লেখক: মরহূম হাফিজ মওলানা মঈনুল ইসলাম
সম্পাদনা: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বসৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী। সৃষ্টির আদিতে তাঁরই পবিত্র সত্তায় নবূয়্যতের সূচনা এবং তাঁরই পবিত্র সত্তায় সেটার পরিসমাপ্তি। এ অর্থে তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশ্য এবং তিনিই প্রচ্ছন্ন। হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) তাঁর উম্মত হিসেবে কিয়ামতের পূর্বে আবির্ভূত হবেন, নবী হিসেবে নন। এ জন্যেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম) এ পার্থিব জগতে জীবিত থাকতেন, তাহলে আমার অনুসরণ ব্যতিরেকে তাঁর কোনো গত্যন্তর ছিলো না” [আল-হাদীস]। নবুয়্যত ও রিসালাতের ক্রমধারার পরিসমাপ্তি ঘটলেও বেলায়াতের দ্বার রুদ্ধ হয়নি। এ কারণেই যুগে যুগে আল্লাহর আউলিয়ায়ে কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) আল্লাহর বান্দাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকীম তথা (ঐশী) সহজ-সরল রাস্তায় প্রতিষ্ঠিত রাখবার মহৎ উদ্দেশ্যে এ ধরাধামে আগমন করে থাকেন। তাঁরা আম্বিয়া-ই-কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁদের প্রচারিত ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে থাকেন এবং কুসংস্কারমুক্ত করে খাঁটি ধর্মের স্বরূপ জগদ্বাসীর সামনে তুলে ধরেন; আর ধর্মীয় আলোড়নের মাধ্যমে নবজাগরণের সৃষ্টি করেন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রতিটি শতাব্দীতে একজন মুজাদ্দেদ তথা ধর্ম-সংস্কারক আগমন করবেন, যিনি ধর্মকে কুসংস্কারমুক্ত করে নবজীবন দান করবেন” [আল-হাদীস]। মনুষ্যকুলের আদি পিতা হযরত আদম (আলাইহিস্ সালাম) হতে হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) পর্যন্ত বহু নবী এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। তাঁদের প্রচারিত ধর্ম হচ্ছে দ্বীন-ইসলাম। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা চিরন্তন ও আদি এবং এটা পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হয়েছে নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে। পবিত্র কুর’আনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” এই ঘোষণার মাধ্যমে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রচারিত ও প্রবর্তিত দ্বীন পূর্ণাঙ্গ ইসলাম, যা আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের ধারক ও বাহক আল্লাহর আউলিয়ায়ে কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-ও আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুগ্রহ ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত। শ্রেষ্ঠ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বদৌলতে তাঁরাও শ্রেষ্ঠ। এ জন্যেই কালামে পাকে (ঐশীবাণীতে) তাঁদের শানে একাধিকবার অভয়বাণী উচ্চারিত হয়েছে। তাঁরাই মহিমাময়ের মহিমার বিকাশ বা প্রকাশস্থল; (আল্লাহর) প্রিয়ভাজন বান্দা; সৃষ্টিজগতের জন্যে ঐশী করুণা ও কল্যাণ; নিপীড়িত মানবতার মুক্তিদাতা; সত্য ও ন্যায়ের দিশারী; সর্বোপরি, সৃষ্টিকুলের কৃতজ্ঞতাভাজন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস অতি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ ভারতের রাজা পেরুমল প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র হাতে ইসলামের বাইআত গ্রহণ করেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ভারতের কালিকট, সুরাট মালাবার, গুজরাট, কচ্ছ প্রদেশ (বর্তমানে জেলা), সিন্ধু, মুলতান, বেলুচিস্তান এমন কী বঙ্গের সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইসলামের আলো পৌঁছে গিয়েছিলো।
