Saturday, 28 September 2024

প্রিয়নবী (দ.) কুর’আন ব্যাখ্যাকারী মর্মে কোনো আয়াত আছে কি? - প্রতিক্রিয়া ও জবাব

 -এডমিন


সম্প্রতি ফেইসবুকে উপরোক্ত শিরোনামের গবেষণামূলক লেখাটির অংশবিশেষ প্রকাশের পরে আমার জনৈক তরীক্বতী ভাই ও ফেইসবুক বন্ধু তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাতে তিনি লেখাটির সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। মন্তব্য সেকশনে তাঁর বক্তব্য আমি পুরোটুকু উদ্ধৃত করছি: 


ভাইয়া লিখেছেন খুব ভালো, তথ্যবহুল। তবে আমার কিঞ্চিৎ অমত আছে। যেসব আয়াত দ্বারা লেখক কোরআন ব্যক্ষ্যার দায়িত্ব হুজুপুরনুর(সাঃ) এর দাবী করেছেন; সেগুলি মুলত রুপক। আল্লাহ হুজুরপুরনুর(সাঃ)কে মুহাব্বত করেন তাই এই legacy. ৫৯ঃ৭ পড়লে বুঝবেন এই আয়াত গনিমতের মাল বণ্টনের ক্ষেত্রে নাজিল হয়েছিল। মুলত আল্লাহই কোরআন ব্যক্ষ্যাকারী ৭৫ঃ১৯। কোরআন নিজেই নিজের তাফসীর, তাফসিল (বিশদ বিবরন) ৩ঃ১৩৮, ২৫ঃঃ৩৩। আল্লাহর বিধানে শরিক নাই ১৮ঃ২৬। মুলত কোরআনই হাদিস ৩৯ঃ২৩,৪ঃ৮৭,৪৫ঃ৬-৮। কেননা ভাষ্য যার ব্যক্ষ্যাও তার। মতানৈক্যের জন্য ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, বেয়াদবি নিবেন না।”


আলোচ্য লেখাটির আংশিক পড়ে ওপরের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। কেননা লেখাটির প্রথমাংশে লিপিবদ্ধ আছে:


কিছু লোক সম্প্রতি বলছে, "আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের কাছে এটি পাঠিয়েছেন এবং আমাদেরকে শুধুমাত্র এর উপর নির্ভর করতে বলেছেন; এবং তিনি আমাদেরকে অন্য কিছুর জন্য দায়ী করেননি।" এইভাবে তারা জ্ঞাতসারে বা অজান্তে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ ত্যাগ করার চেষ্টা করে এবং তারা সন্দেহ সৃষ্টির অপপ্রয়াস পায় দ্বীনী ক্ষেত্রে সুন্নতের প্রামাণ্য দলিল হওয়ার ব্যাপারটিতে, এর (মানে সুন্নাতের) নির্ভরযোগ্যতা ও বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততার ব্যাপারটিতেও {নোট-১: এই অপচেষ্টা নতুন নয়। এদের ভিত্তি প্রাথমিক যুগ থেকেই আরম্ভ হয়। তবে আমরা ওই অভিব্যক্তি দ্বারা বর্তমান সময়ের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। দেখুন - আবূ যাহও কৃত ‘আল-হাদীস ওয়াল-মুহাদ্দিসূন’, মিসর, ১৩৭৮ হি:/১৯৫৮ খ্রী:, ২১ পৃষ্ঠা; আল-সিবাঈ, ‘আস্ সুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা ফীত্ তাশরিঈল্ ইসলাম,’ কায়রো, ১৯৬৬, ১১-১৪ পৃষ্ঠা; আবদুল গনী অবদুল খালিক্ব, ‘হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, বৈরুত, ১৪০৭ হি:/১৯৮৬ খ্রী:, ২৭৮ পৃষ্ঠা; ‘কিরবাসোগলু, এম. হায়রি, ‘ক্বুরআনা গোরে সুন্নাতেন কোনুমু’ (অপ্রকাশিত প্রবন্ধ), পৃষ্ঠা ১-৩, একই বিষয়ে।} কিছু লোক প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ’র ব্যাপারে অলসতা দেখায় এবং এমন মনোভাব গ্রহণ করে যেনো “সুন্নাহকে অনুসরণ করা বা না করা দুটোই ঠিক আছে।” প্রকৃতপক্ষে, কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সুন্নাহকে একটি অসাধারণ মর্যাদা দিয়েছেন এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর আনুগত্যকে তাঁরই আনুগত্যের মতো গণ্য করেছেন।


