তাসাউফ (সূফীতত্ত্ব)
মূল: শায়খ হিশাম কাব্বানী (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
“রাসূলে পাক (দ:)-এর সময় তাসাউফ ছিল একটি বাস্তবতা যার কোনো নাম ছিল না। আজকে তাসাউফ হলো একটি নাম, কিন্তু এর বাস্তবতা সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন।”
বর্তমানে মুসলমান জাতির জন্যে প্রয়োজন এমন সুজ্ঞানী ব্যক্তিত্বদের যাঁরা ইসলামের সঠিক শিক্ষা অনুশীলন করেন (আ’লিমুন আ’মিল); যুগে যুগে ক্ষয়ে যাওয়া ইসলামী মূল্যবোধ ও সভ্যতা-সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যাঁরা সাধ্যানুযায়ী সচেষ্ট এবং যাঁরা হক (সত্য) ও বাতেলের (মিথ্যার) মধ্যে, হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম; আর যাঁরা আল্লাহর পথে কাউকে ভয় না করেই হক্ক-এ বিশ্বাস করেন এবং বাতেলের বিরুদ্ধাচরণ করেন।
আজকের মুসলামান সমাজকে সত্য, সঠিক পথের দিকে, ধর্মের শিক্ষার দিকে পরিচালনা করার মতো আলেমের সংখ্যা নেই বল্লেই চলে। পক্ষান্তরে, আমরা এমন কিছু আলেমের দেখা পাই যারা ইসলাম সম্পর্কে জানার ভান করেন, অথচ ইসলামের নামে সবার ওপর নিজেদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা চাপিয়ে দেবার চেষ্টায় রত থাকেন। তারা সকল সভা-সমিতি, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দান করেন এবং নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও সীমাবদ্ধ জ্ঞানের আলোকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লেকচার ও বয়ান দেন। এ ধরনের বক্তব্য নবী করীম (দ:)-এর সাহাবীদের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, ইসলামের মহান ইমামদের সাথেও নয়, অধিকাংশ মুসলামানদের ঐকমত্যের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আলেম-উলামা যদি নিজেদের বিবেকের কথা শুনতেন ও ইসলামের প্রতি অনুগত ও নিষ্ঠাবান হতেন, আর অর্থের জোরে মুসলমান দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সরকার ও শক্তিগুলোর প্রভাবমুক্ত হয়ে শুধু দাওয়া ও ইরশাদের (প্রচার) কাজে নিয়োজিত হতেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর স্মরণে মশগুল থাকতেন, তাহলে ইসলামী বিশ্বের পরিস্থিতি ও চেহারা পাল্টে যেতো এবং মুসলমানদেরও প্রভূত উন্নতি সাধিত হতো। আমরা আশা করবো, মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ্ ও শরীয়তকে প্রতিষ্ঠা করতে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের মুসলমান একতাবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবেন।
ইতিহাসকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে সাহাবায়ে কেরামের কঠিন পরিশ্রমের পরে পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার (দাওয়া ও ইরশাদ) ঘটেছিল তাসাউফ (সূফীবাদ)-এর জ্ঞানী বুযূর্গানে দ্বীন ও তাঁদের অনুসারীদের মাধ্যমে, যাঁরা মহানবী (দ:)-এর খলীফাবৃন্দের সঠিক পথের অনুসারী ছিলেন। তাঁরা প্রকৃত সূফীবাদের আলেম ছিলেন, যে সূফী মতবাদ কুরআন ও হাদীসের শিক্ষাসমূহ সমুন্নত রেখেছে এবং তা থেকে বিচ্যুত হয় নি।
ইসলামী যুহদ (কৃচ্ছব্রত) প্রথম হিজরী শতকে বিকশিত হয়েছিল এবং বিভিন্ন তরীকায় পরিণত হয়েছিল; এ সব তরীকার ভিত্তি ছিল কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা এবং এগুলো প্রচার করতেন যাহেদ উলামায়ে কেরাম যাঁরা পরবর্তীকালে সূফী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রথম চার ইমাম, যথা-ইমাম মালেক (রহ:), ইমাম আবু হানিফা (রহ:), ইমাম শাফেয়ী (রহ:), ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:); আরও রয়েছেন ইমাম আবি আব্দাল্লাহ্ মোহাম্মদ আল্ বুখারী (রহ:), আবু হুসাইন মুসলিম বিন আল্ হাজ্জাজ (রহ:), আবু ঈসা তিরমিযী (রহ:) প্রমুখ। অতঃপর যাঁরা আগমন করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম হাসান আল্ বসরী, ইমাম আওযাঈঁ (রহ:)। এঁদের পরে এসেছেন আত্ তাবারানী (রহ:), ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহ:), ইবনে হাজর আল্ হায়তামী (রহ:), আল্ জর্দানী, আল্ জওযী, ইমাম মহিউদ্দীন বিন শারফ বিন মারী বিন হাসান বিন হুসাইন বিন হাযম বিন নববী (রহ:), সৈয়দ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দী (রহ:) প্রমুখ। এসব যাহেদ আলেম তাঁদের আনুগত্য, নিষ্ঠা ও অন্তরের পরিশুদ্ধির কারণে সূফী হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন এবং তাঁদের চেষ্টার ফলেই মুসলমান বিশ্ব আজকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
