Monday 10 March 2014

চার মযহাবের মূল্যায়ন: লা-মযহাবী ফিতনা



মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Dr Abdal-Hakim Murad's online article 'Understanding the Four Madhhabs: The problem with anti-madhhabism'. Translator: Kazi Saifuddin Hossain]

{আমার পীর ও মোর্শেদ চট্টগ্রাম আহলা দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরতুল আল্লামা শাহ সূফী আলহাজ্জ্ব সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পুণ্য স্মৃতিতে উৎসর্গিত}

উম্মতে মোহাম্মদীর (মুসলমান সম্প্রদায়ের) গত এক সহস্র বছরেরও বেশি সময়কালের সবচেয়ে বড় অর্জন নিঃসন্দেহে এর অভ্যন্তরীন বুদ্ধিবৃত্তিক অবিভক্তি। হিজরী পঞ্চম শতক থেকে প্রায় বর্তমান যুগ পর্যন্ত, বিভিন্ন রাজবংশের মধ্যকার সংঘাতের বাহ্যিক নাটকীয়তা সত্ত্বেও সুন্নী মুসলমান সমাজ নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক প্রায় অব্যর্থ মনোভাব লালন করে আসছেন। এটি একটি চমক সৃষ্টিকারী বাস্তবতা যে কোনো ধর্মযুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা হযরানি-ই তাঁদেরকে বিভক্ত করতে পারে নি এই দীর্ঘ সময়কালে, যা অন্যান্য দিক থেকে ভীষণ কঠিন ছিল। ধর্মীয় আন্দোলনসমূহের ইতিহাস বলে যে এটি একটি অসাধারণ ফলাফল। ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) ও তাঁর শিষ্যদের ব্যাখ্যাকৃত সমাজবিদ্যার স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, কোনো ধর্ম তার প্রাথমিক কিছু সময় ঐক্যের স্বাদ আস্বাদন করে থাকে এবং তার পর প্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্বের দ্বারা ক্রমবর্ধমান তিক্ত বিভক্তিতে পতিত হয়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো খৃষ্টধর্ম; তবে এতে অন্যান্যদেরও যোগ করা যায়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মার্কসবাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনও। বাহ্যতঃ এই পরিণতি এড়ানোয় ইসলাম ধর্মের সামর্থ্য বা ক্ষমতা তাক লাগানোর মতো বিষয়, আর তাই এটি সযত্ন বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
অবশ্য এর একটি সহজ, সরল ধর্মীয় ব্যাখ্যা আছে। ইসলাম সর্বশেষ বা চূড়ান্ত ধর্ম, বলা যেতে পারে বাড়ি ফেরার শেষ বাস; আর তাই এটি অধিকতর ক্ষয়রোগগুলো থেকে খোদায়ী হেফাযত তথা সুরক্ষাপ্রাপ্ত। এ কথা সত্য যা আবদুল ওয়াদুদ শালাবী বলেছেন এই মর্মে যে, ইসলামের ঊষালগ্ন থেকে এক আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা (বা প্রশাসন) সক্রিয় রয়েছে – যে বিষয়টি বেশ কিছু সংখ্যক হাদীস দ্বারা ভালভাবে সমর্থিত। বিশেষতঃ বিধাতা এই উম্মাহকে অবহেলা করেন নি। পূর্ববর্তী ধর্মগুলো আলতোভাবে বা বেদনাদায়ক পন্থায় বিভক্তি ও অপ্রাসঙ্গিকতার গহ্বরে পতিত হতে থাকলেও, ক্রমান্বয়ে গুণগত মান হারানো ইসলামী ধার্মিকতা বা ভক্তির মাঝে এমন এক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যার দরুণ এটি স্বর্ণযুগে গুরুত্বারোপিত ঐক্যের মনোভাবের বা চেতনাবোধের অধিকাংশই বজায় রাখতে পেরেছে। আমীর (শাসক) ও রাজনীতিবিদদের ভাঁড়ামি যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, মো’মেন তথা বিশ্বাসীদের ভ্রাতৃত্ববোধ যেটি খৃষ্টধর্ম ও আরও কিছু ধর্মের প্রাথমিক পর্যায়ে বাস্তবতা ছিল, তা গত এই চৌদ্দ’শ বছরে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ঐশী ধর্ম ইসলামের সর্বশেষ ও নিশ্চায়ক (অনুসারী) সমাজের অধিকাংশ সদস্যের জন্যে অপরিহার্য নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এর কারণ সহজ এবং তর্কাতীত: আল্লাহতা’লা আমাদেরকে এই ধর্ম দিয়েছেন তাঁরই চূড়ান্ত বিধান হিসেবে, আর তাই পৃথিবীর শেষ দিনগুলো পর্যন্ত এটি টিকে থাকবে এরই তাওহীদ (একত্ববাদ), এবাদত (উপাসনা) ও নৈতিকতার অত্যাবশ্যকীয় মৌলনীতিমালাসহ।
এই ধরনের ব্যাখ্যার সুস্পষ্ট উৎকর্ষ রয়েছে। কিন্তু তবুও আমাদেরকে এই নিয়মের ব্যতিক্রম সে সব বেদনাদায়ক ঘটনা ব্যাখ্যা করতে হবে যেগুলো আমাদের ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটেছিল। মহানবী (দ:) স্বয়ং তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে এক হাদীসে বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ আমার (হায়াতে জিন্দেগীর) পরে বেঁচে থাকবে, সে প্রচুর ফিতনা-ফাসাদ দেখতে পাবে” (ইমাম তিরমিযী বর্ণিত)।  খলীফা হযরত উসমান (রা:)-এর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহ, হযরত আলী (ক:) ও আমীরে মোয়াবিয়া (রা:)-এর মধ্যকার সংঘাত, খারেজীদের রক্তাক্ত বিভক্তি সৃষ্টি, প্রাথমিক যুগের এই সব ফিতনা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিম রাষ্ট্রশরীরে অনৈক্যের ছুরি চালিয়েছিল। শুধু উম্মতের (বুযূর্গ) উলামাদের অন্তঃস্থিত সহজাত সুস্থ বিচারবুদ্ধি ও ঐক্যের প্রতি মহব্বত, যা নিঃসন্দেহে খোদায়ী মদদপ্রাপ্ত ছিল, তা-ই ওই প্রথম দিককার ফিতনার সফল মোকাবেলা করে এবং সুন্নী মতাদর্শের এমন একটি শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল কাঠামো বিনির্মাণ করে যা অন্ততঃ ধর্মীয় ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিহাসের ৯০% সময়কাল যাবত এই উম্মতের ৯০% জনসংখ্যাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
আমাদের মুসলমানদের বর্তমানকার ক্রমবর্ধমান বিভক্তি সম্পর্কে ভালভাবে বুঝতে হলে সুদূর অতীতে বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তিগুলোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই ধরনের অনেক (ফিতনাবাজ) ছিল, যাদের কেউ কেউ অত্যন্ত গোঁড়াপন্থী। কিন্তু এদের মধ্যে শুধু দু’টি গণমুখি আন্দোলনের রূপ নেয়, যার চালিকা-শক্তি ছিল ধর্মীয় মতবাদ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মবিশ্বাস ও মনীষার বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহ। সঙ্গত কারণেই এই দুটো আন্দোলন খারেজীবাদ ও শিয়াবাদের নাম অর্জন করে। সুন্নী মতাদর্শের সাথে বৈসাদৃশ্য রেখে এই দু’টি মতবাদ অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ও উপ-আন্দোলনের জন্ম দিতে পেরেছে। তথাপি ইসলামে ধর্মীয় কর্তৃত্বের উৎসসম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নে মুসলমানদের মূলধারা হতে পৃথক দু’টি মতবাদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়ায় এরা মতপার্থক্যের চিহ্নিত দু’টি ধারা হিসেবে টিকে গিয়েছে।
হযরত আলী (ক:)-এর বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তি)-পরবর্তীকালের অন্ধ সমর্থক (শিয়া)-রা পূর্ববর্তী খলীফাবৃন্দকে নৈতিকভাবে অধঃপতিত মনে করে ধর্মীয় কর্তৃত্বের এমন একটি থিওরীর জন্ম দেয়, যা ঐতিহ্যবাহী সাম্যের ধারণাকে পরিত্যাগ করে ধর্মীয় কর্তৃত্ব অর্পণ করে ভক্তি সঞ্চারের ক্ষমতাধর ইমামবর্গের এক পরম্পরার কাছে। আমাদের এখানে থামা উচিত হবে না এই প্রশ্নের উত্তর যাচাই করতে যে প্রাচ্যদেশীয় খৃষ্টমত হতে ধর্মান্তরিত কতিপয় নও-মুসলিম দ্বারা এ ধারণাটি প্রভাবিত ছিল কি-না, যারা যীশু খৃষ্টের ভাববাদী বার্তাবাহক (হাওয়ারী)-দের উত্তরাধিকারের ধারণায় পুষ্ট ছিল, যে দানের বদৌলতে অনুমান করা হয় খৃষ্টান চার্চকে দেয়া হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মাঝে যীশু খৃষ্টের দর্শন প্রচারের অনন্য ক্ষমতা। এখানে সঠিকভাবে যার মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন তা হলো, প্রাথমিক যুগের ইসলামী সমাজে ব্যাপকভাবে অনুভূত চূড়ান্ত ধর্মীয় কর্তৃত্বের অভাবের প্রত্যুত্তর হিসেবেই অগণিত সংখ্যক আকার-আকৃতির শিয়া মতবাদ বিকশিত হয়েছিল। খুলাফায়ে রাশেদীন তথা সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ শাসকদের যুগ শেষ হয়ে এলে পরে, এবং  মো’মেন (বিশ্বাসী)-দের নেতা হিসেবে যে জীবন যাপন পদ্ধতি উমাইয়া শাসকবর্গের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, তা হতে তাঁরা নজর-কাড়া ক্রমাগত বিচ্যুতিতে গা ভাসালে, চরম পরস্পরবিরোধী ও সদ্য জন্ম নেয়া ফেকাহর মযহাবগুলোকে এমতাবস্থায় মনে হচ্ছিল ধর্মীয় বিষয়াদিতে শক্তিশালী ও দ্ব্যর্থহীন কর্তৃত্ব রক্ষায় ঘাটতিপূর্ণ। এরই ফলশ্রুতিতে নিখুঁত ইমামসম্পর্কিত ধারণার অপ্রতিরোধ্য চিত্তাকর্ষণ বারংবার ঘটতে থাকে।
