মূল: মুহাম্মদ আকদাস্ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: মুহাম্মদ রুবাইয়েৎ বিন মূসা
আউলিয়ার মাযার যেয়ারত করে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করা ইসলাম ধর্মে বৈধ কি-না, এ প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিম উম্মাহর উলামায়ে হাক্কানী রব্বানীবৃন্দের আকিদা-বিশ্বাস বিবেচনা করবো।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
আক্বীদা-বিশ্বাস
(১) হযরত বুরায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে খোদা এরশাদ ফরমান,
نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ
الْقُبُورِ فَزُورُوهَا.
- ইতিপূর্বে তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে যেয়ারত করো।[১]
এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দীসে
দেহেলভী লিখেছেন যে, অজ্ঞতার যুগ সবেমাত্র পার হওয়ায় রাসূলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম কবর যেয়ারত নিষেধ করেছিলেন এই আশঙ্কায় যে মুসলমানবৃন্দ পুরোনো জীবনধারায় প্রত্যাবর্তন করবেন। তবে মানুষেরা যখন ইসলামী ব্যবস্থার সাথে ভালোভাবে পরিচিত হলেন, তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেয়ারতকে অনুমতি দিলেন।
(২)হযরত ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ
الْقُبُورِ فَزُورُوهَا.
-
আমি তোমাদের কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে যেয়ারত করো। [৩]
(৩) মুহাম্মদ বিন নোমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান,
مَنْ زَارَ قَبْرَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدِهِمَا
فِي كُلِّ جُمُعَةٍ غُفِرَ لَهُ، وَكُتِبَ بَرًّا.
-
যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবার তার পিতা-মাতার বা তাঁদের যে কোনো একজনের কবর যেয়ারত করে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং পুণ্যবানদের একজন হিসেবে তার নাম
লেখা হবে। [৪]
এ সকল হাদীস থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কবর যেয়ারত বৈধ। উপরস্তু, যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবার তাঁর পিতামাতার কবর যেয়ারত
করেন, তাঁর গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এ হাদীস প্রমাণ করে যে বেসালপ্রাপ্ত পুণ্যাত্মাদের যেয়ারত তথা সাক্ষাৎ দ্বারা দুনিয়ার মানুষ কল্যাণপ্রাপ্ত হন। অর্থাৎ, বেসালপ্রাপ্ত পুণ্যাত্মাবৃন্দ জগতবাসী মানুষের মঙ্গল করতে পারেন।]
ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আকীদা-বিশ্বাস
আল্লামা ইবনে
আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কথা উদ্ধৃত
করেন, যিনি বলেন,
قَالَ: إنِّي لَأَتَبَرَّكُ
بِأَبِي حَنِيفَةَ وَأَجِيءُ إلَى قَبْرِهِ، فَإِذَا عَرَضَتْ لِي حَاجَةٌ صَلَّيْت
رَكْعَتَيْنِ وَسَأَلْت اللَّهَ تَعَالَى عِنْدَ قَبْرِهِ فَتُقْضَى سَرِيعًا.
-
আমি ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর
সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর মাযার যেয়ারত করি। আমার যখন কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, তখন আমি দু’রাকাত নামায আদায় করে ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি
আলাইহি-এর মাযার যেয়ারত করি এবং তৎক্ষণাৎ আমার প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়।[৫]
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভীও লিখেন: ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি
বলেছেন যে হযরত মূসা কাযেমের (রহমতুল্লাহি আলাইহি) মাযারে
তাৎক্ষণিক দোয়া কবুল হয়। [৬]
এ সকল লেখনীতে প্রতিভাত হয় যে, ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি’র এ মর্মে
আকিদা-বিশ্বাস ছিল আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারত করে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ এবং মাযারস্থ আউলিয়ায়ে কেরাম বিপদ-আপদ দূর করার একটি মাধ্যম, এ বিশ্বাস অন্তরে পোষণ
করাও বৈধ।
ইমাম সাবী মালেকী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা-বিশ্বাস
وَابْتَغُوا إِلَيْهِ
الْوَسِيلَةَ.
