এডমিন/বঙ্গানুবাদকের আরয
[আহলে বাইত ও আসহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি শীর্ষক বই প্রসঙ্গে]
সম্প্রতি তুরস্কের আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশীক্ব (রহ:)’এর রচিত ও আমার অনূদিত “আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি” পুস্তকটি সম্পর্কে ফেইসবুকে কতিপয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী আপত্তি তুলেছেন। তারা এতে উদ্ধৃত তুর্কী ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার লিখিত “ক্বাসাসুল আম্বিয়া (আ:)” শীর্ষক ইতিহাসগ্রন্থের বক্তব্য এবং পারসিক ইতিহাসবিদদের প্রণীত ইতিহাসবিষয়ক বইপত্রের ভাষ্যের সূত্র ধরে কারবালার ঘটনায় এয়াযীদের দায় নাকি আলোচ্য বইয়ে অস্বীকার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন, যা একেবারেই ভিত্তিহীন। ইতিহাসবিদবৃন্দ এয়াযীদকে দায়মুক্তি দেননি। ফেইসবুকে পুরোটুকু উদ্ধৃত না করে অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কিয়দংশ উদ্ধৃত করা গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। তাই আমি ইসলামী প্রাথমিক যুগের (প্রায় ১২ শ বছর আগের) নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ:) বিরচিত “তাওয়ারিখ” (ইতিহাস) গ্রন্থটি হতে এতদসংক্রান্ত উদ্ধৃতি পেশ করে দেখাবো, আলোচ্য বইয়ে যা আলোচনা করা হয়েছে তা পূর্ববর্তী সময়ের অন্যান্য ইতিহাসবিদও আলোকপাত করেছেন। বিবরণগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আমার নোট/টীকা পেশ করা হবে, ইনশা’আল্লাহ। এখানে উল্লেখ্য যে, কারবালার ময়দানে অসম ও একতরফা যুদ্ধের বিবরণটি আমি দিতে না চাইলেও প্রামাণ্য দলিলের খাতিরে দিতে বাধ্য হলাম। এর জন্যে আমি দুঃখিত ও ব্যথিত। (‘তাওয়ারিখ’ ১৯তম খণ্ড, এয়াযীদ ইবনে মুআবিয়ার খেলাফত, ১৬৮-১৭৩ পৃষ্ঠা; ইউনেস্কোর অর্থায়নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের অনূদিত ইংরেজি সংস্করণ)
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ১
হিশাম বিন মুহাম্মদ কালবী বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ ইবনে এয়াযীদ ইবনে রাওহ ইবনে যিম্বা’ আল-জুযা’মী হতে, তিনি তাঁর পিতা হিমইয়ার অঞ্চলের আল-গা’য বিন রাবীয়াহ আল-জুরাশী হতে, যিনি বলেন:
আল্লাহর কসম! আমি দামেশকে এয়াযীদ ইবনে মুআবিয়া’র সাথে অবস্থান করছিলাম, যখন যাহর বিন ক্বায়স এয়াযীদের সাথে দেখা করতে আসে। এয়াযীদ বলে, “তোমার জন্যে আফসোস! তুমি পেছনে কী রেখে এসেছো? আর কী নিয়ে এসেছো?” সে উত্তর দেয়, “হে আমীরুল মো’মেনীন! আমি আল্লাহতা’লার বিজয় ও সাহায্যের সুখবর নিয়ে এসেছি। হুসাইন ইবনে আলী (রা:) তাঁর ঘরের ১৮ জন ও শীআ’ (সহায়তাকারী) ৬০ জনকে সাথে নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে এসেছিলেন। আমরা তাঁদেরকে মোকাবেলা করতে অগ্রসর হই এবং তাঁদেরকে হয় আত্মসমর্পণ করে গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের আনুগত্য স্বীকার করতে, না হয় যুদ্ধ করতে বলি। তাঁরা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে যুদ্ধকে বেছে নেন। সূর্যোদয়ের সময় আমরা তাঁদেরকে আক্রমণ করি এবং চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলি। অবশেষে আমাদের তরবারি ওই সব মানুষের শিরের ওপরে জয়ী হতে থাকে, আর তাঁরা কোনো আশ্রয় ছাড়াই পালাতে থাকেন। তাঁরা পাহাড় ও গর্তে গিয়ে আমাদের থেকে আশ্রয় নেন ঠিক ঘুঘু পাখির মতোই, যা বাজপাখি হতে আশ্রয় খোঁজে। আল্লাহর নামে শপথ! হে ঈমানদারদের অধিপতি, এ ছিলো প্রাণি হত্যার সময়, অথবা কোনো ব্যক্তির জন্যে قيلولة (ক্বায়লূলাহ) তথা দুপুরের হাল্কা নিদ্রাসম, যতোক্ষণ না আমরা তাঁদের শেষজন অবধি পৌঁছে যাই। সেখানেই পড়ে ছিলো তাঁদের বিবস্ত্র দেহ, রক্তমাখা জামাকাপড়, তাঁদের মুখগুলো ধূলিতে নিক্ষিপ্ত। সূর্য তাঁদের ওপর তাপ ছড়াচ্ছিলো; বায়ু তাঁদের (দেহের ওপর) বালু ছিটাচ্ছিলো; এই বিরাণ ও নির্জন এলাকায় তাঁদের অতিথি হয়েছিলো ঈগল ও শকুনের দল।” এয়াযীদের দু চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে এবং সে বলে, “আমি তোমার বাধ্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতাম, যদি আল-হুসাইন (রা:)’কে হত্যা ছাড়া তা হতো। ইবনে সুমাইয়াহ (গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ)’এর প্রতি আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত! আল্লাহর কসম! আমি যদি তাঁর (আল-হুসাইনের) সাথে থাকতাম (ওই সময়), তাহলে আমি তাঁকে ছেড়ে দিতাম। আল্লাহ যেনো আল-হুসাইনের প্রতি করুণা করেন।” অতঃপর এয়াযীদ ওই বার্তাবাহককে কিছুই দেয়নি। [বঙ্গানুবাদকের নোট: লক্ষ্য করুন যে, ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার ইতিহাসগ্রন্থেও অনুরূপ বিবরণ বিধৃত হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ:)’র স্রেফ এই উদ্ধৃতিটুকু স্বার্থ হাসিলের জন্যে বাছাই করে সহজেই অপবাদ দেয়া যায় যে এখানে এয়াযীদকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসল চিত্র জানার জন্যে তো বাকি অংশ পড়া দরকার! বস্তুতঃ ফেইসবুকে এভাবেই ধোকাবাজি করা হয়েছে। বি:দ্র: এটা এয়াযীদের অভিনয় হতে পারে। সে ছিলো একজন পলিটিশিয়ান।]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ২
আবূ মিখনাফ বর্ণনা করেন আল-সাক্বা’ব বিন যুহায়র হতে, তিনি এয়াযীদের জনৈক গোলাম আল-ক্বা’সিম বিন আবদ আল-রাহমান হতে, যিনি বলেন:
ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর পরিবার এবং অনুসারীদের (কর্তিত) শির (মোবারক) যখন এয়াযীদের সামনে রাখা হলো, তখন সে আবৃত্তি করলো:
“(তরবারি) বিচ্ছিন্ন করেছে মানুষের শির যাঁরা আমাদের প্রিয়,
কিন্তু তাঁরা ছিলেন অবাধ্য ও অসহনীয়।” [ভাবানুবাদ]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ২
আবূ মিখনাফ বর্ণনা করেন আল-সাক্বা’ব বিন যুহায়র হতে, তিনি এয়াযীদের জনৈক গোলাম আল-ক্বা’সিম বিন আবদ আল-রাহমান হতে, যিনি বলেন:
ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর পরিবার এবং অনুসারীদের (কর্তিত) শির (মোবারক) যখন এয়াযীদের সামনে রাখা হলো, তখন সে আবৃত্তি করলো:
“(তরবারি) বিচ্ছিন্ন করেছে মানুষের শির যাঁরা আমাদের প্রিয়,
কিন্তু তাঁরা ছিলেন অবাধ্য ও অসহনীয়।” [ভাবানুবাদ]
(অতঃপর সে আরো বলে), “তথাপিও, হে হুসাইন, আপনার সাথে যদি আমায় যুঝতে হতো, তাহলে আমি আপনাকে হত্যা করতাম না।” [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদের কবিতায় দাম্ভিকতা প্রকাশ পেয়েছে]
আবূ মিখনাফ বর্ণনা করেন আবূ জা’ফর আল-আবসী হতে, তিনি আবূ উমা’রাহ আল-আবসী হতে, যিনি বলেন: মারওয়া’ন বিন আল-হাকামের ভাই এয়াইয়া বিন আল-হাকাম আবৃত্তি করে:
“সমভূমিতে শিরগুলো ছিলো আত্মীয়তায় ইবনে যিয়াদের চেয়েও ঘনিষ্ঠ,
যে ছিলো এক গোলাম এবং যার বংশপরিচয় ছিলো দুষ্ট,
উমাইয়া সন্তানের সংখ্যা এখন নুড়িপাথরের মতো অগণিত,
অথচ নবী-নন্দিনী আপন সন্তান হতে হয়েছেন বঞ্চিত।” [ভাবানুবাদ]
এতদশ্রবণে এয়াযীদ নিজ হাত দ্বারা এয়াহইয়া বিন আল-হাকামের বুকে আঘাত করে চিৎকার করে বলে, “চুপ থাকো!” [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদ নিজের তোয়াজ পছন্দ করেনি। অথবা, এটাও তার পলিটিক্যাল চাল হতে পারে। কেননা তার সভাসদদের সামনেই এই ঘটনা ঘটেছিলো]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৩
এয়াযীদ একটি সভা ডেকে সিরীয় গণ্যমান্যদের তার চারপাশে বসায়। এরপর সে হযরত আলী ইবনে আল-হুসাইন ওরফে ইমাম যাইনুল আবেদীন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে এবং শহীদ হযরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর পরিবারের নারী ও শিশুদেরকে সেখানে এনে বসতে দেয়, আর মানুষেরা তা অবলোকন করেন। এয়াযীদ হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে বলে, “আলী, তোমার বাবা (মানে ইমাম হুসাইন) আমার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছিলেন, আমার অধিকারের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন এবং আমার কর্তৃত্ব হতে আমাকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে এর প্রতিদান দিয়েছেন যা তুমি প্রত্যক্ষ করেছো।” হযরত আলী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) উত্তর দেন:
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي ٱلأَرْضِ وَلاَ فِيۤ أَنفُسِكُمْ إِلاَّ فِي كِتَٰبٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ
অর্থ: পৌঁছে না কোনো মুসীবত পৃথিবীতে এবং না তোমাদের নিজেদের প্রাণগুলোতে, কিন্তু তা একটা কিতাবের (মানে লওহে মাহফূযের) মধ্যে রয়েছে, এরই পূর্বে যে সেটাকে আমি সৃষ্টি করি। [আল-ক্বুরআন, ৫৭:২২; নূরুল এরফান]
এমতাবস্থায় এয়াযীদ আপন পুত্র খালিদকে এর প্রতি জবাব দেবার জন্যে তাকিদ দেয়। কিন্তু খালিদ কী উত্তর দেবে তা তার জানা ছিলো না। তাই এয়াযীদ বলে:
وَمَآ أَصَـٰبَكُمْ مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُواْ عَن كَثِيرٍ
অর্থ: এবং তোমাদেরকে যে মুসীবত স্পর্শ করেছে তা তারই কারণে, যা তোমাদের হাতগুলো উপার্জন করেছে এবং বহু কিছু তো তিনি (আল্লাহ) ক্ষমা করে দেন। [আল-ক্বুরআন, ৪২:৩০; নূরুল এরফান]
এতে হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে) চুপ হয়ে যান। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদের মনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। তার ক্ষমতার প্রতি লোভ ছিলো। হযরত ইমাম (রা:)’এর প্রতি অন্তরে যে ক্ষোভ ছিলো, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। কোনো ঈমানদার-ই এরকম ক্ষোভ লালন করতে পারেন না। তবে এয়াযীদ ক্বুরআন-হাদীস যে পড়তো, তা তার প্রত্যুত্তরে বোঝা যায়]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৪
এয়াযীদ মহিলা ও শিশুদেরকে সামনে বসতে দেয়। সে এক ভয়ঙ্কর ও অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখতে পায়। সে বলে, “ইবনে মারজানা’র (মানে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের) প্রতি আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত! আপনাদের সাথে যদি তার কোনো আত্মীয়তা থাকতো, তাহলে সে আপনাদের সাথে এরকম (আচরণ) করতে পারতো না; এখানে আপনাদেরকে পাঠাতো না।”