ইমাম মতবাদের উত্থানের এই ব্যাখ্যাটি শিয়া মতবাদের সম্প্রসারণের দ্বিতীয় বড় পর্যায় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতেও সহায়তা করে। হিজরী পঞ্চম শতকের সুন্নী পুনর্জাগরণের সাফল্যের পরে যখন সুন্নী মতাদর্শকে অবশেষে অবিভক্ত একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনি শিয়া মতবাদ ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। এর চরমপন্থী শাখা, ইসমাইলী শিয়া সম্প্রদায়, ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর তোপের মুখে পড়ে, যাঁর প্রণীত ‘বাতেনীদের নানা কলংক’ বইটি তাদের গোপন ধ্যান-ধারণাকে প্রলয়ংকরী শক্তিসহ উম্মোচিত ও মূলোৎপাটিত করে। শিয়াদের এই পতন সপ্তম হিজরী শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে থামে, যখন চেঙ্গিস খানের অধীনে মংগল বাহিনী ইসলামের শাসনাধীন মধ্য (এশীয়) অঞ্চলের দেশগুলো দখল করে নেয় এবং ধ্বংস করে ফেলে। এই আক্রমণের ভয়াবহতা কল্পনাতীত; উদাহরণস্বরূপ, আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, হেরাট শহরের এক লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে মাত্র চল্লিশজন আগুনে ভস্মিভূত নগরীর ধ্বংসস্তুপ থেকে বেরিয়ে আসেন ওই ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হতে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির এই করাল গ্রাস কাটতে না কাটতেই নব্য-ধর্মান্তরিত তুর্কমান যাযাবর জাতি বিধ্বস্ত নগরীগুলোতে প্রবেশ করে; নগরীগুলোর সুন্নী উলেমাবৃন্দ ইতোমধ্যে শহীদ হওয়ায় এবং ভয়-ভীতি ও গণ্ডগোলের পরিবেশ বিরাজ করায়, অধিকন্তু আকাশে-বাতাসে মুক্তিদূত আবির্ভাবের প্রত্যাশা থাকায় তুর্কমান যাযাবর জাতি শিয়া মতবাদের সবচেয়ে উগ্র আকার ধারণ করে। শিয়াদের ইরান দখল, যা এক সময় সুন্নীদের অনুগত রাজ্য ছিল, তা ইতিহাসের ওই বেদনাদায়ক অধ্যায়েই সংঘটিত হয়েছিল।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে অপর যে ভিন্ন মতাবলম্বী দলের আবির্ভাব ঘটে, তা হলো খারেজী সম্প্রদায় – যারা আক্ষরিক অর্থেই ’খারিজ’ বা ধর্মত্যাগী; তারা এই খেতাবে ভূষিত, কারণ তারা খলীফা হযরত আলী (ক:)-এর সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করেছিল যখনই ‍তিনি আমীরে মোয়াবিয়া (রা:)-এর সাথে তাঁর বিরোধ সালিশে নিষ্পত্তি করতে সম্মত হন। “ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহি” (আল্লাহর আদেশ ছাড়া কোনো হুকুম নেই) – কুরআন মজীদের এই আয়াতটি প্রদর্শন করে তারা হযরত আলী (ক:) ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে; তাঁর সৈন্যবাহিনীতে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নেতৃস্থানীয় সাহাবী (রা:)-বৃন্দও ছিলেন। অবশেষে হযরত আলী (ক:) নাহরাওয়ান-এর যুদ্ধে খারেজীদেরকে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধে দশ হাজারের মতো খারেজী মারা যায়।
প্রথম দিককার খারেজীরা মারা গেলেও খারেজী মতবাদ নিজে টিকে থাকে। এই মতবাদ নিজেকে সূত্রবদ্ধ করার সময় শিয়া মতবাদের ঠিক উল্টো রূপ পরিগ্রহ করে, ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে বা ভক্তি-শ্রদ্ধার বদৌলতে প্রাপ্ত নেতৃত্বের যে কোনো ধারণাকে এটি প্রত্যাখ্যান করে এবং একমাত্র পুণ্য কর্মের ভিত্তিতেই ঈমানদারদের সমাজের নেতৃত্ব বাছাইয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে। অত্যন্ত মৌলিক মাপকাঠি দ্বারা এটি নিরূপণ করা হয়: প্রথম দিককার খারেজীরা আমল পালনে তাদের কঠোর নীতির কারণে পরিচিত ছিল; আর এই কঠোর মতবাদের দৃষ্টিতে যে মুসলমান-ব্যক্তি বড় পাপ (গুনাহে কবীরাহ) সংঘটন করেন, তিনি অবিশ্বাসী (কাফের) হয়ে যান। ‘তাকফির’ তথা অবিশ্বাসের এই ধারণাটি খুজেস্তানের প্রত্যন্ত পার্বত্য জেলাগুলোতে তাঁবু ফেলে থাকা খারেজী দলগুলোকে উমাইয়া শাসনের প্রতি আনুগত্য স্বীকারকারী মুসলমানদের বসতি আক্রমণের অনুমতি এনে দেয়। এই সব অভিযানে অ-খারেজীদেরকে নিয়মিতভাবে হত্যা করা হতো, যার দরুণ আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফের মতো প্রতাপশালী উমাইয়া শাসকবর্গ নির্মম দমনমূলক পাল্টা ব্যবস্থা নিতেন। তবে খারেজীদের উদ্দেশ্যহীন কর্মকাণ্ড হতাশাব্যঞ্জক হওয়া সত্ত্বেও আক্রমণগুলো চলতে থাকে। খলীফা হযরত আলী (ক:) শহীদ হন নাহরাওয়ানের যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসা ইবনে মুলজাম নামের এক খারেজীর হাতে; অপর দিকে, মুহাদ্দীস ইমাম নাসাঈ (রহ:), ‘সুনান’ শীর্ষক হাদীসগ্রন্থের যিনি প্রণেতা, তাঁকে ৩০৩ হিজরী/৯১৫ খৃষ্টাব্দ সালে দামেশকে খারেজী উগ্রবাদীরা একইভাবে শহীদ করে। শিয়া মতবাদের মতো খারেজীবাদও ইরাক ও মধ্য এশিয়ায় এবং সময়ে সময়ে অন্য এলাকায়ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে, ঠিক ইসলামের চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এই সময়ে এসেই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। সুন্নী মতাদর্শ একটি বিস্তারিত ব্যবস্থা হিসেবে ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় আবির্ভূত হয়, যা এই সময় সমাধানমূলক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ উলেমাবৃন্দের পথ ও মতের এমন উজ্জ্বল প্রতিফলনকারী ছিল যে প্রতিদ্বন্দ্বী আন্দোলনগুলোর আকর্ষণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
ঘটনা এই যে, সমতাবাদী খারেজী মতবাদ ও শিয়া আধিপত্যপরম্পরার চরম দুই পন্থার মাঝামাঝি অবস্থানকারী সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক ইসলাম দীর্ঘ সময় যাবত নিজের কর্তৃত্বের ধারণা সম্পর্কেই মতপার্থক্যে জড়িয়ে ছিল। সুন্নীদের কাছে কর্তৃত্ব মূলতঃ কুরআন ও সুন্নাহতে নিহিত। কিন্তু এতো বিশাল এক হাদীসশাস্ত্র যা সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের অনুসারীদের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার দরুণ সমগ্র ইসলামী বিশ্বের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন আকৃতিতে ও বর্ণনায় বিস্তার লাভ করেছিল, তার মুখোমুখি হয়ে সুন্নাহকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা কখনো কখনো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এমন কি এই বিশাল সম্ভার, যার সমষ্টি কয়েক লক্ষ রওয়ায়াত (বর্ণনা), তা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসগুলো বাছাই করে নেয়ার পরও এমন কিছু হাদীস ছিল যেগুলো দৃশ্যতঃ পরস্পরবিরোধী, বা আল-কুরআনের আয়াতের সাথেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি স্পষ্ট ছিল যে খারেজীদের মতো হাদীসের একটি ছোট্ট সংগ্রহশালা গঠন করে তা থেকে সরাসরি নীতিমালা প্রণয়ন ও আইন-কানুন বের করার সহজ পন্থা অবলম্বন এ ক্ষেত্রে কার্যকরী নয়। হাদীসগুলোর অভ্যন্তরীন অসামঞ্জস্য এতো অধিক সংখ্যক এবং সেগুলোর প্রতি আরোপিত ব্যাখ্যাগুলো এতো জটিল ছিল যে কাজী (বিচারক)-মণ্ডলীর পক্ষে স্রেফ কুরআন মজীদের ও হাদীস শাস্ত্রের কোনো সংশ্লিষ্ট পাতা খুলে রায় দেয়া সম্ভবই ছিল না।