আমরা এ তথ্যটি গোপন করতে চাই না যে, ওই সময় কিছু ইসলামের শত্রু সীমা লংঘন করে সূফীবাদের নামে ও সূফী হবার ভান করে প্রকৃত সূফী দর্শনকে ধ্বংস করার অসৎ উদ্দেশ্যে এবং মুসলমানদের মনকে সূফী দর্শনের প্রতি তিক্ত করার লক্ষ্যে নিজেদের মনগড়া মতবাদ পরিবেশন করেছিল। উল্লেখ্য যে, ওই সময় সূফী মতাদর্শ মুসলমানদের মধ্যে মূলধারা ছিল। প্রকৃত তাসাউফ যুহদ ও এহ্সান (অন্তরের পবিত্রতা)-এর ওপর ভিত্তিশীল। মুসলিম বিশ্বের মহান ইমামবৃন্দ যাঁদেরকে সকল মুসলমান দেশে অনুসরণ করা হতো, তাঁরা সূফী গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইমাম মালেক (রহ:), ইমাম আবু হানিফা (যাঁর পীর ছিলেন ইমাম জা’ফর সাদেক-রহ:), ইমাম শাফেয়ী (যিনি শায়বান আর রায়কে পীর হিসেবে অনুসরণ করতেন) ও ইমাম হাম্বল (যাঁর মুরশিদ ছিলেন বিশর আল্ হাফী) সকলেই তাসউফকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
মুসলমান দেশগুলোর সকল বিচারালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় অদ্যাবধি এই চার ইমামের মযহাবগুলোর শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, মিসর, লেবানন, জর্দান, ইয়েমেন, জিবুতি ও আরও কিছু দেশ শাফেয়ী মযহাব অনুসরণ করে। সুদান, মরক্কো, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া ও সোমালিয়া মালেকী মযহাবের অনুসারী। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান এবং আরও কিছু দেশ হাম্বলী মযহাব অনুসরণ করে। তুরস্ক, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং রুশীয় কিছু মুসলমান প্রজাতন্ত্রের দেশে হানাফী মযহাব অনুসরণ করা হয়। মুসলমান দেশগুলোর বিচারালয়ের অধিকাংশই এই চার মযহাবের ফতোওযা অনুযায়ী চলে। আর এই চার মযহাবের সবগুলোই তাসাউফকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।
ইমাম মালেক (রহ:)-এর একটি বিখ্যাত বাণী আছে, যার মধ্যে তিনি বলেন- “মান তাসাওয়াফ্ফা ওয়া লাম ইয়াতাফাকাহা ফাকাদ তাযানদাকা; ওয়া মান তাফাকাহা ওয়া লাম ইয়াতাসাওয়াফা ফাকাদ তাফাসাক; ওয়া মান তাসাওয়াফ্ফা ওয়া তাফাকাহা ফাকাদ তাহাকাক।” অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি ফেকাহ্ ছাড়া তাসাউফ শিক্ষা করে, সে যিনদিক তথা গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হয়; আর যে ব্যক্তি তাসাউফ বাদ দিয়ে ফেকাহ্ শিক্ষা করে সে ফাসিক গুনাহ্গার হয়; কিন্তু যে ব্যক্তি তাসাউফ ও ফেকাহ দুটোই শিক্ষা করে, সে সত্য ও ইসলামের বাস্তবতাকে খুঁজে পায়।”
ভ্রমণ করা যখন সবচেয়ে কঠিন ছিল এমনি এক সময়ে ইসলাম ধর্ম সূফী পর্যটকদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় দ্রুত প্রসার লাভ করে; এই সূফীবৃন্দ এতো বড় মহান কাজের জন্যেই আল্লাহর পছন্দকৃত বান্দা হবার শর্ত যুহদ আদ্ দুনইয়া (কৃচ্ছব্রত)-তে সুশিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠেছিলেন। তাঁদের জীবনই ছিল দাওয়া, আর তাঁদের খাদ্য ছিল রুটি ও পানি। তাঁদের এই সংযম দ্বারা ইসলামের আশীর্বাদে তাঁরা পশ্চিম থেকে দূর প্রাচ্যে পৌঁছেছিলেন।
হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে সূফী গুরুদের প্রচেষ্টা ও অগ্রগতির ফলে তাসাউফ ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করে। প্রতিটি সূফী তরীকা তার মুরশিদের নামে পরিচিতি লাভ করে, যাতে করে অন্যান্য তরীকা থেকে তাকে পৃথকভাবে চেনা যায়। একইভাবে আজকে প্রত্যেক ব্যক্তি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিজ নামের সাথে বহন করেন। এটা নিশ্চিত যে ইসলাম ধর্ম একই থাকে, এক সূফী পীর থেকে অন্য সূফী পীরে কখনো পরিবর্তিত হয় না; ঠিক যেমনি ইসলামী শিক্ষা এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তিত হয় না।
তবে, অতীতে শিক্ষার্থীরা (মুরিদরা) তাঁদের পীরের উন্নত নৈতিকতা ও আচার ব্যবহারে প্রভাবিত হতেন। সে কারণে তাঁরা একনিষ্ঠ ও অনুগত ছিলেন। কিন্তু আজকে আমাদের আলেম-উলামা সেই ধরনের দিক-নির্দেশনা দিতে অক্ষম এবং তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে শিখতে হচ্ছে অমুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে, অমুসলিম শিক্ষকদের কাছ থেকে।