-
আল্লাহর নৈকট্যের জন্যে অসীলার অন্বেষণ করো। [৭]
এই আয়াতটি ব্যাখ্যাকালে ইমাম সাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আল্লাহ্ ভিন্ন অপর কারো এবাদত-বন্দেগী করছেন মনে করে আউলিয়ায়ে
কেরামের মাযার যেয়ারতকারী মুসলমানদেরকে কাফের আখ্যা দেয়া স্পষ্ট গোমরাহী। তাঁদের মাযার যেয়ারত করা আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারো এবাদত-বন্দেগী নয়, এটা হলো আল্লাহ্ যাঁদেরকে ভালোবাসেন তাঁদেরকে ভালোবাসার নিদর্শন।[৮]
ইমাম সাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায় যে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারত বৈধ এবং এটা
আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারো পূজা-অর্চনা নয়, বরং আল্লাহ্ যাঁদেরকে ভালোবাসেন তাঁদেরকে
ভালোবাসার নির্দশন।
সুলতানুল মাশায়েখ হযরত নিযামউদ্দীন আউলিয়ার আক্বীদা-বিশ্বাস
হযরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে মওলানা
কাটহেলী একবার তাঁর নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন: কোনো এক বছর দিল্লীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আমি একটি বাজার এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম আর তখন আমার খিদে পেয়েছিল। আমি কিছু
খাবার কিনে মনে মনে বল্লাম, এ খাবার আমার একা খাওয়া উচিৎ নয়; এটা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে হবে। এমতাবস্থায় আমি এক বৃদ্ধ মানুষের
দেখা পেলাম যাঁর গায়ে চাদর মোড়ানো ছিল। আমি তাঁকে বল্লাম, ওহে খাজা! আমি গরিব এবং
আপনাকেও গরিব মনে হচ্ছে। মওলানা কাটহেলী ওই বৃদ্ধকে খাবার গ্রহণের জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন এবং তিনি তা গ্রহণ করলেন। মওলানা কাটহেলী বলেন, আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখন আমি ওই বয়স্ক মরুব্বীকে জানালাম যে আমি ২০ টাকা (রূপী) ঋণগ্রস্ত। এ কথা শুনে ওই বয়স্ক মরুব্বী আমাকে খাওয়া
চালিয়ে যেতে তাগিদ দিলেন এবং ওই ২০ টাকা (রূপী) এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমি আপন মনে ভাবলাম,
তিনি ওই টাকা পাবেন কোথায়? খাওয়া শেষে সেই বয়স্ক মরুব্বী উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে মসজিদে
নিয়ে গেলেন। এই মসজিদের ভেতরে একটি মাযার অবস্থিত ছিল।
তিনি ওই মাযারের কাছে কী যেন চাইলেন। তাঁর হাতে যে ছোট লাঠি ছিল তা দ্বারা দু বার মাযারে আলতোভাবে ছুঁয়ে তিনি বল্লেন, এই লোকের ২০ টাকা প্রয়োজন, তাকে তা দেবেন। অতঃপর বয়স্ক মরুব্বী আমার দিকে ফিরে বল্লেন, ‘মওলানা, ফিরে যান; আপনি আপনার ২০ টাকা পাবেন।’
আমি এ কথা শুনে ওই মরুব্বীর হাতে চুমো খেলাম এবং শহরের দিকে ফিরে চল্লাম। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কীভাবে আমি ওই ২০ টাকা খুঁজে পাবো। আমার সাথে একটা চিঠি ছিল যা কারো বাসায় আমাকে পৌঁছে দেবার কথা ছিল। ওই চিঠি যথাস্থানে নিয়ে গেলে আমি জনৈক তুর্কী ব্যক্তির দেখা পাই। তিনি তাঁর গৃহ-ভৃত্যদের বল্লেন আমাকে ওপর তলায় নিয়ে যাবার জন্যে। আমি তাঁকে চেনার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না, কিন্তু তিনি বার বার বলছিলেন কোনো এক সময় নাকি আমি তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। আমি তাঁকে না চেনার কথা বল্লেও তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন বলে জানালেন। আমরা এভাবে কিছুক্ষণ কথাবর্তা বল্লাম। অতঃপর তিনি ভেতর থেকে ফিরে এসে আমার হাতে ২০ টাকা গুজে দিলেন ।[৯]