কুর’আনে বলা হয়েছে যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের জন্য, বিশেষ করে ঈমানদার/বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর আশীর্বাদ; তাঁর প্রতি বিশ্বাস আল্লাহর আনুগত্যের সাথে জড়িত; তাঁকে মানুষের জন্য মডেল হিসেবে দেখানো হয়েছে; এটি বিবৃত হয়েছে যে তাঁকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, যার মানে কুরআনের সাথে অনেক জায়গায় সুন্নাহও রয়েছে যাতে তিনি সেগুলি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন; এবং ওহী শুধুমাত্র কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; অধিকন্তু, আল্লাহর আনুগত্যের সাথে নবীর আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে এবং নবীর আনুগত্যের কথা আলাদাভাবেও বলা হয়েছে।


তবে এটা নিঃসন্দেহ যে সুন্নাহ কখনই কুরআনের মতো একই স্তরে মানা হয়নি; কুরআন সর্বদা প্রথম স্থানে রয়েছে এবং সুন্নাহ এটি অনুসরণ করেছে।


প্রকৃতপক্ষে, এটি মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:)-কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রদত্ত নির্দেশে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে, যখন তাঁকে ইয়েমেনে গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় {নোট-২: তিরমিযী, ‘আহকাম,’ ৩; মুসনাদ, ৫:২৩০; আবূ দাউদ, ‘আক্বদিয়া’, ১১}। উপরন্তু, সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’মণ্ডলীর অনুশীলিত রীতিও একই রকম ছিলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগী ও বেসাল শরীফ উভয় সময়কালেই। তাঁরা প্রথমে কুরআন এবং তারপরে সুন্নাহর রেফারেন্স দিতেন {নোট-৩: এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে ’হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, ২৮৩-২৯১ পৃষ্ঠা দেখুন}।


চলুন, দেখা যাক আমরা এইমাত্র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা কীভাবে কুরআনের আয়াতগুলো প্রকাশ করে।


নিঃসন্দেহে এটি একটি মহান আশীর্বাদ যে মহান আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে একজন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে মনোনীত করেছেন এবং তাঁকে আমাদের কাছে এক জীবন্ত আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন।


(১) কুরআনের যেসব আয়াতে বলা হয়েছে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু’মিনদের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর মহান আশীর্বাদ:


 لَقَدْ مَنَّ ٱللهُ عَلَى ٱلْمُؤمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُّبِينٍ.


অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে, তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন, আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিলো। [আল-ক্বুর’আন ৩:১৬৪, নূরুল ইরফান]


لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ،  فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ ٱللهُ لاۤ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْعَظِيمِ.


অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসূল, যাঁর নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, (যিনি) তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু। [আল-ক্বুর’আন, ৯:১২৮/১২৯, নূরুল ইরফান] {নোট-৪: একই বিষয়ে আরো আয়াত সম্পর্কে জানতে বাক্বারা-১৫২, তওবা-৬১, আম্বিয়া-১০৭, জুমুআ-২/৪ দেখুন} 


নিঃসন্দেহে মানুষ হিসেবে আমাদের যা করা দরকার তা হলো, এই মহান নেয়ামতের মূল্য জানা, যেমনটি আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে {নোট-৫: আল-আহযাব, ৬ আয়াত} এই মর্মে যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে আমাদের আত্মার চেয়েও মূল্যবান মনে করা, তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসা এবং তাঁর মহান সত্তাকে অনুসরণ করা, যাঁকে আমাদের কাছে মডেল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি বিশ্বাস মুসলমান হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। কালেমা আশ-শাহাদায় আল্লাহর পবিত্র নামের সাথে তাঁর মোবারক নামও বিদ্যমান। এছাড়া, কুরআন মজীদে তাঁর প্রতি ঈমান আনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে {নোট-৬: দেখুন সূরাহ আ’রাফ, ১৫৮; নিসা, ১৩৬; তওবা ৯১; নূর, ৬২; ফাতহ, ৮-৯, ১৩; হুজুরাত, ১৫; তাগাবুন, ৮}। নিঃসন্দেহে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের এমন এক অর্থ আছে যা তাঁর স্রেফ নবী হওয়ারও ঊর্ধ্বে, যা অপরিহার্য করে তোলে সেসব বিষয়কে গ্রহণ করা যেগুলোকে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ, উপদেশ, অনুশীলিত রীতি, সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সংক্ষেপে, সকল ক্ষেত্রে তাঁকে মডেল হিসেবে বিবেচনার বিষয়াদি। 


