Monday, 31 March 2014

আল্লাহতা’লা যে উদ্দেশ্যে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেন

 
[এই জওয়াবটি মুফতী জা’ফরউদ্দীন আল-বিহারী রেযভী সাহেব কৃত ”না’ফি’ইল বাশার ফী ফাতাওয়ায়ে জা’ফর” শীর্ষক ফতোওয়াগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। সংকলক হলেন মোহাম্মদ আকদস (যুক্তরাজ্য)। এটি রাওয়ালপিণ্ডির শায়খ রহীম বখশ সাহেবের এক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে, যা মুফতী সাহেব ১৩২৪ হিজরী সালের ১৫ই রজব তারিখে হাতে পান। মুফতী সাহেব ছিলেন ইমাম আহমদ রেযা খান সাহেবের প্রথম দিককার ছাত্র]

প্রশ্ন: “লাও লাকা লা মা খালাকতুল আফলাক” (হে রাসূল, আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করতাম না) - এই হাদীসে কুদসী সম্পর্কে বিজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন ও শরীয়তের মুফতীবৃন্দের অভিমত কী? এটি কোন্ হাদীসগ্রন্থে বিদ্যমান? রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কারণেই সৃষ্টিকুলের উৎপত্তি হয়েছে, এ কথা কি সত্য? এই রওয়ায়াতের সমর্থনে আরও আহাদীস আছে কি?

উত্তর: হ্যাঁ, মহানবী (দ:)-এর কারণেই হযরত আদম (আ:) ও সমগ্র জগতের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি না হলে আরশ ও ফরশ, লওহ ও কলম, বেহেশত ও দোযখ, গাছ ও পাথর এবং অন্যান্য সকল সৃষ্টি অস্তিত্ব পেতো না। এর সমর্থনে অনেক হাদীস বিরাজমান।

হাদীস নং-১: হাকিম নিজ ‘মোসতাদরেক’, বায়হাকী তাঁর ‘দালাইল আন্ নবুওয়া’, তাবরানী নিজস্ব ‘কবীর’, আবূ নুয়াইম তাঁর ‘হিলইয়া’, এবং ইবনে আসাকির নিজ ‘তারিখে দিমাশক’ পুস্তকে উদ্ধৃত করেন হযরত আমীরুল মো’মেনীন ফারুকে আ’যম (রা:)-এর বাণী: “হুযূর পূর নূর (দ:) বলেন যে মহান আল্লাহ বলেছেন, আদম (আ:) যখন গন্দুম খেলেন, তখন তিনি আরয করেন, এয়া আল্লাহ! মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ওয়াস্তে আমায় মাফ করুন। এমতাবস্থায় আল্লাহ বলেন, ওহে আদম! তুমি কীভাবে তাঁর কথা জানলে যেহেতু আমি তাঁকে এখনো সৃষ্টি করি নি? আদম (আ:) উত্তর দেন, এয়া আল্লাহ! আপনি আমাকে সৃষ্টি করে আমার মাঝে রূহ ফোঁকার পরে আমি মাথা তুলে দেখতে পাই আরশে লেখা রয়েছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (দ:)’। তাই আমি বুঝতে পারি যে আপনার সবচেয়ে প্রিয় কারো নাম-ই আপনার নামের পাশে আপনি যুক্ত করেছেন। অতঃপর আল্লাহ বলেন, ওহে আদম! তুমি সত্য বলেছ। নিশ্চয় মহানবী (দ:) আমার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন, আর তাই তুমি যখনই তাঁর অসিলায় আমার কাছে চেয়েছ, তখনই আমি তোমায় ক্ষমা করেছি। রাসূলুল্লাহ (দ:) না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।” (ইমাম সুবকী কৃত ’আশ্ শিফাউস্ সিকাম’ এবং শেহাবউদ্দীন খাফাজী প্রণীত ‘নাসীম আর-রিয়াদ’ বইগুলোতেও বর্ণিত)

হাদীস নং-২: হাকিম তাঁর ‘মোসতাদরেক’ গ্রন্থে এবং আবূ শায়খ নিজ ‘তাবকাত আল-ইসফাহানী’ পুস্তকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “আল্লাহ পাক হযরত ঈসা (আ:)-কে বলেছেন, ওহে ঈসা! মহানবী (দ:)-এর প্রতি ঈমান আনো এবং তোমার উম্মতকেও তা করতে বলো। রাসূলুল্লাহ (দ:) না হলে আমি আদমকে সৃষ্টি করতাম না, বেহেশত বা দোযখও সৃষ্টি করতাম না।” (ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী রচিত ‘শিফাউস্ সিকাম’ ও শায়খুল ইসলাম আল-বুলকিনী প্রণীত ‘ফতোওয়া’ এবং ইবনে হাজর রচিত ‘আফদাল আল-কুরআন’ গ্রন্থগুলোতেও উদ্ধৃত)

হাদীস নং-৩: ইমাম দায়লামী নিজ ‘মুসনাদ আল-ফেরদউস’ কেতাবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “রাসূলে খোদা (দ:) বলেছেন যে হযরত জিবরীল আমীন (আ:) তাঁর কাছে আসেন এবং উদ্ধৃত করেন আল্লাহর বাণী, ‘আমি (খোদা স্বয়ং) আপনাকে (রাসূল-এ-পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে) সৃষ্টি না করলে বেহেশত বা দোযখ সৃষ্টি করতাম না’।”

হাদীস নং-৪: ইবনে আসাকির উদ্ধৃত করেন হযরত সালমান ফারিসী (রা:)-কে, যিনি বলেন: “হযূর পূর নূর (দ:)-এর কাছে
জিবরীল আমীন (আ:) এসে পৌঁছে দেন আল্লাহর বাণী, ‘(হে রাসূল) আপনার চেয়ে অধিক সম্মানিত আর কাউকেই আমি সৃষ্টি করি নি। আমি বিশ্বজগত ও এর মধ্যে যা কিছু আছে তার সবই সৃষ্টি করেছি যাতে তারা জানতে পারে আপনার মহান মর্যাদা সম্পর্কে। আমি এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করতাম না, যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম’।”

হাদীস নং-৫: ইমাম শেহাবউদ্দীন ইবনে হাজর আসকালানী বলেন, “এই সকল বর্ণনা ব্যক্ত করে যে মহানবী (দ:)-কে সৃষ্টি করা না হলে আল্লাহতা’লা আসমান-জমিন, বেহেশ্ত-দোযখ, চন্দ্র-সূর্য কিছুই সৃষ্টি করতেন না।”

এই বিষয়ে আরও অনেক আহাদীস আছে যা ইমাম আহমদ রেযা খান সাহেব তাঁর ‘তাজাল্লী আল-এয়াকীন বি আন্না নাবিই-ইয়ানা সাইয়্যেদিল মুরসালীন’ শিরোনামের চমৎকার গ্রন্থে সংকলন করেছেন; আর নিঃসন্দেহে সত্যপন্থী বুযূর্গানে দ্বীন ও উলামাবৃন্দ মহানবী (দ:)-কে ’হযরত আদম (আ:) ও বিশ্বজগত সৃষ্টির কারণ’ হিসেবে সম্বোধন করেছেন। তাঁদের এ সব বাণী সংকলন করলে বিশালাকৃতির বই হবে। এর মধ্য থেকে কিছু বাণী উদ্ধৃত করা হলো:

উদ্ধৃতি-১: ইমাম সাইফুদ্দীন আবূ জা’ফর বিন উমর আল-হুমাইরী আল-হানাফী নিজ ‘আদ-দুররূল তানযীম ফী মওলিদিন্ নাবিই-ইল করীম’ শীর্ষক কেতাবে বলেন: আল্লাহতা’লা যখন হযরত বাবা আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি তাঁর মনে এই ভাবের উদয় করেন যার দরুণ তিনি মহান প্রভুকে প্রশ্ন করেন, ”এয়া আল্লাহ! আপনি আমার কুনিয়া (বংশ-পরম্পরার নাম) কেন ’আবূ মোহাম্মদ’ (মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পিতা) করেছেন?” আল্লাহ উত্তরে বলেন, “ওহে আদম! তোমার মাথা তোলো।” তিনি শির উঠিয়ে আরশে মহানবী (দ:)-এর নূর (জ্যোতি) দেখতে পান। হযরত আদম (আ:) জিজ্ঞেস করেন, “এয়া আল্লাহ! এই নূর কোন্ মহান সত্তার?” আল্লাহতা’লা জবাবে বলেন, “তোমার বংশেই এই মহান নবী (দ:)-এর জন্ম। আসমানে তাঁর নাম আহমদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এবং জমিনে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। আমি তাঁকে সৃষ্টি না করলে তোমাকে বা আসমান ও জমিনকে সৃষ্টি করতাম না।” 

উদ্ধৃতি-২: সাইয়্যেদ আবূল হুসাইন হামদূনী শাযিলী তাঁর ‘কাসিদায়ে দা’লিয়া’তে লেখেন: “প্রিয়নবী (দ:) হলেন সারা বিশ্বজগতের মধ্যমণি এবং সকল সৃষ্টির কারণ (অসিলা)। তিনি না হলে কিছুই অস্তিত্ব পেতো না।”

উদ্ধৃতি-৩: ইমাম শরফউদ্দীন আবূ মোহাম্মদ বুসিরী তাঁর কৃত ‘কাসিদা-এ-বুরদা’ কাব্য-পুস্তকে লেখেন: “রাসূলুল্লাহ (দ:) না হলে দুনিয়া অস্তিত্বশীল হতো না।”

উদ্ধৃতি-৪: ইমাম বুসিরী (রহ:)-এর কাব্যের ব্যাখ্যামূলক পুস্তকে ইমাম শায়খ ইবরাহীম বাইজুরী লেখেন: “হুযূর করীম (দ:) অস্তিত্বশীল না হলে বিশ্বজগত-ই অস্তিত্বশীল হতো না। হযরত আদম (আ:)-কে আল্লাহ বলেন, ‘মহানবী (দ:) অস্তিত্বশীল না হলে আমি তোমোকে সৃষ্টি করতাম না। হযরত আদম (আ:) হলেন মনুষ্যজাতির আদি পিতা, আর পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই মানুষের জন্যে সৃষ্ট। তাই হযরত আদম (আ:)-কে যেহেতু রাসূলে খোদা (দ:)-এর অস্তিত্বের কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু সমগ্র জগতই মহানবী (দ:)-এর কারণে সৃষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। অতএব, সকল অস্তিত্বশীল সত্তার সৃষ্টির কারণ হলেন বিশ্বনবী (দ:)।”

উদ্ধৃতি-৫: কাসিদা-এ-বুরদা কাব্য সম্পর্কে আল্লামা খালেদ আযহারী মন্তব্য করেন: “রাসূলে পাক (দ:)-এর কারণেই দুনিয়া অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব পেয়েছে।”

উদ্ধৃতি-৬: মোল্লা আলী কারী লেখেন: ”রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর আশীর্বাদ ও মহত্ত্ব ছাড়া
সমগ্র এই বিশ্বজগত অস্তিত্ব পেতো না এবং আল্লাহ ছাড়া কিছুই অস্তিত্বশীল থাকতো না।”

উদ্ধৃতি-৭: আল্লামা আবূল আয়াশ আবদুল আলী লাখনৌভী নিজ ‘ফাওয়াতিহ আর-রাহমূত শরহে মোসাল্লাম আস্ সুবূত’ পুস্তকে লেখেন: “রাসূলে খোদা (দ:) অস্তিত্বশীল না হলে সৃষ্টিকুল আল্লাহর রহমত-বরকত (আশীর্বাদ)-ধন্য হতো না।”

মহানবী (দ:) সৃষ্টিকুলের অস্তিত্বের মূল, এই প্রতিপাদ্য বিষয়ের সত্যতা ও প্রামাণিকতা সম্পর্কে বিতর্ক একমাত্র মূর্খ লোকেরাই করতে পারে। হুযূর পূর নূর (দ:)-এর কারণেই আল্লাহ পাক সমগ্র বিশ্বজগত সৃষ্টি করেন।

                                              --সমাপ্ত--
[Bengali translation of Muhammad Aqdas' online article 'The reason why Allah created the Universe']

Thursday, 27 March 2014

শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত

মূল: শায়খ আহমদ হেনড্রিকস্ (দক্ষিণ আফ্রিকা)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[অনুবাদকের আ’রয

’দিগন্ত’ স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল বন্ধ হওয়ার কিছু দিন আগে সরাসরি সম্প্রচারিত ওর এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপককে ইমেইলযোগে প্রশ্ন করা হয় যে শরীয়ত ও তরীকত বলতে কী বোঝায় । ওতে উপস্থিত দু’জন বক্তার একজন ছিলেন ‘মুফতী’ এবং অপরজন কোনো ইসলামী একাডেমীর ‘অধ্যাপক’। ‘মুফতী’ সাহেব জবাবে বলেন যে শরীয়ত বলতে সামগ্রিকভাবে ইসলামী দ্বীনকে বোঝায় । ‘অধ্যাপক’ সাহেব তরীকত সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন । কেননা, আল্লাহতা’লা তাঁর কুরআন মজীদে বিভিন্ন ‘সাবিল’ তথা পথ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। বলা বাহুল্য, এই নিষেধাজ্ঞা-সম্বলিত আয়াতগুলো আসলে মক্কার কাফেরদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল । ‘অধ্যাপক’ সাহেব কাফেরদের প্রতি অবতীর্ণ আয়াত মুসলমানদের প্রতি আরোপ করেন! বিশেষ করে আউলিয়ায়ে কেরাম ও বুযূর্গানে দ্বীনের প্রবর্তিত বিভিন্ন তরীকত সম্পর্কে তিনি কুৎসা রটনা করেন । আমরা মুসলমান সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই তাঁরা যেন তরীকত-বিষয়ক প্রশ্ন শরীয়ত ও তরীকতের জ্ঞান বিশারদদের কাছে উত্থাপন করেন এবং শুধু ’যাহেরী এলম’ (প্রকাশ্য জ্ঞান)-সম্পন্ন কারো কাছে তা জানতে চেষ্টা না করেন । আমাদের মযহাবের ইমাম আবূ হানিফা (রহ:) সূফীদের ইমাম জা’ফর সাদেক (রহ:)-এর খেদমতে তাঁর জীবনের শেষ দুই বছর অতিবাহিত করেন । অতঃপর তিনি বলেন, “এই দুই বছর না হলে নু’মান বিন সাবেত (তিনি নিজে) ’হালাক’ তথা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতেন ।” দেখুন, ফেকাহর এতো বড় জ্ঞান বিশারদও তাসাউফ-তরীকতকে আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং এ পথ ছাড়া নাজাত নেই বলে প্রত্যয় পোষণ করেছিলেন ।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিশিষ্ট আলেম শায়খ আহমদ হেনড্রিকস্ যিনি মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদপ্রাপ্ত এবং মক্কার বিখ্যাত আলেমে দ্বীন শায়খ মোহাম্মদ আলাউইয়ী মালেকী (রহ:)-এর ভাবশিষ্য , তিনি শরীয়তের দলিল-আদিল্লা থেকে এ প্রবন্ধে প্রমাণ করেছেন যে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অনুসৃত ‘সাবিল’ তথা তরীকত সত্য ও সঠিক । আমি এর অনুবাদ আমার পীর ও মুরশীদ চট্টগ্রাম আহলা দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি সৈয়দ মওলানা আলহাজ্জ্ব এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে উৎসর্গ করছি ।

-- অনুবাদক]

শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত

শরীয়ত, তরীকত ও হাকীকত - এই তিনটি সংজ্ঞার অর্থ এবং এগুলোর প্রয়োগ এমনই এক বিষয় যা নিয়ে কিছু বিতর্ক দেখা যায়। এগুলোর প্রকৃত অর্থ কী এবং এগুলো প্রথমাবস্থায় কেন অস্তিত্ব পেয়েছে তা-ও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই শব্দগুলোর প্রথমটি - শরীয়ত - আমাদের প্রায় সবার কাছেই সম্পূর্ণভাবে পরিচিত। আমরা যখন শরীয়ত সম্পর্কে কথা বলি, তখন মুসলমান সর্বসাধারণ বুঝতে পারেন যে আমরা হয় সার্বিকভাবে দ্বীন সম্পর্কে বলছি, নয়তো বিশেষ করে ইসলাম ধর্মশাস্ত্রের আইনি দিকগুলো বা ’ফেকাহ’ সম্পর্কে বলছি। সাধারণতঃ এর অভিব্যক্তি হলো, “আমাদেরকে শরীয়ত অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে।” আর আমরা সাথে সাথেই বুঝে যাই যে এর মানে “মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতা’লার আইন অনুযায়ী।” যে প্রশ্নটি মুসলমানদেরকে প্রায়শ-ই ভাবিয়ে তোলে তা হলো, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতা’লার আইনের পাশাপাশি সম্ভাব্য আর কী-ই বা থাকতে পারে? আমাদের সামনে উপস্থিত রয়েছে আমাদের ধর্ম, মহানবী (দ;)-এর আনীত জীবনাচার তথা শরীয়ত; এমতাবস্থায় আমরা যে শুনে থাকি তাসাউফের সাথে সম্পর্কিত তরীকত ও হাকীকত বিষয়ে, সেগুলো আসলে কী? আমরা এ প্রবন্ধে এ ব্যাপারে কিছু ব্যাখ্যা দেবার আশা রাখি, ইনশা’আল্লাহ।

আমি অন্য একটি লেখায় প্রমাণ করেছি যে তাফাককুর (গভীর ধ্যান) সচেতন ও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিত মুসলিম-জীবনের অপরিহার্য প্রারম্ভিক ধাপ। তাফাককুর ছাড়া আমাদের জীবন মুসলমান হিসেবে অসার হতে বাধ্য। আমাদের ইসলাম এ পরিস্থিতিতে কেবল নিজেদের পিতামাতাকে অনুকরণ করার চেয়ে বেশি কিছু হবে না; অথবা তা মুসলমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার অনুকরণ ছাড়া ওর বাইরে কিংবা ঊর্ধ্বে যেতে পারবে না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, তাফাককুর হতে পারে বৈপ্লবিক। এটি আমাদের জীবনে বৈপ্লবিক ও সামগ্রিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। তাফাককুরের বরকত ও নূর দ্বারা জীবনের মানে স্রেফ অনুকরণ ও অন্ধ বিশ্বাসের চেয়েও ঢের বেশি বলে পরিদৃষ্ট হয়। আমাদের সাদামাটা, অগভীর, অনুকরণশীল ও বস্তুগত অস্তিত্বে আমরা সন্তুষ্ট হই না। এই অসন্তুষ্টি অহরহ-ই মানসিক যন্ত্রণা ও বিচলিত ভাবে পর্যবসিত হয়। আমরা মহাবিপদে পড়ি, যদি এই সময় কোনো নির্ভরযোগ্য ও সুদৃঢ় (সঠিক) পথপ্রদর্শন না পাই। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আমরা ধৈর্য ধরি এবং পরিপক্ক ও জ্ঞানী পরামর্শকের শরণাপন্ন হই। আমাদের মনে রাখতে হবে, অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে তাফাককুরের প্রতি আমাদের উৎসাহ জোগানো হতে পারে, এমন কি তা চাপিয়েও দেয়া হতে পারে। হেদায়াতের পথ বহু ধরনের এবং তা কখনো কখনো রহস্যময়-ও। উদাহরণস্বরূপ, গভীর তাফাককুর কারো জীবনে কোনো সংকট থেকে উদ্ভূত হতে পারে - কোনো নিকটজনের মৃত্যু, বা চাকরি হারানো ও তৎপরবর্তী হতাশা, কিংবা কোনো বড় দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির অঙ্গহানি ইত্যাদি দ্বারা।

’সংকটে পতিত’ এই মুসলমানকে মহাপ্রভু আল্লাহতা’লা ডেকে বলেন, “ইন্না হাযিহী তাযকিরাতুন; ফামান শায়াত-তাখিযু ইলা রাব্বিহী সাবিলান্।” অর্থাৎ, নিশ্চয় এই কুরআন এক উপদেশ; সুতরাং যার ইচ্ছে হয় সে যেন আপন প্রতিপালকের দিকে কোনো ‘সাবিল’ তথা রাস্তা গ্রহণ করে (সূরা মুযাম্মেল, ১৯ আয়াত)

এই আয়াতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবৃত হয়েছে:

/ - কুরআন মজীদ হলো একটি ‘তাযকেরাহ’। এটি আমাদেরকে কতোগুলো মৌলিক সত্য বিষয় সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়; আর তা হলো আমরা কোত্থেকে এসেছি এবং সবশেষে কোথায় যাবো, যে সত্যটি সম্পর্কে আমরা বিস্মৃত। এটি এমন এক আলো যা আমাদেরকে বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে, আমাদের নিজেদের সত্য (বাস্তবতা) সম্পর্কে এবং কবরের পরবর্তী জগত-বিষয়ে পুনঃজাগ্রত করে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও ভাগ্যের দিকে এটি আহ্বান করে। আল্লাহ এরশাদ করেন, “আমি জ্বিন ও ইনসান জাতিকে আমার এবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করি নি।” সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ’আমার এবাদত’ বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে ‘আমাকে জানা’।

/ - আল-কুরআনে যদি কোনো মুসলমানকে এ কথা-ই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাঁকে এমন পথ গ্রহণ করতে দেয়া হোক যা তাঁকে মহান আল্লাহর সুগভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাগরে অবগাহন করতে দেবে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়তা করবে, আর চূড়ান্ত পর্যায়ে খোদাতা’লার বেহেশত লাভের পথ সুগম করবে। তাঁকে এমন পথ বেছে নিতে দেয়া হোক যা তাঁকে তাঁর চূড়ান্ত পরিণতি তথা মহান আল্লাহর মা’রেফতের দিকে নিয়ে যাবে।

’সাবিল’ বা পথ কিংবা সার্বিক কার্যক্রম, যেটি এই সুউচ্চ লক্ষ্যে কাউকে পৌঁছে দেয়, তাতে রয়েছে উলেমাদের মতানুযায়ী তিনটি পারস্পরিক-সম্পর্কিত বিষয়। আমরা সংক্ষেপে এগুলোর প্রতিটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো:

* মহানবী (দ:)-এর কাছে উম্মোচিত সকল ঐশী আইন-কানুন, নৈতিকতা ও আকীদা-বিশ্বাসের সমষ্টিকে শরীয়ত বলে। তওহীদ (এ’তেকাদ), ফেকাহ (শাস্ত্রীয় আইন) ও তাসাউফ (সূফীতত্ত্ব/আধ্যাত্মিকতা)-এর উলেমাবৃন্দ শরীয়তের দু’টো উৎস আল-কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আইন-কানুন বের করার ও শরীয়তের সংকলনের গুরুদায়িত্ব কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সুচারুভাবে পালন করেন।
* কোনো সুযোগ্য মোরশেদ/গুরু ও শিক্ষকের অধীনে শরীয়তের অনুশীলন। অনুশীলনের এই বিশেষ দিকটি হলো, বাহ্যিক ও আত্মিকভাবে হারাম তথা নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর বর্জন এবং সাধ্যানুযায়ী শরীয়তের আদেশগুলো পালন। এটিকেই ’তরীকত’ বলা হয়। ’তরীকাহ’ শব্দটি, যার অর্থ ’পথ’ বা ‘পদ্ধতি’, তা হচ্ছে শরীয়তের অনুশীলন। এই সংজ্ঞার অন্যান্য প্রয়োগগুলো সম্পর্কে আমার প্রবন্ধাবলীর এই সিরিজে পরে ব্যাখ্যা করা হবে, ইনশা’আল্লাহ। [এই সিরিজ ধাপে ধাপে অনুবাদ করার আশা রইলো, মওলার মর্জিতে - অনুবাদক]
* তৃতীয় দিকটি যাকে ’হাকীকত’ বলা হয়, তা হলো জ্ঞানের ফল ও তার অব্যাহত অনুশীলন। ’হাকীকাহ’ শরীয়ত ও তরীকতের ফল। যেমনটি মহানবী (দ:) থেকে বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নিজ এলম তথা জ্ঞানের অনুশীলন করেন, তাকে আল্লাহ পাক তিনি যা জানেন না তা-ও শিক্ষা দেবেন।”

পক্ষান্তরে, হাকীকতে উন্নতিরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বিদ্যমান:

