Thursday 16 May 2013

সূফীবাদের উৎস






সূফীবাদ হলো এমন একটি জ্ঞানের শাখা যা সমগ্র জগতের প্রভু খোদা তা’লার নৈকট্য লাভের বিভিন্ন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়। এর আরও মানে হলো আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং প্রশংসনীয় গুণাবলী দ্বারা আত্মার বিভূষণ। সূফীবাদ এমন একটি পদ্ধতি যার মধ্যে সৃষ্টি লয়প্রাপ্ত হয়ে হক্ক তথা খোদাতা’লার শুহুদ অর্থাৎ দর্শনে বিভোর হয়। অতঃপর আল্ আসর তথা বিস্ময়ের জগতে প্রত্যাবর্তন করে। এর প্রারম্ভে হলো জ্ঞান, মধ্যবর্তী পর্যায়ে হলো কর্ম এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে খোদা তা’লা হতে প্রাপ্ত অপরূপ সুন্দর উপহার।


ইতিহাসে দেখা যাবে সূফীবাদের চারটি প্রধান বিবর্তনকাল: (১) মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের যমানা; (২) হাসান আল্ বসরী (রহ:), রাবেয়া আল্ আদাউইয়্যা (রহ:) প্রমুখ মহান সূফী ব্যক্তিত্বদের সময়কাল; (৩) এই সময়কালে সূফীবাদের বিভিন্ন তত্ত্বকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়; এবং (৪) সূফীবাদের কেন্দ্র ইরাকের বাগদাদ থেকে শুরু করে পূর্বে ইরান ও ভারত এবং পশ্চিমে (মাগরেব) ইউরোপের আন্দালুসিয়া (স্পেন) পর্যন্ত সূফীবাদের প্রচার-প্রসার করা হয় এই সময়কালে।


মহানবী (দ:) ও তাঁর  সাহাবীদের যমানায় ‘সূফীবাদ’ শব্দটি স্বতন্ত্র বা পৃথক কোনো শাস্ত্র হিসেবে বিরাজ করছিল না। বরঞ্চ এটা ইসলামের আধ্যাত্মিকতার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে বিরাজমান ছিল। “এটা ছিল এমন একটা বাস্তবতা যার কোনো নাম (সংজ্ঞা) ছিল না;” সাহাবীদের দ্বারা মহানবী (দ:)-এর হাতে আধ্যাত্মিক দীক্ষা (বায়াত) গ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে এর চর্চা তথা অনুশীলন চলছিল। মহানবী (দ:) ছিলেন তাঁদের কাছে এর ‘মূর্তমান মডেল’ এবং অনুপ্রেরণার উৎস।


