Saturday, 28 September 2024

প্রিয়নবী (দ.) কুর’আন ব্যাখ্যাকারী মর্মে কোনো আয়াত আছে কি? - প্রতিক্রিয়া ও জবাব

 -এডমিন


সম্প্রতি ফেইসবুকে উপরোক্ত শিরোনামের গবেষণামূলক লেখাটির অংশবিশেষ প্রকাশের পরে আমার জনৈক তরীক্বতী ভাই ও ফেইসবুক বন্ধু তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাতে তিনি লেখাটির সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। মন্তব্য সেকশনে তাঁর বক্তব্য আমি পুরোটুকু উদ্ধৃত করছি: 


ভাইয়া লিখেছেন খুব ভালো, তথ্যবহুল। তবে আমার কিঞ্চিৎ অমত আছে। যেসব আয়াত দ্বারা লেখক কোরআন ব্যক্ষ্যার দায়িত্ব হুজুপুরনুর(সাঃ) এর দাবী করেছেন; সেগুলি মুলত রুপক। আল্লাহ হুজুরপুরনুর(সাঃ)কে মুহাব্বত করেন তাই এই legacy. ৫৯ঃ৭ পড়লে বুঝবেন এই আয়াত গনিমতের মাল বণ্টনের ক্ষেত্রে নাজিল হয়েছিল। মুলত আল্লাহই কোরআন ব্যক্ষ্যাকারী ৭৫ঃ১৯। কোরআন নিজেই নিজের তাফসীর, তাফসিল (বিশদ বিবরন) ৩ঃ১৩৮, ২৫ঃঃ৩৩। আল্লাহর বিধানে শরিক নাই ১৮ঃ২৬। মুলত কোরআনই হাদিস ৩৯ঃ২৩,৪ঃ৮৭,৪৫ঃ৬-৮। কেননা ভাষ্য যার ব্যক্ষ্যাও তার। মতানৈক্যের জন্য ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, বেয়াদবি নিবেন না।”


আলোচ্য লেখাটির আংশিক পড়ে ওপরের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। কেননা লেখাটির প্রথমাংশে লিপিবদ্ধ আছে:


কিছু লোক সম্প্রতি বলছে, "আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের কাছে এটি পাঠিয়েছেন এবং আমাদেরকে শুধুমাত্র এর উপর নির্ভর করতে বলেছেন; এবং তিনি আমাদেরকে অন্য কিছুর জন্য দায়ী করেননি।" এইভাবে তারা জ্ঞাতসারে বা অজান্তে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ ত্যাগ করার চেষ্টা করে এবং তারা সন্দেহ সৃষ্টির অপপ্রয়াস পায় দ্বীনী ক্ষেত্রে সুন্নতের প্রামাণ্য দলিল হওয়ার ব্যাপারটিতে, এর (মানে সুন্নাতের) নির্ভরযোগ্যতা ও বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততার ব্যাপারটিতেও {নোট-১: এই অপচেষ্টা নতুন নয়। এদের ভিত্তি প্রাথমিক যুগ থেকেই আরম্ভ হয়। তবে আমরা ওই অভিব্যক্তি দ্বারা বর্তমান সময়ের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। দেখুন - আবূ যাহও কৃত ‘আল-হাদীস ওয়াল-মুহাদ্দিসূন’, মিসর, ১৩৭৮ হি:/১৯৫৮ খ্রী:, ২১ পৃষ্ঠা; আল-সিবাঈ, ‘আস্ সুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা ফীত্ তাশরিঈল্ ইসলাম,’ কায়রো, ১৯৬৬, ১১-১৪ পৃষ্ঠা; আবদুল গনী অবদুল খালিক্ব, ‘হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, বৈরুত, ১৪০৭ হি:/১৯৮৬ খ্রী:, ২৭৮ পৃষ্ঠা; ‘কিরবাসোগলু, এম. হায়রি, ‘ক্বুরআনা গোরে সুন্নাতেন কোনুমু’ (অপ্রকাশিত প্রবন্ধ), পৃষ্ঠা ১-৩, একই বিষয়ে।} কিছু লোক প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ’র ব্যাপারে অলসতা দেখায় এবং এমন মনোভাব গ্রহণ করে যেনো “সুন্নাহকে অনুসরণ করা বা না করা দুটোই ঠিক আছে।” প্রকৃতপক্ষে, কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সুন্নাহকে একটি অসাধারণ মর্যাদা দিয়েছেন এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর আনুগত্যকে তাঁরই আনুগত্যের মতো গণ্য করেছেন।


কুর’আনে বলা হয়েছে যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের জন্য, বিশেষ করে ঈমানদার/বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর আশীর্বাদ; তাঁর প্রতি বিশ্বাস আল্লাহর আনুগত্যের সাথে জড়িত; তাঁকে মানুষের জন্য মডেল হিসেবে দেখানো হয়েছে; এটি বিবৃত হয়েছে যে তাঁকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, যার মানে কুরআনের সাথে অনেক জায়গায় সুন্নাহও রয়েছে যাতে তিনি সেগুলি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন; এবং ওহী শুধুমাত্র কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; অধিকন্তু, আল্লাহর আনুগত্যের সাথে নবীর আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে এবং নবীর আনুগত্যের কথা আলাদাভাবেও বলা হয়েছে।


তবে এটা নিঃসন্দেহ যে সুন্নাহ কখনই কুরআনের মতো একই স্তরে মানা হয়নি; কুরআন সর্বদা প্রথম স্থানে রয়েছে এবং সুন্নাহ এটি অনুসরণ করেছে।


প্রকৃতপক্ষে, এটি মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:)-কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রদত্ত নির্দেশে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে, যখন তাঁকে ইয়েমেনে গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় {নোট-২: তিরমিযী, ‘আহকাম,’ ৩; মুসনাদ, ৫:২৩০; আবূ দাউদ, ‘আক্বদিয়া’, ১১}। উপরন্তু, সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’মণ্ডলীর অনুশীলিত রীতিও একই রকম ছিলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগী ও বেসাল শরীফ উভয় সময়কালেই। তাঁরা প্রথমে কুরআন এবং তারপরে সুন্নাহর রেফারেন্স দিতেন {নোট-৩: এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে ’হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, ২৮৩-২৯১ পৃষ্ঠা দেখুন}।


চলুন, দেখা যাক আমরা এইমাত্র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা কীভাবে কুরআনের আয়াতগুলো প্রকাশ করে।


নিঃসন্দেহে এটি একটি মহান আশীর্বাদ যে মহান আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে একজন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে মনোনীত করেছেন এবং তাঁকে আমাদের কাছে এক জীবন্ত আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন।


(১) কুরআনের যেসব আয়াতে বলা হয়েছে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু’মিনদের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর মহান আশীর্বাদ:


 لَقَدْ مَنَّ ٱللهُ عَلَى ٱلْمُؤمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُّبِينٍ.


অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে, তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন, আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিলো। [আল-ক্বুর’আন ৩:১৬৪, নূরুল ইরফান]


لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ،  فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ ٱللهُ لاۤ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْعَظِيمِ.


অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসূল, যাঁর নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, (যিনি) তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু। [আল-ক্বুর’আন, ৯:১২৮/১২৯, নূরুল ইরফান] {নোট-৪: একই বিষয়ে আরো আয়াত সম্পর্কে জানতে বাক্বারা-১৫২, তওবা-৬১, আম্বিয়া-১০৭, জুমুআ-২/৪ দেখুন} 


নিঃসন্দেহে মানুষ হিসেবে আমাদের যা করা দরকার তা হলো, এই মহান নেয়ামতের মূল্য জানা, যেমনটি আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে {নোট-৫: আল-আহযাব, ৬ আয়াত} এই মর্মে যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে আমাদের আত্মার চেয়েও মূল্যবান মনে করা, তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসা এবং তাঁর মহান সত্তাকে অনুসরণ করা, যাঁকে আমাদের কাছে মডেল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি বিশ্বাস মুসলমান হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। কালেমা আশ-শাহাদায় আল্লাহর পবিত্র নামের সাথে তাঁর মোবারক নামও বিদ্যমান। এছাড়া, কুরআন মজীদে তাঁর প্রতি ঈমান আনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে {নোট-৬: দেখুন সূরাহ আ’রাফ, ১৫৮; নিসা, ১৩৬; তওবা ৯১; নূর, ৬২; ফাতহ, ৮-৯, ১৩; হুজুরাত, ১৫; তাগাবুন, ৮}। নিঃসন্দেহে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের এমন এক অর্থ আছে যা তাঁর স্রেফ নবী হওয়ারও ঊর্ধ্বে, যা অপরিহার্য করে তোলে সেসব বিষয়কে গ্রহণ করা যেগুলোকে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ, উপদেশ, অনুশীলিত রীতি, সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সংক্ষেপে, সকল ক্ষেত্রে তাঁকে মডেল হিসেবে বিবেচনার বিষয়াদি। 


ধর্মে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর অসাধারণ মর্যাদা প্রদর্শনকারী আরেকটি পয়েন্ট হলো এই যে, তাঁকে স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই সকল ক্ষেত্রে মডেল তথা অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পেশ করেছেন। 


(২) কুরআনের যেসব আয়াত মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে পেশ করেছে মডেল হিসেবে:


আমরা কুরআনে দেখতে পাই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহতায়ালা একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যা ঈমানদার তথা বিশ্বাসীদের দ্বারা স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে গৃহীত হবে। এটা বোঝা যায় যে, তাঁকে সকল দিক থেকে মানুষের জন্য একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে; কারণ এই বিষয়ে আয়াতে কোনো শর্ত রাখা হয়নি।


এর মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিম্নরূপ:


لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ ٱللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُواْ ٱللهَ وَٱلْيَوْمَ ٱلآخِرَ وَذَكَرَ ٱللهَ كَثِيراً.


অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর অনুসরণ উত্তম, তারই জন্য, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব স্মরণ করে। [আল-ক্বুর’আন, ৩৩:২১, নূরুল ইরফান]


যাঁরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করেন তাঁদের জন্য আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে একটি সুন্দর আচরণের নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তাঁকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসের সাথে জড়িত, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান করে তাঁর সুন্নাহকে কতোখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 


কুরআন কেবল এ কথাই বলে না যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের জন্য একটি আদর্শ, বরঞ্চ এর ওপরও জোর দেয় যে তিনি চরিত্রবৈশিষ্ট্যের এক উচ্চ মানদণ্ড:


نۤ وَٱلْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ، مَآ أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍ، وَإِنَّ لَكَ لأَجْراً غَيْرَ مَمْنُونٍ، وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ.


অর্থ: নূ-ন। কলম ও তাদের লিখার শপথ। আপনি আপনার রবের অনুগ্রহে উন্মাদ নন; এবং অবশ্যই আপনার জন্য অশেষ পুরস্কার রয়েছে; এবং নিশ্চয় আপনার চরিত্র তো মহা মর্যাদারই। [আল-ক্বুর’আন, ৬৮:১-৪, নূরুল ইরফান]


ধর্মে সুন্নাতের মূল্য প্রদর্শনকারী আরেকটি উপাদান হলো এটি সাধারণভাবে ওহীরই একটি ফল। প্রকৃতপক্ষে আমরা যখন কুরআনের দিকে তাকাই, তখন আমরা অনেক নিদর্শন দেখতে পাই যে ওহী কেবল কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এবং নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের বাইরেও ওহী পেয়েছিলেন।


(৩) যেসব আয়াত উল্লেখ করে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের বাইরেও ওহী পেয়েছিলেন:


এটি কুরআনে বলা হয়েছে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে নিম্নোক্ত উপায়ে ওহী প্রেরণ করেন:


وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ ٱللهُ إِلاَّ وَحْياً أَوْ مِن وَرَآءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولاً فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَآءُ إِنَّهُ عَلِيٌّ حَكِيمٌ.


অর্থ: কোনো মানুষের পক্ষে শোভা পায় না যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন, কিন্তু ওহী রূপে, অথবা এভাবে যে, ওই মানুষ মহত্ত্বের পর্দার অন্তরালে থাকবে অথবা (আল্লাহ) কোনো ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, সে তাঁর নির্দেশে ওহী করবে যা তিনি চান; নিশ্চয় তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল, প্রজ্ঞাময়। [আল-ক্বুর’আন, ৪২:৫১, নূরুল ইরফান]


অতএব, এটি পরিদৃষ্ট হলো যে আল্লাহ ওপরোক্ত আয়াতে করীমায় বিবৃত করেছেন তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে আপন ইচ্ছানুযায়ী কালাম/কথপোকথন করেন, যা ওই সব পন্থার যে কোনোটি হতে পারে, আর তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে নিজ কালামকে কোনো (ঐশী) কিতাবের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ রাখেন না।


উপরন্তু, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্বুর’আনের বাইরেও যে ওহী পেয়েছিলেন তার ইঙ্গিতবহ একটি দিক হলো কুরআন মজীদের বিবৃতি এমর্মে যে,  নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং অন্যান্য কয়েকজন নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-কে দেওয়া কিতাবগুলোর পাশাপাশি "হিকমাহ (জ্ঞান-প্রজ্ঞা)" দেওয়া হয়েছিল {নোট-৭: দেখুন সূরাহ বাক্বারাহ, ২৫১; আলে ইমরান, ৪৮; নিসা, ৫৪; সা’দ, ২০; যুখরুফ, ৬৩}। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছে:


كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولاً مِّنْكُمْ يَتْلُواْ عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ.


অর্থ: যেমন আমি তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রাসূল তোমাদের মধ্য থেকে, যিনি তোমাদের প্রতি আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ/পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেন। আর তোমাদের ওই শিক্ষা দান করেন, যার জ্ঞান তোমাদের ছিলো না। [আল-ক্বুর’আন, ২:১৫১, নূরুল ইরফান] {নোট-৮: অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন সূরা বাকারা, ১২৯, ২৩১; আলে ইমরান, ১৬৪; নিসা, ১১৩; আহযাব, ৩৪; জুমুআ’, ২} 


এই "হিকমাহ", যা কিতাবের পাশাপাশি নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)’মণ্ডলীকে দেওয়া হবে বলে উপরের আয়াত এবং অনুরূপ আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে সাধারণত আল্লাহর নবী-রসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)’বৃন্দের প্রতি প্রদত্ত "সুন্নাহ" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম শাফেয়ী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে প্রকাশ করেছেন:


فذكر الله الكتاب، وهو القُرَآن، وذكر الحِكْمَة، فسمعتُ مَنْ أرْضى من أهل العلم بالقُرَآن يقول: الحكمة سنة رسول الله. وهذا يشبه ما قال، والله أعلم. لأن القُرَآن ذُكر وأُتْبِعَتْه الحكمة.