মিখনাফ বর্ণনা করেন আল-হা’রিস বিন কা’আব হতে, তিনি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কন্যা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে; তিনি বলেন: “আমাদেরকে যখন এয়াযীদের সামনে বসানো হয়, সে আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে; আমাদের জন্যে বিভিন্ন জিনিস আদেশ করে এবং আমাদের প্রতি সদয় হয়। এমতাবস্থায় এক লাল বর্ণের চেহারাবিশিষ্ট সিরীয় লোক এয়াযীদের সামনে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, ‘হে আমিরুল মো’মেনীন, একে আমায় দিন।’ সে আমাকে বুঝিয়েছিলো। আমি ছিলাম এক সুন্দরী তরুণী। (এতদশ্রবণে) ভয়ে আমি কম্পমান হয়ে দূরে সরে যাই, কেননা আমি ভেবেছিলাম তাকে এর অনুমতি বুঝি দেয়া হবে। আমার বোন যায়নাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) জামা ধরি আমি। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং আমার চেয়ে বুদ্ধিমতিও। তিনি বলেন এটা হবে না। সিরীয় লোকটিকে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তুমি একটা মিথ্যুক! আল্লাহর শপথ! তুমি নিচু বংশজাত! এ তোমার জন্যে নয়, তার (মানে এয়াযীদের) জন্যেও নয়।’ এয়াযীদ রাগে চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহর শপথ! আপনি-ই (বরঞ্চ) মিথ্যুক! সে আমার জন্যেই। আমি যদি চাই, আমি তা করতে পারি।’ যায়নাব (রা:) প্রত্যুত্তর দেন, ‘আল্লাহর শপথ! না, আল্লাহ তোমায় তা করতে দেবেন শুধু তখনি, যখন তুমি আমাদের ধর্মত্যাগ করবে এবং অন্য ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ এয়াযীদ রাগে চিৎকার করে বলে, ‘আপনি আমায় মোকাবেলা করার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন? আপনার পিতা-ই তো ধর্মত্যাগ করেছিলেন এবং আপনার ভাই-ও।’ যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তুমি, তোমার পিতা ও দাদা আল্লাহতা’লার দ্বীন দ্বারা হেদায়াতপ্রাপ্ত তথা সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছো, যে দ্বীন আমার বাবার, আমার ভাইয়ের এবং আমার দাদার।’ এয়াযীদ চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহর দুশমন, আপনি মিথ্যে বলছেন!’ এমতাবস্থায় যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) উত্তর দেন, ‘তুমি একজন নেতা, যার এরকম (বড়) কর্তৃত্ব রয়েছে, অথচ তুমি অন্যায়ভাবে অপবাদ দিচ্ছো এবং তোমার কর্তৃত্ব দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে শাসন করছো।’ আল্লাহর কসম! এতদশ্রবণে সে যেনো লজ্জিত হয়ে যায় এবং নিশ্চুপ হয়। ওই সিরীয় লোকটি পুনরায় বলে, ‘হে আমিরুল মোমেনীন, আমায় ওই তরুণীকে দিন।’ এয়াযীদ তাকে বলে, ‘দূর হও! আল্লাহ তোমার বিনাশ সাধন করুন’!”
অতঃপর এয়াযীদ বলে, “আল-নু’মান আল-বশীর, এঁদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস/সাজ-সরঞ্জাম দ্বারা এঁদেরকে সাজিয়ে দাও এবং এঁদের সাথে একজন উত্তম সিরীয় ব্যক্তিকে প্রেরণ করো। তার সাথে অশ্বারোহীদের ও খেদমতকারীদেরও পাঠাও, যাতে সে তাঁদেরকে মদীনায় নিয়ে যেতে পারে।” এরপর সে মহিলাদেরকে একটি পৃথক/নিরিবিলি গৃহে বসবাসের জন্যে (সেবকদের প্রতি) আদেশ করে। তাঁদের সাথে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস সে প্রেরণ করে। তাঁদের ভাই হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)-ও সেই গৃহে অবস্থান করেন। তাঁরা ওই গৃহ হতে বের হয়ে এয়াযীদের ঘরে গেলে হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বংশের এমন কোনো নারী-ই আর বাকি ছিলেন না, যিনি ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র জন্যে কান্নারত অবস্থা ছাড়া তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তা্ঁরা ওই আহাজারি তিন দিনব্যাপী করেছিলেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এই ঘটনায়ও এয়াযীদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। তবে হযরত ইমাম (রা:) পরিবারসদস্যের কড়া প্রতিবাদের মুখে সে নিরুত্তর হয়ে যায়। তবু একটা দিক এখানে লক্ষণীয় যে, ওই পুতঃপবিত্র পরিবারের নারীদেরকে সে হেনস্থা হতে দেয়নি। আর এটাই তার বাবা হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র দেয়া শিক্ষাদীক্ষা ছিলো, যা সে সর্বময় ক্ষমতা পেয়েও লঙ্ঘন করতে পারেনি]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৫
হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে আমন্ত্রণ ছাড়া এয়াযীদ কখনোই দুপুরের বা রাতের খাবার গ্রহণ করেনি। একদিন সে তাঁকে এবং আমর ইবনে হাসান ইবনে আলী তথা আলীর পুত্র হাসান, তাঁর পুত্র আমর (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে আমন্ত্রণ করে; ওই সময় আমর (রহ:) ছোট্ট বালক ছিলেন। এয়াযীদ তাঁকে বলে, “তুমি কি এই বালকের (মানে তার পুত্র খালিদের) সাথে লড়াই করবে?” আমর (রহমতুল্লাহে আলাইহে) প্রত্যুত্তর দেন, “না। তবে তাকে একটা ছুরি দিন আর আমাকেও একটা ছুরি দিন; তাহলে আমি তার সাথে লড়বো।” এয়াযীদ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে এবং এরপর বলে, “এটাই সেই আচরণ যা আমি চিনি (তার) বাবার কাছ থেকে। সাপের ঘরে কি সাপ ছাড়া অন্য কিছু পয়দা হয়?” যখন তাঁরা (দামেশ্ক) ছেড়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হন, তখন এয়াযীদ হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে ডেকে বলে, “আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত ইবনে মারজানাহ’র (মানে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের) প্রতি! আমি যদি তোমার বাবার সাথে থাকতাম, তাহলে তাঁর কোনো অনুরোধই আমি পূরণ না করে থাকতাম না; আমি তাঁকে আমার সর্বশক্তি দিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতাম, এমন কী যদি তাতে আমার নিজের কিছু সন্তানেরও প্রাণহানি ঘটতো। কিন্তু আল্লাহতা’লা (এটাই) ডিক্রি করেছেন যা তুমি প্রত্যক্ষ করেছো। মদীনা হতে আমাকে পত্র লেখো এবং যা যা প্রয়োজন জানিয়ো।” সে তাঁদেরকে জামাকাপড় উপহার