Saturday, 21 February 2015

তাবিজ ও ঝাড়ফুঁক

আলহাজ্ব মূফতী এস এম সাকীউল কাউছার 
[সাজ্জাদানশীন, ঘিলাতলা দরবার শরীফ, কুমিল্লা]

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মানব দেহে রোগ-বিমার দিয়ে মু’মিনদের পরীক্ষা করেন। আবার রোগের প্রতিষেধকও তিনি দান করেন। আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন -

و اذا مرضت فهو يشفين -

(ইব্রাহিম আ: বলেন), “আমি যখন রোগে আক্রান্ত হই তখন তিনি-ই (আল্লাহ) আমাকে রোগমুক্ত
করেন।” (সূরা শুআরা: আয়াত ৮০)


বুখারী শরীফে বর্ণিত একখানা হাদীসে রাসূলে পাক (দ:) এরশাদ করেন -


“আল্লাহ এমন কোনো রোগ প্রেরণ করেন না যার আরোগ্য নেই।


আল্লাহ্ পাক আরও বলেন -


 
وننزل من القوأن ما هو شفاء ورحمة للمؤمنين-

“আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।“ (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮২)


আল্লাহ্ তা’আলা আরও এরশাদ করেন -


ويشف صدور قوم مؤمنين-


“তিনি মুমিনদের অন্তরের রোগ নিরাময়কারী” (সূরা তওবা: আয়াত ১৪)।


মানব দেহের রোগ-বিমারের বিভিন্ন দিক থাকতে পারে। যেমন শারীরিক রোগ, মানুষ ও জ্বিনের কুদৃষ্টি, তাবিজ-টোনা ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো এবং এর প্রতিকারে ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ-দোয়া ব্যবহার কতটুকু ইসলাম বা কোরআন-হাদীছসম্মত তা নিয়ে কিছু আলোচনা করছি। এ বিষয়ে অনেকে জানতে চেয়েছেন।


আমাদের প্রথমেই জেনে রাখতে হবে আল্লাহ’র দয়া-রহমত ছাড়া কোনো সাফল্য বা মুক্তি নেই। তাবিজ ও ঝাড়ফুঁকে কাজ হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। এগুলো এক ধরণের দোয়া, আল্লাহ্ পাক ইচ্ছা করলে কবুল করতে পারেন আবার না-ও করতে পারেন। সেজন্য যেমন দোয়া চাওয়া বন্ধ করা যায় না, তেমনি কোরআন-হাদীছকে অবিশ্বাসও করা যাবে না।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব তাবিজ ও ঝাড়ফুঁক-ই বুজুর্গদের ইজতেহাদ, অভিজ্ঞতা ও কাশফের মাধ্যমে উদ্ভূত। কোরান-হাদীছে স্পষ্ট বলা হয়নি যে অমুক তাবিজ বা অমুক ঝাড়ফুঁক দ্বারা অমুক কাজ হবে। তাই কোনো তাবিজে কাঙ্ক্ষিত ফল না হলে কোরআন-হাদীছের সত্যতা নিয়ে কিছু বলার বা ভাবার অবকাশ নেই। যেমন জ্বর বেশি হলে এই আয়াত পড়ে ফুঁ দিলে কাজ হয় - يا نار كونى بردا و سلاما على ابراهيم “ইয়া নারু কুনি বারদাও ওয়া সালামান আলা ইব্রাহিম” যার অর্থ - হে আগুন ইব্রাহিমের (আ:) জন্য শান্তিদায়ক ঠান্ডা হয়ে যাও। কোনো কোনো বুজুর্গ এ আয়াত দ্বারা বালিতে ফুঁ দিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ছিটিয়ে দিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগলে নিভিয়ে দিয়েছেন (সুবহানাল্লাহ)। এখন যদি এ আমল দ্বারা আগুন না নিভে তাহলে কোরআনের ক্ষমতা নেইেএ কথা বলা যাবে না।