ধর্মে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর অসাধারণ মর্যাদা প্রদর্শনকারী আরেকটি পয়েন্ট হলো এই যে, তাঁকে স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই সকল ক্ষেত্রে মডেল তথা অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পেশ করেছেন। 


(২) কুরআনের যেসব আয়াত মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে পেশ করেছে মডেল হিসেবে:


আমরা কুরআনে দেখতে পাই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহতায়ালা একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যা ঈমানদার তথা বিশ্বাসীদের দ্বারা স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে গৃহীত হবে। এটা বোঝা যায় যে, তাঁকে সকল দিক থেকে মানুষের জন্য একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে; কারণ এই বিষয়ে আয়াতে কোনো শর্ত রাখা হয়নি।


এর মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিম্নরূপ:


لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ ٱللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُواْ ٱللهَ وَٱلْيَوْمَ ٱلآخِرَ وَذَكَرَ ٱللهَ كَثِيراً.


অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর অনুসরণ উত্তম, তারই জন্য, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব স্মরণ করে। [আল-ক্বুর’আন, ৩৩:২১, নূরুল ইরফান]


যাঁরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করেন তাঁদের জন্য আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে একটি সুন্দর আচরণের নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তাঁকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসের সাথে জড়িত, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান করে তাঁর সুন্নাহকে কতোখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 


কুরআন কেবল এ কথাই বলে না যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের জন্য একটি আদর্শ, বরঞ্চ এর ওপরও জোর দেয় যে তিনি চরিত্রবৈশিষ্ট্যের এক উচ্চ মানদণ্ড:


نۤ وَٱلْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ، مَآ أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍ، وَإِنَّ لَكَ لأَجْراً غَيْرَ مَمْنُونٍ، وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ.


অর্থ: নূ-ন। কলম ও তাদের লিখার শপথ। আপনি আপনার রবের অনুগ্রহে উন্মাদ নন; এবং অবশ্যই আপনার জন্য অশেষ পুরস্কার রয়েছে; এবং নিশ্চয় আপনার চরিত্র তো মহা মর্যাদারই। [আল-ক্বুর’আন, ৬৮:১-৪, নূরুল ইরফান]


ধর্মে সুন্নাতের মূল্য প্রদর্শনকারী আরেকটি উপাদান হলো এটি সাধারণভাবে ওহীরই একটি ফল। প্রকৃতপক্ষে আমরা যখন কুরআনের দিকে তাকাই, তখন আমরা অনেক নিদর্শন দেখতে পাই যে ওহী কেবল কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এবং নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের বাইরেও ওহী পেয়েছিলেন।


(৩) যেসব আয়াত উল্লেখ করে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের বাইরেও ওহী পেয়েছিলেন:


এটি কুরআনে বলা হয়েছে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে নিম্নোক্ত উপায়ে ওহী প্রেরণ করেন:


وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ ٱللهُ إِلاَّ وَحْياً أَوْ مِن وَرَآءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولاً فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَآءُ إِنَّهُ عَلِيٌّ حَكِيمٌ.


অর্থ: কোনো মানুষের পক্ষে শোভা পায় না যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন, কিন্তু ওহী রূপে, অথবা এভাবে যে, ওই মানুষ মহত্ত্বের পর্দার অন্তরালে থাকবে অথবা (আল্লাহ) কোনো ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, সে তাঁর নির্দেশে ওহী করবে যা তিনি চান; নিশ্চয় তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল, প্রজ্ঞাময়। [আল-ক্বুর’আন, ৪২:৫১, নূরুল ইরফান]


অতএব, এটি পরিদৃষ্ট হলো যে আল্লাহ ওপরোক্ত আয়াতে করীমায় বিবৃত করেছেন তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে আপন ইচ্ছানুযায়ী কালাম/কথপোকথন করেন, যা ওই সব পন্থার যে কোনোটি হতে পারে, আর তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে নিজ কালামকে কোনো (ঐশী) কিতাবের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ রাখেন না।


