঃ এসব শ্রেণীবিন্যাস অস্তিত্ব পেয়েছে ইমাম বোখারী (রহ:) ও তাঁর মতো মোহাদ্দেসীনবৃন্দের আগমনের পর, যাঁরা ‘এলমুল হাদীস’-এর উসূল তথা মূলনীতি প্রণয়ন ও সেগুলোর শ্রেণীকরণ করেন; আর এগুলোর কোনোটি-ই রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর জমানায় ছিল না। আরেক কথায়, হাদীসের এই শ্রেণীবিন্যাস কুরআন মজীদ বা সুন্নাহ’তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়নি; কিংবা সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-দের যুগেও এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না; বরং এগুলোকে পরবর্তীকালে উলেমাবৃন্দ-ই সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।

মহানবী (দ:) ও হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর যুগে হাদীস ও সুন্নাহ’র জ্ঞান অস্তিত্বশীল ছিল। কেননা, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বাণী (আহাদীস) ও কর্ম (সুন্নাহ) সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং এই জ্ঞান শিক্ষাও দিতেন। কিন্তু ওই সময় এটি কোনো বিদ্যাশাস্ত্র হিসেবে জ্ঞাত ছিল না। অতঃপর যখন হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) একে একে বেসালপ্রাপ্ত হওয়া আরম্ভ করেন, আর তাবেঈনবৃন্দ-ও রাসূলুল্লাহ (দ:) এবং তাঁর খলীফা-মণ্ডলী কী কী বলেছিলেন এবং কী কী করেছিলেন তা জানার জন্যে চেষ্টা করতে থাকেন, তখন-ই হুযূর পাক (দ:) ও তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দের বাণী ও জীবনভিত্তিক কর্ম লিপিবদ্ধ এবং বর্ণনা করার জন্যে কোনো পদ্ধতি তৈরির প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে দেখা দেয়। তাই সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে এবং মহানবী (দ:)-এর যুগের সঙ্গে সময়ের দূরত্ব বৃদ্ধির কারণে রেওয়ায়াতের তথা বর্ণনা-পরম্পরার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিক কাঠামো ও যাচাই-পদ্ধতি যুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়ে; আর এতে সবসময়ই ‘সনদ’ তথা রাসূলুল্লাহ (দ:) কিংবা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (দ:)-সম্পর্কিত তথ্যাদির বর্ণনাকারীদের যাচাইযোগ্য পরম্পরা অন্তর্ভুক্ত রাখা হতে থাকে।

অন্যদিকে, অসংখ্য অনারব ভাষাভাষী মানুষ দ্বীন-ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ায় এবং হাদীস মুখস্থ করার কারণে ’রাবী’ তথা বর্ণনাকারীদের বিদ্যাশাস্ত্র ও ’রেওয়ায়াত’ তথা বর্ণনার বিদ্যাশাস্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়; এরই ফলশ্রুতিতে আহাদীসের ৩৫টি শ্রেণীবিন্যাস করা হয়, আর এগুলোর কোনোটিরই অস্তিত্ব মহানবী (দ:)-এর যুগে ছিল না। অতএব, আমরা দেখতে পাই একটিমাত্র ‘হাদীস’ শব্দ, যেটি শেখা ও প্রচারের জন্যে হুযূর পূর নূর (দ:) তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে জোর তাকিদ দিয়েছিলেন, সেটি নিজস্ব (পারিভাষিক) শব্দাবলী ও পদ্ধতিসহ একটি মহা-বিদ্যাশাস্ত্রে পরিণত হয়; আর এগুলোর অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যুগে ছিল না। তাঁর জমানায় হাদীসের প্রচার ও যাচাই ছিল স্বাভাবিক, আনুষ্ঠানিক নয়। আর এখন ‘এলম আল-হাদীস’ নিজেই একটি বিদ্যাশাস্ত্র। আজকে অনেক পণ্ডিত এই শাস্ত্রে বিশেষায়িত শিক্ষা নেন, আর তাঁদেরকে বলা হয় ‘মোহাদ্দেসীন’

অনুরূপভাবে, আরবী ব্যাকরণ ও ‘তাশকিল’ (লেখা বা মুদ্রণে ব্যবহৃত বিশেষ চিহ্ন যা দ্বারা কোনো বর্ণের বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়) বিশ্বনবী (দ:)-এর যুগের পরবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবর্তিত হয়, যখন পরিবর্তন ও ভুল উচ্চারণ থেকে কুরঅান-হাদীসের আরবী ভাষাকে মুক্ত রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়। আজকের আরবীয়দের সেই চিরায়ত আরবী ভাষা সংরক্ষণের জন্যে অবশ্যই ‘নাহু’‘তাশকিল’ শিখতে হবে। অথচ মহানবী (দ:)-এর জমানায় এই ভাষার ‘ফিতরা’ (নির্দোষ) অবস্থার কারণে এমন কি একজন শিশু-ও শুদ্ধ আরবী জানতো।

একইভাবে, কুরআন ও সুন্নাহ’তে শেকড় গেড়ে থাকা ‘তাসাউফ’ শাস্ত্র-ও একটি মহা-বিদ্যাশাস্ত্র, যাকে বিভিন্ন ভাগে ও শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে এবং যার গভীরতা বর্ণনার জন্যে অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ বিদ্যমান। অতএব, আপনারা কি আমাদেরকে মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত শব্দে তাসাউফের সংজ্ঞা দিতে বলেন, যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইসলামধর্মে রয়েছে বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার, যার প্রতিটি বিষয় ও বিদ্যা  (‘এলমুন মিনাল উলূম’)-ই নানা শব্দ ও শ্রেণীতে বিন্যস্ত, এবং যার ওপরোক্ত আহাদীসের ৩৫টি শ্রেণীবিন্যাসের কথাই কুরঅান বা সুন্নাহ’তে উল্লেখিত হয়নি? আরও মনে রাখবেন যে মহানবী (দ:)-এর সময় এমন কি ‘হাদীস’ শব্দটিও আজকে মুসলমানদের দ্বারা যেভাবে ব্যবহৃত হয় সেভাবে ব্যবহৃত হয়নি।

হাদীসের আলেম-উলেমা (মোহাদ্দেসীন) 

ইতিপূর্বে যা আলোচিত হয়েছে তা থেকে আমরা বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস অধ্যয়ন না করে তাঁর সুন্নাহ’কে উপলব্ধি করা অসম্ভব। আর হাদীসের আলেম-উলেমাদের কাছে না গিয়ে মহানবী (দ:)-এর হাদীস অধ্যয়ন করা একেবারেই অসম্ভব। এ সকল মোহাদ্দেসীনের অন্যতম হলেন ইমাম মালেক (৯৫ হিজরী), যিনি হেজায অঞ্চলের ফেকাহ ও হাদীসের ইমাম, এবং যাঁর ‘আল-মোওয়াত্তা’ গ্রন্থখানা প্রস্তুত করতে সময় লেগেছিল ৪০ বছর। সময়কাল হিসেবে তাঁর পরবর্তী মোহাদ্দেস ছিলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিজরী), যিনি লিখেছিলেন ‘আল-মুসনাদ’ নামের বই, যা’তে তিনি তাঁর মুখস্থকৃত ৭,৫০,০০০ হাদীস হতে তাঁরই দ্বারা বাছাইকৃত আহাদীস সংকলন করেছিলেন। এই অালেমবৃন্দ ইমাম বোখারী (রহ:)-এর যুগের আগেকার, এবং তাঁরাই হাদীসের উসূল তথা নীতিমালা প্রণয়ন করেন। কাজেই আমরা সর্ব-ইমাম মালেক (রহ:) ও আহমদ (রহ:)-সহ আটজন ইমামকে পেয়েছি, যাঁরা বিশ্বনবী (দ:)-এর বেশ কিছুকাল পরে হাদীস সংকলন করেন। সুতরাং ইমাম মালেক (রহ:)-এর যদি হাদীস সংকলন করে বই লেখতে ৪০ বছর লাগে, তাহলে ‘এলম আত্ তাসাউফের’ মতো অনুরূপ ব্যাপক এক বিদ্যাশাস্ত্র সম্পর্কে সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয়ার ব্যাপারটি এতো অল্প সময়ে ও এমন স্বল্প পরিসরে কীভাবে কারো কাছ থেকে আশা করা যেতে পারে আপনারাই বলুন!

আজকাল ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সমস্যা হলো, তারা আমাদের ধর্মকে অত্যন্ত অগভীর, ’রেডিমেড’ ও সহজে হজম হওয়ার প্রক্রিয়াজাতকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিখতে চান। কিন্তু এই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব অসীম, ব্যাপক ও সুগভীর; আর এটি মানব মস্তিষ্কের সংকীর্ণতায় সীমাবদ্ধ নয়, যেমনটি সীমাবদ্ধ অন্যান্য ধর্ম।

আমি যা বলেছি, আমার (দ্বীনী) ভাই ও বোনদের কাছ থেকে তার স্বীকৃতি জ্ঞাপন চাই আমি। যে কোনো প্রকৃত আলেম-ব্যক্তিকে হাদীসের এই শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে জানতে এবং তা ব্যবহার করতে সামর্থ্যবান হতে হবে। এমতাবস্থায় আমি জানতে চাই, কুরআন ও সুন্নাহ’তে কোথায় আক্ষরিকভাবে (আহাদীসের) এই ৩৫টি শ্রেণীর কথা উল্লেখিত হয়েছে? এটি একটি সহজ উদাহরণ। আমরা ওপরে উল্লেখিত ‘উলূম’ (বিদ্যাশাস্ত্রগুলোর)-এর প্রতিটির ক্ষেত্রেই একই রকম প্রশ্ন ছুঁড়তে পারি। বস্তুতঃ এক্ষণে যে প্রশ্ন দাঁড়ায় তা হলো, “কুরঅান ও হাদীসের কোথায় নামসহ ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্র (উলূম)-গুলো বিধৃত হয়েছে?”

বোখারী ও মুসলিম শরীফে লিপিবদ্ধ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান, “আমার এই শতাব্দী হলো সেরা, এরপর সেরা হলো পরবর্তী শতাব্দী;” আর অন্যান্য রেওয়ায়াতে তিনি ফরমান, “(সেরা হচ্ছে) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দী।” সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর পরে ছিলেন তাবেঈন, এরপর তাবে’ তাবেঈনবৃন্দ। ইসলামের সকল জ্ঞান বিশারদ-ই বলেছেন যে তাবেঈনবৃন্দের যুগ শেষ হয়েছিল ১৫০ হিজরী সালের দিকে; আর তাবে’ তাবেঈনদের যুগ সমাপ্ত হয় ২২০ হিজরী সাল নাগাদ। আমরা দেখতে পাই যে সর্ব-ইমাম আবূ হানিফা (রহ:), মালেক (রহ:), শাফেঈ (রহ:) ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) সবাই ওই সময়কার। ইমাম আবূ হানিফা  (রহ:)-এর জন্ম ৮০ হিজরী সালে; ইমাম মালেক (রহ:)-এর ৯৫ হিজরীতে; ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর আনুমানিক ১৫০ হিজরীতে; আর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর ১৬০ হিজরী সালে। রাসূলুল্লাহ (দ:) যে যুগকে ’সেরা সময়’ বলেছিলেন, এঁরা সবাই ওই সময়-ই আবির্ভূত হন, আর তাঁদের পরবর্তী সময়ে আগত উলামা-মণ্ডলীর সাথে তা ছিল বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। তাঁরা সবাই বিভিন্ন ’উলূম’ তথা বিদ্যাশাস্ত্রের নামগুলো, যেগুলো মহানবী (দ:)-এর পরবর্তী সময়ে প্রবর্তিত হয়েছিল, সেগুলো গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এসব শাস্ত্রের মধ্যে ছিল, উদাহরণস্বরূপ, ‘এলম আন্ নাহু’, ‘এলম আল-আজায’, ‘এলম আল-কালাম’, ‘এলম আত্ তাওহীদ’, ‘এলম আল-আকীদা’, ‘এলম আল-কুরঅান’, ‘এলম আল-ফেকাহ’, ‘এলম আল-হাদীস’, ‘এলম আস্ সীরাহ’, ‘এলম আস্ সরফ’, ‘এলম আল-বয়ান’, ‘এলম আত্ তাফসীর’, ‘এলম আত্ তাজবীদ’, ‘এলম আত্ তারতীল’, ‘এলম আত্ তাসাউফ’  (‘এলম আল-এহসান’) ও ‘এলম আল-মেরাস্’

আমাদের মুসলমান ভাই ও বোনেরা, আমরা আনন্দিত যে আমরা এই তাসাউফ-সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলতে পারছি এবং আপনাদের সাথে পরিচিত হতে পারছি; আর এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে এবং একে অপরের মতামতকে সম্মান করেই আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে পারছি; আর এই আলোচনা থেকে আমরা সবাই উপকৃত-ও হচ্ছি। কিন্তু আমাদেরকে পারস্পরিক দোষারোপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে, কেননা তা পাপের উৎস হতে পারে। এক্ষেত্রে আল্লাহ পাক ফরমান - “ইন্না বা’য়াদ আয-যন্নি ইসম”; মানে “নিশ্চয় কিছু কিছু ধারণা (সন্দেহ) পাপ।” তাই আমরা বলি, “আল্লাহতা’লা আমাদের ও আপনাদের ক্ষমা করুন। আর একমাত্র তাঁরই উপাসনা করার এবং মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত না হবার জন্যে তিনি আমাদেরকে সামর্থ্য দিন, আমীন।”

অতএব, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে আমরা শায়খ আদলীর উত্থাপিত প্রশ্নমালাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি না। কিন্তু যেহেতু তাঁর জিজ্ঞাসিত বিষয়টি ব্যাপক, সেহেতু আমাদের কাছ থেকে যাঁরা জবাব আশা করেন তাঁদের প্রতি অন্যায় করা হবে যদি এই বিষয়ের প্রাপ্য উত্তরের চেয়ে ঘাটতিপূর্ণ কোনো উত্তর আমরা দেই। উপরন্তু, আমরা সম্মানিত শ্রোতামণ্ডলীর মনোযোগ আকর্ষণ করবো এ বিষয়ের দিকে যে, মহানবী (দ:)-এর যুগের পরে বিভিন্ন সময়ে অনেক শব্দ ও বিদ্যাশাস্ত্রের প্রবর্তন করা হয়েছে।

