- ড: এ. এস. এম. ইউসূফ জিলানী
কিছু কিছু লা-মাযহাবী ভাই ‘মাওলানা’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে সমাজে নতুন করে ফেতনার জাল সৃষ্টি করে চলছে। তারা বলে, আলেমদের নামের পূর্বে ‘মাওলানা’ শব্দ ব্যবহার করা শিরক!! অথচ যুগ যুগ ধরে উলামায়ে কেরাম নামের পূর্বে ‘মাওলানা’ শব্দ ব্যবহার করে আসছেন। কেউ কোনদিন আপত্তি করেন নি। অনেক সময় সাধারণ মুসলমানও তাদের বিভ্রান্তির শিকার হয়। নিচে লা-মাযহাবী ভাইদের ভ্রান্তির কিছু দলিল পেশ করা হলো:
‘মাওলানা’ শব্দটি আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত। তাই নিম্নে আসমাউল হুসনা সম্পর্কে শরীয়তের হুকুম উল্লেখ করা হলো:
আল্লাহ শব্দের গুণবাচক নাম দুই ধরনের:
প্রথমতঃ
যে সকল নাম শুধু আল্লাহ তায়ালার সাথে নির্দিষ্ট। যেমন, القيوم,البارى,الخالق,الرحمان,الله ইত্যাদি শব্দে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম রাখা জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা المسمى(মুসাম্মা) তার জন্যই নির্দিষ্ট; যা অংশীদারিত্বকে গ্রহণ করেনা।
দ্বিতীয়তঃ
আল্লাহ পাকের নাম সমূহের মধ্যে যে সকল নামের ব্যাপক অর্থ রয়েছে; অবস্থাভেদে যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। যেমন- মালিক, আযীয, জাব্বার, মুতাকাব্বির ইত্যাদি শব্দ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার জায়েয আছে। এ সকল শব্দ আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে কোথাও নিজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, আবার কোথাও বা বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণগুলোর প্রতি লক্ষ করুন:
১. বান্দার ক্ষেত্রে الْعَلِيمُ শব্দের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ অর্থাৎ, ‘নিশ্চয়ই তিনি সকল কথা শোনেন, সকল কিছু জানেন।’(সূরা-আনফাল-৬১)
উক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে الْعَلِيمُ (তথা সর্বজ্ঞ) ব্যবহার করেছেন, আবার নিম্নোক্ত আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রেও الْعَلِيمُ শব্দ ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন: وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ অর্থাৎ ‘অতঃপর তারা তাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিল, যে বড় জ্ঞানী হবে।’ (সূরা- যারিআত -২৮)
এখানে বড় জ্ঞানী বলতে হযরত ইসহাক (আ:)’কে বুঝানো হয়েছে। তবে আল্লাহ তাআলার ইলম আর বান্দার ইলমের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আল্লাহ তাআলার ইলম হচ্ছে পরিপূর্ণ ও অসীম। আদিতেই তার ইলম ছিল, কখনো অজ্ঞতা ছিল না। আর তিনি কখনো বিস্মৃত হন না এবং তার ইলমে কখনো কমতি ও ত্রুটি দেখা দেয় না। এর বিপরীত হলো মানুষের জ্ঞান, কেননা তা ত্রুটিপূর্ণ। মানুষের ইলমের আগের অবস্থা হলো মূর্খতা ও অজ্ঞতা। আর মানুষদেরকে যে জ্ঞান দান করা হয়েছে তা স্বল্পই।
২. বান্দার ক্ষেত্রে الْعَزِيزُ, الْجَبَّارُ, الْمُتَكَبِّرُ শব্দের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাআলা ক্ষমতাবান, সকল দোষ-ত্রুটি হতে সংশোধনকারী, গৌরবান্বিত।’ (সূরা-হাশর-২৩)
উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে ‘আযীয’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার সূরা ইউসূফে বান্দার ক্ষেত্রেও ‘আযীয’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে- قَالَتِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ অর্থাৎ, ‘আযীযের স্ত্রী বলল, এবার সত্য কথা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ (সূরা ইউসুফ-৫১)
অন্য আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রেও الْجَبَّارُ ও الْمُتَكَبِّرُ শব্দ দু’টি ব্যবহার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- كَذَلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَى كُلِّ قَلْبِ مُتَكَبِّرٍ جَبَّارٍ অর্থাৎ, ‘এভাবেই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তির অন্তরে মোহর করে দেন।’ (সূরা মুমিন-৩৫)
৩. বান্দার ক্ষেত্রে حَلِيمًا শব্দের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا অর্থাৎ ‘তিনি সহনশীল, ক্ষমাশীল।’ (সূরা ফাতির-৪১)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে حَلِيمًا শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার তিনি অন্যত্র বান্দার ক্ষেত্রেও حَلِيمًا শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন, ইরশাদ হয়েছে- فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ অর্থাৎ, ‘সুতরাং আমি তাকে (ইব্রাহীম আ:’কে) এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’
(সূরা আস-সফফাত-১০১)
(সূরা আস-সফফাত-১০১)
৪. বান্দার ক্ষেত্রে سَمِيعًا ও بَصِيرًا শব্দের ব্যবহার:
মহান আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا অর্থাৎ, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সব কিছু শোনেন, সব কিছু দেখেন।’ (সূরা নিসা-৫৮)
উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে سَمِيعًا ওبَصِيرًا শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার সূরা দাহরে আল্লাহ তাআলা বান্দার ক্ষেত্রেও উক্ত শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন।
মাওলানা’ উপাধি মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘মাদরাসা স্নাতকোত্তর পাস করা ব্যক্তিকে ‘মাওলানা’ বলা হয়ে থাকে।
প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। ‘মাওলানা’ শব্দটি আরবি, তবে আরব থেকে ইরান, তুর্কি, আফ্রিকা ও ভারত উপমহাদেশ ঘুরে নানা অর্থ পরিগ্রহ করেছে। যেমন—ইরানের প্রখ্যাত কবি রুমির নামের আগে ‘মওলানা’ ব্যবহৃত হয়। ‘মাওলানা’ শব্দটির তুর্কি উচ্চারণ হলো ‘মেভলানা’।
‘মাওলানা’ শব্দটি মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাপূর্ণ অর্থ বহন করে। অন্যদিকে সাধারণ ধর্মীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে উপাধি হিসেবে ‘মৌলভি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
‘মাওলানা’ বা ‘মওলানা’ শব্দটি আরবি। এটি ‘মাওলা’ ও ‘না’ দুটি শব্দে গঠিত। ‘না’ একটি সর্বনাম। এর অর্থ আমরা বা আমাদের। আর ‘মাওলা’ শব্দের প্রায় ৩০টি অর্থ আছে। যেমন—প্রভু, বন্ধু, সাহায্যকারী, মনিব, দাস, চাচাতো ভাই, প্রতিনিধি, অভিভাবক, নিকটবর্তী, আত্মীয়, নেতা, গুরু, প্রতিপালক, সর্দার, প্রেমিক, প্রতিবেশী, আনুগত্য, প্রার্থনা, নীরবতা, ইবাদত, দণ্ডায়মান ইত্যাদি। (লিছানুল আরব : ৮/৪৫২, আল-মিসবাহুল মুনির, পৃষ্ঠা ৫৯১)
পবিত্র কুরআন শরিফে প্রায় ৪টি অর্থে মাওলা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:
১.সূরা বাকারার ২৮৫ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: ﺍﻧﺖ ﻣﻮﻻﻧﺎ ﻓﺎﻧﺼﺮﻧﺎ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻘﻮﻡ ﺍﻟﻜﺎﻓﺮﻳﻦ’ এখানে শব্দটি অভিভাবক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
২.সূরা হাদীদের ১৫ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: ﻓَﺎﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻟَﺎ ﻳُﺆْﺧَﺬُ ﻣِﻨﻜُﻢْ ﻓِﺪْﻳَﺔٌ ﻭَﻟَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭﺍ ﻣَﺄْﻭَﺍﻛُﻢُ ﺍﻟﻨَّﺎﺭُ ﻫِﻲَ ﻣَﻮْﻟَﺎﻛُﻢْ ﻭَﺑِﺌْﺲَ ﺍﻟْﻤَﺼِﻴﺮُ এখানে শব্দটি আবাসস্থল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৩.সূরা মুহাম্মাদের ১১ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: ذلك بأن الله مولى الذين ..آمنوا. এখানে শব্দটি বন্ধু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪.সূরা তাহরীমের ৪ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: والله مولاكم... এখানে সহযোগী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অনেকে না জেনে বলে ফেলেন যে ‘মাওলানা’ শব্দটি আল্লাহর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট। তাই মানুষের জন্য এ শব্দ ব্যবহার করা ‘শিরক’! প্রমাণ হিসেবে তারা বলেন, পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আনতা মাওলানা ফানছুরনা—অর্থাৎ আপনিই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আপনি আমাদের সাহায্য করুন। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
এ আয়াতে ‘মাওলানা’ বলে আল্লাহকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই কোনো মানুষকে ‘মাওলানা’ বলে সম্বোধন বা বিশেষিত করা জায়েজ নয়, বরং শিরক!
আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘মাওলানা’ শব্দকে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, আলেমদের ক্ষেত্রে সে অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘মাওলানা’ অর্থ হলো আমাদের প্রভু বা প্রকৃত অভিভাবক; আর আলেমদের ক্ষেত্রে তার অর্থ হচ্ছে আমাদের ধর্মীয় অভিভাবক। (সূত্র : কিতাবুল ফাতাওয়া : ১/২২৮, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল : ২/৬৩৮)
যদি শুধু শব্দগত রূপের ক্ষেত্রে মিল থাকার ফলে কোনো শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ঈমানদারদের জন্য ‘মুমিন’ শব্দ ব্যবহারও ‘নাজায়েজ’ হতে বাধ্য। কেননা আল্লাহ তাআলার ৯৯ নামের একটি হচ্ছে ‘মুমিন’। অথচ কোরআন ও হাদিসে বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ‘মুমিন’ বলে বিশেষিত করা হয়েছে। এর কারণ হলো, বান্দার ক্ষেত্রে ‘মুমিন’ শব্দ এক অর্থে আর আল্লাহর ক্ষেত্রে অন্য অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। একই কথা ‘মাওলানা’ শব্দটার বেলায়ও প্রযোজ্য।
ইতিহাসে দেখা যায়, প্রখ্যাত তাবেয়ি হজরত হাছান বসরিকে লোকেরা ‘মাওলানা’ বলে ডাকত।(সূত্র : তাহজিবুত তাহজিব : ২/২৬৩, আলবেদায়া ওয়ান্নেহায়া : ৬/২৬৬)
তাছাড়া আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উর্দু ভাষায় ‘মাওলানা’ শব্দটি উস্তাদ ও আলেমে দ্বিন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। (সূত্র : আল-হাদিয়্যাতুল মারযিয়্যা, পৃষ্ঠা ১১৭, ফিরুজুল লুগাত, পৃষ্ঠা ৬৬৪)
আমরা যেহেতু এই শব্দের ব্যবহার উর্দুভাষীদের থেকে পেয়েছি, তাই মাওলানা দ্বারা এই দুই অর্থই উদ্দেশ্য।
কাজেই না জেনে এ শব্দ ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করা বা বিভ্রান্তি ছড়ানো অনুচিত।
*সমাপ্ত*
*সমাপ্ত*