[Bengali translation of the online article "Puncturing the Devil's Dream about the Hadiths of Najd and Tamim" at www.masud.co.uk/ISLAM/misc/najd.htm; translator: Kazi Saifuddin Hossain]
মূল: হিশাম স্কাল্লি
(সুন্নী ডিফেন্স লীগ, লাদজনাত আল-দিফা’আ আ’ন আস্ সুন্নাহ আল-মোতাহহারাহ, মিলান, ইতালী)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
এই বিষয়টি লক্ষণীয় যে, অন্যান্য মুসলমান দেশে অসংখ্য অনন্য সাধারণ মোহাদ্দেসীন, মুফাসসেরীন, ব্যাকরণবিদ, ইতিহাসবিদ অথবা অাইনশাস্ত্রজ্ঞ তথা ইসলামী জ্ঞান বিশারদ পয়দা হলেও নজদ নামে পরিচিত অঞ্চলে অনুরূপ মহান কোনো আলেম-ই আবির্ভূত হন নি। এই প্রবন্ধটি খোলা মনের অধিকারী মুসলমানদের কাছে এই লক্ষণীয় বিষয়ের একটি ব্যাখ্যা প্রদানের উদ্যোগমাত্র।
নজদ অঞ্চলবিষয়ক হাদীস সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন
নজদ রাজ্য, যা দুই শতাব্দী যাবত ওহাবী মতবাদের মহাপরীক্ষার স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা এক গুচ্ছ কৌতূহলোদ্দীপক হাদীস ও প্রাথমিক (যুগের) রওয়ায়াতের বিষয়বস্তুতে আজ পরিণত, যেগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হলো ইমাম বোখারী (রহ:)-এর বর্ণনায় হযরত ইবনে উমর (রা:)-এর রওয়ায়াত, যা’তে তিনি বলেন: “রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, ‘এয়া আল্লাহ! আমাদের সিরিয়া (শাম) ও আমাদের ইয়েমেনদেশে বরকত দিন।’ সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) আরয করেন, ‘আমাদের নজদ অঞ্চলের জন্যেও (দোয়া করুন)?’ রাসূলুল্লাহ (দ:) আবার দোয়া করেন, ‘এয়া আল্লাহ! আমাদের শাম ও ইয়েমেনদেশে বরকত দিন।’ সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) আবারও আরয করেন, ‘আমাদের নজদ অঞ্চলের জন্যেও (দোয়া করুন)?’ তৃতীয়বারে আমার (ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু) মনে হলো তিনি বল্লেন, ‘ওখানে রয়েছে ভূমিকম্পসমূহ ও নানা ফিতনা (বিবাদ-বিসংবাদ), এবং সেখান থেকে উদিত হবে শয়তানের শিং (কারনুশ্ শয়তান)’।”
এই হাদীস স্পষ্টই নজদীদের কাছে হজম হবার মতো নয়, যাদের কেউ কেউ আজো অন্যান্য প্রসিদ্ধ অঞ্চলের মুসলমানদেরকে বোঝাতে অপতৎপর যে হাদীসটি যা স্পষ্ট বলছে তা তার আসল অর্থ নয়। এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের ব্যবহৃত একটি কূটচাল হলো এমন ধারণা দেয়া যা’তে ইরাককে নজদ অঞ্চলের সীমান্তে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। নজদীরা এই ধূর্ত চালের দ্বারা সিদ্ধান্ত টানে যে, হাদীসে কঠোরভাবে সমালোচিত নজদের অংশটি আসলে ইরাক, আর মূল নজদ এলাকা এই সমালোচনার বাইরে। মধ্যযুগের ইসলামী ভূগোলবিদগণ এই সহজাতভাবে অদ্ভূত ধারণার বিরোধিতা করেছেন (উদাহরণস্বরূপ দেখুন ইবনে খুররাদাযবিহ কৃত ‘আল-মাসালিক ওয়াল-মামালিক’, লেইডেন, ১৮৮৭, ১২৫ পৃষ্ঠা; ইবনে হাওকাল প্রণীত ‘কেতাব সুরত আল-আরদ’, বৈরুত ১৯৬৮, ১৮ পৃষ্ঠা)। তাঁরা (ভূগোলবিদগণ) নজদের উত্তর সীমানাকে ‘ওয়াদি আল-রুম্মা’ পর্যন্ত, অথবা আল-মাদা’ইনের দক্ষিণে অবস্থিত মরুভূমি পর্যন্ত চিহ্নিত করেন। কুফা ও বসরার মতো জায়গাগুলো, যেখানে কলহ-বিবাদের দ্বিতীয় ঢেউ উঠেছিল, সেগুলো প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মনে ‘নজদ’ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হবার কোনো ইঙ্গিত-ই এখানে নেই। পক্ষান্তরে, এই সব স্থান (কুফা, বসরা ইত্যাদি) সর্বক্ষেত্রে ইরাকের এলাকা হিসেবেই চিহ্নিত ছিল।
নজদ অঞ্চলবিষয়ক হাদীসটি সম্পর্কে সাধারণভাবে বোধগম্য যে অর্থ বিদ্যমান, নজদকে সেই প্রাথমিক যুগের উপলব্ধির আওতামুক্ত রাখতে বর্তমানকালের নজদীপন্থী লেখকেরা যথেষ্ট উদ্ভাবনী ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কতিপয় আত্মপক্ষ সমর্থনকারী এই হাদীসটিকে বেশ কিছু হাদীসের সাথে মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন, যেগুলোতে ‘শয়তানের শিং’-কে ‘পূর্বাঞ্চলের’ সাথে সম্পৃক্ত করা হয়; পূর্বাঞ্চল বলতে সাধারণতঃ ইরাককে বোঝায়। মধ্যযুগের শেষলগ্নের কিছু ব্যাখ্যা এই ধারণার বশবর্তী হলেও আধুনিক ভৌগোলিক জ্ঞান স্পষ্টতঃ এই ধারণাকে নাকচ করে দেয়। আধুনিক মানচিত্রের (গোলকের) দিকে এক নজর বুলালেই পরিদৃষ্ট হবে যে মদীনা মোনাওয়ারা থেকে পূর্ব দিকে টানা এক সরল-রেখা ইরাকের ধারে-কাছে কোথাও যায় না, বরং রিয়াদের কিছুটা দক্ষিণে স্থিত হয়। অর্থাৎ, নজদ অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত হয়। অতএব, এ প্রসঙ্গে যে সব হাদীসে ‘পূর্বাঞ্চলের’ কথা উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলো নজদ অঞ্চলকেই ইঙ্গিত করে, ইরাককে নয়।
সুযোগ পেলেই নজদীপন্থী আত্মপক্ষ সমর্থনকারীরা আরবী ‘নজদ’ শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ তুলে ধরে; এ শব্দের মানে হলো ‘উঁচু স্থান’। তবে আবারও আধুনিক মানচিত্রের (গোলকের) শরণাপন্ন হলে এই বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা পাওয়া যায়। আজকের উত্তর ইরাক, যাকে বর্তমান শতাব্দীর আগ পর্যন্ত কোনো মুসলমান-ই ইরাকের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন নি (একে বলা হতো ‘আল-জাযিরা’), তার ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র ইরাক অঞ্চল-ই লক্ষণীয়ভাবে সমতল ও নিচু ভূমি; আজও এর অধিকাংশ এলাকা নিচু জলাভূমি, আর বাকি বাগদাদ পর্যন্ত বা তারও উত্তরে রয়েছে সমতল, নিচু মরু এলাকা বা কৃষি জমি। এর বিপরীতে নজদ অঞ্চল হলো বেশির ভাগই মালভূমি, যা’তে ’জাবাল শাম্মার’ পর্বতমালার উঁচু শৃঙ্গ ‘জাবাল তাঈয়ী’ (১৩০০ মিটার)-ও অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণ ইরাকের সমতল ভূমির প্রতি কীভাবে আরবীয়রা নিত্যনৈমিত্তিকভাবে প্রাকৃতিক বিবরণমূলক ‘উঁচু ভূমি’ সংজ্ঞাটি আরোপ করতে পারেন তা বোঝা এক্ষণে দুষ্কর। [এই একই এলাকা ১৯৯১ সালের ’উপসাগরীয় যুদ্ধ’ চলাকালে ট্যাংক-লড়াইয়ের উপযোগী হিসেবে প্রমাণিত হয়, আর এটি-ই রিয়াদের ‘ক্যাভেলিয়ার্স’ (রাজতন্ত্রপন্থী) ও ‘রাউন্ডহেডস্’ (গণতন্ত্রপন্থী)-দের মধ্যে দ্বন্দ্বের কুখ্যাত উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়]
নজদ অঞ্চলকে সহজভাবে সনাক্ত করা যায় হাদীসশাস্ত্র দ্বারা, যা’তে অসংখ্যবার নজদের কথা বিবৃত হয়েছে; আর এগুলোর সবই পরিষ্কারভাবে মধ্য আরব অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছে। কয়েক ডজন উদাহরণের মাঝে কিছু এখানে তুলে ধরা হলো: আবূ দাউদ শরীফ (সালাত আল-সফর, ১৫) বর্ণনা করে, “আমরা রাসূলুল্লাহ (দ:)-সহ নজদ অঞ্চলে যাই এবং ‘যাত আল-রিকা’ পৌঁছাই, যেখানে গাতফান (নজদী) গোত্রের একটি দলের সাথে তাঁর (দ:) দেখা হয়।” তিরমিযী শরীফে (হজ্জ্ব, ৫৭) মহানবী (দ:)-এর সাথে আরাফাতে এক নজদী প্রতিনিধিদলের দেখা হওয়ার বিবরণ রয়েছে (আরও দেখুন ইবনে মাজাহ, মানাসিক, ৫৭)। এ সব ক্ষেত্রের কোনোটিতেই সুন্নাহ থেকে এই আভাস পাওয়া যায় না যে ইরাক রাজ্য রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর ভাষ্যানুযায়ী নজদের অন্তর্গত ছিল।
হাদীসসমূহের এক গুচ্ছ থেকে আরও প্রামাণ্য দলিল পেশ করা যায়, যেগুলো হাজ্বীদের জন্যে ‘মিকাত’-স্থানগুলো চিহ্নিত করে। ইমাম নাসাঈ বর্ণিত একখানা হাদীসে (মানাসিক আল-হাজ্জ্ব, ২২) হযরত মা আয়েশা (রা:) ঘোষণা করেন, ’হুযূর পাক (দ:) মদীনাবাসীদের জন্যে যুল-হুলায়ফা-তে ‘মিকাত’-স্থান নির্ধারণ করেছেন, সিরিয়া ও মিসরবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন আল-জুহফাতে, ইরাকবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন যাত এরক-এ, নজদবাসীর জন্যে করেছেন কার্ন-এ, আর ইয়েমেনবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন এয়ালামলাম-এ।’ ইমাম মুসলিম-ও (হজ্জ্ব, ২) অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেন, ‘মদীনাবাসীর জন্যে হলো যুল-হুলায়ফা, অপর রাস্তার জন্যে এটি আল-জুহফা; ইরাকবাসীর জন্যে হলো যাত এরক, নজদবাসীর জন্যে কার্ন; আর ইয়েমেনবাসীর জন্যে এটি হলো এয়ালামলাম।’
এই হাদীসগুলো তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে যে মহানবী (দ:) নজদ ও ইরাকের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন, এমনই পার্থক্য যে তিনি এই দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্যে আলাদা আলাদা ’মিকাত’-স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে স্পষ্টতঃ ইরাক নজদ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
হাদীসে বর্ণিত নজদ
বহু আহাদীসে রাসূলে খোদা (দ:) বিভিন্ন দেশের প্রশংসা করেছেন। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, নজদ অঞ্চল মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার সবচেয়ে কাছের হলেও এ সব হাদীসের কোনোটিতেই নজদের প্রশংসা করা হয় নি। ওপরে উদ্ধৃত সর্বপ্রথম হাদীসটিতে সিরিয়া ও ইয়েমেন দেশের জন্যে দোয়া করার বেলায় মহানবী (দ:)-এর আগ্রহ পরিদৃষ্ট হয়; আর নজদের জন্যে দোয়া করার ক্ষেত্রে তাঁর জোর অসম্মতিও এতে প্রকাশ পায়। অধিকন্তু, যেখানেই নজদ অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতেই স্পষ্ট দেখা যায় সেটি সমস্যাসঙ্কুল এলাকা। উদাহরণস্বরূপ, নিম্নবর্ণিত সহীহ হাদীসটি বিবেচনা করুন:
হযরত আমর ইবনে আবাসা (রা:) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) একদিন ঘোড়া যাচাই-বাছাই করছিলেন; সাথে ছিল উবায়না ইবনে হিসন ইবনে বদর আল-ফাযারী। উবায়না মন্তব্য করে, ‘মানুষের মধ্যে সেরা তারাই, যারা নিজেদের তলোয়ার নিজেদের কাঁধেই বহন করে এবং বর্শা ঘোড়ার (পায়ে) বাঁধা সেলাইকৃত মোজার মধ্যে রাখে; আর যারা আলখাল্লা পরে। এরাই নজদের মানুষ।’ কিন্তু হুযূর পূর নূর (দ:) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তুমি মিথ্যে বলেছ! বরঞ্চ সেরা মানুষ হলো ইয়েমেনীরা। ঈমানদারী এক ইয়েমেনী, এই সেই ইয়েমেন যা’তে অন্তর্ভুক্ত লাখম, জুদাম ও আমিলা গোত্রগুলো....হারিস গোত্রের চেয়ে হাদ্রামওত সেরা; এক গোত্রের চেয়ে অপর গোত্র শ্রেয়; (আবার) আরেক গোত্র আরও মন্দ।....আমার প্রভু খোদাতা’লা কুরাইশ বংশকে অভিসম্পাত দিতে আমাকে আদেশ করেন, আর আমিও তাদের অভিসম্পাত দেই। কিন্তু এর পর তিনি তাদেরকে দু’বার আর্শীবাদ করতে নির্দেশ দেন, আর আমিও তা করি।......আল্লাহর দৃষ্টিতে কেয়ামত (পুনরুত্থান) দিবসে আসলাম ও গিফার গোত্র এবং তাদের সহযোগী জুহাইনা গোত্র আসাদ ও তামিম, গাতাফান ও হাওয়াযিন গোত্রগুলোর চেয়ে শ্রেয়।.....বেহেশ্তে সর্বাধিক সদস্য হবে ইয়েমেনী মাযহিজ ও মা’কুল গোত্রগুলোর’।” [সহীহ সনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও আত্ তাবারানী; আলী ইবনে আবি বকর আল-হায়সামী কৃত ‘মজমাউল যাওয়াইদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়াইদ’, কায়রো ১৩৫২ হিজরী, ১০ম খণ্ড, ৪৩ পৃষ্ঠায়ও উদ্ধৃত]
নজদের প্রশংসাকারী ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন, ‘তুমি মিথ্যেবাদী।’ উপরন্তু, তিনি কোথাও নজদের প্রশংসা করেন নি। অথচ এর বিপরীতে অন্যান্য অঞ্চলের প্রশংসাসূচক অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, হযরত উম্মে সালামা (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) অন্তিমলগ্নে নিম্নের আদেশ দেন, “আল্লাহর শপথ! তাঁরই দোহাই দিয়ে আমি তোমাদের বলছি, মিসরীয়দের ব্যাপারে তোমরা তাদের ওপর বিজয়ী হবে; আর তারাও তোমাদের সাহায্যকারী হবে আল্লাহর পথে।” [আত্ তাবারানী; আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ শ্রেণীভুক্ত, ‘মজমা’, ১০ খণ্ড, ৬৩ পৃষ্ঠা; মিসরীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানতে আরও দেখুন সহীহ মুসলিম, ইমাম নববী কৃত শরাহ, কায়রো ১৩৪৭ হিজরী, ১৬তম খণ্ড, ৯৬-৭ পৃষ্ঠা]
হযরত কায়স ইবনে সা’দ (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “তারকারাজি (আসমান) থেকেও যদি ঈমান দূর হয়ে যায়, তবুও ফারিস (পারস্য)-দেশের সন্তানেরা সেখানে তা পৌঁছে দেবে।” [আবূ এয়ালা ও আল-বাযযার উভয়ের ‘মুসনাদ’ গ্রন্থগুলো; সহীহ শ্রেণীভুক্ত করেছেন আল-হায়তামী নিজ ’মজমা’ পুস্তকে, ১০ম খণ্ড, ৬৪-৫ পৃষ্ঠা; আরও জানতে দেখুন ইমাম নববী প্রণীত শরহে মুসলিম, ১৬তম খণ্ড, ১০০ পৃষ্ঠা]
রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান, “সাকিনা তথা প্রশান্তি হেজায অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিরাজমান।” [আল-বাযযার, আল-হায়তামী কর্তৃক উদ্ধৃত, ১০ম খণ্ড, ৫৩ পৃষ্ঠা]
হযরত আবূদ্ দারদা (রহ:)-এর বর্ণনায় মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “তোমরা অনেক (মোজাহেদীন) যোদ্ধার দেখা পাবে। একটি বাহিনী সিরিয়ায়, আরেকটি মিসরে, অপর একটি ইরাকে, আবার একটি ইয়েমেনে” [আল-বাযযার ও তাবারানী; আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ শ্রেণীভুক্ত, মজমা’, ১০ম খণ্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা]। জ্বেহাদে স্বেচ্ছাসেবকদের আবাসস্থল হিসেবে এই সব অঞ্চলকে প্রশংসা করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান, “পরম করুণাময়ের ফেরেশতাকুল সিরিয়ার ওপর তাঁদের পাখা মেলেছেন।” [তাবারানী; মজমা’ গ্রন্থের ১০ম খণ্ডের ৬০পৃষ্ঠায় সহীহ হিসেবে শ্রেণীকরণ; আরও দেখুন তিরমিযীর ব্যাখ্যায় ইমাম মোহাম্মদ ইবনে আবদ্ আল-রহমান আল-মোবারকপুরী কৃত ‘তোহফাত আল-আহওয়াযী বি-শরহে জামে’ আল-তিরমিযী, ১০ম খণ্ড, ৪৫৪ পৃষ্ঠা; এতে তিনি এই হাদীসকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন]
আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন যে হুযূর পাক (দ:) এরশাদ ফরমান, “ইয়েমেনবাসী তোমাদের কাছে এসেছে। তাদের অন্তর কোমল, আত্মা আরও কোমল। ঈমানদারী এক ইয়েমেনী, আর জ্ঞান-প্রজ্ঞাও ইয়েমেনী।” [তিরমিযী, ফী ফযলিল ইয়ামান, নং-৪০২৮; মোবারকপুরী, ১০ম খণ্ড, ৪৩৫, ৪৩৭ পৃষ্ঠা - হাদীস হাসান সহীহ শ্রেণীভুক্ত; ৪৩৬ পৃষ্ঠায় ইমাম মোবারকপুরী উল্লেখ করেন যে আনসার সাহাবীদের পূর্বপুরুষগণ ইয়েমেন দেশ থেকে এসেছিলেন।]
মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “ইয়েমেনদেশের মানুষেরা পৃথিবীর বুকে সেরা মানব।” [আবূ এয়ালা ও আল-বাযযার; সহীহ শ্রেণীভুক্ত: আল-হায়তামী, ১০ম খণ্ড, ৫৪-৫ পৃষ্ঠা]
রাসূলে খোদা (দ:) আরবীয় গোত্রগুলোর কাছে তাঁর এক দূত/প্রতিনিধি প্রেরণ করেন, কিন্তু তারা তাঁকে অপমান ও মারধর করে। এমতাবস্থায় তিনি হুযূর পাক (দ:)-এর কাছে ফিরে এসে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁকে উত্তরে বলেন, “তুমি যদি ওমানের মানুষদের কাছে যেতে, তাহলে তারা তোমাকে অপমান করতো না, মারধরও করতো না।” [মুসলিম, ফযাইল আস্ সাহাবা, ৫৭ পৃষ্ঠা; দেখুন ইমাম নববীর শরাহ তথা ব্যাখ্যা, ১৬তম খণ্ড, ৯৮ পৃষ্ঠা, যা’তে তিনি মন্তব্য করেন, ‘এতে তাঁদের প্রশংসা ও মাহাত্ম্যের ইঙ্গিত রয়েছে।’]
ওপরের হাদীসগুলো অসংখ্য হাদীসের সংগ্রহশালা থেকে সংকলিত হয়েছে, যা’তে বিভিন্ন আশপাশ এলাকা সম্পর্কে মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা লিপিবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু আবারও বলতে হচ্ছে, নজদ অঞ্চল এগুলোর যে কোনোটি থেকে সন্নিকটে হলেও সেটি সম্পর্কে প্রশংসাসূচক হাদীস লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত।
নজদীরা নিজেরাই এই সত্যটি সম্পর্কে সাধারণভাবে জানে, তবে তারা এর প্রচার করে না। এটি স্পষ্ট যে, নজদ অঞ্চল সম্পর্কে একটিমাত্র প্রশংসাসূচক হাদীস বিদ্যমান থাকলেও তারা উম্মাহকে তা জানিয়ে দিতো। তাদের প্রদেশ সম্পর্কে মহানবী (দ:)-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিন্দাকে পাশ কাটানোর বা নিষ্ক্রিয় করার জন্যে তাদের কেউ কেউ হাদীসে উল্লেখিত এলাকার বিষয়টিকে মনোযোগ আকর্ষণের যোগ্য বলে স্বীকারই করে না, বরং নজদে বসবাসকারী গোত্র-উপগোত্রের বিভক্তির দিকেই নিজেদের মন্তব্যকে কেন্দ্রীভূত রাখে।
বনূ তামিম গোত্র
মধ্য আরব অঞ্চলের সর্বাধিক পরিচিত গোত্র হলো বনূ তামিম। প্রধান প্রধান আরব গোত্রগুলোর প্রশংসাসূচক অনেক হাদীস বিদ্যমান, যার মাত্রা ব্যক্ত করতে নিম্নের কয়েকটি উদাহরণের তালিকা পেশ করা হলো:
* রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, “এয়া আল্লাহ, ‘আহমাস’ গোত্র ও এর ঘোড়াগুলো এবং মানুষজনকে সাত গুণ (আপনার) আশীর্বাদধন্য করুন।” [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল; আল-হায়তামী কৃত ‘মজমা’, ১০ম খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা; আল-হায়তামীর মতে এর বর্ণনাকারীরা সবাই আস্থাভাজন]
* হযরত গালিব বিন আবজুর (রা:) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর উপস্থিতিতে ’কায়স’ গোত্রের কথা উল্লেখ করলে তিনি এরশাদ ফরমান, ‘আল্লাহতা’লা কায়স গোত্রের প্রতি তাঁর রহমত নাযেল করুন।’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি কি কায়স গোত্রের জন্যে আল্লাহর রহমত কামনা করছেন?’ তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, সে আল্লাহর পেয়ারা ও আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম (আ:)-এর ধর্ম অনুসরণ করেছে। কায়স, আমাদের ইয়েমেনকে অভিবাদন জানাও! ইয়েমেন, আমাদের কায়সকে অভিবাদন জানাও! কায়স হলো পৃথিবীর বুকে আল্লাহতা’লার অশ্বারোহী বাহিনী’।” [আত্ তাবারানী; আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ ঘোষিত, ১০ খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা]
* হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “আযদ গোত্রের মানুষেরা কতোই না উত্তম! মিষ্টভাষী, ওয়াদা পূরণকারী ও নির্মল (পরিষ্কার) অন্তর!” [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল; হাসান এসনাদ বলে সমর্থন করেন আল-হায়তামী, ১০ খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা]
* হযরত আনাস বিন মালেক (রা:) বলেন, “আমরা যদি আযদ গোত্র হতে (আবির্ভূত) না হই, তবে আমরা মনুষ্য জাতি হতে নই।” [তিরমিযী কৃত ‘মানাকিব’ ৭২ পৃষ্ঠা; হাসান গরিব সহীহ হিসেবে সমর্থন করেছেন মোবারকপুরী, ১০ খণ্ড, ৪৩৯ পৃষ্ঠা]
* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, “আমি প্রত্যক্ষ করি যে মহানবী (দ:) ’নাখ’ গোত্রের জন্যে দোয়া করেন।” অথবা তিনি (ইবনে মাসউদ) বলেন, “হুযূর পাক (দ:) তাদের এমন প্রশংসা করেন যে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ’নাখ’ গোত্রের সদস্য হই।” [আহমদ ইবনে হাম্বল; সহীহ এসনাদ বলে সমর্থন করেন আল-হায়তামী, ১০ম খণ্ড, ৫১ পৃষ্ঠা]
* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে বলতে শুনেছি ‘এই খেলাফত থাকবে কুরাইশ গোত্রের অধীন। তারা যতোদিন ধর্ম কায়েম রাখবে, কেউ তাদের বিরোধিতা করলে আল্লাহ তাকে মুখ উপুড় করে (মাটিতে) ছুঁড়ে ফেলে দেবেন’।” [বোখারী, মানাকিব, ২য় পৃষ্ঠা]
যে হাদীসে দৃশ্যতঃ তামিম গোত্রকে প্রশংসা করা হয়েছে, তা ব্যতিক্রমী নয়, এবং তাতে অন্যান্য গোত্রের ওপর তামিমের শ্রেষ্ঠত্ব কোনোভাবে কল্পনাও করা যায় না। বস্তুতঃ বিভিন্ন গোত্রের গুণের প্রশংসাসূচক এই বিশাল হাদীস সংকলনে কেবল একটিমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ বর্ণনায় তামিম গোত্রের প্রশংসা পাওয়া যায়। বর্ণনাটি নিম্নরূপ: হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর কাছ থেকে তামিম গোত্র সম্পর্কে তিনটি বিষয় শোনার পর আমি তাদেরকে পছন্দ করি। তিনি এরশাদ ফরমান, ‘তামিম গোত্র আমার উম্মতের মধ্যে দাজ্জালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর হবে।’ তাদের একজন আয়েশা (রা:)-এর মালিকানাধীন বন্দী ছিল। রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন, ‘এই নারীকে মুক্ত করে দাও, কেননা সে হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর বংশধর।’ আর যখন তামিম গোত্র নিজেদের যাকাত নিয়ে আসে, তখন হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান, ‘এটি একটি জাতির যাকাত’; অথবা (বর্ণনান্তরে), ‘আমার জাতির (যাকাত)’।” [বোখারী, মাগাযী, ৬৮ পৃষ্ঠা]
এই হাদীস স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে দাজ্জালের বিরুদ্ধে শেষ ফয়সালাকারী যুদ্ধে বনূ তামিম গোত্রের কঠোরতাকে ইসলামের বিপক্ষে নয়, বরং পক্ষে ব্যবহার করা হবে; আর এটি প্রশ্নাতীতভাবে একটি গুণ। দ্বিতীয় বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম তাৎপর্যপূর্ণ, যেহেতু সকল আরব গোত্রই হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর বংশধর; তৃতীয় বিষয়টির বিভিন্ন বর্ণনা দ্ব্যর্থহীনভাবে এর তাৎপর্য তুলে ধরতে অক্ষম। এমন কি এই বিষয়ের সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাখ্যায়ও আমরা এর বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না যে মহানবী (দ:) ওই গোত্রের প্রতি ততোক্ষণ-ই সন্তুষ্ট ছিলেন, যতোক্ষণ তারা যাকাত দিচ্ছিল। অতঃপর আমরা দেখতে পাবো যে তাদের যাকাত দানের ব্যাপারটি ক্ষণস্থায়ী হিসেবেই প্রমাণিত হয়।
তামিম গোত্রের স্পষ্ট সমালোচনা বিধৃত হয়েছে এমন হাদীসের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। নজদীপন্থী আত্মপক্ষ সমর্থনকারীরা সাধারণতঃ এ সব হাদীসকে অগ্রাহ্য করে; কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাচর্চা বা গবেষণা এটি আমাদের কাছে দাবি করে যে কেবল কিছু সংখ্যক নয়, বরং এতদসংক্রান্ত সমস্ত প্রামাণ্য দলিল-ই বিবেচনায় আনা জরুরি এবং কোনো মীমাংসায় পৌঁছার আগে এগুলোকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর তামিম গোত্র সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক সমালোচনামূলক দলিলকে বিবেচনায় নিলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে মহানবী (দ:) ও সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মা)-বৃন্দ এই গোত্রকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখতেন।
বনূ তামিম গোত্রভুক্ত লোকদের সম্পর্কে প্রাথমিক ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং খোদাতা’লা তাঁরই পাক কালামে। সূরা হুজুরাতের ৪র্থ আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় ওই সব লোক যারা আপনাকে হুজরা (প্রকোষ্ঠ)-সমূহের বাইরে থেকে আহ্বান করে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই নির্বোধ।” এ আয়াতের ‘সাবাব আন্ নুযূল’ বা অবতীর্ণ হবার কারণ নিচে বর্ণনা করা হলো:
”হুজূরাত তথা প্রকোষ্ঠসমূহ ছিল দেয়াল-ঘেরা কক্ষ। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রত্যেক স্ত্রীর একটি করে কক্ষ ছিল। এই আয়াতটি নাযেল হয় যখন বনূ তামিম গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল মহানবী (দ:)-এর কাছে আসে। তারা মসজিদে প্রবেশ করে এবং ওই প্রকোষ্ঠগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর উচ্চস্বরে ডেকে বলে, ’ওহে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আমাদের কাছে বেরিয়ে আসুন!’ এই কাজটি রূঢ়, স্থূল ও বেয়াদবিপূর্ণ ছিল। রাসূলে করীম (দ:) কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন এবং তারপর তাদের কাছে বেরিয়ে আসেন। আল-আক্করা’ ইবনে হাবিস নামে পরিচিত তাদের একজন বলে, ‘হে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। আমার প্রশংসা হলো একটি অলংকার, আর আমার অভিযুক্তকরণ লজ্জা বয়ে আনে।’ এমতাবস্থায় মহানবী (দ:) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তোমার জন্যে আফসোস! এটি-ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার পাওনা’।” [ইমাম মোহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে জুযাঈ কৃত ‘আল-তাশিল’, বৈরুত ১৪০৩ হিজরী সংস্করণ, ৭০২ পৃষ্ঠা; অন্যান্য তাফসীরগ্রন্থও দেখুন; এছাড়া ইবনে হাযম প্রণীত ‘জামহারাত আনসাব আল-’আরব’, তামিম অধ্যায়, ২০৮ পৃষ্ঠা, কায়রো ১৩৮২ হিজরী সংস্করণ দ্রষ্টব্য। অনুবাদকের নোট: মুফতী আহমদ এয়ার খান নঈমী রচিত তাফসীরে ’নূরুল এরফান’-গ্রন্থেও তামিম গোত্রের কথা উল্লেখিত হয়েছে; বঙ্গানুবাদক - মওলানা এম, এ, মান্নান, চট্টগ্রাম]
আল-কুরআনের এই সমালোচনার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ হাদীসে উম্মতের প্রতি এই গোত্র সম্পর্কে উপদেশবাণী পেশ করা হয়েছে। যেহেতু রাসূলে পাক (দ:)-এর মৌন সমর্থনও হাদীস (সুন্নাতে তাকরীরী) হিসেবে পরিগণিত, সেহেতু আমরা নিম্নের ঘটনা দিয়ে শুরু করতে পারি।
এটি হযরত হাসসান ইবনে সাবেত (রা:)-এর একটি প্রসিদ্ধ কবিতা। তামিম গোত্রের লোকেরা শেষদিকে ইসলাম গ্রহণ করে, যা তারা অনেক বিরোধিতার পর করেছিল; বছরটি ছিল ‘আম আল-উফূদ’ তথা প্রতিনিধিদলের বছর, হিজরী নবম সাল। ফলে তামিম গোত্রীয়রা ’সাবিকা’ তথা ইসলামে অগ্রবর্তী বা পূর্ববর্তী হবার বৈশিষ্ট্যশূন্য ছিল। মহানবী (দ:)-এর দরবারে সবশেষে এসে তারা তাঁর সাথে একটি প্রকাশ্য বাহাস বা বিতর্ক দাবি করে বসে। এমতাবস্থায় হুযূর পাক (দ:) হযরত হাসসান বিন সাবেত (রা:)-কে তামিম গোত্র সম্পর্কে তাদের অন্তঃসারশূন্য দর্পচূর্ণ করার জন্যে নিয়োগ করেন। হযরত হাসসান (রা:)-এর এই কাব্য, যা তামিম গোত্রকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করে এবং তাদের নিচুতা ও হীনতাকে ফুটিয়ে তোলে, তা বনূ তামিম গোত্র সম্পর্কে মহানবী (দ:)-এর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনের প্রমাণ বলেই বিবেচনা করা যায়; কেননা, এই অভিযোগ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর উপস্থিতিতেই উত্থাপিত হয়, এবং এর প্রতি তাঁর সমালোচনার কোনো প্রামাণিক দলিল বিদ্যমান নেই। [’দেওয়ানে হাসসান ইবনে সাবেত, বৈরুত, ১৯৬৬ ইং, ৪৪০ পৃষ্ঠা; পুরো ঘটনার বৃত্তান্ত জানার জন্যে একই গ্রন্থে বারকুকীর ব্যাখ্যা দেখুন; আরও দেখুন ইবনে হিশাম কৃত ‘সীরাহ’, Guillaume অনূদিত সংস্করণ, ৬৩১ পৃষ্ঠা]
বনূ তামিম গোত্র সম্পর্কে অপর এক রওয়ায়াতে আছে:
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা:) বর্ণনা করেন যে তামিম গোত্রের এক প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দরবারে এলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে এরশাদ ফরমান, “ওহে তামিম গোত্র! শুভসংবাদ গ্রহণ করো!” তারা উত্তর দেয়, “আপনি আমাদেরকে সুসংবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; অতএব, আমাদেরকে কিছু (অর্থ-কড়ি) দিন!” এমতাবস্থায় হুযূর করীম (দ:)-এর চেহারা মোবারকে পরিবর্তন ঘটে। ঠিক সে সময় কয়েকজন ইয়েমেনী তাঁর দরবারে উপস্থিত হন, আর তিনি তাঁদেরকে বলেন, “হে ইয়েমেনবাসী! শুভসংবাদ গ্রহণ করো, যদিও তামিম গোত্র তা গ্রহণ করে নি!” অতঃপর ইয়েমেনীরা বলেন, “আমরা গ্রহণ করলাম।” আর মহানবী (দ:) সৃষ্টির প্রারম্ভ ও আরশ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন। [আল-বোখারী, বাদ’ আল-খালক্ক, ১]
কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে বিধৃত তামিম গোত্রের রূঢ় ও উচ্ছৃঙ্খল মন-মানসিকতা মূর্তি-পূজারী কুরাইশ বংশীয় নেতা আবূ জাহেলের ব্যক্তিত্বসংশ্লিষ্ট একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে। মহানবী (দ:)-এর প্রতি অন্ধ আক্রোশ পোষণকারী আবূ জাহেলের শৈশব নিশ্চয় তামিমী ভাবধারায় গড়ে ওঠে। তার মাতা আসমা বিনতে মুখাররিবা তামিম গোত্রভুক্ত ছিল (আল-জুমাহী কৃত ‘তাবাকাত ফুহূল আল-শুয়ারা’, সম্পাদক মোহাম্মদ শাকির, কায়রো, ১৯৫২ সংস্করণ, ১২৩ পৃষ্ঠা)। আবূ জাহেল বিয়ে করে উমাইর ইবনে মা’বাদ আল-তামিমীর কন্যাকে, যার গর্ভে তার এক পুত্র সন্তান হয় এবং নাম রাখা হয় তামিম, কারণটি যার সহজেই অনুমেয় (মুস’আব ইবনে আব্দিল্লাহ প্রণীত ‘নসব কুরাইশ’, কায়রো, ১৯৫৩, ৩১২ পৃষ্ঠা)।