উপরন্তু, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্বুর’আনের বাইরেও যে ওহী পেয়েছিলেন তার ইঙ্গিতবহ একটি দিক হলো কুরআন মজীদের বিবৃতি এমর্মে যে,  নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং অন্যান্য কয়েকজন নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-কে দেওয়া কিতাবগুলোর পাশাপাশি "হিকমাহ (জ্ঞান-প্রজ্ঞা)" দেওয়া হয়েছিল {নোট-৭: দেখুন সূরাহ বাক্বারাহ, ২৫১; আলে ইমরান, ৪৮; নিসা, ৫৪; সা’দ, ২০; যুখরুফ, ৬৩}। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছে:


كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولاً مِّنْكُمْ يَتْلُواْ عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ.


অর্থ: যেমন আমি তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রাসূল তোমাদের মধ্য থেকে, যিনি তোমাদের প্রতি আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ/পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেন। আর তোমাদের ওই শিক্ষা দান করেন, যার জ্ঞান তোমাদের ছিলো না। [আল-ক্বুর’আন, ২:১৫১, নূরুল ইরফান] {নোট-৮: অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন সূরা বাকারা, ১২৯, ২৩১; আলে ইমরান, ১৬৪; নিসা, ১১৩; আহযাব, ৩৪; জুমুআ’, ২} 


এই "হিকমাহ", যা কিতাবের পাশাপাশি নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)’মণ্ডলীকে দেওয়া হবে বলে উপরের আয়াত এবং অনুরূপ আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে সাধারণত আল্লাহর নবী-রসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)’বৃন্দের প্রতি প্রদত্ত "সুন্নাহ" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম শাফেয়ী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে প্রকাশ করেছেন:


فذكر الله الكتاب، وهو القُرَآن، وذكر الحِكْمَة، فسمعتُ مَنْ أرْضى من أهل العلم بالقُرَآن يقول: الحكمة سنة رسول الله. وهذا يشبه ما قال، والله أعلم. لأن القُرَآن ذُكر وأُتْبِعَتْه الحكمة.


"আল্লাহ এখানে প্রথমে কিতাব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, যা কুরআন মজীদ, এবং এরপরে "হিকমাহ" সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। আমি কুরআনের তাফসীর-শাস্ত্রে বিজ্ঞ আলেমবৃন্দের কাছ থেকে শুনেছি যে, এখানে (হিকমাহ দ্বারা) যা বোঝানো হয়েছে তা হলো আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ। কেননা, প্রথমে কুরআনকে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারপরে "হিকমাহ" (শব্দটি) যোগ করা হয়েছে" {নোট-৯: ইমাম শাফেঈ (রহ.), ‘আর-রিসালা’, ১/৭৩}। ইমাম আল-আওজাই (বেসাল: ১৫৭ হিজরী/৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) বর্ণনা করেছেন যে হযরত হাসান বি. আতিয়া (রা.) বলেন,


كَانَ جِبْرِيلُ يَنْزِلُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالسُّنَّةِ، كَمَا يَنْزِلُ عَلَيْهِ بِالْقُرْآنِ.


"জিবরীল (আ.) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে সুন্নাহ নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক যেমনিভাবে তিনি কুরআন নিয়ে এসেছিলেন" {নোট-১০: দারিমী, ‘আস্ সুনান,’ ১/৪৭৪; ‘তাউয়ীলু মুখতালিফিল হাদীস’, ১৬৬ পৃষ্ঠা; কুরতুবী (রহ.), ১:৩৩}।


আমরা কুরআনে এমন তথ্য পাই যে অন্যান্য নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)’বৃন্দকেও তাঁদের কাছে প্রেরিত আসমানী কিতাবের বাইরে ওহী পাঠানো হয়েছিল। সর্ব-পয়গাম্বর ইব্রাহিম (আলাইহিস্ সালাম) ও লুত (আলাইহিস্ সালাম)’এর প্রতি তাঁদের নিজ নিজ জাতিকে ধ্বংস করার দায়িত্বের কথা জানিয়ে ফেরেশতাদের বিবৃতি ওই ধরনের ওহী ছিলো {নোট-১১: দেখুন সূরা আনকাবুত, ৩১-৩২; হিজর, ৫২-৭৭}। পয়গাম্বর জাকারিয়া (আলাইহিস্ সালাম), যাঁকে কোনো আসমানী কিতাব পাঠানো হয়নি, আল্লাহ কর্তৃক তাঁর একজন পুত্র সন্তান জন্মাবার কথা জানানোও অনুরূপ একটি বিষয় ছিলো {নোট-১২: আলে ইমরান, ৩৮-৪০}; ঠিক যেমনটি ছিলো মরিয়ম (রা.)’এর সাথে আল্লাহর কালাম, যদিও তিনি নবী ছিলেন না {নোট-১৩: আলে ইমরান, ৪২-৪৫}। অনেক আয়াতে বিবৃত হয়েছে যে, আল্লাহর সাথে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ওহীর বাইরেও যোগাযোগ ছিল {নোট-১৪: এরকম দুটো দৃষ্টান্তের জন্য দেখুন - সূরা আনফাল, ৯-১০; তাহরিম, ৩; বাক্বারাহ, ১৪২-১৪৪}।