আহলুস্ সুফফা (নিচু বারান্দার মানুষ)-দেরকে ইতিহাসে প্রথম দিককার সূফী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কেননা তাঁরা নিয়মিত যিকিরের সমাবেশ করতেন এবং নিচের আয়াতে করীমার আশীর্বাদ লাভের বিষয়বস্তুতে তাঁরা পরিণত হয়েছিলেন: “এবং আপন আত্মাকে তাদেরই সাথে সম্পর্কযুক্ত রাখুন যারা সকাল সন্ধ্যায় আপন প্রতিপালককে আহ্বান করে, তাঁরই সন্তুষ্টি চায় এবং আপনার চক্ষুদ্বয় যেন তাদেরকে ছেড়ে অন্য দিকে না ফেরে; আপনি কি পার্থিব জীবনের শোভা-সৌন্দর্য কামনা করবেন? আর সেই ব্যক্তির কথা মানবেন না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি এবং সে আপন খেয়াল-খুশির অনুসরণ করেছে, আর তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে” (সূরা কাহাফ, ২৮ নং আয়াত)। অতএব এ কথা স্পষ্ট যে আমাদের রাসূলুল্লাহ্ (দ:) খোদায়ী আদেশ পেয়েছিলেন এ মর্মে যে তাঁকে সাহাবীদের ওই দলটির সাথে থাকতে হবে। আহলুস্ সুফফা যা অনেক মুসলমান ইতিহাসবিদদের মতে “সূফী” শব্দটির মূল, তা মহানবী (দ:)-এর সাহাবীদের একটি দলকে বোঝায়, যাঁদের অনেকে ভিনদেশী ছিলেন। যেমন, হযরত বেলাল (রা:) এসেছিলেন ইথিওপিয়া থেকে; হযরত সালমান (রা:) পারস্য থেকে; হযরত সুহাইব (রা:) রোম থেকে। তাঁরা কুরাইশ গোত্র-প্রধানদের অনেক অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হন। তাঁদের পার্থিব গরিবী এবং তাঁদের উন্নত আধ্যাত্মিক মহাপ্রাণতা উভয়ই তাঁদেরকে “ফকির” হিসেবে বর্ণনা করার যোগ্যতা এনে দিয়েছে; ফকির হলেন এমন ব্যক্তি যিনি আল্লাহ্ তা’লার সামনে গরিব। ওই একই বিবেচনায় তাঁদেরকে “মুরিদ”-ও বলা চলে; কেননা একজন মুরিদ বলতে আল্লাহ্ তা’লার জ্ঞানে উপনীত হতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিকে বোঝায়। এই শব্দটি কুরআনের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- “ইউরিদুনা ওয়াজহাহু” (তাঁর চেহারার দর্শন পেতে ইচ্ছুক)। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে “ইউরিদু” ক্রিয়াটি যার অর্থ “ইচ্ছা পোষণ করা”। যে ব্যক্তি এ রকম ইচ্ছা পোষণ করেন তাঁকে মুরিদ বলা হয়।


সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (রা:) হলেন আমাদের হুজূর পূর নূর (দ:)-এর চাচাতো ভাই, মেয়ের জামাই ও সাহাবী। রাসূলে পাক (দ:) হতে আধ্যাত্মিক সিলসিলার (চেইনের) প্রধান উৎস হলেন তিনি। অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছেন হযরত আনাস্ বিন মালিক (রা:) এবং হযরত সালমান ফার্সী (রা:)।


তাসাউফ তথা সূফীতত্ত্ব ইসলামের আধ্যাত্মিকতা অর্থাৎ হাকিকত বা অন্তর্নিহিত সত্যকে নিয়ে চর্চা করে; ঠিক যেমনিভাবে শরীয়ত তার একমাত্র প্রকৃত উৎস নবুয়্যত নিয়ে ব্যাপৃত। এ কারণেই প্রথম প্রজন্মের সাধকদের সাধনাকে সূফীবাদের অন্তর্নিহিত বাস্তবতা অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছিল, যদিও ওই সময় “সূফীবাদ” শব্দটির প্রচলন ছিল না। এই প্রেক্ষিতে আল্ হুজউইরীর কথা উপলব্ধি করা সহজ; তিনি বলেন: “আজকে তাসাউফ হলো বাস্তবতাবিহীন একটি নাম, অথচ এটা ছিল নামবিহীন এক বাস্তবতা।” আল্ হুজউইরী আরও বলেন: ‘সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের উত্তরসূরীদের সময় এই নামটির অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু এটা যে বাস্তবতার ইঙ্গিত বহন করতো তা তাঁদের প্রত্যেকেরই জানা ছিল।”


অতএব, সূফীবাদের নির্যাস ও নীতিমালাকে এর ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রকাশ থেকে পৃথক করা জরুরি। আল্ কুরআন ও তার প্রকৃত উৎস তথা খোদা ত’লার নৈকট্য হতে উৎসারিত ঐশী আলো ও গোপন বিষয়াদি নিয়ে সূফীবাদ তত্ত্বচর্চা করে। এই বিশেষ কারণেই সূফীবৃন্দ তাসাউফ বিদ্যাকে খোদা তা’লার নৈকট্য হতে উদ্ভূত জ্ঞান হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন (ইলমে লাদুন্নী)। এই জ্ঞানের শাখাকে যওক তথা স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে আহরিত হিসেবে সাধারণত বর্ণনা করা হয়; অর্থাৎ খোদা তা’লার নৈকট্যের ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতার আলোকে।