প্রাথমিক যুগের উলেমাবৃন্দ বিভিন্ন লিপির মধ্যকার বাহ্যিক অসঙ্গতির অন্তর্নিহিত কারণগুলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করেন; এটি করার সময় অহরহ-ই সবচেয়ে তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন প্রথিতযশা উলেমাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক চলেছিল। উসূলে ফেকাহ (ইসলামী বিধানের মৌলনীতি)-এর বেশির ভাগ অংশ প্রণয়ন করা হয়েছিল এ ধরনের অসঙ্গতি দূরীকরণের একটি নিয়ম, যা ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করে, তা জারি করতে। ‘তায়ারুদ আল-আদিল্লা’ (প্রামাণ্য দলিলাদির পরস্পরবিরোধিতা) শব্দটি মুসলমানদের আইনশাস্ত্রের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও জটিল বিষয় হিসেবে ইসলামী ফেকাহর সকল ছাত্রের কাছেই পরিচিত। ইবনে কুতাইবা (রহ:)-এর মতো প্রাথমিক যুগের আলেমবৃন্দ এই বিষয়ে গোটা বই উৎসর্গ করার বাধ্যবাধকতা অনুভব করেছিলেন। উসূলের উলেমাবৃন্দ তাঁদের গবেষণার শুরুতেই ধরে নেন যে শাস্ত্রলিপির পরস্পরবিরোধিতা মহানবী (দ:) কর্তৃক প্রকাশিত বিধাতা (খোদাতা’লা)-র ঐশী বিধানের অসঙ্গতি প্রতিফলন করে না, বরং তা বিভিন্ন ব্যাখ্যার অসামঞ্জস্যতা-ই পরিস্ফুট করে। ইসলামের মর্মবাণী হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলন)-প্রাপ্তির আগেই নিখুঁতভাবে পৌঁছানো হয়েছিল; আর এর অব্যবহিত পরের উলেমাবৃন্দের কাজ ছিল শুধু তা ব্যাখ্যা করা, সংস্কার বা সংশোধন করা নয়।
ইসলামের মৌলিক শাস্ত্র যে শুধু ব্যাখ্যা-ই করা যায়, সে বিষয়ে সচেতন হয়ে ইসলামী জ্ঞান বিশারদবৃন্দ জটিল দলিল-আদিল্লা পরখ কালে কিছু প্রাথমিক তত্ত্বগত পরীক্ষা ও সমাধান-পদ্ধতির সিরিজ প্রয়োগ করতেন। পূর্ববর্তী যুগের উলামাবৃন্দ যে পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন তা হলো, দুটো কুরআন মজীদের আয়াত বা দুটো হাদীস শরীফ যদি পরস্পরবিরোধী প্রতীয়মান হতো, তবে উলেমাবৃন্দ সেগুলোর এবারত/লিপির ভাষা বিশ্লেষণ করতেন, যাতে আরবী থেকে ব্যাখ্যা করার সময় কোনো ভুলের কারণে এই পরস্পরবিরোধিতার উৎপত্তি হয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করা যায়। এই পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করা না গেলে উলেমাবৃন্দ শাস্ত্রলিপিগত, আইনী ও ইতিহাস রচনাগত এই তিনটি দিকের সমন্বিত কৌশলের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে চেষ্টা করতেন ওই দুটো দলিলের মধ্যে কোনোটি ’তাখসিস’-এর আওতাভুক্ত কিনা; অর্থাৎ, সেটি কোনো বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে হওয়ায় অপর দলিলটিতে বিবৃত অধিকতর সার্বিক নীতির সুনির্দিষ্ট ব্যতিক্রম কিনা। ফকীহবৃন্দকে বিভিন্ন রওয়ায়াত (বর্ণনা)-এর শাস্ত্রগত নির্ভরযোগ্যতাও নির্ণয় করতে হতো। তা এই নীতির ভিত্তিতে হতো যে একটি এসনাদ-বিশিষ্ট (আহাদ জাতীয়) বর্ণনাসম্বলিত হাদীসকে আল-কুরআনের যে কোনো আয়াত নাকচ করে দিতে সক্ষম, যেমনিভাবে তা নাকচ করতে সক্ষম অনেকগুলো এসনাদ-বিশিষ্ট কোনো হাদীস (মোতাওয়াতের/মাশহুর জাতীয়)। এই সকল পদ্ধতি প্রয়োগের পরও যদি ফকীহবৃন্দ তাতে সমস্যাটি বিদ্যমান দেখতে পেতেন, তাহলে দুটো দলিলের একটির দ্বারা অপরটি ’নাসখ’ (রহিত) হয়েছে কিনা তার সম্ভাব্যতা তাঁদেরকে যাচাই করে দেখতে হতো।
’নাসখ’-এর এই নীতি এমন একটি উদাহরণ যা দ্বারা প্রতিভাত হয় সুন্নী উলেমাবৃন্দ ‘তায়ারুদ আল-আদিল্লাহ’-এর মতো সূক্ষ্ম ও নাজুক বিষয়গুলোতে কীভাবে শাস্ত্রগত নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে সমাধান খুঁজতেন; আর তাঁদের ওই পদ্ধতি অনেক আগেই বহুবার মহানবী (দ:) কর্তৃক তাঁর হায়াতে জিন্দেগীর সময় স্বীকৃত হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ‘এজমা’ তথা ঐকমত্যের ভিত্তিতে জানতেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রেসালতের প্রথম বছরগুলোতে তিনি যখন তাঁদেরকে শিক্ষা দিচ্ছিলেন এবং তাঁদের যত্ন নিচ্ছিলেন, আর তাঁদেরকে অংশীবাদের বিভ্রান্তি থেকে আল্লাহর একত্ববাদের ঐকান্তিক ও করুণাময় পথে সরিয়ে নিয়ে আসছিলেন, তখন তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা ও বাণী তাঁদের (জাগতিক ও পারলৌকিক) উন্নতির সাথে যেন খাপ খায় ঠিক তেমনি ঐশীভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছিল। এটির সবচেয়ে ভালভাবে জ্ঞাত নজির হলো ধাপে ধাপে মদ নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি, যা প্রথম দিককার একটি কুরআনের আয়াতে অনুৎসাহিত করা হয়; অতঃপর এর নিন্দা করা হয়, এবং সবশেষে নিষিদ্ধ করা হয়। ইসলামের আরও মৌলিক নীতির সাথে সম্পৃক্ত নামাযের বিধানটিও এর আরেকটি উদাহরণ। প্রাথমিক সময়কার উম্মতের প্রতি দৈনিক দুই ওয়াক্ত নামায পড়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মে’রাজ রাতে এই বিধান দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তে উন্নীত করা হয়। মো’তাহ (সাময়িক) বিয়েকেও ইসলামের সূচনালগ্নে অনুমতি দেয়া হয়, কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি, নারীর প্রতি সম্মান বৃদ্ধি ও নৈতিকতার শেকড় অন্তরের গভীরে গেঢ়ে বসার পর তাও পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ করা হয় [এ প্রথা ও মদ্যপানের রেওয়াজ পূর্ববর্তী আরবীয় ঐতিহ্য ছিল - অনুবাদক]। এ রকম আরও অনেক নজির রয়েছে যার অধিকাংশ ঘটনা হিজরতের পরে ঘটেছিল, যখন এই অল্পবয়সী উম্মতের পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে।
’নাসখ’ (রহিতকারী শরয়ী দলিল) দুই প্রকার: ‘সারিহ’ (সুস্পষ্ট) ও ‘দিমনি’ (অন্তর্নিহিত)। পূর্বোক্তটি সহজে বোঝা বা চিহ্নিত করা যায়, কেননা তাতে সংশ্লিষ্ট ছিল এমন শাস্ত্রলিপি যা সুনির্দিষ্টভাবে জ্ঞাত করেছে পূর্ববর্তী কোনো আইনের পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ, কুরআন মজীদে একটি আয়াতে করীমা (২:১৪২) আছে যেটি মুসলমানদেরকে জেরুসালেম থেকে কাবা শরীফের দিকে কেবলা পরিবর্তনের আদেশ করে। হাদীসশাস্ত্রে এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরও ঘন ঘন দেখা যায়; যেমন – ইমাম মুসলিম (রহ:) বর্ণিত একটি হাদীস এরশাদ ফরমায়: “আমি ইতিপূর্বে তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; এখন থেকে যেয়ারত করো!” এই হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দীস উলেমাবৃন্দ বলেন যে ইসলামের সূচনালগ্নে মূর্তি পূজোর স্মৃতি মানুষের মনে তখনো তাজা থাকায় কিছু মুসলমান তাতে বিভ্রান্ত হতে পারেন এমন আশংকা থেকে কবর যেয়ারত নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর একত্ববাদ সংক্রান্ত মুসলমানদের বিশ্বাস সুদৃঢ় হওয়ার পরপরই এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আজ তাই কবরস্থদের জন্যে দোয়া করা এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করার জন্যে কবর যেয়ারত করা মুসলমানদের মাঝে একটি আদিষ্ট প্রথা। [উক্ত হাদীসের আদেশ যখন জারি হয়, তখন মুসলমানদের কবর ছিল না; সবই অমুসলিমদের সমাধি ছিল। মুসলমানবৃন্দ ইন্তেকাল করা আরম্ভ করলে তাঁদের মাযার-রওযা যেয়ারতের আদেশ জারি হয় - অনুবাদক]