সূফী গুরুগণ তাঁদের মুরিদদেরকে বলতেন আল্লাহ্ তা’লাকে স্রষ্টা হিসেবে এবং তাঁর রাসূলকে তাঁরই হাবীব ও নবী হিসেবে গ্রহণ করতে; আরও নির্দেশ দিতেন একমাত্র আল্লাহ্ তা’লার এবাদত করতে এবং মূর্তি পূজা পরিহার করতে; খোদা তা’লার কাছে তওবা করতে; নবী (দ:)-এর সুন্নাহ্ অনুসরণ করতে; আর নিজেদের অন্তর পরিশুদ্ধ করতে; যাবতীয় ভুল-ত্রুটি থেকে নিজেদের সত্তাকে পরিচ্ছন্ন করতে এবং আল্লাহর একত্বে তাদের বিশ্বাসকে সদৃঢ় করতে। মুরিদবৃন্দকে তাঁরা শিক্ষা দিয়েছিলেন যাতে সকল কাজে তাঁরা সৎ ও আস্থাভাজন হন, যাতে তাঁরা খোদার ওপর নির্ভর করেন এবং সকল সৎগুণাবলীর অধিকারী হন, যা ইসলাম আমাদের কাছে দাবি করে।
আন্তরিকতা ও পবিত্রতার এ সব মকাম (স্তর) অর্জনের উদ্দেশ্যে সূফী পীরবৃন্দ তাঁদের মুরিদদেরকে বিভিন্ন দোয়া কালাম শিখিয়েছিলেন যা নবী (দ:), তাঁর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনবৃন্দের আমল ছিল। তাঁরা শিক্ষা দিয়েছিলেন যিকরুল্লাহ্ তথা আল্লাহর স্মরণ, কুরআন পাঠের মাধ্যমে; দোয়া ও তসবীহ, হাদীস শরীফ হতে; আর আল্লাহর নাম ও সিফাত (গুণ)-এর তসবীহ-তাহলীল, তাকবীর ও তামজীদ-এর মাধ্যমে তাঁরাই শিক্ষা দিয়েছিলেন। এগুলো যিকর-সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস্ দ্বারা সমর্থিত (সহীহ্ বুখারী, মুসলিম, তাবারানী, ইবনে মাজাহ্, আবু দাউদ ইত্যাদি হাদীসের গ্রন্থে ইসলামে যিকর শীর্ষক অধ্যায়ে এগুলো পাওয়া যায়)।
এ সকল সূফী মুরশিদ (প্রকৃত আলেম-উলামা) খ্যাতি ও উচ্চ পদকে, অর্থবিত্ত ও বস্তুবাদী জীবনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁরা আমাদের যমানার আলেম-উলামার মতো ছিলেন না, যারা যশ-প্রতিপত্তি ও অর্থবিত্তের পেছনে ছুটছেন। বরঞ্চ তাঁরা ছিলেন যাহেদ ও আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল, যেমনিভাবে কুরআনে তিনি আদেশ করেছেন, “মা খালাকতুল জিন্নী ওয়াল ইনসী ইল্লা লি ইয়া’বুদুন।” অর্থাৎ, “আমি জ্বিন ও ইনসান (মানব) জাতি দুটোকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার এবাদত করার উদ্দেশ্যে”।
সূফীবৃন্দের শিষ্টাচার ও যুহদের ফলে তাঁরা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন সারা মুসলিম জাহানে মসজিদ ও খানেকাহ্ নির্মাণ করতে। বস্তুতঃ এখানে গরীবদের ফ্রি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে খানেকাহ্ ও মসজিদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রসার লাভ করে। এ সব আশ্রয়স্থল, যেখানে গরিব মানুষেরা খেতে পেতো ও ঘুমোতে পারতো এবং আশ্রয়হীনরা মাথা গুজবার ঠাঁই পেতো, সেগুলো ছিল গরিবদের অন্তরের জন্যে নিরাময়স্বরূপ; সেগুলো আরও ছিল ধনী ও গরিবের, সাদা ও কালো, হলুদ ও লাল বর্ণের মানুষের, আরব ও অনারবের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার এবং একাত্ম হবার স্থান।
হযরত রাসূলে করীম (দ:) একটি হাদীসে এরশাদ ফরমান- “আরব ও অনারবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, শুধু ন্যায়-নীতি দ্বারাই পার্থক্য করা হবে”।
এ সকল খানেকাহ্ পৃথিবীর সমস্ত জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের জন্যে সম্মিলনস্থলে পরিণত হয়। সূফীবৃন্দ সুন্নাহ্ এবং শরীয়তকে সমুন্নত রেখেছিলেন। তাঁদের ইতিহাস হলো আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম (জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্) করার সাহসিকতায় ভরা; নিজেদের দেশ ছেড়ে মানুষের মন জয় করার ও ভালবাসা দিয়ে তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় আনার সংগ্রাম। তাঁরা জাতি-গোষ্ঠী, বয়স ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ভালবেসেছিলেন। তাঁরা সবাইকে সম্মান করেছেন, বিশেষ করে অবহেলিত নারী সমাজ ও গরিব-দুঃস্থ মানুষকে। সূফীবৃন্দ ছিলেন পৃথিবীতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো, সর্বত্র দেদীপ্যমান; তাঁরা সবাইকে জেহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্ তথা আল্লাহর রাস্তায় কঠিন সাধনা করতে উৎসাহিত করেছিলেন; ইসলাম প্রচার-প্রসারে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন; গরিবদেরকে সাহায্য করতে বলেছিলেন। তাঁরা ঈমানী দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন মধ্য এশিয়া থেকে ভারত, পাকিস্তান, তাশখন্দ, বোখারা, দাগিস্তান এবং চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অন্যান্য অঞ্চলে।
