Thursday 21 November 2013

মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের বৈধতা





-ড: ঈসা আল-মানে’ আল-হুমাইরী,
আওক্কাফ দপ্তর, দুবাই
ধর্ম ও ইসলাম-বিষয়ক কার্যালয় [ইফতা ও গবেষণা বিভাগ, দুবাই সরকার]
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন 


[আমার পীর ও মুরশেদ চট্টগ্রাম আহলা দরবার শরীফের সৈয়দ মওলানা আবু জাফর 
মোহাম্মদ সেহাবউদ্দীন খালেদ (রহ:)-এর পুণ্য স্মৃতিতে উৎসর্গিত]

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

বর্তমানে আমরা মিথ্যা ও ধোকাপূর্ণ বিভিন্ন প্রকাশনা দেখতে পাই যা মুসলমান সর্বসাধারণকে বিভ্রান্ত করে এবং তাঁরা মহানবী (দ:)-এর সম্মানিত মওলিদ/মীলাদ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেন। এ সব প্রকাশনায় দাবি করা হয় যে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন ইসলামবিরোধী এক নতুন উদ্ভাবিত প্রথা বৈ কিছু নয়। এটি সত্য থেকে যোজন যোজন দূরে; আর তাই যাঁরা স্পষ্টভাবে এ ব্যাপারে বলতে পারেন, তাঁদের জন্যে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে এই সবচেয়ে বরকতময় দিনটি সম্পর্কে সন্দেহের অপনোদন করা জরুরি। এই মহৎ উদ্দেশ্যে আমি ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর পক্ষে নিম্নের দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করছি।

রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মে নতুন কোনো কিছু পরিবেশন করে যা এই ধর্মে নেই, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।” তিনি আরও ফরমান: “বেদআত (নতুন উদ্ভাবিত প্রথা) হতে সতর্ক হও, কেননা সকল বেদআত-ই গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা” [কুল্লু বেদআতিন্ দালালাতুন্]।

মীলাদবিরোধীরা এই হাদীস উদ্ধৃত করে বলে যে আরবী ‘কুল’ (সকল) শব্দটি সার্বিক, যা’তে অন্তর্ভুক্ত - কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই - সব ধরনের উদ্ভাবিত প্রথা; আর তাই মীলাদ হলো গোমরাহী। এ কথা বলার দুঃসাহস দেখিয়ে তারা ইসলামী উলামাদের বিরুদ্ধে নতুন প্রথা প্রবর্তনের অভিযোগ এনে থাকে। তারা যে জ্ঞান বিশারদদের প্রতি এই অপবাদ দেয় তাঁদের অগ্রভাগে রয়েছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা:)। এই বিরোধীরা এর ত্বরিত উত্তর দেয় এ কথা বলে, “আমরা তো হুযূর পাক (দ:)-এর সাহাবীদের ব্যাপারে বলি নি।”

বস্তুতঃ ‘কুল’ বা ‘সকল’ শব্দটিকে সার্বিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না। তাই মহানবী (দ:) যদিও বা নিজের পবিত্র বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) দিবস পালনের কথা বলেন নি, তবুও তা পালন করা বেদআত নয়। কেননা, নিচে পেশকৃত উদাহরণগুলো প্রতীয়মান করে যে সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-বৃন্দ হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বেসালের পরে বহু নতুন কাজ ও প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন যা বেদআত হিসেবে পরিগণিত হয় নি।

আল-কুরআন সংকলন

সাহাবী হযরত যায়দ ইবনে সাবেত (রা:) হতে বর্ণিত: “মহানবী (দ:)-এর বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার পর কুরআন মজীদ কোথাও সংকলন করা হয় নি। এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক (রা:) খলীফা হযরত আবু বকর (রা:)-কে একটি গ্রন্থে তা সংকলনের পরামর্শ দেন। যখন ইয়ামামার যুদ্ধে বহু সংখ্যক সাহাবী শহীদ হন, তখন হযরত আবু বকর (রা:) ভাবনায় পড়েন, ‘হুযূর পাক (দ:) যা করেন নি, আমরা তা করি কীভাবে?’ হযরত উমর (রা:) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! এটা উত্তম কাজ।’ তিনি খলীফাকে এতে উৎসাহিত করেন, যার দরুন ওই পরামর্শের সাথে তিনি একমত হয়ে হযরত যায়দ ইবনে সাবেত (রা:)-কে তলব করেন এবং কুরআন সংকলনের ভার অর্পণ করেন।” হযরত যায়দ (রা:) বলেন, “আল্লাহর কসম, যদি তাঁরা কোনো পাহাড় সরাতেও আমাকে বলতেন, তথাপিও তা কুরআন সংকলনের মতো এতো কঠিন কাজ হতো না।” এই রওয়ায়াত বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে।

কাবা শরীফের সাথে সম্পর্কিত মাকাম-এ-ইবরাহীম     

হযরত আয়েশা (রা:) থেকে ইমাম বায়হাকী (রহ:) নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (দ:) ও হযরত আবু বকর (রা:)-এর সময়ে ‘মাকাম-এ-ইবরাহীম’ কাবা ঘরের সাথে যুক্ত ছিল; অতঃপর হযরত উমর (রা:) তা সেখান থেকে সরান।” হাফেয ইবনে হাজর তাঁর ‘আল-ফাতহ’ পুস্তকে বলেন, “সাহাবায়ে কেরাম হযরত উমর ফারূক (রা:)-এর বিরোধিতা করেন নি; তাঁদের পরে যাঁরা আসেন, তাঁরাও এর বিরোধিতা করেন নি। ফলে এতে এজমা (প্রাথমিক যুগের মুসলমান বিদ্বানদের ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” হযরত উমর (রা:)-ই সর্বপ্রথম ওতে ’মাকসুরা’ তথা ঘের নির্মাণ করেন যা আজও বিদ্যমান।

