Saturday, 29 April 2017

মিসরীয় সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী আলী জুমুআ’র সঙ্গীতবিষয়ক ফতোয়া



[Bengali translation of the former Egyptian grand mufti Ali Gomaa's fatwa regarding music and singing, which is available at this website: https://archive.is/wBHuf; translator: Kazi Saifuddin Hossain] 

অনুবাদক: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: মুহাম্মদ রুবাইয়েৎ বিন মূসা 

[
অনুবাদকের উৎসর্গ: পীর ও মুর্শীদ সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-ক্বাদেরী আল-চিশ্তী সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর পুণ্যস্মৃতিতে.....]


প্রশ্নসঙ্গীত সম্পর্কে ইসলামের হুকুম কী?

উত্তর'Music' তথা সঙ্গীত (সেমা) শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন গ্রীস (রাজ্য) হতে এবং তা বলতে বোঝায়, “বিভিন্ন আওয়াজের নির্দিষ্ট এক বিন্যাসযুক্ত শিল্পকলা যার উদ্দেশ্য নান্দনিক প্রভাব বিস্তার।এটা এসব আওয়াজকে সুর-মূর্ছনায় পরিণত করে। অতএব, কোন্ কোন্ আওয়াজ একত্রে খাপ খায়, আর কোন্ কোন্ আওয়াজ খায় না, সে বিষয়ে সঙ্গীত গবেষণা করে থাকে। আর এটা অর্জিত হয়ে থাকে মানুষের কণ্ঠস্বর ও বাদ্যযন্ত্র উভয়েরই মাধ্যমে।

গান শোনা ইসলামী বিধানে এমন এক বিষয়, যার ব্যাপারে মতপার্থক্য বিরাজমান। এটা ধর্মীয় আক্বীদা-বিশ্বাস বা ধর্ম হতে অবশ্যম্ভাবীরূপে জ্ঞাত বিষয়গুলোর একটি নয়। তাই এ ধরনের বিষয়গুলোতে মুসলমানদের একে অপরকে নিন্দা করাটা বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়, কেননা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেবল সেগুলোর ব্যাপারেই (মানে সেগুলো হতে বিচ্যুতির ক্ষেত্রেই) সমালোচনা সাজে, মতপার্থক্যের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তা সাজে না। যেহেতু সঙ্গীত শোনা জায়েয/বৈধ বলে এর পক্ষে বেশ কিছু ফক্বীহ (ধর্মীয় আইনশাস্ত্রজ্ঞ) রায় দিয়েছেন এবং তাঁদের শরঈ-গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের অনুসরণ করাটা যেহেতু অনুমতিপ্রাপ্ত, সেহেতু যে সকল মুসলমান সেমাপন্থী ফক্বীহদের এ ধরনের রায়কে অনুসরণ করেন তাঁদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করার কোনো অনুমতি-ই নেই। এটা আরো জরুরি হয় তখন-ই, যখন দেখা যায় যে সঙ্গীতকে বিশেষতঃ হারাম বলার পক্ষে শরঈ একটি দলিল-ও নেই।