’নাসখ’-এর দ্বিতীয় প্রকারটি আরও সূক্ষ্ম এবং এটি অহরহ-ই প্রাথমিক যুগের জ্ঞান বিশারদদের মেধার সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রয়াস বা খাটুনি আদায় করে নিয়েছিল। এতে সম্পৃক্ত ছিল সে সব শাস্ত্রলিপি যা পূর্ববর্তীগুলোকে নাকচ বা ব্যাপকভাবে সংস্কার করেছিল, কিন্তু তার কোনো উল্লেখ বাস্তবে তাতে ছিল না। উলেমাবৃন্দ এর বহু উদাহরণ পেশ করেছেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সূরা বাকারার দুটো আয়াত, যেখানে বিধবা নারীদের ‘ইদ্দত’-এর সময় কোনো সম্পত্তি থেকে কীভাবে ভরণ-পোষণ করা হবে সে সম্পর্কে পৃথক পৃথক আদেশ জারি হয়েছিল (২:২৪০ এবং ২:২৩৪)। আর হাদীসশাস্ত্রে এমন একটি দৃষ্টান্ত আছে যা’তে মহানবী (দ:) তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে বলেছিলেন তিনি অসুস্থতাহেতু বসে বসে নামায পড়লে তাঁরাও যেন তাঁর ইমামতিতে বসে নামায পড়েন। এই হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রহ:) কর্তৃক বর্ণিত। তথাপি আমরা ইমাম মুসলিম (রহ:)-এরই বর্ণিত আরেকটি হাদীসে দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ (দ:) বসে নামায আদায়ের সময় সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) তাঁর ইমামতিতে দাঁড়িয়ে নামায পড়েন। এই স্পষ্ট পরস্পরবিরোধিতা কালানুক্রমিক সযত্ন বিশ্লেষণের দ্বারা সমাধান করা হয়েছে, যা’তে প্রতীয়মান হয় যে শেষোক্ত ঘটনাটি পূর্বোক্ত ঘটনার পরেই ঘটেছিল। আর তাই তা পূর্বোক্ত ঘটনার চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে। মহান উলেমাদের ফেকাহ শাস্ত্রে এটি যথাবিহিত গুরুত্ব সহকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
’নাসখ’ (শরয়ী দলিল রহিতকারী অপর দলিল) চিহ্নিতকরণের কৌশলগুলো উলেমাবৃন্দকে অধিকাংশ স্বীকৃত ‘তায়ারুদ আল-আদিল্লা’ (শরয়ী দলিলসমূহের পরস্পরবিরোধিতা)-এর সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম করে তোলে। এ সব কৌশলের জন্যে প্রয়োজন ছিল কেবল হাদীসশাস্ত্র-সংক্রান্ত পূর্ণ ও বিস্তারিত জ্ঞান-ই নয়, বরং ইতিহাস, রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সীরাহ মোবারক এবং সংশ্লিষ্ট হাদীসের উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও অন্যান্য উলামাদের মতামত-ও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটিমাত্র হাদীসের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্যে মোহাদ্দীস উলামাবৃন্দ সারা ইসলামী দুনিয়া সফর করে বেড়াতেন।
সব ধরনের কৌশল বা পদ্ধতি প্রয়োগের পরও যদি রহিতকরণ প্রমাণ করা না যেতো, তবে সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক ৩ শতকের পুণ্যাত্মাবৃন্দ)-এর জ্ঞান বিশারদগণ আরও অতিরিক্ত পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করতেন। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি ছিল ‘মতন’-এর বিশ্লেষণ (হাদীসের এসনাদের পরিবর্তে মূল বর্ণনা)। ‘সারিহ’ (স্পষ্ট) বক্তব্যকে ইশারা-ইঙ্গিতের (’কেনায়া’) চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হতো; আর ‘মোহকাম’ (সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট) কথাবার্তা অগ্রাধিকার পেতো দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্যের চেয়ে; এই দ্ব্যর্থবোধক শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে ‘মোফাসসর’ (ব্যাখ্যাকৃত), ‘খফি’ (গোপন, অস্পষ্ট) এবং ‘মুশকিল’ (জটিল, সমস্যাসংকুল)। পরস্পরবিরোধী হাদীসগুলোর বর্ণনাকারীদের অবস্থাও বিবেচনা করা হতো, যার দরুণ যে বর্ণনাকারী যতো বেশি বর্ণনার সাথে সরাসরি জড়িত হতেন তিনি ততো-ই অগ্রাধিকার পেতেন। এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো হযরত মায়মুনাহ (রা:) বর্ণিত হাদীসটি, যা বিবৃত করে রাসূলুল্লাহ (দ:) যখন তাঁকে বিয়ে করেন তখন হুযূর পাক (দ:) হজ্জ্বের জন্যে এহরাম বাঁধা অবস্থায় ছিলেন না। যেহেতু তাঁর বিবরণটি ছিল চাক্ষুস সাক্ষ্যের, সেহেতু হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর অনুরূপ নির্ভরযোগ্য এসনাদ-সমৃদ্ধ কিন্তু পরস্পরবিরোধী বর্ণনাটি, যা’তে ব্যক্ত হয়েছিল মহানবী (দ:) ওই সময় হজ্জ্বের ‘এহরাম’ বাঁধা অবস্থায় ছিলেন, তার চেয়ে হযরত মায়মুনা (রা:)-এর সাক্ষ্য অগ্রাধিকার পায়।
এমন আরও অনেক নিয়ম আছে যেগুলো বিবৃত করে অনুমতির চেয়ে নিষেধাজ্ঞা অগ্রাধিকার পাবে। অনুরূপভাবে, পরস্পরবিরোধী হাদীসগুলোর মাঝে ফয়সালা পাওয়া যেতো কোনো সাহাবী (রা:)-এর ফতোওয়াকে সদ্ব্যবহার করে; তবে শর্ত ছিল এই যে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ফতোওয়ারও তুলনা ও মূল্যায়ন করতে হতো। সবশেষে, কেয়াস (তুলনামূলক বিচার-পদ্ধতির মাধ্যমে মুজতাহিদবৃন্দের রায়) প্রয়োগ করা হতো। এ রকম একটি উদাহরণ হলো ‘সালাত আল-কুসুফ’ (সূর্যগ্রহণের নামায)-এর বিভিন্ন বর্ণনা, যা রুকূ ও সেজদার ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যার বিবরণ দিয়েছিল। উলেমাবৃন্দ এ সকল বর্ণনার সতর্ক বিচার-বিশ্লেষণশেষে ওপরে বর্ণিত কোনো পদ্ধতি দ্বারা এর সমাধান বের করতে না পেরে কেয়াস প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই মর্মে, যেহেতু এটিকে ’সালাত’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেহেতু সালাত বা নামাযের নিয়মসিদ্ধ পদ্ধতি-ই অনুসরণ করতে হবে; অর্থাৎ, একবার রুকূ ও দু’বার সেজদা এতে থাকবে। এতদসংক্রান্ত অন্যান্য হাদীস এমতাবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে।
ঐশী শাস্ত্রলিপি থেকে শরীয়তের নিখুঁত আইন-কানুন বের করার ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দলিলের ফয়সালাসূচক এই পদ্ধতির সতর্ক প্রয়োগ মূলতঃ ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এরই অনবদ্য কাজ ছিল। তাঁর সময়কার ফেকাহবিদদের মধ্যকার বিভ্রান্তি ও মতপার্থক্য দেখতে পেয়ে এবং মনুষ্য ত্রুটি-বিচ্যুতির সম্ভাবনা যতোটুকু পারা যায় এড়িয়ে একটি সঙ্গতিপূর্ণ ফেকাহ-পদ্ধতি প্রবর্তনের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি তাঁর চমৎকার ‘রেসালা’ (ইসলামী ফেকাহ-বিষয়ক পুস্তক) রচনা করেন। অন্যান্য প্রধান প্রধান শরয়ী আইনবেত্তাদের দ্বারা  বিভিন্নভাবে তাঁর চিন্তা-ভাবনা সহসা গৃহীত হয়; যার দরুণ আজকে শরীয়তের আনুষ্ঠানিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগুলো মৌলিক বিষয় হয়ে গিয়েছে।
শরয়ী দলিল-আদিল্লার ভাণ্ডার থেকে ইসলামী আইন-কানুন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি কমানোয় ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর এই পদ্ধতি ‘উসূল আল-ফেকাহ’ (ফেকাহর মূলনীতি) নামে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে যায়। ইসলাম ধর্মের অন্যান্য শাস্ত্রের মতোই এটি মন্দ অর্থে নতুন কোনো কিছুর প্রবর্তন (বেদআত) ছিল না, বরং মূলনীতি-ভিত্তিক এমন সমাধান ছিল যা ইতোমধ্যে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সময়ে দেখা গিয়েছিল। কালের পরিক্রমায় সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক প্রতিটি ফেকাহ-ব্যবস্থায় এই মূলনীতির আলোকে নিজস্ব নিয়ম-রীতি চালু করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন শাখার উদ্ভব হয় (অর্থাৎ, আমল পালনের বেলায় একেক মযহাবের নির্দিষ্ট ফতোওয়া)। যদিও এ সব পার্থক্য হতে নিঃসৃত বিতর্ক কখনো কখনো উদ্যমী ছিল, তথাপি ইসলামের প্রথম দুই শতাব্দীতে উদ্ভূত বড় বড় অন্তঃকোন্দল ও আইনী মতপার্থক্য যা ‘উসূল আল-ফেকাহ’ শাস্ত্রের আবির্ভাব দ্বারা পরিসমাপ্ত হয়, তার তুলনায় ওই সমস্ত পার্থক্য তাৎপর্যহীন ছিল।