"আল্লাহ এখানে প্রথমে কিতাব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, যা কুরআন মজীদ, এবং এরপরে "হিকমাহ" সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। আমি কুরআনের তাফসীর-শাস্ত্রে বিজ্ঞ আলেমবৃন্দের কাছ থেকে শুনেছি যে, এখানে (হিকমাহ দ্বারা) যা বোঝানো হয়েছে তা হলো আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ। কেননা, প্রথমে কুরআনকে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারপরে "হিকমাহ" (শব্দটি) যোগ করা হয়েছে" {নোট-৯: ইমাম শাফেঈ (রহ.), ‘আর-রিসালা’, ১/৭৩}। ইমাম আল-আওজাই (বেসাল: ১৫৭ হিজরী/৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) বর্ণনা করেছেন যে হযরত হাসান বি. আতিয়া (রা.) বলেন,


كَانَ جِبْرِيلُ يَنْزِلُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالسُّنَّةِ، كَمَا يَنْزِلُ عَلَيْهِ بِالْقُرْآنِ.


"জিবরীল (আ.) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে সুন্নাহ নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক যেমনিভাবে তিনি কুরআন নিয়ে এসেছিলেন" {নোট-১০: দারিমী, ‘আস্ সুনান,’ ১/৪৭৪; ‘তাউয়ীলু মুখতালিফিল হাদীস’, ১৬৬ পৃষ্ঠা; কুরতুবী (রহ.), ১:৩৩}।


আমরা কুরআনে এমন তথ্য পাই যে অন্যান্য নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)’বৃন্দকেও তাঁদের কাছে প্রেরিত আসমানী কিতাবের বাইরে ওহী পাঠানো হয়েছিল। সর্ব-পয়গাম্বর ইব্রাহিম (আলাইহিস্ সালাম) ও লুত (আলাইহিস্ সালাম)’এর প্রতি তাঁদের নিজ নিজ জাতিকে ধ্বংস করার দায়িত্বের কথা জানিয়ে ফেরেশতাদের বিবৃতি ওই ধরনের ওহী ছিলো {নোট-১১: দেখুন সূরা আনকাবুত, ৩১-৩২; হিজর, ৫২-৭৭}। পয়গাম্বর জাকারিয়া (আলাইহিস্ সালাম), যাঁকে কোনো আসমানী কিতাব পাঠানো হয়নি, আল্লাহ কর্তৃক তাঁর একজন পুত্র সন্তান জন্মাবার কথা জানানোও অনুরূপ একটি বিষয় ছিলো {নোট-১২: আলে ইমরান, ৩৮-৪০}; ঠিক যেমনটি ছিলো মরিয়ম (রা.)’এর সাথে আল্লাহর কালাম, যদিও তিনি নবী ছিলেন না {নোট-১৩: আলে ইমরান, ৪২-৪৫}। অনেক আয়াতে বিবৃত হয়েছে যে, আল্লাহর সাথে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ওহীর বাইরেও যোগাযোগ ছিল {নোট-১৪: এরকম দুটো দৃষ্টান্তের জন্য দেখুন - সূরা আনফাল, ৯-১০; তাহরিম, ৩; বাক্বারাহ, ১৪২-১৪৪}।


উপরোক্ত আল্লাহর সাথে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ওহীর বাইরেও যোগাযোগ থাকার বিষয়ে বর্ণিত ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর মধ্যে একটি হলো:


حَافِظُواْ عَلَى ٱلصَّلَوَٰتِ وٱلصَّلَٰوةِ ٱلْوُسْطَىٰ وَقُومُواْ للَّهِ قَٰنِتِينَ، فَإنْ خِفْتُمْ فَرِجَالاً أَوْ رُكْبَاناً فَإِذَآ أَمِنتُمْ فَٱذْكُرُواْ ٱللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ.


অর্থ: সজাগ দৃষ্টি রেখো সমস্ত নামাযের প্রতি এবং মধ্যবর্তী নামাযের প্রতি। আর দণ্ডায়মান হও আল্লাহর সম্মুখে আদব সহকারে। অতঃপর যদি আশঙ্কায় থাকো, তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায়, যেমনি সম্ভব হয়। অতঃপর যখন নিরাপদে থাকো, তখন আল্লাহকে স্মরণ করো - যেমন তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যা তোমরা জানতে না। [আল-ক্বুর’আন, ২/১৩৮-১৩৯; নূরুল ইরফান] 


অতএব, প্রতীয়মান হয় যে নামাজ এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী সালাত (অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, বিকালের আসর সালাত) সর্বোত্তম উপায়ে আদায় করার নির্দেশ দেওয়ার পরে আল্লাহ বলেছেন যে নামাজ পদচারণায় বা ঘোড়-সওয়ার অবস্থায় পড়া যায়। ভ্রমণের সময় যদি কেউ বিপদের আশঙ্কা করেন তবে অশ্বারোহণ করা উচিত; তবে বিপদ কেটে যাওয়ার পরে তিনি আপনাকে যেভাবে শিখিয়েছেন সেভাবে সেগুলি অবশ্যই করতে হবে। এখানে "তিনি আপনাকে যেভাবে শিখিয়েছেন" মর্মে বাক্যটি কৌতূহলোদ্দীপক। যেমনটি জানা যায়, কুরআনে নামায বিস্তারিতভাবে শেখানো হয়নি। সেক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত যে, কুরআনের বাইরেও জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম)’এর মাধ্যমে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর কাছ থেকে কিছু তথ্য পেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কিছু বর্ণনা আছে যে জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে এসেছিলেন এবং নিজে নিজে অনুশীলন করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বিস্তারিতভাবে শিখিয়েছিলেন {নোট-১৫: দেখুন - বুখারী, বাদ’উল-খালক্ব, ৬; মুসলিম, মাসাজিদ, ১৬৬; আবূ দাউদ, সালাত, ২; ইবনে মাজাহ, সালাত ১; মুসনাদ, ১/৩৩৩, ১১১, ৩০}। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবীদেরকেও একইভাবে শিক্ষা দিয়ে বলেন - وَصَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي - "তোমরা সেভাবেই নামাজ আদায় করো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখো।" {নোট-১৬: বুখারী, আযান, ১৮ অধ্যায়, বই-১০, হাদীস-২৮}


উপরন্তু, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কুর’আনে প্রায়শই আদেশ করা হয়েছে যে তাঁর প্রতি যা অবতীর্ণ হয় তা অনুসরণ করতে {নোট-১৭: দেখুন - সূরা নিসা, ১০৫; আল-মায়েদা, ৪৮-৪৯, ৬৭; আন’আম, ১০৬; আহযাব, ১-২; জাতিয়্যা, ১৮}। যদি ওহী শুধুমাত্র কুর‘আনেরই সমষ্টি হতো, আর যেহেতু এটা স্পষ্ট যে ইসলাম শুধুমাত্র কুরআন নিয়ে গঠিত নয়, তাই এটা মেনে নিতে হবে যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহীর বাইরে অনেক কিছু করেছেন। সেক্ষেত্রে কিছু অসম্ভব বিষয়, যেমন নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দ্বারা আল্লাহর আদেশ পালন না করাকে মেনে নিতে হবে, যা তাঁর সম্পর্কে চিন্তা করাও অসম্ভব {নোট-১৮: কেননা আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করেছেন, বলেছেন তিনি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, আর তিনি তাঁকে আপন উম্মতের জন্য সাক্ষী করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দেখুন - সূরা আম্বিয়া, ১০৭; আহযাব, ৪৫-৪৬; বাক্বারা, ১৪৩}। এরকম কিছু হলে আল্লাহ হস্তক্ষেপ করতেন।


পরিশেষে, আল্লাহ তায়ালা এই বিষয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে নিম্নোক্ত কথা বলেছেন:


وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰ، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَىٰ. 


অর্থ: এবং তিনি কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। তা তো ওহীই, যা তাঁর প্রতি (নাযিল) করা হয়। [আল-ক্বুর’আন, ৫৩:৩-৪; নূরুল ইরফান] {নোট-১৯: অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন - সূরাহ ইঊনুস, ১৫; আহক্বাফ, ৯; বাক্বারা, ১৪২-১৪৪}


উপরের আয়াতে উল্লিখিত ঐশী অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা কিছু অলেমের মতে শুধুমাত্র কুরআন, কিন্তু অন্যান্য আলেম-উলামার মতে কুর’আন এবং কিছু সুন্নাহ। কেননা, হাদীসসমূহ কখনো ওহী এবং কখনো আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ইজতিহাদ (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত)। তবে তাঁর ইজতিহাদে ভুল থাকলেও আল্লাহ তাঁকে সংশোধন করেন {নোট-২০: এ বিষয়ের উদাহরণ - সূরাহ তওবা, ৪৩, ৮৪; আনফাল, ৬৭; ইসরা, ৭৪; আহযাব, ২, ৩৭; আবাসা, ১-১০; ইঊনুস্, ৯৪; আন’আম, ৩৫, ৫২; তাহরিম, ১; নিসা, ১০৫; মুনাফিক্বূন, ৬; আরো দেখুন - আল্ মাতরাফি কৃত ‘আয়াতুল তাবীলিল্ মুস্তফা’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কায়রো, ১৯৭৭}। এভাবে তাঁর সমস্ত কথা, কাজ এবং অনুশীলন আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন {নোট-২১: দেখুন শাতিবী কৃত ‘আল-মুওয়াফাক্বাত,’ ৪/১৫; মুহাম্মদ হামদী এয়াযীর প্রণীত ‘হাক দীনী কুরআন দিলি,’ ইস্তাম্বুল, ১৯৩৫-১৯৩৯, ৪/৪৫৭১}। তাই তাঁর ধর্মীয় আদেশ ও অনুশীলন যা ওহীর উপর ভিত্তি করে নয়, কিন্তু যেগুলোকে ওহী দ্বারা বাতিল বা সংশোধন করা হয়নি তাকে ওহী হিসেবেই গণ্য করা হয়। অধিকাংশ হানাফী আলেম-উলামা এই ধরনের ওহীকে "ওয়াহী বাতিনী" নামে অভিহিত করেছেন। {নোট-২২: ‘হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, ৩৪০ পৃষ্ঠা}


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ক্বুর’আনের বাইরেও আল্লাহর ওহী পেয়েছিলেন তা প্রতীয়মানকারী একটি প্রমাণ এই যে, তাঁকে কুর’আন প্রচারের পাশাপাশি কুর’আন ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এটা নিশ্চিত, তিনি তা সম্পন্ন করতেন আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা দ্বারা, তাঁর ব্যক্তিগত জ্ঞান ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে নয়।” [প্রিয়নবী (দ.) কুর’আন ব্যাখ্যাকারী মর্মে কোনো আয়াত আছে কি? - শিরোনামের লেখাটির প্রথমাংশ; গুগল ডকস্ লিঙ্ক: https://docs.google.com/document/d/1kMCmG9EcVyZdfozdQVSYBjsNpurHjOeokueMoYX4rkE/edit?usp=sharing ]


আশা করি সমস্ত প্রশ্নের জবাব উপরের অংশে পাওয়া যাবে। মনে রাখা দরকার যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর legacy তথা উত্তরাধিকারসূচক ধারা বলে কিছু নেই। তা কেবল মৃত ব্যক্তির হতে পারে। আমরা তাঁকে হায়াতুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বাস করি যা নিচের লিঙ্কে প্রমাণিত: https://kazisaifuddinhossain.blogspot.com/2019/05/blog-post.html


সবশেষে, আমি একটি হাদীসের রেফারেন্স দিতে চাই যা এ বিষয়ে ফায়সালাকারী:


أَنَّ رَسُولَ الله ﷺ لَمّا بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ قَالَ لَهُ: كَيْفَ تَقْضِي إِنْ عَرَضَ لَكَ قََضَاءٌ؟ قَالَ: أَقْضِي بِكِتَابِ اللهِ، قَال: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي كِتَابِ اللهِ؟ قَالَ:أَقْضِي بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ ﷺ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ؟ قَالَ: أَجْتَهِدُ رَأْيِي لاَ آلُو، قَال: فَضَرَبَ بِيَدِهِ فِي صَدْرِي، وَقَالَ: الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُلَ رَسُولِ اللهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللهِ ﷺ.