* খোদার অন্বেষণকারী ও মহাপ্রভুর মধ্যকার পর্দা উঠে যাওয়ার পর্যায়, যার দরুণ মহান আল্লাহর যাত (সত্তা) মোবারক ও তাঁর সিফাত (গুণাবলী), তাঁর রাজসিকতা ও সৌন্দর্য, আমাদের সন্নিকটে তাঁর অবস্থান ও পরম নৈকট্য অনুভব করা যায়। এই অনুভূতি ও কলব্ তথা অন্তরের জ্ঞানের ফলস্বরূপ খোদা-তালাশি ব্যক্তি তরীকতের গোপন রহস্য জানতে পারেন এবং তিনি হাকীকতেরও জ্যোতি ও অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেন।
* নফস (কুপ্রবৃত্তি/একগুঁয়ে সত্তা) সব ধরনের দোষ-ত্রুটিমুক্ত হয়ে প্রশংসনীয় গুণাবলী লাভ করে। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর অনুপম আখলাক (চরিত্র-বৈশিষ্ট্য) এমতাবস্থায় খোদা-তালাশি ব্যক্তির নিজের আখলাক হয়ে যায়। তাঁর ধৈর্য, তওবা (পাপ মোচন), তাকওয়া (খোদাভীরুতা), এসতেকামাহ (নিয়মিত এবাদত-বন্দেগী), আল্লাহতে তাওয়াককুল (আস্থা ও নির্ভরতা) সবই গভীরভাবে প্রোথিত এবং প্রকৃত হয়ে থাকে।
* ওই খোদা-তালাশি ব্যক্তির অন্তর ইসলামের নূরের জন্যে অবশেষে উম্মুক্ত হয়। এবাদত ও নেক আমল অতি সহজেই তাঁর দ্বারা অর্জিত হয়। তিনি ’নফস আল-মোতমাইন্না’ (প্রশান্ত সত্তা)-এর পর্যায়ে এখন উন্নীত এবং তাঁর অস্তিত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দ্বীনকে তিনি গ্রহণ করে নিয়েছেন।

অতএব, আমাদের কথার সার-সংক্ষেপ এই: শরীয়ত হলো জাহাজসদৃশ, যাতে আমরা চড়ি, তরীকত হলো সমুদ্র, আর হাকীকত হলো মণি-মুক্তা, যা আমরা সাগর থেকে আহরণ করি; অথবা, শরীয়ত গাছসদৃশ, তরীকত তার শাখা (ডালপালা) এবং হাকীকত সেই ফল যা আমরা ভক্ষণ করি।

ওপরে আমাদের উদ্ধৃত ‘আপন প্রতিপালকের দিকে কোনো সাবিল (পথ)’ আয়াতটিতে এই তিনটি বিষয়কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আমাদের জীবনে শরীয়তের জ্ঞান, শরীয়তের অনুশীলন ও ফলশ্রুতিতে শরীয়ত-অনুশীলনের ফসল ঘরে তোলা, এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় না করতে পারলে আমরা আল্লাহতা’লার সান্নিধ্য অর্জন করতে সক্ষম হবো না। আমাদের অসন্তুষ্টি ও আত্মিক বিচ্ছিন্নতার সমাধান এই তিনের সমন্বয় সাধনে নিহিত। ধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তুলে ধরার জন্যেই ইসলামী উলামাবৃন্দ শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত শব্দগুলো চয়ন করেছেন।

ইমাম মালেক (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যে ব্যক্তি হাকীকত ছাড়া শরীয়ত অনুশীলন করে, সে ফাসেক (পাপী); আর যে ব্যক্তি শরীয়ত বাদ দিয়ে হাকীকতের দাবি করে, সে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছে; কিন্তু যে ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন, তিনি ইসলামের মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

                                                               সমাপ্ত




            




Saturday, 22 March 2014

ঈমান ও ইসলাম









মূল: মওলানা খালেদ আল-বাগদাদী (রহ:)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

অনুবাদকের আরয

ইরাকে বাগদাদ শরীফের মহান আলেম হযরত মওলানা জিয়াউদ্দীন খালেদ আল-বাগদাদী (রহ:)। প্রায়  তিন’শ বছর আগে তিনি এ বইটি “এ’তেকাদনামা” নাম দিয়ে রচনা করেন। তুরস্কভিত্তিক ’ওয়াকফ এখলাস্’ (হাকীকত কিতাবেভী, ইস্তাম্বুল) সংস্থাটি তাঁর এ বইখানা “ঈমান ও ইসলাম” নাম দিয়ে পুনঃপ্রকাশ করেছে। এ বইয়ে দ্বীন ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অসংখ্য শুকরিয়া জানাই আমার পীর ও মুরশিদ চট্টগ্রাম বোয়ালখালীস্থ আহলা দরবার শরীফের পীরে তরীকত আলহাজ্জ্ব সৈয়দ মওলানা এ,জেড,এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলার পাক দরবারে যাঁর আধ্যাত্মিক সুদৃষ্টি ছাড়া আমি এ বই অনুবাদ করতে সক্ষম হতাম না। মহান আল্লাহ্ পাক আমার পীর ও মুরশিদের অসিলায় এ বইটি কবুল করে নিলেই আমার শ্রম সার্থক হবে, আমীন!

ঈমান ও ইসলাম

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম,
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল করীম, আম্মা বা’দ

এ বইটিতে (এ’তেকাদনামা) ঈমান ও ইসলাম বর্ণনাকারী নবী করীম (দ:)-এর একখানা হাদীস শরীফ ব্যাখ্যা করা হবে। আমি আশা করি যে, এই হাদীসটির আশীর্বাদে মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস পূর্ণতাপ্রাপ্ত হবে এবং তাঁরা নাজাত (পরিত্রাণ) ও সুখ-শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হবেন। আমি আরও আশা করি যে, আমি খালেদ আল-বাগদাদী অতিশয় পাপী হওয়া সত্ত্বেও এর দ্বারা পরিত্রাণ পাবো। আল্লাহ্ তা’লা যিনি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন এবং যাঁর দয়া ও নেয়ামত অগণিত ও অফুরন্ত এবং যিনি নিজ বান্দাদের প্রতি পরম করুণাময়, তাঁর একজন নাদান, নাখাস্তা বান্দা – যার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত ও যার অন্তর অত্যন্ত কালো, ময়লা – তাকে তার অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তার জন্যে ক্ষমা করবেন এবং তার ত্রুটিপূর্ণ এবাদত-বন্দেগীও গ্রহণ করবেন। অতঃপর মিথ্যাবাদী, ধোকাবাজ শয়তানের ক্ষতি থেকেও তিনি আমাদেরকে রক্ষা করবেন এবং আমাদেরকে সুখ-শান্তি দান করবেন। নিশ্চয় তিনি দয়ালুদের সেরা এবং তিনি দাতাদেরও সেরা।

ইসলামী উলামাগণ (জ্ঞান বিশারদগণ) বলেছেন যে প্রত্যেক বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর ও নারীর জন্যে সঠিকভাবে আল্লাহতা’লার ’সিফাতুয্ যাতিয়্যা’ (সত্তাগত গুণাবলী) এবং ’সিফাত আস্ সুবুতিয়্যা’ (প্রমাণিত গুণাবলী) সম্পর্কে জানা এবং বিশ্বাস করা অবশ্য কর্তব্য। এটা-ই প্রত্যেকের জন্যে প্রাথমিকভাবে ফরয (অবশ্য পালনীয়) কর্তব্য। এটা না জানাটা ওজর নয়, বরং একটি গুণাহ্। খালেদ আল-বাগদাদী (লেখক স্বয়ং) এ বইটি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও পাণ্ডিত্য অন্যদের সামনে প্রদর্শন করার জন্যে কিংবা সুনাম কুড়াবার জন্যে রচনা করি নি, বরং একটি উপহার, একটি খেদমত পেছনে রেখে যাবার জন্যেই করেছি। আল্লাহ্ পাক তাঁর ক্ষমতা দ্বারা এবং তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-এর রহমতপ্রাপ্ত রূহ্ মোবারকের মাধ্যমে এই অধম খালেদকে সাহায্য করুন, আমীন!

আল্লাহতা’লা ভিন্ন অপরাপর সকল বস্তুকে “মা সিওয়া” বা “আলম” (সৃষ্টি, বিশ্বজগত) বলা হয়, যাকে মানুষেরা বর্তমানে “প্রকৃতি”ও বলে থাকে। সকল সৃষ্টি-ই অস্তিত্ববিহীন ছিল। একমাত্র আল্লাহতা’লাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিসমূহ হলো “মুমকিন” (অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) এবং “হাদীস” (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত)। অর্থাৎ, অস্তিত্ববিহীন অবস্থা হতে তারা হয়তো অস্তিত্ব পেতে পারে এবং অস্তিত্ববিহীন অবস্থায় তারা অস্তিত্ব পেয়েছে। “আল্লাহতা’লা যখন ছিলেন, তখন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না”- হাদীসটি এটাকে সত্য প্রমাণ করে।

সমগ্র বিশ্বজগত এবং সকল সৃষ্টি যে হাদীস্, তা প্রতীয়মানকারী দ্বিতীয় প্রমাণটি হলো এই যে, সৃষ্টি জগত প্রতিটি মুহূর্তেই পরিবর্তিত ও বিকশিত হচ্ছে। অপর পক্ষে, যা কাদিম (আরম্ভবিহীন) তা কখনোই পরিবর্তিত হতে পারে না। আল্লাহতা’লার যাত মোবরক (পবিত্র সত্তা) এবং গুণাবলী হলো কাদিম ও অপরিবর্তনীয়। সৃষ্টিসমূহে সংঘটিত পরিবর্তন অনন্ত অতীত হতে আগমনকারী নয়; সেগুলোর একটি আরম্ভ আছে। সেগুলোর নিশ্চয় কোনো বস্তু বা পদার্থ দ্বারা আরম্ভ হয়েছে যা নিশ্চয়ই অনস্তিত্ব থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল।

সমগ্র বিশ্বজগত যে “মুমকিন” (অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) তা প্রতীয়মানকারী আরেকটি প্রমাণ হলো এই যে, আমাদের দৃষ্ট সৃষ্টিসমূহ হলো হাদীস্ (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত)।

জগতে দুই প্রকারের সত্তা আছে: “মুমকিন” ও “ওয়াজিবুল ওজুদ” (অস্তিত্বসম্পন্ন সত্তা)। যদি শুধুমাত্র “মুমকিন” (অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) বিরাজ করতো কিংবা যদি “ওয়াজিবুল ওজুদ” (অবশ্যই বিরাজমান) বিরাজ না করতেন, তাহলে কিছুই অস্তিত্বসম্পন্ন থাকতো না। এ কারণেই ’মুমকিন’ নিজ হতে অস্তিত্ব পেতে পারে না। যদি কোনো শক্তি এর ওপর প্রভাব বিস্তার না করতো, তাহলে এটা সবসময়ই অস্তিত্ববিহীন থাকতো এবং অস্তিত্বসম্পন্ন হতে পারতো না। যেহেতু একটি “মুমকিন” নিজেকেই সৃষ্টি করতে অক্ষম, সেহেতু এটা অবশ্যই অন্যান্য ‘মুমকিন’কে সৃষ্টি করতেও অক্ষম। ’মুমকিন’কে সৃষ্টি করেছেন যে সত্তা, তিনি অবশ্যঅবশ্যই ’ওয়াজিবুল অজুদ’ হবেন। “আলম” (বিশ্বজগত)-এর অস্তিত্ব-ই প্রতিভাত করে যে এর একজন স্রষ্টা, যিনি এটাকে অস্তিত্বহীনতা হতে সৃষ্টি করেছেন, তিনিও বিরাজমান। অতএব, সকল ’মুমকিনের’ তথা সৃষ্টিসমূহের একক স্রষ্টা হলেন ’ওয়াজিবুল অজুদ’ যিনি নিজে হাদীস (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত) কিংবা মুমকিন নন, বরং সর্বদা অস্তিত্বসম্পন্ন। “ওয়াজিবুল অজুদ” অর্থ হলো এর অস্তিত্ব অন্য কোনো কিছু থেকে প্রাপ্ত নয়, বরং নিজ হতেই অস্তিত্বসম্পন্ন। অর্থাৎ, এটা সর্বদা স্ব-অস্তিত্বসম্পন্ন এবং কারো দ্বারা সৃষ্ট নয়। যদি এ রকম না হতো, তবে এটাকে অন্য কারো দ্বারা সৃষ্ট একটি সৃষ্টি (মুমকিন ও হাদীস্) হতে হতো। আর এ বিষয়টি উপরোল্লিখিত সিদ্ধান্তটির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। পারসিক “খোদা” শব্দটির মানেও হলো “সর্বদা স্ব-অস্তিত্বসম্পন্ন”।
আমরা সকল শ্রেণীর সত্তাকে একটি বিস্ময়কর নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ দেখতে পাই এবং বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত এই নিয়মের নিত্যনতুন আইন-কানুন আবিষ্কার করে থাকে। এই নিয়মের স্রষ্টা নিশ্চয় “হাই” (চিরঞ্জীব), “আলিম” (সর্বজ্ঞানী) “কাদির” (সর্ব শক্তিমান), “মুরিদ” (চূড়ান্ত ইচ্ছার মালিক), “সামিউন” (সর্ব-বিষয় শ্রবণকারী), “বাসির” (সর্ব-দ্রষ্টা), “মুতাকাল্লিম” (সর্ব বাক্ শক্তিসম্পন্ন)। কেননা, মৃত্যু, অজ্ঞতা, অক্ষমতা, শ্রবণ শক্তিহীনতা, দৃষ্টি শক্তিহীনতা, বাক্ শক্তিহীনতা ইত্যাদি হচ্ছে ত্রুটি-বিচ্যুতি, অপূর্ণতা। এই আলম (জগত) বা “কায়নাত” (সকল সত্তা) যিনি এ রকম নিয়মে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি সেগুলোকে ধ্বংস হতে রক্ষা করছেন, তাঁর পক্ষে ওই ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির অধিকারী হওয়া একদম অসম্ভব। উপরন্তু, আমরা উপরোক্ত পূর্ণতার গুণাবলী সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও অবলোকন করে থাকি। তিনি ওই সকল গুণ তাঁর সৃষ্টির মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন। যদি এ সব গুণ তাঁর মধ্যে বিরাজ না করতো, তাহলে কীভাবে তিনি এগুলো তাঁর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে সৃষ্টি করতেন। তাঁর সৃষ্টিসমূহ কি তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতো না, যদি তিনি ওই সব গুণ-বিবর্জিত হতেন?

আমরা আরও যোগ করবো, যিনি এ সকল সত্তার জগতসমূহ সৃষ্টি করেছেন, তাঁর মধ্যে পূর্ণতার সকল গুণ ও মাহাত্ম্য থাকা উচিৎ এবং কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকা-ই উচিৎ। কেননা, যে সত্তা ক্রটিপূর্ণ সে সৃষ্টিশীল হতে পারে না।
এ সব যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ ছাড়াও আয়াত ও হাদীসসমূহ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে আল্লাহতা’লা পূর্ণতার অধিকারী। সুতরাং এতে সন্দেহ পোষণ করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। সন্দেহ কুফর বা অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। তাঁর সত্তা, গুণাবলী কিংবা কর্মের মধ্যে কোনো ত্রুটি, অনিয়ম কিংবা পরিবর্তন নেই।

ইসলামের মূলনীতি

আল্লাহতা’লা যিনি সকল আলম (জগত)-কে অস্তিত্ব দিয়ে রেখেছেন এবং যিনি সকল করুণা ও দয়া প্রদর্শন করছেন এবং যিনি কখনো-ই নিদ্রাচ্ছন্ন নন, তাঁরই প্রদত্ত সাহায্য ও শক্তি দ্বারা এখন আমরা আমাদের নবী করীম (দ:)-এর পবিত্র মুখ-নিঃসৃত বাণী ব্যাখ্যা করতে শুরু করবো।

আমাদের প্রিয় বুযূর্গ হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা:), যিনি রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও মুসলিমদের সরদার ছিলেন, এবং যিনি নিজ সত্যবাদিতার জন্যে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি বলেন:
“এটা এমন-ই এক দিন ছিল, যেদিন আমরা কতিপয় সাহাবী (রা:) রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর উপস্থিতিতে এবং খেদমতে ছিলাম।” সেই দিন, সেই মুহূর্তটি এতো নেয়ামতপূর্ণ, এতো মূল্যবান ছিল যে তিনি এমন দিন আর দ্বিতীয়বার অতিক্রম করার হায়াত পাবেন কিনা সন্দেহ! সেই দিনটিতে হুজুর পূর নূর (দ:)-এর পবিত্র সাহচর্য ও তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলের দর্শন হযরত ওমর (রা:)-এর ভাগ্যকে ধন্য করেছিল, যা রূহসমূহের খাদ্য ও প্রশান্তিও। দিনটির মূল্য ও মাহাত্ম্যকে সমর্থন দেয়ার জন্যে তিনি বলেন, “এটা এমন-ই এক দিন ছিল …..”। এ রকম একটি মুহূর্ত হতে কি আর অন্য কোনো সময় সম্মানজনক ও মূল্যবান হতে পারে, যখন তাঁরই ভাগ্যকে ধন্য করার জন্যে তিনি মনুষ্য বেশধারী হযরত জিবরীল (আ:)-কে দেখতে ও তাঁর কণ্ঠস্বরকে শুনতে পেয়েছিলেন এবং মনুষ্যজাতির জন্যে প্রয়োজনীয় ও উপকারী জ্ঞান এতো সুন্দর এবং এতো স্পষ্টভাবে মহানবী (দ:)-এর পবিত্র মুখ হতে শ্রবণ করতে পেরেছিলেন?

“সেই মুহূর্তে চন্দ্রোদয়ের মতো এক ব্যক্তি আমাদের কাছে আসেন। তাঁর জামা-কাপড় ছিল ধবধবে সাদা এবং তাঁর চুল ছিল ঘন কালো। তাঁর দেহে কোনো ভ্রমণের শ্রান্তি কিংবা ঘাম দৃশ্যমান ছিল না। হযরত নবী করীম (দ:)-এর সাহাবীদের মধ্যে আমরা কেউই তাঁকে চিনতাম না [অর্থাৎ, তিনি অপরিচিত আগন্তুক ছিলেন]। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সামনে উপবিষ্ট হলেন এমনভাবে যে, তাঁর হাঁটু বিশ্বনবী (দ:)-এর হাঁটুর সামনে স্থাপিত হলো।”

“অতঃপর ওই মহান ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর পবিত্র হাঁটুর ওপর দুই হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (দ:)! আমাকে ইসলাম ও একজন মুসলিমের সংজ্ঞা প্রদান করুন।”

ইসলামের আক্ষরিক অর্থ “আত্মসমর্পণ”। রাসূলে আকরাম (দ:) ব্যাখ্যা করলেন যে “ইসলাম” অর্থ হলো শরীয়তের ৫টি মূল ভিত্তি, যা নিম্নরূপ:

১। ইসলামের পাঁচটি মূলনীতির প্রথমটি কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করা। অর্থাৎ, “আশহাদু আন লা ইলাহা ইলাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মোহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো মা’বুদ/উপাস্য নেই এবং হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় বান্দা ও রাসূল) — বাক্যটি সবাইকে পড়তে হবে।  প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো ব্যক্তিকে মৌখিকভাবে বলতে হবে, “আসমান ও জমিনে তিনি (আল্লাহতা’লা) ছাড়া আর কেউই অর্চনা পাওয়ার যোগ্য নয়। একমাত্র তাঁকেই অর্চনা করতে হবে। তিনি-ই ওয়াজিবুল অজুদ। তাঁর মধ্যে সকল প্রকারের শ্রেষ্ঠত্ব বিরাজমান। কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি তাঁর মধ্যে নেই। তাঁর নাম আল্লাহ্।” আর এ কথাগুলোকে সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে নিতে হবে। অতঃপর আরও বলতে হবে – “হযরত মোহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও প্রেরিত পয়গম্বর।” রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর মাতার নাম আমিনা বিনতে ওয়াহহাব। আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণের কারণে তাঁকে একজন “আরব” বলা হয়। তাঁর গোত্রের নাম বনী হাশিম। তাঁর গায়ের রং ছিল গোলাপি এবং তাঁর চেহারা মোবারক ছিল উজ্জ্বল লালচে ফর্সা ও পছন্দনীয়; তাঁর ভ্রু ছিল কালো, চোখও কালো, প্রশস্ত কপাল এবং তাঁর আচার-ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ভদ্র-নম্র। তাঁর কথা ছিল অত্যধিক মিষ্টি। তাঁর ছায়া কখনো মাটিতে পড়ে নি। বি’সাত তথা নবুয়ত প্রকাশের সালে যখন তিনি চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তখন তাঁকে জ্ঞাত করানো হয় যে তিনি বিশ্বনবী (দ:)। অতঃপর তিনি মক্কা নগরীতে তেরো বছর মানুষদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। আল্লাহর অনুমতিক্রমে এরপর তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করেন। দশ বছর পর মদীনায় তিনি বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলন)-প্রাপ্ত হন।

২। ইসলামের দ্বিতীয় মূলনীতি হলো (পাঁচ ওয়াক্ত) নামায কায়েম করা। নামায ওর ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতসমূহের প্রতি মনোযোগ রেখে এবং আল্লাহর প্রতি অন্তরকে সমর্পণ করে সময় উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই পড়তে হবে। কুরআন মজীদে নামাযকে “সালাত” বলা হয়েছে। সালাতের অর্থ হলো কোনো ব্যক্তির প্রার্থনা, ফেরেশতাদের এসতেগফার ও খোদাতা’লার করুণা এবং দয়া। অবশ্য শরীয়তে এর অর্থ হলো ’এলমুল হাল্’ গ্রন্থাবলীতে প্রদর্শিত কিছু বিষয় পাঠ ও কিছু কর্ম সংঘটন। সালাত “আল্লাহু আকবর” শব্দগুলো যাকে “তাকবিরুল ইফতেতাহ্” বলা হয়ে থাকে, তা দ্বারা আরম্ভ হয় এবং কান পর্যন্ত হাত দুটো উত্তোলন করে নাভির নিচে বেঁধে তারপর পাঠ করতে হয় (পুরুষদের জন্যে)। এর পরিসমাপ্তি ঘটে কাঁধের ডান ও বাম দিকে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে যা শেষ বৈঠকে করতে হয়।

৩। ইসলামের তৃতীয় মূলনীতি হলো কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি হতে যাকাত প্রদান করা। যাকাতের আক্ষরিক অর্থ পবিত্রতা। আরেক কথায়, প্রশংসা করা এবং ভালো ও সুন্দর হওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত মানে যাকাত প্রদানের সামর্থ্যবান ব্যক্তির সম্পত্তি হতে “নিসাব” নামক বিশেষ অংশ আলাদা করে তা আল-কুরআনে বর্ণিত মুসলমানদের কাছে তাঁদেরকে তিরস্কার না করেই প্রদান করা। যাকাত আট ধরনের লোককে দেয়া হয়ে থাকে। চার মযহাবের সবগুলোতেই চার ধরনের যাকাত আছে; স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত, বাণিজ্যিক পণ্যের যাকাত, অর্ধ বছর হতে অধিক সময়কালব্যাপী চারণক্ষেত্রে লালিত গৃহপালিত পশু (যথা – ভেড়া, ছাগল, গরু ইত্যাদি)-এর যাকাত এবং সবশেষে জমিতে উৎপন্ন প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের যাকাত। এই চতুর্থ ধরনের যাকাত যাকে “উশর” বলা হয়, তা ফসল কেটে ঘরে তোলার অনতিবিলম্নেই প্রদান করতে হয়। বাকি তিন ধরনের যাকাত নিসাবের পরিমাণে পৌঁছার এক বছর পর প্রদান করা হয়।

৪। ইসলামের চতুর্থ মূলনীতি হলো রমযান মাসের প্রতিটি দিন রোযা রাখা। রোযাকে বলা হয় “সওম”।  সওমের অর্থ একটি বস্তুকে আরেকটি বস্তু হতে রক্ষা করা। শরীয়তে এর মানে নিজেকে রমযান মাস তিনটি কাজ থেকে বিরত রাখা; যথা – আহার, পান ও স্ত্রী সহবাস।

৫। ইসলামের পঞ্চম মূলনীতি হলো কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্যে জীবনে একবার হজ্জে গমন। হজ্জের যাতায়াত খরচ ও তার অনুপস্থিতিতে পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচ বহনে সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্যে মক্কা শরীফ যেয়ে কাবা শরীফের তওয়াফ, আরাফাত ময়দানের ওয়াকফা ও আনুষাঙ্গিক রীতিসমূহ শারীরিক সুস্থতা ও জীবনের নিরাপত্তা বজায় রেখে জীবনে একবার পালন করা ফরয।

“রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর কাছ থেকে এ সকল জওয়াব শোনার পর ওই ব্যক্তি বললেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ্ (দ:)! আপনি সত্য বলেছেন’! আমরা শ্রোতারা তাঁর এ মন্তব্যে বিস্মিত হয়ে গেলাম”- হযরত ওমর (রা:) তাঁর এ বর্ণনা দ্বারা বোঝাতে চাইছেন যে, মজলিসে উপস্থিত সাহাবীগণ ওই ব্যক্তির আচরণে এ কারণে বিস্মিত হয়েছিলেন যে তিনি প্রশ্ন করে নিজেই আবার এর সত্যতা সমর্থন করেছিলেন। প্রশ্ন করা হয় সাধারণতঃ জানবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যদি বলা হয় “আপনি সত্য বলেছেন,” তাহলে প্রতিভাত হয় যে প্রশ্নকারী আগেই উত্তরটি জানতেন।

উপরোল্লিখিত পাঁচটি মুলনীতির মূখ্য নীতি হলো কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করা এবং এর অর্থ বিশ্বাস করা। অতঃপর শ্রেষ্ঠ হলো সালাত। এরপর আসে সিয়াম (রোযা)। সিয়ামের পরের মূলনীতি হজ্জ। সবশেষে যাকাত। কলেমায়ে শাহাদাত যে সর্বশ্রেষ্ঠ, তা উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য দ্বারা নিশ্চিত। অপর চারটির ব্যাপারে আমরা ওপরে যা লিখেছি, তা-ই অধিকাংশ উলামার অভিমত। কলেমায়ে শাহাদাত ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে ফরয হয়েছিল। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয় বি’সাত বা নবুয়ত প্রচারের এক যুগের মাথায় – হিজরতের এক বছর কয়েক মাস আগে, মে’রাজ রজনীতে । রোযা দ্বিতীয় হিজরী সালের শা’বান মাসে ফরয করা হয়। যে বছর রোযা ফরয হয় সেই বছরের রমযান মাসে যাকাতও ফরয করা হয়। আর ষষ্ঠ হিজরী সালে হজ্জ ফরয করা হয়। ফলে মাহাত্ম্যের ক্ষেত্রে যাকাত সর্বশেষ, আর সর্বশেষ ফরয হওয়ার সময় হিসেবে হজ্জ-ই সর্বশেষ।

যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের এ পাঁচটি মূলনীতির যে কোনো একটিকে অস্বীকার করে, কিংবা অবিশ্বাস করে, কিংবা প্রত্যাখ্যান করে, অথবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, অথবা অশ্রদ্ধা করে, তবে সে কাফের (অবিশ্বাসী) হয়ে যাবে। আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন, আমীন! অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষিত হালাল কিংবা হারাম বস্তুসমূহকে সেভাবে গ্রহণ না করে, কিংবা হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল হিসেবে আখ্যা দেয়, সেও কাফেরে পরিণত হয়। যদি কোনো ব্যক্তি সর্বসাধারণের শ্রুত ও জ্ঞাত কোনো একটি ইসলামী বিশ্বাসকে অস্বীকার কিংবা ঘৃণা করে, অর্থাৎ, এমন শিক্ষা যা সাধারণ মুসলমানগণও শুনেছেন এবং জেনেছেন, তাহলে সেও কাফেরে রূপান্তরিত হবে। যদি কোনো সাধারণ ব্যক্তি সর্বসাধারণ্যে ততোটুকু জ্ঞাত কিংবা শ্রুত কিংবা প্রসারলাভকৃত শিক্ষাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত না হয়, যা তার জানা থাকা উচিৎ, তবে সে কাফের হবে না বটে, কিন্তু গুণাহগার (ফাসিক) হবে।

ঈমানের মূলনীতি

”ওই মহান ব্যক্তি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ্ (দ:)! এবার আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।” ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করার এবং উত্তর পাওয়ার পর হযরত জিবরাইল আমীন (আ:) রাসূলে আকরাম (দ:)-এর কাছে ঈমানের সারমর্ম ও প্রকৃতি জানতে চাইলেন। ঈমান অর্থ হলো কোনো সত্তাকে ত্রুটিবিহীন ও সত্যবাদী জানা এবং তাঁর প্রতি আস্থা রাখা। শরীয়তের পরিভাষায় অবশ্য এর মানে হলো এই বিষয়টিতে বিশ্বাস যে, রাসূলে আকরাম (দ:) আল্লাহতা’লার সর্বশেষ মনোনীত পয়গম্বর; আর এ কথাটি সর্বান্তকরণে মৌখিকভাবে উচ্চারণ করা এবং তিনি যা সংক্ষিপ্তভাবে এনেছেন তা সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্বাস করা ও তিনি যা আল্লাহ্ পাকের কাছ থেকে বিস্তারিতভাবে এনেছেন তা বিস্তারিতভাবে বিশ্বাস করা; এ ছাড়া যতোবার সম্ভব ঘন ঘন কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করা। শক্তিশালী ঈমান সেটাই – যেভাবে আগুন দহন করে কিংবা সর্পের বিষ মৃত্যু ঘটায় ইত্যাদি চির সত্যে আমরা বিশ্বাস করি এবং ওগুলো থেকে সতর্ক থাকি, ঠিক সেভাবে আমাদেরকে আল্লাহতা’লা ও তাঁর গুণাবলীকে মহান জানতে হবে এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে, আর তাঁর প্রেম ও সৌন্দর্যের (জামাল) জন্যে প্রার্থী হতে হবে এবং তাঁর গযব (রুদ্র রোষ) ও জালাল (ভয়াল রূপ) হতে সতর্ক থাকতে হবে। মারবেলে খোদাইকৃত লেখার মতোই এই ঈমানকে আমাদের হৃদয়ের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করতে হবে।

ঈমান ও ইসলাম হলো এক-ই। উভয়টিতেই কোনো ব্যক্তিকে কলেমায়ে শাহাদাত-এ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। যদিও “উমুম” (সার্বিক দিকগুলো) ও “খুসুস” (বিশেষ দিকগুলো)-তে তাদের উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান এবং যদিও তাদের উভয়ের আক্ষরিক অর্থ পৃথক, তবু শরীয়তে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য-ই বিরাজমান নেই।

ঈমান কি একটি মৌল উপাদান? নাকি বহু যৌগ উপাদানে গঠিত? যদি এটা যৌগ উপাদানে গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে এর কতোগুলো অংশ আছে? আমল কিংবা এবাদত ঈমানের অন্তর্ভুক্ত কি-না? যখন “আমি ঈমান রাখি” বলা হয়, তখন কি “ইনশা’আল্লাহ্” যোগ করা উচিৎ? ঈমানের মধ্যে কি স্বল্পতা কিংবা স্ফীতি আছে? ঈমান কি একটি প্রাণী? এটা কি কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তির আয়ত্ত্বাধীন? নাকি ঈমানদারেরা চাপের মুখেই বিশ্বাস করে নিয়েছেন? যদি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শক্তি কিংবা চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তাহলে কেন সবাইকে বিশ্বাস করতে আদেশ দেয়া হয়েছে? এ প্রশ্নগুলে একে একে ব্যাখ্যা করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। অতএব, এখানে আমি এগুলো আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করবো না। কিন্তু এটা ভাল করে জেনে রাখা দরকার যে, আশআরী ও মু’তাযেলা মতবাদ অনুযায়ী আমাদের সাধ্যাতীত কোনো কর্ম সংঘটন করার আদেশ দেয়াটা আল্লাহর পক্ষে জায়েয নয়। আর মু’তাযেলা সম্প্রদায়ের মতানুযায়ী তা সম্ভব, কিন্তু মানুষের ক্ষমতাবহির্ভূত কাজের আদেশ দেয়া আল্লাহর পক্ষে জায়েয নেই। আশআরীদের মতে এটা জায়েয, কিন্তু খোদাতা’লা তা আদেশ করেন নি। মানুষদেরকে আকাশে উড়তে বলা এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত। ঈমান কিংবা এবাদতের ক্ষেত্রে কোথাও আল্লাহ্ পাক তাঁর সৃষ্টিসমূহকে তাদের সাধ্যাতীত কোনো কাজ করতে আদেশ দেন নি। এ কারণেই যে ব্যক্তি মুসলিম থাকা অবস্থায় পাগল কিংবা গাফেল (উদাসীন) কিংবা নিদ্রাচ্ছন্ন কিংবা মৃত হয়ে যায়, সে মুসলমান-ই থাকে; যদিও তার অবস্থা নিশ্চিত নয়।

এই হাদীসে ‘ঈমানের” আক্ষরিক অর্থ সম্পর্কে চিন্তা করা আমাদের উচিৎ নয়। কেননা, তদানীন্তন আরবে এমন কোনো সাধারণ মানুষও ছিলেন না, যিনি এর আক্ষরিক অর্থ জানতেন না। সত্য বটে, নবী করীম (দ:)-এর সাহাবীগণও (রা:) তা জানতেন। কিন্তু হযরত জিবরীল (আ:) শরীয়তে এর অর্থ কী তা জিজ্ঞেস করে সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-কে ঈমানের অর্থ শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ্ (দ:) বলেছেন যে ঈমান হলো ছয়টি বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস:
১। প্রথমতঃ “আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস।” আল্লাহতা’লা-ই যে ’ওয়াজিব আল অজুদ’ এবং প্রকৃত মা’বুদ (উপাস্য) ও সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, তা ওই ছয়টি বিষয়ের প্রথমটি। এটা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে কেবলমাত্র আল্লাহতা’লাই এ জগত ও পরবর্তী জগতে শূন্য হতে কোনো বস্তু, সময় কিংবা সাযুজ্য ছাড়াই সকল জিনিস সৃষ্টি করে থাকেন। তিনি যেমন বিশ্বজগতের সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনি তিনি-ই সব কিছু ধ্বংস করে দেবেন (কেয়ামতের সময়)। সৃষ্টিসমূহের স্রষ্টা, মালিক, সর্বময় শাসনকারী  হলেন একমাত্র আল্লাহ্ পাক-ই। এ কথাও বিশ্বাস ও জ্ঞাত করতে হবে যে তাঁর ওপর কোনো আধিপত্য বিস্তারকারী কিংবা হুকুমকারী অথবা তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সত্তা আর কেউই নেই। সব ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবং পূর্ণতার গুণাবলী একমাত্র আল্লাহতা’লার জন্যেই বিহিত। তাঁর মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি কিংবা বিচ্যুতি বিরাজমান নেই। তিনি যা এরাদা (ইচ্ছা) করেন, তা-ই করতে সক্ষম হন। তিনি কাউকে খুশি করার জন্যে কিছু করেন না। পুরস্কারের জন্যেও তিনি কিছু করেন না। তবে তাঁর কৃত সকল কর্মের মধ্যেই হেকমত বা গোপন বিষয়াদি, উপকার ও বরকতসমূহ অন্তর্নিহিত রয়েছে।

সৃষ্টিসমূহের কল্যাণ ও উপকার করতে আল্লাহ বাধ্য নন। আবার কিছু লোককে পুরস্কৃত করে কিছু লোককে শাস্তি দিতেও তিনি বাধ্য নন। যদি তিনি সকল পাপীকে জান্নাতে দাখিল করেন, তবে সেটা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও দয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর তাঁর ন্যায়বিচারের সাথে এটাও সঙ্গতিপূর্ণ হবে যদি তিনি তাঁর অনুগত এবাদত-বন্দেগীকারীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন। তবু তিনি ঘোষণা ও ডিক্রি (বিধান জারি) করেছেন যে তাঁর উপাসনাকারী মুসলমানদেরকে তিনি জান্নাতে দাখিল করবেন এবং তাঁদের প্রতি তাঁর রহমত বর্ষণ করবেন, আর তিনি অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে জাহান্নামে অনন্তকাল শাস্তি দেবেন। তিনি কখনোই তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। যদি সমস্ত সৃষ্টিজগত তাঁকে বিশ্বাস করতো এবং তাঁর অর্চনা করতো, তাতে তাঁর কোনো উপকার-ই হতো না। পক্ষান্তরে, যদি সমস্ত সৃষ্টিজগত অবিশ্বাসী কিংবা অবাধ্য হয়ে যেত, তাতেও তাঁর কোনো ক্ষতি হতো না। যখন মানুষ কোনো কিছু করতে চায়, তখন তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি তা সৃষ্টি করে দেন। তাঁর সৃষ্ট মানুষের সকল ক্রিয়া এবং সকল বস্তু একমাত্র আল্লাহতা’লাই সৃষ্টি করে থাকেন। যদি তিনি সৃষ্টির এরাদা (ইচ্ছা) না করেন, তবে কোনো কিছুই সংঘটিত হতে পারে না। যদি তিনি ইচ্ছা না করেন, তাহলে কেউই অবিশ্বাসী কিংবা বিদ্রোহী হতে পারে না। কেউই তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় কিংবা কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি কেন এমন করেছেন অথবা অমন করেছেন অথবা তিনি কীভাবে করবেন সে বিষয়ে মন্তব্য করার কোনো অধিকার কিংবা ক্ষমতা কারোরই নেই। শেরক কিংবা কুফর ছাড়া বাকি যে কোনো বড় অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি, যে নাকি তওবা  ব্যতিরেকেই মৃত্যু বরণ করেছে, তাকে তিনি ইচ্ছা করলে মাফ করে দিতে পারেন। অপর পক্ষে, তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তবে ছোট-খাটো পাপের জন্যেও তিনি তাকে শাস্তি দিতে পারেন। তিনি ঘোষণা করেছেন যে তিনি কখনোই অবিশ্বাসী ও ধর্মত্যাগী (মুরতাদ)-দেরকে ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে অনন্তকাল শাস্তি দেবেন। তিনি তাঁর এবাদতকারী সেই সব মুসলমানদেরকেও শাস্তি দেবেন যাদের আকিদা-বিশ্বাস আহলে সুন্নাতের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং যারা তওবা না করে মৃত্যু বরণ করেছে।

পৃথিবীতে চোখ দ্বারা আল্লাহতা’লাকে দেখা সম্ভব (জায়েয), কিন্তু কেউই কখনো দেখেন নি। শেষ বিচার দিনে কাফের ও গুণাহগার মুসলমানরা তাঁকে তাঁর রূদ্র রূপে দেখতে পাবে। পক্ষান্তরে, পুণ্যবান মুসলমানগণ তাঁকে তাঁর জামাল (সুন্দর) ও দয়ালু রূপে দেখতে পাবেন। বিশ্বাসীগণ তাঁকে তাঁর “জামালী” গুণাবলীসহ বেহেশতে দেখবেন। ফেরেশতা ও মহিলারাও তাঁকে দেখতে পাবেন। কিন্তু অবিশ্বাসী কাফেররা এ থেকে বঞ্চিত হবে। একটি শক্তিশালী খবরে (বর্ণনায়) বিবৃত হয়েছে যে (অধিকাংশ) জ্বিনরাও এ থেকে বঞ্চিত হবে। অধিকাংশ উলামার মতানুযায়ী “আল্লাহতা’লার ভালোবাসাপ্রাপ্ত মুসলমানগণ প্রতি সকাল ও প্রতি বিকেলে আল্লাহতা’লার ’জামাল’ (সৌন্দর্য) দর্শনে ধন্য হবেন। কম মর্যাদাসম্পন্ন মুসলমানগণ প্রতি শুক্রবার তাঁর দর্শনে ধন্য হবেন; আর মহিলাগণ দুনিয়ার উৎসব পর্বের দিনগুলোর মত বছরে কয়েকবার তাঁকে দেখবেন।” এটা বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহতা’লাকে দেখা যাবে। কিন্তু এটা কীভাবে হবে তা নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ নয়। কেননা, আকল্ (বুদ্ধি) দ্বারা আল্লাহ্ পাকের কর্মকাণ্ড উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাঁর ক্রিয়াসমূহ দুনিয়াবী বিষয়াবলী নয়। সেগুলোকে পদার্থ বিদ্যা কিংবা রসায়ন বিদ্যার মাপকাঠিতে পরিমাপ করা যায় না। দিক কিংবা বিপরীত দিক কিংবা কাছের দিক দ্বারা আল্লাহর অবস্থান নির্ণীত হয় না। আল্লাহ্ পাক কোনো বস্তু নন। তিনি কোনো উপাদান কিংবা উপাদানের সংমিশ্রণ কিংবা যৌগ উপাদানও নন। তিনি অসীম। তিনি সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ নন, তাই তাঁকে মূল্যায়নও করা যায় না। তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না। তিনি স্থান, কাল, পাত্র দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। তার কোনো অতীত কিংবা ভবিষ্যত, সম্মুখভাগ কিংবা পশ্চাৎভাগ, উপরিভাগ কিংবা তলদেশ, দক্ষিণ কিংবা বাম দিক নেই। অতএব মানব যুক্তি কিংবা বুদ্ধি কিংবা জ্ঞান তাঁকে উপলব্ধি করতে একেবারেই অক্ষম। তাই তাঁকে কীভাবে দেখা যাবে তা মানুষ বুঝতে অপারগ। যদিও আল্লাহতা’লার জন্যে অপ্রযোজ্য ’হাত’, ’পা’, ’দিক’, ’স্থান’ ও অনুরূপ বিষয়াদির বর্ণনা কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহে বিরাজমান, তবুও বর্তমানকালে আমরা যেভাবে সেগুলোর ব্যবহার করি, সেভাবে সেগুলোর অর্থ ব্যবহৃত হয় নি। ওই ধরনের আয়াত ও হাদীসসমূহকে “মুতাশাবিহাত” বলা হয়ে থাকে। এগুলোতে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু মুতাশাবিহাতকে বুঝতে অথবা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে উচিৎ হবে না। অথবা সেগুলোকে তা’বিল (ভিন্নতর ব্যাখ্যা) করা যেতে পারে সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত আকারে। অর্থাৎ, আল্লাহতা’লার জন্যে বিহিত অর্থসমূহ সেগুলোর প্রতি আরোপ করা যেতে পারে। যথা – ‘হাত’কে শক্তি কিংবা ক্ষমতারূপে ব্যাখ্যাকরণ।

মে’রাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ্ (দ:) আল্লাহ পাকের দর্শন লাভ করেন (এ দর্শন চর্মচক্ষে হয়েছিল)। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি দাবি করে সে আল্লাহকে এ পৃথিবীতে দেখেছে, তবে সে একজন যিনদিক (অন্তর্ঘাতী শত্রু)। আউলিয়ায়ে কেরামের দর্শনক্ষমতা অবশ্য এ পৃথিবীর কিংবা পরকালের দৃষ্টিক্ষমতা নয়। আরেক কথায়, তাঁদের ওপর “রূ’য়্যা” (দৃষ্টি) নয়, বরং “শুহুদ” (দিব্যদৃষ্টি) প্রকাশ পায়। কিছু আউলিয়া বলেছেন যে তাঁরা দর্শন করেছেন। তবে, তাঁদের জযবার অবস্থায় (অর্থাৎ, ভাবের সাগরে তন্ময় অবস্থায়) তাঁরা শুহুদকে রূ’য়্যা হিসেবে ভুল বুঝেছিলেন। অথবা তাঁদের কথাকে তা’বিল করতে হবে।

প্রশ্ন: ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে আল্লাহকে এ পার্থিব চোখ দ্বারা দেখা জায়েয (সম্ভব)। তাহলে যে ব্যক্তি এটাকে সম্ভব বলে তাকে কীভাবে যিনদিক আখ্যা দেয়া যায়? যদি ওই কথা উচ্চারণকারী ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়, তাহলে কি সেটাকে সম্ভব বলা যাবে?

উত্তর: আক্ষরিক অর্থে “জায়েয” শব্দটির মানে হলো সংঘটিত হওয়া সম্ভব কিনা। তবে ইমাম আশআরীর মতে, রূ’য়্যার সম্ভবনার অর্থ হলো আল্লাহতা’লা মানুষের মধ্যে এমন এক ভিন্ন ধরনের দর্শনক্ষমতা সৃষ্টি করতে সক্ষম যা তাঁকে সামনাসামনি দেখার থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন এবং যা তাঁর সৃষ্ট দুনিয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম হতেও ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি যেহেতু সক্ষম, সেহেতু এটা সম্ভব যে চীনের একজন অন্ধ লোককে তিনি আন্দালুসিয়ার একটি মশা প্রদর্শন করতে পারেন কিংবা চাঁদ অথবা নক্ষত্রের মধ্যে অবস্থিত কোনো বস্তু তিনি পৃথিবীতে অবস্থানকারী একজন ব্যক্তিকে প্রদর্শন করতে পারেন। এ ক্ষমতাটি কেবলমাত্র আল্লাহতা’লার জন্যেই সুনির্দিষ্ট (খাস্)। উপরন্তু, আমরা বলি, “আমি এ পৃথিবীতে দেখেছি” বলাটা আয়াত ও উলামায়ে কেরামের মতৈক্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। অতএব, যে ব্যক্তি ও রকম কথা বলবে, সে যিনদিক কিংবা মুলহিদ (ধর্মচ্যুত) হয়ে যাবে। তৃতীয়তঃ আমরা বলি, “এ পৃথিবীতে আল্লাহকে দেখা জায়েয” মানে এই নয় যে “প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের অধীন এ পৃথিবীতে আল্লাহকে দেখা জায়েয।” কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি অন্যান্য বস্তুকে দেখার মতোই আল্লাহকে দেখার দাবি করে, তাহলে তার এ দাবি জায়েয (সম্ভব) নয়। যে ব্যক্তির কথাবার্তা অবিশ্বাস জন্ম দেয়, তাকে যিনদিক কিংবা মুলহিদ বলে। অতএব, সাবধান!