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, যদিও চার মহান মুজতাহিদ ইমাম আবূ হানিফা (রহ:), ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রহ:), ইমাম শাফেয়ী (রহ:) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-কে চার মযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মনে করা হয়, যে চার মযহাব সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞেস করা হলে আমরা সংক্ষেপে বলবো সেগুলো বেদআত তথা নতুন পরিবেশনা এড়ানোর সূক্ষ্ম কৌশল, তথাপি তাঁদের মযহাবগুলো পরবর্তী প্রজন্মের উলেমাদের দ্বারাই কেবল (বর্তমানের আকারে) প্রণালীবদ্ধ হয়। সুন্নী উলেমাবৃন্দ দ্রুত চার মযহাবের ইমামগণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেন এবং ইসলামের তৃতীয় শতকের শেষে আমরা দেখতে পাই যে এই চার মযহাব ছাড়া অন্য কোনো মযহাব অনুসরণ করার মতো কোনো আলেম-ই অবশিষ্ট ছিলেন না। ইমাম বুখারী (রহ:) ও ইমাম মুসলিম (রহ:)-সহ মহান মুহাদ্দীসবৃন্দ কোনো না কোনো মযহাব, বিশেষ করে ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর মযহাবের অনুসারী ছিলেন। তবে প্রতিটি মযহাবের অভ্যন্তরে নেতৃস্থানীয় উলেমাবৃন্দ নিজেদের স্ব স্ব মযহাবের শেকড় ও শাখা-প্রশাখার উন্নয়ন ও সংস্কার সাধনে গবেষণা চালিয়ে যান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পরিস্থিতি শুধু এটি সম্ভবই করে তোলে নি, বরং জরুরিও করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর মযহাব, যেটি কুফা ও বসরার প্রাথমিক যুগের শরয়ী আইন-কানুন বের করার পদ্ধতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটির জ্ঞান বিশারদবৃন্দ ইরাকের উপদলীয় গভীর প্রভাবের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট জালিয়াতির কারণে সে দেশে প্রসার লাভকৃত কিছু কিছু হাদীসের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। তবে পরবর্তীকালে ইমাম বোখারী (রহ;), ইমাম মুসলিম (রহ:) ও অন্যান্যদের হাদীস সংকলনসমূহ সহজলভ্য হওয়ার পর হানাফী উলেমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো নিজেদের মযহাব সম্প্রসারণ ও সংস্কারে এই হাদীস-সমগ্রকে ব্যবহার করেন। এই ধরনের প্রক্রিয়া দুই শতাব্দী ধরে চলে, যতোক্ষণ না হিজরী চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে তা পরিপক্কতার পর্যায়ে পৌঁছে। উপরন্তু, মযহাবগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা এবং সদ্ভাব ওই সময়েই সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়। এই নীতিপ্রণেতা ইমাম গাযযালী (রহ:), যিনি নিজেই শাফেয়ী ফেকাহর চারটি গ্রন্থের রচয়িতা; এ ছাড়াও তিনি ‘আল-মুসতাসফা’ নামের একখানা পুস্তক প্রণয়ন করেন, যেটি ‘উসূলে উসূল আল-ফেকাহ ফীল্ মাযহাব’-এর ওপর সবচেয়ে অগ্রসর ও গবেষণামূলক কাজ হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃতি পেয়েছে।
শরয়ী মূল দলিল-আদিল্লার অপব্যাখ্যাগত বিপদ এড়াতে মুসলমানদের যেমন কোনো স্বীকৃত মযহাবের অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক, ঠিক তেমনি অন্যান্য মযহাবের চেয়ে নিজেদের মযহাবকে স্পষ্টতঃ শ্রেয় বিবেচনা করার ফাঁদে পড়া থেকেও তাঁদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। কিছু তাৎপর্যহীন ব্যতিক্রম বাদে মহান সুন্নী উলেমাবৃন্দ ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর নির্দেশিত মূল্যবোধেরই অনুসরণ করেন; আর তাঁরা একে অপরের মযহাবের প্রতি নজর-কাড়া শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করেন। ইসলামী ঐতিহ্যবাহী উলেমাবৃন্দের দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তি-ই এ ব্যাপারে ওয়াকেফহাল। কতিপয় প্রাচ্যবিশারদের ধারণার ঠিক বিপরীত, ইতিবাচক (কল্যাণকর) আইনের সংস্কার বা সম্প্রসারণের সামর্থ্য এই চার মযহাবের বিবর্তন দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয় নি। পক্ষান্তরে, তাতে এমন সূক্ষ্ম পদ্ধতি বিদ্যমান ছিল যা যোগ্য আলেমদেরকে কেবল কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নিজেদের কর্তৃত্বে আইন-কানুন বের করার অনুমতি-ই দেয় নি, বরং বাস্তবিকপক্ষে তাঁদেরকে তা করতে নীতিগত বাধ্যবাধকতাও দিয়েছিল। (ওই সময়কার) অধিকাংশ ইসলামী জ্ঞান বিশারদের মতে, কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণ জ্ঞান অর্জনকারী ও ইসলামী পাণ্ডিত্যের জন্যে প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত পূরণকারী বিদ্বান-ব্যক্তির পক্ষে নিজ মযহাবের ইতিপূর্বে বহাল সিদ্ধান্ত মানা বা অনুসরণ করার অনুমতি ছিল না; তাঁকে সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকে আইন-কানুন প্রণয়ন করতে হতো। এ ধরনের আলেমবৃন্দ ‘মুজতাহিদ’ নামে পরিচিত, যে শব্দটি হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:)-এর প্রসিদ্ধ হাদীস শরীফ থেকে এসেছে।
কোনো মুসলমানের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ মতের বাইরে গিয়ে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাঁকে অবশ্যই মহা বিদ্বান হতে হবে, এ কথা খুব কম মানুষই সিরিয়াসভাবে অস্বীকার করবে। স্বল্পশিক্ষিত ও অযোগ্য লোকদের দ্বারা শরীয়তের মূল উৎসকে ভুল বোঝার এবং ফলশ্রুতিতে শরীয়তের ক্ষতি সাধনের বিপদ একদম বাস্তব, যে পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল চার মযহাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ববর্তী সময়কালে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের জীবনকে, এমন কি কতিপয় সাহাবী (রা:)-এর জীবনকে আক্রান্তকারী বিভক্তি ও দ্বন্দ্বের কারণে। প্রাক ইসলামী জমানায় শাস্ত্রলিপিগত পাণ্ডিত্য-ঘাটতির দরুণ গোটা ধর্মসমূহ বিশ্বাসের দুর্বলতাজনিত ধ্বংসের মুখে পড়েছিল; আর তাই এটি অপরিহার্য হয়েছিল দ্বীন ইসলামকে (অনুরূপ) তুলনীয় কোনো পরিণতি থেকে সুরক্ষা করা। বেদআত ও বিকৃতির বিপদ থেকে একে রক্ষাকল্পে ‘উসূল’-এর মহান উলেমাবৃন্দ অতঃপর কঠিন শর্তাবলী আরোপ করেন, যা এজতেহাদের দাবিদার যে কাউকে অবশ্যঅবশ্যই পূরণ করতে হতো। এ সকল শর্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল:
(ক) আরবী ভাষায় পাণ্ডিত্য, যাতে কেবল ভাষাগত দিক থেকে শরয়ী অপব্যাখ্যার সম্ভাবনা কমানো যায়;
(খ) কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান এবং প্রতিটি আয়াত ও হাদীস প্রকাশ হবার প্রেক্ষিত/পটভূমি, আর সেই সাথে কুরআনের তাফসীর ও হাদীসের শরাহগুলোর সামগ্রিক জ্ঞান, এবং ওপরে আলোচিত সমস্ত ব্যাখ্যা-পদ্ধতি/কৌশল রপ্তকরণ;
(গ) হাদীসশাস্ত্রের বিশেষায়িত জ্ঞান, যেমন বর্ণনাকারীদের মূল্যায়ন ও ’মতন’ (মূল পাঠ/লিপি);
(ঘ)  সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), তাঁদের অনুসারী ও মহান ইমামবৃন্দের এতদসংক্রান্ত মতামত এবং ফেকাহশাস্ত্রের বইপুস্তকে গৃহীত অবস্থান ও এর পক্ষে যুক্তি, পাশাপাশি কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ’এজমা’ (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারও জ্ঞান;
(ঙ) ‘কেয়াস’ এবং এর বিভিন্ন ধরন ও শর্তাবলী সংক্রান্ত জ্ঞান;
(চ) নিজের সমাজ ও জনস্বার্থ (’মাসলাহাহ’)-বিষয়ক জ্ঞান;
(ছ) শরীয়তের সার্বিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (’মাকাসিদ’) সম্পর্কে জ্ঞান; এবং
(জ) তীক্ষ্ণ মেধা ও ব্যক্তিগত (আত্মিক) পবিত্রতা অর্জন, এবং এর পাশাপাশি করুণা, সৌজন্যবোধ ও বিনয়ের সমন্বয় সাধন।