অর্থ: ইয়েমেনে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করার পর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে তিনি বিচার কাজ পরিচালনা করবেন। হযরত মু’আয (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উত্তর দেন, “আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী (أَقْضِي بِكِتَابِ اللهِ)।” রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরপর জিজ্ঞেস করেন, “যদি তুমি আল্লাহর কিতাবে (সমাধান) না পাও (فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي كِتَابِ اللهِ؟)?” ওই সাহাবী (রা.) উত্তর দেন, “তাহলে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বাস্তবায়ন করবো (أَقْضِي بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ ﷺ)।” প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার জিজ্ঞেস করেন, “যদি তাতেও (মানে সুন্নাহ’তেও) না পাও ( فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ؟)?” তখন ওই সাহাবী (রা.) উত্তর দেন, “আমি নিজ ইজতিহাদ প্রয়োগ করে রায় দেবো (أَجْتَهِدُ رَأْيِي لاَ آلُو)।” অতঃপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পবিত্র হাতখানি হযরত মু’আয (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বুকের উপর স্থাপন করে বলেন, “আল-হামদু লিল্লাহ, আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলের রাসূলকে (মানে সহকারী প্রতিনিধিকে) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সন্তুষ্টির সাথে একাত্ম করে দিয়েছেন (الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُلَ رَسُولِ اللهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللهِ ﷺ)।” [ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ (রহ.): আল-মুসান্নাফ, ফীল কাযী আঁই ইয়ানবাগী ৪/৫৪৩, হাদীস-২২৯৮৮; ইমাম আহমদ (রহ.): মুসনাদ, হাদীসু মু’য়ায বিন জাবাল (রা.), ৫/২৩০, হাদীস - ২২০৬০; ইমাম দারিমী (রহ.), আস্ সুনান, ১/২৬৭, হাদীস - ১৭০; ইমাম মুসলিম (রহ.): সহীহ, বাবুত্ তাহরীজ আলাল ক্বতলিল্ খাওয়ারিজ, ২/৭৪৬, হাদীস - ১০৬৬; ইমাম আবূ দাউদ (রহ.): আস্ সুনান, বাবু ইজতিহাদির্ রায়ি, ৩/৩০৩, হাদীস - ৩৫৯২; তিরমিযী: আস্ সুনান, বাবু মা জা’য়া ফীল্ ক্বাদ্বী, ৩/৯, হাদীস - ১৩২৭; ত্ববরানী: আল্ মু’জামুল কবীর, ২০/১৭০, হাদীস - ১৭১১৯; ইমাম বাগাবী: শরহুস্ সুন্নাহ, বাবু ইজতিহাদিল হাকিম, ১০/১১৬; এবং মুশকিলুল  আছার: আশ্ শরাহ, ২/২১২, হাদীস - ৩৫৮২] 


এখানে লক্ষণীয় যে তিনটি আলাদা আলাদা প্রশ্ন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী উত্তর এসেছে। (১) আল্লাহর কিতাব, (২) সুন্নাহ  এবং (৩) সর্বশেষে পুণ্যাত্মাবৃন্দের রায়/সিদ্ধান্ত। হযরতে মুয়ায ইবনে জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীসটিতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “যদি কুর’আনে না পাও?” মানে কুর’আনে সব বিষয় খোলাসা করে বলা হয়নি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, “যদি সুন্নাহ’তে (মানে হাদীসে)-ও না পাও?” অর্থাৎ, তাতেও সব বিষয় খোলাসা নেই। তখন ওই সাহাবী (রা.) বলেন, “আমি আমার রায় (ইজতিহাদ) প্রয়োগ করবো।” এ দেশের আহলে হাদীস গোষ্ঠী উপরের হাদীসটিকে যয়ীফ/দুর্বল বল্লেও পূর্ববর্তী যুগের ইমামবৃন্দ এটাকে সমর্থন করেছেন। দ্বীনী জ্ঞান বিশারদবৃন্দ হাদীসটি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল। অনেক আরবী ওয়েবসাইটে এটা বিদ্যমান যা তুর্কী “ওহাবীদের প্রতি নসীহত” গ্রন্থে নক্বল করা হয়েছে। বস্তুতঃ আহলে হাদীস ও আহলে কুর’আন দুটো গোষ্ঠী-ই ধর্মে ফিতনা সৃষ্টিকারী এবং বেয়াদব! আল্লাহ সবাইকে এদের ফিতনা থেকে রক্ষা করুন, আমীন।  


*সমাপ্ত*        



  


  

Saturday, 21 September 2024

হাদীসের আলোকে ফকির-দরবেশের প্রতি বেয়াদবি নিষেধ

 

-এডমিন

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিরোনামের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আউলিয়া (রহ.)’মণ্ডলীর মাযার-দরগাহে হামলার পাশাপাশি ফকির-দরবেশের প্রতি হামলাও হচ্ছে। এ হীন অপকর্ম করছে নজদী-ওহাবীদের অনুসারীচক্র। হযরত শাহ পরাণ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযারে হামলার ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। ফকিরি পথ ও মতের অনুসারীদের মধ্যে কে যে ওলী, তা তো বলতে পারবে না এসব নালায়েক্ব বেয়াদব! পরে এমন বদ দোয়া পড়বে যে গোটা জাতিকেই না গুনতে হয় এর মাশুল! কেননা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন:

হাদীস শরীফ

"‏رب أشعث أغبر مدفوع بالأبواب لو أقسم على الله لأبره ‏"‏ ‏(‏‏(‏رواه مسلم‏)‏‏)‏‏.

অর্থ
(হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন), ’’বহু এমন লোকও আছে যার মাথা উষ্কখুষ্ক ধুলোভরা, যাদেরকে দরজা থেকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। (কিন্তু সে আল্লাহর নিকট এতো প্রিয় যে) সে যদি আল্লাহর নামে কসম খায়, তাহলে আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন।’’ [মুসলিম শরীফ, ২৬২২, ২৮৫৪; রিয়াদুস্ সালেহীন, আন্তর্জাতিক নম্বর ২৫৭]

সারমর্ম
এ হাদীসটি আউলিয়া (রহ.)-বৃন্দের হালত-অবস্থা প্রকাশের পাশাপাশি একটি সতর্কীকরণ বার্তাও। কেননা তাঁদেরকে চেনা যায় না। দরজা থেকে বিতাড়িত তথা সমাজ হতে দূরে হতে পারেন এ সকল দরবেশ। কিন্তু তাঁদের অন্তরে আঘাত করে কিছু করা হলে হয়তো তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়ে বদ দোয়াও করতে পারেন। তাঁরা যা আল্লাহর নামে কসম করবেন, তা-ই তিনি মঞ্জুর করবেন। অতএব, সাবধান! সমাজের সব মানুষের দায়িত্ব ওই সব নালায়েক্ব বেয়াদবদের লাগাম টেনে ধরা! নতুবা বেয়াদবির দরুন মহাবিপদ ডেকে আনা হবে। এ হাদীসের অন্তর্নিহিত বাণী উপলব্ধি করাই হবে সবার জন্যে মঙ্গল। যারা ধর্মের শরঈ দলিল খোঁজে বেশি, হাদীসের এ দলিলটি তাদের বেশি করে পড়া এবং আত্মস্থ করা জরুরি।
আল্লাহতায়ালা সবাইকে বোঝার সামর্থ্য দিন, আমীন।

*****************************************************************************************************

Tuesday, 18 June 2024

শরীয়তের দৃষ্টিতে জগতে একই দিনে ঈদ উদযাপন

আলোচ্য বিষয়টির প্রতি সবার, বিশেষ করে দেশের কর্ণধারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আমি। আজ (১৭/০৬/২০২৪) অনলাইনে (সময় টিভির ভিডিও ফুটেজে) দেখলাম, দেশের কোথাও কোথাও এবং ঢাকায়ও কিছু কিছু জামাতে সৌদি আরবের অনুসরণে ঈদের নামায পড়া হয়েছে। অথচ সরকারি সংস্থা ইসলামী ফাউন্ডেশনের চাঁদ দেখা কমিটি আগামীকাল ১৭ তারিখে ঈদ হবে বলে জানিয়েছিলেন। এ রকম পরিস্থিতিতে ওই কমিটির যথার্থতা ও কার্যকারিতা রইলো কই? এ যেনো রাস্তায় যে যার মতো অনিয়মের হদ্দ করে গাড়ি চালনার দৃষ্টান্ত! আমরা সরকারের কাছে ইসলামী ফাউন্ডেশনের এবং দেশের গণ্যমান্য আলেম-উলামার এতদসংক্রান্ত সর্বসম্মত রায় প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।

আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান মোতাবেক এ বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। জানি, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মুসলিম কমিউনিটি সৌদি আরবের সাথে মিলিয়ে ঈদ পালন করে থাকেন। তা পালন করেন না শুধু এ উপমহাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়। এর পক্ষে যুক্তি-প্রমাণও রয়েছে। আমি শরঈ দলিলগুলো প্রথমে পেশ করবো এবং এরপর আক্বলী তথা বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেবো।
*শরঈ দলিল*
প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন:
"‏ الشَّهْرُ تِسْعٌ وَعِشْرُونَ لَيْلَةً لاَ تَصُومُوا حَتَّى تَرَوْهُ وَلاَ تُفْطِرُوا حَتَّى تَرَوْهُ إِلاَّ أَنْ يُغَمَّ عَلَيْكُمْ فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَاقْدِرُوا لَهُ ‏"‏‏.‏
অর্থ: মাস ঊনত্রিশ রাত্রবিশিষ্ট হয়ে থাকে। তাই তোমরা চাঁদ না দেখে সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) আরম্ভ করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার (ঈদ) করবেনা। হ্যাঁ, যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে (ত্রিশ দিন) পূর্ণ করবে। [মুসলিম শরীফ, ২৩৭৮ (আন্তর্জাতিক নম্বর); ইসলামী ফাউন্ডেশন লিঙ্ক - https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=11741 ]
ওপরে উক্ত হাদীসটিতে খালি চোখে চাঁদ দেখার কথা বলা হয়েছে। বিগত চৌদ্দ শ বছরে এভাবেই ঈদ উদযাপন হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে চাঁদ দেখে জগতে এক দিনে ঈদ উদযাপনের ধারণাটি অতি সাম্প্রতিক। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগেও মূল আরব অঞ্চলে এ প্রথার অস্তিত্ব ছিলো না, আমাদের দেশে তো নয়ই। শরীয়তের দালিলিক প্রমাণের নিরিখে এ রকম ঐকমত্য সিদ্ধ নয়, বরং ইবাদতে নব আবিষ্কার তথা বিদ’আত। কেননা, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন -
«خَيْرُ أُمَّتِي قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ إِنَّ بَعْدَهُمْ قَوْمًا يَشْهَدُونَ وَلَا يُسْتَشْهَدُونَ وَيَخُونُونَ وَلَا يُؤْتَمَنُونَ وَيَنْذُرُونَ وَلَا يفون وَيَظْهَرُ فِيهِمُ السِّمَنُ» . وَفِي رِوَايَةٍ: «وَيَحْلِفُونَ وَلَا يستحلفون» . مُتَّفق عَلَيْهِ
অর্থ: আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক হলো আমার যুগের লোক (সাহাবীদের যুগ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক, অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক, অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক, তাদের পর এমন কিছু লোকের আগমন ঘটবে, যারা সাক্ষ্য দিবে অথচ তাদের কাছ হতে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। তারা খিয়ানত করবে, তাদের আমানাতদারীর উপর বিশ্বাস করা যাবে না। তারা মানৎ করবে; কিন্তু তা পূর্ণ করবে না, তাদের মধ্যে স্থূলতা প্রকাশ পাবে। অপর এক বর্ণনাতে আছে, তারা (নিষ্প্রয়োজনে) শপথ করবে, অথচ তাদের কাছ হতে শপথ চাওয়া হবে না। (বুখারী ও মুসলিম) [ইসলামী ফাউন্ডেশন লিঙ্ক: https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=85986 ]
এটাই সেই যুগ যখন ধর্মীয় পদে সমাসীন লোকেরা ধর্মকে অধর্ম বানাবে! সবকিছু উল্টাপাল্টা করবে। যা আমরা সারা জীবন দেখিনি, তাই এখন ধর্ম হিসেবে চালিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে। যদি কেউ ধর্ম পালনে সত্যনিষ্ঠ হন, তবে তাঁদের পক্ষে সেরা যুগের মু’মিন জনগোষ্ঠীকে অনুসরণ করাই অত্যাবশ্যক হবে। খালি চোখে চাঁদ দেখে ঈদ পালন করতে হবে।
*আক্বলী/বৃদ্ধিবৃত্তিক জবাব*
প্রযুক্তির সহায়তায় চাঁদ দেখে সৌদির অনুসরণে ঈদ পালন করার মধ্যে সমস্যা নিহিত। এটা পৃথিবীর স্থানীয় সময়কালের বিভিন্নতা। ধরুন, সৌদি আরবে সকাল ৭টা বা ৮টায় জামাত, কিন্তু বাংলাদেশে তখন ৩ ঘণ্টা যোগ করে প্রায় দুপুর ১১টা। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে আরো ২ বা ৪ ঘণ্টা যোগ করতে হবে। মানে সেখানে যোহরের নামাযের ওয়াক্ত। সৌদি থেকে উত্তরে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলো পিছিয়ে আছে ৩ ঘণ্টা। সৌদিতে সকাল ৮টা হলে ইউরোপে ফজরের নামাযের ওয়াক্ত-প্রায়। সৌদির অনুকরণে নামায পড়তে হলে তাদের সময়সূচিও বজায় রাখতে হবে! আগে বা পরে নামায পড়লে চলবে না!
প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে যাঁরা দূরবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে চাঁদ দেখে ঈদ পালন করছেন, তাঁরা একই প্রযুক্তির দান টেষ্ট-টিউব বেবী নেয়ার ব্যাপারে কী বলবেন? এই প্রযুক্তিতে কোনো স্বামী বা স্ত্রী অন্যের সহায়তায় সন্তান গ্রহণ করতে সক্ষম। কিন্তু তা কি শরীয়তে বৈধ হবে? নাকি হারাম/নিষিদ্ধ হবে? চর্মচক্ষে চাঁদ দেখে রোযা রাখতে এবং রোযা ছাড়তে বলা হয়েছে। এর বাইরে গিয়ে আদেশ অমান্য করাও নিষিদ্ধ হবে।
পরিশেষে বলবো, ইসলামী ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞ আলেম-উলামা কর্তৃক এ ব্যাপারে তাঁদের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত প্রদান এখন সময়ের দাবি।
*সমাপ্ত*
পুনশ্চ:
প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন। এর ফলাফল ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন স্থানে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন বলুন, এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানব সভ্যতার জন্যে কতোখানি সুফল বয়ে এনেছে? স্রেফ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ধুয়ে পানি খেলে একদিন দেখা যাবে দুনিয়া থেকে মানবজাতির বিনাশ হয়েছে, ঠিক যেমনটি ডায়নোসোর প্রজাতির হয়েছিলো।



Sunday, 19 May 2024

নব্য ফিতনা “সালাফিয়্যা”

 


মূল: হুসাইন হিলমী ইশিক (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন



উৎসর্গ

আমার পীর ও মুর্শিদ হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব
সৈয়দ এ.জে.এম. সেহাবউদ্দীন খালেদ
আল্ কাদেরী আল্ চিশ্তী (রহ:)-এর
পুণ্য স্মৃতিতে উৎসর্গিত



অনুবাদকের আরয

সম্প্রতি “সালাফিয়্যা” নামের একটি নতুন মনগড়া ও পথভ্রষ্ট ধর্মীয় মতবাদের উৎপত্তি হয়েছে। এই মতের অনুসারীরা নিজেদেরকে সালাফী দাবি করছে এবং নিজেদের নামের পেছনে সালাফী শব্দটি যোগ করছে; উপরন্তু দাবি করছে যে, তারা সালাফ আস্ সালেহীন তথা ইসলামের প্রাথমিক যুগের পুণ্যবান মুসলমানদের মযহাবের অনুসরণ করছে। বিশেষ করে সউদী ওহাবীদের বেতনভুক এদেশীয় দালাল ওহাবী-মওদূদীপন্থীরা এবং আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের লোকেরা এ মতের পক্ষে ওকালতি করছে।

এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে তথাকথিত সালাফীদের ধোঁকাবাজি সম্পর্কে মুসলিম সমাজকে অবগত করার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তুরস্কের প্রথিতযশা আলেম ও লেখক আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশিক (রহ:)। তাঁর এ প্রবন্ধ ‘নব্য ফিতনা: সালাফিয়্যা’- এর অনুবাদ প্রকাশ করতে পেরে আমি মহান আল্লাহ্ তা’লার দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার পীর ও মুরশীদ হযরতুল আল্লামা শাহ্ সূফী আলহাজ্জ সৈয়দ এ.জেড.এম. সেহাবউদ্দীন খাদেল সাহেব কেবলা (রহঃ) -এর অসীলায় মহান আল্লাহ তা’লা এ প্রকাশনাকে কবুল করে নিলেই আমার শ্রম সার্থক হবে, আমীন!