হাদীসশাস্ত্রে তামিমীদের যে বৈশিষ্ট্য বার বার উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়াবাড়ি। তারা যখন অবশেষে ইসলাম গ্রহণ করে, তখন তারা এমন উগ্র ধার্মিকতার সাথে জড়ায় যা উপলব্ধির পরিবর্তে সাদামাটা ও অনমনীয় আনুগত্যের দাবি পেশ করে; আর যা ঘন ঘন ধর্মের প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে অমান্য করে। ইমাম মুসলিম (রহ:) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শাকিক (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) একবার আমাদেরকে ধর্মশিক্ষা দিচ্ছিলেন আসর নামাযের বা’দে। অতঃপর সূর্য ডুবে যায় এবং আকাশে তারা দৃশ্যমান হয়। মানুষেরা বলতে আরম্ভ করে, ‘নামায!’ ’নামায!’ বনূ তামিম গোত্রের এক লোক তাঁর কাছে এসে জোর দিয়ে বার বার বলে, ‘নামায!’ ‘নামায!’ এমতাবস্থায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) জবাব দেন, ‘তুমি কি আমায় সুন্নাহ শেখাতে এসেছ, হতভাগা কোথাকার’?” [মুসলিম শরীফ, সালাত আল-মোসাফিরীন, ৬]
বনূ তামিম ও খাওয়ারিজ
তামিম গোত্রভুক্তদের অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আমাদের মনোযোগ আবারও আকর্ষণ করার মতো সর্বাধিক প্রসিদ্ধ যে হাদীসটি বিদ্যমান তা সম্ভবতঃ যুল খোয়াইসারা-বিষয়ক:
হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা:) বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম; ওই সময় তিনি গনীমতের মালামাল বণ্টন করছিলেন। তামিম গোত্রভুক্ত যুল খোয়াইসারা নামের এক লোক এসে বলে, ‘হে রাসূল (দ:)! ইনসাফের সাথে বণ্টন করুন।’ মহানবী (দ:) উত্তর দেন, ‘আফসোস তোমার প্রতি! আমি ন্যায়পরায়ণ না হলে কে হবে? তুমি বিষাদগ্রস্ত ও হতাশ যে আমি ন্যায়পরায়ণ নই?’ এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারুক (রা:) বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমাকে অনুমতি দিন যাতে আমি তার শিরোচ্ছেদ করতে পারি!’ কিন্তু হুযূর পূর নূর (দ:) বলেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও। তার আরও সাথী আছে। তাদের নামায বা রোযার মোকাবেলায় তোমাদের নামায-রোযাকে অন্তঃসারশূন্য মনে হবে; তারা কুরআন তেলাওয়াত করে, কিন্ত ওর মর্মবাণী কণ্ঠনালির নিচে যায় না। তীর যেমন ধনুক থেকে লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যায়, তারাও ইসলাম ধর্ম থেকে তেমনি খারিজ হয়ে যাবে’।” হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা:) আরও বলেন, “আমি (আল্লাহর নামে) কসম করে বলছি, হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (ক:) যখন তাদের (খারেজীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তিনি নির্দেশ দেন যেন ওই লোককে খুঁজে বের করে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়; আর তাকে আমাদের সামনে ধরে আনা হয়।” [আল-বোখারী কৃত ‘মানাকিব’, ২৫; ‘লক্ষ্যভেদ করে বের হয়ে যাওয়া’ সম্পর্কে জানতে দেখুন আবূল আব্বাস আল-মোবাররাদ প্রণীত ‘আল-কামেল’, ‘আখবার আল-খাওয়ারিজ’ অধ্যায়, যা ’দার আল-ফিকর আল-হাদীস’, বৈরুত (তারিখ অনুল্লিখিত) কর্তৃক আলাদাভাবে প্রকাশিত, যা’তে নিম্নের মন্তব্য আছে: ‘সাধারণতঃ এমনটি যখন হয় (লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া), তখন কোনো শিকারের রক্ত-ই তীরে মাখা থাকে না’]
এই হাদীসটিকে ব্যাখ্যাকারীগণ খারেজীদের প্রকৃতিসম্পর্কিত একটি ভবিষ্যদ্বাণী, একটি সতর্কবার্তা হিসেবে গ্রহণ করেন। নির্দিষ্ট এক ধরনের ধর্মের গোঁড়া সমর্থক আছে, যারা ধর্মে এতো জোরে প্রবেশ করে যে অপর দিক দিয়ে বেরিয়ে আসে, যার দরুণ তাদের সাথে ধর্মের অল্প কিছু অংশ থাকে, বা কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই বিষয়টির প্রতি সমর্থনদাতা অন্যতম আলেম হলেন হাম্বলী মযহাবের ইবনুল জাওযী, যিনি হযরত মারূফ আল-কারখী (রহ:) ও হযরত রাবেয়া আল-আদাউইয়্যা (রহ:)-এর জীবনী রচনার জন্যে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর ‘তালবিস ইবলিস’ গ্রন্থের (বৈরুত, ১৪০৩ হিজরী, ৮৮ পৃষ্ঠায়) ‘খারেজীদের প্রতি শয়তানী বিভ্রমের উল্লেখ’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি উপরোক্ত হাদীসখানি উদ্ধৃত করে লিখেন: “এই লোকের নাম যুল-খোয়াইসারা আত্ তামিমী। ইসলামে সে-ই প্রথম খারেজী। তার দোষ ছিল নিজ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সন্তুষ্ট থাকা; সে যদি (বে-আদবি থেকে) বিরত থাকতো, তবে সে উপলব্ধি করতে পারতো যে মহানবী (দ:)-এর দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো অভিমত নেই।”
ইবনুল জাওযী এরপর খারেজী আন্দোলনের প্রসারসম্পর্কিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন, পাশাপাশি তামিম গোত্রের মুখ্য ভূমিকা সম্পর্কেও লিখেন। তিনি বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় বলেন, “(সুন্নীদের বিরুদ্ধে হারুরা) যুদ্ধে সেনাপতি ছিল শাবিব ইবনে রাবী’ আত্ তামিমী।” তিনি ৯২ পৃষ্ঠায় আরও বলেন, “আমর ইবনে বকর আত্ তামিমী হযরত উমর (রা:)-কে হত্যা করতে সম্মত হয়েছিল।” খারেজীদের শিবিরে কুরআন তেলাওয়াতের তৎপরতার কারণে মৌচাকের মতো শব্দ হলেও সেখানেই আবার এই ধরনের গোপন ষড়যন্ত্র চলেছিল (৯১ পৃষ্ঠা, ‘তালবিস ইবলিস’)।
মূল খারেজী বিদ্রোহ আরম্ভ হয় সিফফিনের সালিশে, যখন প্রাথমিক যুগের ভিন্ন মতাবলম্বীরা হযরত আলী (ক:)-এর সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করেছিল। তাদের একজন ছিল আবূ বিলাল মিরদাস্, তামিম গোত্রেরই সদস্য (ইবনে হাযম, ২২৩); নিয়মিত নামায ও কুরআন তেলাওয়াত সত্ত্বেও সে এক নিষ্ঠুর খারেজী ধর্মান্ধে পরিণত হয়। ‘তাহকিম’ তথা ‘আল্লাহর আইন ছাড়া কোনো বিধান নেই’ (ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ), যা পরবর্তীকালে খারেজী দাওয়া’ কার্যক্রমের স্লোগানে রূপান্তরিত হয়, ওই ফর্মূলার প্রথম প্রবর্তনকারী হিসেবে তাকেই স্মরণ করা হয়।
ইমাম আবদুল কাহির আল-বাগদাদী খারেজী বিদ্রোহ সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘ বিশ্লেষণে এর সাথে তামিম গোত্রের ঘনিষ্ঠ এবং মধ্য-আরব অঞ্চলের অধিবাসীদের সার্বিক সংশ্লিষ্টতার বর্ণনাও লিপিবদ্ধ করেন; তিনি এও উল্লেখ করেন যে ইয়েমেন ও হেজাযের গোত্রগুলো থেকে কেউই এই বিদ্রোহে সম্পৃক্ত হয় নি। তিনি যুল-খুয়াইসারার পরবর্তীকালের খারেজী তৎপরতার একটি বিবরণ তাঁর বইয়ে দিয়েছেন। হযরত আলী (ক:)-এর সামনে ধরে আনা হলে সে বলে, “ইবনে আবি তালেব! আমি শুধু আপনার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আল্লাহ ও পরকালেরই খাতিরে!” হযরত আলী (ক:) জবাবে বলেন, “না, তুমি ওদের মতোই যাদের সম্পর্কে আল্লাহ এরশাদ ফরমান - ‘হে রাসূল বলুন: আমি কি তোমাদের বলে দেবো সর্বাপেক্ষা অধিক মূল্যহীন কর্ম কাদের? তাদেরই, যাদের সমস্ত প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনেই হারিয়ে গেছে এবং তারা এ ধারণায় রয়েছে যে তারা সৎকর্ম করছে’ (সূরা কাহাফ, ১০৩)।” [ইমাম আবদুল কাহির আল-বাগদাদী কৃত ‘আল-ফারক্ক বাইন আল-ফিরাক্ক’, কায়রো (তারিখবিহীন), ৮০ পৃষ্ঠা; যুল-খোয়াইসারার পূর্ণ সনাক্তকরণের জন্যে ওই বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠা দেখুন]
প্রাথমিক যুগের খারেজী বিদ্রোহগুলো, যা নিরীহ, নিরপরাধ মুসলমানদের দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডে পরিপূর্ণ ছিল, তার বিবরণ দেয়ার সময় ইমাম আবদুল কাহির পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন যে প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ খারেজী বিদ্রোহের নেতা-ই নজদ অঞ্চল থেকে এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ, সবচেয়ে ভয়ংকর ও ব্যাপকতা লাভকারী ‘আযারিকা’ নামের খারেজী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় নাফী’ আল-আযরাক; এই লোক ছিল মধ্য-আরব অঞ্চলের বনূ হানিফা গোত্রভুক্ত (ইমাম আবদুল কাহির, ৮২ পৃষ্ঠা)। ইমাম সাহেব লিপিবদ্ধ করেন, “নাফী’ ও তার অনুসারীরা মনে করতো যারা তাদের বিরোধিতা করে, তাদের এলাকা দারুল কুফর (বৈরী দেশ); তাই ওখানে বিরোধীদের নারী ও শিশুকে হত্যা করা বৈধ...আযারিকা খারেজীরা আরও বলতো, আমাদের বিরোধীরা মুশরিক (মূর্তি পূজারী), তাই তাদের কোনো আমানত আমরা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নই” (ইমাম আবদুল কাহির, ৮৪ পৃষ্ঠা)। যুদ্ধে আল-আযরাকের মৃত্যুর পর আযারিকা বিদ্রোহীরা উবায়দুল্লাহ ইবনে মা’মুন আত্ তামিমীর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। আল-মোহাল্লাব এরপর আহওয়ায এলাকায় তাদের মোকাবেলা করেন, যেখানে উবায়দুল্লাহ ইবনে মা’মুন আত্ তামিমী নিজেও মারা যায়; আর তার সাথে মারা পড়ে তার ভাই ইবনে মা’মুন এবং আযারিকার তিন’শ সবচেয়ে ধর্মান্ধ ও উগ্র খারেজী। বাকি আযারিকা খারেজীরা আয়দাজ অঞ্চলে পশ্চাদপসারণ করে, যেখানে তারা কাতারী ইবনে আল-ফুজা’আর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। ইবনে ফুজা’আকে তারা আমীরুল মো’মেনীন বলে সম্বোধন করতো (ইমাম আবদুল কাহির, ৮৫-৬ পৃষ্ঠা)। ইমাম সাহেবের বইয়ের ব্যাখ্যাকারী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ইবনে ফুজা’আ-ও তামিম গোত্রভুক্ত ছিল (পৃষ্ঠা ৮৬)।
আযারিকা-খারেজী মতবাদ গ্রহণ না করার জন্যে শত-সহস্র মুসলমান হত্যাকারী এই গোত্রের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল খারেজী নজদীয়া অংশে। এদের নামকরণ হয়েছিল নজদা ইবনে আমীরের অনুসরণে, যে ব্যক্তি হানিফা গোত্রভুক্ত ছিল; এই গোত্রের আবাসভূমিও নজদ অঞ্চলে। নজদা নিজেও নজদ এলাকার অন্তর্গত এয়ামামায় তার সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে। [ইমাম আবদুল কাহির, ৮৭]
সকল যুগের খারেজী মতবাদীদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নজদীয়া অংশও বিরোধী মতের প্রতি তাদের অসহিষ্ণুতা থেকে সৃষ্ট উত্তপ্ত বিতর্কের কারণে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই ধর্মীয় মতবাদগত বিরোধের কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মদীনা মোনাওয়ারায় খারেজী আক্রমণ, যা’তে অনেক বন্দী নেয়া হয়; এ ছাড়াও বন্দী অ-খারেজী মুসলমান নারীদের সাথে যৌনসম্পর্কের ব্যাপারে বিভিন্ন খারেজী এজতেহাদের দরুন ওই বিরোধ দানা বাঁধে। এই বিভক্তি থেকে তিনটি প্রধান উপদলের সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক উপদলটির নেতৃত্ব দেয় বনূ হানিফা গোত্রভুক্ত আতিয়্যা ইবনে আল-আসওয়াদ। নজদার মৃত্যুর পরপরই তার দলটিও তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার একটি উপদল বসরার আশপাশ এলাকা আক্রমণের জন্যে নজদ ত্যাগ করে। [ইমাম আবদুল কাহির, ৯০-১]
খারেজীদের শেষ বড় দলটির নাম এবাদিয়্যা, যেটি আজও অধিকতর শান্ত ও খর্বকায় আকৃতিতে জানজিবার, দক্ষিণ আলজেরিয়া ও ওমানে টিকে আছে। এর স্থপতি ছিল আরেক তামিম গোত্রভুক্ত আবদুল্লাহ ইবনে এ’বাদ। এই মতবাদ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল যা জানা যায় তা হলো, তাদের দৃষ্টিতে অ-এবাদী মুসলমানগণ কুফফার; তাঁরা মো’মেন (বিশ্বাসী) নন। তবে তাঁরা মুশরিক বা বহু উপাস্যে বিশ্বাসীও নন। “অ-এবাদী মুসলমানদের গুপ্তহত্যা তারা নিষেধ করে, কিন্তু প্রকাশ্য যুদ্ধকে অনুমোদন করে। তারা অ-এবাদী মুসলমানদের সাথে বিবাহ-সম্পর্কের অনুমতি দেয়, এবং তাঁদের উত্তরাধিকার নেয়াকেও অনুমতি দেয়। এবাদীরা দাবি করে যে আল্লাহ ও রাসূল (দ:)-এর পক্ষে জেহাদে সাহায্য হিসেবে এগুলো করা যায়।” [ইমাম আবদুল কাহির, ১০৩]
খারেজীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নারী ছিল বনূ তামিম গোত্রভুক্ত কুতাম বিনতে আলকামা। সে পরিচিত এই কারণে যে, সে তার জামাই ইবনে মুলজামকে বলেছিল, “আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবো আমারই আরোপিত মোহরানার ভিত্তিতে; আর তা হলো তিন হাজার দিরহাম, একজন পুরুষ গোলাম ও একজন মহিলা বাঁদী, আর (হযরত) আলী (ক:)-এর হত্যা!” ইবনে মুলজাম বলে, “তুমি এর সবই পাবে; কিন্তু হযরত আলী (ক:)-কে কীভাবে হত্যা করবো?” কুতাম জবাব দেয়, “অতর্কিত হামলায় তাকে হত্যা করো। তুমি বেঁচে গেলে মানুষজনকে বদমাইশির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং তোমার স্ত্রীর সাথেও বসবাস করবে; আর যদি তুমি এই প্রচেষ্টায় মারা যাও তবে চিরশান্তির স্থান বেহেশতে যাবে” (মুবাররাদ, ২৭)। সবাই জানেন, ইবনে মুলজাম কর্তৃক কুফার মসজিদে হযরত আলী (ক:)-কে ছুরিকাঘাতে হত্যার করার পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
মুসলমান সর্বসাধারণ যাঁরা অতীতের এই সন্তাপজনক ভুল-ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না, তাঁরা এই ঘটনাপ্রবাহের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে ঘভীরভাবে ভাবতে অবশ্যই চাইবেন। সহস্র সহস্র মুসলমান যারা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি ছিল নিবেদিত ও ধর্ম অনুশীলনে বিশিষ্ট, তারা এতদসত্ত্বেও খারেজী প্রলোভনের শিকারে পরিণত হয়। উলেমাবৃন্দ এই প্রলোভনের উৎস হিসেবে যুল-খোয়াইসারার ঘটনাকে খুঁজে পান, যে ব্যক্তি নিজেকে মহানবী (দ:)-এর চেয়েও উত্তম মুসলমান মনে করেছিল। আর সে অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ খারেজী নেতার মতোই বনূ তামিম গোত্রভুক্ত ছিল। অ-তামিমী খারেজী নেতাদেরও প্রায় সবাই নজদ অঞ্চল থেকে এসেছিল।
রিদ্দা: প্রথম ফিতনা
নজদ সম্পর্কে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে আরেকটি বিষয় তাঁরা বিবেচনায় নিতে চাইবেন। এটি মহানবী (দ:)-এর বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্তির পরে নজদীদের আচরণ সংক্রান্ত। ইতিহাসবিদগণ সাক্ষ্য দেন যে হযরত আবূ বকর (রা:)-এর খেলাফত আমলে যাকাত দেয়ার ব্যাপারে যতো বিদ্রোহ হয়েছে, তার অধিকাংশই নজদীদের দ্বারা সংঘটিত। উপরন্তু, আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অনেক নজদী বিদ্রোহ-ই অদ্ভূত ইসলামবিরোধী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাতি পায় যে বিদ্রোহটি, তা নবী দাবিদার ভণ্ড মুসাইলামার নেতৃত্বে হয়েছিল; এই লোক একটি পাল্টা শরীয়ত দাঁড় করিয়েছিল, যা’তে দৃশ্যতঃ অন্তর্ভুক্ত ছিল রোযা ও ইসলামী খাদ্যাভ্যাসের মতো মুসলিম আচার ও প্রথা। সে নামাযের ইসলামী বিধান মানতো, তবে ফজর ও এশা’র নামায বিলোপ করেছিল। তার তথাকথিত একটি ‘ঐশী বাণী’ ব্যক্ত করে:
বনূ তামিম এক পবিত্র গোত্র,
স্বাধীন ও ত্রুটিমুক্ত,
যাকাত থেকে তারা মওকুফপ্রাপ্ত।
আমরা হবো তাদের রক্ষাকারী মিত্র,
যতোদিন বাঁচি, রাখবো তাদের সাথে বন্ধুত্ব!