সেমা ও এর শ্রবণকে জায়েয যে সকল হ্ক্কানী আলেম বলেছেন, তাঁদের মধ্যে ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন:
فَالْعُطَلَةُ مُعَوِنَةٌ عَلَىْ الْعَمَلِ وَالَّلهْوُ مُعَيِنٌ عَلَىْ الجْدِّ وَلَا يَصْبِرُ عَلَىْ الْجِدِّ المْحْضِ وَالْحَقِّ المْر إِلاَّ نُفُوْسِ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمْ السَّلَامُ فَالْلَهْوُ دَوَاءُ القَلْبِ مِنْ دَاءِ الإِعْيَاءِ وَالْمِلاَلِ فَيَنْبَغِيُ أَنْ يَكُوْنَ مُبَاحًا وَلَكِنَّ لَا يَنْبَغِي أَنْ يَسْتَكْثِرَ مِنْهُ كَمَا لَا يَسْتَكْثِرُ مِنَ الدَّوَاءِ فَإِذَا الَّلهْوِ عَلَىْ هَذِهِ النِّيَّةِ يَصِيْرُ قُرْبَةً هَذَا فِيْ حَقِّ مَنْ لَا يَحْرِكُ السِّمَاعَ مِنْ قَلْبِهِ صِفَةٌ مَحْمُوْدَةٌ يَطْلُبُ تَحْرِيْكُهَا بَلْ لَيْسَ لَهُ إِلاَّ الَّلذَّةُ وَاِلاِسْتِرَاحَةُ الْمُحْضَةُ فَيَنْبَغِي أَنْ يَسْتَحَبَّ لَهُ ذَلِكَ لِيَتَوَصَّلُ بِهِ إِلَى الْمَقْصُوْدِ الَّذِيْ ذَكَرَنَاهُ نَعَمْ هَذَا يَدِلُّ عَلَىْ نُقْصَان عَنْ ذَرْوَةِ الْكَمَالِ فَإِنَّ الْكَامَلَ هُوَ الَّذِيْ لَا يَحْتَاجُّ أَنْ يَرُوْحَ نَفْسَهُ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَلَكِنَّ حَسَنَاتُ الأَبْرَارِ سَيِّئَاتٌ الْمُقَرَّبيِنْ َوَمَنْ أَحَاطَ بِعِلْمٍ عِلَاجَ الْقُلُوْبِ وَوُجُوْهَ التَّلْطُفِّ بِهَا لِسَيَاقَتِهَا إِلْىْ الْحَقِّ عِلُمٌ قطعاً أَنْ تَرَوِيْحَهَا بِأَمْثَالِ هَذِهِ الأُمْوْرِ دَوَاءٌ نَافِعٌ لَا غِنَىْ عَنْهُ.
-      আনন্দ-বিনোদন কাউকে (জীবনের) গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর বিষয়গুলোতে সাহায্য করে; কেননা এ ধরনের সহায়ক বস্তু ছাড়া কারো পক্ষে তা (অর্থাৎ, গুরুতর বিষয়াদি) সহ্য করা অসম্ভব; এর ব্যতিক্রম শুধু পয়গম্বরবৃন্দ (আলাইহিমুস্ সালাম)। অতএব, ক্লান্তি-অবসাদ হতে অন্তরের ব্যাধির আরোগ্য হচ্ছে আনন্দ-বিনোদন, আর তাই তা সে অনুযায়ী জায়েয (অনুমতিপ্রাপ্ত)। তবে কেউ তাতে মাত্রাতিরিক্তভাবে জড়িত হতে পারবে না, ঠিক যেমনটি কেউ মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবন করতে পারে না। এই নিয়্যতের (অর্থাৎ, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর বিষয়গুলো হতে জিরানোর উদ্দেশ্যের) ওপর ভিত্তি করেই আনন্দ ও বিনোদন আল্লাহতালার নৈকট্যলাভের (পুণ্যদায়ক) কর্মে পরিণত হয়; আর এটা সে ব্যক্তির জন্যেই প্রযোজ্য যিনি সেমা শ্রবণে বিশেষ যে প্রশংসনীয় গুণ বিকাশের পথ অন্বেষণ করছেন, তা (তাঁর মাঝে) বিকশিত হয় না। বরঞ্চ এ ধরনের ব্যক্তি স্রেফ আনন্দ ও বিনোদন তালাশ করেন। তাই এ ধরনের আমল (কর্ম/অনুশীলন) তাঁর জন্যে প্রশংসনীয় হওয়া জরুরি যাতে তিনি সেটার অনুশীলন দ্বারা উপরোল্লিখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেন।

তবে এই পরিস্থিতি পূর্ণতা হতে নিম্নতর এক স্তরের ইঙ্গিত বহন করে। কেননা পূর্ণতাপ্রাপ্ত জন তিনি-ই, যাঁর সাহায্যের জন্যে সত্য ছাড়া অন্য কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। অবশ্য সাধারণ মানুষের সওয়াব তথা পুণ্যদায়ক কর্ম হচ্ছে আধ্যাত্মিকতায় উচ্চস্তরের সিদ্ধপুরুষদের জন্যে হারাম-কর্ম। অন্তরের ব্যাধি নিরাময় ও অন্তরকে (খোদার প্রতি) বিগলিত করার বিদ্যা যিনি রপ্ত করেছেন, তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন এ ধরনের আনন্দ-বিনোদন এমন-ই বিষয়াবলী যা কেউ পরিহার করতে পারে না।[১]

ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো লেখেন

-      বাদ্যযন্ত্র যদি মদ্যপায়ীদের বা লাম্পট্যের (সাথে সংশ্লিষ্টতার) চিহ্ন হয়, হারমোনিকা, ফুঁ দ্বারা বাজানো যন্ত্র, তারবিশিষ্ট বাদ্য, কিম্বা মদ্যপায়ীদের ব্যবহৃত ঢোল জাতীয় বাদ্য হয়, তাহলে তা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র, যেমন ঝুনঝুনির সাথে খঞ্জনি, (দফ), ঢোল, ডালপালা দ্বারা আঘাতকৃত ঢোল, তারবিশিষ্ট গিটার জাতীয় বাদ্য ও অনুরূপ বাজনা, এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র শোনা জায়েয।

অপরাপর উলামামণ্ডলী সঙ্গীত ও তা শ্রবণের মাঝে দেখতে পেয়েছেন সমঝদারদের এবং উচ্চ মক্বামের পুণ্যাত্মাদের জন্যে শিক্ষা ও পরোক্ষ (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের দিকনির্দেশনা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম কাজী আয়াজ শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি যাঁকে সঙ্গীত শ্রবণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি এর উত্তরে বলেন, “সঙ্গীতের স্পষ্ট প্রতীয়মান প্রকৃতি হচ্ছে চিত্তাকর্ষক ও প্রলুব্ধকর; পক্ষান্তরে দীক্ষিত ব্যক্তিদের (মানে আহলে সেমার) জন্যে এতে নিহিত রয়েছে পূর্ণ (আধ্যাত্মিক) শিক্ষা। অতএব, যাঁরা পরোক্ষ (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের দিকনির্দেশনাসমূহ বুঝতে সক্ষম, তাঁদের জন্যে সেমা শ্রবণ জায়েয।”

অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায় সুলতানুল উলামা ইমাম আল-ইযয ইবনে আবদ আল-সালাম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছ থেকেও, যিনি বলেন, “অন্তরের ব্যাধি নিরাময়ের পথগুলো বহু, যেমন ক্বুরআন তেলাওয়াত শোনা, যেটা শ্রবণের বেলায় সেরা জিনিস; এটা আরো করা যায় উপদেশ ও যিকর-তাযকেরাসূচক ওয়ায-নসীহত শুনে, গান (সেমা) ও কবিতা আবৃত্তি শুনে; আরো করা যায় সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র শ্রবণ করে, তবে এর অনুমতি নিয়ে (উলামাদের মধ্যে) মতপার্থক্য বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, বাঁশি শ্রবণ জায়েয হলে এর শ্রোতার মাঝে উদ্ভূত হাল (আধ্যাত্মিক মত্ততা) প্রশংসাযোগ্য; আর যেসব (বাদ্যযন্ত্রের) ক্ষেত্রে মতপার্থক্য বিরাজমান, তা শ্রবণে ধর্মীয় সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে।