উপরোক্ত আল্লাহর সাথে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ওহীর বাইরেও যোগাযোগ থাকার বিষয়ে বর্ণিত ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর মধ্যে একটি হলো:


حَافِظُواْ عَلَى ٱلصَّلَوَٰتِ وٱلصَّلَٰوةِ ٱلْوُسْطَىٰ وَقُومُواْ للَّهِ قَٰنِتِينَ، فَإنْ خِفْتُمْ فَرِجَالاً أَوْ رُكْبَاناً فَإِذَآ أَمِنتُمْ فَٱذْكُرُواْ ٱللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ.


অর্থ: সজাগ দৃষ্টি রেখো সমস্ত নামাযের প্রতি এবং মধ্যবর্তী নামাযের প্রতি। আর দণ্ডায়মান হও আল্লাহর সম্মুখে আদব সহকারে। অতঃপর যদি আশঙ্কায় থাকো, তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায়, যেমনি সম্ভব হয়। অতঃপর যখন নিরাপদে থাকো, তখন আল্লাহকে স্মরণ করো - যেমন তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যা তোমরা জানতে না। [আল-ক্বুর’আন, ২/১৩৮-১৩৯; নূরুল ইরফান] 


অতএব, প্রতীয়মান হয় যে নামাজ এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী সালাত (অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, বিকালের আসর সালাত) সর্বোত্তম উপায়ে আদায় করার নির্দেশ দেওয়ার পরে আল্লাহ বলেছেন যে নামাজ পদচারণায় বা ঘোড়-সওয়ার অবস্থায় পড়া যায়। ভ্রমণের সময় যদি কেউ বিপদের আশঙ্কা করেন তবে অশ্বারোহণ করা উচিত; তবে বিপদ কেটে যাওয়ার পরে তিনি আপনাকে যেভাবে শিখিয়েছেন সেভাবে সেগুলি অবশ্যই করতে হবে। এখানে "তিনি আপনাকে যেভাবে শিখিয়েছেন" মর্মে বাক্যটি কৌতূহলোদ্দীপক। যেমনটি জানা যায়, কুরআনে নামায বিস্তারিতভাবে শেখানো হয়নি। সেক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত যে, কুরআনের বাইরেও জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম)’এর মাধ্যমে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর কাছ থেকে কিছু তথ্য পেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কিছু বর্ণনা আছে যে জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে এসেছিলেন এবং নিজে নিজে অনুশীলন করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বিস্তারিতভাবে শিখিয়েছিলেন {নোট-১৫: দেখুন - বুখারী, বাদ’উল-খালক্ব, ৬; মুসলিম, মাসাজিদ, ১৬৬; আবূ দাউদ, সালাত, ২; ইবনে মাজাহ, সালাত ১; মুসনাদ, ১/৩৩৩, ১১১, ৩০}। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবীদেরকেও একইভাবে শিক্ষা দিয়ে বলেন - وَصَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي - "তোমরা সেভাবেই নামাজ আদায় করো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখো।" {নোট-১৬: বুখারী, আযান, ১৮ অধ্যায়, বই-১০, হাদীস-২৮}