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল করীম
আম্মা বা’দ

                                  
প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, আহলে সুন্নাতের উলামায়ে কেরামের বইপত্রে ‘সালাফিয়্যা’ বা ‘সালাফিয়্যা মযহাব’ নামের কোনো কিছু উল্লেখিত হয় নি। এ সকল নাম, যা নাকি লা-মযহাবীদের দ্বারা পরবর্তীকালে বানানো হয়েছে, তা ধর্মীয় পদে সমাসীন অজ্ঞ লোকদের দ্বারা লা-মযহাবীদের আরবী বইপত্র থেকে তুর্কী ভাষায় অনূদিত হওয়ার কারণে তুর্কীদের মধ্যে প্রসার লাভ করেছে। তাদের মতে:

‘সালাফিয়্যা’ হচ্ছে সেই মযহাবের নাম, যা আশআরিয়া ও মাতুরিদিয়া মযহাবগুলোর গোড়াপত্তনের আগে সকল সুন্নী মুসলিম কর্তৃক অনুসৃত হয়েছিল। তাঁরা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনবৃন্দের অনুসারী ছিলেন। সালাফিয়্যা মযহাব হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনবৃন্দের মযহাব। চারজন মহান ইমামই এ মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সালাফিয়্যা মযহাবের সমর্থনে লিখিত প্রথম পুস্তক হচ্ছে ইমামুল আযম হযরত আবু হানীফা (রহ.)-এর ‘ফিকাহ আল্ আকবর’। ইমাম গাযযালী (রহ.) তাঁর প্রণীত ‘ইলজামুল আওয়াম আন্ ইলমিল কালাম’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, সালাফিয়্যা মযহাবে সাতটি প্রয়োজনীয় নীতি ছিল। মুতাখখিরীন বা পরবর্তী উলামাবৃন্দের ইলমুল কালাম আরম্ভ হয়েছিল ইমাম গাযযালী (রহ.) হতে। কালাম শাস্ত্রের পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামবৃন্দের মযহাবসমূহ এবং ইসলামী দার্শনিকদের দর্শনসমূহ অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ করে ইমাম গাযযালী (রহ.) ইলমুল কালামের পদ্ধতিসমূহের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি তাঁদেরকে (পূর্ববর্তীদেরকে) খণ্ডন করার লক্ষ্যে ইলমুল কালামের মধ্যে দার্শনিক বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত করেন।

আল-রাযী ও আল-আমিদী কালামশাস্ত্র ও দর্শন শাস্ত্রকে মিশ্রিত করে একটি জ্ঞানের শাখায় রূপান্তরিত করেন। আর আল-বায়দাবী এ দুটোকে অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে ফেলেন। মুতাখখিরীনবৃন্দের ইলমুল কালাম সালাফিয়্যা মযহাবের প্রসার রোধ করে দেয়। ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্য ইবনে কাইয়েম আল-জাওযিয়া সালাফিয়্যা মযহাবকে সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করেন, যা পরবর্তীতে দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে; পূর্ববতী সালাফীবৃন্দ আল্লাহ্তা’লার সিফাত (গুণাবলী) কিংবা মুতাশাবিহ্ (দ্ব্যর্থবোধক) নস্ বা কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস ইত্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপৃত হন নি। কিন্তু পরবর্তী সালাফিবৃন্দ তা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এ বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয় ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়েম আল-জাওযিয়ার মত পরবর্তী সালাফীদের ক্ষেত্রে। পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সালাফীদেরকে সম্মিলিতভাবে ‘আহল্ আস সুন্নত আল খাস্সা’ বলা হয়ে থাকে। আহলে সুন্নতের কালাম শাস্ত্রের ব্যক্তিবর্গ কিছু ’নস’কে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিন্তু সালাফীবৃন্দ তার বিরোধিতা করেন। আল্লাহ্তায়ালার চেহারা ও তাঁর আগমন মানুষের চেহারা ও আগমন হতে ভিন্ন - এই কথাটি বলে সালাফীয়্যাবৃন্দ মুশাববিহা সম্প্রদায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন”। (লা-মযহাবীদের বক্তব্য শেষ হলো)

আল-আশআরী ও আল-মাতুরিদী মযহাবগুলোর গোড়াপত্তন পরবর্তীকালে হয়েছে বলাটা সঠিক নয়। এ দুইজন মহান ইমাম (আল-আশআরী ও আল-মাতুরিদী) সালাফ-এ সালেহীন কর্তৃক রওয়ায়েতকৃত ই’তিক্বাদ ও ঈমানের জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করে এবং শ্রেণীবিভক্ত করে প্রকাশ করেছিলেন, যাতে করে যুব সম্প্রদায় তা সহজে বুঝতে পারেন। ইমাম আল্ আশআরী ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর শিষ্যদের শৃংখলভুক্ত ছিলেন। আর ইমাম মাতুরিদী ছিলেন হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর শিষ্যদের শৃংখলের অন্তর্ভুক্ত। আল্ আশআরী (রহ.) ও আল্ মাতুরিদী (রহ.) কখনোই তাঁদের ইমামের সার্বিক মযহাবের বাইরে যান নি। তাঁরা নতুন কোনো মযহাবের গোড়াপত্তন করেন নি। এই দুইজন এবং তাঁদের শিক্ষকমণ্ডলী এবং চার মযহাবের ইমামবৃন্দ সবাই একটি সার্বিক (common) মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বিশ্বাস (আকীদা)-সংক্রান্ত এই মযহাবটি আহলুস-সুন্নাতে ওয়াল জামা’আত নামেই সুপরিচিত। এই সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের বিশ্বাস হচ্ছে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীনমণ্ডলীর বিশ্বাস। ইমামুল আযম হযরত আবু হানীফা (রহ.) কর্তৃক লিখিত ‘ফিকাহ্ আল-আকবর’ পুস্তকটি আহলে সুন্নতের মযহাবটিকে সমর্থন করে। ‘সালাফিয়্যা’ শব্দটি সেই পুস্তকে কিংবা ইমাম গাযযালী (রহ.)-এর ’ইলজামুল আওয়াম আন্ ইলমিল কালাম’ গ্রন্থটিতে অস্তিত্বহীন। ‘ফিকাহে আকবর’ গ্রন্থের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘কওলুল ফসল’ আহলে সুন্নতের মযহাবটি শিক্ষা দেয় এবং বাতিলপন্থী সম্প্রদায় ও দার্শনিকদের জবাব দেয়। ইমাম গাযযালী (রহ.) তাঁর “ইলজামুল আওয়াম” গ্রন্থে লিখেছেন, “এ বইটিতে আমি দেখাবো যে সালাফবৃন্দের মযহাবটি সত্য এবং সঠিক। আমি আরো ব্যাখ্যা করবো যে, যারা এ মযহাবটি হতে বিচ্যুত হয় তারা বিদ’আতী! সালাফবৃন্দের মযহাব হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও তাবেয়ীন (রহ.)-মণ্ডলীর অনুসৃত মযহাব। এ মযহাবটির প্রয়োজনীয় নীতি হলো সাতটি।” অতএব, পরিস্ফুট হলো যে, “ইলজাম” পুস্তকটি “সালাফবৃন্দের” মযহাবের সাতটি মূলনীতি সম্পর্কে লিখেছে। কিন্তু এগুলোকে ‘সালাফিয়্যাদের’ প্রয়োজনীয় নীতি বলাটা হলো বইটির ভাষ্যকে বিকৃত করা এবং ইমাম গাযযালী (রহ.) -এর কুৎসা রটনা করা। আহলে সুন্নাতের অন্যান্য পুস্তকের মতোই মহামূল্যবান ফিকাহ গ্রন্থ ‘দুররুল মুখতার-এর ‘সাক্ষ্য’ অধ্যায়ে ‘সালাফ’ ও ’খালাফ’ শব্দগুলোর পরে লেখা আছে:

كلمة السلف إسم الصحابة والتابعين ويقال لهم السلف الصالحون والخلف يقال لعلماء أهل سنة الذين أتو بعد السلف الصالحين.

 ‘সালাফ’ শব্দটি হলো সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও তাবেয়ীন (রহ.)-মণ্ডলীর নাম। তাঁদেরকে ‘সলফে সালেহীন’ হিসেবেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে। আর আহলে সুন্নতের সেই সকল উলামা যাঁরা সলফে সালেহীনের পরে এসেছেন তাঁদেরকে বলা হয় “খালাফ”।

তাবে তাবেয়ীনবৃন্দও সলফে সালেহীনের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম আল-গাযযালী (রহ.), ইমাম আল-রাযী (রহ.) ও ইমাম আল-বায়দাবী (রহ.) যাঁদেরকে মুফাস্সিরীনে কেরাম বা কুরআন মজীদ ব্যাখ্যাকারীমণ্ডলী সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন ও ভালবাসতেন, তাঁরাও সলফে সালেহীনের মযহাবের অন্তর্গত ছিলেন।

উপরোক্ত বুযূর্গবৃন্দের সময়ে আবির্ভূত বিদআতী সম্প্রদায়গুলো ইলমুল কালামকে দর্শনের সাথে মিশ্রিত করে। বস্তুতঃ দর্শনের ওপরই তারা তাদের ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করে। “আল মিলাল ওয়ান্ নিহাল” পুস্তকটি ওই সকল গোমরাহ্ (পথভ্রষ্ট) দলগুলোর বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেছে। ওই সকল গোমরাহ্ দলের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা খণ্ডন করে আহলে সুন্নতের মযহাবটিকে সমর্থন করতে যেয়ে এই তিনজন মহান ইমাম তাদের ভ্রান্ত দর্শনের প্রতি বিস্তারিত জওয়াব দিয়েছিলেন। ওই সকল জওয়াব দেয়ার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা আহলে সুন্নতের মযহাবের সাথে দর্শনকে মিশ্রিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে, তাঁরা কালাম শাস্ত্রকে ওরই মধ্যে সন্নিবেশিত দার্শনিক ধ্যান-ধারণা থেকে পরিশুদ্ধ করেন। আল্ বায়দাবীর তাফসীরগ্রন্থ কিংবা সেটার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যাগ্রন্থ শায়খজাদার তাফসীরের কোনোটাতেই দার্শনিক ধ্যান-ধারণা অথবা দার্শনিক পদ্ধতি নেই। এ সকল মহান ইমাম দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন বলাটা জঘন্য কুৎসা রটনা ছাড়া আর কিছু নয়। ইবনে তাইমিয়াই সর্বপ্রথমে তার “আল ওয়াসিতা” নামক পুস্তকে সুন্নী জামাতের উলামাদের প্রতি এই অপবাদটি প্রদান করে। উপরন্তু, ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্য ইবনে কাইয়েম আল্ জাওযিয়া সালাফিয়্যা মযহাবকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিল বলাটা আসলে হকপন্থী ও বাতিলপন্থীদের মতপার্থক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আরেকটি ভাঁওতা যোগ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দুই ব্যক্তির আগে “সালাফিয়্যা” নামের কোনো মযহাবই ছিল না, এমন কি “সালাফিয়্যা” শব্দটিও ছিল না; তাহলে কীভাবে দাবি করা যায় যে তারা এটাকে সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিল? ওই দুই জনের আগে কেবলমাত্র একটি সঠিক মযহাব ছিল - সলফে সালেহীনের সঠিক মাযহাব, যার নাম আহল্ আস্ সুন্নত ওয়াল জামা’আত। ইবনে তাইমিয়াই এই সঠিক মাযহাবটিকে বিকৃত করতে চেষ্টা করেছিল এবং বহু বিদআতের আবিষ্কার করেছিল। বর্তমানকালের লা-মাযহাবী লোকদের বিকৃত ও গোমরাহ চিন্তাধারা, বক্তব্য এবং বইপত্রের উৎস হচ্ছে ইবনে তাইমিয়ার আবিষ্কৃত বিদআতসমূহ। মুসলিমদেরকে ধোঁকা দেবার জন্যে এবং যুব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করবার জন্যে এ সকল গোমরাহ ব্যক্তি এখন একটি অত্যন্ত ধূর্ত চাল চেলেছে। তারা “সলফে সালেহীন” শব্দটি থেকে “সালাফিয়্যা” শব্দটি বানিয়ে নিয়েছে, যাতে করে তারা ইবনে তাইমিয়ার বিদআত ও ভ্রষ্ট ধ্যান-ধারণাকে সঠিক প্রতিপন্ন করতে পারে এবং যুব সমাজকে তাদের গোমরাহীতে টেনে নিয়ে যেতে পারে। তারা সালাফ-ই-সালেহীনদের উত্তরসূরী ইসলামী উলামাদের প্রতি বিদআত ও দর্শনের অপবাদ ছুঁড়ে দিয়েছে এবং তাঁদেরকে তাদেরই আবিষ্কৃত “সালাফিয়্যা” নামটির বিরুদ্ধাচরণ করার জন্যে দোষারোপ করেছে। তারা ইবনে তাইমিয়াকে একজন মুজতাহিদ হিসেবে পেশ করে, যে নাকি “সালাফিয়া”কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, সালাফ-ই সালেহীনের উত্তরসূরী আহলে সুন্নতের উলামাবৃন্দই সলফে সালেহীনের মযহাব আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’আতের এ’তেকাদ (আকীদা-বিশ্বাস) সংক্রান্ত শিক্ষাসমূহ নিষ্কলুষ রাখতে তৎপর ছিলেন এবং আজ পর্যন্ত তাঁরা যা লিখেছেন এবং লিখছেন তাতে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন এবং জানাচ্ছেন যে ইবনে তাইমিয়া, শওকানী এবং অনুরূপ ব্যক্তিবর্গই সালাফে সালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তারাই মুসলমানদেরকে ধ্বংস করছে ও জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যাঁরা “আত তাওয়াসসুলু বিন্ নবী ওয়া জাহলাতুল ওয়াহহাবীয়িন”, “উলামাউল ইসলাম ওয়াল ওয়াহহাবীঈন”, “শিফাউস সিকাম” এবং তার মুখবদ্ধ “তাতহিরুল ফুয়াদ মিন দানিসিল এ’তেকাদ” পড়েছেন, তাঁরা স্পষ্টই বুঝতে পারবেন, যে সকল লোক ‘নতুন সালাফিয়্যা’ নামক মহাভ্রান্ত বিশ্বাসসমূহ আবিষ্কার করে নিয়েছে, তারা আসলে মুসলিমদেরকে ভেতর থেকে ধ্বংস করছে।