আশা করি আপনারা আমাদের দ্বারা শায়খ আদলীর উত্থাপিত প্রশ্নমালার জবাব অবিলম্বে না দেয়ার কারণে হতাশ হননি। দুই-চার কিংবা এমন কি দশ পৃষ্ঠায়ও অতি সাধারণ একখানা ব্যাখ্যা দেয়া এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে না; কেননা ’তাযকিয়্যা’-সম্পর্কিত জ্ঞান ও ‘এহসান’ অবস্থার সংজ্ঞাগত ভিত্তিস্বরূপ বিভিন্ন কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফ উল্লেখ করতে মহা ‘যুহদ’ (প্রচেষ্টা)-এর প্রয়োজন। আমাদের দ্বীনী ভাই ও বোনেরা যদি জিজ্ঞেস করেন আমরা কেন এখানে হাদীসের প্রসঙ্গ টেনে এনেছি, তাহলে তাঁদের বুঝতে হবে যে আমরা এই শাস্ত্রকে ইচ্ছাকৃতভাবে উল্লেখ করেছি উদাহরণস্বরূপ; কেননা আমাদের অধিকাংশেরই এ শাস্ত্রে জ্ঞান ও উপলব্ধি আছে। তাই এ শাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে আমরা কোনো ব্যাখ্যা পেশ করলে সবাই তা সহজে বুঝতে পারবেন। আর যদিও বা এই শাস্ত্রটি সর্বজনবিদিত, তবুও ইতিপূর্বে প্রদত্ত হাদীসের ৩৫টি শ্রেণির আলোকে এটি স্পষ্ট যে আমাদের অধিকাংশেরই এ বিদ্যা সম্পর্কে প্রারম্ভিক জ্ঞান বিদ্যমান।

কিন্তু আমরা যখন ’তাসাউফ’-এর মতো একটি শাস্ত্রের কথা উল্লেখ করবো, যার সাথে শ্রোতামণ্ডলী ভালভাবে পরিচিত নন, তখন এই বিদ্যা সম্পর্কে আমাদেরকে একটি সম্যক ধারণা পেতে হবে যাতে আমরা একে ব্যাখ্যা করতে পারি এবং এর উপযোগী শব্দাবলী ও নীতিমালা দ্বারা একে পরবর্তী পর্যায়ে সংজ্ঞায়িত করতে পারি; অধিকন্তু এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত এবং কুরআন-হাদীসে এর ভিত্তিও তুলে ধরতে পারি। এটি করতে হলে এর ইতিহাস ও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার পদ্ধতি সম্পর্কে শ্রোতামণ্ডলীকে সম্যক ধারণা দেয়া জরুরি। তাই আবারো আমরা পাঠকমণ্ডলীকে অনুরোধ করবো তাঁরা যেন আমাদের প্রতি মূল কথা না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্য কথা বলার দোষারোপ না করেন; বরং তাঁরা যেন উপলব্ধি করেন যে আমরা শায়খ আদলীর উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দেয়ার ভিত্তি-ই রচনা করছি। আর কেউ যদি মনে করেন যে আমাদের উত্তর সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত, তাহলে আমরা জিজ্ঞেস করবো - “শুধুমাত্র কুরআন ও হাদীস থেকে বের করা একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দ্বারা কি হাদীসের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে জানা ও বোঝা আদৌ সম্ভব?” অতএব, আমরা ইমাম আলী (ক:)-এর কথারই প্রতিধ্বনি করবো। তিনি বলেন, “আল-ইনসানু ‘আদুউন লি মা এয়াজহালু”- মানে “মানুষ যা জানে না তারই প্রতি সে বৈরীভাবাপন্ন।” এমতাবস্থায়, আমরা যা জানি না তা প্রত্যাখ্যানের পরিবর্তে আমাদের মন ও মস্তিষ্ককে উম্মুক্ত রাখা একান্ত আবশ্যক, যেমনটি প্রয়োজন ‘এলম আত্ তাযকিয়্যা’ তথা ‘তাসাউফ’ শাস্ত্র হিসেবে খ্যাত পরিশুদ্ধিবিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে।

এক্ষণে আমরা যেহেতু শায়খ আদলীর প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য এবং যেহেতু তিনিও উল্লেখ করেছেন যে এটি নও-মুসলিম ও ‘তাসাউফ’ শব্দের সাথে অপরিচিত মুসলমানদের অবগতির খাতিরে করা প্রয়োজন, আর আমরাও যেহেতু সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে চাই নি, সেহেতু আমরা আমাদের সফরসূচির আগেই এর ত্বরিত জবাব দিচ্ছি - কেননা আমাদেরকে এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অতএব, দীর্ঘ ও যথাযথ জবাব তৈরির উদ্দেশ্য আমাদের অন্তরে থাকলেও ত্বরিত উত্তরের জন্যে চাপ প্রয়োগ হওয়ায় আমরা আগামী দিন বা তৎপরবর্তী দিন একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পেশ করবো, ইনশা’আল্লাহ।

জাযাকুম আল্লাহ খায়রান আলাইকুম,

- শায়খ হিশাম মোহাম্মদ কাব্বানী 


ছয়টি উত্তর 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ওয়াস্ সালাতু ‍ওয়াস্ সালামু ’আলা নাবিই-ইনা মোহাম্মদ ওয়া ‘আলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়া সাল্লাম।

হে শায়খ আদলী - আস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

অনুগ্রহ করে এই উত্তরের সংক্ষিপ্ততার জন্যে মাফ করবেন। কেননা, আমরা মনে করি এই বিষয়টি আরও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। তবে কোনো ডব্লিউ,ডব্লিউ,ডব্লিউ ওয়েবসাইটের জন্যে এটি যথেষ্ট একখানা খোরাক হবে। আমরা আরও কিছু রেফারেন্সের একটি তালিকা এতে দেবো, আগ্রহী পাঠকবৃন্দ ইসলামী তাসাউফ-শাস্ত্র সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে যেগুলোর শরণাপন্ন হতে পারবেন।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর: “তাসাউফ কী?”
  
“তাসাউফ কী? অনুগ্রহ করে এই পারিভাষিক শব্দের বিস্তারিত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দিন এবং সেই সাথে খোদ শব্দটির মানেও উল্লেখ করুন।” - এই প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলি:

আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাই যে আপনি ‘তাসাউফ কী’ প্রশ্নটিকে আপনারই এতদসংক্রান্ত সংজ্ঞা ও শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চাওয়ার ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। এর মানে হচ্ছে আপনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে এটি স্রেফ একটি পারিভাষিক শব্দ, যেটি এমন একটি অবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়েছে, যে অবস্থা মহানবী (দ:)-এর সময় উল্লেখিত হয়েছিল। অতঃপর আপনি ওই শব্দটিকেই ব্যাখ্যা করতে বলেছেন, যার দরুন ‘তাসাউফ’ যে একটি বিষয়কে বোঝানোর জন্যে ব্যবহৃত কোনো পারিভাষিক শব্দ তার প্রতি আপনি ইঙ্গিত করেছেন। 

এ পারিভাষিক শব্দকে আমরা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হবো। কেননা, বিভিন্ন জায়গা থেকে এতোগুলো অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি; যদিও আমরা পাঠকমণ্ডলীর খেদমতে এর পটভূমি রচনায় আরও সময় দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এসব প্রশ্ন থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি মর্মে অনেক অভিযোগের কারণে আমরা তা সংক্ষেপ করেছি। 

এ কথা নিশ্চিত এবং সর্বজনবিদিত যে এই শতাব্দীতে ‘তাসাউফ’ শাস্ত্র সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধিগত বিভিন্নতা বিদ্যমান। কিছু মানুষ মনে করেন এই শাস্ত্র ইসলামবিরোধী এবং শরীয়ত, কুরআন বা সুন্নাহ’তে এটি উল্লেখিত হয়নি। অপরদিকে, ইবনে তাইমিয়্যার অনুসারীরা এবং চার মযহাবের ইমামমণ্ডলীর অনুসারীবৃন্দ আর সর্ব-ইমাম আস্ সুবকী (রহ:), আস্ সৈয়ুতী (রহ:), ইবনে হাজর হায়সামী (রহ:) ও অন্যান্য পরবর্তী যুগের ইমামমণ্ডলীর অনুসারীবৃন্দ সবাই ‘তাসাউফ’কে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন; আর তাঁরা এও জানতেন যে এ বিদ্যাশাস্ত্রের শেকড় কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়তের গভীরে প্রোথিত। এই মহান আলেম-উলেমা ’তাসাউফ’কে গ্রহণ করেছিলেন, কেননা তারা এই শব্দের অর্থগত বাস্তবতা সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ ওয়াকেফহাল।

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যুগে ‘তাসাউফ’ শব্দটি পরিচিত ছিল না। তবে নামটি নতুন হলেও এর মর্ম ধর্মের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল এবং তা ছিল অবিচ্ছেদ্য। ‘তাসাউফের’ উদ্দেশ্য হচ্ছে পাপ হতে নিঃসৃত সব ধরনের মন্দ স্বভাব, অশুভ অভিপ্রায় ও অশুচিতা অন্তর থেকে অপসারণ করে তাকে সদাচরণ ও সৎস্বভাব দ্বারা সুশোভিত করা, যা পবিত্র আল-কুরআন ও মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ আমাদের কাছে দাবি করে থাকে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ‘এহসান’ অবস্থা সৃষ্টি তথা চারিত্রিক পূর্ণতা সাধন করা, যেটি ছিল হুযূর পূর নূর (দ:)-এর (আধ্যাত্মিক) অবস্থা; আর যে অবস্থা অর্জনের জন্যে আসহাবে কেরাম (রা:) ছিলেন সদা সচেষ্ট। 

তাসাউফ = তাযকিয়্যাত আন্ নফস্

‘তাসাউফ’ শব্দটিকে ইতিপূর্বে অন্তর পরিশুদ্ধিকরণের উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হতো; যাকে মূলতঃ কুরআন মজীদে ‘তাযকিয়্যাত আন্ নফস্’ নামে উল্লেখ করা হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তীকালে যেটি ‘তাসাউফ বিদ্যা’ নামে সুপরিচিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ‘এলম’ (বিদ্যাশাস্ত্র) ‘যুহদ’ (কৃচ্ছ্বব্রতসম্পর্কিত বিদ্যা), ‘তাযকিয়্যা’(পরিশুদ্ধিবিষয়ক জ্ঞান) ও ‘এহসান’ (পূর্ণতাপ্রাপ্ত চরিত্র সংক্রান্ত শাস্ত্র) নামে জ্ঞাত ছিল। এই ‘যুহদ’, ‘তাযকিয়্যাহ’‘এহসান’ শব্দগুলো মহানবী (দ:)-এর যুগে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীকালে এগুলোকে ‘এলম আল-হাদীস’, ‘এলম আল-কালাম’, ‘এলম আন-নাহু’, ‘এলম আল-তাসাউফ’-সহ অন্যান্য ইসলামী বিদ্যার মতোই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়। রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁর জমানায় যা যা করেছেন, বলেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই এসব বিদ্যাশাস্ত্রকে ব্যাখ্যা করা হয় এবং এগুলোর বিদ্যালয়-ও প্রতিষ্ঠা করা হয়।

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পরবর্তী যুগে ইসলামী বিদ্যা চালুর প্রয়োজনীয়তা 

আমরা দেখতে পাই যে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর জমানায় ‘এলম আন্ নাহু’ এমন কি কোনো শিশুকেও শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কেননা, হেজায অঞ্চলে বেড়ে ওঠে তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থায় (‘ফিতরা’) এমন কি একজন শিশুও ‘তাশকিল’ (লেখা বা মুদ্রণে ব্যবহৃত বিশেষ চিহ্ন যা দ্বারা কোনো বর্ণের বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়) ছাড়াই কবিতা বা আরবী লিপি পড়তে পারতো। বেড়ে ওঠার সময় জানা থাকার কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ই আরবীয় সর্বসাধারণ এটি রপ্ত করতে সক্ষম হতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে অনারব মানুষ যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা আরম্ভ করেন, তখন তাঁরা কুরঅান মজীদ ভুলভাবে পাঠ করতে থাকেন। এমতাবস্থায় পবিত্র গ্রন্থের শুদ্ধ পঠনে সহায়তার জন্যে নতুন নিয়মকানুন প্রবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে। এভাবেই ‘এলম আন্ নাহু’‘এলম আত্ তাশকিল’ প্রতিষ্ঠা পায়। 

অনুরূপভাবে, ‘এহসান’ (পূর্ণতাপ্রাপ্ত) অবস্থা, ‘যুহদ’ (কৃচ্ছ্বব্রত) অবস্থা, ‘ওয়ারা’ (খোদাভীতি) অবস্থা এবং ‘তাকওয়া’ (খোদাসম্পর্কিত সচেতনতা) অবস্থাও সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কর্তৃক স্বাভাবিকভাবে অনুশীলিত হয়েছিল; কেননা তাঁরা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সোহবতে তথা সান্নিধ্যে, আর ওই সব অবস্থার সূত্রপাত হয়েছিল ওই সোহবতের সরাসরি ফলাফলস্বরূপ। এ কারণেই তাঁদেরকে ‘সাহাবা’ বলা হতো; কেননা তাঁরা ছিলেন মহানবী (দ:)-এর সঙ্গি-সাথী এবং তাঁর ওই সঙ্গ-ই তাঁদেরকে পরিশুদ্ধ হতে সহায়তা করেছিল।