ইমাম আল-কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ আল-জামেউ আল-আহকাম আল-ক্বুরআন শীর্ষক তাফসীরগ্রন্থে বর্ণনা করেন যে
ضُرِبَ بَيْنَ يَدَيِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ دَخَلَ الْمَدِينَةَ، فَهَمَّ أَبُو بَكْرٍ بِالزَّجْرِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (دَعْهُنَّ يَا أَبَا بَكْرٍ حَتَّى تَعْلَمَ الْيَهُودُ أَنَّ دِينَنَا فَسِيحٌ) فَكُنَّ يَضْرِبْنَ وَيَقُلْنَ: نَحْنُ بَنَاتُ النَّجَّارِ، حَبَّذَا مُحَمَّدٌ مِنْ جَارِ. وَقَدْ قِيلَ: إِنَّ الطَّبْلَ فِي النِّكَاحِ كَالدُّفِّ، وَكَذَلِكَ الْآلَاتُ الْمُشْهِرَةُ لِلنِّكَاحِ يَجُوزُ اسْتِعْمَالُهَا فِيهِ بِمَا يَحْسُنُ مِنَ الْكَلَامِ وَلَمْ يَكُنْ فِيْهِ رَفَثُ.
-     মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে যেদিন মদীনা মোনাওয়ারায় প্রবেশ করেন, সেদিন কিছু ক্বুরাইশ বংশীয় (তরুণী) তাঁর উপস্থিতিতে গান গাইছিলেন। হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এতে বিরক্ত হন। এমতাবস্থায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেন, “এদের ছেড়ে দাও, ওহে আবূ বকর, যাতে ইহুদী সম্প্রদায় দেখতে পায় যে আমাদের পথ ও মত প্রসারণশীল।ওই মেয়েরা দফ (ঢোল) বাজিয়ে গান করছিল এই বলে, “আমরা বনি নাজ্জার বংশের তরুণী, আর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রতিবেশী হিসেবে পাওয়া পছন্দ করি।ইমাম আল-ক্বুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি অতঃপর বলেন, “কথিত আছে যে বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত দফ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র জায়েয - যতোক্ষণ গানের কথা আদবশীল ও নির্ভরযোগ্য হয় এবং মন্দ/অশ্লীল না হয়।” []

আল-শওকানী তার কৃত নায়ল আল-আওতারগ্রন্থের সঙ্গীত ও আনন্দ-উল্লাসের বাদ্যযন্ত্রপরিচ্ছেদে সঙ্গীতকে জায়েয ও হারাম ঘোষণাকারী উলামাদের উভয় পক্ষের যুক্তিপূর্ণ ভাষ্যই উদ্ধৃত করেন। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেই হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করেন, যাতে এরশাদ হয়েছে:
كُلُّ لَهْوٍ يَلْهُو بِهِ الْمُؤْمِنُ فَهُوَ بَاطِلٌ إلَّا ثَلَاثَةٌ: مُلَاعَبَةُ الرَّجُلِ أَهْلَهُ، وَتَأْدِيبُهُ فَرَسَهُ، وَرَمْيُهُ عَنْ قَوْسِهِ.
-      ঈমানদারের জন্যে ফুর্তির সকল ধরনই ফায়দাহীন, তিনটি ছাড়া: স্ত্রীর সাথে তার স্বামীর আনন্দ, কোনো লোকের দ্বারা আপন ঘোড়া নিয়ে খেলা, এবং তীরন্দাজের খেলা।[]

অতঃপর আল-শওকানী এ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন,
قَالَ الْغَزَالِيُّ: قُلْنَا قَوْلَهُ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - " فَهُوَ بَاطِلٌ " لَا يَدُلُّ عَلَى التَّحْرِيمِ، بَلْ يَدُلُّ عَلَى عَدَمِ فَائِدَةٍ انْتَهَى.
-      হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিরর্থকমর্মে কথাটি ওই বিষয়ের হারাম হওয়াকে আবশ্যিক করে না, বরঞ্চ ইঙ্গিত করে যে এতে ফায়দা নিহিত নেই।এরপর আল-শওকানী যোগ করেন, “এটা বাস্তবিকই একটা নির্ভরযোগ্য বক্তব্য। কেননা সরাসরি ফায়দা নেই এমন যে কোনো বিষয়-ই জায়েয শ্রেণিভুক্ত।

আল-শওকানী এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য শরঈ দলিলও উপস্থাপন করেন; উদাহরণস্বরূপ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো একটি জ্বেহাদ থেকে সহি-সালামতে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর সামনে দফ বাজিয়ে গান করার মানতকারিনী নারীর ঘটনাটি, যার অনুমতি তিনি নিরাপদে ফেরার পর কোনো ভর্ৎসনা ছাড়াই দিয়েছিলেন। এই অনুমতি প্রমাণ করে যে ওই ধরনের পরিস্থিতিতে মহিলাটি যা করেছিলেন, তা অবাধ্যতার কোনো অনুশীলন ছিল না।