জুম’আর নামাযে প্রথম আযানের প্রবর্তন

হযরত সা’য়েব বিন এয়াযিদ (রা:) হতে সহীহ আল-বুখারীতে উদ্ধৃত, তিনি বলেন: “মহানবী (দ:), হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত উমর (রা:)-এর সময় শুক্রবারের জুম’আ নামাযের আযান দেয়া হতো এমন মুহূর্তে যখন ইমাম সাহেব মিম্বরে বসতেন। হযরত উসমান (রা:)-এর যুগে তিনি তৃতীয় আযানটি যুক্ত করেন (একে তৃতীয় বিবেচনা করা হয় প্রথম আযান ও একামতের সূত্রে। কিন্তু এর নামকরণ প্রথম আযান এই কারণে যে এটা জুম’আর আযানের পরে দেয়া হয়)।”

মহানবী (দ:)-এর প্রতি সালাত-সালাম যা হযরত আলী (ক:) রচনা করেছেন ও শিখিয়েছেন 

এই ‘সালাওয়াত’ (দরুদ-সালাম) হযরত সাঈদ ইবনে মনসুর (রা:) ও ইবনে জারির তাবারী নিজ ‘তাহযিব আল-আসার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন; এছাড়াও উল্লেখ করেছেন ইবনে আবি আসিম ও এয়াকুব ইবনে শায়বা তাঁর ‘আখবারে আলী (ক:)’ পুস্তকে; আর ইমাম তাবরানী ও অন্যান্যরা উদ্ধৃত করেছেন হযরত সালামাহ আল-কিন্দী (রা:) থেকে।

’তাশাহহুদ’-এ হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর সংযোজন

নামাযের ’তাশাহহুদে’ বসে ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’ (এবং আল্লাহর করুণা ও আশীর্বাদ বর্ষিত হোক), এই সালাত-সালামের সাথে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) পড়তেন, ‘আস্ সালামু আলাইনা মিন রাব্বিনা’ (আমাদের প্রভুর কাছ থেকে আমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক)। এর বর্ণনাকারী আত্ তাবারানী নিজ ‘আল-কবীর’ কেতাবে এটি উদ্ধৃত করেছেন, আর ‘মজমা’উল যাওয়াঈদ’ পুস্তকের ভাষ্যানুযায়ী এর বর্ণনাকারীরা নির্ভরযোগ্য।

’তাশাহহুদ’-এ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:)-এর সংযোজন 

হযরত ইবনে উমর (রা:) ‘তাশাহহুদ’-এর প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহ’ যোগ করেন। তিনি (হজ্জ্বের) ‘তলবিয়া’র সাথেও যোগ করেন - ‘লাব্বাইকা ওয়া সা’দাইকা ওয়াল খায়রু বি ইয়াদাইকা ওয়াল রাগবা’উ ইলায়িকা ওয়াল ‘আমালু’। এর বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে আল-বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্যদের বইতে।

রাসূলে পাক (দ:)-এর সময়ে ছিল না এমন অনেক কাজ ও প্রথা তাঁরই সাহাবায়ে কেরাম (রা:), উলামায়ে কেরাম ও তাঁরই উম্মতের সম্মানিত অনুসারীদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল, যেগুলোকে তাঁরা নেক তথা পুণ্যময় বিবেচনা করেছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁরা কি পথভ্রষ্ট ও মন্দ বেদআত চালু করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন?

ধর্মে উত্তম বেদআত বলে কিছু নেই, এই দাবি মিথ্যা প্রমাণার্থে নিচে সম্মানিত বুযূর্গানে দ্বীনের বাণীসমূহ পেশ করা হলো:

ইমাম নববী তাঁর কৃত ’শরহে মুসলিম’ (৬:২১) কেতাবে বলেন, “হুযূর পাক (দ:)-এর কথা ‘কুল্লু’ (সকল) একটি সার্বিক-বিশেষ শব্দ এবং তা অধিকাংশ বেদআত (নতুন উদ্ভাবন)-কে উদ্দেশ্য করেছে। ভাষাতত্ত্ববিদগণ বলেন, ‘বেদআত হলো পূর্ববর্তী ধরনের (প্রথার) সাথে ধারাবাহিকতাহীন কোনো কর্ম, আর এটা পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে’।” ইমাম নববী তাঁর প্রণীত ‘তাহযিব আল-আসমা’ ওয়াল সিফাত’ গ্রন্থে আরও বলেন, “ধর্মীয় আইনে বেদআত হলো মহানবী (দ:)-এর সময়ে অস্তিত্বশীল ছিল না এমন কোনো কিছু প্রবর্তন করা; আর এটা ভাল ও মন্দ দুই ভাগে বিভক্ত।” তিনি আরও বলেন, “আল-মোহদাসাত (মোহদাসা-এর বহুবচন) শব্দটির অর্থ ধর্মীয় আইনে মূলবিহীন কোনো প্রথা বা কর্ম চালু করা। ধর্মীয় আইনের প্রথায় একে বলা হয় বেদআত; কিন্তু তাতে এর মূল নিহিত থাকলে এটা বেদআত নয়। ধর্মীয় আইনে বেদআত ধর্মবিরোধী, যা ভাষায় চালু করা সকল মূলবিহীন উদ্ভাবন, চাই তা ভাল হোক বা মন্দ, তার অনুরূপ নয়।”

শায়খ ইবনে হাজর আসকালানী, যিনি আল-বুখারীর ব্যাখ্যা লিখেছেন, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যুগে ছিল না এমন যে কোনো কিছুই বেদআত হিসেবে অভিহিত। তবে এর কিছু কিছু ভাল, আবার কিছু কিছু মন্দ।”

