Thursday 16 May 2013

তাযকিয়ায়ে নফস্ (প্রবৃত্তি/ষড়রিপুর পরিশুদ্ধি): সূফী প্রেরণার একটি মৌলনীতি


মূল: শায়খ হিশাম কাব্বানী (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন



প্রাথমিক যুগের সূফী প্রচারকবৃন্দ ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার করেছিলেন সমগ্র ভারত উপমহাদেশে, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, আফ্রিকায় এবং এমন কি রাশিয়ার কিছু অংশেও - ঠিক যেমনি বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় সমসাময়িককালের সূফীমন্ডলী ইসলামী আকিদার বিস্তার ঘটাচ্ছেন। কিন্তু সূফীদের উৎপত্তিস্থল কোথায়? আর তাসাউফ বা সূফীতত্ত্বের ব্যাপারে ইসলামী ফেকাহের বিভিন্ন মযহাবের এবং সমাজের বরেণ্য জ্ঞান বিশারদদেরই বা দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? [এখানে তাসাউফ মানে হলো আত্মশুদ্ধিবিষয়ক ইসলামী জ্ঞানের শাস্ত্র এবং আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পূর্ণতাপ্রাপ্ত চরিত্রের অনুকরণ-অনুসরণ]

আজকাল ইসলাম ধর্ম এমন কিছু লোকের কথা দ্বারা প্রচার হচ্ছে যারা এর অনুশীলনের ধারই ধারে না, অথবা যারা এর চর্চার মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধও করে না। এই দুর্ভাগ্যজনক অধঃপতন সম্পর্কে মহানবী (দ:)-এর বহু হাদীসে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল; উদাহরণস্বরূপ, এরশাদ হয়েছে, “তারা (তথাকথিত প্রচারকরা) মানুষকে উপদেশ দেবে, কিন্তু নিজেরা সেই অনুযায়ী অনুশীলন (আমল) করবে না” (সর্ব-হযরত উমর, আলী, ইবনে আব্বাস ও অন্যান্যরা। এগুলো হযরত আবু তালেব মক্কী প্রণীত ’কুত আল-কুলূব ফী মু’আমালাত আল-মাব্বুব’ গ্রন্থের ‘দুনিয়ার আলেম ও আখোতের আলেমবৃন্দের মধ্যে পার্থক্য’ শীর্ষক অধ্যায়ে সংগৃহীত। কায়রো হতে ’মাতবা’আত আল-মায়মুনিয়্যা’ কর্তৃক ১৩১০ হিজরী/১৮৯৩ খৃ: সালে প্রকাশিত বইটির ১ম খন্ডের ১৪০-৪১ পৃষ্ঠা দেখুন)।

একইভাবে, মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন, “আমি শুধু তোমাদের প্রতি (ঈসা) মসীহ-বিরোধীদের (ইহুদীদের) বৈরিতা আশংকা করি না”। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, “এ ছাড়া আর কাদের তরফ থেকে আশংকা করেন”? তিনি বল্লেন, “গোমরাহ/পথভ্রষ্ট আলেমদের থেকে” (ইমাম আহমদ কৃত মুসনাদ)। তিনি অন্যত্র আরও এরশাদ করেন, “আমার উম্মতের জন্যে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই যাকে, সে হলো আলেমের মতো জিহ্বাসম্বলিত মোনাফেক/কপট ব্যক্তি” (ইমাম আহমদ সহীহ সনদে এটি বর্ণনা করেছেন তাঁর মুসনাদ পুস্তকে)। এটা তো ছিল না সাহাবীদের, বিশেষ করে আহলুস্ সুফ্ফাদের পথ - যে সূফীদের সম্পর্কে আয়াত নাযেল হয়েছে, “এবং (হে রসূল), আপন আত্মাকে তাদেরই সাথে সম্পর্কযুক্ত রাখুন যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে আহ্বান করে, তাঁরই সন্তুষ্টি চায় এবং আপনার চোখ দুটো যেন তাদেরকে ছেড়ে অন্য দিকে না ফেরে; আপনি কি পার্থিব জীবনের শোভা/সৌন্দর্য কামনা করবেন? আর সেই ব্যক্তির কথা মানবেন না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি এবং সে আপন খেয়াল-খুশির অনুসরণ করেছে, আর তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে” (সুরা কাহাফ, ২৮ আয়াত)।

