Thursday, 22 August 2013

সৈয়দ আহমদ বেরেলভী সম্পর্কে যুগ-জিজ্ঞাসা





--- কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

(২০০১ সালে মাসিক তরজুমানে প্রকাশিত আমার বক্তব্যের সার-সংক্ষেপ)


 উপমহাদেশে ওহাবীদের শীর্ষস্থানীয় নেতা সৈয়দ আহমদ বেরেলভী। তিনি বিশাল এক ‘মুজাহিদীন’ বাহিনী গঠন করেছিলেন এবং পান্ঞ্জাবে তার বাহিনীসহ গিয়েছিলেন ‘জেহাদের’ উদ্দেশ্যে। তার এ সব কর্মকাণ্ডকে বৃটিশের বিরুদ্ধে জেহাদ আন্দোলন বলে তার ভক্তরা দাবি করে থাকেন। আমরা যারা ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী, তারা ভক্তদের লেখনী দ্বারা ইতিহাসকে মূল্যায়ন করি না। আমরা বাস্তবতার নিরিখে বিচার করতে আগ্রহী। আর বাস্তবতা হলো, সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও তার বাহিনী বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তো দূরে থাক, একটি গুলিও ছোঁড়েন নি; বরন্ঞ্চ তিনি পান্ঞ্জাবের শিখ ও পাঠানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বৃটিশের বিভক্ত করে শাসন করার কূটচালে তিনি ক্রীড়নক হয়ে শিখ ও পাঠানদের সাথে সংঘাতের পথ বেছে নেন যার পরিণতিতে তার প্রাণ সংহার হয়। অথচ, তার উচিৎ ছিল উপমহাদেশীয় সকল শক্তিকে কূটনীতি দ্বারা ঐক্যবদ্ধ করে বৃটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা। এতে আজাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতেন। তা না করে পাঠান ও শিখদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তিনি সবার শক্তি খর্ব করেন এবং এভাবে বৃটিশের হাতকে শক্তিশালী করেন। এতো বড় একটা মোজাহিদ বাহিনী নিয়েও সৈয়দ আহমদ বেরেলভী বৃটিশের বিরুদ্ধে কোনো গুলি ছোঁড়েন নি। ব্যাপারটা রহস্যজনক। তার ভক্তরা অনেক গুণকীর্তন করতে পারেন, স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করতে পারেন; কিন্তু ইতিহাসের এ বাস্তবতার খণ্ডনে তাদের কী বলার আছে? ইতিহাসে মওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী, মওলানা ফজলুর রাসূল বদায়ুনী, মওলানা রহমতুল্লাহ কায়রানভী প্রমুখের ভূমিকা সুস্পষ্ট। বৃটিশের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান দিবালোকের মতোই উজ্জ্বল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর ভূমিকা রহস্যময়। যে ব্যক্তি বৃটিশের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ তো দূরে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও একটি গুলিও ছোঁড়েন নি, তাকে যা-ই বলা হোক না কেন অন্ততঃ বৃটিশ-বিরোধী যোদ্ধা বলা যায় না। উপরন্তু, তিনি বৃটিশের বিভক্ত করে শাসন করার পক্ষে কাজ করেছেন শিখ ও পাঠানদের সাথে যুদ্ধ করে। এটাই ইতিহাসের বাস্তবতা।