হযরত নিযামউদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বর্ণিত এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে তিনি এ মর্মে বিশ্বাস পোষণ করতেন যে আউলিয়ায়ে কেরাম যাহেরী/প্রকাশ্য জিন্দেগীতে থাকাকালীন সময়ে যেভাবে মানুষদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম, ঠিক একইভাবে মাযারস্থ অবস্থায়ও তাঁরা মানুষদেরকে আধ্যাত্মিক সাহায্য দিতে সক্ষম। আর তাঁদের কাছে এই সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। প্রকৃত দাতা হলেন আল্লাহ তা’লা; আউলিয়ায়ে কেরাম আমাদের সাহায্য করেন আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে; যেমনিভাবে প্রকৃত আরোগ্য দানকারী হলেন আল্লাহ্ পাক, কিন্তু রোগীরা আরোগ্যের জন্যে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা-বিশ্বাস
আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি
শায়খ আবুল হারিস আওলাসী রহমতুল্লাহি আলাইহি-কে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন যে, হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি
সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শুনেছেন। তাই কিছু মাসআলা সম্পর্কে জানতে আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সাথে দেখা করার
কথা মনস্থ করেন। কিন্তু যখন তিনি
মিসর পৌঁছেন তখন জানতে পারেন যে হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বেসালপ্রাপ্ত (খোদার সাথে পরপারে মিলিত) হয়েছেন। এমতাবস্থায় আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর
মাযারে যান এবং মোরাকাবায় বসেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি হয়রান বোধ করেন এবং ঘুমিয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-কে স্বপ্নে দেখেন এবং তাঁর প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন। শায়খ মিসরী তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাঁর কাঁধ
থেকে বোঝা নামিয়ে দেন ।[১০]
এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর আকীদা-বিশ্বাস
স্পষ্ট করলেন এ মর্মে যে, কোনো প্রয়োজন নিয়ে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযারে যাওয়া
বৈধ। তাঁরা আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমাদেরকে সাহায্য করে থাকেন।
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা
ইমাম ইবনে হাজর মক্কী
রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেন,
وَاَنَّ قَبْرَهُ يُزَارُ لِقَضَاءِ
الْحَوَائِجِ اِعْلَمْ اَنَّهُ لَمْ يَزَلِ الْعُلَمَاءُ وَذَوو الْحَاجَاتَ قَبْرَهُ
وَيَتَوَسَّلُوْنَ عِنْدَهْ فِيْ قَضَاءِ حَوَائِجِهِمْ يَرُوْنَ نَجْحَ ذَلِكَ مِنْهُمْ
الْأِمَامُ الشَّافِعِيِ رَحْمَهُ اللهُ لَمَا كَانَ بِبَغْدَادٍ فَأِنَّهُ جَاءَ
عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ: إنِّي لَأَتَبَرَّكُ بِأَبِي حَنِيفَةَ وَأَجِيءُ
إلَى قَبْرِهِ، فَإِذَا عَرَضَتْ لِي حَاجَةٌ صَلَّيْت رَكْعَتَيْنِ وَسَأَلْت
اللَّهَ تَعَالَى عِنْدَ قَبْرِهِ فَتُقْضَى سَرِيعًا.