উপরন্তু, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কুর’আনে প্রায়শই আদেশ করা হয়েছে যে তাঁর প্রতি যা অবতীর্ণ হয় তা অনুসরণ করতে {নোট-১৭: দেখুন - সূরা নিসা, ১০৫; আল-মায়েদা, ৪৮-৪৯, ৬৭; আন’আম, ১০৬; আহযাব, ১-২; জাতিয়্যা, ১৮}। যদি ওহী শুধুমাত্র কুর‘আনেরই সমষ্টি হতো, আর যেহেতু এটা স্পষ্ট যে ইসলাম শুধুমাত্র কুরআন নিয়ে গঠিত নয়, তাই এটা মেনে নিতে হবে যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহীর বাইরে অনেক কিছু করেছেন। সেক্ষেত্রে কিছু অসম্ভব বিষয়, যেমন নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দ্বারা আল্লাহর আদেশ পালন না করাকে মেনে নিতে হবে, যা তাঁর সম্পর্কে চিন্তা করাও অসম্ভব {নোট-১৮: কেননা আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করেছেন, বলেছেন তিনি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, আর তিনি তাঁকে আপন উম্মতের জন্য সাক্ষী করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দেখুন - সূরা আম্বিয়া, ১০৭; আহযাব, ৪৫-৪৬; বাক্বারা, ১৪৩}। এরকম কিছু হলে আল্লাহ হস্তক্ষেপ করতেন।


পরিশেষে, আল্লাহ তায়ালা এই বিষয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে নিম্নোক্ত কথা বলেছেন:


وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰ، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَىٰ. 


অর্থ: এবং তিনি কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। তা তো ওহীই, যা তাঁর প্রতি (নাযিল) করা হয়। [আল-ক্বুর’আন, ৫৩:৩-৪; নূরুল ইরফান] {নোট-১৯: অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন - সূরাহ ইঊনুস, ১৫; আহক্বাফ, ৯; বাক্বারা, ১৪২-১৪৪}


উপরের আয়াতে উল্লিখিত ঐশী অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা কিছু অলেমের মতে শুধুমাত্র কুরআন, কিন্তু অন্যান্য আলেম-উলামার মতে কুর’আন এবং কিছু সুন্নাহ। কেননা, হাদীসসমূহ কখনো ওহী এবং কখনো আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ইজতিহাদ (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত)। তবে তাঁর ইজতিহাদে ভুল থাকলেও আল্লাহ তাঁকে সংশোধন করেন {নোট-২০: এ বিষয়ের উদাহরণ - সূরাহ তওবা, ৪৩, ৮৪; আনফাল, ৬৭; ইসরা, ৭৪; আহযাব, ২, ৩৭; আবাসা, ১-১০; ইঊনুস্, ৯৪; আন’আম, ৩৫, ৫২; তাহরিম, ১; নিসা, ১০৫; মুনাফিক্বূন, ৬; আরো দেখুন - আল্ মাতরাফি কৃত ‘আয়াতুল তাবীলিল্ মুস্তফা’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কায়রো, ১৯৭৭}। এভাবে তাঁর সমস্ত কথা, কাজ এবং অনুশীলন আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন {নোট-২১: দেখুন শাতিবী কৃত ‘আল-মুওয়াফাক্বাত,’ ৪/১৫; মুহাম্মদ হামদী এয়াযীর প্রণীত ‘হাক দীনী কুরআন দিলি,’ ইস্তাম্বুল, ১৯৩৫-১৯৩৯, ৪/৪৫৭১}। তাই তাঁর ধর্মীয় আদেশ ও অনুশীলন যা ওহীর উপর ভিত্তি করে নয়, কিন্তু যেগুলোকে ওহী দ্বারা বাতিল বা সংশোধন করা হয়নি তাকে ওহী হিসেবেই গণ্য করা হয়। অধিকাংশ হানাফী আলেম-উলামা এই ধরনের ওহীকে "ওয়াহী বাতিনী" নামে অভিহিত করেছেন। {নোট-২২: ‘হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, ৩৪০ পৃষ্ঠা}


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ক্বুর’আনের বাইরেও আল্লাহর ওহী পেয়েছিলেন তা প্রতীয়মানকারী একটি প্রমাণ এই যে, তাঁকে কুর’আন প্রচারের পাশাপাশি কুর’আন ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এটা নিশ্চিত, তিনি তা সম্পন্ন করতেন আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা দ্বারা, তাঁর ব্যক্তিগত জ্ঞান ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে নয়।” [প্রিয়নবী (দ.) কুর’আন ব্যাখ্যাকারী মর্মে কোনো আয়াত আছে কি? - শিরোনামের লেখাটির প্রথমাংশ; গুগল ডকস্ লিঙ্ক: https://docs.google.com/document/d/1kMCmG9EcVyZdfozdQVSYBjsNpurHjOeokueMoYX4rkE/edit?usp=sharing ]