আর ওই কপটতার পথ ছিল না হযরত আবু বকরের (রা:)-ও যাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ ফরমান, “আবু বকর (রা:) তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বেশি বেশি নামায-রোযা করার জন্যে নয়, বরং তাঁর অন্তরে রহস্য (আধ্যাত্মিকতা) শিকড় গাড়ার জন্যেই এই শ্রেষ্ঠত্ব” (ইমাম আহমদ এটি বর্ণনা করেছেন তাঁর কিতাব ’ফযাইলে সাহাবাতে’ যা ওয়াসিউল্লাহ্ ইবনে মোহাম্মদ আব্বাস সম্পদিত এবং মক্কা হতে প্রকাশিত মুআস্সাসাত আল রিসালা ১৯৮৩, ১:৪১ # ১১৮ গ্রন্থে বিদ্যমান)। আর তাঁদের উত্তরসূরী হাসান বসরী, সুফিয়ান সাওরীর মতো তাবেঈনবৃন্দ এবং পরবর্তী যুগের অন্যান্য সূফীমন্ডলী যাঁরা ওই পূর্বসূরীদেরকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরাও সেই কপটতার অনুসরণ করেন নি। সূফীকুল শিরোমণি হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ:)-এর কথা ইমাম কুশাইরী বর্ণনা করেন, যিনি বলেন, “তাসাউফ নামায ও রোযার অতি প্রাচুর্য নয়, বরং অন্তরের (কল্বের) পূর্ণতা ও নিজেকে বিলীন করা” (আল্ কুশাইরী প্রণীত ‘রেসালাত কেতাব আল সামা’ অধ্যায়, যা ’আল রাসায়েল আল কুশায়রীয়্যা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত; সিডোন ও বৈরুতস্থ আল মাকতাবা আল আসরিয়্যা ১৯৭০, পৃষ্ঠা ৬০)।

এ ধরনের কপটতার পথ গ্রহণ করেন নি চার মযহাবের ইমামবৃন্দও, যাঁরা  স্রেফ ফরয আদায়ের তৃপ্তির চেয়ে যুহদ (কৃচ্ছব্রত) ও প্রকৃত তাকওয়া (খোদাভীতি)-এর ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করতেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) এই দুটো বিষয়ের ওপর সংশ্লিষ্ট শিরোনামযুক্ত আলাদা দুটো বই লিখেছেন। তিনি সূফী-দরবেশদের জ্ঞানকে (যাহেরী) আলেমদের জ্ঞানের চেয়ে উচ্চমর্যাদা দিয়েছেন, যা তাঁরই শিষ্য আবু বকর আল মারওয়াযীর (রহ:) বর্ণনা থেকে পরিস্ফুট হয়; তিনি বর্ণনা করেন, ফাতাহ্ ইবনে আবি আল্ ফাতাহ্ (রহ:) ইমাম আহমদ হাম্বলের (রহ:) শেষ অসুখের সময় তাঁকে বলেন, “আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যাতে তিনি আমাদেরকে আপনার একজন যোগ্য উত্তরাধিকারী মঞ্জুর করেন।” অতঃপর জিজ্ঞেস করেন, “আপনার পরে আমরা কার কাছে জ্ঞান শিক্ষা করবো?” ইমাম আহমদ (রহ:) উত্তর দেন, “আবদুল ওয়াহ্হাবকে জিজ্ঞেস করো”। ওখানে উপস্থিত কেউ একজন বলে উঠলেন, “কিন্তু তিনি তো বেশি জ্ঞানী নন”। আবু আবদিল্লাহ (ইমাম আহমদ) উত্তর দিলেন, “তিনি একজন দরবেশ, আর তাই সত্য বলার ক্ষেত্রে তাঁকে সাফল্য নসীব করা হয়েছে” (ইমাম আহমদ কৃত ’কিতাব আল ওয়ারা’- বৈরুত দারুল কিতাব আল আরবী ১৪০৯ হিঃ/১৯৮৮ ইং, পৃষ্ঠা-১০)।

সুপ্রসিদ্ধ একটি ফতোওয়ায় শাফেয়ী মযহাবের ইমাম আল্ ইযয্ ইবনে আবদ্ আল সালামও আরেফীনদেরকে (খোদার পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞানীদেরকে) ফেকাহবিদদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করেছেন। ইমাম মালেক (রহ:) অভ্যন্তরীন পূর্ণতার ওপর একই রকম গুরুত্ব  দিয়ে বলেন, “ধর্ম শুধু কিছু বর্ণনার সমষ্টি নয়, বরং অন্তরে আল্লাহ্ তা’লার স্থাপিত নূর (আলো)-ই হলো দ্বীন”। হযরত ইবনে আরবী (রহ:)-কে ইবনে আতাউল্লাহ উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, “নিশ্চয় তা (ঈমান) মস্তিষ্কের প্রমাণাদি থেকে বদ্ধমূল হয় না বরং অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত হয়”।