বিগত ৭১২ খ্রীষ্টাব্দ সালে মুহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতের মুসলিম শাসনের ভিত্তিস্থাপন করেন। তিন বছর পর খলীফার নির্দেশক্রমে তিনি দামেস্কে ফিরে যান। তাঁর সঙ্গী-সাথীবৃন্দের মধ্যে হাজারেরও অধিক এবং ত্রিশ হাজারেরও অধিক ভারতীয় নও-মুসলিম তিনি এদেশে রেখে যান। এভাবে পশ্চিম ভারতে মুসলিম বসতি গড়ে উঠে। এই সমস্ত মুসলিমের তা’লিম-তরবীয়তের (তথা শিক্ষা-দীক্ষার) জন্যে সর্ব-শাইখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়্যা মুলতানী, সাইয়্যেদ আলী হিজবিরী লাহোরী (দাতা গঞ্জেবখশ্), আবূল হাসান খিরকানী কাবুলী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) প্রমুখ সূফীয়ায়ে কেরামের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শ্রম-সাধনার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ভারতের সর্বত্র ইসলামের প্রচার-প্রসার তাঁদেরই সাধনার ফসল।
ভারতীয় মুসলিমদের সাথে ভারতীয় অ-মুসলিম/মুশরিকদের সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপনের যাবতীয় প্রচেষ্টা এক সময় ব্যর্থ হয়। কেননা ইসলামের প্রচার-প্রসার দেখতে পেয়ে এতদঞ্চলের রাজা-বাদশাহ গং এ ধর্মকে এখান থেকে বিদায় করার অভিপ্রায়ে তৎপর হন। এতে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি নিপীড়ন-নির্যাতন আরম্ভ হয়। সে সময় সুলতান গাজী মাহমূদ গযনবী গযনী শাসন করছিলেন। তিনি মুসলমানদের করুণ দশা সম্পর্কে অবহিত হয়ে ১০০১ খ্রীষ্টাব্দ সাল হতে ১০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সতেরো বার ভারতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং মুসলমানদের কষ্ট অনেকাংশে লাঘব করেন। গোয়ালিওর, উজ্জয়িনী, নগরকোট, মুলতান, কাশমীর, কনৌজ, দিল্লী, আজমীর, পাঞ্জাব ইত্যাদি এলাকা ও সোমনাথ মন্দির তাঁর আয়ত্তাধীন হয়। কিন্তু কোথাও তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করে শাসন পরিচালনা করেন নি।
বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করার অনুমোদন ইসলামে নেই। সুলতান মাহমূদ বলপ্রয়োগ করলে অধিকাংশ ভারতীয় অমুসলিমকে তিনি হয়তো ধর্মান্তরিত করতে পারতেন এবং বর্তমান ভারত উপমহাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হতো। তিনি তা করেন নি। সোমনাথ মন্দিরের যুদ্ধে তিনি হযরতে বায়েযীদ বোস্তামী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর রূহানী খিলাফতপ্রাপ্ত শাইখ আবূল হাসান খিরকানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) প্রদত্ত খিরকাহ পরিধান করে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এরপর থেকেই ভারতে আউলিয়ায়ে কেরাম (রহ.)-এর ইসলাম প্রচার-প্রসার ও শাসন প্রতিষ্ঠার আন্তরিক আগ্রহ দেখা দেয়। বস্তুতঃ হযরতে খাজা আবূ মুহাম্মদ চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) গায়েবী/ঐশী নির্দেশে সত্তর বছর বয়সে সোমনাথের যুদ্ধে শরীক হন। ওই বিজয়ের পর চিশ্তীয়া তরীকার আউলিয়ায়ে কেরাম (রহ.) নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া শুরু করেন এবং রূহানী শক্তির মাধ্যমে ভারতের আনাচে-কানাচে ইসলামের শাশ্বত বাণী পৌছে দেন। সুলতানুল হিন্দ হযরতে খাজা গরীবে নওয়াজ মুঈনউদ্দীন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর দাদাপীর হযরতে খাজা জিন্দানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার শরীফ কারো কারো মতে উত্তর ভারতের কনৌজ শহরে অবস্থিত। যদি তা-ই হয়, তবে পারস্যের চিশত্ হতে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি তথায় আগমন করেছিলেন।