তাবিজ ও ঝাড়ফুঁক কোরআন-হাদীছের বাক্যাবলী ও আল্লাহ্‌র আসমায়ে হুসনা দ্বারা বৈধ উদ্দেশ্যে করা হলে তা জায়েয। পক্ষান্তরে কুফরী-শিরকের কথা দ্বারা বা এরূপ কোনো যাদু হলে তা দ্বারা তাবিজ-ঝাড়ফুঁক হারাম। এমনিভাবে কোনো অবৈধ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাবিজ-ঝাড়ফুঁক করা হলে তা জায়েয নয়, যদিও কোরআন হাদীছের বাক্য দ্বারা হয়।

মুসলীম শরীফের হাদীছে রয়েছে -

عن عوف بن مالك الاشجعى قال كنا نرقى فى الجاهلية فقلنا يا رسول الله كيف ترى فى ذالك ؟ فقال اعرضوا على رقاكم لا بآس بارقى ما لم يكن فيه شرك-
(رواه مسلم فى كتاب الاسلام-باب استحباب الرقية -------- والنظرة )

অর্থাৎ, হযরত আউফ ইবনে মালিক আশজায়ী বলেন, আমরা জাহেলী যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। তাই জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? তিনি বলেন, তোমরা কী দিয়ে ঝাড়ফুঁক করো তা আমার কাছে পেশ করো। যাতে শিরক নেই এমন কিছু দিয়ে ঝাড়ফুঁক করাতে দোষ নেই। (মুসলীম শরীফ, কিতাবুস সালাম)

তাবীজ বা ঝাড়ফুঁক দ্বারা ভালো হলে সেটাকে তাবীজ দাতার বা আমলের বুজুর্গি মনে করা যাবে না। যা কিছু হয় আল্লাহ্’র ইচ্ছা বা দয়ায় হয়, এটা বিশ্বাস রাখতে হবে।

তাবীজ ও ঝাড়ফুঁক কোরআন হাদীছের বাক্যাবলী দ্বারা বৈধ উদ্দেশ্যে করা হলে তা জায়েয।
এ সম্পর্কে কয়েকটি দলীল নিম্নে পেশ করা হলো:

عن عمرو بن شعيب عن ابيه عن جده قال قال رسول الله صلى الله وسلم1 (১)
اذا فرغ احدكم فى نومه فليقل بسم الله اعوذ بكلمات الله التامات من غضبه وسوء عقابه و من شر عباده و من شر الشياطين -----------------عليه (اخرجه ابن ابى شيبه فى مصنف حديث رقم 24013 )

এ হাদীছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা:) কর্তৃক তাঁর বাচ্চাদের জন্য তাবীজ লিখে দেয়ার কথা উল্লখ আছে। ( মুসান্নেফে আবি শায়ব হাদীছ নং- ২৪০১৩)।

(২) عن عمرو بن شعيب عن ابيه عن جده قال قال رسول الله صلى الله وسلم كان يعلمهم من الفزع كلمات اعوذ بكلمات الله------------------- فعلقه عليه- (اخرجه ابو داؤد فى الطب)

এ হাদীছেও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা:) কর্তৃক তাঁর বাচ্চাদের জন্য তাবীজ লিখে দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। ( আবু দাউদ)
(৩)
عن ثوير قال كان مجاهد يكتب للناس التعويذ فيعلقه (اخرخه ابن ابى شيبة حديث رقم 24011)
و اخرج عن ابى جعفر و محمد بن شرين و عبيد الله بن عبد الله بن عمر و الضحاك ما يدل على انهم كانوا يبيحون كتابه التعويذ و تعليقه او ربطه بالعضد و نحوه- انظر حديث رقم -24012-24013-24015-24018)

এ রেওয়ায়েতে হজরত মুজাহিদ (রহঃ) কর্তৃক মানুষকে তাবীজ লিখে দেয়ার কথা বর্ণিত আছে এবং আবু জাফর, মুহাম্মদ ইবনে শিরিন (রহ:) আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:)-এর পুত্র উবায়দুল্লাহ ও জাহহাক প্রমুখের দ্বারা অন্যদেরকে তাবীজ লিখে দেয়ার কথা, সূতা বাঁধা, তাবীজ হাতে বা গলায় বাঁধা ও তাবীজ লেখা বৈধ হওয়া মর্মে তাঁদের মন্তব্য বর্ণিত হয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা হাদীছ নং- ২৪০১১, ২৪০১২, ২৪০১৪, ২৪০১৫, ২৪০১৮)