আল্লাহতা’লার সাথে সময় কিংবা দিন-রাত্রির আবর্তন সম্পৃক্ত নয়। তাঁর মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন-ই সাধিত হয় না। এ কথাও বলা যায় না যে তিনি অতীতে এ ধরনের ছিলেন, কিংবা ভবিষ্যতে আরেক ধরনের হবেন। আল্লাহ্ পাক কোনো কিছুর মধ্যে প্রবিষ্ট হন না। কোনো জিনিসের সাথে তিনি একীভূতও হন না। আল্লাহতা’লার কোনো শরীক, সহকারী, পথ প্রদর্শক কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী সত্তা নেই। তাঁর কোনো পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা কিংবা স্ত্রীও নেই। তিনি সর্বদা সকলের কাছে হাযের-নাযের, সকল জিনিস ও বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। প্রত্যেক ব্যক্তির গ্রীবাস্থ শিরাটির চাইতেও তিনি সন্নিকটে। তবে আমরা উপরোক্ত কথানুযায়ী তাঁর উপস্থিতি, নৈকট্য বলতে যা বুঝি, বাস্তবে কিন্তু তা নয়। তাঁর নৈকট্য উলামাগণের জ্ঞান, বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্ক দ্বারা উপলব্ধি করা অসম্ভব। মানব যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধি কথাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে সক্ষম নয়। আল্লাহ্ পাক তাঁর সত্তা ও গুণাবলীতে তুলনাবিহীন এবং অসাযুজ্যপূর্ণ। তাঁর সত্তাগত গুণাবলীর মধ্যেও কোনো পরিবর্তন অথবা পৃথকীকরণ সাধিত হয় না।

আল্লাহ্ পাকের নামগুলো তওকিফী। অর্থাৎ, তাঁর নামগুলো শরীয়ত প্রদর্শিত পন্থায় ব্যবহার করা অনুমতিপ্রাপ্ত এবং অন্য শব্দ ব্যবহার করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। আল্লাহতা’লার নামগুলোও অশেষ। এটা সুপ্রসিদ্ধ যে তাঁর এক হাজার একটি নাম আছে। অর্থাৎ, তিনি তাঁর বান্দাদের কাছে এক হাজার একটি নাম প্রকাশ করেছেন। তবে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শরীয়তে আল্ আসমাউল হুসনা” নামক নিরানব্বইটি নাম-ই কেবল প্রকাশিত হয়েছে।

মাতুরিদিয়া মযহাবে “সিফাতুস্ সুবুতিয়া” আটটি। আশআরিয়া মযহাবে সাতটি। আল্লাহতা’লার সত্তা মোবারকের মতো তাঁর এ সব সিফাত (গুণ)-ও চিরন্তন, চিরস্থায়ী। এগুলো পুতঃপবিত্রও। সৃষ্টিসমূহের গুণাবলীর মতো এগুলো নয়। মানুষের ওপর তাঁর প্রতিটি গুণের উদাহরণ তিনি প্রতিফলিত করেছেন। এগুলো দেখে আল্লাহতা’লার গুণাবলী সম্পর্কে অল্প কিছুটুকু উপলব্ধি করা যায়। যেহেতু মানুষ আল্লাহকে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে অক্ষম, সেহেতু তাঁকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করার কিংবা চিন্তাভাবনা করার কোনো অনুমতি-ই নেই। তাঁর আটটি গুণ তাঁর সত্তাকে গঠন করে না, আবার সেগুলো তাঁর সত্তা থেকে অসম্পৃক্ত কিছুও নয়। এ আটটি সিফাত হলো: (১) হায়াত, (২) এলম (সর্বজ্ঞান), (৩) সাম’ (শ্রবণশক্তি), (৪) বাসার (দৃষ্টিশক্তি), (৫) কুদরত (সর্বশক্তি), (৬) কালাম (বাকশক্তি), (৭) এরাদা (চূড়ান্ত ইচ্ছা) এবং (৮) তাকওয়ীন (সৃজনশীলতা)। আশ্আরী মযহাবে তাক্উয়ীন ও কুদরত মিলেই একটি গুণ। “মাশীয়্যা” ও এরাদা হলো সমার্থক শব্দ।

আল্লাহ্ তা’লার আটটি গুণের প্রত্যেকটি-ই অতুলনীয় এবং অপরিবর্তনীয় অবস্থায় বিরাজমান। সেগুলোর মধ্যে কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না। কিন্তু সৃষ্টিসমূহের সাথে সম্পৃক্ততার অনুপাতে সেগুলো সৃষ্টিসমূহে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে প্রকাশমান। আর সৃষ্টিসমূহের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সেগুলোর অতুলনীয়তাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।  অনুরূপভাবে, যদিও আল্লাহ্ পাক-ই এতো রকম সৃষ্টি করেছেন এবং লয়প্রাপ্তি থেকে ওগুলোকে রক্ষা করছেন, তবুও তিনি একই সত্তা। তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন-ই সংঘটিত হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তেই প্রত্যেক সৃষ্টির তাঁকেই প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর কাউকে প্রয়োজন নেই।

ঈমানের ছয়টি মূলনীতির দ্বিতীয়টি হলো “খোদা তা’লার ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস।” ফেরেশতাগণ বস্তু নন, বরং লতিফ (বায়বীয়)। বস্তুর গ্যাসীয় স্তর হতেও অধিক বায়বীয় তাঁরা। তাঁরা নূরানী (জ্যোতির্ময়) এবং জীবিতও বটেন। তাঁদের আকল্ (বিচার-বুদ্ধি) আছে। মানবের মধ্যে যে সব মন্দ আছে তা তাঁদের মধ্যে বিরাজ করে না। তাঁরা যে কোনো আকৃতি গ্রহণ করতে সক্ষম, গ্যাস যেমন তরল ও কঠিন আকৃতি গ্রহণ করতে পারে, ঠিক তেমনি ফেরেশতাগণও সুন্দর আকৃতিসমূহ গ্রহণ করতে পারেন। ফেরেশতাগণ মহান ব্যক্তিদের দেহত্যাগকারী রূহসমূহ নন। খ্রীষ্টানরা মনে করেন থাকেন যে ফেরেশতাগণ বুঝি তা-ই। শক্তি ও ক্ষমতার সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে তাঁরা অ-বস্তুগত নন। কিছু প্রাচীন দার্শনিকরা তাঁদেরকে তা-ই ধারণা করেছিলেন। তাঁদের সবাইকে “মালাইকা” বলা হয়ে থাকে। “মালাক” (ফেরেশতা) অর্থ “প্রতিনিধি,” “বার্তাবাহক” অথবা “শক্তি”। সকল জীবিত সৃষ্টির আগেই ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সুতরাং পবিত্র কেতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাসের আগে ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্যে আমরা আদিষ্ট হয়েছি, যে কেতাবসমূহ নবী (আ:)-গণের আগে এসেছে। আর কুরআন মজীদে এ সব বিশ্বাসের নামগুলো এই ক্রমানুসারেই বিবৃত হয়েছে।

ফেরেশতাকুলের প্রতি বিশ্বাস নিম্নের বর্ণনা মোতাবেক হতে হবে: ফেরেশতাগণ খোদা তা’লার সৃষ্টি। তাঁরা তাঁর শরীক (অংশীদার) নন, পুত্র কিংবা কন্যাও নন – যেভাবে কাফের ও মুশরিকরা ধারণা করতো। আল্লাহতা’লা তাঁর সকল ফেরেশতাকেই ভালোবাসেন। তাঁরা আল্লাহতা’লার আদেশ মান্য করেন এবং কখনোই পাপ সংঘটন কিংবা আদেশ অমান্য করেন না। তাঁরা পুরুষ কিংবা নারী নন। তাঁরা বিয়েও করেন না। তাঁদের কোনো সন্তানও নেই। তাঁদের জীবন আছে; অর্থাৎ, তাঁরা জীবিত। তবে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত একটি রওয়ায়াত অনুসারে কতিপয় ফেরেশতার সন্তান ছিল, যাদের মধ্যে শয়তান ও জীনদেরকে ধরা হয়ে থাকে; এর তা’বিল (বিশদ ব্যাখ্যা) বিভিন্ন বই-পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যখন আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেন যে তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক, তখন ফেরেশতাগণ আরয করেন, “হে আল্লাহ পাক! আপনি কি ওদের সৃষ্টি  করবেন যারা দুনিয়ার বুকে ফিতনা ও রক্তপাত ঘটাবে?” “যাল্লা” নামক তাঁদের এ সকল প্রশ্ন ফেরেশতাগণের ক্রটিহীনতার কোনো ক্ষতি সাধন করে না।
সকল সৃষ্টির মধ্যে ফেরেশতাগণ-ই হলেন অধিক সংখ্যক। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউই তাঁদের সংখ্যা জানেন না। আসমানে এমন কোনো খালি জায়গা নেই যেখানে ফেরেশতাগণ এবাদত করেন না। আসমানের প্রত্যেক জায়গা-ই রুকূকারী কিংবা সেজদাকারী ফেরেশতাগণ দ্বারা পরিপূর্ণ। আসমানে, পৃথিবীতে, ঘাসে, তারা-নক্ষত্রে, সকল জীবিত ও জড় সৃষ্টিতে, প্রতিটি বৃষ্টির ফোটায়, বৃক্ষ-লতায়, অণু-পরমাণুতে, প্রত্যেক প্রতিক্রিয়ায়, স্পন্দনে, এক কথায়, সকল বিষয়ে ফেরেশতাগণের কর্তব্য নিহিত। সর্বত্র তাঁরা আল্লাহতা’লার আদেশ পালন করে থাকেন। আল্লাহতা’লা ও সৃষ্টিজগতের মধ্যে তাঁরা হলেন মধ্যস্থতাকারী। তাঁদের কেউ কেউ আবার অন্যান্য ফেরেশতাদের সরদার (আমীর)। মানবের মধ্যে নবীগণের কাছে তাঁদের কেউ কেউ বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছেন। মানব অন্তরে কতিপয় ফেরেশতা “এলহাম” (ঐশী প্রত্যাদেশ) নামক ভাল চিন্তা বহন করে নিয়ে আসেন। অপর কয়েকজন ফেরেশতা আল্লাহতা’লার জামাল (সৌন্দর্য) অনুভব করে চেতনালুপ্ত হয়ে মানবকুল ও সৃষ্টিজগত সম্পর্কে অনবধান অবস্থায় আছেন। প্রত্যেক ফেরেশতা-ই নির্দিষ্ট একটি স্থানে অবস্থান করেন। তাঁরা তাঁদের স্থানত্যাগ করতে পারেন না। কারো কারো দুইটি পাখা আছে, কারো বা চারটি কিংবা ততোধিক। বেহেশতের ফেরেশতাগণ সেখানে অবস্থান করেন। তাঁদের নেতা হলেন “রিদ্ওয়ান”। জাহান্নামের ফেরেশতাগণ যাঁদের নাম “যাবানী”, তাঁরা জাহান্নামে যা করতে আদিষ্ট হন, তা তাঁরা পালন করেন। সমুদ্র যেমন মাছের জন্যে ক্ষতিকর নয়, তেমনি জাহান্নামের আগুনও তাঁদের কোনো  ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। ’যাবানী’দেরকে ১৯জন নেতৃত্ব দেন। তাঁদের প্রধান হলেন “মালিক”।

প্রত্যেক মানুষের ভাল ও মন্দ কাজ নথিভুক্ত করেন চারজন ফেরেশতা। দুইজন রাতে এবং অপর দুইজন দিনে আসেন। তাঁদেরকে বলা হয় “কিরামান কাতেবীন” অথবা “হাফাযা” ফেরেশতা। এ কথাও বলা হয়েছিল যে হাফাযা ফেরেশতাগণ কিরামান কাতেবীন হতে ভিন্ন। ডান কাঁধের ফেরেশতাটি বাঁ কাঁধের ফেরেশতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তিনি সৎকাজসমূহ নথিভুক্ত করেন। বাঁ কাঁধের ফেরেশতা বদ কাজসমূহ নথিভুক্ত করেন। অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে এবং অবাধ্য মুসলমানদেরকে তাদের কবরে শাস্তি দেবার জন্যে কতিপয় ফেরেশতা বিরাজমান; কবরে সওয়াল-জওয়াবের জন্যেও কতিপয় ফেরেশতা বিদ্যমান। প্রশ্নকারী ফেরেশতাগণ হলেন “মুনকার” ও “নকির”। মুসলমানদেরকে যাঁরা প্রশ্ন করবেন তাঁদেরকে “মুবাশশির” এবং “বাশীর”-ও বলা হয়।

ফেরেশতাগণের একে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব আছে। শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা হলেন চারজন। তাঁদের প্রথম জন হলেন হযরত “জীবরাইল আমীন” (আ:)। তাঁর দায়িত্ব ছিল আম্বিয়া (আ:)-দের কাছে ওহী পৌঁছানো এবং আদেশ নিষেধসমূহ অবহিত করানো। দ্বিতীয় জন হযরত “ইস্রাফিল” (আ:), যিনি “সুর” নামক শিঙ্গায় শেষ ফুঁক দেবেন। তিনি দুবার ফুঁক দেবেন। প্রথম ফুঁকে আল্লাহ্ ছাড়া সকল প্রাণী-ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন। দ্বিতীয় ফুঁকে সকলেই প্রাণ ফিরে পাবেন। তৃতীয় ফেরেশতা হলেন হযরত “মিকাইল”(আ:)। তাঁর কাজ হলো আধিক্য কিংবা অভাব দান করা এবং প্রত্যেক বস্তুকে স্থানান্তর করা। চতুর্থ জনের নাম হযরত ”আযরাইল”। তিনি রূহ্ বা জান কবজ করেন। এই চারজনের পরে চারটি শ্রেণীর উচ্চ মকামের ফেরেশতাগণ বিরাজমান: “হামালাত আল আরশের” চারজন ফেরেশতা, যাঁরা পুনরুত্থানের সময় আটজন হবেন। “মুকাররাবুন” নামের ফেরেশতাগণ, যাঁরা খোদা তা’লার সান্নিধ্যে আছেন। এরপর শাস্তি প্রদানকারী ফেরেশতাদের নেতৃবৃন্দ, যাঁদের নাম “কারুবিয়ুন”, অতঃপর রহমতের ফেরেশতাগণ, যাঁদের নাম “রূহানীয়ুন”। এ সকল উচ্চ মকামের ফেরেশতাগণও নবী, ওলী ও পুণ্যবান মুসলমানগণ ছাড়া সকল মানব সন্তানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সাধারণ কিংবা নিম্ন মকামের ফেরেশতাদের চেয়ে মুসলমানগণ অধিক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। আর সাধারণ ফেরেশতাগণ হলেন সাধারণ তথা পাপী, অবাধ্য মুসলমানদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

অবশ্য অবিশ্বাসী কাফেররা সকল সৃষ্টির চেয়ে নিকৃষ্ট। “সুর”-এর প্রথম আওয়াজে ’হামালাত্ আল্ আরশ্’ ও চারজন প্রধান ফেরেশতা ছাড়া বাকি সকল ফেরেশতা-ই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। এরপর তাঁরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। দ্বিতীয় আওয়াজে সকল ফেরেশতা-ই জীবন ফিরে পাবেন। “সুর”-এর দ্বিতীয় আওয়াজটির অল্প আগেই ’হামালাত্ আল্ আরশ্’ ও চারজন প্রধান ফেরেশতা উত্থিত হবেন। এরপর সকল প্রাণীর বিলুপ্তি হলে এ সকল ফেরেশতাও নিশ্চিহৃ হয়ে যাবেন, যেহেতু তাঁদেরকে সবার আগে সৃষ্টি করা হয়েছিল।

৩।  ঈমানের ৩য় মূলনীতি হলো “আল্লাহ্ তা’লা কর্তৃক প্রকাশিত কেতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন”। আল্লাহতা’লা এ সব কেতাব কিছু নবী (আ:)-এর কাছে প্রেরণ করছিলেন ফেরেশতার মাধ্যমে, যিনি এগুলো তাঁদেরকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। কয়েকজনের কাছে তিনি (পাথরের) ফলকের ওপর খোদাইকৃত কেতাব পাঠিয়েছিলেন, আর কয়েকজনের কাছে ফেরেশতার মধ্যস্থতা ছাড়াই (বাণী) শ্রবণ করিয়েছিলেন। এ কেতাবগুলোর সবগুলোই কালামুল্লাহ্ (আল্লাহর বাণী); এগুলো অতীত হতেই অনন্ত, চিরন্তন। এগুলো সৃষ্টি নয়, ফেরেশতাদের বানানো কথাও নয়, আবার নবী (আ:)-গণের বাণীও নয়। আমরা যে ভাষায় লিখি, মস্তিষ্কে ধারণ কান এবং কথা বলি, তার সাথে খোদাতা’লার বাণী সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এটা লেখনী, বক্তৃতা কিংবা মস্তিষ্কে থাকার মতো নয়। এর কোনো আক্ষরিক শব্দ নেই। আল্লাহতা’লা ও তাঁর সিফাত (গুণাবলী)-সমূহ কেমন, তা মানুষ উপলব্ধি করতে অক্ষম। কিন্তু মানুষ সেই বাণীটি পাঠ করতে, মস্তিষ্কে ধারণ করতে এবং লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম। যখন সেটা আমাদের সাথে অবস্থান করে, তখন সেটা হাদীস তথা সৃষ্টিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ, আল্লাহর কালামের দুইটি দিক আছে। যখন এটা মানুষের সাথে বিরাজ করে, তখন এটা হাদীস ও সৃষ্টি। আর যখন এটাকে আল্লাহর বাণী হিসেবে চিন্তা করা হয়, তখন এটা ’কাদিম’ (চিরন্তন)।
আল্লাহতা’লা কর্তৃক প্রেরিত সকল আসমানী কেতাব-ই সত্য, সঠিক ও ন্যায্য। সেগুলোর মধ্যে কোনো মিথ্যা অথবা ত্রুটি নেই। যদিও তিনি বলেছেন তিনি আযাব ও শাস্তি দেবেন, তবুও এ কথা বলা হয়েছে যে তাঁর দ্বারা ক্ষমা প্রদর্শন করাও সম্ভব (জায়েয)। এটা তাঁর এরাদা (ইচ্ছা) কিংবা মানুষের অজ্ঞাত শর্তাবলীর ওপর নির্ভরশীল। কিংবা এর মানে এই যে, মুসলমানগণ যে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, সেটা তিনি ক্ষমা করে দেবেন। যেহেতু “আযাব” ও ‘শাস্তি’ শব্দগুলো কোনো ঘটনাকে বিবৃত করে না,  সেহেতু এটা মিথ্যা হবে না যদি তিনি ক্ষমা করে দেন। অথবা, যদিও তাঁর ওয়াদাকৃত পুরস্কারসমূহ প্রদান না করা তাঁর পক্ষে জায়েয নয়, তবুও শাস্তিসমূহ মাফ করে দেয়া তাঁর পক্ষে জায়েয। আয়াতসমূহ, যুক্তি ও মানব আচরিত রীতি-নীতি আমাদেরকে সঠিক প্রমাণ করে।

আয়াত ও হাদীসমূহকে ওগুলোর আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা অবশ্য কর্তব্য, যদি না কোনো ঝুঁকি কিংবা অসুবিধা বিরাজ করে। ওগুলোর আক্ষরিক অর্থের অনুরূপ অন্য কোনো অর্থ প্রদান করার কোনো অনুমতি-ই এ ক্ষেত্রে নেই। ‘মুতাশাবিহাত’ নামক আয়াতগুলোর মধ্যে মানব জ্ঞানের উর্ধ্বে এবং গোপনীয় অর্থসমূহ নিহিত রয়েছে। শুধুমাত্র আল্লাহতা’লা এবং কিছু বিশিষ্ট বুযূর্গানে দ্বীন যাঁদেরকে “এলম-এ-লাদুন্নী”  মঞ্জুর করা হয়েছে, তাঁরা-ই কেবল এগুলোর অর্থ জানেন। আর কেউই এগুলো বুঝতে সক্ষম নয়। এ কারণেই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে মুতাশাবিহাত আয়াতসমূহ খোদা তা’লারই পাক কালাম এবং এগুলোর অর্থ আমাদের অনুসন্ধান করা চলবে না। আশ্আরী মযহাবের উলামাগণ বলেছেন যে এগুলোকে সংক্ষেপে কিংবা বিস্তারিতভাবে তা’বিল তথা ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেয়া অনুমতিপ্রাপ্ত। তা’বিল অর্থ “একটি শব্দের কয়েকটি অর্থের মধ্য হতে অব্যবহৃত অসাধারণ অর্থটি পছন্দ করে নেয়া।” উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহতা’লার বাণী “আল্লাহতা’লার হাত তাদের হাতের ওপরে” — আয়াতটির ক্ষেত্রে আমাদের বলা উচিৎ “আল্লাহ্ পাক এর দ্বারা যা বোঝাত চান, আমি তা বিশ্বাস করি।” এটা বলা সবচেয়ে ভাল, “আমি এর অর্থ উপলব্ধি করতে অক্ষম। আল্লাহতা’লার জ্ঞান আমাদের জ্ঞানের মতো নয়। তাঁর ইচ্ছাও আমাদের ইচ্ছার মতো নয়। অনুরূপভাবে, আল্লাহতা’লার হাতও তাঁর সৃষ্ট মানব জাতির হাতের মতো নয়।

আল্লাহতা’লা কর্তৃক নাযিলকৃত কেতাবসমূহের মধ্যে কিছু আয়াতের উচ্চারণ নয়ত অর্থ অথবা উভয়-ই আল্লাহতা’লা কর্তৃক পরিবর্তন করা হয়েছিল। আল-কুরআন সকল কেতাবের স্থলে অবতীর্ণ হয় এবং পূর্ববর্তী ওগুলোর আইন-কানুন রহিত করে দেয়। দুনিয়া লয়প্রাপ্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত কুরআন মজীদে কোনো ভুল-ভ্রান্তি, বিস্মৃত বিষয়, সংযোজন অথবা বিয়োজন হবে না এবং এটা বিস্মৃতও হবে না। অতীত ও ভবিষ্যতের সকল জ্ঞান-ই কুরআন মজীদে বিরাজমান। এ কারণেই এটা অন্যান্য আসমানী কেতাব হতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং মূল্যবান। রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ মো’জেযা হলো আল-কুরআন। যদি সমস্ত জ্বীন-ইনসান সমবেত হয়ে কুরআন পাকের সবচেয়ে ছোট সুরাটির অনুরূপ একটি কথাও বলতে চেষ্টা করতো, তাহলেও তারা তা পারতো না। বস্তুতঃ আরবের বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা সমবেত হয়ে যথেষ্ট খাটা-খাটুনি করেছিল, কিন্তু তারা তিনটি ছোট আয়াতের অনুরূপ কিছু-ই বানাতে পারে নি। তারা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিল। আল-কুরআনের মোকাবেলায় ইসলামের শত্রুদেরকে মহান আল্লাহতা’লা অক্ষম ও পরাভূত করে থাকেন। কুরআনের সাবলীল ভাষা মানব ক্ষমতার উর্ধ্বে। এটা যেভাবে বক্তব্য রাখে, মানুষ সেভাবে বক্তব্য রাখতে অক্ষম। কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ মানুষের রচিত পদ্য, গদ্য কিংবা গীতের মতো নয়। অথচ এটা আরবেরই বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের ভাষার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে।

আমাদের কাছে এক’শ চারটি ঐশী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; এর মধ্যে সর্বজন জ্ঞাত দশটি সুহুফ (সহিফা বা ছোট কেতাবের বহুবচন) হযরত আদম (আ:)-এর কাছে নাযিল হয়েছিল। অতঃপর পঞ্চাশটি সুহুফ হযরত শীষ (আ:), ত্রিশটি সুহুফ হযরত ইদ্রিস (আ:) এবং দশটি সুহুফ হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর কাছে নাযিল হয়। তাওরাত কেতাব অবতীর্ণ হয় হযরত মুসা (আ:)-এর কাছে; যাবুর নাযিল হয় হযরত দাউদ (আ:)-এর কাছে; ইনজিল প্রকাশিত হয় হযরত ঈসা (আ:)-এর কাছে; আর কুরআনুল করিম নাযিল হয় খাতেমুন্ নাবিয়্যিন, শাফিউল মুযনেবীন, রহমতুল্লিল্ আলামীন হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে।

কোনো ব্যক্তি যখন একটি আদেশ, নিষেধ, অনুরোধ কিংবা কিছু খবর দিতে চান, তখন তিনি প্রথমে এটা চিন্তা করেন এবং তা মস্তিষ্কে প্রস্তুত করে রাখেন। মস্তিষ্কের মধ্যে এ সকল অর্থকে “কালাম নাফসী” বলে, যাকে আরবী, ফারসী কিংবা ইংরেজি বলা যায় না। বিভিন্ন ভাষায় এগুলোর অভিব্যক্তি এগুলোর অর্থকে পরিবর্তন করতে পারে না। এ অর্থগুলোর বহিঃপ্রকাশ যে বাক্য দ্বারা করা হয়, তাকে বলা হয় “কালাম লাফযী”। কালাম লাফযী বিভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত করা যায়। অতএব, কোনো ব্যক্তির কালাম নাফসী হলো একটি খাঁটি, অপরিবর্তনযোগ্য, স্পষ্ট গুণ, যা ওর অধিকারী ব্যক্তির জ্ঞান, ইচ্ছা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি গুণাবলীর মতোই ব্যক্তিটির মধ্যে বিরামান। আর কালাম লাফযী হলো একটি বাক্যমালা, যা কালাম নাফসীকে ব্যক্ত করে এবং যা ওগুলোর উচ্চারণকারী ব্যক্তির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এবং যা কানে শ্রুত হয়ে থাকে। সুতরাং আল্লাহতা’লার কালাম হলো চিরন্তন, অবিনশ্বর, সরব ও অসৃষ্ট বাক্য, যা তাঁর পবিত্র সত্তার সাথে বিরাজমান। এটা আল্লাহতা’লার সিফাত আয্ যাতিয়্যা ও সিফাতুস্ সুবুতিয়্যা হতে একটি সুস্পষ্ট গুণ, যেমন নাকি জ্ঞান ও এরাদা (চূড়ান্ত ইচ্ছা)।

কালাম (কথা, বাক্য) গুণটি কখনোই পরিবর্তন হয় না এবং এটা খাঁটি, নির্মল। এটা অক্ষর কিংবা শব্দ নয়, এটাকে আদেশ, নিষেধ, বর্ণনা কিংবা আরবী, ফারসী, হিব্রু, তুর্কী অথবা সিরীয়-র মতো পৃথক অথবা চিহ্নিত করা যাবে না। এটা ও রকম আকার গ্রহণ করে না। এটাকে লেখাও যায় না। বুদ্ধিমত্তা, কান অথবা জিহ্বার মতো মাধ্যম কিংবা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন এর নেই। তবু আমাদের জ্ঞাত সকল সত্তা হতে পৃথক একটি সত্তা হিসেবে আমরা ওগুলোর মাধ্যমে এটাকে উপলব্ধি করতে পারি। এটা ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো ভাষায় ব্যক্ত করা যায়। অতএব, যখন এটাকে আরবীতে বলা হয়, তখন এর নাম হয় আল-কুরআন। যখন হিব্রুতে বলা হয়, তখন এটা তাওরাত। যদি এটা সিরীয়তে বলা হয়, তবে ইন্জিল। “শরহ আল-মাকাসিদ” পুস্তকটিতে লেখা আছে, যদি এটা গ্রীক-এ বলা হয়, তবে এটা ইন্জিল, আর যদি এটা সিরীয়তে বলা হয়, তবে এর নাম যাবুর।