দেয় এবং ওই (বিশ্বস্ত) খেদমতগারের দায়িত্বে অর্পণ করে। তিনি তাঁদের সাথে যাত্রা করেন। রাতে সফরকালে তাঁরা তাঁর সামনে থাকতেন, কিন্তু দৃষ্টির বাইরে নয়। তাঁরা থামলে তিনি তাঁদের থেকে এক পাশে চলে যেতেন। তিনি ও তাঁর সহকারীবৃন্দ তাঁদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেন প্রহরী দলের মতো; তিনি এমন-ই এক অবস্থানে থাকতেন, যাতে কেউ গোসল বা প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার সময় কোনো রকম লজ্জাবোধ না করেন। তাঁদের কোনো কিছু প্রয়োজন হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতে তিনি কখনোই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি তাঁদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করেন মদীনা পর্যন্ত গোটা ওই সফরে।
হা’রিস্ বিন কাআব বর্ণনা করেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কন্যা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে, যিনি বলেন: আমি আমার (বড়) বোন যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে বলি, “বোন, এই সিরীয় লোকটি (মানে এয়াযীদ) আমাদের সাথে সদাচরণ করেছে! আপনি কি মনে করেন না আমাদের পক্ষ থেকে তাকে উপহার দেয়া উচিৎ?” তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহর শপথ! আমাদের কাছে তো কিছুই নেই আমাদের গহনা ছাড়া।” আমি বলি, “চলুন, আমাদের গহনা-ই তাকে উপহারস্বরূপ দেই।” অতঃপর আমি আমার বালা ও বাহুবন্ধ এবং তিনি তাঁর বালা ও বাহুবন্ধ নিয়ে এয়াযীদকে উপহারস্বরূপ দিতে চাই। আমরা তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলি, “আমাদের সাথে যে সদাচরণ করেছো, এগুলো তোমার প্রতি তারই পুরস্কার।” সে উত্তর দেয়, “আমি যা করেছি তা যদি স্রেফ পার্থিব সম্পদের খাতিরে হতো, তাহলে আপনাদের গহনার মাঝে থাকতো সন্তুষ্টি এবং তার চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু, আল্লাহর কসম, আমি এটা করেছি শুধু আল্লাহর খাতিরে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে আপনাদের (আত্মীয়তার) সম্পর্কের খাতিরেই।”
[বঙ্গানুবাদকের নোট: এয়াযীদের এই আচরণটি ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ:) ছাড়াও আরো অনেক ইতিহাসবিদ নিজেদের বইপত্রে আলোকপাত করেছেন (ইবনে ক্বাসীর কৃত বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া দ্রষ্টব্য)। ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাহাদাতের দায়দায়িত্ব সে গ্রহণ করতে চায়নি, বরং ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদেরই প্রতি তা বারবার আরোপ করেছে। আমাদের বিশ্লেষণে এয়াযীদ দায়ী এ কারণে যে, তার শাসনামলেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিলো। কিন্তু সে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলো কি না, তা প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদদের ইতিহাসে স্পষ্ট নয়। এই কারণে ইমামবৃন্দের মধ্যে তার কুফরীর ব্যাপারে পারস্পরিক ভিন্নমত বিদ্যমান। সবাই তার ফাসিক্ব হওয়ার ব্যাপারে একমত, কিন্তু কাফির কি না, সে বিষয়ে তাঁরা একমত নন। ইমামবৃন্দ দুটো মতে বিভক্ত হয়ে পড়লে আমাদের জন্যে তৃতীয় কোনো (নিজস্ব মনগড়া) মত গ্রহণের অবকাশ নেই। এখানে ধর্মতত্ত্বীয় সেই বিষয়টির গভীরে আমরা যাবো না; আমাদের ফোকাস কেবল ইতিহাসের দিকে। তুরস্কের আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:) বিরচিত ও আমার অনূদিত ‘আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি’ শীর্ষক বইটি সম্পর্কে ফেইসবুকে আপত্তির কারণেই ইতিহাসের পাতা হতে এই অনুবাদের অবতারণা হয়েছে। বইটির লেখক উসমানীয় তুর্কী আমলের ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার ‘ক্বাসাসুল আম্বিয়া’ হতে অনুরূপ বৃত্তান্তের উদ্ধৃতি দানশেষে বলেন, “কারণ যা-ই হোক না কেন, এমন কী এয়াযীদ-ও এই হীন বর্বরতার দায়দায়িত্ব নিতে চায়নি। সে ইবনে যিয়াদকে এ জঘন্য কর্মের জন্যে অভিসম্পাত দিয়েছিলো। এয়াযীদের এ অপরাধ যতোই গুরুতর হোক, তার এ অপরাধের জন্যে তার বাবা হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে দায়ী করার অপচেষ্টা একই পর্যায়ের অন্যায় হবে” (আহলে বায়ত ও আসহাবের প্রতি ভক্তিতে মুক্তি, ১৩৩ পৃষ্ঠা)। অতএব, তিনিও উক্ত পুস্তকে এয়াযীদকে দায়মুক্তি দেননি]
*অতিরিক্ত তথ্য*
আবূ মিখনাফ বর্ণনা করেন আবূ জা’ফর আল-আবসী হতে, তিনি আবূ উমা’রাহ আল-আবসী হতে, যিনি বলেন: মারওয়া’ন বিন আল-হাকামের ভাই এয়াইয়া বিন আল-হাকাম আবৃত্তি করে:
“সমভূমিতে শিরগুলো ছিলো আত্মীয়তায় ইবনে যিয়াদের চেয়েও ঘনিষ্ঠ,
যে ছিলো এক গোলাম এবং যার বংশপরিচয় ছিলো দুষ্ট,
উমাইয়া সন্তানের সংখ্যা এখন নুড়িপাথরের মতো অগণিত,
অথচ নবী-নন্দিনী আপন সন্তান হতে হয়েছেন বঞ্চিত।” [ভাবানুবাদ]
এতদশ্রবণে এয়াযীদ নিজ হাত দ্বারা এয়াহইয়া বিন আল-হাকামের বুকে আঘাত করে চিৎকার করে বলে, “চুপ থাকো!” [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদ নিজের তোয়াজ পছন্দ করেনি। অথবা, এটাও তার পলিটিক্যাল চাল হতে পারে। কেননা তার সভাসদদের সামনেই এই ঘটনা ঘটেছিলো]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৩