আবু নায়ীম বর্ণনা করেন ইবরাহীম আল-জুনাইদ থেকে, তিনি বলেন: “আমি ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-কে বলতে শুনেছি, ‘বেদআত দুই প্রকার; প্রশংসনীয় বেদআত ও দূষণীয় বেদআত। যা কিছু সুন্নাহের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, তা-ই দূষণীয় বেদআত।”

ইমাম আল-বায়হাকী তাঁর ‘মানাক্কিব আশ্ শাফেয়ী’ গ্রন্থে ইমাম শাফেয়ীকে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: “বেদআত দুই ধরনের; যা কুরআন, সুন্নাহ কিংবা মুসলমান (উলামাদের) ঐকমত্যের খেলাফ, তা একটি ধোকাপূর্ণ বেদআত (উদ্ভাবন)। পক্ষান্তরে, একটি উত্তম বেদআত এগুলোর কোনোটারই পরিপন্থী নয়।”

আল-ইযয্ ইবনে আব্দিস্ সালাম নিজ ‘আল-কাওয়াঈদ’ পুস্তকের শেষে বলেন: “বেদআত বাধ্যতামূলক, নিষিদ্ধ, পছন্দনীয়, অপছন্দনীয় ও অনুমতিপ্রাপ্ত - এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত; আর এগুলোর কোনটি কী, তা নির্ণয়ে ধর্মীয় আইনের নিরিখে এগুলোর যাচাই-বাছাই প্রয়োজন।”

আমরা ওপরে উদ্ধৃত হক্কপন্থী বুযূর্গ উলামাদের মতামত থেকে জানতে পারলাম যে এবাদতের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সকল বেদআতকে মন্দ হিসেবে ব্যাখ্যা করা নিতান্তই মূর্খতা। কেননা, এই পুণ্যবান জ্ঞান বিশারদবৃন্দ যাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ইমাম নববী ও ইমাম শাফেয়ী, তাঁরা ঘোষণা করেছেন যে শরীয়তের আইন-কানুনের সাথে সঙ্গতি বা বিচ্যুতির ভিত্তিতে বেদআতকে উত্তম বা মন্দ হিসেবে বিভক্ত করা যায়।

উপরন্তু, নিম্নের হাদীসটি উলামাবৃন্দ ছাড়াও মুসলমান সর্বসাধারণের জ্ঞাত; হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান: “যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্মে কোনো সুন্নাতুন্ হাসানা তথা উত্তম প্রথা/রীতি প্রবর্তন করেন, তিনি ওর সওয়াব পান এবং যারা তাঁর পরে ওতে আমল করেন, তাদের সওয়াবও তিনি পেতে থাকেন; আর তাদের (পরবর্তী আমলকারীদের) সওয়াবেরও এতে ন্যূনতম কমতি হয় না।” অতএব, কোনো মুসলমানের পক্ষে একটি নেক (পুণ্যময়) আমল বা প্রথা প্রবর্তন করা অনুমতিপ্রাপ্ত, যাতে নেক মকসূদ (উদ্দেশ্য) পুরো হয় এবং সওয়াব অর্জন করা যায়, যদি ওই আমল মহানবী (দ:) পালন না-ও করে থাকেন। উত্তম রীতি/প্রথা প্রবর্তনের (সান্না সুন্নাতুন্ হাসানা) মানে হলো শরীয়তের আইন-কানুন বা শাস্ত্র থেকে এজতেহাদ (নিজস্ব রায়) ও এস্তেনবাত (আহরণ)-এর মাধ্যমে কোনো আমলকে প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের দ্বারা ওপরে উদ্ধৃত রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সাহাবাবৃন্দের এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের আমল ও কাজই এর পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ।

মহানবী (দ:)-এর বেলাদত দিবস (মীলাদুন্নবী) উদযাপনের বিরোধীরা স্বল্প-শিক্ষিত মুসলমানদেরকে ধোকা দিয়ে নিজেদের মিথ্যাচারের প্রচার-প্রসার করেছে। তারা দাবি করে থাকে, ইবনে কাসীর তার ‘আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া’ (১১:১৭২) পুস্তকে লিখেছেন যে ইহুদী বংশোদ্ভূত ফাতেমী-ওবায়দী রাষ্ট্রের মিসরীয় শাসক উবায়দুল্লাহ বিন্ মায়মুন আল-কাদ্দাহ (শাসনকাল - ৩৫৭-৩৬৭ হিজরী) কিছু সংখ্যক দিবস উদযাপনের প্রথা প্রবর্তন করেন, যার মধ্যে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) একটি। এই ধোকাপূর্ণ মিথ্যা ইবনে কাসীরের এবং সমস্ত ইসলামী উলামার জ্ঞান-গরিমার প্রতি এক বড় ধরনের অপমান ছাড়া কিছু নয়। সত্য হলো, ইবনে কাসীর ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) সম্পর্কে ’আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’ (১৩:১৩৬) গ্রন্থে বলেন: “বিজয়ী সুলতান আবু সাঈদ কাওকাবুরী অত্যন্ত উদার, বিশিষ্ট নেতা, এবং মহিমান্বিত রাজা ছিলেন; তিনি অনেক ভাল কাজ রেখে যান। তিনি পবিত্র মীলাদুন্নবী (দ:) জাঁকজমকের সাথে উদযাপন করতেন। অধিকন্তু, তিনি ছিলেন মর্যাদাবান, সাহসী বীর, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ, এবং ন্যায়পরায়ণও।” ইবনে কাসীর আরও বলেন, “সুলতান মীলাদুন্নবী (দ:) উপলক্ষে তিন লক্ষ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ব্যয় করতেন।” এর সমর্থনে আয্ যাহাবী তাঁর ‘সিয়ার আলম আল-নুবালা’ (২২:৩৩৬) কেতাবে সুলতান আবু সাঈদ কাওকাবুরী সম্পর্কে লিখেন: “তিনি ছিলেন বিনয়ী, ন্যায়বান ও (বুযূর্গ) আলেম-উলামাবৃন্দের প্রতি মহব্বতশীল।”