আজকাল কিছু মুখ খুব ঘন ঘন ‘সালাফিয়্যা’ নামটি উচ্চারণ করে থাকে। অথচ প্রত্যেক মুসলমানেরই এটা ভাল করে জানা উচিৎ যে, “সালাফিয়্যা মযহাব” নামে ইসলামে কোনো কিছু নেই; বরং হাদীস শরীফে প্রশংসিত প্রথম দুই ইসলামী শতাব্দীর মুসলমান তথা সালাফ-ই-সালেহীনবৃন্দের একটি মযহাবই আছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে আগমনকারী ইসলামী উলামাকে বলা হয় “খালাফ আস সোয়াদেকীন”। এ সকল সম্মানিত জ্ঞান বিশারদদের এ’তেকাদ বা বিশ্বাসসমূহকেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের মতাদর্শ বলে। এটা হচ্ছে ঈমানের মযহাব। আসহাবে কেরাম ও তাবেয়ীনবৃন্দেরও এই একই ঈমান ছিল। তাঁদের ঈমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। বর্তমানকালে পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিমই আহলে সুন্নতের আদর্শে বিশ্বাসী। ইসলামী দ্বিতীয় শতাব্দীর পরে বাহাত্তরটি মহাভ্রান্ত বিদআতী দলের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করে; তাদের মধ্যে কয়েকটি দলের স্থপতিরা পূর্বেই আগমন করেছিল, কিন্তু তাবেয়ীনবৃন্দের পরেই তাদের বইপত্র প্রকাশ পায় এবং তারা দলে দলে আবির্ভূত হয়ে আহলে সুন্নাতকে আক্রমণ করতে শুরু করে।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই আহলে সুন্নাতের বিশ্বাসসমূহ নিয়ে এসেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামবৃন্দ (রা.) ঈমান সংক্রান্ত এ সকল শিক্ষা উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন। আর তাবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীনমণ্ডলী (রহ.) ক্রমানুসারে এগুলো তাঁদের থেকে গ্রহণ করে নেন। এরপর তাঁদের উত্তরসূরীবৃন্দ এগুলো শিক্ষা করেন; ফলশ্রুতিতে এই শিক্ষাসমূহ আমাদের কাছে ‘তাওয়াতুর’ (জনশ্রুতি) ও বর্ণনার মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছে। এ শিক্ষাগুলো যুক্তি বা বিশ্লেষণ দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। মস্তিষ্ক এগুলোকে পরিবর্তিত করতে পারে না, বরং উপলব্ধি করতে সহায়তা করতে পারে। অর্থাৎ, এগুলোকে বুঝতে হলে মস্তিষ্কের প্রয়োজন আছে; এগুলো যে সঠিক এবং মূল্যবান তা জানবার ও বুঝবার জন্যে মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয়। সকল হাদীসের উলামাই আহলে সুন্নতের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আমল সংক্রান্ত চারটি মযহাবের (যথা হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী) ইমামবৃন্দও এ আদর্শে বিশ্বাস করতেন। আর বিশ্বাস সংক্রান্ত আমাদের মযহাবটির দুইজন ইমাম হযরত মাতুরিদী (রহ.) এবং হযরত আশআরী (রহ.) উভয়ই এই মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উভয় ইমামই এই মযহাবটি প্রচার করেছিলেন। তাঁরা সব সময়ই গোমরাহ ব্যক্তিবর্গ এবং প্রাচীন গ্রীক দর্শনের চোরাবালিতে আটকে পড়া বস্তুবাদীদের বিরুদ্ধে এই মযহাবের পক্ষাবলম্বন করে এটাকে সমর্থন যুগিয়েছেন। যদিও তাঁরা সমসাময়িককালের ছিলেন, তবুও তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন স্থানের অধিবাসী হওয়ার কারণে এবং তাঁদের মোকাবিলাকৃত বিরুদ্ধবাদীদের চিন্তা-চেতনা ভিন্ন হওয়ার দরুন তাঁদের জওয়াব দেবার পদ্ধতিও পৃথক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন মযহাবের অন্তর্গত ছিলেন। এই দুই জন মহান ইমামের পরবর্তীকালে আগত শত সহস্র উচ্চ শিক্ষিত উলামা ও আউলিয়া তাঁদের বইপত্র অধ্যয়ন করে সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেছেন যে, তাঁরা আহলে সুন্নতের অনুসারী ছিলেন। সুন্নী উলামাবৃন্দ ’নস্’সমূহের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং প্রয়োজন ব্যতিরেকে সেগুলোকে তা’বিল তথা ভিন্নতর ব্যাখ্যা প্রদান কিংবা পরবর্তিত করেন নি। আর তাঁরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যান-ধারণা মাফিক কোনো পরিবর্তনও করেন নি। কিন্তু যারা গোমরাহ ও লা-মযহাবী দলগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা ইসলামের দুষমন গ্রীক দার্শনিক ও ভণ্ড বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষানুযায়ী ঈমান ও এবাদতের শিক্ষাসমূহের পরিবর্তন সাধন করতে কালবিলম্ব করে নি।

আহলে সুন্নতের উলামাদের খেদমতগার ও ইসলামের ধারক-বাহক উসমানীয় তুর্কীদের যখন পতন ঘটলো - যা সম্ভব হয়েছিল সর্বশক্তি নিয়োগকারী বৃটিশদের শয়তানী চাল ও মিশনারী এবং ম্যাসন (অন্তর্ঘাতী মুনাফিক)-দের নিরলস অপতৎপরতা দ্বারা, তখন লা-মযহাবীরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো। চালবাজী ও ঘৃণ্য পন্থায় তারা আহলে সুন্নাহ্কে আক্রমণ শুরু করে দিল এবং ইসলামকে ভেতর থেকে ধ্বংস করতে লাগলো। এটা ঘটতে থাকলো সেই সব দেশে যেখানে সুন্নী উলামাদের কোনো বাক্-স্বাধীনতা নেই (উদাহরণস্বরূপ, সউদী আরব)। সউদী ওহাবীদের হাতে ব্যয়কৃত কোটি কোটি প্রেট্রো ডলার এ আক্রমণকে সারা বিশ্বে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে। পাক-ভারত ও আফ্রিকী দেশগুলো হতে প্রাপ্ত খবরে বোঝা যাচ্ছে যে, ইসলমী জ্ঞানে অজ্ঞ ও খোদা ভীতিহীন কিছু লোককে তাদের দালালির জন্যে এ সকল আক্রমণকারী উচ্চপদ ও ভরণ-পোষণ দান করছে। বিশেষ করে যুব সমাজকে ধোঁকা দিয়ে সুন্নী পথ হতে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্যেই তাদেরকে এ সকল ঘৃণিত সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে।

গোমরাহ ওহাবীদের দ্বারা মাদ্রাসার ছাত্রদের এবং মুসলিম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে লিখিত বইসমূহের একটিতে লেখা হয়েছে : “আমি মযহাবসমূহের একগুঁয়েমি দূর করতে এবং সবাইকে শান্তিতে নিজ নিজ মযহাবে জীবন ধারণ করতে সহায়তা করার উদ্দেশ্যেই এ পুস্তকখানি প্রণয়ন করেছি”। এ লোকটি বোঝাতে চাচ্ছে যে, মযহাবসমূহের ‘একগুঁয়েমির’ সমাধান আহলে সুন্নাতকে আক্রমণ ও সুন্নী উলামায়ে কেরামকে হেয়করণের মধ্যেই নিহিত। সে ইসলামের বুকে ছুরিকাঘাত করছে এবং তারপরে বলছে, সে এটা মুসলমানদের শান্তিতে বসবাসের জন্যেই করছে! পুস্তকটির অন্যত্র লেখা আছে, “যদি কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি তাঁর চিন্তায় সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, তবে তাঁকে দশটি পুরস্কার দেয়া হবে। যদি তিনি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে ব্যর্থ হন, তবে তিনি একটি পুরস্কার পাবেন”। এ কথা অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি - হোক সে খ্রীষ্টান কিংবা মুশরিক মূর্তিপূজারী - তার প্রতিটি চিন্তার জন্যে পুরস্কৃত হবে! দেখুন কীভাবে এ লোকটি আমাদের রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র হাদীস শরীফকে বিকৃত করছে এবং কীভাবে সে চালবাজী করছে! হাদীস্ শরীফটি এরশাদ ফরমায়:

فإن أصبت فلك عشر حسنات وإن أخطأت فلك حسنة.

অর্থ: ‘যদি কোনো মুজতাহিদ কোনো আয়াতে করীমা কিংবা হাদীস শরীফ হতে আইন-কানুন বের করতে যেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, তবে তাঁর জন্যে দশটি সওয়াব থাকবে। আর যদি তিনি তাঁর ইজতিহাদে ভুল করেন, তাহলে তাঁকে একটি সওয়াব দেয়া হবে’ (আল হাদীস)। হাদীস শরীফটি পরিস্ফুট করে এ সকল সওয়াব যে কোনো চিন্তাভাবনাকারী ব্যক্তিকে প্রদান করা হবে না, বরং ইজতেহাদের মর্যাদা লাভকারী একজন ইসলামী জ্ঞান বিশারদকেই প্রদান করা হবে; তাঁর প্রতিটি চিন্তার জন্যে এগুলো প্রদান করা হবে না, বরং ‘নস’ বা শরীয়তের দলিল হতে তাঁর আইন কানুন বের করার জন্যেই তাঁকে এগুলো দেয়া হবে। কেননা, তাঁর এ কাজটি একটি এবাদত। অন্য যে কোনো এবাদতের মতো এটাকেও সওয়াব দেয়া হবে।

সালাফ-এ-সালেহীন ও তাঁদের উত্তরসূরী মুজতাহিদ ইমামবৃন্দের জমানায়, অর্থাৎ ইসলামী চতুর্থ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত, যখনি জীবনধারা ও জীবন মান পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে কোনো নতুন বিষয়ের আবির্ভাব ঘটতো, তখনি মুজতাহিদ ইমামবৃন্দ রাত দিন পরিশ্রম করে ‘আল্ আদিল্লাত আশ্ শরীয়ত’-এর চারটি উৎস হতে সেই বিষয়টি কীভাবে পালন করা হবে তার ফয়সালা বের করতেন। আর সকল মুসলমান তাঁদের নিজ নিজ মযহাবের ইমামের প্রদত্ত সিদ্ধান্তানুযায়ী তা পালনও করতেন এবং যাঁরা পালন করতেন তাঁদেরকে দশটি কিংবা একটি সওয়াব প্রদান করা হতো! ইসলামী চতুর্থ শতাব্দীর পর মানুষেরা ওই সকল মুজতাহিদের সিদ্ধান্তগুলোই অনুসরণ করতে থাকেন। এ দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় কোনো মুসলমানই আমল করার ব্যাপারে কোনো সমস্যায় পেরেশানগ্রস্ত হন নি। ইত্যবসরে কোনো আলেম বা মুফতীকে এমন কি ইজতেহাদের সপ্তম সারিতে পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করা হয় নি। ফলে আমাদেরকে আজকাল এমন একজন মুসলমানের কাছ থেকে তা শিক্ষা করতে হয় যিনি চার মযহাবের কোনো একটি মযহাবের ইমামমণ্ডলীর বইপত্র পাঠ করতে পারেন এবং বুঝতে পারেন এবং যিনি সেগুলো অনুবাদও করতে পারেন; আমাদেরকে সেগুলো অনুযায়ী আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন ও এবাদত-বন্দেগী সম্পন্ন করতে হবে।

আল্লাহ তা’লা তাঁর কুরআনুল করীমে প্রত্যেক বস্তুর আইন-কানুন ঘোষণা করেছেন। তাঁর মহান রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলোর সবই ব্যাখ্যা করেছেন। আর আহলে সুন্নাতের উলামামণ্ডলী সেগুলো সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-বৃন্দের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ সকল পুস্তক বর্তমানে সারা বিশ্বে বিরাজ করছে। কেয়ামত পর্যন্ত যে কোনো স্থানে উদ্ভূত যে কোনো বিষয়ের সাথে এ সকল পুস্তকের কোনো একটি শিক্ষার সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যাবেই। এ সম্ভাবনাটি হলো কুরআনুল করীমের একটি মু’জিযা এবং ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের একটি কারামত। কিন্তু একজন প্রকৃত সুন্নী মুসলমানের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে শেখাটা এ ক্ষেত্রে একান্ত জরুরি। যদি আপনারা একজন লা-মযহাবী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে সে আপনাদেরকে ফেকাহ গ্রন্থের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ জবাব দিয়ে গোমরাহ/পথভ্রষ্ট করবে।

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি কীভাবে যুব সম্প্রদায় সে সমস্ত লা-মযহাবী মূর্খ ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে, যারা কিছু বছর আরব দেশগুলোতে অবস্থান করে আরবী শিক্ষা লাভ করে এবং সেখানে আমোদ-ফুর্তিতে সময় অতিবাহিত করার পর আহলে সুন্নতের একজন শত্রু লা-মযহাবী গোমরাহ ব্যক্তির সইকৃত সনদপত্র সংগ্রহ করে ভারত কিংবা পাকিস্তানে (বাংলাদেশেও) ফিরে যায়। যুবকেরা তাদের নকল সনদপত্র দেখে এবং আরবী কথাবার্তা শুনে মনে করে যে সত্যি সত্যি বুঝি তারা ইসলামী উলামা! অথচ তারা ফেকাহর একটি গ্রন্থও বুঝতে সক্ষম নয়। আর তারা ফেকাহ্ গ্রন্থের শিক্ষাসমূহ সম্পর্কেও অজ্ঞ। বস্তুতঃ তারা এ সকল ধর্মীয় শিক্ষায় বিশ্বাসই করে না; বরং তারা এগুলোকে কুসংস্কার ও একগুঁয়েমি আখ্যায়িত করে থাকে। পূর্ববর্তী জমানায় ইসলামী উলামাবৃন্দ তাঁদের প্রতি করা প্রশ্নসমূহের উত্তর ফেকাহর গ্রন্থাবলীতে খুঁজে দেখতেন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত উত্তর প্রশ্নকারীকে প্রদান করতেন। কিন্তু লা-মযহাবী একজন ধর্মীয় ব্যক্তি ফেকাহর গ্রন্থাবলী পড়তে ও বুঝতে অক্ষম হয়ে নিজের মূর্খতা ও ত্রুটিপূর্ণ মস্তিষ্কে যা কিছু আসবে তাই প্রশ্নকারীদেরকে জবাব দিয়ে তাদেরকে গোমরাহ (পথভ্রষ্ট) ও জাহান্নামী বানাবে। এ কারণেই আমাদের রাসূলে করীম (দঃ) এরশাদ করেছেন-
 