হযরত খাজা উসমান হারূনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে এবং নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশে ঈসায়ী/খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ভারতে আগমন করেন। সেই সময় গজনীর সুলতান মুয়ীযুদ্দীন মুহাম্মদ শিহাবুদ্দীন ঘোরী ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে ভারতীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। খ্রীষ্টাব্দ ১১৯১ সালে তরাইন বা সিরহিন্দের (প্রথম) যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যের মোকাবিলায় পরাজিত হয়ে বিফল মনোরথে মুহাম্মদ ঘোরী গজনী ফিরে যান। ভারতের রূহানী বাদশাহ (সুলতানুল হিন্দ্) হযরতে খাজায়ে মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তখন দিল্লী ও আজমীরের চৌহান-রাজ যোগী সম্রাট পৃথ্বীরাজের রাজধানী দখল করে ইসলামী ঝাণ্ডা বুলন্দ্ তথা উড্ডীন করে দিয়েছেন। দলে দলে যোগী সন্যাসী ও সম্রাট পৃথ্বীরাজের উৎপীড়িত হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রজা সাধারণ হযরতে খাজা আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর হাতে বাইয়াত হয়ে ইসলামী ঝাণ্ডার সুশীতল ছায়ায় সমবেত হতে থাকেন। এতে পৃথ্বীরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে যাদু-টোনা তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা হযরতে খাজা আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর প্রতি অসদাচারণ শুরু করেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই এ মহান ওলীকে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখতে না পেরে চৌহানরাজ নবদীক্ষিত মুসলমানদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। হযরতে খাজায়ে আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এতে খুবই ব্যথিত হন। তাঁর পবিত্র জবান হতে উচ্চারিত হয়, “আমি পৃথ্বীরাজকে সুলতান শিহাবুদ্দীন ও মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে জীবন্ত ছেড়ে দিলাম।” যেদিন তিনি এ কথা বলেন, সেই দিনগত রাতে সুলতান ঘোরী স্বপ্নে দেখতে পান যে, একজন দরবেশ তাঁকে ভারতে বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছেন। অতঃপর তিনি সসৈন্যে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। খ্রীষ্টীয় ১১৯২ সালে পাঞ্জাবের তরাইন বা সিরহিন্দ নামক স্থানে আবারো পৃথ্বীরাজের সাথে তুমূল যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এবার রাজা বন্দী ও নিহত হন। আল্লাহর ওলী হযরতে খাজায়ে আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর দোয়ার বদৌলতে ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কুতুবুদ্দীন আইবেককে ভারতের শাসনভার অর্পণ করে সুলতান ঘোরী গজনীতে ফিরে যান।
খ্রীষ্টাব্দ ১২৩৬ সালে প্রায় একশত বছর বয়সে সুলতান শামসুদ্দীন আল-তামাশের (ইলতুৎমিশের) শাসনকালে প্রায় এক কোটি ভারতীয় অমুসলিমকে দ্বীন-ইসলামে দীক্ষিত করে হযরতে খাজায়ে আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) জান্নাতবাসী হন।
হযরত খাজা আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর প্রধান খলীফা ছিলেন হযরত খাজা কুতু্বুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)। তিনি দিল্লীকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রস্থল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দয়ালু-দাতা শাসক কুতুবুদ্দীন আইবেক ও দরবেশ-ফকির বাদশাহ শামসুদ্দীন আলতামাশ ছিলেন হযরত খাজা কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খাস্ মুরীদ ও ভক্ত। উভয়ই উচ্চস্তরের ওলী ছিলেন। দিল্লী কুতুব মিনারের পাশে খাজা কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) মাযারে শায়িত আছেন। ভারতে ইসলাম প্রচারের ধারা হযরত কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খলীফা হযরত শাইখ ফরীদুদ্দীন মসউদ গঞ্জেশকর (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর আমলে আরো