একইভাবে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর যুগের পরে মহানবী (দ:) বা সাহাবী (রা:)-বৃন্দের সোহবত না পাওয়া বহু অপবিত্র মানুষ ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার দরুন এবং ওই সময় অনেক নব্য মুসলিমের দ্বারা প্রকৃত ইসলাম ধর্মের পথ পরিত্যাগের কারণে একটি বিদ্যালয় তার ভিত্তিসহ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়ে, ঠিক যেমনিভাবে ’এলম আন্ নাহু’ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এ রকম বিভিন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, যেগুলোর মাধ্যমে ‘এলম আত্ তাকওয়া’, ‘এলম আল-ওয়ারা’, ‘এলম আল-এহসান’, ‘এলম আয্ যুহদ’ শাস্ত্রগুলোর উৎপত্তি ঘটে; আর এসব বিষয়কে ‘এলম আত্ তাসাউফ’ (তাসাউফ-বিষয়ক জ্ঞান) শীর্ষক শাস্ত্রের সাথে সংযুক্ত করা হয়। 

কোনো জ্ঞানের শাখার নামকরণে যে কোনো শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারটি গৃহীত ও সর্বজনবিদিত; উপরন্তু, এ ব্যাপারে কারোর ইচ্ছানুযায়ী নামকরণে কোনো বাধা-ই নেই। অনুরূপভাবে, ‘এলম আল-এহসান’ শাস্ত্রটি-ও ভিন্ন কোনো নামকরণে পরিবর্তিত হয়ে যায় না। আমি যা মনেপ্রাণে চাই তা হলো, ‘তাসাউফ’ শব্দটির প্রতি অপছন্দ থাকার কারণে কুরআন ও হাদীসে উল্লেখিত এই গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা চর্চা করার ক্ষেত্রে যেন কাউকে বাধা দেয়া না হয়। কারো কাছে শব্দটি সমস্যা মনে হলে তিনি যেন সেটিকে নতুন কোনো নাম দেন, তার পছন্দের যে কোনো নাম যেন তিনি দেন।

আমাদের অবশ্যই জানা থাকা প্রয়োজন যে ‘তাসাউফ’ আমাদের ইসলাম ধর্মে নতুন কোনো বিষয় নয়, নতুন প্রবর্তিত বিষয়-ও নয়। বরঞ্চ এটি মহানবী (দ:) ও সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত একটি বিষয়, যার ভিত্তি ইসলাম ধর্মেই নিহিত রয়েছে। কতিপয় ইসলাম ধর্মের দুশমন প্রাচ্যবিশারদ ও তাদের শিষ্যরা এটি সম্পর্কে যা বলেছিল, এটি  মোটেও তা নয়। তারা তাসাউফের জন্যে কিছু নতুন নামের উদ্ভাবন করেছিল যাতে তারা এ বিদ্যাশাস্ত্রকে এবং রাসূলুল্লাহ (দ:) কর্তৃক পবিত্র হাদীস শরীফে উল্লেখিত ‘এহসান’ অবস্থাকে আক্রমণ করতে পারে। তারা ‘তাসাউফ’ শাস্ত্রের প্রতি ‘শাওওয়াযা’ তথা কুসংস্কার শব্দটি আরোপ করার অপচেষ্টাও চালিয়েছিল। 
  
‘তাসাউফ’ শব্দের ধাতু  
  
‘তাসাউফ’ শব্দের ধাতু চারটি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমটির আরবী ‘সাফা’ শব্দ থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ প্রাকৃতিক উপাদান স্ফটিকের মতো নির্মল; পানির মতো স্বচ্ছ। কোনো স্বচ্ছ, পুতঃপবিত্র ও নির্মল অন্তরের বেলায় এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

এ রকম আরও অনেক ব্যাখ্যা ‘তাসাউফ’ শব্দটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন একটির উৎপত্তি হয়েছে ‘আহলুস্ সুফফা’ (মসজিদে নববী-সংলগ্ন ছোট বারান্দার মানুষজন) শব্দটি থেকে; এই পুণ্যাত্মাবৃন্দ মহানবী (দ:)-এর প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগীর সময় মসজিদে নববী-সংলগ্ন বারান্দায় অবস্থান করতেন এবং তাঁদের সম্পর্কে আল-কুরআনে এরশাদ হয়েছে: “এবং (হে রাসূল) আপন আত্মাকে তাদেরই সাথে সম্বন্ধযুক্ত রাখুন, যাঁরা সকাল-সন্ধ্যায় আপন রব্ব (প্রতিপালক)-কে আহ্বান করেন, তাঁরই সন্তুষ্টি চান, এবং আপনার চক্ষুদ্বয় যেন তাঁদেরকে ছেড়ে অন্য কারো দিকে না ফিরে; আপনি কি পার্থিব জীবনের শোভা-সৌন্দর্য কামনা করবেন? এবং তার কথা মানবেন না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি এবং সে আপন খেয়াল-খুশির অনুসরণ করেছে; আর তার কার্যকলাপ সীমাতিক্রম করে গিয়েছে।” [সূরা কাহাফ, ২৮ নং আয়াত]

ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ কতোখানি নিজেদের জিহ্বা, মস্তিষ্ক ও অন্তর দ্বারা যিকিরের তথা খোদাতা’লাকে স্মরণ করার অবস্থায় থাকবেন, তার প্রতি ওপরে উদ্ধৃত আয়াতটি গুরুত্বারোপ করেছে।

তৃতীয় ধাতুটির উৎপত্তি আরবী ‘আস্ সিফফা’ শব্দটি হতে, যার মানে হলো সৎ স্বভাব ধারণ ও অসৎ স্বভাব বর্জনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়া।

চতুর্থ ধাতুটির উৎপত্তি আরবী ‘সূফফাতুল কাফফা’ শব্দটি হতে, যার অর্থ ‘একটি নরম স্পন্জ’। কেননা, এ শব্দের বিশেষ্য ‘সূফী’হচ্ছেন স্পন্জের মতোই নরম; তাঁর অন্তর নির্মল হওয়ার কারণে অত্যন্ত নরম। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (দ:) সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর প্রতি এতোখানি যত্নবান ছিলেন, যাতে তাঁদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা যায়; অধিকন্ত, তিনি তাঁদেরকে এ বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে প্রত্যেকের নিজ নিজ সত্তার উন্নতি নির্ভর করে অন্তরের উন্নতির ওপর এবং সেটির অভ্যন্তরীন ও বহির্ভাগের সকল ব্যাধি হতে আরোগ্যের ওপরও। 

রাসূলুল্লাহ (দ:) অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন -

ইমাম বোখারী (রহ:) বর্ণিত এক হাদীসে এরশাদ হয়েছে: “নিশ্চয় (মানুষের) শরীরে এক টুকরো গোস্ত আছে, যেটি পবিত্র হলে সারা শরীর পবিত্রতা অর্জন করে; আর তা অপবিত্র হলে সারা শরীর অপবিত্রতা লাভ করে; নিশ্চয় শরীরের সে অংশটি হচ্ছে হৃদয় (অন্তর)।”  

মহানবী (দ:)-এর বাণী মুসলিম শরীফের আল-বিরর অধ্যায়েও উদ্ধৃত হয়েছে; তিনি এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আল্লাহ পাক তোমাদের শরীর বা চেহারার দিকে দেখেন না, বরং তোমাদের অন্তরের দিকেই দেখেন।”

অতএব, আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি যে হুযূর পূর নূর (দ:) সব কিছুকে অন্তরের পবিত্রতার সাথে বেঁধে দিয়েছেন। মন্দ স্বভাব ও আচরণ ত্যাগ করে আমরা যখন অন্তরকে সৎ স্বভাব ও সুন্দর আচরণ দ্বারা সুশোভিত করতে সক্ষম হবো, তখনই আমরা নিখুঁত ও স্বাস্থ্যকর অন্তর অর্জন করতে পারবো। আল্লাহতা’লা তা-ই উল্লেখ করেছেন তাঁর কুরঅান মজীদে; তিনি এরশাদ ফরমান: 
  
“ওই দিন (শেষ বিচার দিবসে) না ধনসম্পদ, না পুত্র সন্তানসন্ততি কারো উপকারে আসবে; শুধু (উপকার হবে) সে ব্যক্তির, যিনি প্রশান্ত অন্তর নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হবেন।” [সূরা শু’আরা, ৮৮-৯ আয়াত]   

ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) বলেন, “অন্তরের বিদ্যা  (‘আত্ তাসাউফ’) অর্জন এবং হিংসা-বিদ্বেষ, অহঙ্কার ও দম্ভের মতো অন্তরের সমস্ত ব্যাধি সম্পর্কে জানা ও সেগুলো বর্জন প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি অবশ্য কর্তব্য।”

মোফাসসেরীন-বৃন্দ বলেন হিংসা  (‘হাসাদ’), প্রদর্শনী  (‘আর-রিয়া’), কপটতা  (‘আন্ নিফাক’) ও ঘৃণা (’আল-হিকদ্’) হচ্ছে সেসব মন্দ স্বভাব ও আচরণ যা আল্লাহ পাক নিষেধ করেছেন তাঁর পাক কালােমে; তিনি এরশাদ ফরমান:
  
“হে রাসূল বলুন, নিশ্চয় আমার প্রভু (খোদাতা’লা) হারাম করেছেন সমস্ত প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য লজ্জাজনক মন্দ কাজ (আল-ফাওয়াহিশা)।” [সূরা আ’রাফ, ৩৩ অায়াত]   

আয়াতোল্লিখিত ‘আল-ফাওয়াহিশা’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে ঘৃণা (হিকদ্), হিংসা, বিদ্বেষ ও কপটতাকে। আর আয়াতোক্ত ‘প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য’ বাক্যটি দ্বারা আল্লাহতা’লা এই বিষয়ের দলীল উপস্থাপন করেছেন যে, শুধু বাহ্যিক আমল তথা কর্ম সংশোধন-ই নয়, বরং প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তঃস্থিত হৃদয়ে লুকানো অপবিত্রতা-ও পরিশুদ্ধ করা প্রয়োজন, যে অশুচিতা সম্পর্কে কেবল তার প্রভু খোদাতা’লা-ই ভাল জানেন।

মহানবী (দ:) মুসলিম শরীফের ‘কিতাবুল ঈমান’ অধ্যায়ে বর্ণিত এক হাদীসে এরশাদ ফরমান:
  
“যে ব্যক্তির অন্তরে এক বিন্দু পরিমাণ অহঙ্কার বিদ্যমান, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”

’তাসাউফ’ হচ্ছে এমন এক বিদ্যাশাস্ত্র ও জ্ঞানের শাখা যা দ্বারা কেউ ‘নফস্’ তথা নিজ একগুঁয়ে সত্তার মন্দ স্বভাব ও আচরণ পরিশুদ্ধ করতে শেখে; এই মন্দ দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে হিংসা, প্রতারণা, প্রদর্শনী, প্রশংসার মুখাপেক্ষিতা, অহঙ্কার, দম্ভ, রাগ, লোভ, কৃপণতা, ধনীর প্রতি সম্মান ও গরিবের প্রতি অবহেলা। প্রত্যেকের বহিরঙ্গের পবিত্রতা অর্জনের মতো এগুলো থেকেও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করা একান্ত আবশ্যক। ’তাসাউফ’-শাস্ত্র সবাইকে নিজের সত্তার দিকে লক্ষ্য করতে এবং পবিত্র কুরআন ও রাসূল (দ:)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী আত্মপরিশুদ্ধি অর্জন করতে শিক্ষা দেয়; আর নিখুঁত গুণাবলী (‘আস্ সিফাতুল কামেলাহ’) দ্বারা নিজ চরিত্রকে সুশোভিত করতেও শেখায়। এসব গুণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অনুশোচনা (‘তওবা’), খোদাতা’লা-সম্পর্কিত সচেতনতা (‘তাকওয়া’), সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা (‘এস্তেকামা’), সত্যবাদিতা  (‘সিদক’), নিষ্ঠা (‘এখলাস’), মন্দ পরিহার  (‘যুহদ’), পুতঃপবিত্রতা (‘ওয়ারা’), আল্লাহর প্রতি ভরসা (‘তাওয়াককুল’), খোদায়ী বিধির প্রতি সন্তুষ্টি (‘আর-রিদা’), আল্লাহর প্রতি সমর্পিত থাকা (‘আত্ তাসলীম’), শিষ্টাচার (‘আল-আদব’), প্রেম-ভালোবাসা (‘মোহাব্বাত’), স্মরণ (‘যিকর’), লক্ষ্য রাখা (‘মোরাকাবা’) এবং এ রকম আরও অনেক, অনেক গুণ যা সংখ্যাধিক্যের কারণে এখানে বিস্তারিত উল্লেখ করা যাচ্ছে না। 

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের এই জবাবনামার ভূমিকায় উল্লেখিত হাদীস-শাস্ত্রের যেমন ৩৫টি শ্রেণীবিন্যাস বিদ্যমান, তেমনি ‘তাসাউফ’-শাস্ত্রেরও অসংখ্য শ্রেণীবিন্যাস বিদ্যমান; যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত দুটো শ্রেণীকরণ - ‘এহসান’ অবস্থা অর্জন তথা উত্তম ‘মোহসিন’ কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ঈমানদারদের দ্বারা বাধ্যতামূলকভাবে গড়ে তোলা সৎ গুণাবলী (‘আখলাকান হাসানা’) এবং বাধ্যতামূলকভাবে বর্জনীয় মন্দ স্বভাব (‘আখলাক এয-যামীমা’)

এখানেই আমরা ‘তাসাউফ’-শাস্ত্রের গুরুত্ব ‍ও এর উপকারিতা বা সুফল দেখতে পাই। এটি আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট করে ইসলামের আত্মা তথা মর্ম ও প্রাণস্পন্দন (‘রুহ আল-ইসলাম ওয়া কালবাহু আন্ নাবিদ’)। দ্বীন ইসলাম শুধু কোনো বাহ্যিক অনুশীলনী নয়, বরং এর একটি অন্তঃস্থিত জীবন বিরাজমান; যেমনটি আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন:

“পাপের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন দিকগুলো পরিত্যাগ করো।”

আল্লাহতা’লা আল-কুরআনে আরও এরশাদ ফরমান: “মুসলমানদের মধ্যে কিছু এমন পুরুষ রয়েছেন, যাঁরা সত্য প্রমাণ করেছেন যে-ই অঙ্গীকার তাঁরা আল্লাহর সাথে করেছিলেন।” [সূরা আহযাব, ২৩ নং আয়াত]