যে কারো থেকে তাদের রাখবো সুরক্ষিত,
আর আমাদের মরণকালে তারা ’রহমানের’ হেফাযতপ্রাপ্ত।
[ইমাম তাবারী কৃত ‘তারিখ আল-রুসূল ওয়াল-মুলূক’, বৈরুত, ১৪০৭ হিজরী, ২য় খণ্ড, ২৭৬ পৃষ্ঠা]
মুসাইলামা ছিল একজন বাগ্মী। ফলে মধ্য আরব অঞ্চলে তার অনেক অনুসারী জুটে যায়। তবে ইতিহাসবিদগণ লিখেন যে মহানবী (দ:)-এর মো’জেযা (অলৌকিক ক্ষমতা) যখনই সে অনুকরণ করতে চাইতো, অমনি বিপর্যয় নেমে আসতো। তার কাছে নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আনা অসুস্থ শিশুরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়তো। তার ওযু করা পানি ফসলের ওপর ছিটালে জমি উর্বরতা হারাতো। তার ব্যবহৃত কূপগুলোর পানি লবণাক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু গোত্রীয় প্রভাবের কারণে অনেকে এ সব বিষয় আমলেই নেয় নি।
তালহা আল-নামারী নজদে এসে জিজ্ঞেস করে, “মুসাইলামা কোথায়?” এ কথা শুনে মানুষেরা তাকে বলে, “সাবধান! তাকে আল্লাহর রাসূল বলে ডাকো।” তালহা জবাব দেয়, “তাকে না দেখা পর্যন্ত ওই খেতাবে ডাকবো না।” অতঃপর মুসাইলামার সামনে উপস্থিত হলে সে জিজ্ঞেস করে, “মুসাইলামা কি তুমি?” সে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ।” তালহা জিজ্ঞেস করে, “তোমার কাছে কে আগমন করেন?” মুসাইলামা জবাবে বলে, “আল-রহমান।” তালহা আবার জিজ্ঞেস করে, “তিনি কি আলোতে আসেন, না অন্ধকারে?” জবাবে মুসাইলামা বলে, “অন্ধকারে।” এমতাবস্থায় তালহা বলে, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি মিথ্যেবাদী এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-ই সত্যবাদী। কিন্তু আমার কাছে তোমার গোত্রের মিথ্যেবাদীও তাঁর গোত্রের সত্যবাদীর চেয়ে প্রিয়ভাজন।” এরপর সে মুসাইলামা আল-কাযযাবের বাহিনীতে যোগ দেয় এবং আক্করাবার যুদ্ধে নিহত হয়। [তাবারী, ২য় খণ্ড, ২৭৭ পৃষ্ঠা]
এ ধরনের ঘটনা দুটো বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে। প্রথমতঃ এতে মুসাইলামার ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তার মতে, আল্লাহ আকৃতিসম্পন্ন যিনি ‘আসতে’ পারেন। দ্বিতীয়তঃ এতে অন্ধ অনুসরণের আরব গোত্রীয় প্রভাব ও প্রতাপ-প্রতিপত্তির দিকটিও পরিস্ফুট হয়, যা তখনো বিরাজমান ছিল।
বিরোধী ধর্মমতের নেতা হিসেবে মুসাইলামা ও তার নজদী উগ্রবাদীরা ‘বাগী’ তথা ধর্মে ফিতনা সৃষ্টিকারী ও খলীফার কর্তৃত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়; আর তাই হযরত আবূ বকর (রা:) তাদেরকে দমনের উদ্দেশ্যে সেনাপতি হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা:)-এর অধীনে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। হিজরী ১২ সালে হযরত খালেদ (রা:) আল-আকরাবার যুদ্ধে নজদীদেরকে পরাজিত করেন। যুদ্ধের এই স্থানটি ছিল দেয়ালঘেরা একটি বাগান এবং এখানেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নজদীদের হাতে শত শত সাহাবী (রা:) শহীদ হওয়ায় আমাদের ইতিহাসবিদদের কাছে এটি ‘মৃত্যু বাগিচা’ নামে পরিচিত হয়েছে। এই যুদ্ধ ছিল প্রাচীন আরব গোত্রবাদের বিরুদ্ধে সমান অধিকারের পক্ষাবলম্বনকারী ইসলাম ধর্মের, যে বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে এই ঘটনায় যে মোহাজির সাহাবী (রা:)-দের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্রীতদাস হতে মুক্তিপ্রাপ্ত পারসিক সাহাবী হযরত সেলিম (রা:); আর আনসার সাহাবী (রা:)-দের পতাকা উচুঁ করে ধরেছিলেন হযরত সাবেত ইবনে কায়েস (রা:)। মুসলমানদের রণহুংকার কোনো গোত্র বা পূর্বপুরুষের নামে ছিল না, বরং তা ছিল ‘এয়া মোহাম্মদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম (তাবারী, ২৮১)। নবী দাবিদার ভণ্ড মুসাইলামাকে হত্যা করেন ক্রীতদাস ইথিয়পীয় সাহাবী হযরত ওয়াহশি (রা:)। যদিও তিনি ইতিপূর্বে মহানবী (দ:)-এর চাচা হযরত আমীরে হামযা ইবনে আব্দিল মোত্তালিব (রা:)-কে ওহুদের জ্বিহাদে শহীদ করেন, তবুও তিনি পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মে দাখিল হন এবং একজন সম্মানিত উম্মত হিসেবে পরিচিতি পান। আরবীয় সমাজের কাছে নিচু জাত বলে বিবেচিত একজন আফ্রিকী বংশোদ্ভূত ব্যক্তির দ্বারা নজদীদের গর্বের ‘নবী’কে হত্যা করার ব্যাপারটি ইসলামী সমতাবাদী নীতি-আদর্শের একটি শক্তিশালী প্রতীক ছিল। [দেখুন আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে কুতায়বা রচিত ‘কিতাব আল-মা’আরিফ’, কায়রো, ১৯৬০ ইং সংস্করণ, ২০৬ পৃষ্ঠা; আহমদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-বালাদুরী প্রণীত ‘ফুতুহ আল-বুলদান’, বৈরুত, পুনঃমুদ্রিত, তারিখবিহীন, ৮৬ পৃষ্ঠা]
তথাপিও মুসাইলামা আল-কাযযাবের প্রতি অন্ধ ভক্তি মধ্য আরব অঞ্চলে টিকে যায়। নজদীদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে একখানা বর্ণনা দিয়েছেন অ-মুসলমান পর্যটক পালগ্রেভ (Palgrave)। তিনি ১৮৬২ সালে এসে দেখতে পান যে, এতো বছর পরও কিছু কিছু নজদী গোত্রভুক্ত লোক মুসাইলামাকে নবী হিসেবে শ্রদ্ধা করে। [ডব্লিউ, পালগ্রেভ প্রণীত ‘ন্যারেটিভ অফ আ ইয়ারস্ জার্নী থ্রু সেন্ট্রাল এ্যান্ড ইস্টার্ন এ্যারাবিয়া’ (মধ্য ও পূর্ব আরবে এক বছরব্যাপী যাত্রার বিবরণ), লণ্ডন, ১৮৬৫, ১ম খণ্ড, ৩৮২ পৃষ্ঠা]
ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে নজদী বিদ্রোহের অপর এক হোতা ছিল সাজাহ নাম্নী এক নারী, যার আসল নাম ছিল উম্মে সাদির বিনতে আউস। সেও তামিম গোত্রীয় ছিল। এই নারী এমন রব্ব তথা প্রভুর নামে ‘নবী’ দাবি করে, যে প্রভু ‘মেঘে’ অবস্থান করে; সে ‘ওহী’ বা ’ঐশী বাণী’ প্রকাশ করে তামিম গোত্রের কিছু অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়। ওই সময় তামিমদের এই অংশ মদীনায় কায়েম হওয়া খেলাফতের কর্তৃত্ব কতোখানি প্রত্যাখ্যান করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে জড়িত ছিল। যে সকল গোত্র ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু যুদ্ধ পরিচালনার পর এই নজদী ভণ্ড নারী অপর ভণ্ড মুসাইলামার সাথে জোট বাঁধে। এ ছাড়া তার পরিণতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। [ইবনে কুতায়বা রচিত ‘মা’আরিফ’, ৪০৫ পৃষ্ঠা; বালাদুরী কৃত ‘ফুতুহ’, ৯৯-১০০ পৃষ্ঠা]
সাম্প্রতিক নজদী প্রবণতা
এ কথা সর্বজনবিদিত যে নজদী সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব বনূ তামিম গোত্রভুক্ত ছিল। তার নাম বহনকারী এই আন্দোলেনের সাথে যে সহিংসতা ও ‘তাকফির’ (মুসলমানদেরকে কাফের ফতোওয়া) সম্পৃক্ত রয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে প্রাচীন নজদের তামিমী খারেজী নীতি ও মানসিকতার সাথে কাকতালীয় মিলের চেয়েও বেশি কিছু হবে। যেমন বিবেচনা করুন, এপ্রিল ১৮০১ খৃষ্টাব্দে কারবালায় সংঘটিত শিয়া গণহত্যা, যা জনৈক ওহাবী ইতিহাসবিদ বর্ণনা করেছে:
”সউদ তার বিজয়ী সৈন্যবাহিনী, উন্নত জাতের ঘোড়া এবং নজদের সকল স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানুষ ও বেদুঈন (যাযাবর)-কে সাথে নিয়ে কারবালা গমন করে।....মুসলমানরা (অর্থাৎ, ওহাবীরা) কারবালা ঘেরাও করে এবং ঝড়ের বেগে শহরটির দখল নেয়। বাজার ও বাসা-বাড়িতে তারা বেশির ভাগ মানুষকে হত্যা করে। সেখানে লুণ্ঠনকৃত মালামালের সংখ্যা কেউ গুণে শেষ করতে পারবে না। তারা শুধু একটি সকাল সেখানে কাটিয়েছিল, এবং দুপুরে সমস্ত মালামাল নিয়ে স্থান ত্যাগ করেছিল। কারবালায় প্রায় দুই হাজার মানুষকে ওই সময় হত্যা করা হয়।” [উসমান ইবনে বিশর কৃত ‘উনওয়ান আল-মাজদ ফী তারিখে নজদ’, মক্কা ১৩৪৯ হিজরী, ১ম খণ্ড, ১২১-১২২ পৃষ্ঠা]
এই হামলা ও এটি অর্জনে সংঘটিত নৃশংসতা এবং এক হাজার বছর আগে একই এলাকায় পরিচালিত খারেজী আক্রমণের মধ্যে পার্থক্য করা দুষ্কর। মোহাম্মদ ফিনাতি নামে এক ধর্মান্তরিত ইতালীয় মুসলমান, যিনি ওহাবীদের ওপর বিজয়ী উসমানীয় তুর্কী খেলাফতের সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, তিনি সীমাহীন নজদী বর্বরতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর একখানা বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। উদাহরণস্বরূপ, তাতে তিনি লিখেন:
“আমাদের মধ্যে কিছু সৈন্য জীবিতাবস্থায় এ সব নিষ্ঠুর ধর্মান্ধের হাতে আটক হন; তাঁদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হাত-পা তারা (নজদীরা) এমন পৈশাচিকভাবে কেটে বিকৃত করে এবং সেই অবস্থায় মরতে ফেলে রেখে যায় যে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, আমরা যখন (যুদ্ধশেষে) ফিরে আসছিলাম তখন এই (অসহায়) মানুষগুলোর আমাদের কাছে একমাত্র চাওয়া-পাওয়া ছিল যেন আমরা তাঁদের জীবনাবসান ঘটাই।” [জি, ফিনাতি প্রণীত ’ন্যারেটিভ অফ দ্য লাইফ এ্যান্ড এ্যাডভেনচারস অফ জিওভানি ফিনাতি’ (আত্মজীবনী ও অভিযানের বর্ণনা), লণ্ডন, ১৮৩০ ইং, ১ম খণ্ড, ২৮৭ পৃষ্ঠা]
এ কথা কখনো কখনো দাবি করা হয় যে, ’নজদের সব অ-যাযাবর ও যাযাবর (বেদুঈন) লোক’দের দ্বারা খুশি মনে এই ধরনের গণহত্যা সংঘটনের দিনগুলো অনেক পেছনে ফেলে আসা হয়েছে এবং ওহাবীবাদ এখন আরও উদারনৈতিক। কিন্তু আরও সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ এর বিপরীত কথাই বলছে। ওহাবী সৈন্যবাহিনী ১৯২৪ সালে তায়েফ নগরী দখল করে তিন দিন যাবত লুঠপাট চালায়। এই সময় প্রধান কাজী (বিচারক) ও উলেমাবৃন্দকে তাঁদের বাসা থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনা হয় এবং হত্যা করা হয়; কয়েক’শ সাধারণ নাগরিককেও একইভাবে হত্যা করা হয় [ইবনে হিযলুল রচিত ‘তারিখে মুলূক আল-সউদ’, রিয়াদ, ১৯৬১, ১৫১-৩ পৃষ্ঠা]। হেজাযের সুন্নী জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদের একখানা শিক্ষা দিয়ে ‘বৃটেনের মৌন সমর্থনে ইবনে সউদ মক্কা দখল করে নেয়’ [আলেক্সেই ভ্যাসিলিয়েভ প্রণীত ‘সউদী আরবের ইতিহাস’, লণ্ডন, ১৯৯৮, ২৬৪ পৃষ্ঠা]।
উপসংহার
সালাফ আস্ সালেহীনের (প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের) সময়কাল থেকেই নজদ ও তামিম গোত্র সম্পর্কে বিস্তর দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমরা যদি নজদীদের অনুসৃত পদ্ধতি বর্জন করি, যে পদ্ধতিটি কিছু বেছে নেয়া হাদীসের উদ্ধৃতির পাশাপাশি মধ্যযুগের শেষলগ্নের কতিপয় ব্যাখ্যাকারীর ব্যক্ত মতামতের অন্ধ অনুসরণ ছাড়া কিছু নয়, তাহলে আমরা মধ্য আরব অঞ্চল ও এর অধিবাসীদের সম্পর্কে কিছু যৌক্তিক ও দলিলভিত্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে সক্ষম হবো। কুরআন মজীদ, সহীহ (বিশুদ্ধ) হাদীস ও সালাফ আস্ সালেহীনের অভিজ্ঞতা একচেটিয়াভাবে প্রমাণ করে যে মধ্য আরব অঞ্চল একটি ফিতনা-ফাসাদের এলাকা। ইসালামের সর্বপ্রথম ফিতনা সেখান থেকেই জাগ্রত হয়, যা ছিল যুল-খোয়াইসারা ও তার মতো লোকদের ঔদ্ধত্য; আর এ ছাড়াও ভণ্ড নবীদের গোমরাহী ও তাদের প্রতি ভক্তি হযরত আবূ বকর (রা:)-এর খেলাফতের জন্যে কঠিন সময় ছিল। এর অব্যবহিত পরেই নজদী শেকড় থেকে গজানো খারেজী গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা) ইসলামী ইতিহাসের সূচনালগ্নে মুসলমানদের মাঝে বিভক্তির কালো ছায়া ফেলে, যার দরুন তাঁদের সৈন্যবাহিনী বিজিনটিন সাম্রাজ্য জয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারে নি; অধিকন্তু, এই ফিতনা প্রাথমিক যুগের মুসলমান প্রজন্মগুলোর মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ, সন্দেহ ও তিক্ততার বীজ বপণ করে। এই প্রামাণ্য দলিল, যেটি নির্মল ও খাঁটি সালাফবৃন্দ বর্ণনা করেছেন, তাকে এড়িয়ে যেতে পারে একমাত্র একগুঁয়ে, চোখে ঠুলি বসানো ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সেই সব নজদী সমর্থক, যারা বারংবার এই প্রতারণার আশ্রয় নিতে চায় যে নজদ ও তার পথভ্রষ্টতা, বাহ্যিক ধর্মপালনে কঠোরতা যা ওই অঞ্চলে পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়ে চলেছে, তা কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত এলাকা।
আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভাল জানেন। তিনি এই উম্মাহকে ধর্মীয় একগুঁয়েমি প্রত্যাখ্যানকারী সালাফ আস্ সালেহীনের প্রতি মহব্বতের মাধ্যমে একতাবদ্ধ করুন। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে খারেজী মতবাদের ফাঁদ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের এই যুগে যারা এই ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তাদেরকেও হেফাযত করুন, আমীন।
সমাপ্ত
মূল: হিশাম স্কাল্লি
(সুন্নী ডিফেন্স লীগ, লাদজনাত আল-দিফা’আ আ’ন আস্ সুন্নাহ আল-মোতাহহারাহ, মিলান, ইতালী)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
এই বিষয়টি লক্ষণীয় যে, অন্যান্য মুসলমান দেশে অসংখ্য অনন্য সাধারণ মোহাদ্দেসীন, মুফাসসেরীন, ব্যাকরণবিদ, ইতিহাসবিদ অথবা অাইনশাস্ত্রজ্ঞ তথা ইসলামী জ্ঞান বিশারদ পয়দা হলেও নজদ নামে পরিচিত অঞ্চলে অনুরূপ মহান কোনো আলেম-ই আবির্ভূত হন নি। এই প্রবন্ধটি খোলা মনের অধিকারী মুসলমানদের কাছে এই লক্ষণীয় বিষয়ের একটি ব্যাখ্যা প্রদানের উদ্যোগমাত্র।
নজদ অঞ্চলবিষয়ক হাদীস সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন
নজদ রাজ্য, যা দুই শতাব্দী যাবত ওহাবী মতবাদের মহাপরীক্ষার স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা এক গুচ্ছ কৌতূহলোদ্দীপক হাদীস ও প্রাথমিক (যুগের) রওয়ায়াতের বিষয়বস্তুতে আজ পরিণত, যেগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হলো ইমাম বোখারী (রহ:)-এর বর্ণনায় হযরত ইবনে উমর (রা:)-এর রওয়ায়াত, যা’তে তিনি বলেন: “রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, ‘এয়া আল্লাহ! আমাদের সিরিয়া (শাম) ও আমাদের ইয়েমেনদেশে বরকত দিন।’ সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) আরয করেন, ‘আমাদের নজদ অঞ্চলের জন্যেও (দোয়া করুন)?’ রাসূলুল্লাহ (দ:) আবার দোয়া করেন, ‘এয়া আল্লাহ! আমাদের শাম ও ইয়েমেনদেশে বরকত দিন।’ সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) আবারও আরয করেন, ‘আমাদের নজদ অঞ্চলের জন্যেও (দোয়া করুন)?’ তৃতীয়বারে আমার (ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু) মনে হলো তিনি বল্লেন, ‘ওখানে রয়েছে ভূমিকম্পসমূহ ও নানা ফিতনা (বিবাদ-বিসংবাদ), এবং সেখান থেকে উদিত হবে শয়তানের শিং (কারনুশ্ শয়তান)’।”
এই হাদীস স্পষ্টই নজদীদের কাছে হজম হবার মতো নয়, যাদের কেউ কেউ আজো অন্যান্য প্রসিদ্ধ অঞ্চলের মুসলমানদেরকে বোঝাতে অপতৎপর যে হাদীসটি যা স্পষ্ট বলছে তা তার আসল অর্থ নয়। এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের ব্যবহৃত একটি কূটচাল হলো এমন ধারণা দেয়া যা’তে ইরাককে নজদ অঞ্চলের সীমান্তে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। নজদীরা এই ধূর্ত চালের দ্বারা সিদ্ধান্ত টানে যে, হাদীসে কঠোরভাবে সমালোচিত নজদের অংশটি আসলে ইরাক, আর মূল নজদ এলাকা এই সমালোচনার বাইরে। মধ্যযুগের ইসলামী ভূগোলবিদগণ এই সহজাতভাবে অদ্ভূত ধারণার বিরোধিতা করেছেন (উদাহরণস্বরূপ দেখুন ইবনে খুররাদাযবিহ কৃত ‘আল-মাসালিক ওয়াল-মামালিক’, লেইডেন, ১৮৮৭, ১২৫ পৃষ্ঠা; ইবনে হাওকাল প্রণীত ‘কেতাব সুরত আল-আরদ’, বৈরুত ১৯৬৮, ১৮ পৃষ্ঠা)। তাঁরা (ভূগোলবিদগণ) নজদের উত্তর সীমানাকে ‘ওয়াদি আল-রুম্মা’ পর্যন্ত, অথবা আল-মাদা’ইনের দক্ষিণে অবস্থিত মরুভূমি পর্যন্ত চিহ্নিত করেন। কুফা ও বসরার মতো জায়গাগুলো, যেখানে কলহ-বিবাদের দ্বিতীয় ঢেউ উঠেছিল, সেগুলো প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মনে ‘নজদ’ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হবার কোনো ইঙ্গিত-ই এখানে নেই। পক্ষান্তরে, এই সব স্থান (কুফা, বসরা ইত্যাদি) সর্বক্ষেত্রে ইরাকের এলাকা হিসেবেই চিহ্নিত ছিল।
নজদ অঞ্চলবিষয়ক হাদীসটি সম্পর্কে সাধারণভাবে বোধগম্য যে অর্থ বিদ্যমান, নজদকে সেই প্রাথমিক যুগের উপলব্ধির আওতামুক্ত রাখতে বর্তমানকালের নজদীপন্থী লেখকেরা যথেষ্ট উদ্ভাবনী ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কতিপয় আত্মপক্ষ সমর্থনকারী এই হাদীসটিকে বেশ কিছু হাদীসের সাথে মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন, যেগুলোতে ‘শয়তানের শিং’-কে ‘পূর্বাঞ্চলের’ সাথে সম্পৃক্ত করা হয়; পূর্বাঞ্চল বলতে সাধারণতঃ ইরাককে বোঝায়। মধ্যযুগের শেষলগ্নের কিছু ব্যাখ্যা এই ধারণার বশবর্তী হলেও আধুনিক ভৌগোলিক জ্ঞান স্পষ্টতঃ এই ধারণাকে নাকচ করে দেয়। আধুনিক মানচিত্রের (গোলকের) দিকে এক নজর বুলালেই পরিদৃষ্ট হবে যে মদীনা মোনাওয়ারা থেকে পূর্ব দিকে টানা এক সরল-রেখা ইরাকের ধারে-কাছে কোথাও যায় না, বরং রিয়াদের কিছুটা দক্ষিণে স্থিত হয়। অর্থাৎ, নজদ অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত হয়। অতএব, এ প্রসঙ্গে যে সব হাদীসে ‘পূর্বাঞ্চলের’ কথা উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলো নজদ অঞ্চলকেই ইঙ্গিত করে, ইরাককে নয়।
সুযোগ পেলেই নজদীপন্থী আত্মপক্ষ সমর্থনকারীরা আরবী ‘নজদ’ শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ তুলে ধরে; এ শব্দের মানে হলো ‘উঁচু স্থান’। তবে আবারও আধুনিক মানচিত্রের (গোলকের) শরণাপন্ন হলে এই বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা পাওয়া যায়। আজকের উত্তর ইরাক, যাকে বর্তমান শতাব্দীর আগ পর্যন্ত কোনো মুসলমান-ই ইরাকের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন নি (একে বলা হতো ‘আল-জাযিরা’), তার ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র ইরাক অঞ্চল-ই লক্ষণীয়ভাবে সমতল ও নিচু ভূমি; আজও এর অধিকাংশ এলাকা নিচু জলাভূমি, আর বাকি বাগদাদ পর্যন্ত বা তারও উত্তরে রয়েছে সমতল, নিচু মরু এলাকা বা কৃষি জমি। এর বিপরীতে নজদ অঞ্চল হলো বেশির ভাগই মালভূমি, যা’তে ’জাবাল শাম্মার’ পর্বতমালার উঁচু শৃঙ্গ ‘জাবাল তাঈয়ী’ (১৩০০ মিটার)-ও অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণ ইরাকের সমতল ভূমির প্রতি কীভাবে আরবীয়রা নিত্যনৈমিত্তিকভাবে প্রাকৃতিক বিবরণমূলক ‘উঁচু ভূমি’ সংজ্ঞাটি আরোপ করতে পারেন তা বোঝা এক্ষণে দুষ্কর। [এই একই এলাকা ১৯৯১ সালের ’উপসাগরীয় যুদ্ধ’ চলাকালে ট্যাংক-লড়াইয়ের উপযোগী হিসেবে প্রমাণিত হয়, আর এটি-ই রিয়াদের ‘ক্যাভেলিয়ার্স’ (রাজতন্ত্রপন্থী) ও ‘রাউন্ডহেডস্’ (গণতন্ত্রপন্থী)-দের মধ্যে দ্বন্দ্বের কুখ্যাত উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়]
নজদ অঞ্চলকে সহজভাবে সনাক্ত করা যায় হাদীসশাস্ত্র দ্বারা, যা’তে অসংখ্যবার নজদের কথা বিবৃত হয়েছে; আর এগুলোর সবই পরিষ্কারভাবে মধ্য আরব অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছে। কয়েক ডজন উদাহরণের মাঝে কিছু এখানে তুলে ধরা হলো: আবূ দাউদ শরীফ (সালাত আল-সফর, ১৫) বর্ণনা করে, “আমরা রাসূলুল্লাহ (দ:)-সহ নজদ অঞ্চলে যাই এবং ‘যাত আল-রিকা’ পৌঁছাই, যেখানে গাতফান (নজদী) গোত্রের একটি দলের সাথে তাঁর (দ:) দেখা হয়।” তিরমিযী শরীফে (হজ্জ্ব, ৫৭) মহানবী (দ:)-এর সাথে আরাফাতে এক নজদী প্রতিনিধিদলের দেখা হওয়ার বিবরণ রয়েছে (আরও দেখুন ইবনে মাজাহ, মানাসিক, ৫৭)। এ সব ক্ষেত্রের কোনোটিতেই সুন্নাহ থেকে এই আভাস পাওয়া যায় না যে ইরাক রাজ্য রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর ভাষ্যানুযায়ী নজদের অন্তর্গত ছিল।
হাদীসসমূহের এক গুচ্ছ থেকে আরও প্রামাণ্য দলিল পেশ করা যায়, যেগুলো হাজ্বীদের জন্যে ‘মিকাত’-স্থানগুলো চিহ্নিত করে। ইমাম নাসাঈ বর্ণিত একখানা হাদীসে (মানাসিক আল-হাজ্জ্ব, ২২) হযরত মা আয়েশা (রা:) ঘোষণা করেন, ’হুযূর পাক (দ:) মদীনাবাসীদের জন্যে যুল-হুলায়ফা-তে ‘মিকাত’-স্থান নির্ধারণ করেছেন, সিরিয়া ও মিসরবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন আল-জুহফাতে, ইরাকবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন যাত এরক-এ, নজদবাসীর জন্যে করেছেন কার্ন-এ, আর ইয়েমেনবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন এয়ালামলাম-এ।’ ইমাম মুসলিম-ও (হজ্জ্ব, ২) অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেন, ‘মদীনাবাসীর জন্যে হলো যুল-হুলায়ফা, অপর রাস্তার জন্যে এটি আল-জুহফা; ইরাকবাসীর জন্যে হলো যাত এরক, নজদবাসীর জন্যে কার্ন; আর ইয়েমেনবাসীর জন্যে এটি হলো এয়ালামলাম।’
এই হাদীসগুলো তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে যে মহানবী (দ:) নজদ ও ইরাকের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন, এমনই পার্থক্য যে তিনি এই দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্যে আলাদা আলাদা ’মিকাত’-স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে স্পষ্টতঃ ইরাক নজদ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
হাদীসে বর্ণিত নজদ
বহু আহাদীসে রাসূলে খোদা (দ:) বিভিন্ন দেশের প্রশংসা করেছেন। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, নজদ অঞ্চল মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার সবচেয়ে কাছের হলেও এ সব হাদীসের কোনোটিতেই নজদের প্রশংসা করা হয় নি। ওপরে উদ্ধৃত সর্বপ্রথম হাদীসটিতে সিরিয়া ও ইয়েমেন দেশের জন্যে দোয়া করার বেলায় মহানবী (দ:)-এর আগ্রহ পরিদৃষ্ট হয়; আর নজদের জন্যে দোয়া করার ক্ষেত্রে তাঁর জোর অসম্মতিও এতে প্রকাশ পায়। অধিকন্তু, যেখানেই নজদ অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতেই স্পষ্ট দেখা যায় সেটি সমস্যাসঙ্কুল এলাকা। উদাহরণস্বরূপ, নিম্নবর্ণিত সহীহ হাদীসটি বিবেচনা করুন:
হযরত আমর ইবনে আবাসা (রা:) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) একদিন ঘোড়া যাচাই-বাছাই করছিলেন; সাথে ছিল উবায়না ইবনে হিসন ইবনে বদর আল-ফাযারী। উবায়না মন্তব্য করে, ‘মানুষের মধ্যে সেরা তারাই, যারা নিজেদের তলোয়ার নিজেদের কাঁধেই বহন করে এবং বর্শা ঘোড়ার (পায়ে) বাঁধা সেলাইকৃত মোজার মধ্যে রাখে; আর যারা আলখাল্লা পরে। এরাই নজদের মানুষ।’ কিন্তু হুযূর পূর নূর (দ:) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তুমি মিথ্যে বলেছ! বরঞ্চ সেরা মানুষ হলো ইয়েমেনীরা। ঈমানদারী এক ইয়েমেনী, এই সেই ইয়েমেন যা’তে অন্তর্ভুক্ত লাখম, জুদাম ও আমিলা গোত্রগুলো....হারিস গোত্রের চেয়ে হাদ্রামওত সেরা; এক গোত্রের চেয়ে অপর গোত্র শ্রেয়; (আবার) আরেক গোত্র আরও মন্দ।....আমার প্রভু খোদাতা’লা কুরাইশ বংশকে অভিসম্পাত দিতে আমাকে আদেশ করেন, আর আমিও তাদের অভিসম্পাত দেই। কিন্তু এর পর তিনি তাদেরকে দু’বার আর্শীবাদ করতে নির্দেশ দেন, আর আমিও তা করি।......আল্লাহর দৃষ্টিতে কেয়ামত (পুনরুত্থান) দিবসে আসলাম ও গিফার গোত্র এবং তাদের সহযোগী জুহাইনা গোত্র আসাদ ও তামিম, গাতাফান ও হাওয়াযিন গোত্রগুলোর চেয়ে শ্রেয়।.....বেহেশ্তে সর্বাধিক সদস্য হবে ইয়েমেনী মাযহিজ ও মা’কুল গোত্রগুলোর’।” [সহীহ সনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও আত্ তাবারানী; আলী ইবনে আবি বকর আল-হায়সামী কৃত ‘মজমাউল যাওয়াইদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়াইদ’, কায়রো ১৩৫২ হিজরী, ১০ম খণ্ড, ৪৩ পৃষ্ঠায়ও উদ্ধৃত]
নজদের প্রশংসাকারী ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন, ‘তুমি মিথ্যেবাদী।’ উপরন্তু, তিনি কোথাও নজদের প্রশংসা করেন নি। অথচ এর বিপরীতে অন্যান্য অঞ্চলের প্রশংসাসূচক অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, হযরত উম্মে সালামা (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) অন্তিমলগ্নে নিম্নের আদেশ দেন, “আল্লাহর শপথ! তাঁরই দোহাই দিয়ে আমি তোমাদের বলছি, মিসরীয়দের ব্যাপারে তোমরা তাদের ওপর বিজয়ী হবে; আর তারাও তোমাদের সাহায্যকারী হবে আল্লাহর পথে।” [আত্ তাবারানী; আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ শ্রেণীভুক্ত, ‘মজমা’, ১০ খণ্ড, ৬৩ পৃষ্ঠা; মিসরীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানতে আরও দেখুন সহীহ মুসলিম, ইমাম নববী কৃত শরাহ, কায়রো ১৩৪৭ হিজরী, ১৬তম খণ্ড, ৯৬-৭ পৃষ্ঠা]
হযরত কায়স ইবনে সা’দ (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “তারকারাজি (আসমান) থেকেও যদি ঈমান দূর হয়ে যায়, তবুও ফারিস (পারস্য)-দেশের সন্তানেরা সেখানে তা পৌঁছে দেবে।” [আবূ এয়ালা ও আল-বাযযার উভয়ের ‘মুসনাদ’ গ্রন্থগুলো; সহীহ শ্রেণীভুক্ত করেছেন আল-হায়তামী নিজ ’মজমা’ পুস্তকে, ১০ম খণ্ড, ৬৪-৫ পৃষ্ঠা; আরও জানতে দেখুন ইমাম নববী প্রণীত শরহে মুসলিম, ১৬তম খণ্ড, ১০০ পৃষ্ঠা]
রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান, “সাকিনা তথা প্রশান্তি হেজায অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিরাজমান।” [আল-বাযযার, আল-হায়তামী কর্তৃক উদ্ধৃত, ১০ম খণ্ড, ৫৩ পৃষ্ঠা]
হযরত আবূদ্ দারদা (রহ:)-এর বর্ণনায় মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “তোমরা অনেক (মোজাহেদীন) যোদ্ধার দেখা পাবে। একটি বাহিনী সিরিয়ায়, আরেকটি মিসরে, অপর একটি ইরাকে, আবার একটি ইয়েমেনে” [আল-বাযযার ও তাবারানী; আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ শ্রেণীভুক্ত, মজমা’, ১০ম খণ্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা]। জ্বেহাদে স্বেচ্ছাসেবকদের আবাসস্থল হিসেবে এই সব অঞ্চলকে প্রশংসা করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান, “পরম করুণাময়ের ফেরেশতাকুল সিরিয়ার ওপর তাঁদের পাখা মেলেছেন।” [তাবারানী; মজমা’ গ্রন্থের ১০ম খণ্ডের ৬০পৃষ্ঠায় সহীহ হিসেবে শ্রেণীকরণ; আরও দেখুন তিরমিযীর ব্যাখ্যায় ইমাম মোহাম্মদ ইবনে আবদ্ আল-রহমান আল-মোবারকপুরী কৃত ‘তোহফাত আল-আহওয়াযী বি-শরহে জামে’ আল-তিরমিযী, ১০ম খণ্ড, ৪৫৪ পৃষ্ঠা; এতে তিনি এই হাদীসকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন]
আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন যে হুযূর পাক (দ:) এরশাদ ফরমান, “ইয়েমেনবাসী তোমাদের কাছে এসেছে। তাদের অন্তর কোমল, আত্মা আরও কোমল। ঈমানদারী এক ইয়েমেনী, আর জ্ঞান-প্রজ্ঞাও ইয়েমেনী।” [তিরমিযী, ফী ফযলিল ইয়ামান, নং-৪০২৮; মোবারকপুরী, ১০ম খণ্ড, ৪৩৫, ৪৩৭ পৃষ্ঠা - হাদীস হাসান সহীহ শ্রেণীভুক্ত; ৪৩৬ পৃষ্ঠায় ইমাম মোবারকপুরী উল্লেখ করেন যে আনসার সাহাবীদের পূর্বপুরুষগণ ইয়েমেন দেশ থেকে এসেছিলেন।]
মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “ইয়েমেনদেশের মানুষেরা পৃথিবীর বুকে সেরা মানব।” [আবূ এয়ালা ও আল-বাযযার; সহীহ শ্রেণীভুক্ত: আল-হায়তামী, ১০ম খণ্ড, ৫৪-৫ পৃষ্ঠা]
রাসূলে খোদা (দ:) আরবীয় গোত্রগুলোর কাছে তাঁর এক দূত/প্রতিনিধি প্রেরণ করেন, কিন্তু তারা তাঁকে অপমান ও মারধর করে। এমতাবস্থায় তিনি হুযূর পাক (দ:)-এর কাছে ফিরে এসে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁকে উত্তরে বলেন, “তুমি যদি ওমানের মানুষদের কাছে যেতে, তাহলে তারা তোমাকে অপমান করতো না, মারধরও করতো না।” [মুসলিম, ফযাইল আস্ সাহাবা, ৫৭ পৃষ্ঠা; দেখুন ইমাম নববীর শরাহ তথা ব্যাখ্যা, ১৬তম খণ্ড, ৯৮ পৃষ্ঠা, যা’তে তিনি মন্তব্য করেন, ‘এতে তাঁদের প্রশংসা ও মাহাত্ম্যের ইঙ্গিত রয়েছে।’]