তাবীজ নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার ফতোয়া:

(৪) قال عبد الله بن احمد قرأ ت على ابى ثنا يعلى بن عبيد ثنا سفيان عن محمد -------- عن ابن عباس قال اذا عسر على المرأة ولادتها فليكتب بسم الله لا اله الا الله الحليم الكريم سبحان الله رب العرش العظيم الحمد لله رب العالمين كانهم يوم يرونها لم يلبثوا الا عشية او ضحاها كانهم يوم يرون ما يوعدون لم يلبثوا الا ساعة من نهار بلاغ فهل بهلك الا القوم الفسقون-

এ রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) কর্তৃক বাচ্চা প্রসবের সময় প্রসূতির প্রসব বেদনা লাঘব করা ও সহজে প্রসব হওয়ার জন্য বিশেষ তাবীজ শিক্ষা দেয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ রেওয়ায়েতটি সালাফী ও গায়রে মুকাল্লিদগণের সর্বজনমান্য ব্যক্তি ইবনে তাইমিয়া তার ফতোয়ায় উল্লেখ করেছেন। বিঃদ্রঃ ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া - ১৯ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩।

বর্তমান যুগের গায়রে মুকাল্লেদ ও সালাফীগণ তাবীজ-কবজকে নিষিদ্ধ, এমনকি
শিরিক বলে আখ্যায়িত করে। এ প্রসঙ্গে বিরোধীদের মতামত খণ্ডন করে শেষভাগে জবাব দিবো, ইনশা’আল্লাহ! 

নযর ও বাতাস লাগা


নযর ও বাতাস লাগা ইসলাম সম্মত কি-না, তা আমাদের জানা থাকা দরকার। অর্থাৎ, সু-নযর বা কু-নযর ও জ্বীনের বাতাস বা আছর সঠিক কি-না?


হাদীছ শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী নযর লাগার বিষয়টি সত্য। জান-মাল ইত্যাদির প্রতি বদ-নযর লেগে তার ক্ষতি সাধিত হতে পারে। আপনজনের প্রতিও আপনজনের বদ-নযর লাগতে পারে, এমনকি সন্তানের প্রতিও মাতা-পিতার বদ-নযর লাগতে পারে।

 
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন -


العين حق- ( رواه مسلم فى كتاب السلام-باب الطب و المرض و الرقى)


অর্থাৎ, নযর লাগা সত্য। (মুসলীম শরীফ, কিতাবুস সালাম)


আর বাতাস লাগার অর্থ যদি হয় জ্বিনের বাতাস বা তাদের খারাপ নযর বা খারাপ আছর লাগা, তাহলে এটাও সত্য; কেননা জ্বিন মানুষের ওপর আছর করতে সক্ষম। কোরআনে আল্লাহ্ পাক বলেন, আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি (সূরা বাক্বারা)। জ্বিনের মধ্যে মানুষের মতই মু’মেন ও বে-দ্বীন এবং দুষ্ট জ্বিনও রয়েছে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একই সাথে ৪০০ জ্বিন ঈমান এনেছিলো। এখনো মক্কা শরীফে মসজিদে জ্বিন রয়েছে। যা হজ্বে গিয়ে আমি নিজেও দেখে এসেছি। এছাড়াও কোরআন শরীফে একটি সূরার নাম রয়েছে ‘সূরায়ে জ্বিন’। সুতরাং আধুনিকতার দোহাই তুলে জ্বিন জাতির অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনো অবকাশ মুসলমানের নেই। এটাও জেনে রাখা দরকার জ্বীন কোনো কোনো জীবের আঁকারও ধারণ করতে পারে এবং মানুষের ওপর ভর করতে পারে।