মীলাদুন্নবী (দ:) সম্পর্কে হক্কপন্থী ইমামবৃন্দের কিছু কথা নিচে দেয়া হলো:

ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) তাঁর ‘আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’ গ্রন্থে ‘মীলাদ উদযাপনে সৎ উদ্দেশ্য’ শিরোনামে একটি বিশেষ অধ্যায় রচনা করেন যার প্রারম্ভে তিনি বলেন, “রবিউল আউয়াল মাসে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন সম্পর্কে একটি প্রশ্ন করা হয় যে এ ব্যাপারে ধর্মীয় বিধান কী হবে? এটা কি উত্তম, না মন্দ? যে ব্যক্তি এটা উদযাপন করেন, তিনি কি সওয়াব (পুরস্কার) অর্জন করেন, নাকি করেন না? আমার মতে এর ফয়সালা হলো, মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন যা মূলতঃ মানুষদের সমবেত করা, কুরআনের অংশ-বিশেষ তেলাওয়াত, মহানবী (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমন (বেলাদত) সংক্রান্ত ঘটনা ও লক্ষ্মণগুলোর বর্ণনা পেশ, অতঃপর তবাররুক (খাবার) বিতরণ এবং সবশেষে সমাবেশ ত্যাগ, তা উত্তম বেদআত (উদ্ভাবন); আর যে ব্যক্তি এর অনুশীলন করেন তিনি সওয়াব অর্জন করেন, কেননা এতে জড়িত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মহান মর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাঁর সম্মানিত বেলাদতের প্রতি খুশি প্রকাশ।”

ইবনে তাইমিয়া নিজ ’আল-সীরাত আল-মুস্তাকীম’ (২৬৬ পৃষ্ঠা) পুস্তকে বলে: “অনুরূপভাবে, খৃষ্টানদের যীশু খৃষ্টের (হযরত ঈসা আ:) জন্মদিন পালনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাস্বরূপ হোক কিংবা মহানবী (দ:)-এর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপই হোক, মুসলমান সমাজ মীলাদ অনুষ্ঠানে যা আমল করেন তাঁদের এই ধরনের এজতেহাদের জন্যে আল্লাহ পাক অবশ্যই তাঁদেরকে ‍পুরস্কৃত করবেন।” ইবনে তাইমিয়া অতঃপর লিখে, “মীলাদ যদিও বা সালাফ (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাগণ) কর্তৃক আচরিত হয় নি, তথাপি তাঁদের তা অনুশীলন করা উচিত ছিল। কেননা, শরীয়তের দৃষ্টিতে এর বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি ছিল না।” এখানে ইবনে তাইমিয়া ধর্মীয় গোঁড়ামি বাদ দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল )দ:)-এর রেযামন্দি হাসিলের কথা বলেছে। আমাদের বেলায় আমরা মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে থাকি অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু ইবনে তাইমিয়া যা বলেছে ওই উদ্দেশ্যেই - “মহানবী (দ:)-এর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ”। এই ভালোবাসা ও নেক উদ্যোগের জন্যে আল্লাহতা’লা আমাদের পুরস্কৃত করুন, আমীন! আর তিনি তাকেও পুরস্কৃত করুন যে ব্যক্তি বলেছিল - “খৃষ্টানরা তাদের নবী সম্পর্কে যা দাবি করে তা বাদই দিন, আপনারা যেভাবে চান মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা করতে পারেন এবং তাঁর সত্তা মোবারকের প্রতি সকল গুণ/বৈশিষ্ট্য ও তাঁর মর্যাদার প্রতি সকল মাহাত্ম্য আরোপ করতে পারেন; কেননা তাঁর অসীম গুণাবলী ভাষায় ব্যক্ত করা যে কোনো বক্তার পক্ষেই সাধ্যাতীত।”

ইমাম সৈয়ুতী (রহ:)-এর ওপরে উদ্ধৃত একই গ্রন্থে তিনি বলেন: “মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন বিষয়ে কেউ একজন ইমাম ইবনে হাজর (রহ:)-কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি জবাবে বলেন, ‘মীলাদুন্নবী (দ:) পালন মূলতঃ এমন এক উদ্ভাবন যা প্রথম তিন শতাব্দীর পুণ্যবান মুসলমানবৃন্দ কর্তৃক রওয়ায়াত করা হয় নি। তবে, এতে ভাল ও তার পরিপন্থী বিষয়সমূহ আছে; সুতরাং যদি কেউ ভালগুলো বেছে নেন এবং খারাপগুলো এড়িয়ে চলেন, তাহলে এটা উত্তম উদ্ভাবন।’ আমি (ইমাম সৈয়ুতী) এর প্রতিষ্ঠিত উৎস খুঁজে বের করার বিষয়টি মনস্থ করলাম, যা মৌলিক সহিহাইন (বুখারী ও মুসলিম) গ্রন্থ দুটোতে বিধৃত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (দ:) মদীনায় হিজরত করার পর তিনি দেখতে পান যে ইহুদী জাতি আশুরার (১০ই মহররম) দিন রোযা রাখে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা তাঁকে বলে, ‘এই দিন আল্লাহতা’লা ফেরাউনকে পানিতে ডুবিয়ে মারেন এবং মূসা (আ:)-কে রক্ষা করেন। তাই আমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই দিন রোযা রাখি।’ এই ঘটনা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে কোনো নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর রহমত (করুণা) নাযেল তথা অবতীর্ণ হলে কিংবা অপমান বা ক্ষতি থেকে তাঁর সুরক্ষা পেলে শোকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করা হয়।” ইমাম সৈয়ুতী এরপর বলেন, “যে দিন রহমতের নবী (দ:) এই ধরাধামে শুভাগমন করেন, তার চেয়ে বড় নেয়ামত আর কী হতে পারে?”