প্রকৃত সূফীবৃন্দ কখনোই মহানবী (দ:)-এর শরীয়ত ও সুন্নাহ থেকে এবং কুরআন মজীদ থেকে বিচ্যুত হন নি, যদিও কিছু সূফী জযবা হালতে তথা ঐশী ভাবোন্মত্ত অবস্থায় কিছু উক্তি করেছেন এবং আল্লাহর মাহাত্ম্য ও মহানবী (দ:)-এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তাসাউফের প্রধান বা মূল দু’টি উৎস কুরআন মজীদ ও মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ যা সাইয়্যেদুনা হযরত আবু বকর (রা:) ও সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (রা:)-এর ইসলাম-সম্পর্কিত উপলব্ধির মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। এই দু’জন সাহাবীকে সূফী তরিকাহ্সমূহের উৎসমূল বিবেচনা করা হয়। হযরত আবু বকর (রা:) তাসাউফের একটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তাঁর সম্পর্কে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান- “মা সা’ব-আল্লাহু ফী সাদরী শাইয়ান্ ইল্লা ওয়া সাআবতুহু ফী সাদরি আবি বাকরিন।” অর্থাৎ, আল্লাহ্ পাক যা কিছু আমার অন্তরে ঢেলেছেন তার সবই আমি আবু বকরের (রা:) অন্তরে ঢেলেছি” (ইমাম আব্দুল গনী নাবলুসী প্রণীত হাদিকাতুন নদীয়া, কায়রোতে প্রকাশিত, ১৩১৩ হিজরী, পৃষ্ঠা ৯)। আল্লাহ্ তা’লা কুরআন মজীদে এরশাদ ফরমান- “তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ তাঁকে (নবী করীম) সাহায্য করেছেন যখন কাফেরদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁকে বাইরে তাশরীফ নিয়ে যেতে হয়েছে; একজন ছাড়া তাঁর আর কোনো সঙ্গী ছিল না; তাঁরা দু’জনই গুহার মধ্যে ছিলেন” (সুরা তাওবা, ৪০ নং আয়াত)।
রাসূলে আকরাম (দ:) আরেকটি হাদীস শরীফে এরশাদ ফরমান- “আম্বিয়া (আ:) ছাড়া আবু বকরের (রা:) মতো আর কারো ওপর সূর্য এমনভাবে উদিত হয় নি” (ইমাম সৈয়ুতী রচিত খলিফাদের ইতিহাস, কায়রো, ১৯৫২, পৃষ্ঠা ৪৬)। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)-এর মকাম (মর্যাদা) ব্যাখ্যাকারী আরও অনেক হাদীস আছে। তাসাউফের অপর ধারাটি সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (রা:)-এর মাধ্যমে এসেছে; তাঁর সম্পর্কে বহু হাদীস্ বর্ণিত হয়েছে যা ব্যাখ্যা করতে অনেক পৃষ্ঠা ব্যয় হবে। পরিশেষে, মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ্ ও শরীয়ত, যা ফরয (অবশ্য কর্তব্য) ও এহ্সান (আধ্যাত্মিকতা)-এর প্রতিনিধিত্ব করে, তা সূফী বুযুর্গদের চরিত্রে মূর্ত প্রকাশিত ছিল।
হিজরী ১৩ শতাব্দীতে একটি নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে যারা ৭ম হিজরীর দু’জন আলেমের শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এরা নিজেদেরকে হাম্বলী মযহাবের অনুসারী দাবি করলেও ওই মযহাবের আকিদা-বিশ্বাস থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা তাসাউফ সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং চার মযহাব থেকে বিচ্যুত হয়।
সাম্প্রতিককালে ওই নতুন গোষ্ঠীর অনুসারীরা সীমা লংঘন করে তাদের আধুনিক যুগের গুরুদের ফতোওয়ার ওপর ভিত্তি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করছে। এই সব গোষ্ঠী-প্রধান নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ফতোওয়া প্রদান করে মুসলমানদের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বর্তমানে এরাই সূফীতত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করেছে এবং বিগত ১৪০০ বছর যাবত ইসলাম প্রচার-প্রসারে সূফীদের সমস্ত অবদানকে মুছে ফেলতে চাচ্ছে।
আমাদের মুসলমান ভাই ও বোনদের জ্ঞাতার্থে আমরা বিভিন্ন মুসলমান দেশের অগণিত সূফী তাত্ত্বিকদের মধ্য থেকে কয়েকজনের নাম এখানে উপস্থাপন করছি:
(১) মিসরীয় মূফতী হাস্সানাইন মোহাম্মদ আল্ মুখলুফ, মুসলিম ওয়ার্ল্ডে লীগের সদস্য;
(২) মোহাম্মদ আত্ তাইয়ের আন্ নাজ্জার, সুন্নাহ্ এন্ড শরীয়াহ্ ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি এবং আল্ আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি;
(৩) শায়খ আব্দুল্লাহ্ কানুন আল্ হাসানী, মরক্কোর উলামা সংস্থা প্রধান এবং ওয়ার্ল্ড ইসলামিক লীগের ডেপুটি;
(৪) ডঃ হুসাইনী হাশিম, মিসর আল্ আযহারের ডেপুটি এবং মক্কার রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মহাসচিব;
(৫) সাইয়্যেদ হাশিম আল্ রেফাঈঁ, কুয়েত সরকারের সাবেক ধর্মমন্ত্রী;
(৬) শায়খ সাইয়্যেদ আহমদ আল্ আওয়াদ, সুদানের মুফতী;
(৭) উস্তায আব্দুল গফুর আল্ আত্তার, সৌদি আরবীয় লেখক সমাজের সভাপতি;
(৮) কাযী ইউসুফ বিন আহমদ আস্ সিদ্দিকী, বাহরাইনী হাইকোর্টের জজ;
(৯) মোহাম্মদ খাযরাজী শায়খ আহমদ বিন মোহাম্মদ বিন যাবারা, ইয়েমেনের মুফতী;
(১০) শায়খ মোহাম্মদ শাযিলী নিভার, তিউসিশিয়ার শরীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট;
(১১) শায়খ খাল আল্ বানানী, মৌরিতানিয়ার ইসলামিক লীগের সভাপতি;