জোরদার হয়। দিল্লীর সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবনের কন্যা শাহজাদী হুযাইরা’র সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি প্রায় সত্তর হাজার খলীফাকে সমগ্র ভারত ও মধ্য এশিয়ায় ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। মাহবুবে ইলাহী নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও খাজা আলাউদ্দীন আলী আহমদ ফুলাইরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর বিশিষ্ট খলীফা। লক্ষ লক্ষ অমুসলিমকে ইসলামে দীক্ষিত করে ৯৩ বছর বয়সে তিনি জান্নাতবাসী হন। লাহোর ও মুলতানের মধ্যবর্তী পাক-পট্টন শহরে তিনি সমাহিত রয়েছেন।
বাবা ফরীদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর নির্দেশে হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহি) দিল্লীতে আস্তানা স্থাপন করেন। দাসবংশ খিলজী ও তুগলুক বংশের শাসনামলে তিনি দিল্লী ও সন্নিহিত এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। তিনি অপর একজন খাজা নাসিরুদ্দীন (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে ‘চেরাগে দিল্লী’ উপাধি দান করে দিল্লীতে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন। তাঁর প্রধান খলীফা হযরত শাইখ সিরাজুদ্দীন উসমান আঁখি সিরাজ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে ‘আয়নায়ে হিন্দুস্তান’ উপাধি দান করে বঙ্গে ইসলাম প্রচারের জন্যে প্রেরণ করেন। বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের গৌড় বা পাণ্ডুয়ানগরের সাদুল্লাহপুরে তাঁর আস্তানা ছিলো। গৌড়ের তৎকালীন শাসক শ্রেণি, অভিজাতমহল এবং বহু হিন্দু-বৌদ্ধ তাঁর চরিত্র-মাহাত্ম্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পর তাঁরই শ্রেষ্ঠতম খলীফা হযরত শাইখ আলাউল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বঙ্গে ইসলাম প্রচার করেন। বঙ্গের অমুসলিম শাসক তাঁর প্রতাপ-প্রভাবে ভীত হয়ে তাঁকে লক্ষণাবতী হতে সোনারগাঁয়ে নির্বাসন দেন। সোনারগাঁয়ে তিনি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার আরম্ভ করেন। খ্রীষ্টীয় ১৩৯৮ সালে তাঁর বেসালপ্রাপ্তি হলে তাঁরই সুযোগ্য খলীফা নূরুদ্দীন নূর কুতুবে আলম (রহমতুল্লাহি আলাইহি) পীর ও মুর্শীদের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তাঁর অক্লান্ত সাধনায় পূর্ববঙ্গে অসংখ্য মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হন। খ্রীষ্টীয় ১৪৪৭ সালে তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাইখ জাহিদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বঙ্গে ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৪৫৫ খ্রী: সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।
হযরত শাহ জালাল মুজার্রদে ইয়েমেনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই সময়েই দিল্লীর মাহবুবে ইলাহী শাইখ নিযামুদ্দীন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর অনুমতিক্রমে পূর্ববঙ্গে ইসলাম প্রচার করেন। শাইখ ফরীদুদ্দীন গঞ্জেশকর (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর আরেকজন খলীফা শাইখ মখদুম আলাউদ্দীন আলী আহমদ সাবের (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কালিয়ার শরীফে অবস্থান করে ইসলামে প্রচারে ব্যাপৃত হন। শাইখ আবদুল কুদ্দুস গাংগোহী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন চিশ্তী-নিযামী ও চিশ্তী-সাবেরী উভয় তরীকতী সিলসিলায় খেলাফতপ্রাপ্ত। এই সিলসিলা হযরতে ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাধ্যমে আরো শক্তিশালী হয়ে শুধু সমগ্র ভারতবর্ষে নয়, বরং আরব ও আজমে ইসলাম প্রচারে অবদান রেখেছে।