উপরোক্ত শর্তাবলী যে আলেম পূরণ করতে পেরেছেন তাঁকে ‘মোজতাহিদ ফীল্ শার’ বিবেচনা করা যাবে; আর তিনি অস্তিত্বশীল ও প্রতিষ্ঠিত কোনো মযহাবের অনুসরণে বাধ্য নন, এমন কি অনুমতিপ্রাপ্তও নন। এ কথাই কতিপয় ইমাম সাহেব তাঁদের মহান শিষ্যদের বলেছিলেন, যখন তাঁরা শিষ্যদেরকে তাঁদের ‘তাকলিদ’ (প্রশ্নাতীত অনুসরণ) মানতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু যে বৃহত্তর সংখ্যক আলেমবৃন্দের এ রকম চোখ-ধাঁধানো শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না, তাঁদের পক্ষে ’মোজতাহিদ ফীল মাযহাব’ হওয়া সম্ভব ছিল; অর্থাৎ, তাঁরা সামগ্রিকভাবে নিজেদের মযহাবের রীতি-নীতি মেনে চলতেন, তবে নিজেদের মযহাবের অভ্যন্তরে প্রাপ্ত মতামতের সাথে দ্বিমত পোষণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন তাঁরা। এ স্তরের মোজতাহিদদের নমুনা হলেন শাফেয়ী মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ইমাম নববী (রহ:), মালেকী মযহাবের কাজী ইবনে আব্দিল বারর (রহ:),  হানাফী মযহাবের ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (রহ:) এবং হাম্বলী মযহাবের ইমাম ইবনে কুদামা (রহ:)। এই আলেমদের সবাই নিজ নিজ মযহাবের ব্যাখ্যামূলক মৌলনীতির অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে বিবেচনা করতেন; তথাপি তাঁরা নিজেদের সহজাত গুণ পাণ্ডিত্য ও সুবিবেচনা দ্বারা নিজ নিজ মযহাবের অভ্যন্তরে অনেক নতুন সিদ্ধান্ত প্রদানের নজির স্থাপন করেছিলেন। এই বিশেষজ্ঞদের প্রতি-ই মোজতাহিদ ইমামবৃন্দ এজতেহাদ সংক্রান্ত (উপরোক্ত) নির্দেশ দিয়েছিলেন; যেমন – ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর নির্দেশ এই মর্মে ছিল যে, যদি তোমরা আমার সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কোনো হাদীস পাও, তাহলে তার অনুসরণ করবে। এটি স্পষ্ট যে আজকে কিছু লেখক যেভাবে ধারণা করে নিয়েছে তার ঠিক উল্টো, ইসলামী (উচ্চ) শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এমন সর্বসাধারণের জন্যে এই সব পরামর্শ কখনোই উদ্দেশ্য করা হয় নি।
মোজতাহিদদের অন্যান্য শ্রেণীর তালিকা উসূলের উলেমাবৃন্দ লিপিবদ্ধ করেছেন; তবে তাঁদের মধ্যকার পার্থক্য সূক্ষ্ম এবং তা আমাদের এই প্রতিপাদ্যের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। অবশিষ্ট শ্রেণীগুলোকে ব্যবহারিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়: প্রথমতঃ ‘মোত্তাবী’ (অনুসারী) ‍যিনি নিজের মযহাবের অনুসরণ করেন কুরআন ও হাদীসশাস্ত্র সম্পর্কে এবং নিজ মযহাবের সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি সম্পর্কে ভালভাবে জেনে; আর দ্বিতীয়তঃ ‘মোকাল্লিদ’ (অনুকরণ/মান্যকারী) ‍যিনি নিজের মযহাবের ইমামগণের প্রতি আস্থা রেখে মযহাবের আনুগত্য করেন, এবং এ ক্ষেত্রে মযহাবের সহস্র সহস্র সিদ্ধান্তের দলিল বা যুক্তি জানার কোনো বাধ্যবাধকতা তাঁর নেই।
কোনো মোকাল্লিদের জন্যে নিজ মযহাবের প্রামাণ্য দলিলপত্র যতোটুকু সম্ভব শিক্ষা করার পক্ষে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টিও স্পষ্ট যে প্রত্যেক মুসলমান-ব্যক্তি আলেম (ইসলামী জ্ঞান বিশারদ) হতে পারেন না। ইসলামী জ্ঞানে বিদ্বান হতে হলে অনেক সময়ের প্রয়োজন, আর উম্মতে মোহাম্মদীর যথাযথ অগ্রগতি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের খাতিরে অধিকাংশ মানুষের জন্যে অন্যান্য কর্মসংস্থান একান্ত আবশ্যক: যথা – হিসেব রক্ষক, সৈন্য, কসাই ইত্যাদি। এমতাবস্থায় তাঁরা মহান উলামা-এ-কেরাম হবেন এমনটি প্রত্যাশা করাও অবান্তর, এমন কি যদি আমরা ধরেও নেই যে তাঁদের সবার এই বিদ্যাচর্চার জন্যে প্রয়োজনীয় মেধা বিদ্যমান। পবিত্র কুরআন মজীদ স্বয়ং বিবৃত করে যে অপেক্ষাকৃত স্বল্প অবহিত ঈমানদারগণের পক্ষে যোগ্য বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত; এরশাদ হয়েছে, “তোমরা না জানলে ‘আহলে যিকর’-বৃন্দের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে শেখো” (১৬:৪৩)। [তাফসীর বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আহলে যিকর’ বা যিকিরের মানুষ হলেন উলেমাবৃন্দ] অপর এক আয়াতে মুসলমানদেরকে আদেশ করা হয়েছে যেন তাঁরা (নিজেদের মধ্যে) এমন এক বিশেষজ্ঞ দল গড়ে তোলেন যাঁরা অ-বিশেষজ্ঞদেরকে হেদায়াত তথা সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দানের কর্তৃত্বভার বহন করতে সক্ষম। এরশাদ হয়েছে, “অতএব, কেন এমন হলো না যে তাদের প্রত্যেক দল থেকে একটি দল বের হতো, যাঁরা ধর্মের জ্ঞান অর্জন করতেন এবং ফিরে এসে নিজ নিজ সম্প্রদায়কে সতর্ক করতেন এ আশায় যে তারা সতর্ক হবে” (৯:১২২, বাংলা ‘তাফসীরে কানযুল ঈমান’)। কুরআন ও সুন্নাহকে সঠিকভাবে বুঝতে যে সুগভীর পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন এবং শরয়ী দলিলপত্রের বিকৃতি সাধনের ব্যাপারে যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটি নিশ্চিত যে মুসলমান সর্বসাধারণের পক্ষে নিজেদের বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তি এবং সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ওপর নির্ভর না করে বিশেষজ্ঞ মতের অনুসরণ করা অবশ্য কর্তব্য। এই দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কাছে সুপরিচিত ছিল: খলীফা উমর ফারুক (রা:) হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা:)-এর কিছু সুনির্দিষ্ট ফতোওয়া মেনে চলতেন এ কথা বলে, ‘তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করার ব্যাপারে আমি আল্লাহর দরবারে শরমিন্দা।’ আর হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) পূর্ণ অর্থে মোজতাহিদ হওয়া সত্ত্বেও হযরত উমর (রা:)-এর কতিপয় সুনির্দিষ্ট ফতোওয়া মেনে চলতেন। আল-শাবী (রহ:)-এর ভাষ্যমতে, মহানবী (দ:)-এর ছয়জন সাহাবী (রা:) মানুষের উদ্দেশ্যে ফতোওয়া জারি করতেন। এঁরা হলেন সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (রা:), উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা:), আলী (ক:), যায়দ ইবনে সাবেত (রা:), উবাই ইবনে কা’আব (রা:) ও আবূ মূসা আল-আশআরী (রা:)। উপরন্তু, এঁদের মধ্যে তিনজন অপর তিনজনের মোকাবেলায় নিজেদের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিতেন: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) হযরত উমর (রা:)-এর সিদ্ধান্ত পেলে নিজের সিদ্ধান্ত বাদ দিতেন; হযরত আবূ মূসা (রা:) তাঁর সিদ্ধান্ত বাতিল করতেন হযরত আলী (ক:)-এর সিদ্ধান্ত জানামাত্র-ই; আর হযরত উবাই ইবনে কা’আব (রা:)-এর সিদ্ধান্তের মোকাবেলায় হযরত যায়দ (রা:) নিজের সিদ্ধান্ত বাদ দিতেন।
সুন্নাহের অনুসরণে হেদায়াত পাওয়ার জন্যে স্ব-সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর না করে মযহাবের কোনো মহান ইমামের তাবেদারি করার যে নির্দেশনা রয়েছে, তা বৃটেনের মতো (আজমী তথা অনারব) দেশগুলোর মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্যে বাধ্যতামূলক; কেননা, সেখানে তাঁদের মধ্যে খুব স্বল্প শতাংশেরই এ বিষয়ে পছন্দ-অপছন্দের অধিকার রয়েছে। এটি এই বোধগম্য কারণে যে, আরবী না জানা একজন ব্যক্তির পক্ষে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে সমস্ত হাদীস পড়ার ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব নয়। বিভিন্ন কারণে দশটির বেশি হাদীস সংকলনের বিশাল সম্ভার ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় নি। আরও তিন শতাধিক হাদীস-সমগ্র অবশিষ্ট রয়েছে, যা’তে অন্তর্ভুক্ত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর ‘মুসনাদ’, ইমাম ইবনে শায়বা (রহ:)-এর ‘মোসান্নাফ’, ইমাম ইবনে খোযায়মা (রহ:)-এর ’সহীহ’, আল-হাকিম (রহ:)-এর ‘মোস্তাদরাক’ এবং অনেক বহু-খণ্ডবিশিষ্ট সংকলন, যেগুলো পরবর্তী গবেষণার ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ; এ সকল বইপত্রে বৃহৎ সংখ্যক সহীহ (বিশুদ্ধ) হাদীস বিদ্যমান, যেগুলো এ যাবত ইংরেজিতে ভাষান্তরিত বোখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসের বইতে নেই। আমরা যদি ধরেও নেই যে বিদ্যমান অনুবাদগুলো একদম যথাযথ, তবুও আরবী ভাষা না জেনে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি শরয়ী আইন-কানুন বের করার চেষ্টা একেবারেই অসম্ভব। শুধু অনূদিত হাদীসগুলোর আলোকে শরীয়তকে দেখার চেষ্টা করা সুন্নাহ’র বেশির ভাগ অংশকে অবহেলা ও বাদ দেয়ার-ই শামিল, যার ফলশ্রুতিতে মারাত্মক বিকৃতি দেখা দেবে।