কেউ কারও কোনো ভালো কিছু দেখলে যদি ‘মাশা’আল্লাহ’ বলে, তাহলে তার প্রতি তার বদ-নযর লাগে না। আর কারও ওপর কারও বদ-নযর লেগে গেলে যার নযর লাগার সন্দেহ হয় তার মুখ, হাত-কনুইসহ, হাঁটু ধুয়ে সে পানি যার ওপর নযর লেগেছে তার ওপর ঢেলে দিলে খোদা চাহেন তো ভালো হয়ে যাবে।


হাদীছ শরীফে এরশাদ হয়েছে -


عن ابن عباس رضى الله عنه عن النبىِ صلى الله عليه وسلم قال : العين حق ولو كان شىءُ سابق القد ر سبقته العين و اذا استغسلتم فاغسلوا- (رواه مسلم فى كتاب السلام- باب الطب--/ رواه الترمذى فى ابواب الطب- ما جاء ان العين حق والغسل لها وقال: هذا حديث حسن صحيح- واللفظ لمسلم)


অর্থাৎ, ইবনে আব্বাস (রা:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, নযর লাগা সত্য। যদি কোনো কিছু ভাগ্য অতিক্রম করতে পারত, তাহলে নযর তাকে অতিক্রম করত। যখন তোমাদের কাউকে ধুয়ে দিতে বলা হয়, সে যেন ধুয়ে দেয়। (মুসলীম শরীফ- কিতাবুস সালাম/ তিরমিজী শরীফ-আবওয়াবাবে তিব্বী- বাবে মা জা’আ ইন্নাল আইনা হাক্কু ওয়া গোসলু লাহা ওয়া কালা হাজা হাদীছুন সহহীহুন)।


কোরআন শরীফের আয়াত, আল্লাহ’র নাম ও দোয়ায়ে মাছুরা (যে সব দোয়া হাদীছে উল্লেখ আছে) দ্বারা ঝাড়ফুঁক সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয। অনেক হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ছাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ঝাড়ফুঁক করতেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এসব ঝাড়ফুঁক ছিল কোরআন ও আসমায়ে হুসনা দ্বারা। এ কারণে এরূপ ঝাড়ফুঁক সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয।

وهى جائزه بالقران والاسماء الالهية وما فى معناها بالاتفاق- (اللمعات)

অর্থাৎ, কোরআন, আল্লাহ’র আসমায়ে হোসনা ও অনুরূপ অর্থবিশিষ্ট কিছু দিয়ে ঝাড়ফুঁক করা সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয। (লুম’আত)

তবে নিম্নে উল্লেখিত বিষয় দ্বারা ঝাড়ফুঁক জায়েয নয়:

(১) এমন শব্দ বা বাক্যের অর্থ যা বোধগম্য নয়; (২) আরবী ছাড়া অন্য ভাষায়, তবে অন্য ভাষা হলে কুফুরী বাক্য না থাকা; (৩) কুফুরী-শিরিকী কালাম দ্বারা; (৪) ঝাড়-ফুঁকের মধ্যে নিজস্ব ক্ষমতা আছে মনে করা ইত্যাদি।

যে সব হাদীছে ঝাড়ফুঁককে নিষেধ করা হয়েছে বা শিরক বলা হয়েছে তা উপরোক্ত ধরনের ঝাড়ফুঁক, সব ধরনের ঝাড়ফুঁক ওই নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়। যেমন আবু দাউদ শরীফের হাদীছ -

ان الرقى والتمائم والتولة شرك

অর্থাৎ, ঝাড়ফুঁক ও তাবীজ শিরক।

পূর্বের হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে বৈধ পন্থায় বৈধ বিষয়ে ঝাড়ফুঁক জায়েয। বর্তমান যুগের গায়রে মুকাল্লিদ ও সালাফীরা তাবীজ-কবজকে নিষিদ্ধ এমনকি শিরক বলে থাকে। পক্ষান্তরে অন্য সকলের কাছে তাবীজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁকের হুকুম একই রকম।