লক্ষণীয় যে, সকল ঈমানদার কিন্তু ‘খোদাতা’লার সাথে অঙ্গীকার পূরণকারী’ এই মনোনীত দলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নন। এর মানে হলো, কোনো মুসলমান ঈমানদার হতে পারেন, কিন্তু ‘আন্ নাফস্ আয্ যাকিয়্যা’ তথা আত্মপরিশুদ্ধি এবং মহানবী (দ:) কর্তৃক হাদীসে উল্লেখিত ‘এহসান’ অবস্থা অর্জন না করা পর্যন্ত তিনি ওই ‘আল্লাহর সাথে ওয়াদা পূরণকারী’দের দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। ইতিপূর্বে আমরা যে কথা বারবার বলেছি, এটি-ই পরবর্তীকালে ‘তাসাউফ’-বিদ্যা নামে সুপরিচিত হয়ে যায়। 
  
‘তাসাউফ’ শব্দটি সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া যা বলে -  

ইবনে তাইমিয়্যা ‘তাসাউফের’ সংজ্ঞা দিতে গিয়ে যা বলেছে, তা উদ্ধৃত করার অনুমতি এবার আপনারা আমাদের দিন। ইবনে তাইমিয়া বলে:
  
“আল-হামদু লিল্লাহ! ‘তাসাউফ’ শব্দটির উচ্চারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কেবল ইমামমণ্ডলী ও মাশায়েখবৃন্দ-ই কথা বলেননি, বরং এতে আরও অন্তর্ভুক্ত আছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:), শায়খ আবূ সোলাইমান দারানী (রহ:), সর্ব-হযরত সিররী সাকাতী (রহ:), জুনায়দ বাগদাদী (রহ:), মারুফ কারখী (রহ:), আবদুল কাদের জিলানী (রহ:), বায়েযীদ বোস্তামী (রহ:) এবং আরও অনেকে। এটি এমন-ই এক শব্দ/পদ যা ওই জ্ঞানের শাখা [‘তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্ এবং এহসান’] নিয়ে ব্যাপৃত মনীষীবৃন্দকে দেয়া হয়েছিল। আর এটি তেমন-ই একটি শব্দ যখন কেউ এভাবে বলে, ‘কোরায়শী পরিবার হতে’; কিংবা বলে, ‘মাদানী জনগোষ্ঠী হতে’; অথবা বলে, ‘হাশেমী পরিবার হতে’। এটি একটি পরম্পরা (‘নসব’) যেমনটি আমরা মহানবী (দ:)-এর উত্তরসূরীদের বেলায় বলি হাশেমী, কিম্বা তাঁর গোত্র সম্পর্কে বলি কোরায়শী, অথবা তাঁর শহরের অধিবাসীদের বলি মাদানী; ঠিক তেমনি ওই বিদ্যার সাথে সম্পর্কিত (মহা)-জ্ঞানীদের সম্পর্ক (‘নিসবাতান’) ইঙ্গিত করার জন্যেই তাঁদেরকে আমরা সূফী বলে থাকি।”

ইবনে তাইমিয়্যা আরও বলে: “সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামা (‘জামহূর আল-উলামা’) এই বিদ্যাকে অস্বীকার করেননি, যেহেতু এটি শরীয়ত ও সুন্নাহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত; আর তাঁরা এটিকে সমর্থন-ও করেছেন।”  

ইবনে তাইমিয়্যা এরপর বলে: “তাসাউফের রয়েছে বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার বিভিন্ন অবস্থা যা সূফীবৃন্দ তাঁদের বিদ্যাশাস্ত্রে আলোচনা করেন। এর কিছুটা হলো এই যে, সূফী/বোযর্গ তিনি-ই যিনি নিজেকে সেসব বিষয় থেকে পরিশুদ্ধ করেন যেগুলো তাঁকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং যিনি অন্তরের জ্ঞান (মানে আধ্যাত্মিকতা) ও মস্তিষ্কের জ্ঞান দ্বারা এমন-ই পরিপূর্ণ যে তাঁর কাছে স্বর্ণ ও পাথরের মূল্য একই। আর ‘তাসাউফ’ মূল্যবান অর্থগুলোকে সুরক্ষিত রাখে এবং যশ-খ্যাতির মোহ ও আত্মশ্লাঘা পরিত্যাগ করে যাতে সত্যবাদিতার পর্যায়ে পৌঁছানো যায়; কেননা আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর পরে মনুষ্যকুল-সেরা হলেন সিদ্দিকীন, যেমনটি মহান আল্লাহ পাক নিচের আয়াতে করীমায় এরশাদ ফরমান: 
  
‘এবং যে (ব্যক্তি) আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মানে, তবে সে তাঁদেরই সঙ্গ লাভ করবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ, আম্বিয়া (আ:), সিদ্দীকবৃন্দ (সত্যনিষ্ঠ বান্দাগণ), শহীদান এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তিবৃন্দ। এঁরা কতোই উত্তম সঙ্গি!” [সূরা নিসা, ৬৯-৭০ আয়াত, মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘নূরুল এরফান’] 

ইবনে তাইমিয়্যা আরও বলে, “আর বাস্তবিকভাবে সূফী হলেন এক ধরনের সিদ্দীক (সত্যপন্থী), যিনি যুহদ ও এবাদত-বন্দেগীতে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন।”

ইবনে তাইমিয়্যা আরও বলে, “কিছু লোক সূফিয়্যা ও ‘তাসাউফের’ সমালোচনা করেছে এই বলে যে তাঁরা বেদআতী; নবী (দ:)-এর সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত। কিন্তু সত্য হলো, তাঁরা আল্লাহতা’লার আনুগত্যে (‘মোজতাহিদীন ফী তা’আতিল্লাহ’) সাধনারত, ঠিক যেমনিভাবে অন্যান্য আল্লাহ-ওয়ালা আল্লাহর আনুগত্যে ছিলেন সাধনারত। অতএব, তাঁদের মধ্য হতে নিজ সাধনাবলে (‘আস্ সাবিকুল মোকাররাব বি হাসাবে এজতেহাদিহী’) খোদায়ী নৈকট্যে সর্বাধিক অগ্রসর জনের দেখা আপনারা পাবেন। আর তাঁদের কেউ কেউ ডান হাতের দিকের মানুষ [সূরা ওয়াকে’য়াহ-তে বর্ণিত ‘আহলুল এয়ামীন’], তবে (অাধ্যাত্মিক) উন্নতিতে অপেক্ষাকৃত ধীরগতিসম্পন্ন। উভয় শ্রেণীর বেলাতেই তাঁরা হয়তো এজতেহাদ প্রয়োগ করতে পারেন; তবে সেক্ষেত্রে তাঁরা সঠিকও হতে পারেন, আবার ভুলও করতে পারেন। আর উভয় শ্রেণীর পুণ্যাত্মা-ই কোনো না কোনো (এজতেহাদী) ভুল করতে পারেন এবং তওবা-ও করতে পারেন। আর এটি-ই হলো তাসাউফের উৎস। এই উৎসের পরে এটি প্রসার লাভ করেছে এবং এর কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা (‘তাশা’আবাত ওয়া তানাওয়া’আত’) রয়েছে। এতে রয়েছে তিন কিসিম:

১/ - ‘সূফিয়্যাত-ইল-হাকায়েক’, মানে প্রকৃত সূফী
২/ -  ‘সূফিয়্যাত-ইল-আরযাক’, মানে পেশাদার সূফী (ব্যক্তিগত স্বার্থান্বেষী সূফী)
৩/ - ‘সূফিয়্যাত-ইল-রসম’, মানে বাহ্যিক আবরণে সূফী।”

আবদুল্লাহ বিন মোহাম্মদ বিন আব্দিল ওয়াহহাব ‘তাসাউফ’ সম্পর্কে যা বলে - 

আমরা এখানে আপনাদের খেদমতে মোহাম্মদ মানযূর নোমানীর প্রণীত ‘আদ্ দিয়া’আত মোকাশাফা দি’দ আশ্ শায়খ মোহাম্মদ বিন আব্দ আল-ওয়াহহাব’ শীর্ষক পুস্তকের ৮৫ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ চিঠির উদ্ধৃতি দেবো, যেখানে বলা হয়, “শায়খ মোহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের পুত্র আব্দুল্লাহ ‘তাসাউফ’ সম্পর্কে বলে: ‘আমি ও অামার পিতা সূফীতাত্ত্বিক জ্ঞান তথা তাসাউফ বিদ্যাশাস্ত্রকে অস্বীকার করি না, এর সমালোচনাও করি না, বরঞ্চ উল্টো একে সমর্থন করি। কেননা, এই জ্ঞান (আমাদের) যাহের (বাহ্যিক দিক)-কে সাফ করে এবং বাতেন (অভ্যন্তরীন দিক)-কে অপ্রকাশ্য গুনাহ থেকে পরিশুদ্ধ করে; আর এগুলো অন্তর ও শিরা-উপশিরা এবং বাহ্যিক আকৃতির সাথে সম্পৃক্ত; যদিও কোনো ব্যক্তি বাহ্যতঃ সঠিক পথে থাকে, তবুও সে হয়তো ভেতরে (মানে অন্তরে) ভুল পথের পথিক হতে পারে। আর এ কারণেই তাসাউফের প্রয়োজন। কিন্তু আমরা আশা করি না এবং পছন্দ-ও করি না কেউ কেউ ‘তাসাউফের’ নাম ব্যবহার করে অচেতন অবস্থায় কথা বলুক।” 

আমরা এখানেই ক্ষান্ত দিতে চাই। কেননা, এই বর্ণনা আমাদের পাঠকদের জন্যে অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে, আর আমাদের হাতে সময়ও সীমিত। আমরা যেহেতু বলেছিলাম আমাদের ব্যাখ্যা দিতে সময় দরকার, সেহেতু কিছু মানুষ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করেন। উপরন্তু, এ বিষয়ে যা বলা যেতো, সমুদ্রের এক বিন্দু পরিমাণ-ই কেবল আমরা এখানে বলেছি। তাও আবার প্রথম প্রশ্নের উত্তরেই তা বলা হয়েছে! 

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর   

আপনি (শায়খ আদলী) প্রথম প্রশ্নে দেখেছেন আমরা সংক্ষেপে তার উত্তর দিয়েছি। আর আপনি সযত্নে আমাদের প্রথম উত্তরটি পড়লে দেখতে পাবেন যে আমরা আপনার অন্য পাঁচটি প্রশ্নের উত্তরও সেখানে ইতোমধ্যেই দিয়ে ফেলেছি। 

আপনি প্রশ্ন করেছিলেন:

২/ - তাসাউফ সম্পর্কে আল-কুরঅানে কোনো প্রামাণ্য দলিল আছে কি? যদি থাকে, তবে অনুগ্রহ করে খোলাসা করবেন কি?

আল্লাহতা’লা ‘তাযকিয়্যাত আন্ নাফস’কে মহানবী (দ:)-এর একটি কর্তব্য বলে বর্ণনা করেন  

আমরা ইতিপূর্বে যেমনটি বলেছি, আল-কুরআনে এ বিষয়ের দলিল নিম্নরূপ:
  
“তিনি-ই, যিনি উম্মী (মক্কাবাসী) লোকদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেন যেন তাদের কাছে তাঁর (খোদার) আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন (ওয়া ইউযাক্কীহিম) এবং তাদেরকে কেতাব ও হেকমতের জ্ঞান দান করেন; আর অবশ্যঅবশ্য তারা ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলো।” [সূরা জুমু’আ, ২ নং আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’] 
  
‘ওয়া ইউযাক্কীহিম’ বাক্যটি আমরা ওপরে ব্যাখ্যা করেছি এবং ইতিপূর্বেকার ভূমিকায়ও আলোকপাত করেছি। 

আল্লাহ পাক অন্যত্র এরশাদ ফরমান:
  
“এবং (শপথ) আত্মার এবং তাঁরই যিনি তাকে সুঠাম করেছেন; অতঃপর তার অসৎকর্ম ও তার খোদাভীরুতা অন্তরে জাগিয়ে দিয়েছেন; নিশ্চয় লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছে (সে-ই), যে (ব্যক্তি) সেটিকে পবিত্র করেছে; এবং নিরাশ হয়েছে সে, যে (ব্যক্তি) সেটিকে পাপের মধ্যে আচ্ছন্ন করেছে।” [সূরা শামস্, আয়াত নং ৭-১০]  

আমরা এখানে আল-কুরআনের এমন একখানি আয়াত দেখতে পাই, যা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে সফল হবার জন্যে নফস্ (কুপ্রবৃত্তি)-কে পরিশুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি তাকিদ দেয়।

আল্লাহ পাক ঈমানদারদেরকে ‘সাদেকীন’বৃন্দের সাথী হতে আদেশ করেন

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

“হে ঈমানদার মুসলমানবর্গ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সাদেকীন তথা সত্যবাদীদের সাথে থাকো।” [সূরা তওবা, ১১৯ নং আয়াত] 

এখানে উল্লেখিত ‘সাদেকীন’-বৃন্দ হচ্ছেন সেসব পুণ্যাত্মা, যাঁদেরকে ওপরে প্রদত্ত ইবনে তাইমিয়্যার উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আল্লাহতা’লার প্রিয়ভাজন ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ‘সাদেকীন’বৃন্দের সঙ্গি হওয়া এবং তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতীয়মানকারী ওপরোক্ত আয়াতে করীমাটি হচ্ছে এতদসংক্রান্ত একটি দলিল। এই ‘সাদেকীন’বৃন্দ হলেন সর্বোচ্চ স্তরের আউলিয়া, যাঁদের সম্পর্কে আল-কুরআনে এরশাদ হয়েছে:

“শোনো! নিশ্চয় আল্লাহর আউলিয়া (বন্ধু)-দের না কোনো ভয় অাছে, না কোনো দুঃখ।” [সূরা ইউনূস, ৬২ আয়াত]   