-
উলামা ও যাদের প্রয়োজন তাঁদের মধ্যে এই আচার সবসময়ই চালু ছিল যে তাঁরা ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযারে যেতেন এবং নিজেদের অসুবিধা দূর করার জন্যে তাঁর মাধ্যমে দোয়া করতেন। এ
সকল ব্যক্তি এটাকে সাফল্য লাভের একটা অসীলা মনে করতেন এবং এর অনুশীলন দ্বারা বড় ধরনের পুরস্কার লাভ করতেন। বাগদাদে
থাকাকালীন সব সময়েই ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযারে যেতেন এবং তাঁর কাছে আশীর্বাদ তালাশ করতেন। যখন আমার (ইমাম ইবনে হাজর) কোনো প্রয়োজন
দেখা দেয়,
তখন আমি দু’রাকাত নামায আদায় করে তাঁর মাযারে যাই এবং তাঁর অসীলায় দোয়া করি। ফলে আমার অসুবিধা তক্ষণি দূর হয়ে যায় ।[১১]
এ লেখনী থেকে পরিস্ফুট হলো যে, ইমাম ইবনে হাজর মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি বুযুর্গানের দ্বীনের মাযার যেয়ারত ও তাঁদের অসীলা গ্রহণকে বৈধ জানতেন এবং ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-ও এর ওপর আমলকারী ছিলেন।
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি
আলাইহি লিখেন: কবর যেয়ারত করা মোস্তাহাব (প্রশংসনীয়); এ ব্যাপারে ঐকমত্য
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে” ।[১২]
তিনি আরও লিখেন: যেয়ারতের সময় কবরস্থদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব (অবশ্য কর্তব্য), বিশেষ করে পুণ্যবান বান্দাদের ক্ষেত্রে। তাঁরা যাহেরী জিন্দেগীতে থাকাকালীন তাঁদেরকে সম্মান
প্রদর্শন করা যেমন প্রয়োজনীয় ছিল, একইভাবে তাঁদের মাযারেও তা প্রদর্শন করা জরুরি। কেননা, মাযারস্থ বুযুর্গানে দ্বীন যে সাহায্য করে থাকেন, তা তাঁদের প্রতি যেয়ারতকারীদের প্রদর্শিত ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মানের ওপরই নির্ভর
করে।[১৩]
এ লেখনী থেকে পরিস্ফুট হয় যে শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি
আলাইহি আউলিয়ার মাযার যেয়ারত ও তাঁদের তওয়াসসুল
(মধ্যস্থতা) গ্রহণকে শেরক বা বেদআত বলে জানতেন না। উপরন্তু, তাঁর মতে এটা পছন্দনীয় কাজ এবং এর দ্বারা যেয়ারতকারীরা মাযারস্থ বুযুর্গানের দ্বীনের
সাহায্য পান ও আশীর্বাদধন্য হন।
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্
দেহেলভীর আকীদা-বিশ্বাস
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ লিখেন যে তাঁর পিতা শাহ্ আব্দুর রহীম বলেছেন, একবার আমি হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতেয়ার বাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর
মাযার শরীফ যেয়ারত করতে যাই। এমতাবস্থায় তাঁর রূহ্ মোবারক আমার সামনে দৃশ্যমান হন এবং আমাকে বলেন যে আমার একজন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, আর আমি যেন ওর নাম রাখি কুতুবউদ্দীন আহমদ। ওই সময় আমার স্ত্রী বয়স্ক হয়ে গিয়েছিল এবং সন্তান ধারণের বয়স পেরিয়েছিল। তাই শায়খের এ কথা শুনে আমি
মনে মনে ভাবলাম সম্ভবত আমার নাতি হতে যাচ্ছে। হযরত বখতেয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি আমার মনের কথা বুঝতে পেরে সন্দেহ দূর করে দিলেন এ কথা বলে যে তিনি নাতির