ইবনে হাযম বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান,
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ: " إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالْنِّيَاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ اِمْرِئٍ مَا نَوَىَ " فَإِذَا نَوَى المْرَْءُ بِذَلِكَ تَرْوْيْحِ نَفْسِهِ وَإِجْمَالِهَا (1) لِتَقَوْى عَلَىْ طَاعَةِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَمَا أَتِىْ ضَلَالاً.
-      সকল কর্ম-ই নিয়্যত তথা উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভরশীল, আর সেটা প্রত্যেকের প্রতি তা-ই (বর্তায়) যা সে নিয়্যত করেছিল।অতএব, যে কেউ আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতার হাতিয়ারস্বরূপ গান শুনলে বা অন্য কোনো কাজে লিপ্ত হলে, তা মন্দ কর্ম বলে সাব্যস্ত হবে; আর যে কেউ গান শোনার নিয়্যত যদি করেন এ মর্মে  যে এতে তাঁর আত্মার প্রশান্তি লাভ হবে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মের অনুশীলনের প্রতি তা এক হাতিয়ার হবে, তবে তিনি আনুগত্যপূর্ণ কর্মে লিপ্ত হবেন এবং এতে তিনি পুরস্কারও পাবেন, আর এ কাজটি প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য আমল বটে।[৪]

যে কেউ কোনো কাজে আনুগত্য বা অবাধ্যতার নিয়্যত না করলে তার এ কাজটি স্রেফ আনন্দ-ফুর্তি বলে সাব্যস্ত হবে। আর এতে কোনো (ধর্মীয়) ফায়দা নেই। বস্তুতঃ এ ধরনের কাজকে ক্ষমা করা হবে; যেমন - কেউ তার বাগানে হাঁটা, অথবা নিজ গৃহের দরজায় বসে থাকা ইত্যাদি।

সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, বাদ্যসহ বা বিহীন সেমা-কাওয়ালীর বিষয়টি এমন এক বিষয় যা সকল যুগেই উলামাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে। এ সকল আলেম কিছু বিষয়ে একমত হয়েছেন, আবার অন্য বিষয়গুলোতে পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেছেন এ মর্মে, (খোদায়ী) অবাধ্যতা সৃষ্টিকর বা তাতে সহায়ক যে কোনো ধরনের গান-বাদ্য হারাম। যেহেতু গানের মধ্যে কথা রয়েছে, সেহেতু ভালো কথা জায়েয এবং মন্দ/অশ্লীল কথা না-জায়েয। এই আলেমবৃন্দ আরো একমত হয়েছেন যে বিয়ে-শাদী, কারো গৃহে প্রত্যাবর্তন ও ঈদের দিনের মতো খুশির দিনগুলোতে আনন্দপূর্ণ গান পরিবেশনা জায়েয; তা অবশ্য বিশেষ শর্তসাপেক্ষে, যেমন কোনো নারী তাঁর অনাত্মীয় পুরুষদের সামনে গান পরিবেশন করতে পারবেন না।

উলামাবৃন্দের মতানৈক্যের ক্ষেত্রগুলো হলো বাদ্যযন্ত্র জায়েয, না হারাম এবং ইতিপূর্বে উল্লেখিত বিষয়াদি।

এই আলোচনার আলোকে আমরা দেখতে পাই, বাদ্যসহকারে বা বাদ্যবিহীন গান জায়েয এই শর্তে যে, তা (খোদার প্রতি) অবাধ্যতা, লাম্পট্য কিংবা শরীয়তবিরোধী কোনো বক্তব্যসহ হতে পারবে না। আরো উল্লেখ্য যে, সঙ্গীতের মাত্রাহীনতা এর অনুমতিকে নাকচ করে অপছন্দনীয় কাজে পরিণত করতে পারে, হয়তো বা হারামেও।

আল্লাহ তালাই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বজ্ঞানী।

আলী জুমুআ

তথ্যসূত্র
[১] গাযালী : ইহইয়া উলূমুদ্দীন, :২৮৭
[] কুরতুবী : আত তাফসীর, লুকমান, ৩১:
[] শাওকানী : নায়লুল আওতার, :১১৮
[] ইবনে হাযম : আর রাসায়িল, রিসালাতু ফিল গিনায়ী ১:৪৩৯