আশা করি সমস্ত প্রশ্নের জবাব উপরের অংশে পাওয়া যাবে। মনে রাখা দরকার যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর legacy তথা উত্তরাধিকারসূচক ধারা বলে কিছু নেই। তা কেবল মৃত ব্যক্তির হতে পারে। আমরা তাঁকে হায়াতুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বাস করি যা নিচের লিঙ্কে প্রমাণিত: https://kazisaifuddinhossain.blogspot.com/2019/05/blog-post.html


সবশেষে, আমি একটি হাদীসের রেফারেন্স দিতে চাই যা এ বিষয়ে ফায়সালাকারী:


أَنَّ رَسُولَ الله ﷺ لَمّا بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ قَالَ لَهُ: كَيْفَ تَقْضِي إِنْ عَرَضَ لَكَ قََضَاءٌ؟ قَالَ: أَقْضِي بِكِتَابِ اللهِ، قَال: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي كِتَابِ اللهِ؟ قَالَ:أَقْضِي بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ ﷺ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ؟ قَالَ: أَجْتَهِدُ رَأْيِي لاَ آلُو، قَال: فَضَرَبَ بِيَدِهِ فِي صَدْرِي، وَقَالَ: الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُلَ رَسُولِ اللهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللهِ ﷺ.


অর্থ: ইয়েমেনে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করার পর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে তিনি বিচার কাজ পরিচালনা করবেন। হযরত মু’আয (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উত্তর দেন, “আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী (أَقْضِي بِكِتَابِ اللهِ)।” রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরপর জিজ্ঞেস করেন, “যদি তুমি আল্লাহর কিতাবে (সমাধান) না পাও (فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي كِتَابِ اللهِ؟)?” ওই সাহাবী (রা.) উত্তর দেন, “তাহলে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বাস্তবায়ন করবো (أَقْضِي بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ ﷺ)।” প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার জিজ্ঞেস করেন, “যদি তাতেও (মানে সুন্নাহ’তেও) না পাও ( فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ؟)?” তখন ওই সাহাবী (রা.) উত্তর দেন, “আমি নিজ ইজতিহাদ প্রয়োগ করে রায় দেবো (أَجْتَهِدُ رَأْيِي لاَ آلُو)।” অতঃপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পবিত্র হাতখানি হযরত মু’আয (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বুকের উপর স্থাপন করে বলেন, “আল-হামদু লিল্লাহ, আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলের রাসূলকে (মানে সহকারী প্রতিনিধিকে) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সন্তুষ্টির সাথে একাত্ম করে দিয়েছেন (الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُلَ رَسُولِ اللهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللهِ ﷺ)।” [ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ (রহ.): আল-মুসান্নাফ, ফীল কাযী আঁই ইয়ানবাগী ৪/৫৪৩, হাদীস-২২৯৮৮; ইমাম আহমদ (রহ.): মুসনাদ, হাদীসু মু’য়ায বিন জাবাল (রা.), ৫/২৩০, হাদীস - ২২০৬০; ইমাম দারিমী (রহ.), আস্ সুনান, ১/২৬৭, হাদীস - ১৭০; ইমাম মুসলিম (রহ.): সহীহ, বাবুত্ তাহরীজ আলাল ক্বতলিল্ খাওয়ারিজ, ২/৭৪৬, হাদীস - ১০৬৬; ইমাম আবূ দাউদ (রহ.): আস্ সুনান, বাবু ইজতিহাদির্ রায়ি, ৩/৩০৩, হাদীস - ৩৫৯২; তিরমিযী: আস্ সুনান, বাবু মা জা’য়া ফীল্ ক্বাদ্বী, ৩/৯, হাদীস - ১৩২৭; ত্ববরানী: আল্ মু’জামুল কবীর, ২০/১৭০, হাদীস - ১৭১১৯; ইমাম বাগাবী: শরহুস্ সুন্নাহ, বাবু ইজতিহাদিল হাকিম, ১০/১১৬; এবং মুশকিলুল  আছার: আশ্ শরাহ, ২/২১২, হাদীস - ৩৫৮২] 