(১২) শায়খ মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহিদ আহমদ, মিসরের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী;
(১৩) শায়খ মোহাম্মদ বিন আলী হাবাশী, ইন্দোনেশিয়ার ইসলামিক লীগ সভাপতি;
(১৪) শায়খ আহমদ কোফ্তারো, সিরিয়ার মুফতী;
(১৫) শায়খ আবু সালেহ্ মোহাম্মদ আল্ ফাত্তিহ্ আল্ মালেকী, ওনদুরমান, সুদান;
(১৬) শায়খ মোহাম্মদ রাশিদ কাব্বানী, লেবাননের মুফতী;
(১৭) শায়খ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ মালেকী আল্ হাসানী, শরীয়ার অধ্যাপক এবং মক্কা ও মদীনার দু’টো পবিত্র মসজিদে শিক্ষক;
এবং আরো অগণিত সূফীবাদী হক্কানী উলামায়ে কেরাম।
ওহে আমাদের মুসলমান ভাই ও বোনেরা! ইসলাম হলো সহিষ্ণুতা (হিলম্), ভালবাসা, শান্তি; ইসলাম হলো যুহুদ, এহ্সান; ইসলাম মানে সুসম্পর্ক; ইসলাম মানে পরিবার, ভ্রাতৃত্ব; ইসলাম মানে সাম্য; ইসলাম হলো একটি দেহ; ইসলাম হলো জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা; ইসলামের যাহেরী (প্রকাশ্য) ও বাতেনী (অপ্রকাশ্য) জ্ঞান বিদ্যমান; ইসলামের অপর নাম সূফীবাদ, আর সূফীবাদই হলো ইসলাম।
পরিশেষে বলবো, ইসলাম ধর্ম হলো আমাদের প্রতি আল্লাহ্তা’লার প্রেরিত আলো যা তিনি সর্বশেষ নবী (দ:)-এর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন; এই নবী (দ:) হলেন ভালবাসার ও যাহেরী-বাতেনী জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক; সকল মানবের জন্যে তিনি করুণার প্রতীক। তিনি খোদার কাছে আমাদের মধ্যস্থতাকারী; সবার জন্যে তিনি শাফায়াতকারী, যে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আল্লাহ্ তা’লা আমাদের এ লেখায় ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করুন, আমীন।
[এ লেখাটি As-Sunnah Foundation of America-এর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এর লেবাননী বংশোদ্ভূত লেখক ওই ফাউন্ডেশনেরই সভাপতি। যোগাযোগ: www.sunnah.org]
মূল: শায়খ হিশাম কাব্বানী (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
“রাসূলে পাক (দ:)-এর সময় তাসাউফ ছিল একটি বাস্তবতা যার কোনো নাম ছিল না। আজকে তাসাউফ হলো একটি নাম, কিন্তু এর বাস্তবতা সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন।”
বর্তমানে মুসলমান জাতির জন্যে প্রয়োজন এমন সুজ্ঞানী ব্যক্তিত্বদের যাঁরা ইসলামের সঠিক শিক্ষা অনুশীলন করেন (আ’লিমুন আ’মিল); যুগে যুগে ক্ষয়ে যাওয়া ইসলামী মূল্যবোধ ও সভ্যতা-সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যাঁরা সাধ্যানুযায়ী সচেষ্ট এবং যাঁরা হক (সত্য) ও বাতেলের (মিথ্যার) মধ্যে, হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম; আর যাঁরা আল্লাহর পথে কাউকে ভয় না করেই হক্ক-এ বিশ্বাস করেন এবং বাতেলের বিরুদ্ধাচরণ করেন।
আজকের মুসলামান সমাজকে সত্য, সঠিক পথের দিকে, ধর্মের শিক্ষার দিকে পরিচালনা করার মতো আলেমের সংখ্যা নেই বল্লেই চলে। পক্ষান্তরে, আমরা এমন কিছু আলেমের দেখা পাই যারা ইসলাম সম্পর্কে জানার ভান করেন, অথচ ইসলামের নামে সবার ওপর নিজেদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা চাপিয়ে দেবার চেষ্টায় রত থাকেন। তারা সকল সভা-সমিতি, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দান করেন এবং নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও সীমাবদ্ধ জ্ঞানের আলোকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লেকচার ও বয়ান দেন। এ ধরনের বক্তব্য নবী করীম (দ:)-এর সাহাবীদের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, ইসলামের মহান ইমামদের সাথেও নয়, অধিকাংশ মুসলামানদের ঐকমত্যের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আলেম-উলামা যদি নিজেদের বিবেকের কথা শুনতেন ও ইসলামের প্রতি অনুগত ও নিষ্ঠাবান হতেন, আর অর্থের জোরে মুসলমান দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সরকার ও শক্তিগুলোর প্রভাবমুক্ত হয়ে শুধু দাওয়া ও ইরশাদের (প্রচার) কাজে নিয়োজিত হতেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর স্মরণে মশগুল থাকতেন, তাহলে ইসলামী বিশ্বের পরিস্থিতি ও চেহারা পাল্টে যেতো এবং মুসলমানদেরও প্রভূত উন্নতি সাধিত হতো। আমরা আশা করবো, মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ্ ও শরীয়তকে প্রতিষ্ঠা করতে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের মুসলমান একতাবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবেন।
ইতিহাসকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে সাহাবায়ে কেরামের কঠিন পরিশ্রমের পরে পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার (দাওয়া ও ইরশাদ) ঘটেছিল তাসাউফ (সূফীবাদ)-এর জ্ঞানী বুযূর্গানে দ্বীন ও তাঁদের অনুসারীদের মাধ্যমে, যাঁরা মহানবী (দ:)-এর খলীফাবৃন্দের সঠিক পথের অনুসারী ছিলেন। তাঁরা প্রকৃত সূফীবাদের আলেম ছিলেন, যে সূফী মতবাদ কুরআন ও হাদীসের শিক্ষাসমূহ সমুন্নত রেখেছে এবং তা থেকে বিচ্যুত হয় নি।
ইসলামী যুহদ (কৃচ্ছব্রত) প্রথম হিজরী শতকে বিকশিত হয়েছিল এবং বিভিন্ন তরীকায় পরিণত হয়েছিল; এ সব তরীকার ভিত্তি ছিল কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা এবং এগুলো প্রচার করতেন যাহেদ উলামায়ে কেরাম যাঁরা পরবর্তীকালে সূফী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রথম চার ইমাম, যথা-ইমাম মালেক (রহ:), ইমাম আবু হানিফা (রহ:), ইমাম শাফেয়ী (রহ:), ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:); আরও রয়েছেন ইমাম আবি আব্দাল্লাহ্ মোহাম্মদ আল্ বুখারী (রহ:), আবু হুসাইন মুসলিম বিন আল্ হাজ্জাজ (রহ:), আবু ঈসা তিরমিযী (রহ:) প্রমুখ। অতঃপর যাঁরা আগমন করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম হাসান আল্ বসরী, ইমাম আওযাঈঁ (রহ:)। এঁদের পরে এসেছেন আত্ তাবারানী (রহ:), ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহ:), ইবনে হাজর আল্ হায়তামী (রহ:), আল্ জর্দানী, আল্ জওযী, ইমাম মহিউদ্দীন বিন শারফ বিন মারী বিন হাসান বিন হুসাইন বিন হাযম বিন নববী (রহ:), সৈয়দ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দী (রহ:) প্রমুখ। এসব যাহেদ আলেম তাঁদের আনুগত্য, নিষ্ঠা ও অন্তরের পরিশুদ্ধির কারণে সূফী হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন এবং তাঁদের চেষ্টার ফলেই মুসলমান বিশ্ব আজকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
আমরা এ তথ্যটি গোপন করতে চাই না যে, ওই সময় কিছু ইসলামের শত্রু সীমা লংঘন করে সূফীবাদের নামে ও সূফী হবার ভান করে প্রকৃত সূফী দর্শনকে ধ্বংস করার অসৎ উদ্দেশ্যে এবং মুসলমানদের মনকে সূফী দর্শনের প্রতি তিক্ত করার লক্ষ্যে নিজেদের মনগড়া মতবাদ পরিবেশন করেছিল। উল্লেখ্য যে, ওই সময় সূফী মতাদর্শ মুসলমানদের মধ্যে মূলধারা ছিল। প্রকৃত তাসাউফ যুহদ ও এহ্সান (অন্তরের পবিত্রতা)-এর ওপর ভিত্তিশীল। মুসলিম বিশ্বের মহান ইমামবৃন্দ যাঁদেরকে সকল মুসলমান দেশে অনুসরণ করা হতো, তাঁরা সূফী গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইমাম মালেক (রহ:), ইমাম আবু হানিফা (যাঁর পীর ছিলেন ইমাম জা’ফর সাদেক-রহ:), ইমাম শাফেয়ী (যিনি শায়বান আর রায়কে পীর হিসেবে অনুসরণ করতেন) ও ইমাম হাম্বল (যাঁর মুরশিদ ছিলেন বিশর আল্ হাফী) সকলেই তাসউফকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
মুসলমান দেশগুলোর সকল বিচারালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় অদ্যাবধি এই চার ইমামের মযহাবগুলোর শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, মিসর, লেবানন, জর্দান, ইয়েমেন, জিবুতি ও আরও কিছু দেশ শাফেয়ী মযহাব অনুসরণ করে। সুদান, মরক্কো, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া ও সোমালিয়া মালেকী মযহাবের অনুসারী। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান এবং আরও কিছু দেশ হাম্বলী মযহাব অনুসরণ করে। তুরস্ক, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং রুশীয় কিছু মুসলমান প্রজাতন্ত্রের দেশে হানাফী মযহাব অনুসরণ করা হয়। মুসলমান দেশগুলোর বিচারালয়ের অধিকাংশই এই চার মযহাবের ফতোওযা অনুযায়ী চলে। আর এই চার মযহাবের সবগুলোই তাসাউফকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।
ইমাম মালেক (রহ:)-এর একটি বিখ্যাত বাণী আছে, যার মধ্যে তিনি বলেন- “মান তাসাওয়াফ্ফা ওয়া লাম ইয়াতাফাকাহা ফাকাদ তাযানদাকা; ওয়া মান তাফাকাহা ওয়া লাম ইয়াতাসাওয়াফা ফাকাদ তাফাসাক; ওয়া মান তাসাওয়াফ্ফা ওয়া তাফাকাহা ফাকাদ তাহাকাক।” অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি ফেকাহ্ ছাড়া তাসাউফ শিক্ষা করে, সে যিনদিক তথা গোমরাহ-পথভ্রষ্ট হয়; আর যে ব্যক্তি তাসাউফ বাদ দিয়ে ফেকাহ্ শিক্ষা করে সে ফাসিক গুনাহ্গার হয়; কিন্তু যে ব্যক্তি তাসাউফ ও ফেকাহ দুটোই শিক্ষা করে, সে সত্য ও ইসলামের বাস্তবতাকে খুঁজে পায়।”