ওপরের হাদীসগুলো অসংখ্য হাদীসের সংগ্রহশালা থেকে সংকলিত হয়েছে, যা’তে বিভিন্ন আশপাশ এলাকা সম্পর্কে মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা লিপিবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু আবারও বলতে হচ্ছে, নজদ অঞ্চল এগুলোর যে কোনোটি থেকে সন্নিকটে হলেও সেটি সম্পর্কে প্রশংসাসূচক হাদীস লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত।
নজদীরা নিজেরাই এই সত্যটি সম্পর্কে সাধারণভাবে জানে, তবে তারা এর প্রচার করে না। এটি স্পষ্ট যে, নজদ অঞ্চল সম্পর্কে একটিমাত্র প্রশংসাসূচক হাদীস বিদ্যমান থাকলেও তারা উম্মাহকে তা জানিয়ে দিতো। তাদের প্রদেশ সম্পর্কে মহানবী (দ:)-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিন্দাকে পাশ কাটানোর বা নিষ্ক্রিয় করার জন্যে তাদের কেউ কেউ হাদীসে উল্লেখিত এলাকার বিষয়টিকে মনোযোগ আকর্ষণের যোগ্য বলে স্বীকারই করে না, বরং নজদে বসবাসকারী গোত্র-উপগোত্রের বিভক্তির দিকেই নিজেদের মন্তব্যকে কেন্দ্রীভূত রাখে।
বনূ তামিম গোত্র
মধ্য আরব অঞ্চলের সর্বাধিক পরিচিত গোত্র হলো বনূ তামিম। প্রধান প্রধান আরব গোত্রগুলোর প্রশংসাসূচক অনেক হাদীস বিদ্যমান, যার মাত্রা ব্যক্ত করতে নিম্নের কয়েকটি উদাহরণের তালিকা পেশ করা হলো:
* রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান, “এয়া আল্লাহ, ‘আহমাস’ গোত্র ও এর ঘোড়াগুলো এবং মানুষজনকে সাত গুণ (আপনার) আশীর্বাদধন্য করুন।” [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল; আল-হায়তামী কৃত ‘মজমা’, ১০ম খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা; আল-হায়তামীর মতে এর বর্ণনাকারীরা সবাই আস্থাভাজন]
* হযরত গালিব বিন আবজুর (রা:) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর উপস্থিতিতে ’কায়স’ গোত্রের কথা উল্লেখ করলে তিনি এরশাদ ফরমান, ‘আল্লাহতা’লা কায়স গোত্রের প্রতি তাঁর রহমত নাযেল করুন।’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি কি কায়স গোত্রের জন্যে আল্লাহর রহমত কামনা করছেন?’ তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, সে আল্লাহর পেয়ারা ও আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম (আ:)-এর ধর্ম অনুসরণ করেছে। কায়স, আমাদের ইয়েমেনকে অভিবাদন জানাও! ইয়েমেন, আমাদের কায়সকে অভিবাদন জানাও! কায়স হলো পৃথিবীর বুকে আল্লাহতা’লার অশ্বারোহী বাহিনী’।” [আত্ তাবারানী; আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ ঘোষিত, ১০ খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা]
* হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “আযদ গোত্রের মানুষেরা কতোই না উত্তম! মিষ্টভাষী, ওয়াদা পূরণকারী ও নির্মল (পরিষ্কার) অন্তর!” [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল; হাসান এসনাদ বলে সমর্থন করেন আল-হায়তামী, ১০ খণ্ড, ৪৯ পৃষ্ঠা]
* হযরত আনাস বিন মালেক (রা:) বলেন, “আমরা যদি আযদ গোত্র হতে (আবির্ভূত) না হই, তবে আমরা মনুষ্য জাতি হতে নই।” [তিরমিযী কৃত ‘মানাকিব’ ৭২ পৃষ্ঠা; হাসান গরিব সহীহ হিসেবে সমর্থন করেছেন মোবারকপুরী, ১০ খণ্ড, ৪৩৯ পৃষ্ঠা]
* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, “আমি প্রত্যক্ষ করি যে মহানবী (দ:) ’নাখ’ গোত্রের জন্যে দোয়া করেন।” অথবা তিনি (ইবনে মাসউদ) বলেন, “হুযূর পাক (দ:) তাদের এমন প্রশংসা করেন যে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ’নাখ’ গোত্রের সদস্য হই।” [আহমদ ইবনে হাম্বল; সহীহ এসনাদ বলে সমর্থন করেন আল-হায়তামী, ১০ম খণ্ড, ৫১ পৃষ্ঠা]
* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে বলতে শুনেছি ‘এই খেলাফত থাকবে কুরাইশ গোত্রের অধীন। তারা যতোদিন ধর্ম কায়েম রাখবে, কেউ তাদের বিরোধিতা করলে আল্লাহ তাকে মুখ উপুড় করে (মাটিতে) ছুঁড়ে ফেলে দেবেন’।” [বোখারী, মানাকিব, ২য় পৃষ্ঠা]
যে হাদীসে দৃশ্যতঃ তামিম গোত্রকে প্রশংসা করা হয়েছে, তা ব্যতিক্রমী নয়, এবং তাতে অন্যান্য গোত্রের ওপর তামিমের শ্রেষ্ঠত্ব কোনোভাবে কল্পনাও করা যায় না। বস্তুতঃ বিভিন্ন গোত্রের গুণের প্রশংসাসূচক এই বিশাল হাদীস সংকলনে কেবল একটিমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ বর্ণনায় তামিম গোত্রের প্রশংসা পাওয়া যায়। বর্ণনাটি নিম্নরূপ: হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বলেন, “মহানবী (দ:)-এর কাছ থেকে তামিম গোত্র সম্পর্কে তিনটি বিষয় শোনার পর আমি তাদেরকে পছন্দ করি। তিনি এরশাদ ফরমান, ‘তামিম গোত্র আমার উম্মতের মধ্যে দাজ্জালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর হবে।’ তাদের একজন আয়েশা (রা:)-এর মালিকানাধীন বন্দী ছিল। রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন, ‘এই নারীকে মুক্ত করে দাও, কেননা সে হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর বংশধর।’ আর যখন তামিম গোত্র নিজেদের যাকাত নিয়ে আসে, তখন হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান, ‘এটি একটি জাতির যাকাত’; অথবা (বর্ণনান্তরে), ‘আমার জাতির (যাকাত)’।” [বোখারী, মাগাযী, ৬৮ পৃষ্ঠা]
এই হাদীস স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে দাজ্জালের বিরুদ্ধে শেষ ফয়সালাকারী যুদ্ধে বনূ তামিম গোত্রের কঠোরতাকে ইসলামের বিপক্ষে নয়, বরং পক্ষে ব্যবহার করা হবে; আর এটি প্রশ্নাতীতভাবে একটি গুণ। দ্বিতীয় বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম তাৎপর্যপূর্ণ, যেহেতু সকল আরব গোত্রই হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর বংশধর; তৃতীয় বিষয়টির বিভিন্ন বর্ণনা দ্ব্যর্থহীনভাবে এর তাৎপর্য তুলে ধরতে অক্ষম। এমন কি এই বিষয়ের সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাখ্যায়ও আমরা এর বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না যে মহানবী (দ:) ওই গোত্রের প্রতি ততোক্ষণ-ই সন্তুষ্ট ছিলেন, যতোক্ষণ তারা যাকাত দিচ্ছিল। অতঃপর আমরা দেখতে পাবো যে তাদের যাকাত দানের ব্যাপারটি ক্ষণস্থায়ী হিসেবেই প্রমাণিত হয়।
তামিম গোত্রের স্পষ্ট সমালোচনা বিধৃত হয়েছে এমন হাদীসের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। নজদীপন্থী আত্মপক্ষ সমর্থনকারীরা সাধারণতঃ এ সব হাদীসকে অগ্রাহ্য করে; কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাচর্চা বা গবেষণা এটি আমাদের কাছে দাবি করে যে কেবল কিছু সংখ্যক নয়, বরং এতদসংক্রান্ত সমস্ত প্রামাণ্য দলিল-ই বিবেচনায় আনা জরুরি এবং কোনো মীমাংসায় পৌঁছার আগে এগুলোকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর তামিম গোত্র সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক সমালোচনামূলক দলিলকে বিবেচনায় নিলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে মহানবী (দ:) ও সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মা)-বৃন্দ এই গোত্রকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখতেন।
বনূ তামিম গোত্রভুক্ত লোকদের সম্পর্কে প্রাথমিক ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং খোদাতা’লা তাঁরই পাক কালামে। সূরা হুজুরাতের ৪র্থ আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় ওই সব লোক যারা আপনাকে হুজরা (প্রকোষ্ঠ)-সমূহের বাইরে থেকে আহ্বান করে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই নির্বোধ।” এ আয়াতের ‘সাবাব আন্ নুযূল’ বা অবতীর্ণ হবার কারণ নিচে বর্ণনা করা হলো:
”হুজূরাত তথা প্রকোষ্ঠসমূহ ছিল দেয়াল-ঘেরা কক্ষ। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রত্যেক স্ত্রীর একটি করে কক্ষ ছিল। এই আয়াতটি নাযেল হয় যখন বনূ তামিম গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল মহানবী (দ:)-এর কাছে আসে। তারা মসজিদে প্রবেশ করে এবং ওই প্রকোষ্ঠগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর উচ্চস্বরে ডেকে বলে, ’ওহে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আমাদের কাছে বেরিয়ে আসুন!’ এই কাজটি রূঢ়, স্থূল ও বেয়াদবিপূর্ণ ছিল। রাসূলে করীম (দ:) কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন এবং তারপর তাদের কাছে বেরিয়ে আসেন। আল-আক্করা’ ইবনে হাবিস নামে পরিচিত তাদের একজন বলে, ‘হে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। আমার প্রশংসা হলো একটি অলংকার, আর আমার অভিযুক্তকরণ লজ্জা বয়ে আনে।’ এমতাবস্থায় মহানবী (দ:) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তোমার জন্যে আফসোস! এটি-ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার পাওনা’।” [ইমাম মোহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে জুযাঈ কৃত ‘আল-তাশিল’, বৈরুত ১৪০৩ হিজরী সংস্করণ, ৭০২ পৃষ্ঠা; অন্যান্য তাফসীরগ্রন্থও দেখুন; এছাড়া ইবনে হাযম প্রণীত ‘জামহারাত আনসাব আল-’আরব’, তামিম অধ্যায়, ২০৮ পৃষ্ঠা, কায়রো ১৩৮২ হিজরী সংস্করণ দ্রষ্টব্য। অনুবাদকের নোট: মুফতী আহমদ এয়ার খান নঈমী রচিত তাফসীরে ’নূরুল এরফান’-গ্রন্থেও তামিম গোত্রের কথা উল্লেখিত হয়েছে; বঙ্গানুবাদক - মওলানা এম, এ, মান্নান, চট্টগ্রাম]
আল-কুরআনের এই সমালোচনার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ হাদীসে উম্মতের প্রতি এই গোত্র সম্পর্কে উপদেশবাণী পেশ করা হয়েছে। যেহেতু রাসূলে পাক (দ:)-এর মৌন সমর্থনও হাদীস (সুন্নাতে তাকরীরী) হিসেবে পরিগণিত, সেহেতু আমরা নিম্নের ঘটনা দিয়ে শুরু করতে পারি।
এটি হযরত হাসসান ইবনে সাবেত (রা:)-এর একটি প্রসিদ্ধ কবিতা। তামিম গোত্রের লোকেরা শেষদিকে ইসলাম গ্রহণ করে, যা তারা অনেক বিরোধিতার পর করেছিল; বছরটি ছিল ‘আম আল-উফূদ’ তথা প্রতিনিধিদলের বছর, হিজরী নবম সাল। ফলে তামিম গোত্রীয়রা ’সাবিকা’ তথা ইসলামে অগ্রবর্তী বা পূর্ববর্তী হবার বৈশিষ্ট্যশূন্য ছিল। মহানবী (দ:)-এর দরবারে সবশেষে এসে তারা তাঁর সাথে একটি প্রকাশ্য বাহাস বা বিতর্ক দাবি করে বসে। এমতাবস্থায় হুযূর পাক (দ:) হযরত হাসসান বিন সাবেত (রা:)-কে তামিম গোত্র সম্পর্কে তাদের অন্তঃসারশূন্য দর্পচূর্ণ করার জন্যে নিয়োগ করেন। হযরত হাসসান (রা:)-এর এই কাব্য, যা তামিম গোত্রকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করে এবং তাদের নিচুতা ও হীনতাকে ফুটিয়ে তোলে, তা বনূ তামিম গোত্র সম্পর্কে মহানবী (দ:)-এর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনের প্রমাণ বলেই বিবেচনা করা যায়; কেননা, এই অভিযোগ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর উপস্থিতিতেই উত্থাপিত হয়, এবং এর প্রতি তাঁর সমালোচনার কোনো প্রামাণিক দলিল বিদ্যমান নেই। [’দেওয়ানে হাসসান ইবনে সাবেত, বৈরুত, ১৯৬৬ ইং, ৪৪০ পৃষ্ঠা; পুরো ঘটনার বৃত্তান্ত জানার জন্যে একই গ্রন্থে বারকুকীর ব্যাখ্যা দেখুন; আরও দেখুন ইবনে হিশাম কৃত ‘সীরাহ’, Guillaume অনূদিত সংস্করণ, ৬৩১ পৃষ্ঠা]
বনূ তামিম গোত্র সম্পর্কে অপর এক রওয়ায়াতে আছে:
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা:) বর্ণনা করেন যে তামিম গোত্রের এক প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দরবারে এলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে এরশাদ ফরমান, “ওহে তামিম গোত্র! শুভসংবাদ গ্রহণ করো!” তারা উত্তর দেয়, “আপনি আমাদেরকে সুসংবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; অতএব, আমাদেরকে কিছু (অর্থ-কড়ি) দিন!” এমতাবস্থায় হুযূর করীম (দ:)-এর চেহারা মোবারকে পরিবর্তন ঘটে। ঠিক সে সময় কয়েকজন ইয়েমেনী তাঁর দরবারে উপস্থিত হন, আর তিনি তাঁদেরকে বলেন, “হে ইয়েমেনবাসী! শুভসংবাদ গ্রহণ করো, যদিও তামিম গোত্র তা গ্রহণ করে নি!” অতঃপর ইয়েমেনীরা বলেন, “আমরা গ্রহণ করলাম।” আর মহানবী (দ:) সৃষ্টির প্রারম্ভ ও আরশ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন। [আল-বোখারী, বাদ’ আল-খালক্ক, ১]
কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে বিধৃত তামিম গোত্রের রূঢ় ও উচ্ছৃঙ্খল মন-মানসিকতা মূর্তি-পূজারী কুরাইশ বংশীয় নেতা আবূ জাহেলের ব্যক্তিত্বসংশ্লিষ্ট একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে। মহানবী (দ:)-এর প্রতি অন্ধ আক্রোশ পোষণকারী আবূ জাহেলের শৈশব নিশ্চয় তামিমী ভাবধারায় গড়ে ওঠে। তার মাতা আসমা বিনতে মুখাররিবা তামিম গোত্রভুক্ত ছিল (আল-জুমাহী কৃত ‘তাবাকাত ফুহূল আল-শুয়ারা’, সম্পাদক মোহাম্মদ শাকির, কায়রো, ১৯৫২ সংস্করণ, ১২৩ পৃষ্ঠা)। আবূ জাহেল বিয়ে করে উমাইর ইবনে মা’বাদ আল-তামিমীর কন্যাকে, যার গর্ভে তার এক পুত্র সন্তান হয় এবং নাম রাখা হয় তামিম, কারণটি যার সহজেই অনুমেয় (মুস’আব ইবনে আব্দিল্লাহ প্রণীত ‘নসব কুরাইশ’, কায়রো, ১৯৫৩, ৩১২ পৃষ্ঠা)।
হাদীসশাস্ত্রে তামিমীদের যে বৈশিষ্ট্য বার বার উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়াবাড়ি। তারা যখন অবশেষে ইসলাম গ্রহণ করে, তখন তারা এমন উগ্র ধার্মিকতার সাথে জড়ায় যা উপলব্ধির পরিবর্তে সাদামাটা ও অনমনীয় আনুগত্যের দাবি পেশ করে; আর যা ঘন ঘন ধর্মের প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে অমান্য করে। ইমাম মুসলিম (রহ:) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শাকিক (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) একবার আমাদেরকে ধর্মশিক্ষা দিচ্ছিলেন আসর নামাযের বা’দে। অতঃপর সূর্য ডুবে যায় এবং আকাশে তারা দৃশ্যমান হয়। মানুষেরা বলতে আরম্ভ করে, ‘নামায!’ ’নামায!’ বনূ তামিম গোত্রের এক লোক তাঁর কাছে এসে জোর দিয়ে বার বার বলে, ‘নামায!’ ‘নামায!’ এমতাবস্থায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) জবাব দেন, ‘তুমি কি আমায় সুন্নাহ শেখাতে এসেছ, হতভাগা কোথাকার’?” [মুসলিম শরীফ, সালাত আল-মোসাফিরীন, ৬]