খোশ-খবরী (শুভ সংবাদ) দেন নি, বরং আমার নিজের একজন পুত্র সন্তানের কথা বলেছেন।
কিছু কাল পরে আমি আবার বিয়ে করি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে (শাহ্) ওয়ালিউল্লাহর জন্ম হয়।” শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ বলেন, ’আমার জন্মের সময় আমার বাবা ওই ঘটনার কথা ভুলে গিয়েছিলেন আর তাই আমার নাম রেখেছিলেন
ওয়ালিউল্লাহ্। তাঁর যখন এ ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, তখন তিনি আমার দ্বিতীয় নাম রাখেন কুতুবউদ্দীন
আহমদ।[১৪]
এ ঘটনা বর্ণনা করে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ তাঁর বিশ্বাস সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা আমাদের দিয়েছেন। তিনি
বিশ্বাস করতেন যে পুণ্যবান আউলিয়াবৃন্দের
মাযারে যাওয়া জায়েয এবং বেসালের পরও আউলিয়ায়ে কেরামের কাছে গায়েবের খবর জানা আছে, যেমনটি হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতেযার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি ওই পুত্র
সন্তানের জন্মের এক বছর আগে এ সম্পর্কে জানতেন। উপরস্তু, মাযারস্থ বুযুর্গানে দ্বীন মনের খবরও জানেন।
শাহ্ আব্দুল আযীয
দেহেলভীর আক্বীদা-বিশ্বাস
শাহ্ আব্দুল আযীয লিখেন: শরহে মাকাসিদ গ্রন্থে লেখা আছে যে
اَلْأَصْلِيَّةُ
أَنَّهَا نَافِعَةٌ. وَحَقَيْقَةُ الْعَوْدِ تَوَجَّهُ الشَّيِّء إِلَىْ مَا كَانَ
عَلَيْهِ وَالْمُرَادُ هَهُنَا الرُّجْوْع ُإِلَىْ الْوُجْودِ بَعْدَ الْفَنَاءِ أَوْ
رُجُوْع ِأَجْزَاءِ الْبَدَنِ إِلَىْ الْاِجْتِمَاعِ بَعْدَ التَّفَرُّقِ وَإِلَىْ
الحْيَاَةِ بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْأَرْوَاحِ إِلَىْ الْأَبْدَانِ بَعْدَ الْمُفَارَقَةِ
وَأَمَّا الْمَعَادُ الرُّوْحَانِيْ الْمَحَضُ عَلَىْ مَا يَرَاه الْفَلَاسَفة فَمَعْنَاهُ
رُجْوْعُ الْأَرْوَاحِ إِلَىْ مَا كَانَتْ عَلَيْهَ مِنْ التَّجَرُّدِ عَنْ عَلَاقَةِ
الْبَدَنِ.
মাযার যেয়ারত করা উপকারী এবং মাযারস্থ আউলিয়ায়ে কেরামের রূহ্ মোবারক উপকার
সাধন করতে সক্ষম। বাস্তবিকই বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলিত)-প্রাপ্ত হবার পরে আউলিয়ায়ে কেরামের রূহ্ মোবারক
তাঁদের শরীর ও মাযারের সাথে সম্পর্ক রাখেন। তাই কেউ যখন কোনো ওলীর মাযার যেয়ারত করেন এবং ওই ওলীর প্রতি মনোযোগ
দেন, তখন উভয় রূহের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। [১৫]
এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করা হয়েছে যে আউলিয়ায়ে কেরাম জীবিতাবস্থায় বেশি
সাহায্য করতে সক্ষম, না বেসালপ্রাপ্ত অবস্থায়। কিছু উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে বেসালপ্রাপ্ত আউলিয়া বেশি সাহায্য করতে সক্ষম; আর কিছু উলামা হুজুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস এ মতের স্বপক্ষে পেশ করে তা প্রমাণ করেছেন; হাদীসটিতে এরশাদ হয়েছে,
إِذَا تَحَيَّرْتُمْ فِي الْأُمُورِ فَاسْتَعِينُوا
بِأَهْلِ الْقُبُورِ.