ألا إن شر الشر شرار العلماء، وإن خير الخير خيار العلماء

“(সৃষ্টিতে) খারাপের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হলো (বদকার, বদ আকীদাসম্পন্ন) আলেম। আর ভালোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো আলেমে (হক্কানী-রব্বানী, বুযুর্গানে দ্বীন)” (আল্ হাদীস)। হাদীসটি পরিস্ফুট করে যে, আহলে সুন্নতের বিজ্ঞ আলেম-উলামা হলেন সৃষ্টির সেরা; আর লা-মযহাবীরা হলো সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি। কেননা, সুন্নী উলামাবৃন্দ মানুষদেরকে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পথ অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন, ফলশ্রুতিতে জান্নাতে দাখিল হতে সহায়তা করেন। পক্ষান্তরে,  লা-মযহাবীরা নিজেদের গোমরাহ ধ্যান-ধারণার দিকে মানুষদেরকে প্ররোচণা দিয়ে থাকে এবং ফলস্বরূপ তাদেরকে জাহান্নামের বাসিন্দা বানিয়ে দেয়।

জামে’ আল-আজহার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক স্নাতক ডিগ্রিধারী উস্তাদ ইবনে খলীফা আলূভী তাঁর কৃত “আকীদাতুস সালাফ ওয়াল খালাফ” গ্রন্থে আল্লামা আবু জুহরা রচিত ’তারীখ আল্ মযাহিবিল ইসলামিয়া’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, কিছু লোক যারা হাম্বলী মযহাবের সাথে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল, তারা নিজেদেরকে সালাফ্যিয়ীন আখ্যায়িত করেছিল। আবুল ফারাজ ইবনে আল্ জাওযী এবং অন্যান্য হাম্বলী মযহাবের উলামাবৃন্দ সেই সব সালাফীকে সালাফ আস্ সালেহীনের অনুসারী নয় বরং মুজাস্সিমা সম্প্রদায়ের বিদআতী হিসেবে ঘোষণা করে তাদের ফিতনাকে দমন করেন। সপ্তম শতাব্দীতে ইবনে তাইমিয়া পুনরায় এই ফিতনা জাগ্রত করে”। (আকীদাতুস সালাফ ১ম প্রকাশ দামেশক, ১৯৭৮ ইং)

লা-মযহাবীরা “সালাফিয়্যা” নামটি গ্রহণ করেছে এবং ইবনে তাইমিয়াকে ‘সালাফিবৃন্দের মহান ইমাম’ বলে দাবি করছে। এই শব্দটি একটি ক্ষেত্রে সত্য এ কারণে যে, তার আগে সালাফী শব্দটির অস্তিত্বই ছিল না। ইবনে তাইমিয়ার আগে কেবলমাত্র সালাফ আস্ সালেহীনবৃন্দের অস্তিত্ব ছিল, যাঁদের মযহাব (পথ) ছিল আহল্ আস্ সুন্নাহ। ইবনে তাইমিয়ার গোমরাহ ধ্যান-ধারণাই ওহাবী, মওদূদী ও লা-মযহাবী ব্যক্তিবর্গের জন্যে উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইবনে তাইমিয়া পূর্বে হাম্বলী মযহাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছিল; অর্থাৎ সে পূর্বে সুন্নী ছিল। কিন্তু যখন সে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে সমর্থ হলো এবং ফতোয়া প্রদানের ডিগ্রী অর্জন করলো, তখনি সে অহংকারী হয়ে উঠলো এবং আহলে সুন্নতের উলামাদের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে যাহের করতে শুরু করে দিল। তার জ্ঞান বৃদ্ধিই তার গোমরাহীর সূচনা করলো। অতঃপর সে আর হাম্বলী মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কেননা, চার মযহাবের অন্তর্গত হতে হলে সুন্নী বিশ্বাস গ্রহণ করতে হবে। আহলে সুন্নতের আকীদা-বিশ্বাসবর্জিত কোনো ব্যক্তিকে হাম্বলী মযহাবের অন্তর্ভুক্ত বলা যায় না।

লা-মযহাবী ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজেদের দেশে ধর্মীয় কর্তব্য পালনরত সুন্নী ব্যক্তিবৃন্দের প্রতি কালিমা লেপনের এবং হেয় প্রতিপন্নকরণের সুযোগ সন্ধান প্রতিনিয়তই করে থাকে। তারা সুন্নীদের বইপত্র পড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং আহলে সুন্নতের শিক্ষাসমূহ বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের চালবাজীর আশ্রয় নিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এই ফকিরের নাম (হুসাইন হিলমী ইশিক) উল্লেখ করে জনৈক লা-মযহাবী ব্যক্তি বলেছে, “ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে একজন রসায়নবিদ বা ওষুধ বিজ্ঞানীর কাজ কী? তার উচিৎ তার নিজের জ্ঞানের শাখায় কাজ করে যাওয়া এবং আমাদের কাজে নাক না গলানো”। কী চরম অজ্ঞতাপ্রসূত ও আহাম্মকিপূর্ণ ধারণা! সে ধরে নিয়েছে যে, একজন বিজ্ঞানীর কোনো ধর্মীয় জ্ঞান থাকতেই পারে না। অথচ সে এই সত্যটি সম্পর্কে অনবগত যে, মুসলমান বিজ্ঞানীবৃন্দ খোদাতা’লার সৃষ্টিসমূহকে প্রতিটি মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করেন এবং সৃষ্টিতে প্রদর্শিত সৃষ্টার ত্রুটিবিহীন গুণাবলী উপলব্ধি করেন; আর খোদাতা’লার অসীম ক্ষমতার তুলনায় সৃষ্টিসমূহের অক্ষমতা দর্শন করে তাঁরা প্রতিনিয়ত অনুধাবন করেন যে, আল্লাহপাক অন্যান্য কোনো কিছুরই মতো নন এবং তিনি সকল ত্রুটি-বিচ্যুতিরই ঊর্ধ্বে। বিখ্যাত জার্মান পরমাণু পদার্থ বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক তাঁর ‘ডার ষ্ট্রম’ পুস্তকে এটা খুব সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ লা-মযহাবী অজ্ঞ লোকটি তারই মতো কোনো গোমরাহ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রামাণ্য দলিল ও গদির ওপর নির্ভর করে এবং সম্ভবতঃ সউদী আরব হতে সরবরাহকৃত স্বর্ণের মোহাচ্ছন্ন হয়ে ভাবছে যে, ধর্মীয় জ্ঞান বুঝি তারই একচেটিয়া কারবার।

হাঁ, আমি (হুসাইন হিলমী ইশিক) ত্রিশ বছর যাবৎ রসায়ন-কৌশল ও ওষুধ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠভাবে আমার দেশের খেদমত করে এসেছি। কিন্তু একই সাথে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সাত বছর ধরে দিন-রাত পরিশ্রম করে আমি একজন মহান ইসলামী আলেমের দেয়া এজাযত দ্বারা ধন্য হই। ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিশালতার মাঝে আমি নিজের অক্ষমতা পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। এই উপলব্ধির কারণে আমি প্রকৃত অর্থেই একজন বান্দা হবার চেষ্টা করেছি। আমার সব চেয়ে বড় ভয় ও দুশ্চিন্তা আমার সনদ এবং এজাযতের মোহে না পড়ে যাই এবং নিজেকে এসব বিষয়ে ‘সবজান্তা’ না ভেবে বসি। আমার ভীতির নিদর্শন আমার সকল পুস্তকেই বিরাজমান। আমার কোনো বইতেই আমি আমার ধ্যান-ধারণা কিংবা অভিমত উপস্থাপন করার সাহস প্রদর্শন করিনি। আমি আমার ছোট ভাইদের কাছে সব সময়ই আহলে সুন্নতের আলেমমণ্ডলীর মহামূল্যবান লেখনীসমূহ আরবী ও ফারসী হতে অনুধাবন করে উপহার দিতে চেষ্টা করেছি - যে সমস্ত লেখনী সমঝদারবৃন্দ শ্রদ্ধা করেন। আমার এ ভয়ের কারণে বহু বছর আমি বইপত্র লেখার সাহসই করিনি।

إذا ظهرت الفتن ـ أو قال : البدع ـ ، وسب أصحابي ، فليظهر العالم علمه ، فمن لم يفعل ذلك فعليه لعنة الله ، والملائكة ، والناس أجمعين ، لا يقبل الله له صرفا ، ولا عدلا
 
“যখন ফিতনা প্রকাশ হবে কিংবা আমার সাহাবীদেরকে বিদআতী ব্যক্তিবর্গ সমালোচনা করবে, তখন যেন জ্ঞান শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম সত্য প্রকাশ করে। যদি সে এ রকম কাজ না করে, তবে তার ওপর আল্লাহ তা’লা, ফেরেশতাকুল ও মনুষ্যজাতির লা’নত তথা অভিসম্পাত! আল্লাহ পাক তার কোনো কাজ কিংবা ন্যায়-নিষ্ঠাই আর কবুল করবেন না” - এই হাদীসটি দেখার পর আমি গভীর চিন্তা শুরু করলাম। একদিকে আহলে সুন্নতের জ্ঞান বিশারদবৃন্দের ধর্মতত্ত্ব ও তাঁদের সময়কার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানবিষয়ক উপলব্ধি ও মানসিক পরিপক্কতা সম্পর্কে এবং তাঁদের এবাদত ও তাকওয়া সম্পর্কে জানতে পেরে আমি আমার ক্ষুদ্রতা দেখতে পাই, অপর দিকে ক্রমহ্রাসমান পুণ্যবান ব্যক্তিদেরকে আহলে সুন্নতের উলামামণ্ডলীর বইপত্র পড়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম দেখে এবং অজ্ঞ পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদেরকে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সেজে বিভ্রান্তিকর ও ক্ষতিকর গোমরাহ পুস্তকাদি রচনা করতে দেখে আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হই। হাদীসে বর্ণিত শাস্তি আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। আমার প্রিয় ছোট ভাইদের জন্যে আমার অনুভূত দয়া ও সহানুভূতিও আমাকে তাদের খেদমতে আসতে বাধ্য করে, যার দরুন আমি আহলে সুন্নতের উলামাবৃন্দের বইপত্র হতে অনুবাদ ও প্রকাশনা আরম্ভ করি। অসংখ্য অভিনন্দনসূচক চিঠি যা আমি পেয়েছি, তার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে আমি লা-মযহাবীদের পক্ষ থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও কঠোর সমালোচনাও শ্রবণ করেছি। কিন্তু যেহেতু আমার আল্লাহ তা’লার প্রতি এবং আমার বিবেকের প্রতি আমার এখলাছ (নিষ্ঠা) ও সততা সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই, সেহেতু আল্লাহ তা’লার ওপর আস্থা রেখে এবং তাঁর প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র রূহ মোবারক ও আউলিয়া কেরামের রূহ্ মোবারকের তাওয়াসসুল (মধ্যস্থতা) গ্রহণ করে আমি আমার খেদমত অব্যাহত রেখেছি।

মিশরের জামে’ আল-আযহার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং একজন মহান হানাফী আলেম শায়খ মুহাম্মদ বখিত আল-মুতি’য়ী হানাফী তাঁর প্রণীত “তাতহিরুল ফুয়াদ মিন দানিসিল এ’তেকাদ” পুস্তকে লিখেছেন:

“সকলের চেয়ে নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলীর রূহ মোবারক হলেন উচ্চ মকামের এবং পরিপক্ক। তাঁরা ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি, উদাসীনতা, একগুঁয়েমি, নফস বা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ, হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, প্রতিশোধপরায়ণতা ইত্যাদি দোষত্রুটি হতে পবিত্র। নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দ আল্লাহ তা’লা কর্তৃক তাঁদের কাছে প্রকাশিত বিষয়াবলী ব্যাখ্যা ও প্রচার করেছেন। দ্বীন ইসলামের শিক্ষাসমূহ অর্থাৎ নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলীর প্রচারিত আদেশ-নিষেধসমূহ সবই সত্য। তাঁদের কেউই ভ্রান্তি কিংবা দুর্নীতিপরায়ণ নন। নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের পরে তাঁদের সাহাবা-মণ্ডলীই হলেন সবচাইতে উঁচু মর্যাদার অধিকারী ও সবচাইতে পরিপক্ক - কেননা, তাঁরা নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের সান্নিধ্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত, পরিপক্কতাপ্রাপ্ত এবং পরিশুদ্ধতাপ্রাপ্ত। তাঁরা সব সময়ই নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলী হতে যা শুনেছিলেন তাই ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁরা যে সকল বিষয় ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করেছিলেন তার সবই সত্য। তাঁরাও উপরোক্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পবিত্র। নিজেদের একগুঁয়েমি কিংবা জেদ দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাঁরা একে অপরের বিরোধিতা করেন নি, আর তাঁরা নিজেদের নফসকেও অনুসরণ করেন নি। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) কর্তৃক আল্লাহ তা’লার দ্বীনকে তাঁর বান্দাদের কাছে ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে কৃত আয়াত ও হাদীসসমূহের ব্যাখ্যাবলী এবং ইজতেহাদসমূহ হচ্ছে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উম্মতের ওপর খোদাতা’লার মহান নেয়ামত এবং নূর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর বর্ষিত তাঁরই খাস বা বিশেষ দয়া। কুরআনুল করীম ঘোষণা করেছে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) অবিশ্বাসী কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, কিন্তু পরস্পরের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও সহিষ্ণু; আর তাঁরা নিরলসভাবে নামাজ পড়তেন এবং শুধুমাত্র আল্লাহ পাকের কাছ থেকেই সকল জিনিস ও বেহেশত কামনা কিংবা আশা করতেন। তাঁদের সকল ইজতেহাদ - যেগুলো সম্পর্কে এজমা (ঐকমত্য) হয়েছিল, সেগুলো সঠিক ছিল। তাঁদের সবাইকেই সওয়াব দেয়া হয়েছিল - যেহেতু বাস্তবতা কেবলমাত্র একটাই।