ভ্রমণ করা যখন সবচেয়ে কঠিন ছিল এমনি এক সময়ে ইসলাম ধর্ম সূফী পর্যটকদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় দ্রুত প্রসার লাভ করে; এই সূফীবৃন্দ এতো বড় মহান কাজের জন্যেই আল্লাহর পছন্দকৃত বান্দা হবার শর্ত যুহদ আদ্ দুনইয়া (কৃচ্ছব্রত)-তে সুশিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠেছিলেন। তাঁদের জীবনই ছিল দাওয়া, আর তাঁদের খাদ্য ছিল রুটি ও পানি। তাঁদের এই সংযম দ্বারা ইসলামের আশীর্বাদে তাঁরা পশ্চিম থেকে দূর প্রাচ্যে পৌঁছেছিলেন।
হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে সূফী গুরুদের প্রচেষ্টা ও অগ্রগতির ফলে তাসাউফ ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করে। প্রতিটি সূফী তরীকা তার মুরশিদের নামে পরিচিতি লাভ করে, যাতে করে অন্যান্য তরীকা থেকে তাকে পৃথকভাবে চেনা যায়। একইভাবে আজকে প্রত্যেক ব্যক্তি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিজ নামের সাথে বহন করেন। এটা নিশ্চিত যে ইসলাম ধর্ম একই থাকে, এক সূফী পীর থেকে অন্য সূফী পীরে কখনো পরিবর্তিত হয় না; ঠিক যেমনি ইসলামী শিক্ষা এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তিত হয় না।
তবে, অতীতে শিক্ষার্থীরা (মুরিদরা) তাঁদের পীরের উন্নত নৈতিকতা ও আচার ব্যবহারে প্রভাবিত হতেন। সে কারণে তাঁরা একনিষ্ঠ ও অনুগত ছিলেন। কিন্তু আজকে আমাদের আলেম-উলামা সেই ধরনের দিক-নির্দেশনা দিতে অক্ষম এবং তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে শিখতে হচ্ছে অমুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে, অমুসলিম শিক্ষকদের কাছ থেকে।
সূফী গুরুগণ তাঁদের মুরিদদেরকে বলতেন আল্লাহ্ তা’লাকে স্রষ্টা হিসেবে এবং তাঁর রাসূলকে তাঁরই হাবীব ও নবী হিসেবে গ্রহণ করতে; আরও নির্দেশ দিতেন একমাত্র আল্লাহ্ তা’লার এবাদত করতে এবং মূর্তি পূজা পরিহার করতে; খোদা তা’লার কাছে তওবা করতে; নবী (দ:)-এর সুন্নাহ্ অনুসরণ করতে; আর নিজেদের অন্তর পরিশুদ্ধ করতে; যাবতীয় ভুল-ত্রুটি থেকে নিজেদের সত্তাকে পরিচ্ছন্ন করতে এবং আল্লাহর একত্বে তাদের বিশ্বাসকে সদৃঢ় করতে। মুরিদবৃন্দকে তাঁরা শিক্ষা দিয়েছিলেন যাতে সকল কাজে তাঁরা সৎ ও আস্থাভাজন হন, যাতে তাঁরা খোদার ওপর নির্ভর করেন এবং সকল সৎগুণাবলীর অধিকারী হন, যা ইসলাম আমাদের কাছে দাবি করে।
আন্তরিকতা ও পবিত্রতার এ সব মকাম (স্তর) অর্জনের উদ্দেশ্যে সূফী পীরবৃন্দ তাঁদের মুরিদদেরকে বিভিন্ন দোয়া কালাম শিখিয়েছিলেন যা নবী (দ:), তাঁর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনবৃন্দের আমল ছিল। তাঁরা শিক্ষা দিয়েছিলেন যিকরুল্লাহ্ তথা আল্লাহর স্মরণ, কুরআন পাঠের মাধ্যমে; দোয়া ও তসবীহ, হাদীস শরীফ হতে; আর আল্লাহর নাম ও সিফাত (গুণ)-এর তসবীহ-তাহলীল, তাকবীর ও তামজীদ-এর মাধ্যমে তাঁরাই শিক্ষা দিয়েছিলেন। এগুলো যিকর-সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস্ দ্বারা সমর্থিত (সহীহ্ বুখারী, মুসলিম, তাবারানী, ইবনে মাজাহ্, আবু দাউদ ইত্যাদি হাদীসের গ্রন্থে ইসলামে যিকর শীর্ষক অধ্যায়ে এগুলো পাওয়া যায়)।
এ সকল সূফী মুরশিদ (প্রকৃত আলেম-উলামা) খ্যাতি ও উচ্চ পদকে, অর্থবিত্ত ও বস্তুবাদী জীবনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁরা আমাদের যমানার আলেম-উলামার মতো ছিলেন না, যারা যশ-প্রতিপত্তি ও অর্থবিত্তের পেছনে ছুটছেন। বরঞ্চ তাঁরা ছিলেন যাহেদ ও আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল, যেমনিভাবে কুরআনে তিনি আদেশ করেছেন, “মা খালাকতুল জিন্নী ওয়াল ইনসী ইল্লা লি ইয়া’বুদুন।” অর্থাৎ, “আমি জ্বিন ও ইনসান (মানব) জাতি দুটোকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার এবাদত করার উদ্দেশ্যে”।
সূফীবৃন্দের শিষ্টাচার ও যুহদের ফলে তাঁরা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন সারা মুসলিম জাহানে মসজিদ ও খানেকাহ্ নির্মাণ করতে। বস্তুতঃ এখানে গরীবদের ফ্রি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে খানেকাহ্ ও মসজিদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রসার লাভ করে। এ সব আশ্রয়স্থল, যেখানে গরিব মানুষেরা খেতে পেতো ও ঘুমোতে পারতো এবং আশ্রয়হীনরা মাথা গুজবার ঠাঁই পেতো, সেগুলো ছিল গরিবদের অন্তরের জন্যে নিরাময়স্বরূপ; সেগুলো আরও ছিল ধনী ও গরিবের, সাদা ও কালো, হলুদ ও লাল বর্ণের মানুষের, আরব ও অনারবের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার এবং একাত্ম হবার স্থান।