যে ধরনের কালাম দ্বারা ঝাড়ফুঁক জায়েয নয়, সেগুলো লিখে তাবীজ-কবজ ব্যবহার করাও জায়েয নয়। পক্ষান্তরে, যে ধরনের ঝাড়ফুঁক জায়েয, সে ধরনের কালাম বা তার নকশা (আবজাদ হিসেবে) দ্বারা তাবীজ লিখাও জায়েয। সব শ্রেণির ওলামাগণ এ ধরনের তাবীজ-কবজকে জায়েয বলেছেন। এমনকি সালাফীগণ পদে পদে যার তাকলীদ করেন সেই ইবনে তাইমিয়াও বলেছে -

ويجوز ان يكتب للمصاب و غيره من المرضى شيئا من كتاب الله و ذكره بلمراد المباح ويغسل وبقسى-
(فتاوى ابن تيميه ج/19 صفه/ 63)

অর্থাৎ, অসুস্থ বা বিপদগ্রস্ত লোকদের জন্য কালি দ্বারা আল্লাহ’র কিতাব, আল্লাহ’র জিকির লিখে দেয়া এবং ধুয়ে পান করানো জায়েয।

গায়রে মুকাল্লীদগণ যে আরেকজনকে ইমাম হিসেবে মান্য করেন, সেই ইমাম শাওকানীও বলেছেন, সমস্ত ফকহীগণের নিকট এ ধরনের তাবীজ জায়েয (নাইলুল আওতার)।


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি আমল ছিলো -

عن عائشة رضى الله عنه انً النًبىً صلًى الله عليه وسلم كان اذا آوى الى فراشه كل ليلة جمع كفيه ثمً نفث فيهما فقرا بهما قل هو الله احد و قل اعوذ برب الفلق و قل اعوذ برب الناس ثمً مسح بهما ما استطاع من جسده يبدا بهما على رأسه و وجهه وما اقبل من جسده يفعل ذالك ثلاث مراتٍ-

অর্থাৎ, হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, প্রতি রাতে বিছানায় শয়ন করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাতের তালু একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাছ,ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁক দিয়ে মাথা ও মুখমণ্ডল হতে সারা শরীর তিন বার মসেহ করতেন। (তিরমিজী শরীফ, ২য় খণ্ড, ১৭৭ পৃষ্ঠা)

সালাফী ও গায়রে মুকাল্লীদগণের দলীল ও তার জাওয়াব

সালাফীগণ তাবীজ-কবজ নাজায়েজ হওয়া সম্পর্কে পুস্তিকাও প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে একটি পুস্তিকা হল “আক্বীদাহ’র মানদণ্ডে তাবীজ”।

তাদের দলীল প্রথমতঃ 
ওই সব আয়াত যার মধ্যে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদ দূর করাকে আল্লাহ’র শান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন -

(ক) আল্লাহ্‌ তোমাকে ক্লেশ দিলে তিনি ব্যতীত কেউই তা দূর করার নেই। আর তিনি যদি তোমার মঙ্গল চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউই নেই। (সূরা-ইউনুস, আয়াত-১০৭)

(খ) আল্লাহ’রই ওপর তোমরা ভরসা করো যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো। ( সূরা মায়েদা:২৩)

(গ) মু’মিনগণ যেন আল্লাহ’র ওপর-ই ভরসা করে। (সূরা ইব্রাহীম:১১)

জাওয়াব
তাবীজ গ্রহণ করা উল্লেখিত আয়াতগুলোর পরিপন্থী হতো যদি তাবীজ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে শুধু তাবীজের ওপরই ভরসা করা হতো। কিন্তু যদি ভরসা আল্লাহ’র ওপর থাকে এবং তাবীজকে ওসীলা হিসেবে গ্রহণ করা হয় যেমনটি করা হয় ওষুধ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে, তাহলে আদৌ তা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী হবে না। নতুবা বলতে হবে বৈধ পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণ করাও উক্ত আয়াতগুলোর পরিপন্থী। এ জাতীয় আয়াত দ্বারা তাবীজ নিষিদ্ধ হওয়ার দলীল দেয়া অনেকটা ছেলেমানুষী এবং ভাষা জ্ঞানে অপরিপক্কতারই পরিচায়ক।