এ কারণে আমাদের ধর্মের অনেক মহান ইমাম নফস (কৃপ্রবৃত্তি, একগুঁয়ে সত্তা)-এর প্রশিক্ষণ ছাড়া শুধু যাহেরী জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। ইমাম গাযযালী (রহ:) রাজকীয় পদের ও আভিজাত্যপূর্ণ ক্যারিয়ারের মোহ ছেড়ে আত্মিক পরিশুদ্ধির প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ’এহ্ইয়ায়ে উলুম আল দ্বীন’ গ্রন্থের প্রথমেই সেই সব মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন, যারা শুধু ফেকাহকেই (ধর্মের বাহ্যিক আদশে-নিষেধসম্পর্কিত শাস্ত্র) ধর্ম মনে করে থাকেন।

প্রথম দিককার সূফী ও যুগের অন্যতম সেরা হুফফায (হাদীস শাস্ত্রের বিশারদ) হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:)-ও একই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। ধর্মের জন্যে হাদীসের বর্ণনাকে যারা ব্যবহার করে, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “হাদীস যদি শুধু কোনো মাহাত্ম্য (মহৎ/ভাল গুণ) হতো, তাহলে তা হারিয়ে যেতো যেমনিভাবে ভাল কোনো কিছু তিরোহিত হয়েছে। হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের প্রয়াস মৃত্যু-প্রস্তুতির অংশ নয়, বরং তা এমনই এক ব্যাধি যা মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে”। ইমাম যাহাবী এর ব্যাখ্যায় বলেন, “আল্লাহর শপথ! তিনি সত্য বলেছেন। আজকে আমাদের এই যুগে জ্ঞানান্বেষণ ও হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের মানে এখন আর এই নয় যে হাদীসের আলেমকে ওর আরোপিত বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে, যা হাদীসেরই লক্ষ ও উদ্দেশ্য। তিনি যা বলেছেন সত্য বলেছেন এই কারণে যে হাদীস অধ্যয়নের প্রয়াস স্বয়ং হাদীস থেকে ভিন্ন” (ইমাম সাখাবী কৃত ’আল জওয়াহির ওয়া আল-দুরার ফী তারজামাতে শায়খ আল-ইসলাম ইবনে হাজর আল আসকালানী’ - হামিদ আবদ আল-মাজীদ ও তোয়াহা আল-যায়নী সম্পাদিত; কায়রো - উইযারাত আল-আওকাফ, আল-মাজলিস আল-আলা লি আল-শূ’উন আল-ইসলামিয়্যা, লাজনাহ এহ্’ইয়া আল-তুরাস আল-ইসলামি ১৯৮৬; পৃষ্ঠা-২১-২২)।

এই ‘স্বয়ং হাদীসের’ ওয়াস্তে, কুরআনের মর্মবাণী ও মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ জীবনযাপনের খাতিরে, আত্ম-পরিশুদ্ধির মহান ইমামবৃন্দ দুনিয়ার মোহ হিসেবে জ্ঞানান্বেষণকে ত্যাগ করেন, আর এহসান তথা পূর্ণতাপ্রাপ্ত চরিত্র বৈশিষ্ট্য অর্জনকে শ্রেয় বিবেচনা করেন। রাসূলে পাক (দ:)-এর অবস্থা-সম্পর্কিত হযরত আয়েশা (রা:)-এর বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীসের সাথে এই বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ (হুযূরের চরিত্র সম্পর্কে মা আয়েশা বলেন, তাঁর চরিত্র কুরআনের বাস্তব রূপ)। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন হযরত আবু নাসর বিশর আল হাফী (রহ:), যিনি হযরত ফুযায়ল ইবনে আয়ায (রহ:)-এর সোহবতে (সান্নিধ্যে) লাভকৃত সুদৃঢ় ঈমানের তুলনায় হাদীস অধ্যয়নকে থিওরী হিসেবে বিবেচনা করতেন [ইবনে সা’য়াদ রচিত ’তাবাকা’, ৭(২):৮৩; আলুসী কৃত ‘নাতাঈয আল-আফকার আল-কুদসিয়্যা’ (বুলাক, ১৯২০/১৮৭৩); এবং আবদুল ওয়াহহাব শারাওয়ী প্রণীত ‘আল-তাবাকাত আল-কুবরা ১:৫৭]।

এহসান ও তাতে পৌঁছাবার যে প্রক্রিয়া, উভয়ই তাসাউফ হিসেবে জ্ঞাত।


www.sunnah.org/tasawwuf/tazkiyyat_an_nafs.htm 

No comments:

Post a Comment