বাবা ফরীদ গঞ্জেশকর (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর বংশধর খাজা সলীম চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) দিল্লী-আগ্রার অদূরে ফতেহপুর সিক্রির পাহাড়ে ধ্যান-সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। মোঘল সম্রাট আকবর খবর পেয়ে তাঁর সান্নিধ্যে একাধিকবার গমন করেন। এই চিশ্তী দরবেশের কারামত তথা অলৌকিক ক্রিয়ায় আকবর বাদশাহের ঔরশে ১৫৬৭ সালে এক জগদ্বরেণ্য সন্তানের জন্ম হয়। সম্রাট দরবেশের নামানুসারে তাঁর নাম রাখেন সলীম ওরফে জাহাঙ্গীর। খ্রীষ্টীয় ১৫৬৮ সালে দরবেশের বেসালপ্রাপ্তি হয়। সেই বছরই মহামতি আকবর বাদশাহ ফতেহপুর সিক্রিতে মোঘল সাম্রাজ্যের এক মনোরম রাজধানী স্থাপন করেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬০৬ সালে হযরত সলীম চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খান্দানের ইসলাম খাঁন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে পূর্ব-বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করা হয়। তিনি সোনারগাঁও হতে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। ঢাকায় তাঁর এক স্বনামধন্য বংশধর হযরত খাজা শরফুদ্দীন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) পূর্ব হতেই ইসলাম প্রচার করেন। খ্রীষ্টীয় ১৬৭৮ সালে তিনি বেসালপ্রাপ্ত হন। তাঁর আগে আজমীর শরীফের স্বনামধন্য একজন ওলী ঢাকায় ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর নাম হযরত শাহজালাল দখিনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)। বঙ্গভবন এলাকায় তাঁর পবিত্র মাযার শরীফ রয়েছে। [সম্পাদকের নোট: আমার মরহূম পিতা কাজী মুহাম্মদ মোশার্রফ হোসেন (সি.এস.পি.) ১৯৭২ সালের সেপটেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতির মুখ্যসচিব পদে যোগ দিলে বঙ্গভবনের ভেতরে সচিবের বাংলোয় আমরা দু বছর বসবাস করেছিলাম। প্রধান ফটক হতে বাঁ দিকে ওই বাংলো অভিমুখী রাস্তার বাঁ পার্শ্বে ছিলো মাযারটির অবস্থান। তবে ছোট্ট একটি ঘরে শায়িত ছিলেন এই দরবেশ।]
ভারতীয় উপমহাদেশে আউলিয়ে কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-এর ইসলাম প্রচারের ইতিহাস সহজলভ্য নয়। ইসলামের প্রথম যুগ হতে প্রতিটি যুগে বহু আউলিয়া এ উপমহাদেশে এসেছেন। এর প্রমাণ বাংলাদেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। এদেশের একটি জেলাও এমন নেই, যেখানে একাধিক ওলীর মাযার শরীফ নেই। সর্ব-হযরত শাহ্ জালাল, শাহ জামাল, শাহ্ পরাণ, শাহ আলী বাগদাদী, শাহ সুলতান মাহী সওয়ার, শাহ শরফুদ্দীন চিশ্তী, শাহ মখদুম, খাঁন জাহান আলী, বদর শাহ, মোহসেন আউলিয়া, গরীবউল্লাহ শাহ, কমরউদ্দীন রূমী, শাহ আহমদুল্লাহ আল-হাসানী, শাহ গোলামুর রহমান আল-হাসানী, শেখ মুহাম্মদ গৌড়ী, সুলতানুল বাগদাদী, কুতুবে জমান জনাব কাজী আসাদ আলী শাহ, মওলানা নূরুল ইসলাম আল-কাদেরী, সৈয়দ মওলানা এ.জেড.এম. সেহাবউদ্দীন খালেদ (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) প্রমুখ এই বাংলাদেশে সমাহিত রয়েছেন। এ কারণে এদেশকে আউলিয়ার দেশ বলা হয়। বস্তুতঃ যুগ যুগ ধরে অসংখ্য আউলিয়া (রহ.) এ উপমহাদেশে আগমন করে এখানকার মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দান করেছেন। আজ আমরা যে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেই এবং গর্ব করি, এ তো আউলিয়া-ই-কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-এরই অবদান। [সম্পাদকের নোট: আফসোস, বর্তমানে এ ঐতিহ্য সম্পর্কে আত্মভোলা একশ্রেণির মুসলমান নামধারী গণ্ডমূর্খ স্বর্ণযুগের ওই আউলিয়া (রহ.)-বৃন্দের মাযার-দরগাহ নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আসলে তারা ইসলামের দুশমনদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।]
*সমাপ্ত*
No comments:
Post a Comment