এয়াযীদ একটি সভা ডেকে সিরীয় গণ্যমান্যদের তার চারপাশে বসায়। এরপর সে হযরত আলী ইবনে আল-হুসাইন ওরফে ইমাম যাইনুল আবেদীন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে এবং শহীদ হযরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর পরিবারের নারী ও শিশুদেরকে সেখানে এনে বসতে দেয়, আর মানুষেরা তা অবলোকন করেন। এয়াযীদ হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে বলে, “আলী, তোমার বাবা (মানে ইমাম হুসাইন) আমার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছিলেন, আমার অধিকারের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন এবং আমার কর্তৃত্ব হতে আমাকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে এর প্রতিদান দিয়েছেন যা তুমি প্রত্যক্ষ করেছো।” হযরত আলী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) উত্তর দেন:
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي ٱلأَرْضِ وَلاَ فِيۤ أَنفُسِكُمْ إِلاَّ فِي كِتَٰبٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ
অর্থ: পৌঁছে না কোনো মুসীবত পৃথিবীতে এবং না তোমাদের নিজেদের প্রাণগুলোতে, কিন্তু তা একটা কিতাবের (মানে লওহে মাহফূযের) মধ্যে রয়েছে, এরই পূর্বে যে সেটাকে আমি সৃষ্টি করি। [আল-ক্বুরআন, ৫৭:২২; নূরুল এরফান]
এমতাবস্থায় এয়াযীদ আপন পুত্র খালিদকে এর প্রতি জবাব দেবার জন্যে তাকিদ দেয়। কিন্তু খালিদ কী উত্তর দেবে তা তার জানা ছিলো না। তাই এয়াযীদ বলে:
وَمَآ أَصَـٰبَكُمْ مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُواْ عَن كَثِيرٍ
অর্থ: এবং তোমাদেরকে যে মুসীবত স্পর্শ করেছে তা তারই কারণে, যা তোমাদের হাতগুলো উপার্জন করেছে এবং বহু কিছু তো তিনি (আল্লাহ) ক্ষমা করে দেন। [আল-ক্বুরআন, ৪২:৩০; নূরুল এরফান]
এতে হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে) চুপ হয়ে যান। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদের মনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। তার ক্ষমতার প্রতি লোভ ছিলো। হযরত ইমাম (রা:)’এর প্রতি অন্তরে যে ক্ষোভ ছিলো, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। কোনো ঈমানদার-ই এরকম ক্ষোভ লালন করতে পারেন না। তবে এয়াযীদ ক্বুরআন-হাদীস যে পড়তো, তা তার প্রত্যুত্তরে বোঝা যায়]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৪
এয়াযীদ মহিলা ও শিশুদেরকে সামনে বসতে দেয়। সে এক ভয়ঙ্কর ও অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখতে পায়। সে বলে, “ইবনে মারজানা’র (মানে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের) প্রতি আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত! আপনাদের সাথে যদি তার কোনো আত্মীয়তা থাকতো, তাহলে সে আপনাদের সাথে এরকম (আচরণ) করতে পারতো না; এখানে আপনাদেরকে পাঠাতো না।”
মিখনাফ বর্ণনা করেন আল-হা’রিস বিন কা’আব হতে, তিনি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কন্যা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে; তিনি বলেন: “আমাদেরকে যখন এয়াযীদের সামনে বসানো হয়, সে আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে; আমাদের জন্যে বিভিন্ন জিনিস আদেশ করে এবং আমাদের প্রতি সদয় হয়। এমতাবস্থায় এক লাল বর্ণের চেহারাবিশিষ্ট সিরীয় লোক এয়াযীদের সামনে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, ‘হে আমিরুল মো’মেনীন, একে আমায় দিন।’ সে আমাকে বুঝিয়েছিলো। আমি ছিলাম এক সুন্দরী তরুণী। (এতদশ্রবণে) ভয়ে আমি কম্পমান হয়ে দূরে সরে যাই, কেননা আমি ভেবেছিলাম তাকে এর অনুমতি বুঝি দেয়া হবে। আমার বোন যায়নাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) জামা ধরি আমি। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং আমার চেয়ে বুদ্ধিমতিও। তিনি বলেন এটা হবে না। সিরীয় লোকটিকে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তুমি একটা মিথ্যুক! আল্লাহর শপথ! তুমি নিচু বংশজাত! এ তোমার জন্যে নয়, তার (মানে এয়াযীদের) জন্যেও নয়।’ এয়াযীদ রাগে চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহর শপথ! আপনি-ই (বরঞ্চ) মিথ্যুক! সে আমার জন্যেই। আমি যদি চাই, আমি তা করতে পারি।’ যায়নাব (রা:) প্রত্যুত্তর দেন, ‘আল্লাহর শপথ! না, আল্লাহ তোমায় তা করতে দেবেন শুধু তখনি, যখন তুমি আমাদের ধর্মত্যাগ করবে এবং অন্য ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ এয়াযীদ রাগে চিৎকার করে বলে, ‘আপনি আমায় মোকাবেলা করার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন? আপনার পিতা-ই তো ধর্মত্যাগ করেছিলেন এবং আপনার ভাই-ও।’ যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তুমি, তোমার পিতা ও দাদা আল্লাহতা’লার দ্বীন দ্বারা হেদায়াতপ্রাপ্ত তথা সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছো, যে দ্বীন আমার বাবার, আমার ভাইয়ের এবং আমার দাদার।’ এয়াযীদ চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহর দুশমন, আপনি মিথ্যে বলছেন!’ এমতাবস্থায় যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) উত্তর দেন, ‘তুমি একজন নেতা, যার এরকম (বড়) কর্তৃত্ব রয়েছে, অথচ তুমি অন্যায়ভাবে অপবাদ দিচ্ছো এবং তোমার কর্তৃত্ব দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে শাসন করছো।’ আল্লাহর কসম! এতদশ্রবণে সে যেনো লজ্জিত হয়ে যায় এবং নিশ্চুপ হয়। ওই সিরীয় লোকটি পুনরায় বলে, ‘হে আমিরুল মোমেনীন, আমায় ওই তরুণীকে দিন।’ এয়াযীদ তাকে বলে, ‘দূর হও! আল্লাহ তোমার বিনাশ সাধন করুন’!”