দ্বিতীয়তঃ

ওই সব আয়াত যা’তে শিরকের নিন্দাবাদ করা হয়েছে।

ক) নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না। অন্য গুণাহ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। (সূরা নিসা:১১৬)

খ) যে ব্যক্তি আল্লাহ’র সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে, অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় কিংবা বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করে। (সূরা হজ্ব:৩১)

জাওয়াব 
তাবীজের ওপর নিজস্ব প্রভাব বা ক্ষমতা আছে মনে করলে শিরকের প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এ রকম মনে না করলে শিরকের প্রশ্ন অবান্তর। আগেই উল্লেখ করেছি যে তাবীজ গ্রহণ করা জায়েয, তাও শর্ত সাপেক্ষে; এর মধ্যে তাবীজের নিজস্ব ক্ষমতা আছে বিশ্বাস না রেখে আল্লাহ’র রহমতের ওপর বিশ্বাস রাখা শর্ত।

তৃতীয়তঃ

ওই সব হাদীছ যা’তে ঝাড়ফুঁক ও তাবীজেকে শিরক বলা হয়েছে -

ক) যে তাবীজ (পুতি) লটকালো সে শিরক করলো।

খ) অবশ্যই ঝাড়ফুঁক, তাবীজ ও যাদু শিরক।

গ) এক হাদীছে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে একদল লোক উপস্থিত হলো। অতঃপর তিনি নয় জনকে বাই’আত করান, কিন্তু একজনকে বাই’আত করেন নি। তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! একজনকে বাদ রাখলেন কেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তার সাথে একটি তাবীজ রয়েছে। তখন তাঁর হাত ভিতরে ঢুকালেন এবং তাবীজটি ছিঁড়ে ফেললেন। অতপর তাকেও বাই’আত করালেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি তাবীজ ব্যবহার করলো সে শিরীক করলো।

জাওয়াব

কিছু উত্তর আগেই দেয়া হয়েছে। এখানে প্রথম হাদীছ দুটোতে যে তাবীজের কথা বলা হয়েছে, তার দ্বারা শিরকপূর্ণ তাবীজ উদ্দেশ্য। তার প্রমাণ হল এখানে উল্লেখিত দ্বিতীয় হাদীছে ঝাড়ফুঁককেও শিরক বলা হয়েছে, অথচ সব ঝাড়ফুঁক শিরক নয়; স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ছাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমও ঝাড়ফুঁক করতেন, যা পূর্বে সহীহ হাদীছের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, এখানে ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দেয়া হবে তাবীজের ব্যাপারেও একই ব্যাখ্যা দেয়া হবে। এ ব্যাখ্যা করতে আমরা বাধ্য এ কারণেও যে, সহীহ ছাহাবা ও তাবেয়ীনসহ পরবর্তী যুগ পরম্পরায় তাবীজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
তৃতীয় হাদীছে তাবীজ থাকার কারণে যে ব্যক্তির বাই’আত না করা এবং তার তাবীজ খুলে ফেলার কথা বলা হয়েছে, এ দ্বারা কোনোভাবেই সব ধরনের তাবীজ নিষিদ্ধ হওয়ার দলীল দেয়া যায় না। কারণ সে লোকটি ইসলাম গ্রহণের জন্যই এসেছিলো। তাই মুসলমান হওয়ার আগে সে যে তাবীজ লাগিয়েছিলো তা অবশ্যই শিরক-পূর্ণ তাবীজ ছিলো। যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ বলেছেন ও শিরক বলেছেন।

আশা করি দীর্ঘ দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা ইসলামে তাবীজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে সঠিক ফয়সালা বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না। অর্থাৎ, বৈধ উদ্দেশ্যে বৈধ কালাম দ্বারা তাবিজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁক জায়েয। কুফুরী বাক্যাবলী দ্বারা তা জায়েয নেই। ওয়াল্লাহু ওয়া রাসূলাহু আ’লামু।
 

No comments:

Post a Comment