সাদেকীনবৃন্দ হলেন সে সকল পুণ্যাত্মা যাঁরা ঈমানদারিতে সর্বোচ্চ মকাম তথা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে আরও বলা হয়েছে:

“মুসলমানদের মধ্যে কিছু এমন পুরুষ রয়েছেন, যাঁরা সত্য প্রমাণিত করেছেন যে-ই অঙ্গীকার তাঁরা আল্লাহর সাথে করেছিলেন; সুতরাং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপন মান্নত পূর্ণ করেছেন, এবং কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন। আর তাঁরা সামান্যটুকু-ও পরিবর্তিত হননি।” [সূরা আহযা-ব, ২৩ নং আয়াত; প্রাগুক্ত ‘নূরুল এরফান’]

এ আয়াতে বোঝা যায় যে প্রতিটি যুগেই এমন কিছু পুণ্যাত্মা থাকবেন যাঁরা আল্লাহর ওয়াদা পূরণে হবেন বদ্ধ পরিকর। 

আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি জ্ঞানপ্রাপ্ত একজন সম্পর্কে মহান প্রভু স্বয়ং যা বর্ণনা করেন -

হযরত মূসা নবী (আ:) যখন হযরত খিযির (আ:)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন, সেই ঘটনা বর্ণনাকারী কিছু আয়াতে করীমার উদ্ধৃতি আমরা এক্ষণে দেবো। আল্লাহতা’লা এটি প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেন:

“অতঃপর তারা আমার বান্দাদের থেকে একজন বান্দাকে পেলো, যাকে আমি আমার কাছ থেকে অনুগ্রহ দান করেছি এবং তাকে আপন ‘এলমে লাদুন্নী’ দান করেছি। তাকে মূসা বললো, ‘অামি কি তোমার সাথে থাকবো এ শর্তে যে তুমি আমাকে শিক্ষা দেবে ভাল কথা, যা তোমাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে?’ (ওই বান্দা) বললো, ‘আপনি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেন না’।” [সূরা কাহাফ, ৬৫-৬৭ নং আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান নঈমী আশরাফী কৃত তাফসীরে নূরুল এরফান]

ওপরে উল্লেখিত আয়াতগুলোতে পরিস্ফুট হয় যে হযরত মূসা (আ:) আল্লাহর নবী ও মহান প্রভুর সাথে একমাত্র সরাসরি কথপোকথনকারী (কালিমুল্লাহ) হওয়া সত্ত্বেও হযরত খিযির (আ:)-এর এমন জ্ঞান ছিল, যা মূসা (আ:)-এর ছিল না; আর তিনি হযরত খিযির (আ:)-এর কাছে সেই জ্ঞান অন্বেষণ করেছিলেন। কেননা হযরত খিযির (আ:) সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ওই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলেন (‘ওয়া আল্লামনা-হু মিল্ লাদুন্না ‘ইলমা’)। অধিকন্তু, তিনি ছিলেন আল্লাহর আউলিয়া (বন্ধু)-দের একজন, যেমনটি ওপরের আয়াতে করীমায় বর্ণিত হয়েছে। এসব আয়াত ও ওপরে উক্ত অন্যান্য আয়াত থেকে পরিভাষাগত ‘তাসাউফ’-শাস্ত্রে একজন ‘শায়খ আত্ তারবিয়্যা’ তথা পথপ্রদর্শককে অনুসরণের সমর্থনসূচক অনেক দলিলের একটি দলিল আমরা এখানে দেখতে পাই।

আল্লাহ পাক ‘মোসেনীন’-কে সঠিক পথপ্রদর্শনের ওয়াদা করেন    

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:
   
“আর যারা আমার পথে প্রচেষ্টা চালায়, অবশ্যই আমি তাদেরকে আপন রাস্তা দেখাবো; এবং নিশ্চয় আল্লাহ পাক মোহসেনীন তথা সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।” [সূরা আনকাবু-ত, ৬৯ নং অায়াত; প্রাগুক্ত ‘নূরুল এরফান’] 

অধিকাংশ মহান ইসলামী উলেমাবৃন্দ ‘তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্’ চর্চা করেছেন এবং ‘এহসান’ অবস্থা অর্জনে সাধনা করেছেন। তাঁদের দ্বারাই মধ্য এশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, বসনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, ইন্দো-চীন, স্পেন, পূর্ব ইউরোপ এবং আফ্রিকার বেশির ভাগ এলাকায় ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার হয়েছিল। ‘তাসাউফ’ চর্চাকারী এ সকল উলামা-এ-হক্কানী/রব্বানী নিজেদেরযুহদ’, ‘ওয়ারা’, ‘তাকওয়া’‘তাযকিয়্যা’ অবস্থা দ্বারা ওপরোক্ত রাজ্যগুলোতে ইসলামের মর্মবাণী পৌঁছে দেন; কেননা তাঁদের এই গুণগুলো তাঁদেরই সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের কাছে এতো আকর্ষণীয় ও আবেদনপূর্ণ ছিল যে সেসব মানুষ আপনাআপনি ইসলাম ধর্মের প্রতি ধাবিত হয়েছিলেন। 

আল্লাহতা’লা উলামাবৃন্দের অন্তরের কথা উল্লেখ করেন  

আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
   
“বরং ওটা সুস্পষ্ট নিদর্শন তাদের অন্তরের মধ্যে, যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে; এবং (কেউই) আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে না, কিন্তু অত্যাচারীরা (ব্যতিরেকে)।” [সূরা আনকাবু-ত, ৪৯ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]   

অন্যত্র তিনি এরশাদ ফরমান:
    
“আর তারই পথে চলো, যে আমার প্রতি প্রত্যাবর্তন করেছে।” [সূরা লোকমান, ১৫ অায়াত; ‘নূরুল এরফান’]   

আয়াতোল্লিখিত ‘পথ’টি হচ্ছে সেসব প্রিয় বান্দার যাঁরা আল্লাহকে ভালোবাসেন (ইউসূফ আলীর তাফসীর; ‘নূরুল এরফান’ তাফসীর পুস্তকে আউলিয়ার কথা লেখা হয়েছে)। এই হলো মহব্বতের অবস্থা যা আয়াতে করীমায় উল্লেখিত হয়েছে, আর সেটি অন্তরের সাথেই সম্পৃক্ত, মস্তিষ্কের সাথে সম্পৃক্ত নয়। 

আল্লাহ তাঁর নৈকট্য অন্বেষণের জন্যে মাধ্যম তালাশ করতে আদেশ করেন  

আল-কুরআনে এরশাদ হয়েছে:
   
“হে ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ! আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁরই দিকে মাধ্যম তালাশ করো এবং তাঁর পথে জ্বেহাদ করো এ আশায় যে সফলতা পেতে পারো।” [সূরা মায়েদা, ৩৫ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেবের ‘নূরুল এরফান’]

এই আয়াতের অর্থ হলো, কেউ সাফল্যমণ্ডিত হতে চাইলে আল্লাহর রাস্তায় সাধনা করতে হবে এবং নিজের নফস্ তথা একগুঁয়ে সত্তার খামখেয়ালিপনা বা বদ-খায়েশাতের গোলামি করা যাবে না। আর এতে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্যে মহানবী (দ:)-এর অসীলা অন্বেষণেরও তাকিদ রয়েছে। [অনুবাদকের নোট: রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর ‘ওয়ারিস’ হিসেবে উলামায়ে হাক্কানী/রাব্বানী তথা আউলিয়া কেরাম-ও আয়াতোক্ত অসীলা। ‘নূরুল এরফান’ তাফসীর পুস্তকে লেখা আছে, “এ থেকে বোঝা গেল যে মুসলমানদের আমল তথা ধর্ম অনুশীলনের সাথে সাথে নবী (আ:) ও ওলী (রহ:)-বৃন্দের অসীলা-ও তালাশ করা চাই। কেননা, আমলগুলোর কথা তো ‘এত্তাকুল্লাহ’ (আল্লাহকে ভয় করো) মর্মে আদেশের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর ‘অসীলা’ তালাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কথা বোঝা গেল যে ‘অসীলার’ পথেও প্রচেষ্টা চালানো চাই, যাতে অসীলা অর্জিত হয়।”]   

 আল্লাহতা’লা ‘তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্’ উল্লেখ করেন

আল্লাহ এরশাদ ফরমান:
    
“(হে আমাদের রব্ব! এবং তাদের মধ্যে তাদের থেকে ) একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি আপনারই আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করবেন এবং তাদেরকে আপনার কেতাব (আল-কুরঅান) ও পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেবেন; আর তাদেরকে অতি পবিত্র (তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্) করবেন।” [সূরা বাকারা, ১২৯]

 অন্যত্র এরশাদ ফরমান:
  
“যেমন আমি তোমাদের মাঝে প্রেরণ করেছি একজন রাসূল তোমাদেরই মধ্য হতে, যিনি তোমাদের প্রতি আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পবিত্র করেন (তাসাউফের জ্ঞান দ্বারা) এবং কেতাব (আল-কুরআন) ও পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেন।” [সূরা বাকারা, ১৫১]

আল্লাহ পাক অন্যত্র আরও এরশাদ ফরমান:
  
“নিশ্চয় লক্ষ্যে পৌঁছেছে সে-ই, যে ব্যক্তি পবিত্র (তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্) হয়েছে; আর আপন রব্বের নাম নিয়ে নামায পড়েছে।” [সূরা আল-আ’লা, ১৪-১৫ আয়াত; ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ পুস্তকে অন্তরের পবিত্রতা দ্বারা আদায়কৃত সালাত আউলিয়াদের বলে উল্লেখ করা হয়েছে]  

ওপরের আয়াতে করীমায় সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা ‘মোতাসাউয়ীফ’বৃন্দের বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করেছেন। এঁরা  নিজেদেরকে পবিত্রকরণে সাধনারত; আর সর্বদা আপন খোদাতা’লার নাম ও সিফাতের যিকিরে ব্যস্ত; আর নিজেদের নামায আদায়েও মনোযোগী। 

আল্লাহতা’লা আরও এরশাদ ফরমান:
  
“এবং যে ব্যক্তি পবিত্র (তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্) হয়েছে, তবে সে নিজেরই কল্যাণার্থে পবিত্র হয়েছে; আর আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” [সূরা ফা-তির, ১৮ নং আয়াত; ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]  

আমরা এখানে দেখতে পাই আত্মপরিশুদ্ধিমূলক বিদ্যাশাস্ত্র ‘তাসাউফ’-এর সুগভীর নির্যাস। এক্ষণে আমাদের পাঠকদের আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এটি কেবল একটি পারিভাষিক শব্দ, যেটির স্থলে অন্য যে কোনো শব্দ-ও ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি-ই ইসলাম। ইসলাম ধর্ম অনুসরণের বা অনুশীলনের দাবিদার যে কাউকেই আত্মপরিশুদ্ধির এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে, যেহেতু ওপরে উল্লেখিত আয়াতগুলোতে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। নিশ্চয় এই আত্মপরিশুদ্ধির সাধনা ব্যতিরেকে বিন্দু পরিমাণ ইসলামের (আল্লাহর প্রতি সমর্পণের) দাবি করাটা একেবারেই অনর্থক হবে। এই সাধনায় কেউ সফল হলো কি হলো না, তা এখানে প্রশ্ন নয়, বরং এটি যে প্রত্যেক মুসলমান নর অথবা নারীর জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তা-ই এখানে বিবেচ্য বিষয়। 

আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
  
“এবং আপনি কি জানেন? হয়তো সে পবিত্র (তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্) হতো, কিংবা সে উপদেশ গ্রহণ করতো, অতঃপর তাকে উপদেশ উপকৃত করতো।” [সূরা আবাসা, ৩/৪ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]

তিনি অারও এরশাদ ফরমান:
  
“অতঃপর আমরা চাইলাম যে তাদের উভয়ের রব্ব তার চেয়ে উত্তম, পবিত্র (‘যাকা’তান’) এবং তার চেয়ে দয়ার মধ্যে অধিক নিকটতর (সন্তান) দান করবেন।” [সূরা কাহফ, ৮১ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]  

উপরন্তু, তিনি আরও এরশাদ ফরমান:

“(জিবরীল) বল্লো, ‘আমি তো তোমার রব্বের প্রেরিত, অামি তোমাকে এক পবিত্র পুত্র (সন্তান) প্রদান করবো।” [সূরা মরিয়ম, ১৯ নং আয়াত; ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’] বি: দ্র: এখানে ‘যাকিয়্যা’ শব্দটি আবারও ব্যবহৃত হয়েছে হযরত ঈসা (আ:)-কে উদ্দেশ্য করে।

আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:

“হে মাহবূব! তাদের (মো’মেন বান্দাদের) সম্পদ থেকে যাকাত সংগ্রহ করুন, যা দ্বারা আপনি তাদেরকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র (তাযকিয়্যা-এ-নফস্) করবেন এবং তাদের জন্যে মঙ্গল প্রার্থনা (দোয়া) করুন; নিশ্চয় আপনার দোয়া তাদের অন্তরগুলোর প্রশান্তি।” [সূরা তাওবা, ১০৩ আয়াত]

তিনি আরও এরশাদ ফরমান:
  
“আর যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া তোমাদের প্রতি না থাকতো, তবে তোমাদের মধ্যে কেউই কখনো পবিত্র হতে পারতে না। হ্যাঁ, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পবিত্র (তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্) করে দেন এবং আল্লাহ শোনেন, জানেন।” [সূরা নূর, ২১ নং আয়াত; ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]  

আত্মপরিশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বর্ণনাকারী কতিপয় আয়াতে করীমা ওপরে উদ্ধৃত হয়েছে। আর আত্মপরিশুদ্ধি তথা ‘তাযকিয়্যাত আন্ নাফস’ হচ্ছে ‘তাসাউফ’-শাস্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। 
  