অতঃপর এয়াযীদ বলে, “আল-নু’মান আল-বশীর, এঁদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস/সাজ-সরঞ্জাম দ্বারা এঁদেরকে সাজিয়ে দাও এবং এঁদের সাথে একজন উত্তম সিরীয় ব্যক্তিকে প্রেরণ করো। তার সাথে অশ্বারোহীদের ও খেদমতকারীদেরও পাঠাও, যাতে সে তাঁদেরকে মদীনায় নিয়ে যেতে পারে।” এরপর সে মহিলাদেরকে একটি পৃথক/নিরিবিলি গৃহে বসবাসের জন্যে (সেবকদের প্রতি) আদেশ করে। তাঁদের সাথে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস সে প্রেরণ করে। তাঁদের ভাই হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)-ও সেই গৃহে অবস্থান করেন। তাঁরা ওই গৃহ হতে বের হয়ে এয়াযীদের ঘরে গেলে হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বংশের এমন কোনো নারী-ই আর বাকি ছিলেন না, যিনি ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র জন্যে কান্নারত অবস্থা ছাড়া তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তা্ঁরা ওই আহাজারি তিন দিনব্যাপী করেছিলেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এই ঘটনায়ও এয়াযীদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। তবে হযরত ইমাম (রা:) পরিবারসদস্যের কড়া প্রতিবাদের মুখে সে নিরুত্তর হয়ে যায়। তবু একটা দিক এখানে লক্ষণীয় যে, ওই পুতঃপবিত্র পরিবারের নারীদেরকে সে হেনস্থা হতে দেয়নি। আর এটাই তার বাবা হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র দেয়া শিক্ষাদীক্ষা ছিলো, যা সে সর্বময় ক্ষমতা পেয়েও লঙ্ঘন করতে পারেনি]
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৫
হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে আমন্ত্রণ ছাড়া এয়াযীদ কখনোই দুপুরের বা রাতের খাবার গ্রহণ করেনি। একদিন সে তাঁকে এবং আমর ইবনে হাসান ইবনে আলী তথা আলীর পুত্র হাসান, তাঁর পুত্র আমর (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে আমন্ত্রণ করে; ওই সময় আমর (রহ:) ছোট্ট বালক ছিলেন। এয়াযীদ তাঁকে বলে, “তুমি কি এই বালকের (মানে তার পুত্র খালিদের) সাথে লড়াই করবে?” আমর (রহমতুল্লাহে আলাইহে) প্রত্যুত্তর দেন, “না। তবে তাকে একটা ছুরি দিন আর আমাকেও একটা ছুরি দিন; তাহলে আমি তার সাথে লড়বো।” এয়াযীদ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে এবং এরপর বলে, “এটাই সেই আচরণ যা আমি চিনি (তার) বাবার কাছ থেকে। সাপের ঘরে কি সাপ ছাড়া অন্য কিছু পয়দা হয়?” যখন তাঁরা (দামেশ্ক) ছেড়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হন, তখন এয়াযীদ হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে ডেকে বলে, “আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত ইবনে মারজানাহ’র (মানে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের) প্রতি! আমি যদি তোমার বাবার সাথে থাকতাম, তাহলে তাঁর কোনো অনুরোধই আমি পূরণ না করে থাকতাম না; আমি তাঁকে আমার সর্বশক্তি দিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতাম, এমন কী যদি তাতে আমার নিজের কিছু সন্তানেরও প্রাণহানি ঘটতো। কিন্তু আল্লাহতা’লা (এটাই) ডিক্রি করেছেন যা তুমি প্রত্যক্ষ করেছো। মদীনা হতে আমাকে পত্র লেখো এবং যা যা প্রয়োজন জানিয়ো।” সে তাঁদেরকে জামাকাপড় উপহার দেয় এবং ওই (বিশ্বস্ত) খেদমতগারের দায়িত্বে অর্পণ করে। তিনি তাঁদের সাথে যাত্রা করেন। রাতে সফরকালে তাঁরা তাঁর সামনে থাকতেন, কিন্তু দৃষ্টির বাইরে নয়। তাঁরা থামলে তিনি তাঁদের থেকে এক পাশে চলে যেতেন। তিনি ও তাঁর সহকারীবৃন্দ তাঁদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেন প্রহরী দলের মতো; তিনি এমন-ই এক অবস্থানে থাকতেন, যাতে কেউ গোসল বা প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার সময় কোনো রকম লজ্জাবোধ না করেন। তাঁদের কোনো কিছু প্রয়োজন হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতে তিনি কখনোই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি তাঁদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করেন মদীনা পর্যন্ত গোটা ওই সফরে।
হা’রিস্ বিন কাআব বর্ণনা করেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কন্যা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে, যিনি বলেন: আমি আমার (বড়) বোন যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে বলি, “বোন, এই সিরীয় লোকটি (মানে এয়াযীদ) আমাদের সাথে সদাচরণ করেছে! আপনি কি মনে করেন না আমাদের পক্ষ থেকে তাকে উপহার দেয়া উচিৎ?” তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহর শপথ! আমাদের কাছে তো কিছুই নেই আমাদের গহনা ছাড়া।” আমি বলি, “চলুন, আমাদের গহনা-ই তাকে উপহারস্বরূপ দেই।” অতঃপর আমি আমার বালা ও বাহুবন্ধ এবং তিনি তাঁর বালা ও বাহুবন্ধ নিয়ে এয়াযীদকে উপহারস্বরূপ দিতে চাই। আমরা তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলি, “আমাদের সাথে যে সদাচরণ করেছো, এগুলো তোমার প্রতি তারই পুরস্কার।” সে উত্তর দেয়, “আমি যা করেছি তা যদি স্রেফ পার্থিব সম্পদের খাতিরে হতো, তাহলে আপনাদের গহনার মাঝে থাকতো সন্তুষ্টি এবং তার চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু, আল্লাহর কসম, আমি এটা করেছি শুধু আল্লাহর খাতিরে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে আপনাদের (আত্মীয়তার) সম্পর্কের খাতিরেই।”