বনূ তামিম ও খাওয়ারিজ
তামিম গোত্রভুক্তদের অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আমাদের মনোযোগ আবারও আকর্ষণ করার মতো সর্বাধিক প্রসিদ্ধ যে হাদীসটি বিদ্যমান তা সম্ভবতঃ যুল খোয়াইসারা-বিষয়ক:
হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা:) বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম; ওই সময় তিনি গনীমতের মালামাল বণ্টন করছিলেন। তামিম গোত্রভুক্ত যুল খোয়াইসারা নামের এক লোক এসে বলে, ‘হে রাসূল (দ:)! ইনসাফের সাথে বণ্টন করুন।’ মহানবী (দ:) উত্তর দেন, ‘আফসোস তোমার প্রতি! আমি ন্যায়পরায়ণ না হলে কে হবে? তুমি বিষাদগ্রস্ত ও হতাশ যে আমি ন্যায়পরায়ণ নই?’ এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারুক (রা:) বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমাকে অনুমতি দিন যাতে আমি তার শিরোচ্ছেদ করতে পারি!’ কিন্তু হুযূর পূর নূর (দ:) বলেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও। তার আরও সাথী আছে। তাদের নামায বা রোযার মোকাবেলায় তোমাদের নামায-রোযাকে অন্তঃসারশূন্য মনে হবে; তারা কুরআন তেলাওয়াত করে, কিন্ত ওর মর্মবাণী কণ্ঠনালির নিচে যায় না। তীর যেমন ধনুক থেকে লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যায়, তারাও ইসলাম ধর্ম থেকে তেমনি খারিজ হয়ে যাবে’।” হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা:) আরও বলেন, “আমি (আল্লাহর নামে) কসম করে বলছি, হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (ক:) যখন তাদের (খারেজীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তিনি নির্দেশ দেন যেন ওই লোককে খুঁজে বের করে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়; আর তাকে আমাদের সামনে ধরে আনা হয়।” [আল-বোখারী কৃত ‘মানাকিব’, ২৫; ‘লক্ষ্যভেদ করে বের হয়ে যাওয়া’ সম্পর্কে জানতে দেখুন আবূল আব্বাস আল-মোবাররাদ প্রণীত ‘আল-কামেল’, ‘আখবার আল-খাওয়ারিজ’ অধ্যায়, যা ’দার আল-ফিকর আল-হাদীস’, বৈরুত (তারিখ অনুল্লিখিত) কর্তৃক আলাদাভাবে প্রকাশিত, যা’তে নিম্নের মন্তব্য আছে: ‘সাধারণতঃ এমনটি যখন হয় (লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া), তখন কোনো শিকারের রক্ত-ই তীরে মাখা থাকে না’]
এই হাদীসটিকে ব্যাখ্যাকারীগণ খারেজীদের প্রকৃতিসম্পর্কিত একটি ভবিষ্যদ্বাণী, একটি সতর্কবার্তা হিসেবে গ্রহণ করেন। নির্দিষ্ট এক ধরনের ধর্মের গোঁড়া সমর্থক আছে, যারা ধর্মে এতো জোরে প্রবেশ করে যে অপর দিক দিয়ে বেরিয়ে আসে, যার দরুণ তাদের সাথে ধর্মের অল্প কিছু অংশ থাকে, বা কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই বিষয়টির প্রতি সমর্থনদাতা অন্যতম আলেম হলেন হাম্বলী মযহাবের ইবনুল জাওযী, যিনি হযরত মারূফ আল-কারখী (রহ:) ও হযরত রাবেয়া আল-আদাউইয়্যা (রহ:)-এর জীবনী রচনার জন্যে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর ‘তালবিস ইবলিস’ গ্রন্থের (বৈরুত, ১৪০৩ হিজরী, ৮৮ পৃষ্ঠায়) ‘খারেজীদের প্রতি শয়তানী বিভ্রমের উল্লেখ’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি উপরোক্ত হাদীসখানি উদ্ধৃত করে লিখেন: “এই লোকের নাম যুল-খোয়াইসারা আত্ তামিমী। ইসলামে সে-ই প্রথম খারেজী। তার দোষ ছিল নিজ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সন্তুষ্ট থাকা; সে যদি (বে-আদবি থেকে) বিরত থাকতো, তবে সে উপলব্ধি করতে পারতো যে মহানবী (দ:)-এর দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো অভিমত নেই।”
ইবনুল জাওযী এরপর খারেজী আন্দোলনের প্রসারসম্পর্কিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন, পাশাপাশি তামিম গোত্রের মুখ্য ভূমিকা সম্পর্কেও লিখেন। তিনি বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় বলেন, “(সুন্নীদের বিরুদ্ধে হারুরা) যুদ্ধে সেনাপতি ছিল শাবিব ইবনে রাবী’ আত্ তামিমী।” তিনি ৯২ পৃষ্ঠায় আরও বলেন, “আমর ইবনে বকর আত্ তামিমী হযরত উমর (রা:)-কে হত্যা করতে সম্মত হয়েছিল।” খারেজীদের শিবিরে কুরআন তেলাওয়াতের তৎপরতার কারণে মৌচাকের মতো শব্দ হলেও সেখানেই আবার এই ধরনের গোপন ষড়যন্ত্র চলেছিল (৯১ পৃষ্ঠা, ‘তালবিস ইবলিস’)।
মূল খারেজী বিদ্রোহ আরম্ভ হয় সিফফিনের সালিশে, যখন প্রাথমিক যুগের ভিন্ন মতাবলম্বীরা হযরত আলী (ক:)-এর সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করেছিল। তাদের একজন ছিল আবূ বিলাল মিরদাস্, তামিম গোত্রেরই সদস্য (ইবনে হাযম, ২২৩); নিয়মিত নামায ও কুরআন তেলাওয়াত সত্ত্বেও সে এক নিষ্ঠুর খারেজী ধর্মান্ধে পরিণত হয়। ‘তাহকিম’ তথা ‘আল্লাহর আইন ছাড়া কোনো বিধান নেই’ (ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ), যা পরবর্তীকালে খারেজী দাওয়া’ কার্যক্রমের স্লোগানে রূপান্তরিত হয়, ওই ফর্মূলার প্রথম প্রবর্তনকারী হিসেবে তাকেই স্মরণ করা হয়।
ইমাম আবদুল কাহির আল-বাগদাদী খারেজী বিদ্রোহ সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘ বিশ্লেষণে এর সাথে তামিম গোত্রের ঘনিষ্ঠ এবং মধ্য-আরব অঞ্চলের অধিবাসীদের সার্বিক সংশ্লিষ্টতার বর্ণনাও লিপিবদ্ধ করেন; তিনি এও উল্লেখ করেন যে ইয়েমেন ও হেজাযের গোত্রগুলো থেকে কেউই এই বিদ্রোহে সম্পৃক্ত হয় নি। তিনি যুল-খুয়াইসারার পরবর্তীকালের খারেজী তৎপরতার একটি বিবরণ তাঁর বইয়ে দিয়েছেন। হযরত আলী (ক:)-এর সামনে ধরে আনা হলে সে বলে, “ইবনে আবি তালেব! আমি শুধু আপনার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আল্লাহ ও পরকালেরই খাতিরে!” হযরত আলী (ক:) জবাবে বলেন, “না, তুমি ওদের মতোই যাদের সম্পর্কে আল্লাহ এরশাদ ফরমান - ‘হে রাসূল বলুন: আমি কি তোমাদের বলে দেবো সর্বাপেক্ষা অধিক মূল্যহীন কর্ম কাদের? তাদেরই, যাদের সমস্ত প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনেই হারিয়ে গেছে এবং তারা এ ধারণায় রয়েছে যে তারা সৎকর্ম করছে’ (সূরা কাহাফ, ১০৩)।” [ইমাম আবদুল কাহির আল-বাগদাদী কৃত ‘আল-ফারক্ক বাইন আল-ফিরাক্ক’, কায়রো (তারিখবিহীন), ৮০ পৃষ্ঠা; যুল-খোয়াইসারার পূর্ণ সনাক্তকরণের জন্যে ওই বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠা দেখুন]
প্রাথমিক যুগের খারেজী বিদ্রোহগুলো, যা নিরীহ, নিরপরাধ মুসলমানদের দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডে পরিপূর্ণ ছিল, তার বিবরণ দেয়ার সময় ইমাম আবদুল কাহির পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন যে প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ খারেজী বিদ্রোহের নেতা-ই নজদ অঞ্চল থেকে এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ, সবচেয়ে ভয়ংকর ও ব্যাপকতা লাভকারী ‘আযারিকা’ নামের খারেজী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় নাফী’ আল-আযরাক; এই লোক ছিল মধ্য-আরব অঞ্চলের বনূ হানিফা গোত্রভুক্ত (ইমাম আবদুল কাহির, ৮২ পৃষ্ঠা)। ইমাম সাহেব লিপিবদ্ধ করেন, “নাফী’ ও তার অনুসারীরা মনে করতো যারা তাদের বিরোধিতা করে, তাদের এলাকা দারুল কুফর (বৈরী দেশ); তাই ওখানে বিরোধীদের নারী ও শিশুকে হত্যা করা বৈধ...আযারিকা খারেজীরা আরও বলতো, আমাদের বিরোধীরা মুশরিক (মূর্তি পূজারী), তাই তাদের কোনো আমানত আমরা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নই” (ইমাম আবদুল কাহির, ৮৪ পৃষ্ঠা)। যুদ্ধে আল-আযরাকের মৃত্যুর পর আযারিকা বিদ্রোহীরা উবায়দুল্লাহ ইবনে মা’মুন আত্ তামিমীর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। আল-মোহাল্লাব এরপর আহওয়ায এলাকায় তাদের মোকাবেলা করেন, যেখানে উবায়দুল্লাহ ইবনে মা’মুন আত্ তামিমী নিজেও মারা যায়; আর তার সাথে মারা পড়ে তার ভাই ইবনে মা’মুন এবং আযারিকার তিন’শ সবচেয়ে ধর্মান্ধ ও উগ্র খারেজী। বাকি আযারিকা খারেজীরা আয়দাজ অঞ্চলে পশ্চাদপসারণ করে, যেখানে তারা কাতারী ইবনে আল-ফুজা’আর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। ইবনে ফুজা’আকে তারা আমীরুল মো’মেনীন বলে সম্বোধন করতো (ইমাম আবদুল কাহির, ৮৫-৬ পৃষ্ঠা)। ইমাম সাহেবের বইয়ের ব্যাখ্যাকারী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ইবনে ফুজা’আ-ও তামিম গোত্রভুক্ত ছিল (পৃষ্ঠা ৮৬)।
আযারিকা-খারেজী মতবাদ গ্রহণ না করার জন্যে শত-সহস্র মুসলমান হত্যাকারী এই গোত্রের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল খারেজী নজদীয়া অংশে। এদের নামকরণ হয়েছিল নজদা ইবনে আমীরের অনুসরণে, যে ব্যক্তি হানিফা গোত্রভুক্ত ছিল; এই গোত্রের আবাসভূমিও নজদ অঞ্চলে। নজদা নিজেও নজদ এলাকার অন্তর্গত এয়ামামায় তার সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে। [ইমাম আবদুল কাহির, ৮৭]
সকল যুগের খারেজী মতবাদীদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নজদীয়া অংশও বিরোধী মতের প্রতি তাদের অসহিষ্ণুতা থেকে সৃষ্ট উত্তপ্ত বিতর্কের কারণে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই ধর্মীয় মতবাদগত বিরোধের কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মদীনা মোনাওয়ারায় খারেজী আক্রমণ, যা’তে অনেক বন্দী নেয়া হয়; এ ছাড়াও বন্দী অ-খারেজী মুসলমান নারীদের সাথে যৌনসম্পর্কের ব্যাপারে বিভিন্ন খারেজী এজতেহাদের দরুন ওই বিরোধ দানা বাঁধে। এই বিভক্তি থেকে তিনটি প্রধান উপদলের সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক উপদলটির নেতৃত্ব দেয় বনূ হানিফা গোত্রভুক্ত আতিয়্যা ইবনে আল-আসওয়াদ। নজদার মৃত্যুর পরপরই তার দলটিও তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার একটি উপদল বসরার আশপাশ এলাকা আক্রমণের জন্যে নজদ ত্যাগ করে। [ইমাম আবদুল কাহির, ৯০-১]
খারেজীদের শেষ বড় দলটির নাম এবাদিয়্যা, যেটি আজও অধিকতর শান্ত ও খর্বকায় আকৃতিতে জানজিবার, দক্ষিণ আলজেরিয়া ও ওমানে টিকে আছে। এর স্থপতি ছিল আরেক তামিম গোত্রভুক্ত আবদুল্লাহ ইবনে এ’বাদ। এই মতবাদ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল যা জানা যায় তা হলো, তাদের দৃষ্টিতে অ-এবাদী মুসলমানগণ কুফফার; তাঁরা মো’মেন (বিশ্বাসী) নন। তবে তাঁরা মুশরিক বা বহু উপাস্যে বিশ্বাসীও নন। “অ-এবাদী মুসলমানদের গুপ্তহত্যা তারা নিষেধ করে, কিন্তু প্রকাশ্য যুদ্ধকে অনুমোদন করে। তারা অ-এবাদী মুসলমানদের সাথে বিবাহ-সম্পর্কের অনুমতি দেয়, এবং তাঁদের উত্তরাধিকার নেয়াকেও অনুমতি দেয়। এবাদীরা দাবি করে যে আল্লাহ ও রাসূল (দ:)-এর পক্ষে জেহাদে সাহায্য হিসেবে এগুলো করা যায়।” [ইমাম আবদুল কাহির, ১০৩]
খারেজীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নারী ছিল বনূ তামিম গোত্রভুক্ত কুতাম বিনতে আলকামা। সে পরিচিত এই কারণে যে, সে তার জামাই ইবনে মুলজামকে বলেছিল, “আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবো আমারই আরোপিত মোহরানার ভিত্তিতে; আর তা হলো তিন হাজার দিরহাম, একজন পুরুষ গোলাম ও একজন মহিলা বাঁদী, আর (হযরত) আলী (ক:)-এর হত্যা!” ইবনে মুলজাম বলে, “তুমি এর সবই পাবে; কিন্তু হযরত আলী (ক:)-কে কীভাবে হত্যা করবো?” কুতাম জবাব দেয়, “অতর্কিত হামলায় তাকে হত্যা করো। তুমি বেঁচে গেলে মানুষজনকে বদমাইশির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং তোমার স্ত্রীর সাথেও বসবাস করবে; আর যদি তুমি এই প্রচেষ্টায় মারা যাও তবে চিরশান্তির স্থান বেহেশতে যাবে” (মুবাররাদ, ২৭)। সবাই জানেন, ইবনে মুলজাম কর্তৃক কুফার মসজিদে হযরত আলী (ক:)-কে ছুরিকাঘাতে হত্যার করার পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
মুসলমান সর্বসাধারণ যাঁরা অতীতের এই সন্তাপজনক ভুল-ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না, তাঁরা এই ঘটনাপ্রবাহের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে ঘভীরভাবে ভাবতে অবশ্যই চাইবেন। সহস্র সহস্র মুসলমান যারা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি ছিল নিবেদিত ও ধর্ম অনুশীলনে বিশিষ্ট, তারা এতদসত্ত্বেও খারেজী প্রলোভনের শিকারে পরিণত হয়। উলেমাবৃন্দ এই প্রলোভনের উৎস হিসেবে যুল-খোয়াইসারার ঘটনাকে খুঁজে পান, যে ব্যক্তি নিজেকে মহানবী (দ:)-এর চেয়েও উত্তম মুসলমান মনে করেছিল। আর সে অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ খারেজী নেতার মতোই বনূ তামিম গোত্রভুক্ত ছিল। অ-তামিমী খারেজী নেতাদেরও প্রায় সবাই নজদ অঞ্চল থেকে এসেছিল।
রিদ্দা: প্রথম ফিতনা
নজদ সম্পর্কে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে আরেকটি বিষয় তাঁরা বিবেচনায় নিতে চাইবেন। এটি মহানবী (দ:)-এর বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্তির পরে নজদীদের আচরণ সংক্রান্ত। ইতিহাসবিদগণ সাক্ষ্য দেন যে হযরত আবূ বকর (রা:)-এর খেলাফত আমলে যাকাত দেয়ার ব্যাপারে যতো বিদ্রোহ হয়েছে, তার অধিকাংশই নজদীদের দ্বারা সংঘটিত। উপরন্তু, আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অনেক নজদী বিদ্রোহ-ই অদ্ভূত ইসলামবিরোধী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাতি পায় যে বিদ্রোহটি, তা নবী দাবিদার ভণ্ড মুসাইলামার নেতৃত্বে হয়েছিল; এই লোক একটি পাল্টা শরীয়ত দাঁড় করিয়েছিল, যা’তে দৃশ্যতঃ অন্তর্ভুক্ত ছিল রোযা ও ইসলামী খাদ্যাভ্যাসের মতো মুসলিম আচার ও প্রথা। সে নামাযের ইসলামী বিধান মানতো, তবে ফজর ও এশা’র নামায বিলোপ করেছিল। তার তথাকথিত একটি ‘ঐশী বাণী’ ব্যক্ত করে:
বনূ তামিম এক পবিত্র গোত্র,
স্বাধীন ও ত্রুটিমুক্ত,
যাকাত থেকে তারা মওকুফপ্রাপ্ত।
আমরা হবো তাদের রক্ষাকারী মিত্র,
যতোদিন বাঁচি, রাখবো তাদের সাথে বন্ধুত্ব!