আল-কালামুল্ ইলাহিয়্যা (ঐশী বাক্যাবলী) বিভিন্ন বিষয় ব্যক্ত করেছে: যদি এটা সংঘটিত অথবা ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য কোনো ঘটনা ব্যক্ত করে থাকে, তবে একে বলা হয় “খবর” (বর্ণনা)। যদি তা না হয়, তবে বলা হয় “ইনশা’য়া”। যদি এটা আদেশসূচক হয়, তবে এটাকে বলা হয় “আমর” (আদেশ, আজ্ঞা)। যদি নিষেধসূচক হয়, তবে বলা হয় “নাহী” (নিষেধাজ্ঞা)। কিন্তু কালামুল্ ইলাহিয়্যার মধ্যে কোনো পরিবর্তন কিংবা বৃদ্ধি নেই। প্রকাশিত প্রতিটি বই কিংবা পাতা হলো আল্লাহতা’লার কালামের একটি পাতা; অর্থাৎ, সেগুলো তাঁরই কালামুন্ নাফসী। যখন তা আরবীতে হয়, তখন তার নাম হয় আল-কুরআন। যে ওহী পদ্যে প্রকাশিত এবং লিখিত ও কথিত এবং শ্রুত ও মস্তিষ্কে ধারণকৃত হতে পারে, তাকে “কালামুল লাফযী” অথবা “আল-কুরআন” বলা হয়। যেহেতু কালামুল লাফযী কালামুন্ নাফসীকে ইঙ্গিত করে, সেহেতু এটাকে আল-কালামুল্ ইলাহিয়্যা কিংবা ঐশী গুণ বলা অনুমতিপ্রাপ্ত। যদিও এ বাণীটি একই কিসিমের, তবু এটাকে ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে বিভক্ত ও খণ্ড খণ্ড করা সম্ভব। যেহেতু এর সবটুকুকেই কুরআন বলা হয়, সেহেতু এর অংশগুলোকেও কুরআন বলা যায়।

সঠিক পথের (আহলে সুন্নাতের) উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে বলেছেন যে কালামুন্ নাফসী কোনো সৃষ্টি নয়, বরং এটা কাদিম (চিরন্তন)। কালামুল্ লাফযী কি হাদীস (সৃষ্টি) না কাদিম তা নিয়ে মতৈক্য হয় নি। যাঁরা কালামুল্ লাফযীকে হাদীস হিসেবে বিবেচনা করেছেন, তাঁরাও বলেছেন যে এটাকে হাদীস না বলা-ই উত্তম, কেননা এতে ভুল বোঝাবুঝি হবে এবং ফলস্বরূপ কালামুন্ নাফসীকেও হাদীস হিসেবে ধরে নেয়া হবে। এ সম্পর্কে এটা-ই সর্বোত্তম বক্তব্য। যখন মানব মস্তিষ্ক এমন কোনো জিনিস শুনে, যা অন্য কোনো বিষয়ের প্রতি ইশারা করে, তখন সেটা সেই ইশারাকৃত বিষয়াটিকেও একই সঙ্গে স্মরণ রাখে। যখন সঠিক পথের উলামাদের মধ্যে কাউকে বলতে শোনা যায় যে কুরআন মজীদ হলো হাদীস (শূন্য হতে অস্তিত্বপ্রাপ্ত), তখন আমাদেরকে বুঝতে হবে যে তিনি সেই সব শব্দ ও বাক্যকে বুঝিয়েছেন যেগুলো আমাদের মুখ দ্বারা আমরা পাঠ করে থাকি। সঠিক পথের উলামাবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে বলেছেন যে কালামুন্ নাফসী ও কালামুল্ লাফযী উভয়-ই হলো আল্লাহতা’লার বাণী। যদিও কিছু “উলামা” এ বাণীটিকে (অর্থাৎ কালামুন্ নাফসীকে) রূপক হিসেবে বিবেচনা করেছেন, তবু তাঁরা একমত হয়েছেন যে এটা ঐশী বাণী। কালামুন্ নাফসীকে আল্লাহর বাণী বলার মানে হলো এই যে, এটা আল্লাহতা’লার-ই বচন গুণ; আর ’কালামুল্ লাফযী খোদা তা’লার বাণী’ অর্থ হলো এটাকে খোদা তা’লা-ই সৃষ্টি করেছেন।

প্রশ্ন: উপরোক্ত লেখনী থেকে এটা উপলব্ধি করা যায় যে আল্লাহতা’লার চিরন্তন বাণী শোনা যায় না। যে ব্যক্তি বলেন, “আমি আল্লাহতা’লার বাণী শ্রবণ করেছি,” তিনি বোঝান “আমি উচ্চারিত শব্দ ও বাক্য শ্রবণ করেছি”, অথবা “আমি চিরন্তন কালামুন্ নাফসী এ সকল বাক্য দ্বারা উপলব্ধি করেছি।” সকল নবী-রসূল (আ:) এমন কি প্রত্যেক ব্যক্তি-ই এ দুইটির মধ্যে যে কোনো একটি পদ্ধতিতে কালামুন্ নাফসী শ্রবণ করতে সক্ষম। তাহলে হযরত মূসা (আ:)-কে কালিমুল্লাহ্ (আল্লাহর সাথে কথোপকথনকারী) হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ কী?

উত্তর: হযরত মূসা (আ:) চিরন্তন বাণী শ্রবণ করেছিলেন কোনো অক্ষর কিংবা শব্দ ছাড়াই, আল-আদত্ আল-ইলাহিয়্যা তথা ঐশী রীতি-নীতি বা কার্য-কারণ আইন হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রক্রিয়ায়। তিনি এটা এমনভাবে শ্রবণ করেছিলেন যা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, যেমনিভাবে বেহেশতে আল্লাহতা’লার দর্শন লাভ হবে ব্যাখ্যা ও উপলব্ধির অতীত। এ পদ্ধতিতে কেউই শ্রবণ করেন নি। অথবা, তিনি শুধুমাত্র আল্লাহতা’লার বাণী শব্দ আকারে তাঁর কান মোবারক দ্বারা-ই শ্রবণ করেন নি, বরং তাঁর দেহ মোবারকের সকল অণুকণা দ্বারা সকল দিক হতেই শ্রবণ করেছিলেন। অথবা তিনি গাছটির দিক হতেই কেবলমাত্র শ্রবণ করেছিলেন, শব্দ কিংবা বায়ুর প্রকম্পন কিংবা অন্য কোনো মাধ্যম ছাড়াই তিনি তা শুনেছিলেন। যেহেতু তিনি এ তিনটি পন্থার একটি পন্থায় তা শ্রবণ করেছিলেন, সেহেতু তাঁকে “কালিমুল্লাহ্” খেতাবটি দ্বারা মহা-সম্মানিত করা হয়েছে। মে’রাজ রজনীতে হযরত রাসূলে আকরাম (দ:)-ও একই পন্থায় খোদায়ী বাণী শ্রবণ করেছিলেন। ওহী গ্রহণের সময় হযরত জিবরাইল আমীনের (আ:) শ্রুতিও একই পন্থায় হয়েছিল।

৪। ঈমানের ছয়টি মূলনীতির মধ্যে চতুর্থটি হলো “রাসূল (আ:)-বৃন্দের প্রতি বিশ্বাস”- যাঁদের প্রেরণ করা হয়েছিল মানুষদেরকে আল্লাহ্ তা’লার পছন্দকৃত পথটি গ্রহণ করনোর উদ্দেশ্যে এবং তাদেরকে সঠিক পথের দিকে হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে। “রুসূল” (রাসূলের বহু বচন) হলেন “সে সকল পুণ্যাত্মা যাঁদেরকে ঐশী বাণীসহ প্রেরণ করা হয়েছিল।” শরীয়তের পরিভাষায় রাসূল হলেন “সেই মহান, সম্মানিত পুণ্যাত্মা যাঁর স্বভাব-চরিত্র, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা তাঁর সময়কার লোকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং যাঁর চরিত্র বদ কিংবা অপছন্দীয় স্বভাব দ্বারা কলুষিত নয়।” রাসূলগণের একটি গুণ হলো ‘আসমত’। অর্থাৎ, রেসালাত অথবা নবুয়্যতপ্রাপ্তির আগে কিংবা পরে তাঁরা কোনো বড় অথবা ছোট গুনাহ সংঘটন করেন না। নবুয়্যত সম্পর্কে তাঁদেরকে জানানোর পরে এবং তাঁদের নবুয়্যত সর্বজন জ্ঞাত ও সর্বত্র প্রসারিত না হওয়া পর্যন্ত অন্ধত্ব, বধিরতা এবং অনুরূপ ত্রুটি তাঁদেরকে গ্রাস করে নি। এতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে প্রত্যেক রাসূল (আ:)-ই সাতটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন। এগুলো হচ্ছে “আমানা” (বিশ্বস্ততা), “সিদক্” (নিষ্ঠা), “তাবলীগ” (যোগাযোগ), “আদালা” (ন্যায়পরায়ণতা), “আসমত” (নিষ্পাপ), “ফাতানা” (ঐশী জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা) এবং “আমান আল-আযল্” (নবুয়্যত হতে পদচ্যুত হবার ভীতিমুক্ত)।

যে পয়গম্বর একটি নতুন শরীয়ত নিয়ে আসেন, তাঁকে “রাসূল” বলা হয়। যে পয়গম্বর কোনো নতুন শরীয়ত আনেন না, কিন্তু মানুষদেরকে পূর্ববর্তী শরীয়তের প্রতি আহবান করেন, তাঁকে বলা হয় “নবী”। আল্লাহতা’লার দ্বীনের প্রতি মানুষদেরকে আহবানের ক্ষেত্রে এবং তাঁর আজ্ঞাবলী তাবলীগ (প্রচার, পৌঁছানো) করার ক্ষেত্রে একজন নবী ও একজন রসূলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে সকল নবী-রসূল (আ:) ব্যতিক্রম ছাড়া-ই সত্যনিষ্ঠ ও নিবেদিত ছিলেন। যে ব্যক্তি তাঁদের কোনো একজনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে না, সে তাঁদের সকলেরই প্রতি অবিশ্বাসকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।

অত্যধিক এবাদত-বন্দেগী, ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকা, কষ্ট ভোগ কিংবা কঠোর পরিশ্রম দ্বারা নবুয়্যত অর্জন করা যায় না। এটা কেবলমাত্র আল্লাহতা’লার অনুগ্রহ ও মনোনয়ন দ্বারা-ই অর্জন করা যায়। নবী-রসূল (আ:)-গণের মাধ্যমে শরীয়তসমূহ প্রেরিত হয়েছিল যাতে করে মানুষদের বিষয়াবলী এ পৃথিবীতে ও পরলোকে যথাযথ এবং উপকারী হয়; আর যাতে এলোমেলো, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড হতে তাদেরকে বিরত রেখে হেদায়াত, পরিত্রাণ, সুখ-শান্তি অর্জনে তাদেরকে পরিচালনা করা যায়। যদিও রাসূল (আ:)-গণের বহু শত্রু ছিল এবং তাঁরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছিলেন, তবু তাঁরা শত্রুদেরকে ভয় পান নি এবং বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়াবলী ও পালনীয় সৎকর্ম সংক্রান্ত খোদা তা’লার আজ্ঞাসমূহ মানুষদের কাছে প্রচার করার ক্ষেত্রে তাঁরা কাল বিলম্বও করেন নি। আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (আ:)-গণকে সত্যনিষ্ঠ ও নিবেদিত প্রতীয়মান করার উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে মু’জেযা দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। তাঁদের মু’জেযার বিরুদ্ধে কেউই দাঁড়াতে পারে নি। কোনো পয়গম্বরের কওম বা জাতিকে তাঁর “উম্মত” বলা হয়।  শেষ বিচারের দিনে নবী-রসূলগণকে তাঁদের উম্মতদের জন্যে শাফায়াত (সুপারিশ) করার অনুমতি দেয়া হবে, আর তাঁদের শাফায়াতকে গ্রহণও করা হবে। আল্লাহতা’লা তাঁদের উম্মতদের মধ্যে উলামা (জ্ঞান বিশারদগণ), সুলাহা (সৎকর্মশীল পুণ্যাত্মাগণ) ও আউলিয়া (আল্লাহর বন্ধুগণ)-কেও শাফায়াত করার অনুমতি মঞ্জুর করবেন। আর তাঁদের শাফায়াতও গৃহীত হবে। নবী-রসূলগণ তাঁদের মোবারক রওযায় এমন এক জীবনে জীবিত আছেন, যা আমরা জানি না; তাঁদের দেহ মোবারক মাটিতে পচে না। এ কারণেই একটি হাদীস্ শরীফে রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান – “নবী (আ:)-গণ তাঁদের রওযা শরীফে নামায পড়েন এবং হজ্জ করেন।”

কোনো নবী (আ:)-এর মোবারক চোখ নিদ্রাগত হলেও তাঁর অন্তরের চক্ষু কিন্তু নিদ্রাগত হয় না। নবুয়্যত-এর দায়িত্ব পালনকালে এবং নবুয়্যতের মাহাত্ম্য ও গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে নবী (আ:)-গণ সবাই সমান। উপরোক্ত সাতটি বৈশিষ্ট্য তাঁদের সবার মধ্যেই বিদ্যমান। নবী-রসূল (আ:)-গণকে কখনোই তাঁদের নবুয়্যত হতে পদচ্যুত করা হয় নি। তবে আউলিয়াগণ হয়তো বেলায়াত হতে পদচ্যুত হতে পারেন। [এটাও কদাচিৎ হয়ে থাকে। উপরন্তু, পদচ্যুত ব্যক্তি আল্লাহর দৃষ্টিতে ওলী কখনোই ছিলেন না। কেননা, আল্লাহতা’লা তাঁর আউলিয়াগণেরও বেলায়াত কেড়ে নেন না (সুরা ইউনুস, ৬২ আয়াত)- অনুবাদক।] নবীগণ হলেন পুণ্যাত্মা, তাঁরা জ্বীন কিংবা ফেরেশতা নন – যে জ্বীন ও ফেরেশতা কখনোই নবী হতে পারবে না; কেননা তারা মানবাত্মা বনতে সক্ষম হবে না এবং ফলস্বরূপ তারা নবীর মর্যাদাও পাবে না। নবী (আ:)-গণ একে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু তাঁর উম্মাত ও প্রেরণের স্থান বৃহত্তম ছিল এবং যেহেতু তাঁর জ্ঞান ও মা’রেফত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রসারিত হয়েছিল এবং যেহেতু তাঁর মো’জেযা অফুরন্ত ও নিয়মিত প্রবাহমান ছিল এবং যেহেতু তাঁর প্রতি খোদা তা’লার বিশেষ অনুগ্রহ ও বরকত বর্ষিত হয়েছিল, সেহেতু শেষ যমানার রাসূল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য পয়গম্বর হতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। ‘উলুল আযম’ নামে খ্যাত পয়গম্বরগণও অন্যান্য পয়গম্বরগণ হতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। রসূলগণ নবীগণের চেয়ে উচ্চ মকামের ছিলেন – যে নবীগণ রাসূল ছিলেন না।

পয়গম্বরগণের সংখ্যা অজ্ঞাত। এটা সর্বজবিদিত যে তাঁদের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজারের অধিক ছিল। তাঁদের মধ্যে ৩১৩ কিংবা ৩১৫ জন ছিলেন রাসূল (আ:)। রাসূল (আ:)-গণের মধ্যে ছয় জন হলেন উচ্চ মকামের রাসূল, যাঁদেরকে উলুল আযম বলা হয়; তাঁরা হলেন: হযরত আদম (আ:), হযরত নূহ (আ:), হযরত ইব্রাহীম (আ:), হযরত মূসা (আ:), হযরত ঈসা (আ:) ও বিশ্বনবী হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)।

নিম্নোক্ত তেত্রিশ জন পয়গম্বর প্রখ্যাত: সর্ব-হযরত আদম (আ:), ইদ্রীস (আ:), শীষ (আ:), নূহ্ (আ:), হুদ (আ:), সালেহ্ (আ:), ইব্রাহীম (আ:), লুত (আ:), ইসমাইল (আ:), ইসহাক (আ:), ইয়াকুব (আ:), ইউসুফ (আ:), আইয়ুব (আ:), শু’য়াইব (আ:), মুসা (আ:), হারুন (আ:), খিযির (আ:) [এ ব্যাপারে সুন্নী উলামাগণের মত পার্থক্য আছে। কেউ কেউ তাঁকে “ওলী” বলেন। -- অনুবাদক], ইউশা ইবনে নুন (আ:), ইলিয়াস (আ:), আল ইয়াসা (আ:), যুলকিফল (আ:), শামউন (আ:), ইশমোইল (আ:), ইউনুস ইবনে মাতা (আ:), দাউদ (আ:), সুলাইমান (আ:), লোকমান (আ:), যাকারিয়্যা (আ:), ইয়াহইয়া (আ:), উযাইর (আ:), ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:), যুলকারনাইন (আ:) এবং হযরত রাসূলে কারীম (দ:)।

কুরআন মজীদে কেবলমাত্র আটাশ জন পয়গম্বরের নাম উল্লিখিত আছে। যুলকারনাইন (আ:), লুকমান (আ:), উযাইর (আ:) ও খিযির (আ:) নবী কিনা তা নিশ্চিত নয়। হযরত যুলকিফল (আ:)-কে হারকিলও বলা হয়, যাঁকে সর্ব-হযরত ইলিয়াস (আ:), ইদ্রিস (আ:) কিংবা যাকারিয়্যা (আ:)-ও ধারণা করা হয়ে থাকে।

হযরত ইব্রাহীম (আ:) হলেন খলিলউল্লাহ, কারণ তাঁর অন্তরে আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রতি মুহব্বত তথা ভালোবাসা নেই। হযরত মূসা (আ:) হলেন কালিম-উল্লাহ, কেননা তিনি আল্লাহ্ পাকের সাথে কথা বলেছিলেন। হযরত ঈসা (আ:) হলেন কালেমাতুল্লাহ্, কারণ পিতা ছাড়াই তিনি শুধুমাত্র কালেমাত আল ইলাহিয়্যা (খোদায়ী বাক্য) “হও” (কুন্) দ্বারা-ই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। উপরন্তু, তিনি আল্লাহতা’লার বাণী প্রচার করেছিলেন, ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন এবং ঐশী বাণী মানুষের কানে পৌঁছেও দিয়েছিলেন।

হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিনি সৃষ্টিজগতের অস্তিত্বশীল হওয়ার কারণ ছিলেন এবং যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মকামের অধিকারী, মহা সম্মানিত ও সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি হলেন হাবীবউল্লাহ (আল্লাহতা’লার বন্ধু)। তিনি-ই যে হাবীবউল্লাহ ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং মাহাত্ম্যের অধিকারী, তা প্রতীয়মানকারী বহু প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান। এ কারণেই “পরাভূত” কিংবা “পরাজিত হয়েছিলেন” বাক্যগুলো তাঁর শানে ব্যবহার করা উচিৎ নয়। পুনরুত্থানের সময় তিনি-ই সর্বাগ্রে তাঁর রওযা শরীফ হতে পুনরুত্থিত হবেন। তিনি-ই প্রথমে বিচারের স্থানে যাবেন। আবার, তিনি-ই সর্বাগ্রে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। যদিও তাঁর চরিত্রের সুন্দর গুণগুলো গুণে শেষ করা যাবে না এবং তা মানব শক্তি-সামর্থ্য দ্বারা সম্ভবও নয়, তবু আমরা সেগুলোর কয়েকটি এখানে লিখে আমাদের পুস্তককে অলংকৃত করবো:
রাসূলে আকরাম (দ:)-এর একটি মো’জেযা হলো মে’রাজ উপলক্ষে তাঁর উর্ধ্বগমন। যখন তিনি মক্কা মোয়াযযমায় নিজ বিছানায় শায়িত ছিলেন, তখন তাঁকে জাগানো হয় এবং তাঁর পবিত্র স্বশরীরে তাঁকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপর আসমানে এবং তারও পরে আল্লাহতা’লা যে সকল স্থান নির্ধারণ করেছিলেন, সাত আসমানের সেই সব স্থানে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মে’রাজ সম্পর্কে আমাদেরকে এভাবে বিশ্বাস করতে হবে। মে’রাজ কীভাবে হয়েছিল, তা বিস্তারিত লেখা হয়েছে বহু মহামূল্যবান গ্রন্থে, বিশেষ করে শেফা শরীফ পুস্তকে। হযরত জিবরাইল আমীনের সাথে তিনি মক্কা হতে ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানে অবস্থিত সিদরাত আল-মুন্তাহা নামের একটি গাছের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কোনো জ্ঞান, কোনো উর্ধ্বগমনই ইতিপূর্বে এর বেশি যেতে পারে নি। সিদরাত আল-মুন্তাহায় রাসূলুল্লাহ্ (দ:) হযরত জিবরাইল আমীন (আ:)-কে তাঁর ছয়’শ পাখাসহ নিজস্ব (আসল) সুরতে দেখে পান। হযরত জিবরাইল (আ:) সিদরা-তে থেকে যান। মক্কা হতে জেরুজালেম কিংবা সাত আসমানে রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে “বোরাকে” বহন করে নেয়া হয়েছিল, যা বেহেশতের প্রাণী এবং যা একটি খচ্চরের চেয়ে ছোট কিন্তু একটি গাধার চেয়েও বড় আকৃতির। চোখের পলকে এটা চোখের আড়ালে চলে যেতে সক্ষম। মসজিদে আকসায় এশা কিংবা ফজরের নামাযে রাসূলুল্লাহ (দ:) অন্যান্য নবী (আ:)-গণের ইমাম হন। আম্বিয়া (আ:)-গণের রূহ্ মোবারক তাঁদের জিসম্ (দেহ)-সহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। জেরুসালেম হতে সপ্তম আসমান পর্যন্ত তাঁকে মে’রাজ নামক একটি অজ্ঞাত সিঁড়ি দ্বারা উর্ধ্ব-ভ্রমণ করানো হয়। পথিমধ্যে ডান ও বাম ধারে ফেরেশতাকুল সারিবদ্ধ হয়ে রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে সালাত-সালাম ও সম্ভাষণ জানান এবং তাঁর প্রশংসা করেন। প্রতিটি আসমানেই হযরত জিবরাইল আমীন (আ:) রাসূলে আকরাম (দ:)-এর শুভাগমণের শুভসংবাদ ঘোষণা করেন। প্রতিটি আসমানেই রাসূলুল্লাহ্ (দ:) একজন করে পয়গম্বরের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং সালাম জানান। সিদরাতে তিনি বহু আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পান, বেহেশতের নেয়ামত এবং দোযখের শাস্তিও দেখতে পান। তিনি আল্লাহতা’লার জামাল (সৌন্দর্য) দেখার আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-অনুভূতি ছাড়া বেহেশতের নেয়ামতসমূহ দেখেন নি। সিদ্রাতুল মুন্তাহা পার হয়ে তিনি একাই এগিয়ে চললেন বহু নূরের (জ্যোতির) মধ্য দিয়ে। তিনি ফেরেশতাগণের কলমসমূহের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি সত্তর হাজার পর্দার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলেন। এক পর্দা হতে অপর পর্দার দূরত্ব হলো পাঁচ’শ বছরের যাত্রা পথ। অতঃপর “রফরফ্” নামক একটি ফরাশ (বাহন), যেটা সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল, সেটাতে চড়ে তিনি কুরসির মধ্য দিয়ে আরশে পৌঁছুলেন। তিনি আরশ্ থেকে বেরিয়ে গেলেন; স্থান- কাল-পাত্রের জগত হতেও বের হয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি এমন এক মকামে পৌঁছুলেন যেখানে আল্লাহতা’লার কালাম শোনা যায়।