হযরত ইমাম আরও বলেন, “এটা মীলাদের ভিত্তি সংক্রান্ত। আর আমল প্রসঙ্গে, আল্লাহর প্রতি যা কিছু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শুধু তা্-ই বৈধ; যেমন ইতিপূর্বে বলা হয়েছে: কুরআন তেলাওয়াত, তবাররূক-খাদ্য গ্রহণ, দান-সদকাহ, রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সম্মানে কবিতা (শে’র/পদ্য/গজল/সেমা) আবৃত্তি অথবা নেক আমল সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে যা অন্তরকে ভাল ও পরকালীন কল্যাণময় কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ বা পরিচালিত করে।”

মীলাদ-বিরোধীরা যে সব লেখনীকে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত ও অসিদ্ধ তুলনামূলক বিচারপদ্ধতির ফসল মনে করে থাকে তার কয়েকটি নিচে দেয়া হলো:

ইমাম মোহাম্মদ ইবনে আবি বকর আব্দিল্লাহ আল-কায়সী আদ্ দিমাশকী কৃত ‘জামে’ আল-আসার ফী মাওলিদ’; ‘আন্ নবীই্য আল-মুখতার’; আল-লফয আল-রায়েক্ক ফী মাওলিদে খায়র আল-খালায়েক্ক’; এবং ‘মাওলিদ আল-সাদী ফী মাওলিদ আল-হাদী’।

ইমাম আল-এরাকী প্রণীত ‘আল-মাওলিদ আল-হেনী ফীল-মাওলিদ আস্ সানী’।

মোল্লা আলী কারী রচিত ‘আল-মাওলিদ আল-রাওয়ী ফীল-মাওলিদ আন্ নববী’।

ইমাম ইবনে দাহিয়্যা লিখিত ‘আত্ তানউইর ফী মাওলিদিল বাশীর আন্ নাযীর’।

ইমাম শামসুদ্দীন ইবনে নাসির আল-দিমাশকী প্রণীত ‘মাওলিদ আল-সাদী ফী মাওলিদিল্ হাদী’। হুযূর পাক (দ:)-এর পথভ্রষ্ট চাচা আবু লাহাব সম্পর্কে হযরত ইমাম বলেন, “এই অবিশ্বাসী সম্পর্কে আল-কুরআনে নিন্দা করা হয়েছে এই বলে - ‘তার হাত দুটো ধ্বংস হোক’ [১১১:১]। সে চিরকাল জাহান্নামে বসবাস করবে। তথাপি প্রতি সোমবার তার শাস্তি লাঘব করা হয়, কারণ সে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেলাদতে (পৃথিবীতে শুভাগমনে) খুশি প্রকাশ করেছিল (এই সুসংবাদ বহনকারিনী তার দাসী সোয়াইবিয়াকে মুক্ত করে দিয়ে)।” এমতাবস্থায় ওই গোলাম-ব্যক্তি কতোই না রহমত (করুণা) আশা করতে পারেন যিনি সারা জীবন মহানবী (দ:)-এর প্রতি খুশি প্রকাশ করেছেন এবং আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস রেখে ইন্তেকাল করেছেন?

ইমাম শামসুদ্দীন ইবনে আল-জাযরী কৃত ‘আন্ নাশর ফীল্ ক্কেরআতে আল-আশর’; ‘উরফ আল-তা’রীফ বিল্ মাওলিদ আশ্ শারীফ’।

ইমাম ইবনে আল-জাওযী মীলাদ সম্পর্কে বলেন, “এটা সারা বছরের জন্যে নিরাপত্তা, আর সকল (নেক) ইচ্ছা ও প্রার্থনা পূরণের শুভসংবাদ।”

ইমাম আবু শামা (ইমাম নববীর পীর) নিজ ‘আল-বা’য়েস্ ‘আলা এনকার আল-বেদআ’ ওয়াল-হাওয়াদিস্ (২৩ পৃষ্ঠা) পুস্তকে বলেন, ”আমাদের সময়কার অন্যতম সেরা উদ্ভাবন হচ্ছে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) দিবস উদযাপন, যা’তে দান-সদকা ও নেক আমল পালন করা হয়, জাঁকজমক এবং খুশি প্রকাশ করা হয়। কেননা, এতে উদযাপনকারীদের অন্তরে যে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধানুভূতি বিদ্যমান তা প্রকাশ পায়; অধিকন্তু আল্লাহতা’লা বিশ্বজগতের প্রতি তাঁরই রহমত হযরত রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে পৃথিবীতে পাঠানোর মাধ্যমে যে নিজ নেয়ামত বর্ষণ করেছেন, তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়।”

ইমাম আল-শেহাব আল-কসতলানী তাঁর ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ (১:১৪৮) গ্রন্থে বলেন, “আল্লাহতা’লা ওই ব্যক্তির প্রতি রহমত (করুণা) বর্ষণ করুন যিনি অসুস্থ অন্তরগুলোর দুঃখ-কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে মহানবী (দ:)-এর বেলাদতের মাসের (রবিউল আউয়াল) প্রতিটি রাতকে খুশি উদযাপনে ব্যয় করেন।”