আমি শুধু এর দুটো উদাহরণ দেবো। সুন্নী মযহাবগুলো আইনী বিষয়াবলী প্রয়োগের নিয়ম হিসেবে শর্তারোপ করেছে যে ‘হুদুদ’ (শরয়ী শাস্তি) সে সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না যেখানে ন্যূনতম দ্ব্যর্থবোধকতা বা অস্পষ্টতা বিরাজ করছে; আর কাজী তথা বিচারকদেরকে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করতে হবে এ কথা প্রমাণের জন্যে যে ওই ধরনের দ্ব্যর্থবোধকতা বা অস্পষ্টতা অস্তিত্বশীল। আনাড়িভাবে একবার  সিহাহ সিত্তা (৬টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ) পড়ে নিলে এর পক্ষে কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যাবে না। অথচ মযহাবের এই সিদ্ধান্ত এমন এক হাদীসের ওপর ভিত্তি করে নেয়া, যা সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং যা লিপিবদ্ধ আছে ইমাম ইবনে আবি শায়বা (রহ:)-এর ‘মোসান্নাফ’ গ্রন্থে, আল-হারিসী (রহ:)-এর ‘মোসনাদ’ পুস্তকে, আরও আছে মোসাদ্দাদ ইবনে মোসারহাদ (রহ:)-এর ‘মোসনাদ’ কেতাবে। হাদীসটিতে এরশাদ হয়েছে: “দ্ব্যর্থবোধকতা (অস্পষ্টতা)-এর দ্বারা ‘হুদুদ’ (শাস্তি) লাঘব/অপসারণ করো।” ইমাম আস্ সানানী (রহ:) নিজ ‘আল-এনসাব’ পুস্তকে এই হাদীসের প্রেক্ষিত বর্ণনা করেন, ”এক ব্যক্তিকে মদ্যপ অবস্থায় হযরত উমর (রা:)-এর কাছে (বিচারের জন্যে) আনা হয়। তিনি ‘হদ্দ’ (শাস্তি) হিসেবে ৮০টি দোররা মারার হুকুম দেন। যখন এই শাস্তি প্রয়োগ করা হয়, তখন ওই ব্যক্তি বলেন, ‘হে উমর (রা:)! আপনি আমার প্রতি অন্যায় করেছেন, কেননা আমি একজন গোলাম! [গোলামদের ক্ষেত্রে শাস্তি অর্ধেকমাত্র] এই কথা শুনে খলীফা উমর (রা:) বেদনার্ত হন এবং তিনি পাঠ করেন মহানবী (দ:)-এর উপরোক্ত হাদীস – “দ্ব্যর্থবোধকতা (বা অস্পষ্টতা) দ্বারা ’হুদুদ’ (শাস্তি) দূর করো।” মযহাবগুলোর অপর যে গুরুত্বপূর্ণ প্রথা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যায় তা হলো, মাগরেবের ফরয নামাযশেষে সুন্নাত নামায যতো শিগগির সম্ভব পড়ে নেয়া; হাদীসটি এরশাদ ফরমায়: “মাগরেব নামাযের পরে দুই রাকাত সুন্নাত নামায দ্রুত আদায় করো, কেননা তা ফরয নামাযের সাথে আসমানে (বেহেশ্তে) তুলে নেয়া হয়।” এই হাদীসটি ইমাম রাযিন (রহ:) তাঁর ‘জামে’ কেতাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
ইসলামী আইনের বিকৃতি সাধনের আশংকাজনিত ঐতিহ্যবাহী পরহেযগারীর কারণে অতীত যুগের মহান উলেমাবৃন্দের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ, যাঁরা নিঃসন্দেহে নিরানব্বই শতাংশেরও বেশি, তাঁরা মযহাবগুলোর একনিষ্ঠ আনুগত্য করেছেন। এ কথা সত্য যে সমস্যাজর্জরিত চৌদ্দ শতকে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়েম আল-জাওযিয়্যার মতো হাতে গোনা কতিপয় ভিন্ন মতাবলম্বীর আবির্ভাব ঘটেছিল; কিন্তু এমন কি এই লোকেরাও বলে নি যে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ/সহায়তা ছাড়া অর্ধ-শিক্ষিত মুসলমানদের এজতেহাদ (গবেষণালব্ধ ইসলামী সিদ্ধান্ত) প্রয়োগ করা উচিত। এই লেখকদেরকে সাম্প্রতিককালে কবর থেকে পুনরুত্থিত করে বড় করে দেখানো হলেও ঐতিহ্যমণ্ডিত ইসলামী শাস্ত্রের ওপর পাণ্ডিত্যে তাদের প্রভাব একেবারেই নগণ্য, যা পরিস্ফুট হয়েছে ইসলামী বিশ্বের বড় বড় পাঠাগারে রক্ষিত তাদের রচনাবলীর ক্ষুদ্র সংখ্যা দ্বারা। তথাপি গত শতাব্দীতে সামাজিক টালমাটাল পরিস্থিতি এমন কিছু সংখ্যক লেখককে দৃশ্যপটে নিয়ে আসে যারা ইসলামের ঐতিহ্যবাহী পাণ্ডিত্যকে বর্জনের পক্ষাবলম্বন করেছে। এই ধারার পক্ষীয়দের মধ্যে বেশি পরিচিতি পায় মোহাম্মদ আবদুহু ও রশীদ রেযা।
এই সব (ভিন্ন চিন্তাধারার) লোকেরা পশ্চিমা বিশ্বের সাফল্যে চোখ ধেঁধে গিয়ে এবং ফ্রী-ম্যাসন তথা ইসলামের অন্তর্ঘাতী গোষ্ঠীর প্রতি নিজস্ব দলিল-প্রমাণভিত্তিক অঙ্গীকারবদ্ধতা দ্বারা সূক্ষ্ম পন্থায় (পরিস্থিতি সম্পর্কে) অবহিত হয়ে মুসলমানদেরকে ‘তাকলিদ’ (মযহাব অনুসরণ) বর্জন ও চার মযহাবের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করার তাকিদ দিয়েছিল। আজকে কিছু কিছু আরব দেশের রাজধানীতে, বিশেষ করে যেখানে আদি ঐতিহ্যবাহী সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক জ্ঞানচর্চা দুর্বল হয়ে পড়েছে, সে সব স্থানে সাধারণতঃ দেখা যায় আরবীয় তরুণরা হাদীসের সমস্ত সংকলন সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে আসছে এবং স্পষ্টতঃ সেগুলো পড়ছে এই ধারণা নিয়ে যে ইমাম শাফেয়ী (রহ:), ইমাম আহমদ (রহ:) ও অন্যান্য ইমামদের চেয়ে এই বিশাল ও জটিল হাদীসশাস্ত্র অপব্যাখ্যা করার সম্ভাবনা তাদের ক্ষেত্রে অনেক কম। যদিও এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মনোভাব এখনো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে নি, তবুও এ কথা সহজে বোধগম্য যে তা (মূল ইসলামে) ভিন্ন চিন্তাধারা প্রবেশের দ্বার উম্মুক্ত করেছে, যা ইসলাম ধর্মের ঐক্য, বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতার মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে; উপরন্তু তা সহস্রাধিক বছর আগে মহান ইমামবৃন্দের দ্বারা মীমাংসিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কেও তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। বর্তমানে এ দৃশ্য সাধারণতঃ দেখা যায়, তরুণ (লা-মযহাবী) কর্মীরা বিভিন্ন মসজিদে হানা দিয়ে নিজেদের ধারণামতে অন্যান্য মুসুল্লীদের এবাদত-বন্দেগীতে কৃত ‘ভুল-ত্রুটির’ তীব্র সমালোচনা করছে, যদিও এই ক্ষেত্রে আক্রান্ত মুসুল্লীবর্গ ইসলামের মহান ইমামবৃন্দের কয়েকজনের ফয়সালা-ই অনুসরণ করছেন। এই অপ্রীতিকর পরিবেশ ও ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণের ফলে অনেক সাধারণ মুসলমান মসজিদে যেতে একেবারেই নিরুৎসাহিত বোধ করবেন। কেউই আর এখন সামনে তুলে ধরে না প্রাথমিক যুগের উলামাবৃন্দের মতামত, যা ব্যক্ত করে যে মুসলমানগণ সুন্নাহের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার প্রতি ততোক্ষণ-ই সহিষ্ণু হতে পারবেন যতোক্ষণ তা প্রসিদ্ধ ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণ কর্তৃক সমর্থিত হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:) বলেন, “যদি তোমরা কাউকে দেখতে পাও এমন কোনো কাজ করছে যা নিয়ে উলামা-এ-কেরামের মধ্যে মতপার্থক্য বিরাজমান, আর তোমরাও বিশ্বাস করো যে তা নিষিদ্ধ, তবে তাকে ওই কাজে নিষেধ করবে না।” এই নীতির বিকল্প পন্থা অবশ্যই অনৈক্য ও ফিতনা-ফাসাদের জন্ম দেবে, যা মুসলমান সমাজকে ভেতর থেকে ধ্বংস করবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবিত বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে, যেখানে শৈশবকালের শুরুতেই মানুষদেরকে নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করার ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে চ্যালেন্জ করার জন্যে তাকিদ দেয়া হয়, সেখানে নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করার মতো পর্যাপ্ত বিনয় প্রদর্শন করাও কখনো কখনো দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সবাই কিছুটুকু ফেরাউনেরই মতো; প্রকৃতিগতভাবে আমাদের অহংবোধ এই ধারণার বশবর্তী যে, আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বা জ্ঞানী আর কেউই হতে পারে না। সাধারণ মুসলমানগণ, এমন কি তাঁরা আরবী জানলেও, সরাসরি নিজে নিজে শরয়ী আইন-কানুন বের করার ক্ষেত্রে তাঁদের যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ার ধারণাটি ইমামবৃন্দের চেয়ে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনার-ই লাগামহীন বহিঃপ্রকাশ। নিজেদের বিচার-বুদ্ধির ব্যাপারে গর্বিত তরুণ প্রজন্ম, যারা শরয়ী জ্ঞানের উৎসের জটিল বিষয়গুলোর সাথে এবং প্রকৃত পাণ্ডিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের সাথে পরিচিত নয়, তাদের জন্যে পাতা এটি একটি কার্যকর ফাঁদবিশেষ, যা তাদেরকে সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে গভীর বিভক্তি উস্কে দেয়ার অনিচ্ছাকৃত পরিকল্পনাকারীতে পরিণত করবে। ইসলাম ধর্মের মুহাদ্দীসবৃন্দসহ সকল মহান আলেম-উলেমা যে চার মযহাবের অন্তর্গত ছিলেন, আর তাঁদের শিষ্যদের জন্যেও চার মযহাবের অনুসরণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছিলেন, এই বাস্তবতা মনে হয় বিস্মৃত হয়েছে। সাধারণ উপলব্ধি-জ্ঞান (common sense) ও ইসলামের প্রতি দায়িত্বের চেয়ে নিজের সম্পর্কে উত্তম ধারণাকে এখানে অধিক প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