এখানে লক্ষণীয় যে তিনটি আলাদা আলাদা প্রশ্ন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী উত্তর এসেছে। (১) আল্লাহর কিতাব, (২) সুন্নাহ  এবং (৩) সর্বশেষে পুণ্যাত্মাবৃন্দের রায়/সিদ্ধান্ত। হযরতে মুয়ায ইবনে জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীসটিতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “যদি কুর’আনে না পাও?” মানে কুর’আনে সব বিষয় খোলাসা করে বলা হয়নি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, “যদি সুন্নাহ’তে (মানে হাদীসে)-ও না পাও?” অর্থাৎ, তাতেও সব বিষয় খোলাসা নেই। তখন ওই সাহাবী (রা.) বলেন, “আমি আমার রায় (ইজতিহাদ) প্রয়োগ করবো।” এ দেশের আহলে হাদীস গোষ্ঠী উপরের হাদীসটিকে যয়ীফ/দুর্বল বল্লেও পূর্ববর্তী যুগের ইমামবৃন্দ এটাকে সমর্থন করেছেন। দ্বীনী জ্ঞান বিশারদবৃন্দ হাদীসটি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল। অনেক আরবী ওয়েবসাইটে এটা বিদ্যমান যা তুর্কী “ওহাবীদের প্রতি নসীহত” গ্রন্থে নক্বল করা হয়েছে। বস্তুতঃ আহলে হাদীস ও আহলে কুর’আন দুটো গোষ্ঠী-ই ধর্মে ফিতনা সৃষ্টিকারী এবং বেয়াদব! আল্লাহ সবাইকে এদের ফিতনা থেকে রক্ষা করুন, আমীন।  


*সমাপ্ত*        



  


  

Saturday, 21 September 2024

হাদীসের আলোকে ফকির-দরবেশের প্রতি বেয়াদবি নিষেধ

 

-এডমিন

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিরোনামের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আউলিয়া (রহ.)’মণ্ডলীর মাযার-দরগাহে হামলার পাশাপাশি ফকির-দরবেশের প্রতি হামলাও হচ্ছে। এ হীন অপকর্ম করছে নজদী-ওহাবীদের অনুসারীচক্র। হযরত শাহ পরাণ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযারে হামলার ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। ফকিরি পথ ও মতের অনুসারীদের মধ্যে কে যে ওলী, তা তো বলতে পারবে না এসব নালায়েক্ব বেয়াদব! পরে এমন বদ দোয়া পড়বে যে গোটা জাতিকেই না গুনতে হয় এর মাশুল! কেননা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন:

হাদীস শরীফ

"‏رب أشعث أغبر مدفوع بالأبواب لو أقسم على الله لأبره ‏"‏ ‏(‏‏(‏رواه مسلم‏)‏‏)‏‏.

অর্থ
(হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন), ’’বহু এমন লোকও আছে যার মাথা উষ্কখুষ্ক ধুলোভরা, যাদেরকে দরজা থেকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। (কিন্তু সে আল্লাহর নিকট এতো প্রিয় যে) সে যদি আল্লাহর নামে কসম খায়, তাহলে আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন।’’ [মুসলিম শরীফ, ২৬২২, ২৮৫৪; রিয়াদুস্ সালেহীন, আন্তর্জাতিক নম্বর ২৫৭]

সারমর্ম
এ হাদীসটি আউলিয়া (রহ.)-বৃন্দের হালত-অবস্থা প্রকাশের পাশাপাশি একটি সতর্কীকরণ বার্তাও। কেননা তাঁদেরকে চেনা যায় না। দরজা থেকে বিতাড়িত তথা সমাজ হতে দূরে হতে পারেন এ সকল দরবেশ। কিন্তু তাঁদের অন্তরে আঘাত করে কিছু করা হলে হয়তো তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়ে বদ দোয়াও করতে পারেন। তাঁরা যা আল্লাহর নামে কসম করবেন, তা-ই তিনি মঞ্জুর করবেন। অতএব, সাবধান! সমাজের সব মানুষের দায়িত্ব ওই সব নালায়েক্ব বেয়াদবদের লাগাম টেনে ধরা! নতুবা বেয়াদবির দরুন মহাবিপদ ডেকে আনা হবে। এ হাদীসের অন্তর্নিহিত বাণী উপলব্ধি করাই হবে সবার জন্যে মঙ্গল। যারা ধর্মের শরঈ দলিল খোঁজে বেশি, হাদীসের এ দলিলটি তাদের বেশি করে পড়া এবং আত্মস্থ করা জরুরি।
আল্লাহতায়ালা সবাইকে বোঝার সামর্থ্য দিন, আমীন।

*****************************************************************************************************