-
যখন তোমরা কোনো ব্যাপারে পেরেশানগ্রস্ত হও, তখন মাযারস্থ (আউলিয়া)-দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।[১৬]
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি শরহে মেশকাত গ্রন্থে বলেছেন যে এই বিষয়টির পরিপন্থী কোনো
দালিলিক প্রমাণ কুরআন ও সুন্নাহ্ কিংবা সালাফবৃন্দের বাণীতে বিদ্যমান নেই।[১৭]
ফতোওয়ায়ে আযীযিয়ার এই উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে পুণ্যবান আউলিয়ার
মাযার যেয়ারত করা উত্তম একটি আমল এবং তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা শরীয়তে জায়েয (বৈধ)।
তথ্যসূত্র:
[১] মুসলিম : আস সহীহ, বাবু
ইসতি‘যানিন নবীয়্যি, ২:৬৭২ হাদীস নং ৯৭৭
(ক) ইবনে মাজাহ : আস সুনান, বাবু মা
জা‘আ ফি যিয়ারাতিল কুবূর, ১:৫০১ হাদীস নং
১৫৭১।
(খ) আবু দাউদ : আস সুনান, বাবু ফি
যিয়ারাতিল কুবূর, ৩:২১৮ হাদীস নং ৩২৩৫।
(গ) নাসায়ী : আস সুনান,
যিয়ারাতুল কুবূর, ৪:৮৯ হাদীস নং ২০৩২।
(ঘ) আব্দুর রাযযাক : আল
মুসান্নাফ, ৩:৫৬৯ হাদীস নং ৬৭০৮।
(ঙ) ইবনে আবী শায়বা : আল
মুসান্নাফ, ৩:২৯ হাদীস নং ১১৮০৪।
(চ) আহমদ : আল মুসনাদ,
১:১৪৫ হাদীস নং ১২৪৫।
(ছ) ইবনে হিব্বান : আস
সহীহ, ৩:২৬১ হাদীস নং ৯৮১।
(জ) তবরানী : আল মু‘জামুল
আওসাত, ৩:১৩৩ হাদীস নং ২৭০৯।
(ঝ) দারে কুতনী : আস
সুনান, ৫:৪৬৭ হাদীস নং ৪৬৭৯।
(ঞ) হাকিম : আল
মুস্তাদরাক, ১:৫৩০ হাদীস নং ১৩৮৬।
(ট) বায়হাকী : আস সুনানুস
সগীর, ২:৩৬ হাদীস নং ১১৫৩।
(ঠ) বাগাবী : শরহুস
সুন্নাহ, ৫:৪৬২ হাদীস নং ১৫৫৩।
[২] আব্দুল হক মুহাদ্দিস
দেহলভী : আশ্আতুল লোমআত, ১:৭১৭।
[৩]
ইবনে মাজাহ : আস সুনান, বাবু মা জা‘আ ফি যিয়ারাতিল কুবূর, ১:৫০১ হাদীস নং ১৫৭১।
[৪] তবরানী : আল মু‘জামুল আওসাত, ৬:১৭৫ হাদীস নং ৬১১৪।
(ক)
বায়হাকী : শু‘য়াবুল ঈমান,
১০:২৯৭ হাদীস নং ৭৫২২।
(খ) আল খতিব : মিশকাতুল মাসাবীহ, ১:৫৫৩ হাদীস নং ১৭৬৮।
(গ) হাকিম তিরমিযী : নাওয়াদিরুল উসূল
১:৯৬।
[৫] ইবনে আবিদীন : রাদ্দুল মুহতার আল
দুররিল মুখতার, ১:৫৫।
[৬] আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : আশ্আতুল লোমআত, ১:৭১৫।
[৭] আল্ কুরআন : আল মায়েদা, ৫:৩৫।
[৮] সাবী : আত তাফসীর, ১:২৪৫।
[৯] ফাওয়াইদ আল ফাওয়াদ, ১২৪ পৃষ্ঠা।
[১০]
নাফহাত আল্ উনস্ ১৯৩ পৃষ্ঠা।
[১১] ইবনে হাজর মক্কী : খায়রাত আল্ হিসান, ১:৭২।
[১২] আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : আশ্আতুল লোমআত, ১:৭১৫।
[১৩]
প্রাগুক্ত : ১:৭১০।
[১৪] আনফাস্ আল্ আরেফীন, ১১০ পৃষ্ঠা।
[১৫] তাফতাযানী : শরহু মাকাসিদ, ২/২০৯।
[১৬] মোল্লা আলী কারী : মিরকাত শরহু
মিশকাত, ৪:১২৫৯ হাদীস নং ১৭৫৯।
[১৭] ফতোওয়ায়ে আযীযিয়া : ২য় খণ্ড, ১০৮ পৃষ্ঠা।
[এ লেখাটি www.aqdas.co.uk শীর্ষক ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে]
No comments:
Post a Comment