পবিত্র কুরআন মজীদ মুসলমানদেরকে তাঁদের মেধা ও চিন্তাশীলতার সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়; আর যোগ্যতাসম্পন্ন ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের অনুসরণ করার বিষয়টি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে এই সৎগুণকে সযত্নে কাজে লাগাতে হবে। মৌলিক যে বিষয়টির মূল্যায়ন করতে হবে তা হলো, উসূলে ফেকাহ ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এমন যে কোনো বিশেষায়িত জ্ঞানের শাখার মধ্যে কোনো স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান নেই। শায়খ সাঈদ রমাদান আল-বুতী’, যিনি নিজের প্রণীত ‘লা-মযহাবী মতবাদ: ইসলামী শরীয়ার প্রতি হুমকিস্বরূপ সর্ববৃহৎ বেদআত’ পুস্তকে মযহাব-বিরোধী ধারার সুন্নাহ-ভিত্তিক প্রত্যুত্তর দিয়েছেন, তিনি শরয়ী আইন-কানুন বের করার জ্ঞানের (ফেকাহর) শাখাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের সাথে তুলনা দিতে পছন্দ করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, “কারো শিশু অসুস্থ হলে তিনি কি রোগ নির্ণয় ও আরোগ্যের জন্যে নিজেই চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ্যবই খুলে দেখবেন? নাকি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?” বিবেক-বুদ্ধি স্পষ্টভাবে শেষোক্ত সিদ্ধান্তটি-ই নেবে। আর ধর্মীয় বিষয়েও একই রীতি/পদ্ধতি বহাল থাকবে, যে বিষয়টি বাস্তবে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকির সম্ভাবনাময়। আমাদের দ্বারা নিজে নিজে দলিলপত্র খোঁজার চেষ্টা করা এবং ফলশ্রুতিতে নিজেদের মুফতী নিজেরাই বনে বসা মারাত্মক বোকামি ও দায়িত্বহীনতাও। বরঞ্চ আমাদের উচিত এ সত্যটি অনুধাবন করা যে সারা জীবন যাঁরা সুন্নাহ ও শরয়ী আইনের নীতিমালা অধ্যয়ন করেছেন, তাঁদের পক্ষে আমাদের মতো ভুল-ভ্রান্তি করার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কম।
জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে আরেকটি উপমা এখানে দেয়া যায়। আমরা কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহকে তারকা/নক্ষত্রের সাথে তুলনা করতে পারি। খালি চোখে আমরা ওর অনেকগুলোকে দেখতে সক্ষম নই; তাই আমাদের প্রয়োজন দূরবিনের। আমরা যদি বেওকুফ অথবা অহংকারী হই, তবে নিজেরা তা (দূরবিন) বানাতে চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু আমরা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন এবং বিনয়ী হলে ইমাম শাফেয়ী (রহ:) বা ইমাম ইবনে হাম্বল (রহ:) প্রমুখ ইমামবৃন্দের দ্বারা আমাদের জন্যে তৈরিকৃত ’দূরবিন’ যন্ত্রই কেবল আমরা ব্যবহার করবো; যে যন্ত্রটি মহা ’জ্যোতির্বিজ্ঞানী’-রূপী পরবর্তী যুগের উলেমাদের প্রজন্মসমূহ দ্বারা সংস্কৃত, পরিমার্জিত ও উন্নত হয়েছে। সার কথা হলো, মযহাব একখানা সূক্ষ্ম যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়, যা দ্বারা আমরা ইসলামকে সম্ভাব্য সর্বাপেক্ষা স্বচ্ছতাসহ দেখতে সক্ষম হই। আমরা যদি আমাদের নিজেদের তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি, তাহলে আমাদের আনাড়ি চেষ্টাগুলো অনিবার্যভাবে আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে খর্ব করবে।
তৃতীয় নমুনাও এখানে দেয়া যেতে পারে। কোনো জীর্ণ-শীর্ণ উপাসনালয়, যেমন ইস্তাম্বুলের ‘নীল মসজিদ’ (Blue Mosque)-কে সেখানে নামায আদায়কারীদের কারো কারো কাছে হয়তো অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ মনে হতে পারে। উৎসাহী তরুণরা যাদের অন্তরে এই ইমারতকে আরও সুন্দর ও সুনির্মাণ (এবং নিঃসন্দেহে নিজেদের সময়বদ্ধ পছন্দের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ) করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তারা হয়তো ইমারতের নিচে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ কক্ষে (crypts and basement) প্রবেশ করে স্থাপত্যকৌশলের নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী ওপরের ইমারত যে ভিত্তিপ্রস্তর ও স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাকে পুনর্বিন্যাস করলো। তারা কিন্তু পেশাদার স্থপতিদের পরামর্শ নিলো না, শুধু একজন বা দুইজন ছাড়া – যাদের কথাবার্তা তাদের মনে ধরেছিল (ইবনে তাইমিয়া/ইবনে আবদিল ওয়াহহাব); শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যাঁরা এই ইমারতকে রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন, তাঁদের বইপত্র ও স্মৃতিকথার ধার তরুণেরা ধারলো না। তাদের উদ্দীপনা ও অহংকারের কাছে ওই সময় কোথায়? ভূগর্ভস্থ কক্ষের আঁধারে হাতিয়ে হাতিয়ে তারা নিজেদের সাথে আনা শাবল ও ড্রিল মেশিন দ্বারা স্বভাবজাত উৎসাহ নিয়ে কাজে নেমে পড়লো।
সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক ইসলামের প্রতি অনুরূপ এক আচরণের বিপদ এখন দেখা দিয়েছে। এই ইমারত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এর শত্রুদের তীব্র আঘাত সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু অন্তর্ঘাত দ্বারাই একে দুর্বল করা সম্ভব। ইসলামের অনেক বুদ্ধিমান শত্রু আছে এবং তারা এই বিষয়টি ভালভাবে জানে। প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের উত্তম পরহেযগারী সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যকার বিভক্তি এবং চার মযহাবের মহান ইমামবৃন্দের দ্বারা শরীয়তের চূড়ান্ত সংকলনের পরে সুন্নী মতাদর্শের সুষম ও অবিভক্ত রূপ নিশ্চয় বৈরী মস্তিষ্কগুলোতে চক্রান্তের বীজ বপণ করেছিল। এই বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, মহান মযহাবগুলোকে যারা আক্রমণ করে তারা ইসলামের শত্রুদের সচেতন ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু এতে এইটুকু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে কেন তারা এতো ভাল প্রচার-প্রপাগান্ডা ও মোটা তহবিল পেয়ে চলেছে, অপর পক্ষে সুন্নাহভিত্তিক মৌলিক আদর্শটি তা থেকে অভুক্ত রয়েছে। প্রত্যেক মুসলমান অহংকারী ‘মুজতাহিদ’-এ পরিণত হওয়ায় এবং ‘তাকলিদ’-কে বিনম্র ও প্রয়োজনীয় গুণের পরিবর্তে পাপ হিসেবে বর্জন করায় আমাদের প্রাথমিক যুগের হৃদয়বিদারক ভিন্ন মতগুলো আবারো নিশ্চয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। মিলে-মিশে অবস্থানকারী চার মযহাবের পরিবর্তে তিক্ত ও হামসাঁচ্চাই-জনিত বিভেদের কোটি খানেক মযহাবের আবির্ভাব ঘটবে। ইসলাম ধর্ম ধ্বংসের জন্যে এর চেয়ে অতিশয় চতুর ষড়যন্ত্র আর কখনোই পরিকল্পনা করা হয় নি।
[এই প্রভাষণটি আগস্ট ১৯৯৫ সালে এইলসবারী মসজিদে প্রদান করা হয়। এটি Islamica ম্যাগাজিনে ১৯৯৫ সালে পুনঃমুদ্রিত হয়।]

No comments:

Post a Comment