‘তাযকিয়্যা’ শব্দের অভিধানিক অর্থ 

আমরা অভিধানে ‘তাযকিয়্যা’ শব্দটির অর্থ খুঁজে দেখলে এর সকল অর্থে ‘যাকা’ মানে ‘পবিত্র ছিল’, ‘ইউযাক্কী’ মানে ‘পবিত্রকরণ’ ও ‘পরিচ্ছন্ন করা’; এছাড়াও ‘যাকা’ মানে ‘পবিত্রকৃত’। ‘তাযকিয়্যা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘পরিচ্ছন্ন করা বা পবিত্রকরণ’ হিসেবে। ‘ইউযাক্কী’ মানে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্রকৃত।
  
‘যাকা’তুন’ শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে - “একটি ইসলামী কর-ব্যবস্থা যেটি গরিবদের প্রাপ্য; যেটি গরিবদেরই উদ্দেশ্যে দান-সদকাহ বটে।” কিন্তু এসব শব্দের কোনোটি-ই পরিপূর্ণ অর্থজ্ঞাপক নয়। তাই ‘পবিত্রতা’ ও ‘পুণ্যময় ধার্মিকতা’ শব্দগুলোই এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত।
  
‘আযকা’য়া’ শব্দটির অনুবাদ হচ্ছে ‘সবচেয়ে পবিত্র, নির্মল।’ ‘যাকিয়্যাতান্’ মানে ‘নির্মল’, ‘নির্দোষ’।

ওপরের সংজ্ঞাগুলো লিপিবদ্ধ আছে ‘পবিত্র কুরআনের অভিধান’ শীর্ষক বইয়ের ২৪৩ পৃষ্ঠায়। 
  
‘এহসান’ - পূর্ণতাপ্রাপ্ত চারিত্রিক অবস্থাসম্পর্কিত কুরআনের আয়াত

আমরা ওপরে ‘তাযকিয়্যাত আন্ নাফস্’ তথা আত্মপরিশুদ্ধিমূলক বিদ্যাশাস্ত্র সম্পর্কে অনেকগুলো আয়াতে করীমা উপস্থাপন করেছি। এক্ষণে আমরা ‘এহসান’ তথা পূর্ণতাপ্রাপ্ত চারিত্রিক অবস্থাবিষয়ক কিছু আয়াতে করীমা পেশ করতে ইচ্ছুক। আমরা কিন্তু ‘উম্মুল হাদীস’ আল-বোখারী গ্রন্থে বর্ণিত হযরত জিবরীল (অা:)-এর প্রশ্নসম্বলিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এতদসংক্রান্ত হাদীসটি এখনো উদ্ধৃত করিনি। ‘এহসান’ পবিত্র কুরআন মজীদের অনেক স্থানে উল্লেখিত হয়েছে, যেগুলো আমরা নিচে পেশ করছি। আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
  
“নিশ্চয় আল্লাহর দয়া মোহসেনীন (এহসান-কারী)বা সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।” [সূরা আ’রাফ, ৫৬ অায়াত; ‘নূরুল এরফান’]  
  
এবং

“নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে আছেন, যারা (তাঁকে) ভয় করে এবং এহসান তথা সৎকর্ম করে।” [সূরা নাহল, ১২৮ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’] 

এবং
    
“এহসান তথা উত্তম কাজের প্রতিদান কী? শুধু উত্তম কাজ-ই।” [সূরা আর-রাহমা-ন, ৬০ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]

এবং 
   
“অার (তিনি) মোহসেনীন তথা সৎকর্মপরায়ণদেরকে অত্যন্ত উত্তম প্রতিদান দেন।” [সূরা নজম, ৩১ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]  

এবং জুমুআ’র খোতবায় পঠিত আমাদের মুখস্থ করা আয়াতে করীমা -
  
“নিশ্চয় আল্লাহ নির্দেশ দেন ন্যায়বিচার, পুণ্য (এহসান) ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার এবং নিষেধ করেন অশ্লীলতা, মন্দ কথা ও অবাধ্যতা থেকে; তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা ধ্যান করো।” [সূরা নাহল, ৯০ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]   

এবং
   
“হ্যাঁ, কেন (এমন) নয়? যে ব্যক্তি আপন চেহারা ঝুঁকিয়েছে আল্লাহর জন্যে এবং সে হয় মোহসেনীন তথা সৎকর্মপরায়ণ, তবে তার প্রতিদান তার রব্বের কাছে রয়েছে এবং তাদের না আছে কোনো শঙ্কা, আর না আছে কোনো দুঃখ।” [সূরা বাক্কারা, ১১২ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]  

এবং

“আর যে কেউ আপন মুখমণ্ডলকে আল্লাহর দিকে অবনত করে এবং হয় এহসান-কারী তথা সৎকর্মপরায়ণ, তবে সে নিশ্চয় এক মজবুত গ্রন্থি দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছে এবং আল্লাহরই দিকে হচ্ছে সব কাজের শেষ পরিণতি।” [সূরা লোকমান, ২২ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]

এবং
  
“আর ওই ব্যক্তি অপেক্ষা কার দ্বীন উত্তম, যে আপন চেহারা আল্লাহর জন্যে ঝুঁকিয়েছে এবং সে হয় মোহসিন তথা সৎকর্মপরায়ণ।” [সূরা নিসা, ১২৫ আয়াত; ‘নূরুল এরফান’]  

‘এহসান’ ও তা হতে উৎপন্ন শব্দাবলীর আভিধানিক অর্থ   
  
‘এহসান’ অবস্থা সম্পর্কে আল-কুরআনের এতো অগণিত আয়াতে করীমা বিদ্যমান যে আমরা যা উদ্ধৃত করেছি, তা-ই যথেষ্ট হবে। সামনে আমরা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যে হাদীস উদ্ধৃত করতে যাচ্ছি তাতে তাঁর ব্যাখ্যাকৃত ‘এহসানের’ প্রকৃত অর্থ হচ্ছে এমন পন্থায় আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করা যার দরুন ওই এবাদতের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন উভয় দিকের বাস্তবতাকে পূর্ণতা দিতেই আপনি সাধনারত এবং সাফল্যমণ্ডিত হন। এ রকম একটি উদাহরণ হলো বিনয় ও সমর্পিত হয়ে (‘খুযু’ ও ‘খুশু’) সালাত বা নামায আদায়, (এমন প্রত্যয়ে) যেন আপনি আল্লাহতা’লাকে দেখছেন এবং তিনি যে আপনাকে দেখছেন সে সম্পর্কেও আপনি ওয়াকেফহাল আছেন। 

অভিধানে আমরা দেখতে পাই (আরবী) ‘এহসান’ শব্দটি ও তা হতে উৎপন্ন শব্দাবলীর বহু অর্থ বিদ্যমান। সেগুলো নিম্নরূপ: ‘হাসুনা’, মানে ‘উত্তম হওয়া’, ‘ভাল করা’, ‘ভাল মনে হওয়া’, ‘সুন্দর হওয়া’ [ এর মানে সৎ গুণাবলী দ্বারা নিজেকে সুশোভিত করা, বাহ্যিক (জিসমানী) ও অভ্যন্তরীন (রুহানী) উভয় দিককেই উন্নত করা]। এ ছাড়াও অন্যান্য উৎপন্ন শব্দ হলো:
  
‘এহসানান’, যার মানে ‘উত্তম (কর্ম) করা’; 
‘আহসানু’, মানে ‘তারা উত্তম (কর্ম) করেছে’; 
‘আহসানতুম’, মানে ‘তোমরা উত্তম (কর্ম) করেছো’;   
‘আহসিন’, মানে ‘তুমি উত্তম (কর্ম) করো!’
‘আহসিনূ’, মানে ‘তোমরা উত্তম (কর্ম) করো!’
‘এহসা’নুন’, মানে ‘দয়া’; 
‘হুসনা’, মানে ‘পুরস্কার’;  
‘হিসানূন’, মানে ‘সুন্দর ব্যক্তিবৃন্দ’।

আমরা এখানে বিভিন্ন অর্থ পাচ্ছি। এটি যখন সিফাত (বিশেষণ) হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর মানে দাঁড়ায় দয়া এবং একটি অভ্যন্তরীন (অন্তরের) মনোভাব ও আত্মসম্বরণ।

অতএব, আল-কুরআনে উল্লেখিত ‘এহসান’ একটি অতি উচ্চ অবস্থা, যাকে হযরত জিবরীল আমীন (আ:) দ্বীনের অন্তর্নিহিত অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং যাকে তিনি ইসলাম ও ঈমান অবস্থাগুলোর সমপর্যায়েই স্থাপন করেছেন। দ্বীন/ধর্ম তিনটি অবস্থার সমষ্টি: ইসলাম, ঈমানএহসান; এগুলোর প্রতিটিরই নিজ নিজ পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা রয়েছে। এ কারণেই কুরআন মজীদের এতোগুলো স্থানে ‘এহসান’ শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে এবং মহানবী (দ:)-ও হযরত জিবরীল (আ:) কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হওয়ার পরে ইসলাম ও ঈমানের মতোই সমান গুরুত্ব এটিকে দিয়েছেন।
  
এটি-ই হলো‘তাসাউফ’ বিদ্যাশাস্ত্রের সারমর্ম। আপনার পছন্দ না হলে শব্দটি পরিবর্তন করতে পারেন, কিন্তু আমরা এ শব্দটি পছন্দ করি; কেননা এটি সর্বজনবিদিত ও বহুল প্রচলিত। আরবীতে আমরা বলি “মোস্তালাহহাত লা তালগি আল-আহকাম ওয়াল হাকায়েক”, যার অর্থ “কোনো বিষয়ের মৌলিক প্রকৃতি বা বাস্তবতা শব্দাবলী পরিবর্তন সাধন করে না।” আরেক কথায়, “গোলাপ ফুলকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা সুগন্ধ ছড়াবেই।” 

আমরা এভাবে আরও অনেক আয়াতে করীমা উদ্ধৃত করতে পারি, কিন্তু যেহেতু এই জবাবকে আমরা দীর্ঘ করতে চাই না সেহেতু এক্ষণে আমরা ক্ষান্ত দেবো। হয়তো পরবর্তী কোনো সময়ে এ বিষয়ে আরও আলোকপাত করা যাবে। 

তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর 
  
‘তাসাউফ’ সম্পর্কে হাদীসের দলিলগুলো কী কী?  

আমাদের সম্মানিত দ্বীনী ভাই শায়খ মোহাম্মদ আদলীর তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল:

৩/ - ‘তাসাউফ’ ও তার অনুশীলনের পক্ষে মহানবী (দ:)-এর আহাদীস হতে কোনো দলিল-আদিল্লা আছে কি? থাকলে অনুগ্রহ করে সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করুন এবং বিস্তারিত বিবরণ দিন।

জবাবে আমরা বলি:

হ্যাঁ, অবশ্যই সন্দেহাতীতভাবে ‘তাসাউফ’-শাস্ত্র ও তার অনুশীলনের পক্ষে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাহ’তে প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান। ইতিপূর্বে আমরা যা বলেছি, ‘তাসাউফ’ হলো একটি পারিভাষিক শব্দ, যার উৎস প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবগুলোতে আমাদেরই উদ্ধৃত বিভিন্ন অর্থে নিহিত। মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ’র গভীরেও এর শেকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। আর এর উৎস হচ্ছে ‘এহসান’ তথা পূর্ণতাপ্রাপ্ত অবস্থা, যা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাহ’তে, অর্থাৎ, হাদীসে জিবরীল (আ:) নামে খ্যাত হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে; এই হাদীস উলেমাবৃন্দের কাছে ‘উম্মুস্ সুন্নাহ’ (সুন্নাহ’র উৎস) ও ‘উম্মুল আহাদীস’ (হাদীসের উৎস) হিসেবে পরিচিত। সকল হাদীসের উৎপত্তিস্থল এই হাদীসকেই বিবেচনা করা হয়। ইসলাম ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম, আর তাই এর কোনো অতিরিক্ত সমর্থন প্রয়োজন নেই।

উম্মূল আহাদীস: হাদীস-এ-জিবরীল  

হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, “একদিন আমরা নবী করীম (দ:)-এর খেদমতে হাজির ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন, যাঁর কাপড় ধবধবে সাদা ও চুল গাঢ় কালো ছিল। তাঁর মধ্যে সফরের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছিলো না এবং আমাদের কেউ তাঁকে চিনতেও পারছিলাম না। অবশেষে তিনি হুযূর পাক (দ:)-এর কাছে গিয়ে বসলেন এবং নিজের হাঁটুযুগল রাসূল (দ:)-এর বরকতময় হাঁটুযুগলের সাথে লাগিয়ে দিলেন, অার নিজ হাত নিজ উরুর ওপর রাখলেন। অতঃপর (তিনি) আরয করলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।’ জবাবে নবী করীম (দ:) এরশাদ করলেন, ‘ইসলাম এই যে তুমি এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ (উপাস্য) নেই এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহর (প্রেরিত) রাসূল বা পয়গম্বর। অতঃপর নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযানের রোযা রাখবে, পবিত্র কা’বার হজ্জ্ব করবে, যদি সেখানে পৌঁছুতে পারো।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ আমরা তাঁর ব্যাপারে আশ্চর্যান্বিত হলাম এ কারণে যে তিনি হুযূর পূর নূর (দ:)-এর কাছে (প্রশ্ন) জিজ্ঞাসাও করেছেন এবং (এখন উত্তরের) সত্যায়নও করছেন। তিনি আবার আরয করলেন, ‘আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।’ হুযূর পাক (দ:) এরশাদ করলেন, ‘আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা-মণ্ডলী, (অাসমানী) কেতাবসমূহ, তাঁর রাসূলবৃন্দ এবং শেষ (বিচার) দিবসে বিশ্বাস করো। আর ভাল-মন্দ তাকদীরে বিশ্বাস করো।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ (তিনি) পুনরায় আরয করলেন, ‘আমাকে এহসান সম্পর্কে বলুন।’ মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমালেন, ‘অাল্লাহর এবাদত (আরাধনা) এভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে খেয়াল করো যে তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’ (ওই ব্যক্তি) আরয করলেন, ‘কেয়ামত সম্পর্কে সংবাদ দিন।’ রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ করলেন, ‘তুমি যাঁর কাছে জিজ্ঞেস করছো, তিনি কেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারীর চেয়ে অধিক অবগত নন।’ (প্রশ্নকর্তা আবার) আরয করলেন, ‘কেয়ামতের কিছু নিদর্শন সম্পর্কে বলুন।’ এবার হুযূর পাক (দ:) এরশাদ করলেন, ‘দাসী নিজ মালিককে প্রসব করবে, খালি পা, উলঙ্গ শরীরবিশিষ্ট দরিদ্র এবং মেষ-রাখালদেরকে বড় বড় দালানে গর্ব করতে দেখবে।’ (বর্ণনাকারী হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন) অতঃপর ওই প্রশ্নকারী ব্যক্তি চলে গেলেন। আমি সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাকে সম্বোধন করে এরশাদ ফরমালেন, ‘হে উমর! তুমি কি জানো এই প্রশ্নকারী কে?’ আমি আরয করলাম, ‘আল্লাহ ও (তাঁর) রাসূল (দ:)-ই ভাল জানেন।’ তিনি এরশাদ করলেন, ‘তিনি জিবরীল (আ:); তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন’।” [মূল: মুসলিম শরীফ; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘মিরআত শরহে মিশকাত’ ১ম খণ্ড, ’ঈমান পর্ব’ হতে সংগৃহীত; অনুবাদক: মওলানা এম, এ, মান্নান, চট্টগ্রাম] 