সৈয়দ বৈরেলভীর অধীনস্থ মোজাহেদ বাহিনী ওহাবী ধ্যান-ধারণা লালন করতো। ইসমাইল দেহেলভী ছিল তার সেনাপতি। এই ইসমাইল দেহেলভী নিজের রচিত ‘তাকভিয়াতুল ঈমান‘ পুস্তকে আম্বিয়া ও আউলিয়ার প্রতি মানহানিকর বক্তব্য লিখেছে। সৈয়দ বেরেলভীর তা না জানার কথা নয়। এ নিয়ে ইসমাইল দেহেলভীর সাথে মওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী ও মওলানা রহমতুল্লাহ কায়রানভীর বাহাসও অনুষ্ঠিত হয়েছিল দিল্লীর জামে মসজিদে। ইসমাইল দেহেলভী পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছিল। কিন্তু সে নিজের ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ বইটির পক্ষে কোনো জোরালো যুক্তি দাঁড় করাতে পারে নি। সৈয়দ বেরেলভীর এ সব ঘটনা না জানার কথা নয়। এতদসত্ত্বেও ইসমাইল দেহেলভীর মতো বদ আকিদাধারী লোককে তিনি তার দল থেকে বের করে দেন নি। বরন্ঞ্চ তিনি তাকে মূল কমান্ডে রেখেছিলেন। এতে প্রমাণ হয় যে ইসমাইল দেহেলভীর বদ আকিদাকে তিনি সমর্থন করতেন। অর্থাৎ, তিনি ওহাবী মতবাদকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বালাকোটের প্রান্তরে সৈয়দ বেরেলভী ও ইসমাইল দেহেলভী এক সাথে নিহত হন। বস্তুতঃ সৈয়দ বেরেলভী এ সময় ইসমাইল দেহেলভীর মতো একজন কট্টর নবী-ওলীর দুষমনের পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে মারা যান। এতে তিনি কী অবস্থায় মারা গিয়েছেন তা বিশুদ্ধ আকিদার বিচারে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। আমি আবারো বলছি, এ সব সিদ্ধান্ত ইতিহাসের আলোকে নেয়া। ঘটনাপ্রবাহ যা বলছে তা-ই তুলে ধরা হয়েছে। কোনো রকম আবেগ ইতিহাসের ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ করতে পারে না।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বালাকোটের প্রান্তরে সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর মৃত্যু একটি তাৎপর্যহীন ঘটনা। আজাদী আন্দোলনে এর কোনো ইম্প্যাক্ট বা প্রভাব নেই। কেননা নবাব সিরাজুদ্দৌলা বা টিপু সুলতানের মতো রাজন্যবর্গ উপমহাদেশীয় শক্তিগুলোকে বৃটিশের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা সফল হন নি সত্য, কিন্তু তাঁদের এ চেষ্টার জন্যে ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ইতিহাসে তাঁদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, সৈয়দ বেরেলভী উপমহাদেশীয় শক্তিগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও বিভাজন সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে বৃটিশ শাসনকেই পাকাপোক্ত করেন। তিনি এবং তার সেনাপতি ইসমাইল দেহেলভী যে ওহাবী ছিলেন, তা সউদী আরব সরকার কর্তৃক ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘মুহম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব’ শীর্ষক বইতে তথ্য রয়েছে। ওই বইয়ের ৭৮ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে যে সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও ইসমাইল দেহেলভীকে আরবের নজদী ওহাবীরা ১৮২০ সালে ভারত উপমহাদেশে ওহাবী মতবাদ প্রচারের জন্যে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। এ সময় সৈয়দ বেরেলভী ও ইসমাইল দেহেলভী হজ্ব উপলক্ষে আরবে গিয়েছিলেন। ‘শায়খ মুহম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব’ শীর্ষক এ বইটি সউদী বাদশাহ ফয়সালের নির্দেশে ছাপানো হয় (আমি এর আরবী কপি দেখেছি যা’তে বলা হয়েছে পাটনার সৈয়দ আহমদ)। যদি কোনো এজেন্সীদাতা স্বীকার করেন যে কাউকে তিনি এজেন্সী দিয়েছেন, তাহলে তার এই সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য ও অকাট্য। আলোচ্য পুস্তকটির সাক্ষ্য সৈয়দ বেরেলভী ও ইসমাইল দেহেলভীর প্রকৃত মিশন সম্পর্কে আমাদেরকে স্পষ্ট ধারণা দেয়। তারা ওহাবী মতবাদ প্রচার করতে নেমেছিলেনমাত্র। ধর্মীয় অঙ্গণে বিভ্রান্তি ছড়ানোই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য। ইসমাইল দেহেলভী প্রণীত ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ আমি পড়েছি। এতে সে বিশ্বনবী (দ:)-এর শাফায়াতকে অস্বীকার করেছে, আম্বিয়া-আউলিয়াকে ‘চামারের চেয়েও নিকৃষ্ট’ বলেছে, মহানবী (দ:)-কে ‘বড় ভাই’ ও ’গ্রামের জমিদারের’ মতো বলেছে, যা ঈমান-বিধ্বংসীমূলক। তার এ বইটির বাংলা ও উর্দূ কপি আমার কাছে আছে।