রাসূলুল্লাহ্ (দ:) আল্লাহতা’লাকে উপলব্ধি ও ব্যাখ্যার অতীত এমন এক পন্থায় দেখতে পান, যেভাবে স্থান-কালের উর্ধ্বে পরবর্তী জগতে আল্লাহতা’লার দর্শন পাওয়া যাবে। তিনি শব্দ ও অক্ষর ছাড়াই আল্লাহতা’লার সাথে কথা বলেন। তিনি খোদা তা’লার প্রশংসা-স্তুতি করেন। তাঁকেও অসংখ্য উপহার ও সম্মান দেয়া হয়। তাঁর প্রতি এবং তাঁর উম্মতের প্রতি দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের এক কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, যা হযরত মূসা (আ:)-এর মধ্যস্থতায় পাঁচ ওয়াক্তে কমিয়ে আনা হয়। ইতিপূর্বে কেবলমাত্র সকালে, বিকেলে কিংবা রাতেই নামায আদায় করা হতো। এতো বড় দীর্ঘ ভ্রমণশেষে এবং অনেক নেয়ামত ও উপহার লাভের পর এবং বহু বিস্ময়কর জিনিস দর্শন ও শ্রবণের পর তিনি তাঁর বিছানায় ফিরে আসেন, যা তখনো শীতল হয়ে যায় নি। আমরা এ পর্যন্ত যা লিখেছি তা আংশিকভাবে কুরআন মজীদ থেকে, আর আংশিকভাবে হাদীস শরীফ থেকে গৃহীত হয়েছে। এগুলোর সবই বিশ্বাস করা ওয়াজিব নয়। তবু যেহেতু আহলে সুন্তাতের উলামাবৃন্দ এগুলো বর্ণনা করেছেন, সেহেতু যারা এগুলো অস্বীকার করবে, তারা আহলে সুন্নাত হতে খারিজ (বিচ্যুত) হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো আয়াত কিংবা কোনো হাদীস্ বিশ্বাস করবে না, সে কাফের (অবিশ্বাসী) হয়ে যাবে।

হযরত রাসূলুল্লাহ (দ:) যে নবীকুল শ্রেষ্ঠ তা প্রতীয়মানকারী অসংখ্য দালিলিক প্রমাণের মধ্যে কিছু আমরা এখন উদ্ধৃত করবো:

শেষ বিচার দিবসে সকল আম্বিয়া (আ:)-ই রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর পতাকাতলে  আশ্রয় নেবেন। মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর নবী (আ:)-গণকে এই মর্মে আদেশ দিয়েছিলেন যে যদি তাঁরা তাঁর প্রিয়তম মাহবুব মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সময় পর্যন্ত জীবিত থাকেন, তবে তাঁরা যেন তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁরই সাহায্যকারী হন। আর আম্বিয়া (আ:)-গণও তাঁদের শেষ অনুরোধস্বরূপ নিজ নিজ উম্মতদেরকে তা করতে বলে গিয়েছিলেন।

হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন “খাতাম্ আল-আম্বিয়া” (শেষ নবী)। অর্থাৎ, তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। তাঁর পবিত্র রূহ্ মোবারককে সকল নবী (আ:)-এর পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছিল। নবুয়্যতের মর্যাদা তাঁকেই সর্বাগ্রে দেয়া হয়েছিল। আর নবুয়্যতের পূর্ণতাও দেয়া হয়েছে দুনিয়াতে তাঁর শুভাগমণ দ্বারা। দুনিয়ার অন্তিমলগ্নে ইমাম মাহ্দী (রা:)-এর যমানায় হযরত ঈসা (আ:) আসমান হতে দামেশকে অবতরণ করবেন এবং উম্মতে মোহাম্মদীর অন্তর্ভুক্ত হবেন, আর পৃথিবীতে হযরত রাসূলে আকরাম (দ:)-এর শরীয়ত প্রচার করবেন।

হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন নবীকুল শ্রেষ্ঠ এবং সৃষ্টিজগতের জন্যে আল্লাহতা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত (করুণা)। আঠারো হাজার আলম (জগত) তাঁর রহমতের সাগর থেকে উপকার পেয়েছে। (উলামায়ে কেরামের) সর্বসম্মতিতে ব্যক্ত অভিমত হলো এই যে, তিনি জ্বীন ও ইনসান সকলেরই রাসূল (দ:)। বহু উলামা বলেছেন যে তিনি ফেরেশতা, গাছ-গাছালি, প্রাণী ও প্রতিটি বস্তুর জন্যে রাসূল (দ:)। অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-গণকে যেখানে বিশেষ বিশেষ দেশের বিশেষ বিশেষ গোত্রের জন্যে প্রেরণ করা হয়েছিল, সেখানে  রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে সকল জগত ও সকল জীব এবং জড় সৃষ্টির জন্যে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহতা’লা অন্যান্য নবী (আ:)-গণকে নাম সহকারে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর ক্ষেত্রে তিনি কৃপাভরে সম্বোধন করেছেন – “হে আমার রাসূল (দ:)!” প্রত্যেক পয়গম্বর (আ:)-কে উপহৃত প্রতিটি মো’জেযার অনুরূপ মো’জেযা তাঁকে উপহার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’লা অন্যান্য পয়গম্বর (আ:)-কে যা মো’জেযা ও নেয়ামত দান করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি রাসূলে কারীম (দ:)-কে দান করেছেন। তাঁকে অগণিত নেয়ামত, মাহাত্ম্য ও সম্মান দানের মাধ্যমে অন্যান্য পয়গম্বর হতে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি যখন পবিত্র আঙ্গুলের ইশারা করেছেন, তখনই চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। তাঁর হস্তস্থিত পাথর কলেমা পাঠ করেছে। গাছ “ইয়া রাসূলাল্লাহ্” (দ:) সম্ভাষণ জানিয়েছে। হান্নানা নামক শুকনো কাঠটিও রাসূলুল্লাহ্ (দ:) যখন সেটাকে ত্যাগ করেছিলেন, তখন ক্রন্দন করেছিল। তাঁর মোবারক আঙ্গুল হতে পানির নহর বয়েছিল। পরবর্তী জগতে মাকামুল মাহমূদ, শাফায়াতে কুবরা, হাউযুল কাওসার, আল-ওসিলা ও আল-ফযিলা নামক উচ্চ মর্যাদা তাঁকে মঞ্জুর করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বেহেশতে প্রবেশের পূর্বেই তিনি আল্লাহ্ পাকের জামাল দর্শন করার মহাসম্মান লাভ করেছেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক গুণের অধিকারী রাসূলুল্লাহ্ (দ:) একাধারে পূর্ণাঙ্গ ঈমান, জ্ঞান, ভদ্রতা ও পুতঃপবিত্রতা, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা, লজ্জাশীলতা, বিনয়, সুন্দর স্বভাব, দয়া, অন্যদের সাহায্য ও রক্ষাকারী ইত্যাদি গুণাবলীরও অধিকারী ছিলেন। তাঁকে প্রদত্ত মো’জেযার সংখ্যা আল্লাহতা’লা ছাড়া আর কেউই জানেন না। তাঁর আনীত শরীয়ত সকল ধর্মকে রহিত করে দিয়েছে। সকল শরীয়তের চেয়ে তাঁর শরীয়ত-ই শ্রেষ্ঠ। তাঁর উম্মাতও অন্যান্য উম্মত হতে শ্রেষ্ঠ। আর তাঁর উম্মতদের মধ্যে আউলিয়াগণ অন্যান্য উম্মতের আউলিয়া অপেক্ষা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন।

হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর উম্মতের আউলিয়াগণের মধ্যে তাঁর খলিফা হওয়ার যোগ্য ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) যাঁকে আউলিয়ায়ে কেরাম ও ইমামগণ অধিক ভালোবাসতেন এবং যিনি অন্যান্যদের চেয়ে খেলাফতের জন্যে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। পয়গম্বর (আ:)-গণের পরে তিনি-ই আগত ও ভবিষ্যতে আগমনকারী ইনসানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সৌভাগ্যবান। খলিফা হওয়ার মর্যাদা ও সম্মান তিনি-ই সর্বপ্রথম অর্জন করেন। আল্লাহতা’লার দয়া ও রহমতে ইসলামের সূচনার পূর্বেও তিনি মূর্তি পূজা করেন নি। কুফর (অবিশ্বাস) ও গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা)-এর ত্রুটি হতে তাঁকে হেফাযত করা হয়েছিল।

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)-এর পরে ইনসানকুল শ্রেষ্ঠ হলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) যাঁকে আল্লাহতা’লা তাঁর মাহবুব হযরত রাসূলে করীম (দ:)-এর বন্ধু হিসেবে পছন্দ করেছিলেন।

হযরত উমর (রা:)-এর পরে শ্রেষ্ঠ হলেন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান যিন্নূরাইন (রা:) যিনি নেয়ামত ও দয়ার খনি এবং বিনয়, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উৎস ছিলেন।

হযরত উসমান (রা:)-এর পরে শ্রেষ্ঠ হলেন রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর চতুর্থ খলিফা হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (ক:) যিনি বিস্ময়কর গুণাবলীর অধিকারী এবং আল্লাহতা’লার আসাদ (সিংহ) ছিলেন।

হযরত হাসান ইবনে আলী (রা:) তাঁর পরে খলিফা হন। হাদীসে উল্লিখিত খেলাফতের ত্রিশ বছর তাঁর শাসনামল দ্বারা পূর্ণ হয়। তাঁর পরে শ্রেষ্ঠ হলেন হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রা:) যিনি রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর দুই চোখের মণি ছিলেন।
এই সকল শ্রেষ্ঠ গুণাবলী উপরোক্ত পুণ্যাত্মাগণের মধ্যে বিরাজ করার ভিত্তি হলো তাঁদের অধিক সওয়াব অর্জন, ইসলামের ওয়াস্তে স্বদেশ ও স্বজন ত্যাগ, অন্যান্যদের পূর্বে মুসলমান হওয়া, সর্বোচ্চ মাত্রায় রাসূলে আকরাম (দ:)-এর তাবেদারী ও তাঁর সুন্নাতের কাছে আত্মসমর্পণ, নবী করীম (দ:)-এর শরীয়তকে প্রচার-প্রসার করার মহৎ উদ্দেশ্যে সংগ্রাম এবং অবিশ্বাস, ফিতনা (গণ্ডগোল, হট্টগোল) ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন।

হযরত আলী (ক:) ইসলাম গ্রহণ করেন সবার আগে, একমাত্র হযরত আবু বকর (রা:)-এর ক্ষেত্র ছাড়া। তিনি তখন একজন বালক ছিলেন এবং তাঁর কোনো সম্পত্তিও ছিল না; তিনি রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর ঘরে বসবাস করতেন এবং তাঁর খেদমত করতেন। যেহেতু হযরত আলী (ক:) ও তাঁর পুত্রগণ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নিকটাত্মীয় ছিলেন এবং হুজুর পূর নূর (দ:)-এরই মোবারক রক্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন, সেহেতু তাঁদেরকে হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত ওমর ফারুক (রা:) হতে শ্রেষ্ঠ হয়তো বলা যেতে পারে; কিন্তু এ শ্রেষ্ঠত্ব বা মাহাত্ম্য সকল ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব নয় এবং সকল ক্ষেত্রেই তাঁদেরকে এটা ওই সকল মহান ব্যক্তিত্ব হতে শ্রেষ্ঠত্ব দেয় নি। এর দৃষ্টান্ত হলো হযরত খিযির (আ:) ও হযরত মূসা (আ:)-এর ঘটনাটির মতো, যে ঘটনায় খিযির (আ:) হযরত মূসা (আ:)-কে কিছু বিষয় শিক্ষা দিয়েছিলেন।
হযরত মা খাদেজা (রা:) ও হযরত আয়েশা (রা:) হতে হযরত মা ফাতেমা (রা:) উচ্চ মর্যদাসম্পন্ন ছিলেন। কেননা, তিনি নূর নবী (দ:)-এর রক্ত-সম্পর্কের ছিলেন। কিন্তু এক কিসিমের শ্রেষ্ঠত্ব সকল ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিফলন করে না। এঁদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিরূপণ করতে গিয়ে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। হাদীস শরীফ হতে উপলব্ধি করা যায় যে এই তিন জন ও হযরত মরিয়ম এবং ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আসিয়া দুনিয়ার নারীকুল শ্রেষ্ঠ। “বেহেশতের নারীকুল শ্রেষ্ঠ হলো ফাতেমা (রা:) এবং বেহেশতের যুবককুল শ্রেষ্ঠ হলো হাসান (রা:) ও হুসাইন (রা:)” — হাদীসটি একটি ক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠত্বকেই ইশারা করেছে।

রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাহাবীদের মধ্যে পরবর্তী শ্রেষ্ঠ হলেন ”আশারাত্ আল্ মুবাশ্শারা”– দশজন পুণ্যাত্মা, যাঁদেরকে বেহেশতী হওয়ার শুভসংবাদ দ্বারা ধন্য করা হয়েছে। তাঁদের পরে বদরের জেহাদে অংশগ্রহণকারী তিন’শ তের জন মুসলমান-ই হলেন শ্রেষ্ঠ। অতঃপর শ্রেষ্ঠ হলেন উহুদ জেহাদে অংশগ্রহণকারী সাত’শ জন বীর মুসলমান। তাঁদের পরে শ্রেষ্ঠ হলেন “বি’য়াত আর-রিদ্ওয়ান” নামক চৌদ্দ’শ মুসলমান যাঁরা নবী করীম (দ:)-এর কাছে গাছের নিচে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিলেন।

রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর ওয়াস্তে তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রা:) নিজেদের জীবন ও মালামাল উৎসর্গ করেন এবং তাঁকে সাহায্য করেন। তাঁদের যে কারো নাম উল্লেখ করার সময় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাসহ তা করা আমাদের জন্যে অবশ্য কর্তব্য (ওয়াজিব)। তাঁদের মাহাত্ম্যের পরিপন্থী কোনো অশোভনীয় উক্তি করা আমাদের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। অশ্রদ্ধাসহ তাঁদের নাম উল্লেখ করা গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা) ও বিচ্যুতি।

যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কে ভালোবাসেন, তাঁর জন্যে সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-কে ভালোবাসাও কর্তব্য। একটি হাদীসে নূরনবী (দ:) এরশাদ ফরমান — “যে ব্যক্তি আমার সাহাবীদেরকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসার কারণেই ভালোবাসে। যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবাসে না, সে আমাকেও ভালোবাসে না। যে ব্যক্তি তাদেরকে আঘাত দেয়, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকেই আঘাত দেয়। আর যে ব্যক্তি আমাকে আঘাত দেয়, সে আল্লাহ তা’লাকেই আঘাত দেয়। আল্লাহ তা’লাকে যে ব্যক্তি আঘাত দেয়, সে অবশ্যই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।”  অপর এক হাদীস শরীফে তিনি এরশাদ ফরমান — “যখন আল্লাহতা’লা আমার উম্মতের মধ্যে কাউকে কৃপা করতে চান, তখন তিনি তার অন্তরে আমার সাহাবীদের প্রতি ভালোবাসা প্রোথিত করেন। আর ফলস্বরূপ সেই ব্যক্তিও তাদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসে” (আল্ হাদীস)।

এ কারণেই এটা ধারণা করা উচিৎ নয় যে নবী করীম (দ:)-এর সাহাবী (রা:)-গণ খলিফা হওয়ার জন্যে কিংবা নিজেদের বদ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে অথবা নিজেদের ইন্দ্রিয় কামনাকে পূর্ণ করার জন্যে পরস্পর পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এ ধরনের  ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁদের সমালোচনা করা চরম মোনাফেকী (কপটতা) যা কোনো ব্যক্তিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। কেননা, রাসূলে আকরাম (দ:)-এর সাহচর্য ও তাঁর পুণ্যময় ভাষণসমূহ শ্রবণ দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-এর অন্তর থেকে দুনিয়ার প্রেম এবং হিংসা-বিদ্বেষ তিরোহিত হয়েছিল। তাঁদেরকে পরিশুদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাঁরা লোভ, উচ্চাভিলাষ, বিদ্বেষ ও বদ স্বভাব হতে মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা সর্বাংশে পবিত্র হয়ে গিয়েছিলেন। যেখানে এই মহাসম্মানিত রাসূল (দ:)-এর উম্মতের আউলিয়াগণের কোনো একজনের মাত্র কয়েক দিনের সান্নিধ্য লাভকারী ব্যক্তি সেই ওলীর সুন্দর নৈতিকতা ও মাহাত্ম্য হতে উপকার পায় এবং দুনিয়াবী খায়েশ হতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, সেখানে এ কথা কীভাবে ধারণা করা যায় যে প্রিয়নবী (দ:)-এর সাহাবীগণ, অর্থাৎ, আমাদের মনিবগণ যাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন ও নিজেদের জান-মাল তাঁর জন্যে উৎসর্গ করেছিলেন এবং নিজেদের রাজ্য তাঁর ওয়াস্তেই ত্যাগ করেছিলেন, আর তাঁরই সাহচর্যে থাকতে পছন্দ করতেন যা আত্মাসমূহের খাদ্য ছিল, তাঁরাই আবার বদ নৈতিকতা হতে মুক্ত ছিলেন না এবং তাঁদের নফসগুলোও পরিষ্কার ছিল না এবং তাঁরা এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর পচা জিনিসের জন্যে যুদ্ধ করেছিলেন? ওই সকল মহান ব্যক্তি নিশ্চয়ই অন্যান্যদের চেয়ে নির্মল ছিলেন। তাঁদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও যুদ্ধকে আমাদের মতো বদ উদ্দেশ্যসম্পন্ন লোকদের মধ্যকার মতপার্থক্য ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সাথে তুলনা করা কিংবা তাঁরা তাঁদের দুনিয়ারী স্বার্থে ও অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে যুদ্ধ করেছিলেন বলাটা অনভিপ্রেত। প্রিয়নবী (দ:)-এর সাহাবী (রা:)-দের প্রতি এ ধরনের বাজে ধারণা পোষণ করা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। যে ব্যক্তি তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চায়, তার ভাল করে জানা উচিৎ যে সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-এর বিরুদ্ধাচরণ করা নবী করীম (দ:)-এর বিরুদ্ধাচরণই, আর তাঁদের সমালোচনা করা নবী (দ:)-এরই সমালোচনা, যিনি তাঁদেরকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ কারণেই ইসলামের মহান উলামাগণ বলেছেন যে নবী করীম (দ:)-এর সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-এর প্রতি যে ব্যক্তি শ্রদ্ধা ও উচ্চ ধারণা পোষণ করে না, সে প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এরই প্রতি অবিশ্বাস রাখে। সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-এর কুৎসা রটনা করার জন্যে “জামাল” (উট) ও “সিফফিনের” যুদ্ধকে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কিছু ধর্মীয় কারণে এ সকল যুদ্ধে যাঁরা হযরত আলী (ক:)-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তাঁরা পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য ছিলেন। একটি হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম (দ:) এরশাদ ফরমান –  “ইজতেহাদ প্রয়োগকারী মুজতাহিদ যিনি ভুল করেন, তাঁর জন্যে রয়েছে একটি সওয়াব (পুরস্কার)। আর যে মুজতাহিদ সঠিক পথপ্রাপ্ত হন, তাঁর জন্যে রয়েছে দুইটি (বর্ণনান্তরে দশটি) পুরস্কার। একটি পুরস্কার হলো ইজতেহাদ (গবেষণা) প্রয়োগের জন্যে; অপরটি সত্যপ্রাপ্তির জন্যে” (আল্ হাদীস)। ওই সকল মহান  ইসলামী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ হিংসা-বিদ্বেষ হতে সৃষ্ট ছিল না, বরং তা ছিল তাঁদের ইজতেহাদী পার্থক্য হতে সৃষ্ট এবং শরীয়তের আদেশ-নিষেধ পালনে তাঁদের ইচ্ছা হতে নিঃসৃত। নবী পাক (দ:)-এর প্রত্যেক সাহাবী (রা:)-ই একেকজন মুজতাহিদ ছিলেন।

কোনো মুজতাহিদের জন্যে নিজ ইজতেহাদ দ্বারা বের করা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমল করা ফরয, যদিও তা তাঁর চেয়েও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মুজতাহিদের ইজতেহাদের পরিপন্থী হয়। অন্য কারো ইজতেহাদ অনুসরণ করা তাঁর জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। ইমামুল আযম হযরত আবু হানিফা (রহ:)-এর শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (রহ:) ও ইমাম মোহাম্মদ শায়বানি (রা:) এবং ইমাম মোহাম্মদ শাফেয়ী (রহ:)-এর শিষ্য ইমাম আবু সাওর (রহ:) ও ইমাম ইসমাইল মুযানী (রহ:) বহু ক্ষেত্রে নিজেদের ওস্তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন; কয়েকটি বিষয়ে তাঁদের ওস্তাদগণ যেখানে বলেছিলেন “হারাম” (নিষিদ্ধ), সেখানে তাঁরা বলেছেন “হালাল” (অনুমহিপ্রাপ্ত, বৈধ); আর যেখানে তাঁদের ওস্তাদগণ বলেছিলেন “হালাল”, সেখানে তাঁরা “হারাম” বলেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদেরকে পাপিষ্ঠ কিংবা বদ আখ্যা দেয়া চলে না। কেউই তা বলে নি, কেননা তাঁরাও তাঁদের ওস্তাদদের মতোই মুজতাহিদ ছিলেন।

এটা সত্য যে হযরত মু’য়াবিয়া (রা:) ও হযরত আমর ইবনে আস্ (রা:) হতে হযরত আলী (ক:) অনেক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ও শিক্ষিত ছিলেন। তাঁর বহু মাহাত্ম্য ছিল যা তাঁকে ওই দু’জন হতে পৃথক করেছিল, আর তাঁর ইজতেহাদও তাঁদের চেয়ে শক্তিশালী ও তীক্ষ্ণ ছিল। তবে যেহেতু প্রিয়নবী (দ:)-এর সকল সাহাবী-ই মুজতাহিদ ছিলেন, সেহেতু ওই দু’জন সাহাবী (রা:)-এর পক্ষে হযরত আলী (ক:)-এর মতো এতো বড় একজন ধর্মীয় ইমামের ইজতেহাদ অনুসরণ করা অনুমতিপ্রাপ্ত ছিল না। তাঁদের নিজেদের ইজতেহাদকে অনুসরণ করাই তাঁদের জন্যে জরুরি ছিল।

প্রশ্ন: “জামাল” ও ”সিফফিন”-এর যুদ্ধে রাসূলে আকরাম (দ:)-এর সাহাবীদের মধ্যে বহু মুহাজিরিন ও আনসার সাহাবী (রা:) হযরত আলী (ক:)-এর পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁকে অনুসরণ ও মান্য করেছিলেন। যদিও তাঁরা সকলেই মুজতাহিদ ছিলেন, তবুও তাঁরা হযরত আলী (ক:)-কে অনুসরণ করা ওয়াজিব বিবেচনা করেছিলেন। এটা পরিস্ফুট করে যে হযরত আলী (ক:)-কে অনুসরণ করা মুজতাহিদদের জন্যেও ওয়াজেব। যদিও তাঁদের ইজতেহাদ তাঁর ইজতেহাদের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, তবুও তাঁদের জন্যে তাঁর-ই অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক ছিল, তাই নয় কি?

জবাব: হযরত আলী (ক:)-কে যাঁরা অনুসরণ করেছিলেন এবং তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা তা করেছিলেন তাঁর ইজতেহাদকে অনুসরণ করার অভিপ্রায়ে নয়, বরং এ কারণেই যে তাঁদের ইজতেহাদ তাঁর ইজতেহাদের সাথে মিলে গিয়েছিল; তাঁরা এটা করে পরিস্ফুট করলেন যে হযরত ইমাম আলী (ক:)-কে অনুসরণ করা ওয়াজেব ছিল। অনুরূপভাবে, নবী করীম (দ:)-এর বহু বিখ্যাত সাহাবীর ইজতেহাদসমূহও হযরত আলী (ক:)-এর ইজতেহাদের সাথে মিলে নি; ফলে তাঁর বিরোধিতা করা তাঁদের জন্যে ওয়াজেব হয়েছিল। অতএব, নূরনবী (দ:)-এর সাহাবীগণের ইজতেহাদসমূহ তিনটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল: তাঁদের কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন যে হযরত আলী (ক:)-ই সঠিক; তাই তাঁকে অনুসরণ করা তাঁদের জন্যে অত্যাবশ্যক ছিল। অপর পক্ষটি হযরত আলী (ক:)-এর বিরোধিতাকারীদের  ইজতেহাদকে সঠিক মনে করেছিলেন; তাই তাঁদের পক্ষে সেটাকে অনুসরণ করা অবশ্য করণীয় ছিল। তৃতীয় পক্ষটি বলেছিলেন যে উভয় পক্ষকে অনুসরণ করা এবং দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া অপরিহার্য ছিল না; তাই তাঁদের ইজতেহাদ অনুযায়ী দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এ তিনটি পক্ষের সকলেই সঠিক ছিলেন এবং তাঁরা পরকালে পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য।

প্রশ্ন: উপরোক্ত লেখনী প্রতিভাত করে যে যাঁরা হযরত আলী (ক:)-এর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁরাও সঠিক ছিলেন। অথচ আহলে সুন্নাতের উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে হযরত আলী (ক:)-ই সঠিক ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীগণ ভুল করেছিলেন; কিন্তু তাঁদেরকে তাঁদের ওযরের কারণে ক্ষমা করা গিয়েছিল এবং এমন কি তাঁরা এর জন্যে সওয়াবও হাসিল করেছিলেন। এ ব্যাপারে ফয়সালা কী?