[বঙ্গানুবাদকের নোট: এয়াযীদের এই আচরণটি ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ:) ছাড়াও আরো অনেক ইতিহাসবিদ নিজেদের বইপত্রে আলোকপাত করেছেন (ইবনে ক্বাসীর কৃত বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া দ্রষ্টব্য)। ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাহাদাতের দায়দায়িত্ব সে গ্রহণ করতে চায়নি, বরং ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদেরই প্রতি তা বারবার আরোপ করেছে। আমাদের বিশ্লেষণে এয়াযীদ দায়ী এ কারণে যে, তার শাসনামলেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিলো। কিন্তু সে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলো কি না, তা প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদদের ইতিহাসে স্পষ্ট নয়। এই কারণে ইমামবৃন্দের মধ্যে তার কুফরীর ব্যাপারে পারস্পরিক ভিন্নমত বিদ্যমান। সবাই তার ফাসিক্ব হওয়ার ব্যাপারে একমত, কিন্তু কাফির কি না, সে বিষয়ে তাঁরা একমত নন। ইমামবৃন্দ দুটো মতে বিভক্ত হয়ে পড়লে আমাদের জন্যে তৃতীয় কোনো (নিজস্ব মনগড়া) মত গ্রহণের অবকাশ নেই। এখানে ধর্মতত্ত্বীয় সেই বিষয়টির গভীরে আমরা যাবো না; আমাদের ফোকাস কেবল ইতিহাসের দিকে। তুরস্কের আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:) বিরচিত ও আমার অনূদিত ‘আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি’ শীর্ষক বইটি সম্পর্কে ফেইসবুকে আপত্তির কারণেই ইতিহাসের পাতা হতে এই অনুবাদের অবতারণা হয়েছে। বইটির লেখক উসমানীয় তুর্কী আমলের ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার ‘ক্বাসাসুল আম্বিয়া’ হতে অনুরূপ বৃত্তান্তের উদ্ধৃতি দানশেষে বলেন, “কারণ যা-ই হোক না কেন, এমন কী এয়াযীদ-ও এই হীন বর্বরতার দায়দায়িত্ব নিতে চায়নি। সে ইবনে যিয়াদকে এ জঘন্য কর্মের জন্যে অভিসম্পাত দিয়েছিলো। এয়াযীদের এ অপরাধ যতোই গুরুতর হোক, তার এ অপরাধের জন্যে তার বাবা হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে দায়ী করার অপচেষ্টা একই পর্যায়ের অন্যায় হবে” (আহলে বায়ত ও আসহাবের প্রতি ভক্তিতে মুক্তি, ১৩৩ পৃষ্ঠা)। অতএব, তিনিও উক্ত পুস্তকে এয়াযীদকে দায়মুক্তি দেননি]
*অতিরিক্ত তথ্য*
*আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’ শীর্ষক বইটি সম্পর্কে বিভ্রান্তি নিরসন*
ফেইসবুকার যাঁরা উপরোক্ত বইটির স্ক্রীনশট-সহকারে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকর পোষ্টের ধোকায় পড়ে গিয়েছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি - এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। আসলে বইটির লেখক আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:) উসমানীয় তুর্কী ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার ’ক্বাসাসুল আম্বিয়া’ গ্রন্থের রেফারেন্স এখানে দেন নি, বরং দেওবন্দী ওহাবী মাসলাকের হাফেয হাকিম আবদুশ শাকূর এলাহী মীর্যাপুরী (পাকিস্তান)’এর ‘শাহাদাতে হুসাইন (রা:)’ শিরোনামের বই থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন। আমার স্ক্যানকৃত কপির গোটা উদ্ধৃতি-ই ওই দেওবন্দী মৌলভীর, আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ;)’এর বক্তব্য নয়। আমি হাইলাইটার দ্বারা চিহ্নিত করে দিয়েছি। পাকিস্তানী ওই দেওবন্দী আলেমের উর্দূ/ফার্সী বইটি কারো কাছে থাকলে ১১ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার স্ক্যানকৃত কপিতে দেওবন্দী মৌলভী সাহেবের উদ্ধৃতি ১৩৪ পৃষ্ঠা থেকে আরম্ভ হয়ে ১৩৮ পৃষ্ঠার শেষে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। বলা বাহুল্য, দেওবন্দী বইটিতে অনেক শিয়া বইপত্রের রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। সংযুক্ত স্ক্যানকৃত ছবি দেখুন -
*অনূদিত বইয়ের সমালোচনার ব্যাপারে একান্ত ভাবনা*
জনৈক শিয়াপন্থী মৌলভী কর্তৃক তুর্কী আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:)’এর রচিত ও আমার অনূদিত ‘আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি’ শীর্ষক বইয়ের কিছু উদ্ধৃতির ব্যাপারে কয়েকটি স্ক্রীনশট-সম্বলিত একটি হিংসাত্মক পোষ্টের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আমার কয়েকজন ফেইসবুক বন্ধু। ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর লেখা বইটির ব্যাপারে আমি ইতোমধ্যে দুটো পোষ্ট দিয়েছি এবং প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদ ইমামবৃন্দের অনুরূপ লেখনীও উদ্ধৃত করেছি। ইতিহাস লেখা আরম্ভই হয়েছে উমাইয়া-শাসনবিরোধী আব্বাসীয় শাসনামলে। তারপরও ইমামবৃন্দ সত্য প্রকাশে কার্পণ্য করেন নি। সর্ব-ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইবনে ইসহাক্ব, আবূ ইসহাক্ব প্রমুখের বইপত্রে এসব ঘটনা কম-বেশি আলোকপাত করা হয়। পরবর্তী যুগের ইবনে কাসীর, ইবনে জাওযী প্রমুখও তা তুলে ধরেন।
এখানে আমি অতো বিস্তারিত বিবরণে যাবো না। আগামীতে আল্লামা হুসাইন হিলমী তুর্কী (রহ:)’এর প্রণীত ‘আশীর্বাদধন্য সাহাবা কেরাম (রা:)’ শিরোনামের বইটির অনুবাদের সময় বিস্তারিত আলোকপাত করা যাবে, ইনশা’আল্লাহ।