যে কারো থেকে তাদের রাখবো সুরক্ষিত,
আর আমাদের মরণকালে তারা ’রহমানের’ হেফাযতপ্রাপ্ত।
[ইমাম তাবারী কৃত ‘তারিখ আল-রুসূল ওয়াল-মুলূক’, বৈরুত, ১৪০৭ হিজরী, ২য় খণ্ড, ২৭৬ পৃষ্ঠা]
মুসাইলামা ছিল একজন বাগ্মী। ফলে মধ্য আরব অঞ্চলে তার অনেক অনুসারী জুটে যায়। তবে ইতিহাসবিদগণ লিখেন যে মহানবী (দ:)-এর মো’জেযা (অলৌকিক ক্ষমতা) যখনই সে অনুকরণ করতে চাইতো, অমনি বিপর্যয় নেমে আসতো। তার কাছে নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আনা অসুস্থ শিশুরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়তো। তার ওযু করা পানি ফসলের ওপর ছিটালে জমি উর্বরতা হারাতো। তার ব্যবহৃত কূপগুলোর পানি লবণাক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু গোত্রীয় প্রভাবের কারণে অনেকে এ সব বিষয় আমলেই নেয় নি।
তালহা আল-নামারী নজদে এসে জিজ্ঞেস করে, “মুসাইলামা কোথায়?” এ কথা শুনে মানুষেরা তাকে বলে, “সাবধান! তাকে আল্লাহর রাসূল বলে ডাকো।” তালহা জবাব দেয়, “তাকে না দেখা পর্যন্ত ওই খেতাবে ডাকবো না।” অতঃপর মুসাইলামার সামনে উপস্থিত হলে সে জিজ্ঞেস করে, “মুসাইলামা কি তুমি?” সে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ।” তালহা জিজ্ঞেস করে, “তোমার কাছে কে আগমন করেন?” মুসাইলামা জবাবে বলে, “আল-রহমান।” তালহা আবার জিজ্ঞেস করে, “তিনি কি আলোতে আসেন, না অন্ধকারে?” জবাবে মুসাইলামা বলে, “অন্ধকারে।” এমতাবস্থায় তালহা বলে, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি মিথ্যেবাদী এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-ই সত্যবাদী। কিন্তু আমার কাছে তোমার গোত্রের মিথ্যেবাদীও তাঁর গোত্রের সত্যবাদীর চেয়ে প্রিয়ভাজন।” এরপর সে মুসাইলামা আল-কাযযাবের বাহিনীতে যোগ দেয় এবং আক্করাবার যুদ্ধে নিহত হয়। [তাবারী, ২য় খণ্ড, ২৭৭ পৃষ্ঠা]
এ ধরনের ঘটনা দুটো বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে। প্রথমতঃ এতে মুসাইলামার ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তার মতে, আল্লাহ আকৃতিসম্পন্ন যিনি ‘আসতে’ পারেন। দ্বিতীয়তঃ এতে অন্ধ অনুসরণের আরব গোত্রীয় প্রভাব ও প্রতাপ-প্রতিপত্তির দিকটিও পরিস্ফুট হয়, যা তখনো বিরাজমান ছিল।
বিরোধী ধর্মমতের নেতা হিসেবে মুসাইলামা ও তার নজদী উগ্রবাদীরা ‘বাগী’ তথা ধর্মে ফিতনা সৃষ্টিকারী ও খলীফার কর্তৃত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়; আর তাই হযরত আবূ বকর (রা:) তাদেরকে দমনের উদ্দেশ্যে সেনাপতি হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা:)-এর অধীনে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। হিজরী ১২ সালে হযরত খালেদ (রা:) আল-আকরাবার যুদ্ধে নজদীদেরকে পরাজিত করেন। যুদ্ধের এই স্থানটি ছিল দেয়ালঘেরা একটি বাগান এবং এখানেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নজদীদের হাতে শত শত সাহাবী (রা:) শহীদ হওয়ায় আমাদের ইতিহাসবিদদের কাছে এটি ‘মৃত্যু বাগিচা’ নামে পরিচিত হয়েছে। এই যুদ্ধ ছিল প্রাচীন আরব গোত্রবাদের বিরুদ্ধে সমান অধিকারের পক্ষাবলম্বনকারী ইসলাম ধর্মের, যে বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে এই ঘটনায় যে মোহাজির সাহাবী (রা:)-দের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্রীতদাস হতে মুক্তিপ্রাপ্ত পারসিক সাহাবী হযরত সেলিম (রা:); আর আনসার সাহাবী (রা:)-দের পতাকা উচুঁ করে ধরেছিলেন হযরত সাবেত ইবনে কায়েস (রা:)। মুসলমানদের রণহুংকার কোনো গোত্র বা পূর্বপুরুষের নামে ছিল না, বরং তা ছিল ‘এয়া মোহাম্মদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম (তাবারী, ২৮১)। নবী দাবিদার ভণ্ড মুসাইলামাকে হত্যা করেন ক্রীতদাস ইথিয়পীয় সাহাবী হযরত ওয়াহশি (রা:)। যদিও তিনি ইতিপূর্বে মহানবী (দ:)-এর চাচা হযরত আমীরে হামযা ইবনে আব্দিল মোত্তালিব (রা:)-কে ওহুদের জ্বিহাদে শহীদ করেন, তবুও তিনি পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মে দাখিল হন এবং একজন সম্মানিত উম্মত হিসেবে পরিচিতি পান। আরবীয় সমাজের কাছে নিচু জাত বলে বিবেচিত একজন আফ্রিকী বংশোদ্ভূত ব্যক্তির দ্বারা নজদীদের গর্বের ‘নবী’কে হত্যা করার ব্যাপারটি ইসলামী সমতাবাদী নীতি-আদর্শের একটি শক্তিশালী প্রতীক ছিল। [দেখুন আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে কুতায়বা রচিত ‘কিতাব আল-মা’আরিফ’, কায়রো, ১৯৬০ ইং সংস্করণ, ২০৬ পৃষ্ঠা; আহমদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-বালাদুরী প্রণীত ‘ফুতুহ আল-বুলদান’, বৈরুত, পুনঃমুদ্রিত, তারিখবিহীন, ৮৬ পৃষ্ঠা]
তথাপিও মুসাইলামা আল-কাযযাবের প্রতি অন্ধ ভক্তি মধ্য আরব অঞ্চলে টিকে যায়। নজদীদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে একখানা বর্ণনা দিয়েছেন অ-মুসলমান পর্যটক পালগ্রেভ (Palgrave)। তিনি ১৮৬২ সালে এসে দেখতে পান যে, এতো বছর পরও কিছু কিছু নজদী গোত্রভুক্ত লোক মুসাইলামাকে নবী হিসেবে শ্রদ্ধা করে। [ডব্লিউ, পালগ্রেভ প্রণীত ‘ন্যারেটিভ অফ আ ইয়ারস্ জার্নী থ্রু সেন্ট্রাল এ্যান্ড ইস্টার্ন এ্যারাবিয়া’ (মধ্য ও পূর্ব আরবে এক বছরব্যাপী যাত্রার বিবরণ), লণ্ডন, ১৮৬৫, ১ম খণ্ড, ৩৮২ পৃষ্ঠা]
ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে নজদী বিদ্রোহের অপর এক হোতা ছিল সাজাহ নাম্নী এক নারী, যার আসল নাম ছিল উম্মে সাদির বিনতে আউস। সেও তামিম গোত্রীয় ছিল। এই নারী এমন রব্ব তথা প্রভুর নামে ‘নবী’ দাবি করে, যে প্রভু ‘মেঘে’ অবস্থান করে; সে ‘ওহী’ বা ’ঐশী বাণী’ প্রকাশ করে তামিম গোত্রের কিছু অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়। ওই সময় তামিমদের এই অংশ মদীনায় কায়েম হওয়া খেলাফতের কর্তৃত্ব কতোখানি প্রত্যাখ্যান করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে জড়িত ছিল। যে সকল গোত্র ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু যুদ্ধ পরিচালনার পর এই নজদী ভণ্ড নারী অপর ভণ্ড মুসাইলামার সাথে জোট বাঁধে। এ ছাড়া তার পরিণতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। [ইবনে কুতায়বা রচিত ‘মা’আরিফ’, ৪০৫ পৃষ্ঠা; বালাদুরী কৃত ‘ফুতুহ’, ৯৯-১০০ পৃষ্ঠা]
সাম্প্রতিক নজদী প্রবণতা
এ কথা সর্বজনবিদিত যে নজদী সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব বনূ তামিম গোত্রভুক্ত ছিল। তার নাম বহনকারী এই আন্দোলেনের সাথে যে সহিংসতা ও ‘তাকফির’ (মুসলমানদেরকে কাফের ফতোওয়া) সম্পৃক্ত রয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে প্রাচীন নজদের তামিমী খারেজী নীতি ও মানসিকতার সাথে কাকতালীয় মিলের চেয়েও বেশি কিছু হবে। যেমন বিবেচনা করুন, এপ্রিল ১৮০১ খৃষ্টাব্দে কারবালায় সংঘটিত শিয়া গণহত্যা, যা জনৈক ওহাবী ইতিহাসবিদ বর্ণনা করেছে:
”সউদ তার বিজয়ী সৈন্যবাহিনী, উন্নত জাতের ঘোড়া এবং নজদের সকল স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানুষ ও বেদুঈন (যাযাবর)-কে সাথে নিয়ে কারবালা গমন করে।....মুসলমানরা (অর্থাৎ, ওহাবীরা) কারবালা ঘেরাও করে এবং ঝড়ের বেগে শহরটির দখল নেয়। বাজার ও বাসা-বাড়িতে তারা বেশির ভাগ মানুষকে হত্যা করে। সেখানে লুণ্ঠনকৃত মালামালের সংখ্যা কেউ গুণে শেষ করতে পারবে না। তারা শুধু একটি সকাল সেখানে কাটিয়েছিল, এবং দুপুরে সমস্ত মালামাল নিয়ে স্থান ত্যাগ করেছিল। কারবালায় প্রায় দুই হাজার মানুষকে ওই সময় হত্যা করা হয়।” [উসমান ইবনে বিশর কৃত ‘উনওয়ান আল-মাজদ ফী তারিখে নজদ’, মক্কা ১৩৪৯ হিজরী, ১ম খণ্ড, ১২১-১২২ পৃষ্ঠা]
এই হামলা ও এটি অর্জনে সংঘটিত নৃশংসতা এবং এক হাজার বছর আগে একই এলাকায় পরিচালিত খারেজী আক্রমণের মধ্যে পার্থক্য করা দুষ্কর। মোহাম্মদ ফিনাতি নামে এক ধর্মান্তরিত ইতালীয় মুসলমান, যিনি ওহাবীদের ওপর বিজয়ী উসমানীয় তুর্কী খেলাফতের সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, তিনি সীমাহীন নজদী বর্বরতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর একখানা বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। উদাহরণস্বরূপ, তাতে তিনি লিখেন:
“আমাদের মধ্যে কিছু সৈন্য জীবিতাবস্থায় এ সব নিষ্ঠুর ধর্মান্ধের হাতে আটক হন; তাঁদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হাত-পা তারা (নজদীরা) এমন পৈশাচিকভাবে কেটে বিকৃত করে এবং সেই অবস্থায় মরতে ফেলে রেখে যায় যে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, আমরা যখন (যুদ্ধশেষে) ফিরে আসছিলাম তখন এই (অসহায়) মানুষগুলোর আমাদের কাছে একমাত্র চাওয়া-পাওয়া ছিল যেন আমরা তাঁদের জীবনাবসান ঘটাই।” [জি, ফিনাতি প্রণীত ’ন্যারেটিভ অফ দ্য লাইফ এ্যান্ড এ্যাডভেনচারস অফ জিওভানি ফিনাতি’ (আত্মজীবনী ও অভিযানের বর্ণনা), লণ্ডন, ১৮৩০ ইং, ১ম খণ্ড, ২৮৭ পৃষ্ঠা]
এ কথা কখনো কখনো দাবি করা হয় যে, ’নজদের সব অ-যাযাবর ও যাযাবর (বেদুঈন) লোক’দের দ্বারা খুশি মনে এই ধরনের গণহত্যা সংঘটনের দিনগুলো অনেক পেছনে ফেলে আসা হয়েছে এবং ওহাবীবাদ এখন আরও উদারনৈতিক। কিন্তু আরও সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ এর বিপরীত কথাই বলছে। ওহাবী সৈন্যবাহিনী ১৯২৪ সালে তায়েফ নগরী দখল করে তিন দিন যাবত লুঠপাট চালায়। এই সময় প্রধান কাজী (বিচারক) ও উলেমাবৃন্দকে তাঁদের বাসা থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনা হয় এবং হত্যা করা হয়; কয়েক’শ সাধারণ নাগরিককেও একইভাবে হত্যা করা হয় [ইবনে হিযলুল রচিত ‘তারিখে মুলূক আল-সউদ’, রিয়াদ, ১৯৬১, ১৫১-৩ পৃষ্ঠা]। হেজাযের সুন্নী জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদের একখানা শিক্ষা দিয়ে ‘বৃটেনের মৌন সমর্থনে ইবনে সউদ মক্কা দখল করে নেয়’ [আলেক্সেই ভ্যাসিলিয়েভ প্রণীত ‘সউদী আরবের ইতিহাস’, লণ্ডন, ১৯৯৮, ২৬৪ পৃষ্ঠা]।
উপসংহার
সালাফ আস্ সালেহীনের (প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের) সময়কাল থেকেই নজদ ও তামিম গোত্র সম্পর্কে বিস্তর দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমরা যদি নজদীদের অনুসৃত পদ্ধতি বর্জন করি, যে পদ্ধতিটি কিছু বেছে নেয়া হাদীসের উদ্ধৃতির পাশাপাশি মধ্যযুগের শেষলগ্নের কতিপয় ব্যাখ্যাকারীর ব্যক্ত মতামতের অন্ধ অনুসরণ ছাড়া কিছু নয়, তাহলে আমরা মধ্য আরব অঞ্চল ও এর অধিবাসীদের সম্পর্কে কিছু যৌক্তিক ও দলিলভিত্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে সক্ষম হবো। কুরআন মজীদ, সহীহ (বিশুদ্ধ) হাদীস ও সালাফ আস্ সালেহীনের অভিজ্ঞতা একচেটিয়াভাবে প্রমাণ করে যে মধ্য আরব অঞ্চল একটি ফিতনা-ফাসাদের এলাকা। ইসালামের সর্বপ্রথম ফিতনা সেখান থেকেই জাগ্রত হয়, যা ছিল যুল-খোয়াইসারা ও তার মতো লোকদের ঔদ্ধত্য; আর এ ছাড়াও ভণ্ড নবীদের গোমরাহী ও তাদের প্রতি ভক্তি হযরত আবূ বকর (রা:)-এর খেলাফতের জন্যে কঠিন সময় ছিল। এর অব্যবহিত পরেই নজদী শেকড় থেকে গজানো খারেজী গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা) ইসলামী ইতিহাসের সূচনালগ্নে মুসলমানদের মাঝে বিভক্তির কালো ছায়া ফেলে, যার দরুন তাঁদের সৈন্যবাহিনী বিজিনটিন সাম্রাজ্য জয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারে নি; অধিকন্তু, এই ফিতনা প্রাথমিক যুগের মুসলমান প্রজন্মগুলোর মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ, সন্দেহ ও তিক্ততার বীজ বপণ করে। এই প্রামাণ্য দলিল, যেটি নির্মল ও খাঁটি সালাফবৃন্দ বর্ণনা করেছেন, তাকে এড়িয়ে যেতে পারে একমাত্র একগুঁয়ে, চোখে ঠুলি বসানো ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সেই সব নজদী সমর্থক, যারা বারংবার এই প্রতারণার আশ্রয় নিতে চায় যে নজদ ও তার পথভ্রষ্টতা, বাহ্যিক ধর্মপালনে কঠোরতা যা ওই অঞ্চলে পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়ে চলেছে, তা কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত এলাকা।
আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভাল জানেন। তিনি এই উম্মাহকে ধর্মীয় একগুঁয়েমি প্রত্যাখ্যানকারী সালাফ আস্ সালেহীনের প্রতি মহব্বতের মাধ্যমে একতাবদ্ধ করুন। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে খারেজী মতবাদের ফাঁদ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের এই যুগে যারা এই ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তাদেরকেও হেফাযত করুন, আমীন।
সমাপ্ত