ওহাবীপন্থী ইসমাইল দেহেলভী সম্পর্কে আমরা আরও তথ্য পাই পাকিস্তানের অধ্যাপক ড: মাসউদ আহমদের প্রণীত ‘গুনাহে বে-গুনাহী’ বইতে। তাতে তিনি ইতিহাসবিদ মীর্জা হায়রাত দেহেলভীর বরাত দিয়ে লিখেছেন যে ইসমাইল দেহেলভী বলেছে, “বৃটিশ শাসনের অধীনে আমরা সকল প্রকার স্বাধীনতা ভোগ করছি। যদি কোনো বহিঃশত্রু তাঁদেরকে আক্রমণ করে, তবে সেই শত্রুর সাথে লড়াই করা এবং নিজ সরকারের প্রতিরক্ষা করা মুসলমানদের প্রতি অবশ্য কর্তব্য হবে” (মীর্জা হায়রাত দেহেলভী রচিত ‘হায়াতে তাইয়েবা’, ২৯৬ পৃষ্ঠা)। ‘ওয়াজিব’ জেনেই বোধ করি পান্ঞ্জাবের পাঠান ও শিখদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও ইসমাইল দেহেলভী। অতএব, এক্ষণে হিসেব মিলে গিয়েছে। বৃটিশের দালালি করাই ছিল তাদের মূল মিশন। এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য। এই ‍দু’জন যে ওহাবী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিচারপতি আব্দুল মওদুদের ‘ওহাবী আন্দোলন’ শীর্ষক ইতিহাস পুস্তকেও। মজার ব্যাপার হলো, এর লেখক সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বইয়ের নাম রেখেছেন ‘ওহাবী আন্দোলন’ এবং ’জ্বেহাদ আন্দোলন’ নয়। ইতিহাসকে অস্বীকার বা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। ‘ওহাবী আন্দোলন’ বইটিতে লেখা আছে, সৈয়দ বেরেলভী বিশ্বাস করতেন তিনি স্বভাব-চরিত্র ও সকল দিক দিয়ে মহানবী (দ:)-এর মতো। এ ধরনের আকিদা-বিশ্বাস কি সিদ্ধ? একটি হাদীসে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “তোমাদের মধ্যে কে আছো আমার মতো?” অর্থাৎ, কেউ নেই। এমতাবস্থায় নিজেকে তাঁর সমকক্ষ মনে করা শুধু হাস্যকরই নয়, বরং মৌলিক আকিদা-বিশ্বাসের পরিপন্থীও। আবদুল মওদুদ সাহেবের এ রেফারেন্স বহু আগের একটি সংস্করণের যা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কিন্তু বইটি আমার হাতে না থাকাতে পৃষ্ঠা নম্বর ও প্রকাশকাল উল্লেখ করতে পারলাম না। সত্যান্বেষীদের জন্যে এতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। বড় বড় পাঠাগারে এ বইয়ের প্রথম দিককার সংস্করণ সংরক্ষিত থাকার কথা। তাতে খুঁজলেই উদ্ধৃতিটি পাওয়া যাবে। এটা যেহেতু ইতিহাসের বিষয় এবং প্রামাণ্য দলিল হিসেবে প্রদর্শনের বিষয় নয়, সেহেতু সঠিক ইতিহাস জানার উদ্দেশ্যে গবেষকবৃন্দ এ ব্যাপারে গবেষণা করার সামর্থ্য রাখেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমার কাজ হলো তাঁদেরকে দিক-নির্দেশনা দেয়ামাত্র।

ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এতদসংক্রান্ত আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। সৈয়দ বেরেলভীকে তার ভক্তরা বৃটিশ-বিরোধী যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বৃটিশের শাসনের প্রতি হুমকি হতে হলে সৈয়দ আহমদ বেরেলভীকে দিল্লী আক্রমণ করা উচিত ছিল, যেটা বৃটিশের রাজধানী ছিল। ইতিপূর্বে সুলতানী আমলেও দিল্লী রাজধানী ছিল, আর এখনো তা ভারতের রাজধানী। রাজধানী আক্রমণ না করে কোথায় পান্ঞ্জাবের অজপাড়া গাঁ বালাকোটে পাঠান ও শিখদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াকে কীভাবে বৃটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বলা যায়? এর থেকে বড় ধোকাবাজিপূর্ণ ইতিহাস রচনা আর কী হতে পারে? এ তো রীতিমতো ইতিহাস জালিয়াতি! সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর ভক্তরা দাবি করেন যে বৃটিশরা তার ‘আন্দোলন’-কে জনমনে হেয় করার জন্যে নাকি ‘ওহাবী’ আখ্যা দিয়েছিল। এতে নাকি কিছু আলেম-মওলানা বৃটিশের পক্ষে ‘দালালি’ করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছিলেন এবং তাকে ওহাবী হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। এখানেও ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। কেননা, সৈয়দ বেরেলভীর তথাকথিত ‘জেহাদ’ আন্দোলনের বিরোধিতা যে সব সুন্নী আলেম করেছিলেন, তাঁরাই পরবর্তীকালে ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এ আন্দোলনের বিস্তার হয়েছিল সারা উপমহাদেশব্যাপী। লক্ষণীয় যে, সৈয়দ বেরেলভীর ভাবশিষ্যরা ওই সময় বৃটিশের দালালিতে লিপ্ত ছিল, যা আমরা মওলানা ফজলে হক খায়রাবাদীর লিখিত একটি বইয়ে জানতে পারি। বইয়ের লেখককে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হলেও বৃটিশরা সৈয়দ বেরেলভীর ভাবশিষ্যদের জন্যে বড় বড় এনাম বরাদ্দ করে।

No comments:

Post a Comment