“সাহাবায়ে কেরামের পরে শ্রেষ্ঠ ইনসান হলেন সেই সকল মুসলমান যাঁরা সাহাবীদেরকে দেখেছেন এবং তাঁদের সান্নিধ্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এঁদেরকে ‘তাবেউন’ বলা হয়। তাবেউনবৃন্দ তাঁদের ধর্মীয় জ্ঞান সাহাবীদের কাছ থেকে হাসিল করেছেন। তাবেউন-মণ্ডলীর পরে শ্রেষ্ঠ মুসলমান হলেন তাঁরাই যাঁরা তাঁদেরকে দেখেছেন এবং তাঁদের সোহবত বা সাহচর্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এঁদেরকে বলা হয় ‘তাবেউত্ তাবেয়ীন’। তাবেউত্ তাবেয়ীনদের পরে কেয়ামত পর্যন্ত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীতে আগমনকারী মুসলমানবৃন্দের মধ্যে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ হবেন, যাঁরা সালাফে সালেহীন তথা এই তিনটি প্রজন্মকে অনুসরণ করবেন এবং তাঁদের শিক্ষাসমূহ ধারণ করে তাঁদেরকে একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করবেন। সালাফ আস্ সালেহীনের পরে আগত ধর্মীয় কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তি যাঁর কথা ও কাজ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)) এবং সালাফ আস্ সালেহীনের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, আর যিনি তাঁদের পথ হতে কখনোই বিশ্বাসে কিংবা কাজে বিচ্যুত হন না এবং যিনি ইসলামের সীমা লংঘন করেন না, তিনি অন্যদের অপবাদ দেয়ার ও হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতাকে কখনোই ভয় পাবেন না। তাদের বিভ্রান্তির বেড়াজালে তিনি আটক হবেন না। তিনি অজ্ঞদের কথায় কানও দেবেন না। তিনি তাঁর আক্কলকে ব্যবহার করবেন এবং মুজতাহিদ ইমামবৃন্দের চার মযহাবের বাইরে যাবেন না। মুসলমানদেরকে একজন জ্ঞানবিশারদের অন্বেষণ করতে হবে এবং তাঁর কাছে তাঁরা যা জানেন না, তা জিজ্ঞেস করে শিক্ষা করতে হবে এবং তাঁদের দ্বারা সম্পাদিত সকল কাজে ও বিষয়াবলীতে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। কেননা, এই ধরনের জ্ঞানী আলেম-ব্যক্তি আল্লাহ তা’লা কর্তৃক তাঁর বান্দাদেরকে ভুল-ভ্রান্তি হতে রক্ষা করার এবং সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট রূহানী বা আধ্যাত্মিক ওষুধ সম্পর্কে নিজেও জানেন এবং মানুষকেও জানিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, তিনি আত্মার ওষুধ সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ও বুদ্ধিহীনদেরকে নিরাময় করবেন। এই আলেম তাঁর সকল কথায়, কাজে এবং বিশ্বাসে ইসলামকে অনুসরণ করবেন। তাঁর উপলব্ধি সব সময়ই সঠিক হবে। তিনি সকল প্রশ্নই সঠিকভাবে উত্তর দেবেন। আল্লাহ তালাও তাঁর সকল কাজকে পছন্দ করবেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর রেযামন্দী হাসিলের পথসমূহ অন্বেষণকারীদেরকে পথপ্রদর্শন করবেন। তিনি ঈমানদারদেরকে এবং জুলুম-নিপীড়ন ও বালা-মুসীবতে ঈমানের শর্ত পূরণকারীদেরকে রক্ষা করবেন। তিনি তাঁদেরকে নূর (জ্যোতি), পরিত্রাণ ও সুখ-শান্তি অর্জন করতে সাহায্য করবেন। তাঁদের কৃত সকল কর্মেই তাঁরা সুখ-শান্তি পাবেন। পুনরুত্থান দিবসে তাঁরা আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম), সিদ্দিকীন (রহমতুল্লাহি আলাইহিম), শুহাদা ও সালেহীনবৃন্দের সঙ্গে থাকবেন।

“যে কোনো শতাব্দীতেই যদি কোনো ধর্মীয় ব্যক্তি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিংবা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর আজ্ঞাসমূহ অনুসরণ না করে এবং যদি তার কথা, কাজ ও বিশ্বাস তাঁদের শিক্ষাসমূহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় এবং যদি সে নিজের ধ্যান-ধারণাকে অনুসরণ করে ও ইসলামের প্রদত্ত সীমা লংঘন করে, আর যদি সে নিজের উপলব্ধি-বহির্ভূত জ্ঞানের ক্ষেত্রে চার মযহাবের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তাকে ধর্মীয় পদে সমাসীন একজন বদমায়েশ ব্যক্তি হিসেবেই গণ্য করা হবে। আল্লাহ তা’লা তার কলবে (অন্তরে) মোহর মেরে দিয়েছেন। তার চোখ সত্য, সঠিক পথটি দেখতে পাচ্ছে না। তার কানও সঠিক কথাটি শুনতে পাচ্ছে না। আখেরাতে তার জন্যে চরম আযাব (শাস্তি) অপেক্ষা করছে। আল্লাহ তাকে পছন্দ করবেন না। এ ধরনের লোকেরা নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলীরও শত্রু বটে। তারা মনে করে থাকে যে, তারা সঠিক পথের ওপরই কায়েম আছে। তাই তারা নিজেদের কাজকে পছন্দ করে থাকে। অথচ তারাই হলো শয়তানের অনুসারী। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই চৈতন্য ফিরে পায় এবং সঠিক পথ অনুসরণ করে। তাদের কথাবার্তা শিষ্ট ও দরকারি এবং আনন্দদায়ক মনে হলেও তাদের চিন্তাধারা ও পছন্দ হলো বদ। তারা আহাম্মক ও উজবকদেরকে ধোঁকা দিয়ে গোমরাহী এবং ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। তাদের কথাকে তুষারের মত শুভ্র ও নির্মল মনে হলেও সত্যরূপী সূর্যের সামনে ওগুলো গলে যেতে বাধ্য। ধর্মীয় পদে সমাসীন এসব বদমায়েশ লোক যাদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ তা’লা মোহর মেরে দিয়েছেন এবং ময়লা বানিয়ে দিয়েছেন তাদেরকে ‘ আহল্ আল্ বিদআত’ কিংবা ‘লা-মাযহাবী’ বলা হয়। এসব লোকের আকীদা-বিশ্বাস ও আমল কুরআনুল করীম, হাদীস শরীফ কিংবা এজমাউল উম্মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সত্য, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা অন্যদেরকেও ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাদেরকে যারা অনুসরণ করবে তারাও জাহান্নামী হবে। সাহাবী (রা.)-দের সময় এবং তাঁদের পরবর্তীকালে আগত দ্বীনি কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে ওই ধরনের গোমরাহ ব্যক্তি বহু ছিল। মুসলমানদের মধ্যে তাদের উপস্থিতি অনেকটা দেহের মধ্যে গ্যাংরিন রোগের উপস্থিতির মতোই। যদি এই রোগটি দূর করা না যায়, তাহলে দেহের অন্যান্য অংশও এই বিপর্যয় হতে পরিত্রাণ পায় না। এই সকল গোমরাহ লোক হলো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষদের মতোই। তাদের সংস্পর্শে যারা আসবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদেরকে তাদের থেকে দূরে সরে থাকতে হবে, যাতে করে আমরা তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হই”। (শায়খ মুহাম্মদ বখিত আল মুতিয়ী হানাফী কৃত ‘তাতহিরুল ফুয়াদ মিন দানিসিল এ’তেকাদ’ গ্রন্থ)।

ধর্মীয় পদে সমাসীন গোমরাহ ও বদমায়েশ লোকদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল ইবনে তাইমিয়া। তার লিখিত বই পুস্তকে, বিশেষ করে তার ‘আল ওয়াসিতা’ পুস্তকে সে এজমা আল্ মুসলেমীনকে অগ্রাহ্য করেছে, কুরআনুল করীম ও হাদীস শরীফের সুস্পষ্ট ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে এবং সালাফে সালেহীনবৃন্দের পথকে অনুসরণ করেনি। তার ত্রুটিপূর্ণ মস্তিষ্ক ও দুষ্ট চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে সে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিল। তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল সত্য। কিন্তু তার জ্ঞানের কারণেই গোমরাহী তাকে গ্রাস করে। সে তার নিজস্ব চাহিদানুযায়ী চলা শুরু করে। সত্য, সঠিক আদর্শের নামে সে তার মহাভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ধ্যান-ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস পেয়েছিল।

মহান আলেম হযরত ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী আল মক্কী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর “ফতোয়ায়ে হাদীসিয়া” গ্রন্থে লিখেছেন :

“আল্লাহ্তা’লা ইবনে তাইমিয়াকে গোমরাহী ও চরম ক্ষতি প্রদান করেন। তিনি তাকে বধির ও অন্ধ বানিয়ে দেন। বহু উলামা জানিয়েছেন যে, তার কাজগুলো ছিল দূষণীয় এবং কথাগুলো ছিল মিথ্যা। তাঁরা এটা দলিল দ্বারা প্রমাণ করেছেন। যাঁরা মহান ইসলামী উলামায়ে কেরাম হযরতুল আল্লামা আবু হাসান তাকিউদ্দীন সুবকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও তাঁর পুত্র তাজউদ্দীন সুবকী এবং ইমাম ইযয্ ইবনে জামা’আ-র কেতাবপত্র পড়েছেন এবং যাঁরা ইবনে তাইমিয়ার খণ্ডনে তারই সময়কার শাফেয়ী, মালেকী ও হানাফী উলামায়ে কেরামের মৌখিক এবং লিখিত প্রত্যুত্তরসমূহ অধ্যয়ন করেছেন, তাঁরা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে আমরাই সঠিক।

“তাসাউফের জ্ঞান বিশারদদের প্রতি ইবনে তাইমিয়া কুৎসা রটনা করে এবং ইবলিসী পন্থায় অপবাদ দেয়। উপরন্তু, সে ইসলামের স্তম্ভ হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ও হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে আক্রমণ করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। তার কথাবার্তা সীমা লংঘন করে ও আদবের খেলাপ হয়ে দাঁড়ায় এবং সে উঁচু পাহাড়ের দিকেও ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে দেয়। সে সঠিক পথের মনীষীদেরকে অজ্ঞ-মূর্খ ও বেদআতী-গোমরাহ্ হিসেবে হেয় প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হয়।

“ইবনে তাইমিয়া বলেছে, ’ইসলামের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ গ্রীক দার্শনিকদের বিভ্রান্তিকর গোমরাহ ধ্যান-ধারণা তাসাউফের মহান ব্যক্তিত্বদের বইপত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে।’ সে এ কথা প্রমাণের জন্যে তার মহাভ্রান্ত চিন্তাধারা দ্বারা উঠে পড়ে লেগেছিল! যেসব যুবক সত্য সম্পর্কে অনবহিত, তারা তার আবেগপূর্ণ ও ধোঁকাপূর্ণ কথাবার্তায় পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সে বলেছে:

‘তাসাউফপন্থীবৃন্দ বলেন, তাঁরা লওহ্ আল মাহ্ফুজ দেখতে পান। ইবনে সীনার মত কিছু দার্শনিক এটাকে আন্ নফস্ আল ফালাকিয়্যা আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলেন যে, যখন মানবের রূহ বা আত্মা পূর্ণতা অর্জন করে, তখন আত্মাটি নফস্ আল্ ফালাকিয়্যা কিংবা আল্ আক্কল্ আল্ ফা’য়াল-এর সাথে ঘুমন্ত কিংবা জাগ্রতাবস্থায় মিলিত হয়; আর যখন কোনো ব্যক্তির রূহ এ দুটোর সাথে মিলিত হয়, যা পৃথিবীতে সকল জিনিস সংঘটিত হবার কারণস্বরূপ, তখন তিনি এগুলোর মধ্যে বিরাজমান বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত হতে শুরু করেন। এ সকল কথা গ্রীক দার্শনিকরা বলেনি। এগুলো পরবর্তীকালে আগত ইবনে সীনা ও অনুরূপ ব্যক্তিবর্গের কথা। ইমাম আবু হামিদ আল গাযযালী, সুফী মুহিউদ্দিন ইবনে আরবী এবং আন্দালুসীয় দার্শনিক কুতুবুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে সাব’ইনও এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। এগুলো হলো দার্শনিকদের উক্তি। ইসলামে এসব জিনিসের কোনো অস্তিত্বই নেই। এইসব উক্তি দ্বারা তাঁরা সঠিক পথ হতে বিচ্যুত হয়েছেন। তাঁরা শিয়া, ইসমাইলীয়া, কারামতী ও বাতিনী সম্প্রদায়ের মতো মূলহিদ (ধর্মচ্যুত) হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা আহলে সুন্নতের উলামাবৃন্দ, মুহাদ্দিসমণ্ডলী ও ফুযাইল ইবনে আয়াযের মতো তাসাউফের সুন্নী ব্যক্তিত্বদের অনুসৃত সঠিক পথকে পরিহার করেছেন। একদিকে তাঁরা দর্শন শাস্ত্রে ডুব দিয়েছেন, আর অপরদিকে তাঁরা মু’তাযিলা ও কোরামিয়ার মতো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাসাউফপন্থীদের মধ্যে তিনটি শ্রেণী রয়েছে। প্রথম শ্রেণীটি হাদীস ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে আছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীটি কোরামিয়া সম্প্রদায়ের মতো গোমরাহ্। আর তৃতীয় শ্রেণীটি হলো ইখওয়ান আস সাফা’র বইপত্র এবং আবুল হাইয়্যানের কথার অনুসারী। ইবনুল আরবী ও ইবনে সাব’ইন এবং অনুরূপ ব্যক্তিবর্গ দার্শনিকদের কথাকে গ্রহণ করে তাসাউফের পণ্ডিতদের মন্তব্যে রূপান্তরিত করেন। ইবনে সিনার ‘আখির আল ইশারাত আলা মাকামিল আরেফিন’ গ্রন্থটিতে এ ধরনের বহু মন্তব্য আছে। ইমাম আল্ গাযযালীও তাঁর পুস্তকাদিতে এ ধরনের বহু বক্তব্য রেখেছেন, বিশেষ করে তাঁর ‘আল কেতাবুল মাদনুন’ ও ‘মেশকাত আল আনওয়ার’ পুস্তকে। বস্তুতঃ তাঁর বন্ধু আবু বকর ইবনে আল আরবী তাঁকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন এ কথা বলে যে, তিনি দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু তিনিও ইমাম সাহেবকে বাঁচাতে পারেননি। অপর পক্ষে, ইমাম গাযযালী বলেছেন যে দার্শনিকরা কাফের (অবিশ্বাসী)। তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি সহীহ আল বুখারী (হাদীস গ্রন্থ) অধ্যয়ন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, এর দরুন তিনি তাঁর পূর্বলিখিত ধ্যান-ধারণা বর্জন করেছিলেন। আর কেউ কেউ বলেছেন যে, ইমাম গাযযালীকে হেয় করার জন্যে ওই সকল বক্তব্য তাঁর নামে আরোপ করা হয়েছিল! ইমাম গাযযালীর ব্যাপারে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা রয়েছে। মালেকী আলেম মুহাম্মদ মাযারী যিনি সিসিলিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং আন্দালুসীয় পণ্ডিত তরতুসী এবং ইবনুল জাওযী ও ইবনে ঊক্কাইল এবং অন্যান্যরা এ রকম বহু মন্তব্য করেছেন।’ (ইবনে তাইমিয়ার উদ্ধৃতি এখানে শেষ হলো)