ওপরে বর্ণিত হাদীটিতে হযরত জিবরীল (আ:) দ্বীন তথা ধর্মকে কয়েকটি শ্রেণী বা প্রধান শাখায় ভাগ করেছেন, যেগুলো থেকে গোটা ধর্ম, আহাদীস ও সুন্নাহ প্রবাহিত হয়। অধিকন্তু, তিনি প্রত্যেকটি শাখা সম্পর্কে আলাদা আলাদা প্রশ্ন করে প্রতিটি শাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ‘ইসলাম কী?’ - তাঁর এ প্রশ্নের সাথে প্রথম শাখাটি সম্পৃক্ত। ‘ঈমান কী?’ - এ প্রশ্নের সাথে দ্বিতীয়টি সংশ্লিষ্ট। আর ‘এহসান কী?’ - প্রশ্নটির সাথে তৃতীয় শাখাটি সম্পর্কিত। আমরা বলতে পারি না যে ধর্ম শুধু ইসলাম, বা শুধু ঈমান, অথবা শুধু এহসান। আমরা বলি, এগুলোর প্রত্যেকটি-ই দ্বীনের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় বিষয়; কোনোটি-ই বাদ দেয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁর প্রদত্ত জবাবে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং হযরত জিবরীল (আ:) চলে যাওয়ার পর তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-কে বলেছেন, “জিবরীল (আ:) তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।”

হাদীস-এ-জিবরীল (আ:) থেকে আমরা দেখতে পাই যে তিনি (জিবরীল) ধর্মকে তিনটি ভিত্তিস্তম্ভে তথা অত্যাবশ্যকীয় অংশে ভাগ করেছেন। প্রথমটি, অর্থাৎ, ইসলাম হচ্ছে ধর্মের ভিত্তিস্তম্ভ। দ্বিতীয়টি ঈমানের ভিত্তিস্তম্ভ। আর তৃতীয়টি এহসানের ভিত্তিস্তম্ভ। প্রথম স্তম্ভ দ্বীন-ইসলাম হচ্ছে ধর্মের ব্যবহারিক দিক, যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবাদত-বন্দেগী, আমল (অনুশীলন) এবং অন্যান্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। ওই স্তম্ভের অবস্থা হচ্ছে নিজ সত্তার বাহ্যিক দিক, যেটি শরীর ও সমাজের সাথে সম্পৃক্ত। উলেমাবৃন্দ ওই স্তম্ভকে শরীয়ত বলে আখ্যা দেন। এ শাখায় আলেম-উলেমা বিশেষায়িত শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং এটির নামকরণ হয় ফেকাহ-শাস্ত্র। দ্বিতীয় স্তম্ভটি হচ্ছে ঈমান যা মস্তিষ্ক ও অন্তরের দ্বারা বিশ্বাস স্থাপনের সাথে জড়িত। এর মানে আল্লাহ পাক, তাঁর রাসূল (আ:)-বৃন্দ, তাঁর আসমানী কেতাবসমূহ, ফেরেশতা-মণ্ডলী, শেষ (বিচার) দিবস, তাকদীর (ভাগ্য, নিয়তি) ইত্যাদিতে বিশ্বাস স্থাপন। এই জ্ঞানের শাখাটি উলেমাবৃন্দের কাছে ‘এলম আত্ তাওহিদ’ নামে সুপরিচিত।        

দ্বীন-ইসলামের তৃতীয় অংশ - ‘এহসান’ (চারিত্রিক পূর্ণতা)  

ধর্মের তৃতীয় দিকটি অন্তরের আধ্যাত্মিক অবস্থা হিসেবে জ্ঞাত, যা কাউকে ধর্মের প্রথম স্তম্ভ এবাদত-বন্দেগী ও দ্বিতীয় স্তম্ভ ঈমানদারীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের সময় এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলে যে তিনি আল্লাহতা’লার উপস্থিতিতে আছেন এবং খোদাকে নিজের সকল কর্মে ও চিন্তায় দেখতে পাচ্ছেন। আর যদি খোদাতা’লাকে দেখা না যায়, ইহ-জীবনে যেটি সম্ভব নয়, তাহলে এই সদা-সচেতনতা বজায় রাখা যে আল্লাহ পাক সবসময় আমাদের হৃদ-রাজ্যে উপস্থিত আছেন এবং তিনি আমাদের ঈমানদারী ও আমলের নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে খবর রাখেন, অর্থাৎ, তিনি আমাদের এবাদত ও আকীদা-বিশ্বাসের অবস্থা ও গুণাগুণ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল আছেন। এরই ফলশ্রুতিতে আপনার মধ্যে এক পূর্ণতাপ্রাপ্ত তথা উন্নতমানের অবস্থার সৃষ্টি হবে, যা নিজের ব্যাপারে আল্লাহতা’লার ঐশীদৃষ্টি সম্পর্কে নিজেকে সচেতন করে তুলবে এবং আল্লাহতা’লা তাঁর করুণাধারা ও ঐশী দানের মাধ্যমে আপনার অন্তরে যে আধ্যাত্মিকতার আলো বিচ্ছুরণ করবেন তারই আধ্যাত্মিক স্বাদ আপনি আস্বাদন করবেন। উলেমাবৃন্দ এই জ্ঞানের শাখাকে ‘এলম অাল-হাকীকত’ তথা সত্যের বিদ্যাশাস্ত্র নামে আখ্যা দেন; আর এটি মহানবী (দ:)-এর কাছাকাছি সময়ে এই নামেই পরিচিত ছিল; অধিকন্তু, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর সময়কালে এটি পরিচিত ছিল ‘আস্ সিদ্দিকিয়্যা’ বা সিদ্দীকবৃন্দের পথ নামে। পরবর্তীকালেই শুধু এটি ‘তাসাউফ’ নামে সুপরিচিত হয়। 

ওপরের আলোচনার সারসংক্ষেপ হিসেবে বলা যায়, ‘ইসলাম’ একজন মুসলমানের আচার-আচরণ নির্দেশ করে, ‘ঈমান’ তাঁর আকীদা-বিশ্বাসসংক্রান্ত এবং তা ব্যাখ্যা করে, আর ‘এহসান’ অন্তরের এমন অবস্থাকে নির্দেশ করে যেটি কারো জন্যে ‘ইসলাম’‘ঈমান’ ইহ ও পরকালীন জীবনে ফলদায়ক হবে কি না তা নির্ধারণ করে। ইতিপূর্বে উল্লেখিত একখানি হাদীসে এর পক্ষে প্রমাণ বিদ্যমান। মহানবী (দ:) ওই হাদীসে এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় (মানুষের) শরীরে এক টুকরো গোস্ত আছে, যেটি পবিত্র হলে সারা শরীর পবিত্রতা অর্জন করে; আর তা অপবিত্র হলে সারা শরীর অপবিত্রতা লাভ করে; নিশ্চয় শরীরের সে অংশটি হচ্ছে হৃদয় (অন্তর)।”  

অতএব, ‘উম্মুল আহাদীস’ নামে খ্যাত হাদীসে জিবরীল (আ:) হতে আমরা দেখতে পাই যে দ্বীন/ধর্ম তিনটি অবস্থার সমষ্টি: ইসলাম, ঈমান ও এহসান। প্রথম স্তম্ভ ‘ইসলাম” পাঁচটি অংশে বিভক্ত: ‘শাহাদা’, ‘সালাত’, ‘যাকাত’, ‘সওম’‘হজ্জ্ব’‘ঈমান’ বিভক্ত ছয়টি অংশে: ‘আল-ঈমানু বিল্লাহি’, ‘মালা’ইকাতিহী’, ‘কুতূবিহী’, ‘রুসূলিহী’, ‘এয়াওমুল আখির’ ‘কদর’‘এহসান’ অনেক অংশে বিভক্ত, যার মধ্যে রয়েছে কোনো ঈমানদার মুসলমানের সকল সৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী। এসব অংশে অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়: খোদা-সম্পর্কিত সচেতনতা (তাকওয়া); খোদা-ভীতি (ওয়ারা); (পাপ হতে) বিরত থাকা (যুহদ); শ্রদ্ধা ও বিনয় (খু’শু ও খুযু); ধৈর্য (সবর); সত্যবাদিতা (সিদক); খোদার ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল); নৈতিকতা ও সচ্চরিত্র (আদব) যা মহানবী (দ:) হাদীসে গুরুত্বারোপ করেন এই বলে, “আমার প্রভু আল্লাহতা’লা আমাকে আদব শিক্ষা দেন এবং তিনি আমার শিষ্টাচারে পূর্ণতা দিয়েছেন”; সহিষ্ণুতা বা তিতিক্ষা (হিলম); করুণা (রুহমা); মহত্ত্ব (করম); নিজেকে বিনয়ী করা (তাওয়াদা’আ); লজ্জা-শরম (হায়া); সাহস (শুজা’আ) এবং আরও অনেক গুণ যেগুলো দ্বারা আল্লাহ পাক রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে সুশোভিত করেন। 

মহানবী (দ:) সম্পর্কে হযরত মা আয়েশা (রা:) বলেন, “খুলূকুহুল কুরআন”, মানে হযূর পূর নূর (দ:)-এর চরিত্র হচ্ছে ‘মূর্তমান (বা জীবন্ত) কুরআন।’ অপর দিকে রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁর সেসব উন্নত নৈতিক গুণাবলী দ্বারা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে সুশোভিত করেন, যার দরুন মনুষ্যজাতি আপন স্রষ্টা ও নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক কী সম্পর্ক নিয়ে অস্তিত্বশীল থাকবে, তার এক সর্বাধিক পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত তাঁরা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আমরা পরবর্তী কোনো সময়ে ইমাম নববী (রহ:) কর্তৃক প্রদত্ত উম্মূল আহাদীস (জিবরীল)-এর ব্যাখা উদ্ধৃত করতে সচেষ্ট হবো; এটি আট পৃষ্ঠারও বেশি একখানা ব্যাখ্যা। তাতে তিনি ‘তাসাউফেরই’ শাখা ‘এলমুল মোশাহাদা’ (সাক্ষ্যসম্পর্কিত জ্ঞান) ও ‘এলমুল হাকীকা’ (বাস্তবতাবিষয়ক জ্ঞান)-এর আওতায় ‘এহসান’- বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তবে আমাদের হাতে এখানে তা উদ্ধৃত করার সময় বা স্থান এ মুহূর্তে নেই। 
  
‘এহসান’‘তাযকিয়্যা’-বিষয়ক বিদ্যাশাস্ত্র 

হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) যে (ধর্মীয়) বিদ্যা শিক্ষা করেন এবং (আধ্যাত্মিকতায়) দীক্ষা লাভ করেন, তা মহানবী (দ:)-এর বেসালের (পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তির) সাথে সাথে তিরোহিত হয়নি। বরঞ্চ রাসূলুল্লাহ (দ:) যে জ্ঞান ও হেকমত পদ্ধতি (মযহাব ও তরীকত) দ্বারা খোদায়ী আশীর্বাদধন্য হয়েছিলেন, তা তিনি তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর মাঝে ছড়িয়ে দেন; আর তাই তাঁদের প্রত্যেকেই ওই বিদ্যাশাস্ত্রের একেকটি আধারে পরিণত হন যা থেকে সমগ্র উম্মাহ তথা মুসলমান সমাজ জ্ঞান ও হেকমত শিক্ষাপদ্ধতি লাভ করেন। সময়ের পরিক্রমণে এসব শিক্ষাপদ্ধতি আরও উন্নত হয় এবং এগুলোর নিজস্ব নিয়মকানুন প্রণীত হয়। অধিকন্তু, এর দরুন ‘তাসাউফ’ নামের একটি স্বতন্ত্র বিদ্যাশাস্ত্রের উদ্ভব ঘটে। ইসলামের প্রথম তিন শতকে যেমন শরীয়তের মযহাবগুলোর উৎপত্তি হয়, ঠিক তেমনি ‘তাসাউফ’-শাস্ত্রের স্বতন্ত্র ও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ‘তরীকাহ’-গুলোও পরবর্তী মুসলিম প্রজন্মের কাছে এ বিদ্যাশাস্ত্রের জ্ঞান-প্রজ্ঞা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সেসময় গঠিত হয়। উপরন্তু, শরীয়ত যেমন ইসলাম, কুরআন ও সুন্নাহ’র কাঠামোর বাইরে গড়ে ওঠে নি, যদিও সেটির শাখা-প্রশাখা ও জ্ঞানের আওতাভুক্ত ছিল সেসব বিষয় যেগুলো ওপরোক্ত উৎসগুলোতে হুবহু উল্লেখিত ছিল না, তদ্রূপ ‘তাসাউফ’-শাস্ত্রও কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক কাঠামোর ওপর গড়ে ওঠে এবং তা কখনোই সেই কাঠামোর বাইরে যায়নি।
  