জবাব: ইসলামের দু’জন মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম শাফেয়ী (রহ:) ও খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ:) বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাহাবায়ে কেরামের কাউকেই “ভ্রান্ত” আখ্যা দেয়া অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এ কারণেই এটা বলা হয়েছিল ”গুরুজনদের প্রতি ‘ভ্রান্ত’ শব্দটি আরোপ করা চরম ভ্রান্তি।” ছোটদের জন্যে গুরুজনকে “তিনি সঠিক ছিলেন”, তিনি ভ্রান্ত ছিলেন”, “আমরা স্বীকৃতি জানাই”, কিংবা “আমরা অনুমোদন করি না” বলা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। আল্লাহতা’লা যেমন ওই সকল মহান ব্যক্তির রক্ত দ্বারা আমাদের হাতকে রঞ্জিত করেন নি, ঠিক তেমনি আমাদেরকেও তাঁদের প্রতি “সঠিক” ও “ভ্রান্ত” শব্দগুলো ব্যবহার করা হতে আমাদের জিহ্বাকে  হেফাযত করতে হবে। যে সকল গভীর জ্ঞানী আলেম তখনকার ঘটনাবলী ও প্রামাণ্য দলিলাদি বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন যে হযরত আলী (ক:)-ই সঠিক ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধাচারীরা ভুল করেছিলেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে বুঝিয়েছিলেন যে, যদি হযরত আলী (ক:) তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতেন, তাহলে তিনি তাঁদেরকে নিজ ইজতেহাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ইজতেহাদ প্রয়োগ করায় পরিচালিত করতে সক্ষম হতেন। বস্তুতঃ “জামাল”-এর যুদ্ধে হযরত যুবাইর ইবনে আউয়াম (রা:) হযরত আলী (ক:)-এর বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু তথ্যসমূহকে আরো গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার পর তিনি নিজ ইজতেহাদ পরিবর্তন করেন এবং যুদ্ধ বন্ধ করেন। যে সকল আহলে সুন্নাতের আলেম ভুলকে অনুমতিপ্রাপ্ত বিবেচনা করেন, তাঁদের কথাকে ওভাবে গ্রহণ করতে হবে। আর এ কথা বলা অনুমতিপ্রাপ্ত নয় যে হযরত আলী (ক:) ও তাঁর অনুসারীগণ সঠিক ছিলেন এবং মা আয়েশা সিদ্দিকা (রা:)-এর পক্ষাবলম্বনকারী নবী করীম (দ:)-এর অন্যান্য সাহাবী (রা:)-গণ পথভ্রষ্ট ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর সাহাবীগণের মধ্যকার এ সকল দ্বন্দ্ব শরীয়তের আইন-কানুনের সহায়তাকারী শাখা-প্রশাখায় প্রয়োগকৃত ইজতেহাদী মতপার্থক্য হতেই নিঃসৃত হয়েছিল। তাঁরা শরীয়তের মৌলিক বিষয়গুলোতে মতভেদ করেন নি। আজকাল হযরত মোয়াবিয়া (রা:) ও হযরত আমর ইবনে আস্ (রা:)-এর মতো মহান ইসলামী ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে কিছু লোক বেয়াদবিপূর্ণ কুৎসা রটনা করছে [উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের আবুল আলা মওদুদী তার “খেলাফত ও রাজন্ত্র” নামক পুস্তকের ১২৭ পৃষ্ঠায় সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-কে নির্ভুল জানা “যুলুম” ও “অন্যায়” বলেছে (বাংলা সংস্করণ ১৯৮৯ ইং) - অনুবাদক]। তারা উপলব্ধি করতে অক্ষম যে প্রিয়নবী (দ:)-এর সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-কে গালমন্দ করে তারা বাস্তবে রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-কেই হেয় ও অপমান করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। “শিফা” গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে ইমাম মালেক ইবনে আনাস্ (রহ:) বলেছেন, “যে ব্যক্তি হযরত মোয়াবিয়া (রা:) ও হযরত আমর ইবনে আস্ (রা:)-এর কুৎসা রটনা করে এবং তাঁদেরকে গালমন্দ করে, তার প্রাপ্য হলো সেই সব বাক্যমালা যা সে তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছে। যারা তাঁদের বিরুদ্ধে বলে ও লিখে এবং তাঁদেরকে সম্মান করে না, তাদেরকে কঠোরভাবে শাস্তি দেয়া আবশ্যক।” আল্লাহ্ পাক আমাদের অন্তরগুলোকে তাঁর হাবীব (দ:)-এর সাহাবী (রা:)-গণের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা পরিপূর্ণ করুন, আমীন। মোনাফেক ও পাপিষ্ঠ লোকেরা নয়, বরং খোদা-ভীরু, নেককার মুসলমানগণ-ই ওই সকল গুরুজনকে ভালোবাসেন।

হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীয়ত শিক্ষা করার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন ও পৃথিবীর বুকে সকল মুসলমানকে সঠিক পথপ্রাপ্তির দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন চারজন মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁদের একজন হলেন ইমামুল আযম আবু হানিফা নু’মান ইবনে সাবিত (রহ:)। তিনি ইসলামী উলামাগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। আহলে সুন্নাতের তিনি-ই একজন ইমাম। তাঁর জন্ম কুফা নগরীতে ৮০ হিজরী সালে (৬৯৯ খ্রী:)। তিনি ১৫০ হিজরী সালে (৭৬৭ খ্রী:) বাগদাদে বেসালপ্রাপ্ত হন।

উলামাগণের মধ্যে দ্বিতীয় জন হলেন ইমাম মালেক ইবনে আনাস্ (রহ:)। তিনি ৯৫ হিজরী সালে (৯১৩ খ্রী:) মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ  করেন এবং সেখানেই ১৭৯ হিজরী (৭৯৫ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।
তৃতীয় জন হলেন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস্ শাফেয়ী (রহ:), যিনি ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণের নয়নমণি। তিনি প্যালেস্টাইনের গাযায় ১৫০ হিজরী (৭৬৭ খ্রী:) সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিসরে ২০৪ হিজরী (৮১৯ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।

চতুর্থ জন হলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) যিনি বাগদাদ নগরীতে ১৬৪ হিজরী (৭৮০ খ্রী:) সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই ২৪১ হিজরী (৮৫৫ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন। তিনি-ই ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ইমারতের ভিত্তিপ্রস্তর।

আজকাল যারা এই চারজন ইমামের কোনো একজনকে অনুসরণ করে না, তারা মহাবিপদে পতিত। বস্তুতঃ তারা গোমরাহীতে নিমজ্জিত। এই চারজন ইমাম ছাড়াও আরও অনেক সত্যপন্থী মযহাবের ইমাম ছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমণে তাঁদের মযহাব বিস্মৃত হয়েছে এবং বইপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয় নি। উদাহরণস্বরূপ, মদীনা শরীফের সাতজন উলামা যাঁদের “আল্ ফুকাহা আস্ সাব’আ” বলা হতো, তাঁরা এবং হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ:), হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:), হযরত ইসহাক ইবন রাহাউয়ীয়্যা (রহ:), হযরত দাউদ আত-তায়ী (রহ:), হযরত আমীর ইবনে শারাহিল আশ্ শা’বী (রা:), হযরত লাইস্ ইবনে সা’দ (রহ:), হযরত আ’মাশ (রহ:),  হযরত মোহাম্মদ ইবনে জারির তাবারী (রহ:), হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:) ও হযরত আবদুর রহমান আওযাই (রহ:) প্রমুখ উলামায়ে কেরাম ও রকম মযহাবের স্রষ্টা ছিলেন।

প্রিয়নবী (দ:)-এর সকল সাহাবী-ই বাস্তবিক অর্থে হেদায়াত (পথপ্রাপ্তি)-এর “উজ্জ্বল নক্ষত্র” ছিলেন। সারা পৃথিবীকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্যে তাঁদের যে কোনো একজন-ই যথেষ্ট ছিলেন। তাঁরা ছিলেন মুজতাহিদ, যাঁদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র মযহাব ছিল। তাঁদের অধিকাংশ মযহাব-ই অনুরূপ ছিল। তবু যেহেতু তাঁদের মযহাবগুলো বইপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয় নি, সেহেতু আমাদের পক্ষে সেগুলো অনুসরণ করা সম্ভব নয়। চারজন ইমামের মযহাবগুলো, অর্থাৎ, বিশ্বাস সংক্রান্ত ও কর্ম (আমল) সংক্রান্ত তাঁদের বর্ণিত বিষয়াবলী তাঁদের শিষ্যবৃন্দ কর্তৃক সংগৃহীত এবং ব্যাখ্যাকৃত হয়েছে। সেগুলো বইপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক মুসলমানকে উপরোক্ত চারজন ইমামের যে কোনো একজনের মযহাবকে অনুসরণ করতে হয় এবং সেই মযহাব অনুযায়ী জীবনযাপন ও এবাদত-বন্দেগী পালন করতে হয়।
ঈমানের জ্ঞানে এই চারজন ইমামের দু’জন শিষ্য অত্যন্ত উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। ফলে ঈমান তথা এ’তেকাদের ক্ষেত্রে দুইটি মযহাব জন্মলাভ করে। কুরআন ও হাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সঠিক ঈমান হলো সেটাই, যেটা ওই দু’জন ইমাম প্রদর্শন করেছেন। বস্তুতঃ পরিত্রাণপ্রাপ্ত সম্প্রদায় আহলুস্ সুন্নাতের আকিদা-বিশ্বাস ওই দু’জন ইমাম-ই সারা পৃথিবীতে প্রচার-প্রসার করেন। তাঁদের একজন হলেন ইমাম আবুল হাসান আলী আল্ আশআরী (রহ:) যিনি ২২৬ হিজরী (৪৭৯ খ্রী:) সালে বসরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৩০ হিজরী (৯৪১ খ্রী:) সালে বাগোদে বেসালপ্রাপ্ত হন। অপর জনের নাম ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি (রহ:) যিনি ৩৩৩ হিজরী (৯৪৪ খ্রী:) সালে সমরকন্দ অঞ্চলে বেসালপ্রাপ্ত হন। ঈমানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক মুসলমানকেই এই দু’জন ইমামের কোনো একজনকে অনুসরণ করতে হয়।

আউলিয়ায়ে কেরামের তুরুক (তরীকা বা রাস্তার বহুবচন) সত্য, সঠিক। তাঁরা শরীয়ত হতে এক বিন্দুও বিচ্যুত হন নি। আউলিয়াগণ কারামত (অলৌকিক ক্রিয়া)-এর অধিকারী। তাঁদের সকল কারামত-ই সত্য এবং সঠিক। মহান আলেম ইমাম ইয়াফি’ই বলেছেন, “গাউস্ আস্ সাকলাইন হযরত মওলানা আবদুল কাদির আল জিলানী (রহ:)-এর কারামতসমূহ এতো সর্বজনবিদিত ও সর্বত্র প্রসার লাভকৃত যে, কেউ এতে সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাস পোষণ করতে পারে না। কেননা, ’তাওয়াতুর’ (সর্বত্র প্রসার লাভকৃত অবস্থা) হলো সত্যতার একটি সনদ (প্রামাণ্য দলিল)।”

নামায আদায়কারী কোনো ব্যক্তিকে “কাফের” (অবিশ্বাসী) আখ্যা দেয়া আমাদের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, যদি না আমরা তাকে কুফর বা অবিশ্বাস সৃষ্টিকারী কোনো কথা বলতে শুনি অথবা কাজ করতে দেখি। সেই ব্যক্তির কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে না জেনে আমরা লা’নত (অভিসম্পাত) দিতে পারি না। এমন কি একজন কাফের (ভিন্ন ধর্মাবলম্বী)-কেও লা’নত দেয়া অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এ কারণে ইয়াযিদকে লা’নত না দেয়া-ই উত্তম।

৫। ঈমানের পঞ্চম মূলনীতি হলো “শেষ বিচার দিবস (আল-ইয়াওমুল আখির)-এর প্রতি বিশ্বাস”। এটা আরম্ভ হয় কোনো মানুষের মৃত্যু বিদস থেকে এবং এটা কেয়ামত দিবস পর্যন্ত চলতে থাকে। এটাকে শেষ দিবস বলা হয় এ কারণে যে, এর পরে আর কোনো রাত আসবে না; অথবা এ কারণে যে, এটা পৃথিবীর পরে আগমনকারী। এই হাদীসে উল্লিখিত “দিবস”-টি কিন্তু আমাদের জ্ঞাত দিবারাত্রির মতো নয়। এটা কিছু সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। কেয়ামত কবে হবে তা জ্ঞাত করানো নয়। তথাপি আমাদের প্রিয়নবী (দ:) কেয়ামতের বহু আলামত (লক্ষণ) বর্ণনা করেছেন: হযরত ইমাম আল্ মাহ্দী আগমন করবেন; হযরত ঈসা (আ:) আসমান মতে দামেশকে অবতরণ করবেন, দাজ্জাল আবির্ভূত হবে; ইয়াজুজ ও মা’জুজ সম্প্রদায় সমস্ত পৃথিবীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে। সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে, প্রাণ-সংহারী ভূমিকম্পসমূহ সংঘটিত হবে; ধর্মীয় জ্ঞান বিস্মৃত হবে; দুর্নীতি ও বদমায়েশী বৃদ্ধি পাবে; অধার্মিক, দুর্নীতিপরায়ণ, দুশ্চরিত্র লোকেরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে; আল্লাহতা’লার আজ্ঞাসমূহ বিস্মৃত হবে; সর্বত্র হারাম কাজ সংঘটিত হবে; ইয়ামেন রাজ্যে আগুন দেখা দেবে; সাগর ও পর্বতমালা টুকরো টুকরো  হয়ে যাবে; সূর্য ও চাঁদ অন্ধকার হয়ে যাবে; মহাসাগরগুলো একে অপরের সাথে মিশ্রিত হয়ে ফুটন্ত পানি হবে এবং শুকিয়েও যাবে।

যে  মুসলমান ব্যক্তি পাপ সংঘটন করে, তাকে “ফাসিক” (পাপিষ্ঠ) বলা হয়। ফাসিক এবং সকল অবিশ্বাসী মানুষদেরকে তাদের কবরে মর্মন্তুদ আযাব (শাস্তি) প্রদান করা হবে। এগুলোতে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে। দাফন করার পর মৃতজন একটি অজ্ঞাত জীবনে প্রত্যাবর্তন করবেন এবং শান্তি নয়তো শাস্তি পেতে থাকবেন। একটি হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে যে “মুনকার” ও “নকির” নামের দু’জন ফেরেশতা দুইটি অজ্ঞাত, ভয়ংকর মানুষের ছদ্মবেশে মৃতজনের কবরে এসে তাঁকে প্রশ্ন করবেন। কতিপয় উলামার মতানুযায়ী কবরে প্রশ্নগুলো ঈমানের কিছু মূলনীতি সম্পর্কেই করা হবে; আর কতিপয় উলামার মতানুযায়ী সমগ্র ঈমান সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হবে। এ কারণেই আমাদের সন্তানদেরকে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব শিক্ষা দেয়া উচিৎ: তোমার রব্ব (আল্লাহ্) কে? তোমার দ্বীন (ধর্ম) কী? তুমি কোন্ নবী (আ:)-এর উম্মত? তোমার পবিত্র ধর্ম গ্রন্থের নাম কী? তোমার কিবলা কী? ঈমান ও এবাদতের (অর্থাৎ, আমলের) ক্ষেত্রে তোমার মযহাবগুলো কী কী? ’তাযকেরাতুল কুরতুবী’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে, যারা আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নয়, তারা সঠিকভাবে জবাব দিতে সক্ষম হবে না। যাঁরা সঠিক উত্তর দেবেন, তাঁদের কবরগুলো প্রশস্ত হয়ে যাবে এবং বেহেশতের একটি বাতায়ন কবরে খুলে দেয়া হবে। প্রতি সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁরা বেহেশতে নিজেদের স্থান দর্শন করবেন, আর ফেরেশতাগণ তাঁদের সেবা করবেন এবং তাঁদেরকে শুভসংবাদ দেবেন। যারা সঠিক জবাব দিতে ব্যর্থ হবে, তাদেরকে এমন কঠোরভাবে লাঠি দ্বারা প্রহার করা হবে যে মানব ও জ্বীন জাতি ছাড়া বাকি সকল সৃষ্টি-ই তাদের আর্তনাদ শুনতে পাবে। তাদের কবরগুলো এতো সংকীর্ণ হয়ে যাবে যে তারা তাদের হাড়গুলোকে এলোমেলোভাবে জড়ানো মনে করবে। দোযখ অভিমুখে একটি ছিদ্র করা হবে। প্রত্যেক সকাল ও সন্ধ্যায় তারা দোযখে তাদের স্থান দেখতে পাবে। পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাদেরকে তাদের কবরে চরম শাস্তি প্রদান করা হবে।

ইন্তেকালের পরের (আরেকটি) জীবনে বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি। মাটিতে দাফন হবার পর আবারও দেহে আত্মা প্রবেশ করবে এবং শরীর সমেত তা কবর থেকে পুনরুথ্বিত হবে। অতএব, এই সময়টিকেই কেয়ামতের দিন (পুনরুথ্বান দিবস) বলা হয়েছে।

সকল জীবিত সৃষ্টি মাহশর স্থানে সমবেত হবে। আমলনামাগুলো তাদের নিজ নিজ সংঘটনকারীদের কাছে উড়ে যাবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা যিনি আসমান-জমীন, সূর্য-নক্ষত্র ও সকল অণু-কণার স্রষ্টা, তিনি-ই এগুলো সংঘটিত করবেন। আল্লাহতা’লার রাসূল (দ:) বর্ণনা করেছেন যে এগুলো ঘটবে। তিনি যা বলেছেন তা অবশ্যই সত্য। নিশ্চয়ই এগুলোর সব-ই ঘটবে।

সালেহ্ (পুণ্যবান) মানুষদের আমলনামা তাঁদের ডান দিক থেকে প্রদান করা হবে। আর ফাসিক (গুণাহ্গার) লোকদের আলমনামা তাদের বাম দিক থেকে প্রদান করা হবে; পেছন দিক থেকেও দেয়া হবে। ভালো হোক বা মন্দ, বড় বা ছোট, প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য, সব-ই ওই আমলনামায় লিপিবদ্ধ থাকবে। কেরামান কাতেবীন ফেরেশতাগণের অজ্ঞাত আমলগুলোও সেই দিন প্রকাশ হয়ে পড়বে আল্লাহতা’লা কর্তৃক এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা। সেই দিন এ সব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং সবার কাছ থেকেই হিসেব নেয়া হবে। যদি আল্লাহতা’লার ইচ্ছা হয়, তবে প্রতিটি গোপন কর্মই শেষ বিচার দিবসে প্রকাশিত হবে। আসমান ও জমিনে ফেরেশতাগণ কী কাজ করেছেন তার হিসেবও নেয়া হবে। নবী (আ:)-গণ মানুষদের কাছে কীভাবে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও ধর্ম প্রচার করেছেন, তারও হিসেব নেয়া হবে। আর মানুষেরা কীভাবে এসব আদেশ-নিষেধ কবুল করে তদানুযায়ী আমল করেছে, তারও হিসেব নেয়া হবে। শেষ বিচার দিবসে ঈমানদার যাঁদের কর্ম ও নৈতিকতা সুন্দর হবে, তাঁদেরকে উত্তম পুরস্কার দেয়া হবে। পক্ষান্তরে, যাদের মেজাজ উগ্র ও কর্ম মন্দ হবে, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করা হবে।

আল্লাহতা’লা তাঁর ন্যায়বিচারের খাতিরে কিছু মুসলমানকে তাদের ছোট-খাটো গুণাহর জন্যে শাস্তি দেবেন; পক্ষান্তরে, তাঁর দয়ার খাতিরে তিনি যাদের ইচ্ছা করেন, সেই সব কবীরা ও সগীরা গুণাহ্কারী মুসলমানকে ক্ষমা করে দেবেন। কুফর ও শেরক বাদ দিয়ে বাকি সব গুণাহ্ তিনি মাফ করে দিতে পারেন। তাঁর ইচ্ছা হলে ছোট খাটো গুণাহর জন্যেও তিনি শাস্তি দেবেন। তিনি ঘোষণা  করেছেন যে তিনি কখনোই কুফর (অবিশ্বাস) ও শেরক (মূর্তি পূজা)-কে ক্ষমা করবেন না। কেতাব (ঐশীগ্রন্থ)-সম্পন্ন  কিংবা কেতাববিহীন কাফেররা, অর্থাৎ, যারা সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর পয়গম্বর হওয়াকে অথবা তাঁর আনীত কোনো একটি বিধানকে বিশ্বাস করে না, তারা জাহান্নামে চিরকাল শাস্তি পাবে।

শেষ বিচার দিবসে আমল পরিমাপ করার জন্যে একটি মিযান (পাল্লা) থাকবে, যা আমাদের জ্ঞাত পাল্লা হতে ভিন্ন। এটা এতো বড় হবে যে সমস্ত আসমান ও জমীন এর এক পাল্লাতেই এঁটে যাবে। সৎ-কর্ম বা নেক আমলের পাল্লা উজ্জ্বল হবে এবং তা আরশের ডান দিকে হবে — যেখানে বেহেস্ত অবস্থিত; আর গুণাহ-খাতার পাল্লা হবে অন্ধকার এবং তা আরশের বাম দিকে হবে — যেখানে দোযখ অবস্থিত। কর্ম, কথা-বার্তা, চিন্তাধারা ও চাহনি, যা পৃথিবীতে সংঘটন করা হয়েছে, তা আকার-আকৃতি গ্রহণ করবে; উজ্জ্বল আকৃতির নেক আমল ও কুৎসিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন আকৃতির বদ আমলসমূহ ওই মিযানে (পাল্লায়) পরিমাপ করা হবে। এ কথা বর্ণিত হয়েছে যে ভারি পাল্লাটি ওপর দিকে চড়বে এবং হাল্কা পাল্লাটি নিচে নেমে যাবে। কতিপয় উলামার মতে, বহু মিযান থাকবে। আর বহু উলামা বলেছেন, “দ্বীন ইসলামে পরিস্ফুট করা হয় নি যে কতোগুলো মিযানের অস্তিত্ব রয়েছে, তাই এ ব্যাপারে চিন্তা না করা-ই উচিৎ।”

আল্লাহতা’লার আদেশক্রমে দোযখের ওপরে একটি সেতু নির্মাণ করা হবে যার নাম হবে “সিরাত”। সকলকে ওই সেতু পার হওয়ার জন্যে আদেশ করা হবে। সেই দিন অন্যান্য নবী (আ:)-গণও প্রার্থনা করবেন — “হে আল্লাহ্! নিরাপত্তা দান করুন”। যাঁরা বেহেস্তী হবেন, তাঁরা সহজেই সেতু পার হয়ে বেহেস্তে পৌঁছে যাবেন। তাঁদের কেউ কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, আর কেউ কেউ বাতাসের গতিতে এবং অপর কেউ কেউ দ্রুত ধাবমান ঘোড়ার গতিতে সেতুটি পার হয়ে বেহেস্তে পৌঁছুবেন। সিরাত সেতুটি একটি চুলের চেয়েও পাতলা এবং একটি তলোয়ারের চেয়েও ধারালো। এ পৃথিবীতে দ্বীন ইসলামের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়াও তদ্রূপ বিষয়। ইসলামের সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া সিরাত পার হওয়ার মতোই ব্যাপার। যাঁরা এখানে নিজেদের নফস (কুপ্রবৃত্তি)-এর সাথে সংগ্রামের কষ্ট সহ্য করতে পারেন, তাঁরা সিরাত সহজেই পার হয়ে যাবেন। যারা নফসের কারণে দ্বীনদারী অবলম্বন করতে পারে না, তারা বহু কষ্টে সিরাত পার হবে। এ কারণেই আল্লাহতা’লা দ্বীন ইসলামের সঠিক পথটিকে “সিরাত আল্ মুস্তাকীম” আখ্যা দিয়েছেন। নাম দুটোর সাযুজ্য প্রতিভাত করে যে দ্বীন ইসলামের পথের ওপর কায়েম থাকা সিরাত পার হওয়ার মতোই ব্যাপার। যারা জাহান্নামী হওয়ার যোগ্য, তারা সিরাত হতে জাহান্নামে পড়ে যাবে।