মহানবী (দ:) এই জ্ঞান সম্পর্কে বলেছিলেন, “সে ঈমানের সুগন্ধের স্বাদ গ্রহণ করেছে” (যাকা তা’মী আল্ ঈমান; মুসলিম শরীফ, ১১)। এখানে উল্লেখ্য যে, সূফীবাদের কতিপয় বিরোধিতাকারী এর অস্বীকার করে থাকেন এ কথা বলে যে মহানবী (দ:)-এর সময় সূফীবাদের অস্তিত্ব ছিল না। এই সমালোচকরা এটা বুঝতে অক্ষম যে ফিকাহ্, তাফসীর ইত্যাদি জ্ঞানের শাখার মতোই তাসাউফ তথা সূফীতত্ত্ব একটি জ্ঞানের শাখা। আল্ কুরআনের ঐশী বাণীতে ইতোমধ্যে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান সম্ভাবনাগুলোর বাস্তবায়নে এ সকল জ্ঞান সাহায্য করে থাকে। এগুলোর প্রায় একই সময়ে অবির্ভাবের কারণ হলো ঐশী বাণীতে প্রকাশিত নীতিমালা, জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার আলো সম্পর্কে মুসলমান সমাজের প্রয়োজন পূরণ। উপরন্তু, সূফীবাদের বাস্তবতা-সম্পর্কিত ‘হাদীসে জিবরীল’ নামে খ্যাত প্রসিদ্ধ হাদীসে মহানবীকে (দ:) এহ্সান (ঈমান ও নৈতিকতায় উৎকর্ষ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি উত্তরে এরশাদ ফরমান: “আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী এমনভাবে করো যেন তুমি তাঁকে দেখছো; আর তুমি যদি তাঁকে না দেখতে পাও, তবে এটা জেনে তা পালন করো যে তিনি তোমাকে দেখছেন।”


সূফীবৃন্দ ও উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, এই উৎকর্ষের মকাম বা মর্যাদা হচ্ছে নবী করীম (দ:)-এর মহান চরিত্র ও শিষ্টাচার (মাকারীম আখলাক) অনুকরণকারীর আধ্যাত্মিক মকাম এবং আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য সব কিছু থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার পর্যায়/স্তর। মহানবী (দ:)-এর মহান চরিত্র অনুকরণ সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের চেয়ে আর কেউ এতো ভালভাবে করতে পারেন নি। এ কারণে সূফীবৃন্দ নিশ্চিত যে সকল সাহাবীই প্রকৃত সূফী ছিলেন, ‘সূফী’ শব্দটির ঐতিহাসিক উৎস যাই হোক না কেন। সূফীবাদের ওপর ঐতিহ্যবাহী লেখনীতে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও সূফী বিশ্বাস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এবং সেগুলোর ভিত্তি, নীতিমালা, পদ্ধতি ও আধ্যাত্মিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কেও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এই ব্যাখ্যাগুলো উপকারী, কেননা এগুলো  কেবল বিরূপ সমালোচনার জবাব-ই দেয় না, বরং যারা মজলিসে যিকরিল্লাহর তথা খোদ তা’লার স্মরণের সমাবেশ তালাশ করেন এবং আধ্যাত্মিক মহব্বতের স্বাদ গ্রহণ করতে চান, তাদের মাঝে এগুলো আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে। প্রত্যেক যমানার সকল সূফী তরীকার এটাই হলো মূল উদ্দেশ্য। হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ:) বলেন, “আমাদের এ মযহাব (পথ) কুরআন ও সুন্নাহর নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের এই জ্ঞান মহানবী (দ:)-এর বাণীর মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়।” (রেসালায়ে কুশায়রীয়া)


মূল: www.sufiway,net শীর্ষক ওয়েবসাইটের ‘সূফীবাদের উৎস’ প্রবন্ধের অনুবাদ
অনুবাদক: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন



No comments:

Post a Comment