মীলাদুন্নবী (দ:) সম্পর্কে ইমাম সাখাভী, ইমাম ওয়াজিহুদ্দীন ইবনে আলী ইবনে আল-দায়বা’ আল-শায়বানী আল-যুবায়দী প্রমুখসহ আরও অনেক উলেমা-এ-দ্বীন লিখেছেন এবং বলেছেন; তাঁদের সবার বক্তব্য এখানে স্থানাভাবে আমরা উদ্ধৃত করতে পারলাম না। এ সকল বহু প্রামাণ্য দলিল থেকে এতোক্ষণে নিশ্চয় সুস্পষ্ট হয়েছে যে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটা কাজ এবং তা অনুমতিপ্রাপ্ত আমলও। এই উম্মতের সে সব জ্ঞান বিশারদ ও উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব যাঁরা মীলাদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপনকে অনুমোদন করেছেন এবং এর পক্ষে অগণিত বইপত্র লিখেছেন, তাঁদেরকে আমরা অবশ্যই গোমরাহ-পথভ্রষ্ট বলে অবজ্ঞা করতে পারি না। হাদীস, ফেকাহ, তাফসীর এবং অন্যান্য জ্ঞানের শাস্ত্রে উপকারী বইপত্র লেখার জন্যে সারা বিশ্ব যাঁদের কাছে ঋণী, সেই জ্ঞান বিশারদবৃন্দ কি পাপী ও বদকারদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত? তাঁরা কি যীশু খৃষ্টের জন্মদিন উদযাপনকারী খৃষ্টানদের অনুসরণ করছেন, যেমনিভাবে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরোধিতাকারীরা দাবি করছে? এই বিরোধীরা কি দাবি করছে যে মহানবী (দ:) তাঁর উম্মতকে কী করতে হবে তা জানান নি? আমরা আপনাদের (মুসলমান সমাজের) কাছে এ সব প্রশ্নের উত্তরের ভার অর্পণ করছি।

এতদসত্ত্বেও মীলাদবিরোধীরা যে সব ভুল কথাবার্তা বলে, সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ আমাদের করতে হবে। তারা বলে, “মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন যদি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হতো, তাহলে রাসূলুল্লাহ (দ:) তা উম্মতের কাছে স্পষ্ট করতেন, অথবা নিজ হায়াতে জিন্দেগীতে পালন করতেন; কিংবা তাঁর সাহাবামন্ডলী তা উদযাপন করতেন।” কেউই এ কথা দাবি করতে পারবে না যে হুযূর পাক (দ:) তাঁর বিনয়ী স্বভাবের কারণে তা করেন নি; কেননা, তা তাঁর প্রতি অপবাদ বা কুৎসা হবে। অতএব, এই যুক্তি তারা (বিরোধীরা) ব্যবহার করতে পারে না।

উপরন্তু, নবী করীম (দ:) ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ নির্দিষ্ট কোনো কাজ না করার মানে এই নয় যে তাঁরা তা নিষেধ করেছেন। এর প্রমাণ হলো ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হাদীস - “যে কেউ ইসলাম ধর্মে কোনো উত্তম রীতি/প্রথা প্রবর্তন করেন।” এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী দালিলিক প্রমাণ যা শরীয়তের আইনে ভিত্তিশীল কোনো নতুন প্রথা প্রবর্তনের প্রতি উৎসাহ জোগায়, এমন কি যদি তা বিশ্বনবী (দ:) ও তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) পালন করে নাও থাকেন। ইমাম শাফেয়ী বলেন, “ইসলামী আইনে যে বিষয়ের ভিত্তি আছে তা (মন্দ) বেদআত নয়, যদিও বা তা সাহাবাবৃন্দ পালন না করেন। কেননা, তাঁদের তা থেকে বিরত থাকার কারণ হতে পারে ওই সময় তাঁদের বিশেষ কোনো ওযর (কারণ) ছিল, কিংবা তাঁরা ওর চেয়ে আরও ভাল কোনো কিছুর জন্যে ওই কাজ থেকে বিরত ছিলেন; অথবা হয়তো তাঁদের সবাই এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না।” অতএব, মহানবী (দ:) পালন করেন নি, এই ধারণার ভিত্তিতে যে কেউ কোনো আমলকে নিষেধ করলে তার দাবিটি ভিত্তিহীন সাব্যস্ত হবে এবং তা প্রত্যাখ্যাত হবে।

সুতরাং আমরা মীলাদবিরোধীদের বলবো: তোমরা যে আইনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছ মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) করেন নি এমন কোনো আমল পালন করলে বেদআত হবে, তা থেকেই নিঃসৃত হচ্ছে যে মহানবী (দ:) তাঁর উম্মতের জন্যে দ্বীনকে পুরো করেন নি, আর এ কথাও তিনি উম্মতকে জানান নি তাঁদের কী করণীয়। এ কথা আল্লাহর ধর্মত্যাগী গোমরাহ ব্যক্তিরা ছাড়া আর কেউ বলে না। মীলাদ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণকারীদের প্রতি আমরা ঘোষণা করি, “তোমরা যা বলছো, তার ভিত্তিতে আমরা তোমাদের দোষী সাব্যস্ত করি।” কেননা, তোমরা এবাদতের মধ্যে এমন বহু বেদআত পরিবেশন করেছ, যা মহানবী (দ:) পালন করেন নি, তাঁর সাহাবীগণও করেন নি, তাবেঈন বা তাবে তাবেঈনগণও করেন নি। উদাহরণস্বরূপ, 

* মক্কা ও মদীনা শরীফের দুটো মসজিদ এবং অন্যান্য মসজিদে তারাবীহ’র নামাযের পরে তাহাজ্জোদ নামায ইমামের পেছনে জামাতে পড়ানো;

* তারাবীহ’র নামাযে এবং তাহাজ্জোদের নামাযেও কুরআন খতম (খতমে তারাবী) করা;

* পবিত্র দুটো মসজিদে ২৭শে রমযান রাতে কুরআন খতম দেয়া;

* তারাবীহ’র নামাযের একামতে আযানদাতার “আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করুন” বলা;