আমাদের আকা ও মওলা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর জন্যে সংরক্ষিত একটি জলাধারের নাম হবে “হাউয আল কাউসার”। এটা এতো বিশাল যে এর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে আসতে সময় লাগবে এক মাস। এর পানি দুধের থেকেও সাদা হবে এবং এর সুগন্ধ মেশকের চেয়েও বেশি হবে। এর চার পার্শ্বে পানি পানের পাত্রগুলো আকাশে নক্ষত্রে সংখ্যার চেয়েও অধিক। যে ব্যক্তি এর পানি একবার পান করবে সে যদি জাহান্নামেও যায়, তথাপিও তার আর কখনো তৃষ্ণা পাবে না।

এটা বিশ্বাস করতে হবে যে “শাফায়াত” হবে। আম্বিয়া (আ:), আউলিয়া, সুলাহা (পুণ্যাত্মা মুসলমানগণ), ফেরেশতাগণ  এবং যাঁদেরকে আল্লাহতা’লা অনুমতি দেবেন, তাঁরা তওবা ব্যতিরেকে ইন্তেকালকারী মুসলমানদের ছোট অথবা বড় গুণাহ্ মাফ করানোর উদ্দেশ্যে শাফায়াত করবেন এবং তাঁদের শাফায়াত কবুলও করা হবে। [আমাদের রাসূলে পাক (দ:) এরশাদ করেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে বড় বড় গুণাহ্গারদের জন্যে হবে আমার শাফায়াত” - অনুবাদক]
পরবর্তী জগতে পাঁচ কিসিমের শাফায়াত বা সুপারিশ হবে:

প্রথমতঃ পাপীরা ভীড়ের চাপে এবং দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার কারণে কান্নাকাটি আরম্ভ করবে এবং বিচার তাড়াতাড়ি শুরু করার জন্যে ফরিয়াদ করতে থাকবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাফায়াত করা হবে।

দ্বিতীয়তঃ জিজ্ঞাসাবাদ যাতে দ্রুত ও সহজেই সম্পন্ন করা যায়, তার জন্যে শাফায়াত হবে।

তৃতীয়তঃ পাপী মুসলমানরা যাতে সিরাত থেকে দোযখে পড়ে না যায় এবং দোযখের আগুনে কষ্ট না পায়, তার জন্যেও শাফায়াত করা হবে।

চতুর্থতঃ মহাপাপী মুসলমানদেরকে দোযখ থেকে বের করে নেয়ার জন্যেও শাফায়ত করা হবে।

পঞ্চমতঃ বেহেস্তে উচ্চ মকামে উন্নীত হওয়ার জন্যে শাফায়াত করা হবে। অসংখ্য নেয়ামত ও চিরস্থায়ী সুখের আবাস বেহেস্ত আটটি স্তরের হবে, যেখানে প্রত্যেকটি মানুষের স্থান তাঁর ঈমান ও আমলের অনুপাতে বিরাজমান।

বেহেস্ত  ও দোযখ বর্তমানে বিরাজ করছে। বেহেস্ত সাত আসমানের ওপরে অবস্থিত। দোযখ সব কিছুর নিচে অবস্থিত। বেহেস্তের সংখ্যা আটটি এবং দোযখের সংখ্যা সাতটি। পৃথিবী, সূর্য ও আসমানসমূহ থেকে বেহেস্ত আকৃতিতে বড়। দোযখ সূর্যের থেকে আকৃতিতে বড়।

৬। ঈমানের ছয়টি মূলনীতির শেষটি হলো “কদর তথা তাকদীরে বিশ্বাস স্থাপন”। অর্থাৎ, এ কথায় বিশ্বাস করা যে, খায়র (ভালো) ও শারর (মন্দ) সব-ই আল্লাহতা’লার ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণাধীন। আরেক কথায়, সকল মানবের কাছে আগমনকারী ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি আল্লাহতা’লার চূড়ান্ত ইচ্ছার অধীন। “কদর” অর্থ একটি পরিমাণের পরিমাপ; সিদ্ধান্ত, আদেশ; আধিক্য ও বিশালতা। কোনো বস্তুর অস্তিত্বের জন্যে খোদা তা’লার চিরন্তন ইচ্ছাকে “কদর” (নিয়তি) বলে। কদর সংঘটিত হওয়ার দৃষ্টান্ত, অর্থাৎ, যে বিষয়টি এরাদা করা হয় তাকে ’কাযা’ বলে। কাযা এবং কদর পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়। কাযা-র অর্থ হলো অনন্ত অতীত হতে অনন্ত ভবিষ্যত পর্যন্ত আল্লাহতা’লার সৃষ্টি করার এরাদা; আর কদর মানে হলো, কাযার সাথে সঙ্গতি রেখে কোনো কিছু সৃষ্টি করার নজির, যা কমও নয়, আবার বেশিও নয়। অনন্ত অতীতে আল্লাহতা’লা জানতেন যা যা সংঘটিত হবে। তাঁর এ জ্ঞানটিকেই “কাযা” ও “কদর” বলে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা এর নামকরণ করেছিলেন “আল্ এনায়াত আল্ আযলীয়্যা।” কাযা হতেই সকল সৃষ্টির উৎপত্তি হয়েছে। অনন্ত অতীতে আল্লাহতা’লার জ্ঞানানুসারে বস্তুসমূহের সৃষ্টিকেও কাযা এবং কদর বলে। কদর-এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমাদেরকে সুনিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে, যদি অনন্তকালে আল্লাহতা’লা কোনো বস্তু সৃষ্টির এরাদা করে থাকেন, তবে তা তাঁর এরাদা অনুযায়ী অস্তিত্বসম্পন্ন হতে বাধ্য — একটুও কম বেশি তাতে হবে না। তিনি যা সৃষ্টি করতে এরাদা করেছিলেন তার অনস্তিত্ব কিংবা তিনি যা সৃষ্টি করতে এরাদা করেন নি তার অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব।

অনন্তকালে আল্লাহতা’লার জ্ঞানে সকল বস্তু, প্রাণী, গাছ-পালা, প্রাণহীন সৃষ্টি, প্রত্যেক জিনিসের  অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব, প্রতিটি মানুষের ভাল ও মন্দ কর্ম এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের শাস্তি বিরাজমান ছিল। তিনি সব কিছুই জানতেন অনন্তকালে। অনন্ত অতীত হতে চিরস্থায়ী ভবিষ্যত পর্যন্ত যা যা ঘটবে, তার গুণাবলী, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও প্রতিটি ইতিবৃত্ত অনন্ত অতীতে তাঁর জ্ঞানের সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি-ই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের সকল সৎ ও বদ কর্ম, দ্বীন ইসলামে তাদের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস, তাদের সকল ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত কাজ একমাত্র আল্লাহতা’লাই সৃষ্টি করেন। তিনি একাই সৃষ্টি করেন এবং কোনো একটি সাবাব (কারণ)-এর মাধ্যমে তা সংঘটন করেন। তিনি প্রত্যেক জিনিস-ই কার্যকারণের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন।

উদাহারণস্বরূপ, আগুন দহন করে। বাস্তবে আল্লাহ্ পাক একাই দহন সৃষ্টি করেন। দহনের ব্যাপারে আগুনের স্বতন্ত্র কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু আল্লাহতা’লার আদত (স্বাভাবিক রীতি/প্রথা) এমনই যে, আগুন কোনো কিছু স্পর্শ না করলে তিনি দহন সৃষ্টি করেন না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতা’লা একাই দহন করে থাকেন। তিনি আগুন ছাড়াও দহন সৃষ্টি করতে সক্ষম, কিন্তু এটা তাঁর স্বাভাবিক রীতি যে তিনি আগুন দ্বারা-ই দহন করে থাকেন। যদি তিনি দহন না করার এরাদা করেন, তবে আগুনেও দহন অসম্ভব। তিনি হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে আগুনে দহন করেন নি। যেহেতু তিনি তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, সেহেতু তিনি তাঁর স্বাভাবিক রীতিকে নাকচ করেছিলেন।

যদি আল্লাহতা’লা এরাদা করতেন, তাহলে তিনি কোনো কার্য-কারণ ছাড়াই সকল বস্তু সৃষ্টি করতে পারতেন; দহন ব্যতিরেকে আগুন, খাদ্য ছাড়া ভরণ-পোষণ সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি মানুষদেরকে কোনো না কোনো মাধ্যম দ্বারা সৃষ্টি করার নেয়ামত দান করেছেন। তিনি কোনো বিশেষ বস্তুকে কোনো বিশেষ মাধ্যম দ্বারা সৃষ্টির এরাদা করেছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে মধ্যস্থতাকারী বস্তুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছেন। যে ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে কোনো কিছু সৃষ্টির আশা করেন, তিনি মাধ্যমের শরণাপন্ন হন এবং তা হাসিল করেন।

যদি আল্লাহতা’লা মধ্যস্থতা দ্বারা তাঁর কর্ম সৃষ্টি না করতেন, তবে কাউকেই কারো প্রয়োজন হতো না; সকলেই আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি প্রার্থনা করতো এবং কোনো কিছুর শরণাপন্ন হতো না। মানুষের মাঝে সামাজিক সম্পর্ক আর থাকতো না, যথা – মরুব্বি ও শিষ্য, শ্রমিক ও তত্ত্বাবধায়ক, ছাত্র ও শিক্ষক ইত্যাদি। ফলে এই পৃথিবী ও পরবর্তী জগত বিশৃংখল হয়ে যেতো এবং সুন্দর ও কুৎসিত, ভাল ও মন্দ, বাধ্য ও অবাধ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকতো না।
যদি আল্লাহতা’লা এরাদা করতেন, তবে তিনি তাঁর আদত অন্য কোনো পন্থায় সৃষ্টি করতেন এবং প্রতিটি বস্তুকে এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে সৃষ্টি করতেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি তিনি এরাদা করতেন, তাহলে তিনি এই দুনিয়ার মোহাচ্ছন্ন, মানুষের প্রতি অত্যাচারী, বে-ঈমান কাফেরদেরকে বেহেস্তে প্রবেশাধিকার দিতে পারতেন এবং ঈমানদার, সৎকর্মশীল ও দানশীলদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কতে পারতেন। কিন্তু আয়াত ও হাদীসসমূহ প্রতিভাত করে যে তিনি এ রকম এরাদা করেন নি।

মানুষের সকল ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত কর্ম ও তৎপরতার স্রষ্টা হলেন আল্লাহতা’লা। তিনি মানবের মধ্যে তার ইচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ড সৃষ্টির লক্ষ্যে এরাদা (আংশিক স্বাধীন ইচ্ছা) সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যাতে করে এর মাধ্যমে মানুষ তার কর্ম সংঘটন করতে সক্ষম হয়। যখন মানুষ কোনো কিছু করতে চায়, তখন আল্লাহতা’লা ইচ্ছা করলে তা সৃষ্টি করে দেন। যদি মানুষ না চায় এবং আল্লাহ পাকও এরাদা না করেন, তবে তিনি সৃষ্টি করেন না। আল্লাহতা’লা শুধু মানুষের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতেই সৃষ্টি করেন না, বরং তাঁর ইচ্ছানুযায়ীও সৃষ্টি করেন। আল্লাহতা’লার সৃষ্ট মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মগুলোর উপমা হলো আগুনের মতোই, যা কোনো বস্তু স্পর্শ করলে তিনি দহন সৃষ্টি করে দেন; আর আগুন স্পর্শ না করলে তিনি দহন সৃষ্টি করেন না। একইভাবে যখন ছুরি কোনো বস্তু স্পর্শ করে, তখন তিনি কর্তন সৃষ্টি করে দেন। ছুরিটি নয়, বরং তিনি-ই কর্তন করেন। কর্তনের জন্যে ছুরিটিকে তিনি একটি মাধ্যম বানিয়েছেন। আরেক কথায়, তিনি মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মগুলো তাদের ইচ্ছার কারণে (সাবাব) সৃষ্টি করে দেন। তবে প্রকৃতির কর্মকাণ্ড মানুষের ইচ্ছাধীন নয়, বরং আল্লাহতা’লা যখন ইচ্ছা করেন, তখন-ই অন্যান্য কার্যকারণ দ্বারা তা সৃজিত হয়। আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা নেই। তিনি-ই সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, অণুকণা, জীবকোষ, জীবাণু ও তাদের উপাদান সৃষ্টি করেছেন। তথাপি মানুষ ও প্রাণীদের ইচ্ছাধীন কর্মের সাথে প্রাণহীন বস্তুসমূহের কর্মকাণ্ডের পার্থক্য বিরাজ করছে; যখন কোনো মানুষ কিংবা কোনো প্রাণী কোনো কাজ করতে ইচ্ছা পোষণ করে, তখন খোদা তা’লা ইচ্ছা করলে সেই মানুষ কিংবা সেই প্রাণীকে কর্ম সংঘটনের ক্ষমতা মঞ্জুর করেন এবং তিনি তা সৃষ্টি করে দেন। মানুষের ক্রিয়া তার ক্ষমতাধীন নয়। প্রাণহীন (জড়) বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে কোনো ইচ্ছা বা পছন্দ সেগুলোর নেই। আল্লাহতা’লা আগুনের স্পর্শের মাধ্যমে দহন সৃষ্টি করেন, কিন্তু এতে আগুনের কোনো ইচ্ছা বা পছন্দ নেই।

দু’টি কারণে মানুষের ইচ্ছাধীন কর্ম সংঘটিত হয়। প্রথমতঃ মানুষের ইচ্ছা ও ক্ষমতা এর সাথে জড়িত। এ কারণে মানুষের কর্মকাণ্ডকে ’কাসব’ (অর্জন) বলে, যা মানুষের একটি গুণবিশেষ। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহতা’লার সৃষ্টি প্রক্রিয়া জারি হয়। মানুষকে ’কাসব’ মঞ্জুর করার জন্যেই আল্লাহতা’লার আদেশ-নিষেধ, পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুরা সফফাত ৯৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান — “আল্লাহতা’লা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের ক্রিয়াও সৃষ্টি করেছেন” (আল আয়াত)। এ আয়াতটি মানুষের মধ্যে কাসব বা ’এরাদাত-এ-জুযিয়্যার’ (আংশিক স্বাধীন ইচ্ছার) অস্তিত্ব এবং চাপ প্রয়োগের অনস্তিত্ব-ই কেবল প্রতিভাত করে না — যার দরুন ক্রিয়াসমূহ মানুষের প্রতি আরোপিত হয় ও বলা হয় যে “মানুষের কর্ম সংঘটন” — বরং আয়াতটি আরো প্রতিভাত করে যে সকল জিনিস কাযা ও কদরসহ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।

মানুষের দ্বারা ক্রিয়া সৃষ্টির জন্যে প্রথমে তার ইচ্ছার প্রয়োজন হয়। এ ইচ্ছাকে কাসব (অর্জন) বলে। মরহুম আমিদী বলেছেন যে, ক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষেত্রে কাসব প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু এ কথা বলা ভুল নয় যে একটি ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষেত্রে কাসব কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না – যেহেতু মানুষের ইচ্ছাকৃত ক্রিয়াটি এবং সৃষ্ট ক্রিয়াটি একে অপর থেকে ভিন্ন নয়। অতএব, মানুষ যা কিছু চায়, তার সব-ই সে করতে পারে না। সে যা কামনা করে না তাও সংঘটিত হতে পারে। যদি মানুষ যা চাইতো, তাই করতে সক্ষম হতো এবং যদি সে যা চাইতো না তা সংঘটিত না হতো, তবে সে আর মানুষ থাকতো না, বরং খোদা দাবিদার হতো। আল্লাহতা’লা তাঁর সৃষ্ট মনুষ্য জাতিকে দয়া করে তাঁর আদেশ-নিষেধ মান্য করার মতো শক্তি-সামর্থ্য প্রদান করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যবান ও ধনাঢ্য ব্যক্তি জীবনে একবার হজ্জ করতে সক্ষম; আকাশে রোজার চাঁদ দেখার পর তিনি বছরে এক মাস রোযা রাখতে সক্ষম; তিনি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরযকৃত নামায আদায় করতে পারঙ্গম; নিসাবের পরিমাণ সম্পদ অথবা সম্পত্তি থেকে শতকরা আড়াই ভাগ তিনি গরিব মুসলমানদের মাঝে যাকাত দান করতে সমর্থ। অএতব, মানুষ ইচ্ছা করলেই ইচ্ছাধীন ক্রিয়া সংঘটন করে, আর ইচ্ছা না করলে তা করে না। আল্লাহ্ পাকের মাহাত্ম্য এখানেও উপলব্ধি করা যায়। যেহেতু অজ্ঞ ও আহাম্মকেরা কাযা ও কদরের জ্ঞান উপলব্ধি করতে অক্ষম, সেহেতু তারা আহলে সুন্নাতের উলামাগণ যা বলেছেন তা বিশ্বাস করে না এবং মানুষের ক্ষমতা ও (আংশিক) স্বাধীন ইচ্ছাকে সন্দেহ করে। তারা মনে করে যে মানুষ তার ইচ্ছাধীন ক্রিয়া সংঘটনের ক্ষেত্রে অপারগ বা প্রভাবিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনভাবে কর্ম সংঘটন করতে অক্ষম দেখে তারা আহলে সুন্নাতকে গালমন্দ করে থাকে। তাদের এই ভ্রান্ত আচরণ প্রতিভাত করে যে তাদেরও স্বাধীন ইচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দ আছে।

একটি ক্রিয়া সংঘটন করা বা না করার ক্ষমতা হলো কুদরত-এর বিষয়। একটি ক্রিয়া সংঘটন করা বা না করার ইচ্ছাকে এরাদা বলা হয়। কোনো কিছুকে গ্রহণ করা বা অস্বীকৃতি না জানানোকে বলা হয় রেযা (সম্মতি)। যখন কোনো কিছুতে ইচ্ছার প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার শর্তে ক্ষমতা ও ইচ্ছা মিলিত হয়, তখন খালক্ (সৃষ্টি) সংঘটিত হয়। যদি প্রভাব বিস্তার ছাড়াই তারা উভয়ে মিলিত হয়, তবে এটাকে বলা হয় কাসব। যদি প্রভাব বিস্তার করা কিংবা না করা কোনো শর্ত না হয়, তবে এটাকে বলা হয় এখতেয়ার। ইচ্ছা পোষণকারী যে কেউই স্রষ্টা নয়। অনুরূপভাবে, ইচ্ছাকৃত সকল বিষয়ে সম্মতি দেয়াও অত্যাবশ্যক নয়। এখতেয়ার ও কাসব (অর্জন) এক সাথে থাকতে পারে। আবার এখতেয়ার ও সৃষ্টিও এক সাথে থাকতে পারে। এ কারণেই আল্লাহতা’লাকে খালেক (স্রষ্টা) ও মোখতার (এখতেয়ারসম্পন্ন) বলা হয়; আর মানুষকে বলা হয় কাসেব (অর্জনকারী) ও মোখতার (এখতেয়ার সম্পন্ন)।

আল্লাহতা’লা তাঁর বান্দাদের এবাদত ও গুণাহসমূহ এরাদা ও সৃষ্টি করেন। তথাপি তিনি এবাদত-বন্দেগী পছন্দ করেন এবং গুণাহ-খাতা অপছন্দ করেন। তাঁর চূড়ান্ত ইচ্ছা (এরাদা) ও সৃষ্টির দ্বারা-ই সকল বস্তু অস্তিত্ব  পায়। সুরা আন’আমের ১০২ নং আয়াতে তিনি এরশাদ ফরমান  –   “নেই কোনো উপাস্য তিনি ব্যতিরেকে; একমাত্র তিনি-ই সব কিছুর স্রষ্টা” (আল আয়াত)।

মো’তাযেলা সম্প্রদায় এরাদা (ইচ্ছা) ও রেযা (সম্মতি)-র মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অপারগ হয়ে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকা পড়ে গিয়েছিল এবং বলেছিল, “মানুষ নিজেই তার ইচ্ছানুযায়ী ক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে।” ফলে তারা কাযা এবং কদরকে অস্বীকার করে বসে। জবরীয়্যা সম্প্রদায় ছিল পুরোপরিভাবে বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারে নি যে সৃষ্টি ছাড়াও এখতেয়ার বিরাজ করতে পারে। মানুষের মধ্যে কোনো এখতেয়ার নেই ধারণা করে তারা মানুষকে কাঠ ও পাথরের সাথে তুলনা করেছিল। তারা বলেছিল, “মানুষ পাপী নয়; আল্লাহতা’লাই সকল পাপ সংঘটন করেন” (আল্লাহ্ মাফ করুন!)। যদি মানুষের মধ্যে কোনো ইচ্ছা ও এখতেয়ার না থাকতো এবং যদি জবরীয়্যা সম্প্রদায়ের কথা মতে আল্লাহতা’লাই ক্ষমতাবলে বদকর্ম ও পাপ সংঘটন করতেন, তাহলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাহাড় থেকে ফেলে দেয়া মানুষটি এবং চারদিক লক্ষ্য করে হেঁটে নেমে যাওয়া মানুষটির মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকতো না। অথচ প্রথমজন ক্ষমতার জোরে গড়িয়ে নামছে, আর দ্বিতীয়জন তার ইচ্ছা ও এখতেয়ারসহ নামছে। যারা এদের মধ্যকার পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে না, তারা অদূরদর্শী এবং কুরআনের আয়াতসমূহে অবিশ্বাসকারীও। তারা আল্লাহ্ পাকের আদেশ-নিষেধকে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক মনে করে। মো’তাযেলা ও কাদারীয়্যা সম্প্রদায়ের ধারণানুযায়ী যদি মনে করা হয় যে মানুষ নিজেই তার ইচ্ছা হতে সৃষ্টি করে, তাহলে নিম্নোক্ত আয়াতটি অবিশ্বাস করা হয়, যা ঘোষণা করে — “আল্লাহ্ একাই সকল বস্তুর স্রষ্টা”। পাশাপাশি এর দরুন মানুষকেও আল্লাহর শরীকদার বানানো হয়।

মো’তাযেলার মতো শিয়া সম্প্রদায়ও বলে যে মানুষ যা চায়, তা-ই সে সৃষ্টি করতে সক্ষম। এর সমর্থনে তারা বলে যে গাধা যতোই মার খাক না কেন, কখনোই খাল পার হয় না। অথচ তারা একবারও ভেবে দেখে না যে মানুষ যদি কিছু করার ইচ্ছা করে এবং তাতে যদি আল্লাহর ইচ্ছা না থাকে, তাহলে এ দুটো ইচ্ছা এক সাথে হতে পারে না। যদি আল্লাহতা’লার এরাদা সংঘটিত হয়, তবে শিয়ারা যা বলছে তা ভ্রান্ত। অর্থাৎ, মানুষ যা চায়, তার সবই সৃষ্টি করতে বা সংঘটন করতে সে পারে না। যদি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী সব কিছু ঘটতো যা শিয়ারা দাবি করছে, তাহলে আল্লাহতা’লা অক্ষম ও ব্যর্থ হতেন (আল্লাহ্ মাফ করুন!)। কিন্তু তিনি তো অক্ষম নন। শুধু তিনি যা এরাদা করেন, তা-ই সংঘটিত হয়। একমাত্র তিনি-ই সকল জিনিসের স্রষ্টা। আর এটাই আল্লাহতা’লার সত্তা মোবারক। “মানুষ এটা সৃষ্টি করেছে” কিংবা “আমরা এটা সৃষ্টি করেছি” কিংবা “তারা এটা সৃষ্টি করেছে” ইত্যাদি কথার মতো কথা বলা অথবা লিখা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। আল্লাহতা’লার প্রতি এটা দুর্ব্যবহার (হাকিকী অর্থে সৃষ্টি ক্ষমতা যেহেতু তাঁরই)। বস্তুতঃ এটা কুফর বা অবিশ্বাসের জন্ম দেয়।

= সমাপ্ত =