‘শরীয়াহ’ ‘হাকীকত’-এর পারস্পরিক সম্পর্ক
  
‘ফেকাহ’-শাস্ত্র নামে পরিচিত ‘শরীয়াহ’ ‘এহসান’ বা ‘তাসাউফ’ নামে জ্ঞাত বিদ্যাশাস্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে ওপরে যা বলেছি, তা ব্যাখ্যা করতে আমরা এখানে একটি উদাহরণ দেবো। নজির হিসেবে ‘সালাত’ তথা নামাযের কথাই ধরা যাক। ‘ফেকাহ’-শাস্ত্র মোতাবেক শরীয়তে উল্লেখিত শারীরিক নড়াচড়াসহ সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় শর্ত ও নিয়মকানুন মেনে নামায পড়া বাধ্যতামূলক। এটি ‘জাসাদ আস্ সালাত’ তথা নামাযের কাঠামো নামে খ্যাত। অপরদিকে, নামাযের একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো গোটা নামাযেই আল্লাহতা’লার ঐশী উপস্থিতি নিজ অন্তরে জারি রাখা এবং তিনি যে আপনাকে দেখছেন সে ব্যাপারে জানা। এর ফলশ্রুতিতেই আপনি নামাযের গূঢ়তত্ত্ব সম্পর্কে জানবেন এবং তার বাস্তবতার স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হবেন। আর আমরা নামাযের অনুশীলন থেকে এও জানতে পারি যে কেউ কেউ সেটির বাহ্যিক শর্তাবলী মেনে নামায পড়ে সত্য, কিন্তু তাদের অন্তর তাতে হাজির থাকে না। আমরা ‘এহসান’ অবস্থা বলতে যা বোঝাই তা হলো, অন্তরকে মন্দ স্বভাব ও আচরণ থেকে নির্মল এবং দুনিয়ার সমস্ত মনোযোগ বিচ্যুতিকর বিষয় থেকে মুক্ত রাখা। মহানবী (দ:) এই রীতিনীতি-ই অনুশীলন করেছিলেন, কেননা তিনি বলেছিলেন মানুষদেরকে দুনিয়ার আকর্ষণ হতে সরাতে এবং এর মনোযোগ বিচ্যুতিকর বিষয়াদি থেকে তাদেরকে মুক্ত করতেই তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

অতএব, আমরা এখানে দেখতে পাই যে সালাত তথা নামাযের বাহ্যিক আবরণ হচ্ছে তার কাঠামো, আর বিনয় ও অবনত সত্তা (খুশু’) হচ্ছে তার রূহ বা আত্মা। আত্মা ছাড়া দেহের সুফল বা কার্যকারিতা কোথায়? হুযূরি কলব্ তথা অন্তরের উপস্থিতি ছাড়া শারীরিক নড়াচড়ার নাম যদি হয় সালাত, তাহলে তা হবে জীবন্ত লাশ অর্থহীন কর্মকাণ্ড। আত্মার বসতির জন্যে যেমন দেহ প্রয়োজন, ঠিক তেমনি জীবন্ত করে তোলার জন্যে দেহেরও আত্মাকে একান্ত প্রয়োজন। দেহ ও আত্মার সম্পর্কের মতোই হচ্ছে শরীয়ত ও হাকীকতের মধ্যকার প্রকৃত সম্পর্ক। পূর্ণ ঈমানদার ব্যক্তি যিনি ‘এহসান’ অবস্থায় উন্নীত হয়েছেন, কেবল তিনি-ই ‘শরীয়াহ’‘হাকীকত’-কে একসাথে সংযুক্ত করতে সক্ষম হবেন। এটি-ই ‘তাসাউফ’-এর মৌলিক উপলব্ধি: দেহ ও আত্মার মধ্যে সংযোগ স্থাপন, ‘শরীয়াহ’‘হাকীকত’-এর মধ্যে সমন্বয় সাধন। 

মহান ইমামবৃন্দ ‘তাসাউফ’ সম্পর্কে যা বলেছেন - 

যুগের শায়খুল ইসলাম ইমাম মালেক (রহ:) যিনি ৯৫ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং যাঁকে তাবেঈনদের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হতো, তিনি এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত উপদেশ-বাণীতে বলেন:
  
“যে ব্যক্তি ফেকাহ্ শিক্ষা করে কিন্তু তাসাউফকে অবহেলা করে সে ধর্ম প্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে সাব্যস্ত হয়; আর যে ব্যক্তি তাসাউফ শিক্ষা করে কিন্তু ফেকাহকে অবহেলা করে, সে বিচ্যুত হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি দুটোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, সে অবশ্যই সত্যে পৌঁছুতে সক্ষম হয়।”

ইমাম মালেক (রহ:) হাকীকত ছাড়া শরীয়তকে স্বীকার করেননি; আবার শরীয়ত, ফেকাহ, ইসলাম ও এহসান অবস্থা ছাড়া হাকীকতকে মেনে নেননি।

ইমাম শাফেঈ (রহ:) বলেন, “এই জীবনের তিনটি বিষয় আমি পছন্দ করি: প্রথমতঃ মন্দ স্বভাব ও আচরণ পেছনে ফেলে আসা; দ্বিতীয়তঃ অন্যদের প্রতি দয়া প্রদর্শন; এবং তৃতীয়তঃ ‘তাসাউফ’-এর পথ (তরীকাহ) দ্বারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া।”

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ:) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দেন এ কথা বলে: “ওহে আমার পুত্র, সূফী-দরবেশদের সান্নিধ্যে থেকো; কেননা তাঁরা জ্ঞান-প্রজ্ঞায়, খোদাভীতি ও (তাঁর অস্তিত্বের) সচেতনতায়, কৃচ্ছ্বতায় এবং পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে নিষ্ঠার মাত্রায় আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রসর।”

চার মযহাব প্রত্যাখ্যানকারীর ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়ার অভিমত

আমাদের উল্লেখিত তিনজন ইমাম হলেন আহল আস্ সুন্নাহ’র প্রখ্যাত ইমামবৃন্দেরই অন্তর্ভুক্ত যাঁদের সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া তার প্রণীত ‘আল-মোখতাসার আল-ফাতাওয়া আল-মাসরিয়্যা’ পুস্তকের (মাদানী প্রকাশনী, ১৯৮০) ৪৫ পৃষ্ঠায় বর্ণনা দিয়েছে। ওতে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘চার (মযহাবের) ইমামকে কেউ গ্রহণ না করলে তার ব্যাপারে আপনার মতামত কী?’

ইবনে তাইমিয়া জবাবে বলে, “(মুজতাহিদের জন্যে) কোনো একটি নির্দিষ্ট মযহাবকে অনুসরণ করা অপরিহার্য নয়। বরঞ্চ আপনি সবগুলো থেকেই বেছে নিতে পারেন; আর এটি উত্তমও বটে। কিন্তু আপনি যদি এ কথা বলেন - ‘আমি চার মযহাব মানবো না, বরং আমার এজতেহাদ অনুযায়ী অনুশীলন করবো’ - তাহলে আপনি সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্তিতে পতিত হবেন। কেননা সত্যটি এই চার মযহাবের মধ্যেই নিহিত এবং এগুলো যা বর্ণনা করেছে, তা সত্যের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ।”

ইবনে তাইমিয়ার কথায় চার মযহাবের প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়। আর এ কারণেই সে চার মযহাবকে স্বীকার করে নিয়ে সেগুলোর মতামত নিয়েছে। ইবনে তাইমিয়া মুফতী হওয়াতে তা পেরেছিল; অতএব, আমরা এ শতাব্দীতে আগমন করে তাবেঈনদের যুগের মুসলিম জ্ঞান বিশারদদের (অর্থাৎ, চার মযহাবের ইমামবৃন্দের) বাণী এবং ইবনে তাইমিয়ার সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত ইসলামী পণ্ডিতদের কথাও মেনে নিয়েছি; আর আমরা ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য-ও উদ্ধৃত করছি যেভাবে উলামাবৃন্দ একে অপরের বাণী উদ্ধৃত করতেন।

আমরা এখানে ব্যক্ত করছি যে, কোনো বিষয় সম্পর্কে আমাদের মধ্যে এখতেলাফ বা মতপার্থক্য হলে সেটি পূর্ববর্তী উলেমাবৃন্দের মধ্যকার মতপার্থক্য-ই, আমাদের নয়। কেননা, আমরা তাঁদের বইপত্র থেকে যা শিখেছি তা-ই উদ্ধৃত করেছি; আর সেসব বই শরীয়ত ও সুন্নাহ’র সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ। অতএব, আমরা ‘তাসাউফ’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার সময় ইবনে তাইমিয়া বা অন্যান্য আলেম-উলেমার দৃষ্টিকোণ থেকে তা করলে তাঁদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই কাউকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই আমরা বলছি: আল্লাহ পাক আমাদের রক্ষা করুন এবং ওই সকল মহান ইমাম হতে জ্ঞান শিক্ষা করতে সহায়তা করুন। কেননা তাঁরা আল-কুরআন ও মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ হতে তাঁদের জ্ঞান আহরণ করেছিলেন।

বস্তুতঃ এখান থেকেই আমরা এ বিষয়ে উলেমাবৃন্দ যা বলেছিলেন তার গভীর থেকে আরও গভীরে যেতে পারি, কারণ এ বিদ্যাশাস্ত্র অত্যন্ত ব্যাপক; এতোই ব্যাপক যে আমরা এটি ব্যাখ্যা করতে আরও সময় চেয়েছিলাম।

চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রশ্নগুলোর উত্তর

বাকি প্রশ্নগুলো হচ্ছে -

৪/ - আমাদের রাসূলুল্লাহ (দ:) কি সূফী ছিলেন? হ্যাঁ হলে অনুগ্রহ করে কুরআন ও সুন্নাহ হতে সুস্পষ্ট প্রামাণ্য দলিল পেশ করুন।

৫/ - আমাদের নবী করীম (দ:) কি সূফীতত্ত্ব বা ‘তাসাউফ’ চর্চা করেছিলেন? হ্যাঁ হলে কুরআন ও সুন্নাহ হতে দালিলিক প্রমাণ প্রদর্শন করুন।

৬/ - মহানবী (দ:) কি সূফীবাদ বা ‘তাসাউফ’ অনুশীলন করতে বলেছিলেন বা আদেশ করেছিলেন? হ্যাঁ হলে কুরআন ও সুন্নতে নববী থেকে প্রমাণ পেশ করুন।

আপনি (শায়খ আদলী) চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ যে প্রশ্নগুলো করেছেন, তা আমাদের প্রথম তিনটি উত্তরেই দেয়া হয়েছে। আমরা যেহেতু জানি আমাদের শ্রোতামণ্ডলী জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান, সেহেতু আমরা নিশ্চিত যে প্রথম তিনটি উত্তরে দেয়া চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রশ্নের উত্তরগুলো তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে সক্ষম। অধিকন্তু, মতীন সিদ্দিকী তাঁর গতকালকের পোস্টে চতুর্থ প্রশ্নটির আরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ওর যথাবিহিত উত্তর দিয়েছেন।

আমরা আশা করি আমাদের পাঠকমণ্ডলী ও প্রিয় দ্বীনীভাই শায়খ আদলীকে তাঁদের প্রত্যাশানুযায়ী উত্তর দিতে পেরেছি, যদিও তা সংক্ষিপ্ত ছিল। আমরা ইতিপূর্বে পরিকল্পনা করেছিলাম প্রতিটি প্রশ্নের সম্পূর্ণ ও বিস্তারিত উত্তর দেবো। কিন্তু সময়ের স্বল্পতাহেতু এবং মানুষের পীড়াপীড়িতে আমরা এই উত্তরকে সংক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছি। এতে পরিস্ফুট হবে ‘তাসাউফ’ কতোখানি ব্যাপক একটি বিষয়, যেটি তাঁরা এখন ছয়টি প্রশ্নে সীমাবদ্ধ করেছেন।

অাল্লাহতা’লা আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন, কেননা আমরা অতি সাধারণ মুসলমান। আমরা আমাদের দ্বীনী ভাই ও বোনদের প্রতিও আবেদন জানাই আমাদের সাথে হাত মিলানোর উদ্দেশ্যে তাঁদের হাত বাড়াতে, যেভাবে আল্লাহ তাঁর পাক কালামে আদেশ করেন:

“আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে (আঁকড়ে) ধরো এবং (দল) বিভক্ত হয়ো না।” [সূরা আলে ইমরান, ১০৩]

আপনাদের দ্বীনীভাই,

-শায়খ হিশাম কাব্বানী 


রেফারেন্স: 

১/ - মজমু’আ-এ-ফাতাওয়া-এ-ইবনে তাইমিয়া; ইবনে তাইমিয়া লিখিত ও দার আর-রাহমা, মিসর হতে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত; ১১তম খণ্ড, ১৯০ পৃষ্ঠা।

২/ - আল-মোখতাসার আল-ফাতাওয়া আল-মাসরিয়্যা; ইবনে তাইমিয়্যা রচিত ও আল-মাদানী প্রকাশনী কর্তৃক ১৯৮০ সালে প্রকাশিত; ৬০৩ পৃষ্ঠা।

৩/ - প্রথমোক্ত রেফারেন্স বই; ৩১৪ পৃষ্ঠা।

৪/ - এলম আস্ সুলূক (আল্লাহর রাস্তায় গমন সংক্রান্ত জ্ঞান); ১০ম খণ্ড মজমু’আ-এ-ফাতাওয়া-এ-ইবনে তাইমিয়া; ৫১৬ পৃষ্ঠা।

৫/ - মজমু’আ-এ-ফাতাওয়া-এ-ইবনে তাইমিয়া; দার আর-রাহমাত, কায়রো; ২য় খণ্ড, ‘তাসাউফ’ পর্ব, ৪৯৭ পৃষ্ঠা।

৬/ - প্রাগুক্ত ৫ নং রেফারেন্স; ২য় পর্ব, ২য় খণ্ড, ৩৯৬-৭ পৃষ্ঠা। 

  

  
                                      সমাপ্ত