* মহানবী (দ:)-এর যুগে ছিল না এমন প্রতিষ্ঠান স্থাপন; যেমন - ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, কুরআন হেফযের জন্যে বিভিন্ন পরিষদ, দাওয়া বা প্রচারের উদ্দেশ্যে দপ্তর, এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার জন্যে সংস্থাসমূহ। আমরা এগুলোর প্রতি আপত্তি উত্থাপন করছি না, যেহেতু এগুলো উত্তম বেদআতের নমুনা। আমরা শুধু এগুলোর তালিকা পেশ করেছি এটা দেখাতে যে মীলাদবিরোধীরা মহানবী (দ:) কিংবা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) যা পালন করেন নি তা-ই বেদআত মর্মে যে দাবি করছে তা তাদেরই স্থাপিত মানদণ্ডের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। আর যেহেতু তারা নিজেরাই দাবি করে যে সকল বেদআতই মন্দ, সেহেতু তারাই এখানে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হচ্ছে।

মীলাদবিরোধীরা আরেকটি দাবি করে থাকে যে এর উদযাপনকারীরা বেশির ভাগই অসভ্য ও নীতিভ্রষ্ট। এটা আসলে একটা স্থূল মন্তব্য এবং এতে মন্তব্যকারীর চরিত্রই প্রতিফলিত হয় মাত্র। আমাদের উল্লেখিত সকল সম্মানিত উলামা-এ-কেরাম কি মীলাদবিরোধীদের এই দাবি অনুযায়ী অসভ্য ও নীতিভ্রষ্ট? আমরা বিস্মিত হবো না যদি তারা এ রকম ধারণা পোষণ করে থাকে। বস্তুতঃ এটা সবচেয়ে গুরুতর কুৎসা রটনা ছাড়া আর কিছু নয়। কবির ভাষায় আমরাও বলি, “আল্লাহ যদি (কারো) কোনো গুণ প্রচার করতে চান, তাহলে তিনি কোনো হিংসুক ব্যক্তির জিহ্বা দ্বারা তা ছড়িয়ে দেন।”

আল্লাহতা’লা মীলাদবিরোধীদের হেদায়াত দিন, কেননা তারা কিছু বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছে। তারা দাবি করে যে কতিপয় উলামা-এ-দ্বীন আল্লাহর সাথে শেরক (অংশীবাদ) করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম বুসীরী (রহ:) কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি আরয - “হে সৃষ্টিতে সবচেয়ে সহৃদয় সত্তা, চূড়ান্ত বাস্তবতার মুহূর্তে (অর্থাৎ, রোজ কেয়ামতে) আপনি ছাড়া আর কেউই নেই আমার আশ্রয়স্থল।” হযরত ইমামের এই কথাকে বিরোধীদের সযত্ন বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন: ’ইনদা হুলুল আল-হাদীস আল-আমিম’; ’আমিম’ মানে কী? তা হলো সারা বিশ্বজগতকে, সকল সৃষ্টিকে যা গ্রাস করবে; এটাই হলো চূড়ান্ত বাস্তবতা, অর্থাৎ, রোজ কেয়ামত। ইমাম বুসীরী (রহ:) মহানবী (দ:)-এর কাছে ওই দিনের জন্যে শাফায়াত (সুপারিশ) প্রার্থনা করছেন, কারণ ওই দিন আমরা আর কারো কাছে আশ্রয় পাবো না, আবেদন জানাবার জন্যেও কেউ থাকবে না। হযরত ইমাম আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছেন প্রিয়নবী (দ:)-এর মাধ্যমে, কেননা অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ যখন ‘এয়া নফসী, এয়া নফসী’ (আমি, আমি) বলবেন, তখন বিশ্বনবী (দ:) বলবেন, ‘আনা লাহা, আনা লাহা’ (’আমি শাফায়াতের জন্যে, অর্থাৎ, শাফায়াত আমারই অধিকারে’)। এক্ষণে আরও সুস্পষ্ট হয়েছে যে মীলাদবিরোধীদের সংশয়ের কোনো ভিত্তি-ই নেই, ঠিক যেমনি আল্লাহর সাথে শরীক করার বিষয়ে উত্থাপিত তাদের অভিযোগ একদমই ভিত্তিহীন। এটা তাদের অন্ধত্বের কারণেই হয়েছে, যে দৃষ্টিহীনতা শারীরিক ও আত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই বিরাজমান।

অনুরূপ আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো ইমাম কামাল ইবনে হুমাম আল-হানাফী যিনি ‘ফাতহ আল-কাদীর ফী মানাসিক আল-ফারিসী’ ও ‘শারহ আল-মুখতার মিন আল-সাদা আল-আহনাফ’ গ্রন্থ দুটোর প্রণেতা, তাঁর বর্ণিত প্রসিদ্ধ ঘটনাটি। ওতে জানা যায়, ইমাম আবু হানিফা (রা:) মদীনা মোনাওয়ারায় হুযূর পাক (দ;)-এর রওযা মোবারক যেয়ারতের সময় রওযামুখী হয়ে আরয করেন, “হে মানব ও জ্বিন জাতি দুটোর সম্মানিতজন! হে মনুষ্য জাতির রত্ন-ভান্ডার, আপনি আমার প্রতি আপনার করুণা বর্ষণ করুন; আর (আমাতে) আপনার রেযামন্দি (সন্তুষ্টি) লাভের দ্বারা আমাকে সন্তুষ্ট করুন। আমি আপনার দয়ার প্রত্যাশী, জগত-সংসারে এই আবু হানিফার আর কেউই নেই আপনি ছাড়া।” হযরত ইমামের এই আরযি আমাদের অপব্যাখ্যা করা উচিত নয়, বরং এর প্রকৃত অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করা উচিত।