“ইবনে তাইমিয়া হতে উদ্ধৃত তার উপরোক্ত ধারণাসমূহ সুস্পষ্টভাবে আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে তার বদ চিন্তাই প্রতিভাত করে। এমনকি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-বৃন্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠজনদের প্রতিও সে এরকম অপবাদ দিয়েছে। সে আহলে সুন্নতের অধিকাংশ উলামাকে গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইত্যবসরে সে যখন মহান ওলী ও কুতুবুল আরেফীন হযরত আবুল হাসান শাযিলীকে তাঁর ‘হিযবুল কবীর’ ও ’হিযবুল বখর’ গ্রন্থ দুটোর জন্যে গালাগালি করছিল এবং মুহিউদ্দিন ইবনে আরবী, উমর ইবনে ফরিদ ও হাল্লাজ হুসেইন ইবনে মনসুরের মতো মহান সূফীদেরকে অপবাদ দিচ্ছিল, তখন তার সময়কার উলামাবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে ফতোওয়া জারি করেন যে সে একজন গুনাহগার ও গোমরাহ ব্যক্তি।

“৭০৫ হিজরীতে ইবনে তাইমিয়াকে লিখিত একটি চিঠি ঘোষণা করে: ‘হে আমার মুসলিম ভ্রাতা, যে নাকি নিজেকে একজন বড় আলেম ও সময়ের ইমাম মনে করছো। আমি তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবেসেছিলাম। তোমার বিরুদ্ধাচরণকারী উলামাদেরকে আমি স্বীকৃতি দিতাম না। কিন্তু তোমার প্রতি ভালবাসার পরিপন্থী তোমার কিছু কথা আমাকে বিস্মিত করেছে। সূর্যাস্তের পরে যে রাত শুরু হয়, তা কি কোনো জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি সন্দেহ করেন ? তুমি বলেছিলে যে, তুমি সঠিক পথের পথিক এবং ’আল আমরু বিল মা’রূফ ওয়ান নাহী আনিল মুনকার’ (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধাজ্ঞা) পালন করছো। আল্লাহ তা’লাই ভাল জানেন তোমার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (নিয়্যত) কী। তবে মানুষের এখলাস তথা নিষ্ঠা তার কর্ম দ্বারা উপলদ্ধি করা যায়। তোমার কর্ম তোমার মিষ্টি কথার পর্দাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। যারা নিজেদের কুপ্রবৃত্তি (নফসানীয়াত)-কে অনুসরণ করে এবং যাদের কথা নির্ভরযোগ্য নয়, তাদের দ্বারা ধোঁকাপ্রাপ্ত হয়ে তুমি কেবলমাত্র তোমার সময়ে জীবিতদেরকেই হেয় প্রতিপন্ন করো নি, বেসালপ্রাপ্তদেরকেও কুফরীর অপবাদ দিয়েছো। সালাফ আস্ সালেহীনের উত্তরসূরীদেরকে আক্রমণ করে তৃপ্তি না পেয়ে তুমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.), বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জনদেরকেও গালমন্দ করতে কুণ্ঠিত হওনি। তুমি ধারণা করতে পারো তোমার কী অবস্থা হবে যখন ওই সকল মহান ব্যক্তিত্ব পুনরুত্থান দিবসে তাঁদের হক তথা অধিকার দাবি করবেন? সালেহীয়্যা নগরীতে জামে’ আল্ জাবাল মসজিদের মিম্বরে তুমি বলেছো যে, হযরত ওমর (রাঃ)- এর কিছু ভুল মন্তব্য এবং কিছু গুনাহ-খাতা আছে। গুনাহ-খাতাগুলো কী ছিল ? সালাফ আস্ সালেহীন কর্তৃক কোন্ কোন্ গুনাহ-খাতা তোমার কাছে বর্ণিত হয়েছে তা জানতে পারি কি ? তুমি বলেছো যে, হযরত আলী (রাঃ)-এর নাকি তিন শতাধিক ভুল-ভ্রান্তি হয়েছিল। যদি ধরা হয় যে, হযরত আলী (কঃ)-এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল, তাহলে কি তোমার ক্ষেত্রে একটিও সঠিক হবে? এখন আমি তোমার বিরুদ্ধাচরণ করবো। আমি মুসলমানদেরকে তোমার বদমায়েশী থেকে রক্ষা করতে তৎপর হবো। কেননা, তুমি সীমা লংঘন করেছো। তোমার যুলুম-অত্যাচার জীবিত ও বেসালপ্রাপ্তদেরকে স্পর্শ করেছে। মু’মিনদেরকে তোমার শয়তানী হতে দূরে সরে থাকতে হবে।’
(ইবনে তাইমিয়াকে লেখা চিঠির উদ্ধৃতি শেষ হলো)।

“সালাফ আস্ সালেহীনের সাথে ইবনে তাইমিয়া যেসব বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো আল্লামা তাজউদ্দীন সুবকী তালিকাভুক্ত করেছেন। তালিকা নিম্নরূপ:

১। সে বলেছে, তালাক (ইসলামী পন্থায়) প্রকৃত হয় না, (যদি কোনোক্রমে হয়ে যায়) শপথের জন্যে কাফ্ফারা দেয়া অবশ্য কর্তব্য। ইবনে তাইময়ার পূর্বে আগত কোনো ইসলামি আলেমই বলেননি যে, কাফফারা দিতে হবে।
২। সে বলেছে, হায়েজ (ঋতু শ্রাব)-সম্পন্ন নারীকে প্রদত্ত তালাক প্রকৃত হয় না, তার পবিত্রতার সময় প্রদত্ত তালাকও প্রকৃত হয় না।
৩। সে আরো বলেছে, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে তরককৃত নামাযের কাযা (পূরণ) পড়া অপরিহার্য নয়।
৪। তার মন্তব্য, ‘হায়েয-সম্পন্ন নারীর জন্যে কাবা শরীফের তাওয়াফ করা মোবাহ (অনুমতিপ্রাপ্ত)। সে যদি তা করে, তবে তাকে কাফফারা দিতে হবে না।’
৫। ইবনে তাইমিয়া বলেছে, ‘তিন তালাকের নামে প্রদত্ত এক তালাক এক তালাকই থাকবে।’ অথচ এ কথা বলার আগে সে বহুবার বলেছে যে এজমা আল মুসলিমিন এ রকম নয়।’
৬। সে বলেছে, ‘ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কর (ট্যাক্স) তাদের জন্যে হালাল যারা তা দাবি করে’।
৭। ইবনে তাইমিয়ার অভিমত হলো, ‘যখন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়, তখন তা যাকাত হয়ে যায়, যদিও তা যাকাতের নিয়্যতে দেয়া না হয়’।
৮। সে বলেছে, ‘একটি ইঁদুর কিংবা একটি বিড়াল যদি (হাউজের) পানিতে মরে পড়ে থাকে তাতেও পানি নাজস্ বা অপবিত্র হবে না’।
৯। সে আরো বলেছে, ‘জুনুব বা স্ত্রী সহবাসের পর নাপাক ব্যক্তি রাতের গোসল ছাড়াই নফল নামায পড়তে পারবে। এটা অনুমতিপ্রাপ্ত’।
১০। সে বলেছে, ‘ওয়াকিফ তথা ওয়াকফ প্রদানকারী ব্যক্তির আরোপিত শর্তাবলী অবিবেচনাযোগ্য। যা শাফেয়ীদের জন্যে উৎসর্গিত তা হানাফীদের জন্যে খরচ করা হয়’।
১১। সে বলেছে, ‘যে ব্যক্তি এজমা আল্ উম্মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে, সে অবিশ্বাসী (কাফের) কিংবা পাপী (ফাসিক) হয় না’।
১২। ইবনে তাইমিয়া মত প্রকাশ করেছে, ‘আল্লাহ্ তা’লা হলেন মহল্ল-ই-হাওয়াদিস (সৃষ্টির উৎপত্তিস্থল) এবং তিনি সমাবিষ্ট অণুর দ্বারা তৈরি’।
১৩। সে আরো বলেছে, ‘কুরআনুল করীম আল্লাহ পাকের যাত বা সত্তার মধ্যে সৃষ্ট হয়েছে’।
১৪। সে বলেছে, আলম তথা সৃষ্টি জগৎ তার প্রজাতি নিয়ে চিরন্তন থাকবে’।
১৫। ইবনে তাইমিয়ার ধারণা হলো, ‘আল্লাহ্ তা’লাকে ভাল জিনিস সৃষ্টি করতে হয়’।
১৬। সে বলেছে, ‘আল্লাহ পাকের দেহ ও দিক আছে; তিনি তাঁর স্থান পরিবর্তন করেন এবং তিনি আরশের মতোই বড়’।
১৭। সে বলেছে, ‘জাহান্নাম চিরস্থায়ী নয়। এটাও বিলীন হয়ে যাবে’।
১৮। ইবনে তাইমিয়া নবী (আ.)-মণ্ডলীর ত্রুটি-বিচ্যুতিহীনতার প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
১৯। সে বলেছে, ‘রাসুলূল্লাহ (দ.) অন্যান্য সাধারণ মানুষ হতে ভিন্ন কিছু নন। তাঁর মধ্যস্থতায় দোয়া করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়’।
২০। ইবনে তাইমিয়া মত প্রকাশ করেছে, রাসুলুল্লাহ (দ.)-এর যেয়ারত করার নিয়্যতে মদীনা শরীফ যাওয়া পাপ’।
২১। সে বলেছে, ‘মহানবী (দ:)-এর রওযায়ে আকদসে শাফায়াত (সুপারিশ) প্রার্থনা করতে যাওয়া হারাম’।
২২। সে আরো বলেছে, তওরাত ও ইনজিল শব্দসম্ভারে পরিবর্তিত হয় নি, বরং অর্থে পরিবর্তিত হয়েছে।

“কিছু ওলামা বলেছেন যে, উপরোক্ত মন্তব্যগুলো অধিকাংশ ইবনে তাইমিয়ার ছিলা না, কিন্তু ‘খোদা তা’লার দিক আছে এবং তিনি সমাবিষ্ট অণুর দ্বারা তৈরি’ মর্মে ইবনে তাইমিয়ার মন্তব্যকে কেউই অস্বীকার করেন নি। তবে সে যে এলম-এ সমৃদ্ধ ছিল, তা সর্বসম্মতভাবে ঘোষিত হয়েছিল। যে ব্যক্তির ফেকাহ, জ্ঞান, ইনসাফ ও বিচার-বুদ্ধি আছে, তার উচিৎ প্রথমে কোনো বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করা এবং তারপর বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। বিশেষ করে কোনো মুসলমানের কুফরী কিংবা ধর্মচ্যুতি অথবা তাঁকে হত্যা করার বিষয়টি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের এবং সতর্ক দৃষ্টির দাবি রাখে”। (ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী কৃত ফতোয়ায়ে হাদিসিয়ার উদ্ধৃতি এখানে সমাপ্ত হলো)

সম্প্রতি ইবনে তাইমিয়াকে অনুসরণ করা একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। গোমরাহ্ লোকেরা তার গোমরাহ্ লেখনীকে বিশেষ করে তার আল-ওয়াসিতা পুস্তককে সমর্থন করছে এবং সেগুলোকে পুর্নমূদ্রণ করছে। আল-ওয়াসিতা পুস্তকটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কুরআনুল করীম, হাদীস শরীফ ও এজমা আল্ মুসলিমিনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ধ্যান-ধারণায় পরিপূর্ণ। পাঠকদের মধ্যে এটা বিরাট ফিতনা ও বিভক্তি সৃষ্টি করে এবং মুসলমান ভ্রাতাদের মধ্যে বৈরিতার জন্ম দেয়। সৌদী নজদী ওহাবীরা এবং তাদের ফাঁদে পতিত অন্যান্য মুসলিম দেশের ধর্মীয় পদে সমাসীন অজ্ঞ ওহাবী-মওদূদীপন্থী লোকেরা ইবনে তাইমিয়াকে নিজেদের জন্যে ব্যানার বানিয়ে নিয়েছে। তারা তাকে “মহান মুজতাহিদ” ও “শায়খুল ইসলাম” ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করছে। তারা তার গোমরাহ্ চিন্তাধারা ও নীতিভ্রষ্ট লেখনীকে ঈমান এবং আকীদা-বিশ্বাসের নামে আঁকড়ে ধরছে। মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি ও ইসলামের মধ্যে অন্তর্ঘাত-সৃষ্টিকারী এ ভয়াবহ ধারাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে আমাদেরকে এর দলিলভিত্তিক খণ্ডনকারী সুন্নী উলামাবৃন্দের মহামূল্যবান বইপত্র পাঠ করতে হবে। তাঁদের এ সকল লেখনীর মধ্যে মহান ইমাম ও গভীর জ্ঞানী আলেম হযরতুল আল্লামা তাকিউদ্দীন সুবকী রচিত “আশ্ শিফাউস্ সিকাম ফি যেয়ারতী খাইরিল্ আনাম” নামক আরবী গ্রন্থটি ইবনে তাইমিয়ার গোমরাহ্ ধ্যান-ধারণাকে সমূলে উৎপাটিত করেছে, তার ফিতনাকে দমন করেছে এবং তার একগুঁয়েমি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে। এটা ইবনে তাইমিয়ার বদ উদ্দেশ্য ও মহাভ্রান্তির প্রসার রহিত করেছে। এই মহামূল্যবান বইটি সম্প্রতি হাকীকাত কিতাবেভী (ইস্তাম্বুল) হতে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।

                                (সমাপ্ত)