কোনো ঐতিহাসিক বিষয়ের ওপর লেখা গবেষণামূলক বইয়ের ক্রিটিক তথা গবেষণামূলক সমালোচনা ফেইসবুকে কয়েকটি স্কীনশট সহকারে ফালতু পোষ্ট দিয়ে করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, বাতিল শিয়া মতবাদের দোসরদের কৃত এ সব কর্মকাণ্ড একেবারেই ঠুনকো ও জ্ঞান-পরিপন্থী। ফেইসবুকে যারা এ ধরনের কাজে লিপ্ত, তারা গবেষণাধর্মী সমালোচনা সম্পর্কে ভীষণ অজ্ঞ। ওই ধরনের সমালোচনা (ক্রিটিক) লিখতে পুরো বইটিকে আলোচনায় আনতে হয়; এর ভালো দিক ও সমালোচনার দিকগুলোও পর্যালোচনায় আসে। আফসোস, সে ধরনের কোনো কিছু ফেইসবুকে স্ক্রীনশট কারবারিরা প্রদর্শন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তারা শুধু বইয়ের মাঝখান থেকে আগামাথা নেই এমন কিছু অংশ তুলে ধরে বিভ্রান্তি ছড়াতেই ওস্তাদ।
অপপ্রচারকারীদের চামচারা ফেইসবুকের মন্তব্য ফোরামে এসে বিজ্ঞের মতো অনেক কিছু লিখে। কিন্তু সর্বসাধারণের তো এ বিষয়টি সম্পর্কে জানার কথা নয়। তাঁরা এ ধরনের বিষয়গুলোতে নিজেদের মতামত না দেয়াই উচিৎ। তাঁদের বোঝা উচিৎ, ফেইসবুকে স্ক্রীনশট কারবারিরা পানি ঘোলা করতেই অপতৎপর। তাই এ ধরনের গবেষণাবিহীন হিংসাত্মক পোষ্টের পেছনে ছুটা সাধারণ মানুষের পক্ষে একদম অনুচিৎ। শিয়া এজেন্ডাওয়ালা ফেইসবুকারবর্গ আমার অনূদিত ইতিহাসভিত্তিক ‘আহলে বাইত ও আসহাব (রা.)-এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি’ (৩০ সেপটেম্বর ২০১৭, সাঞ্জেরী পাবলিকেশন) শীর্ষক বইটিতে বারংবার ইসলামী আকীদা ও ফতোয়ার খোঁজ করে। কিন্তু তারা যেটা তালগোল পাকিয়ে ফেলে তা হলো, ঐতিহাসিকবৃন্দ ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনা করেন, যেটা স্রেফ ইভেন্ট বা ঘটনা (বি: দ্র: ইতিহাস গ্রহণ বা বর্জন মানুষের ইচ্ছাধীন। আকীদার নিরিখে পছন্দ হলে গ্রহণ করবেন, পছন্দ না হলে বর্জন করবেন। কিন্তু ঐতিহাসিকদের বর্ণিত ঘটনার ব্যাপারে খোদ-মাতব্বরীপূর্ণ নোট দেবেন কোন্ বিদ্যার বলে? বানিয়ে বানিয়ে ইতিহাস লেখা যায় কি?)। ওর মধ্যে আকীদাহ ও ফতোয়া খোঁজা যায় না। তা পেতে হলে খুঁজতে হবে ইসলামী আকীদার কিতাবে, ইতিহাসগ্রন্থে নয়। দ্বিতীয়তঃ ২০১৯ সালের শেষভাগে যখন প্রথমবার ফেইসবুকে আমার অনূদিত বইটি নিয়ে পারসিক শিয়াদের এদেশীয় এজেন্টগুলো হৈচৈ বাধিয়েছিলো, তখন আমি সবেমাত্র ‘গাদীরে খুম’-বিষয়ক আরেকটি শিয়া-বিরোধী বই অনুবাদ করে পর্ব-ওয়ারী ফেইসবুকে পোষ্ট করছিলাম। সেই আন্তর্জাতিক বইটি সম্পর্কে পারস্যদেশীয় শিয়াচক্র জানতো বিধায় তাদের ওই চেলাদেরকে আমার অনুবাদে বিঘ্ন ঘটাবার অসৎ উদ্দেশ্যে এই স্ক্রীনশট ধোঁকাবাজিপূর্ণ ফেইসবুক পোষ্ট করতে লেলিয়ে দেয়। ফলে একযোগে ‘হুক্কা হুয়া’ রবে সব শিয়া’ল ফেইসবুক গরম করে তোলে। আমি যেহেতু নতুন অনুবাদে মনোনিবিষ্ট ছিলাম, তাই ফেইসবুকের মন্তব্য ফোরামে এসব অ-একাডেমিক বকলম-বাহাদুরদের চিৎকার-চেঁচামেচি বন্ধ করার লক্ষ্যে সবাইকে ব্লক করে দেই। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো। এখনো এই মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করছি। কেননা ফেইসবুকের মন্তব্য ফোরামে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, তা গবেষণামূলক নয়, বরং এজেন্ডাকেন্দ্রিক। প্রকৃত গবেষণা করেছেন সুন্নী আলেম-উলামা। তাই তাঁদের লেখনী ভাষান্তরে ব্যস্ত আমি। ২০১৭ সালে সাঞ্জেরী পাবলিকেশনের প্রকাশিত বই নিয়ে শিয়াচক্র হৈচৈ করেছে ২ বছর পরে অর্থাৎ ২০১৯ সালের শেষভাগে। এতোদিন চুপ করে বসেছিলো। যখনই গাদীরে খুম বইটির অনুবাদকর্ম শুরু করলাম, অমনি ‘হুক্কা হুয়া’ রব তুল্লো শিয়া’ল দল! এটাই বাস্তবতা। বর্তমানে দরবার-দরগাহগুলোতে পারস্যের পেট্রো-ডলারের জোরে শিয়া মতবাদে দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তারা টার্গেট করছে তরীকতপন্থীদের। অসাবধান তরীকতপন্থীরা, বিশেষ করে বিভিন্ন দরবারের অনেক বকলম-বাহাদুর আওলাদ শিয়াদের এ ফাঁদে পা দিচ্ছে। কেবল অর্থলোভ নয়, মোত’আ বেশ্যা নারীর লোভ দেখিয়েও বাতীলপন্থীরা ফাঁদ পেতেছে।
এই পরিস্থিতিতে আমরা দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, অনুগ্রহ করে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুণ্ডি করে যে শিয়া পেট্রো-ডলার আসছে এবং বিভিন্ন দরবারের লোকদের ও মৌ-লোভীদের কাছে যাচ্ছে, সেদিকে নজরদারি বাড়ান এবং ব্যবস্থা নিন। এটা বন্ধ করতে পারলে এক মুহূর্তে শিয়া মতবাদের এই মোহ কেটে যাবে।
শেষ কথা হলো, স্ক্রীনশট-কারবারিদের প্রতি আমার চ্যালেঞ্জ: আমার অনূদিত বইয়ের ক্রিটিক লেখার ও প্রকাশ করার সামর্থ্য থাকলে তা করুন! দেখা যাবে কতোখানি জ্ঞানী আপনারা! আমার বই বাজারে আছে। সানজেরী পাবলিকেশন চট্টগ্রাম থেকে তা ছেপেছে, আর সারা দেশে তা প্রসার লাভ করেছে। শিয়াচক্র ছাড়া কেউই উচ্চবাচ্য করেন নি। বস্তুতঃ শিয়াদের গাত্রদাহের কারণ এ বইটি। তারা অনুবাদককে আক্রমণ করছে, অথচ মূল ইতিহাসবিদ এবং মূল লেখককে কিছুই বলছে না। তারা জানে মুসলিম বিশ্বে এ বই গৃহীত। তারা কেন এ বইয়ের মূল প্রকাশক তুরস্কের হাক্বীক্বত কিতাবেভীর কাছে অভিযোগ দিচ্ছে না? আমি তো স্রেফ এর অনুবাদক মাত্র! মূল জায়গায় আপত্তি উত্থাপনের মুরদ নেই, এসেছে এখানে বাহাদুরি ফলাতে! তবে চূড়ান্তভাবে ইয়াযীদের ব্যাপারে ধর্মীয় (সুন্নী) দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলনকারী আমার অনূদিত বইটি ২০২১ সালে ‘ফাদাক বাগান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। ওতে ‘ইয়াযীদ সম্পর্কে আহলুস্ সুন্নাহর সিদ্ধান্ত’ অধ্যায়টি সবাই পড়ে দেখুন।
লিঙ্ক: আরবী সংস্করণ পিডিএফ ১৬টি ফাইল: https://archive.org/details/tarikhislam-tabari;
উর্দূ সংস্করণ পিডিএফ ৭টি ফাইল: https://archive.org/details/Tareekh-e-Tabri-Urdu;