মীলাদবিরোধীদের আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা পরিলক্ষিত হয় তাদের পেশকৃত নিম্নের বক্তব্যে: “মীলাদের মজলিশে/মাহফিলে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা হয়, গান-বাদ্য চলে এবং সেই সাথে চলে মদ্যপান।” আমি ব্যক্তিগতভাবে এ কথার অসত্যতা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল, কারণ আমি নিজে বহু মীলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করেছি এবং কখনোই গান-বাদ্য শুনি নি। আর মাস্তি (ভাবোম্মত্ততা) আমি দেখেছি, তবে তা দুনিয়াদার মানুষের নয়। আমি ওই মজলিশে দেখেছি নবীপ্রেমে আসক্ত মানুষদের, এমন হাল-অবস্থায় দেখেছি যা মৃত্যুযন্ত্রণাকেও হার মানায়, যে মৃত্যুকষ্টকে আমরা জানি হযরত বেলাল হাবাশী (রা:) জয় করেছিলেন তাঁর অন্তিম মুহূর্তে। এই মধুর মাস্তির সময় তিনি বলছিলেন, “আগামীকাল আমি আমার প্রিয়নবী (দ:) ও তাঁর সাথীদের সাথে (পরলোকে) মিলিত হবো।”

প্রসঙ্গতঃ মীলাদবিরোধীরা এ কথাও বলে, “রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেলাদত (ধরণীতে ‍শুভাগমন) ও বেসাল (পরকালে আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্তি) সপ্তাহের একই দিনে (সোমবারে) হয়েছে। তাই এই দিন যেমন খুশির, তেমনি বেদনারও। ধর্ম যদি হয় কারো নিজস্ব মতানুযায়ী, তবে এই দিনে পালিত হওয়া উচিত শোক।” এই খোঁড়া যুক্তির খণ্ডন বিধৃত হয়েছে ইমাম সৈয়ুতীর ’আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’ (১৯৩ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে যেখানে তিনি লিখেন: “বিশ্বনবী (দ:)-এর বেলাদত হলো (আল্লাহর) সর্ববৃহৎ নেয়ামত (আশীর্বাদ); আর তাঁর বেসাল মহা দুর্যোগ। ধর্মীয় বিধান আমাদের প্রতি তাকিদ দেয় যেন আমরা আল্লাহর নেয়ামতের শোকরগুজারি (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ) করি এবং দুর্যোগের মুহূর্তে ধৈর্য ধরি ও শান্ত থাকি। শরীয়তের আইনে আমাদের আদেশ দেয়া হয়েছে কোনো শিশুর জন্মে পশু কোরবানি দিতে (এবং ওর গোস্ত গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে)। এটা ওই শিশুর জন্মোপলক্ষে কৃতজ্ঞতা ও খুশি প্রকাশের নিদর্শন। পক্ষান্তরে, মৃত্যুর সময় পশু কোরবানি দিতে শরীয়ত আমাদের আদেশ দেয় নি। উপরন্তু, শোক প্রকাশ বা মাতম করতে শরীয়তে মানা করা হয়েছে। অতএব, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর ‍পুরো মাসব্যাপী খুশি প্রকাশ করার পক্ষে ইসলামী বিধানের রায় পরিদৃষ্ট হয়; আর তাঁর বেসাল উপলক্ষে শোক প্রকাশ না করার পক্ষে মত দেয়া হয়।”

অধিকন্তু, ইবনে রাজাব নিজ ‘আল-লাতাইফ’ গ্রন্থে মীলাদবিরোধীদের উপরোক্ত যুক্তির সমালোচনা করে বলেন, “কেউ কেউ ইমাম হুসাইন (রা:)-এর শাহাদাত দিবস আশুরা-কে শোক দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ কিংবা তাঁর রাসূল (দ:) কেউই আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের বেসাল বা মহা পরীক্ষার দিনগুলোকে শোক দিবস হিসেবে পালনের নির্দেশ দেন নি; এ ক্ষেত্রে অন্যান্যদের কথা তো দূরে।”

আমরা এই লেখা শেষ করবো মহানবী (দ:)-এর একটি হাদীস দ্বারা, যা হযরত হুযায়ফা (রা:) থেকে আবু এয়ালা বর্ণনা করেছেন এবং যার সম্পর্কে ইবনে কাসীর বলেছেন, “এর সনদ বিশুদ্ধ।” আবু এয়ালা বলেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: ‘আমার উম্মতের মধ্যে আমি শংকিত এমন ব্যক্তি সম্পর্কে, যে নাকি কুরআন শিক্ষা করে এবং এর মাহাত্ম্য তার মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া আরম্ভ করা ও তাকে মুসলমানের সুরতে দৃশ্যমান হওয়ামাত্রই সে এই কেতাব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং একে পেছনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়; অতঃপর সে একটি তরবারি নিয়ে তার প্রতিবেশীর দিকে ধেয়ে যায় এবং তার প্রতি আল্লাহর সাথে শেরক করার দোষারোপ করে।’ এমতাবস্থায় আমি হুযূর পূর নূর (দ:)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আল্লাহর সাথে শেরক করার দায়ে এদের মধ্যে কে বেশি দায়ী? যাকে দোষ দেয়া হয়েছে সে, নাকি দোষারোপকারী?’ মহানবী (দ:) জবাবে বল্লেন, ‘দোষারোপকারী’।”

মহানবী (দ:), তাঁর আহলে বায়ত (পরিবার-সদস্যবৃন্দ) এবং তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর প্রতি সালাত-সালাম পেশ করে এই লেখা শেষ করছি।     

                   - সমাপ্ত -    



            

    

             





    

                             





     

    

    

     









  

1 comment:

  1. ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে নিচের লিংকটি পড়ূন
    http://shobujbanglablog.net/60054.html

    ReplyDelete