হযরত রাসূলে করীম (দ:) একটি হাদীসে এরশাদ ফরমান- “আরব ও অনারবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, শুধু ন্যায়-নীতি দ্বারাই পার্থক্য করা হবে”।
এ সকল খানেকাহ্ পৃথিবীর সমস্ত জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের জন্যে সম্মিলনস্থলে পরিণত হয়। সূফীবৃন্দ সুন্নাহ্ এবং শরীয়তকে সমুন্নত রেখেছিলেন। তাঁদের ইতিহাস হলো আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম (জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্) করার সাহসিকতায় ভরা; নিজেদের দেশ ছেড়ে মানুষের মন জয় করার ও ভালবাসা দিয়ে তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় আনার সংগ্রাম। তাঁরা জাতি-গোষ্ঠী, বয়স ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ভালবেসেছিলেন। তাঁরা সবাইকে সম্মান করেছেন, বিশেষ করে অবহেলিত নারী সমাজ ও গরিব-দুঃস্থ মানুষকে। সূফীবৃন্দ ছিলেন পৃথিবীতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো, সর্বত্র দেদীপ্যমান; তাঁরা সবাইকে জেহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্ তথা আল্লাহর রাস্তায় কঠিন সাধনা করতে উৎসাহিত করেছিলেন; ইসলাম প্রচার-প্রসারে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন; গরিবদেরকে সাহায্য করতে বলেছিলেন। তাঁরা ঈমানী দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন মধ্য এশিয়া থেকে ভারত, পাকিস্তান, তাশখন্দ, বোখারা, দাগিস্তান এবং চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অন্যান্য অঞ্চলে।
প্রকৃত সূফীবৃন্দ কখনোই মহানবী (দ:)-এর শরীয়ত ও সুন্নাহ থেকে এবং কুরআন মজীদ থেকে বিচ্যুত হন নি, যদিও কিছু সূফী জযবা হালতে তথা ঐশী ভাবোন্মত্ত অবস্থায় কিছু উক্তি করেছেন এবং আল্লাহর মাহাত্ম্য ও মহানবী (দ:)-এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তাসাউফের প্রধান বা মূল দু’টি উৎস কুরআন মজীদ ও মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ যা সাইয়্যেদুনা হযরত আবু বকর (রা:) ও সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (রা:)-এর ইসলাম-সম্পর্কিত উপলব্ধির মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। এই দু’জন সাহাবীকে সূফী তরিকাহ্সমূহের উৎসমূল বিবেচনা করা হয়। হযরত আবু বকর (রা:) তাসাউফের একটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তাঁর সম্পর্কে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান- “মা সা’ব-আল্লাহু ফী সাদরী শাইয়ান্ ইল্লা ওয়া সাআবতুহু ফী সাদরি আবি বাকরিন।” অর্থাৎ, আল্লাহ্ পাক যা কিছু আমার অন্তরে ঢেলেছেন তার সবই আমি আবু বকরের (রা:) অন্তরে ঢেলেছি” (ইমাম আব্দুল গনী নাবলুসী প্রণীত হাদিকাতুন নদীয়া, কায়রোতে প্রকাশিত, ১৩১৩ হিজরী, পৃষ্ঠা ৯)। আল্লাহ্ তা’লা কুরআন মজীদে এরশাদ ফরমান- “তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ তাঁকে (নবী করীম) সাহায্য করেছেন যখন কাফেরদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁকে বাইরে তাশরীফ নিয়ে যেতে হয়েছে; একজন ছাড়া তাঁর আর কোনো সঙ্গী ছিল না; তাঁরা দু’জনই গুহার মধ্যে ছিলেন” (সুরা তাওবা, ৪০ নং আয়াত)।
রাসূলে আকরাম (দ:) আরেকটি হাদীস শরীফে এরশাদ ফরমান- “আম্বিয়া (আ:) ছাড়া আবু বকরের (রা:) মতো আর কারো ওপর সূর্য এমনভাবে উদিত হয় নি” (ইমাম সৈয়ুতী রচিত খলিফাদের ইতিহাস, কায়রো, ১৯৫২, পৃষ্ঠা ৪৬)। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)-এর মকাম (মর্যাদা) ব্যাখ্যাকারী আরও অনেক হাদীস আছে। তাসাউফের অপর ধারাটি সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (রা:)-এর মাধ্যমে এসেছে; তাঁর সম্পর্কে বহু হাদীস্ বর্ণিত হয়েছে যা ব্যাখ্যা করতে অনেক পৃষ্ঠা ব্যয় হবে। পরিশেষে, মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ্ ও শরীয়ত, যা ফরয (অবশ্য কর্তব্য) ও এহ্সান (আধ্যাত্মিকতা)-এর প্রতিনিধিত্ব করে, তা সূফী বুযুর্গদের চরিত্রে মূর্ত প্রকাশিত ছিল।
হিজরী ১৩ শতাব্দীতে একটি নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে যারা ৭ম হিজরীর দু’জন আলেমের শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এরা নিজেদেরকে হাম্বলী মযহাবের অনুসারী দাবি করলেও ওই মযহাবের আকিদা-বিশ্বাস থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা তাসাউফ সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং চার মযহাব থেকে বিচ্যুত হয়।
সাম্প্রতিককালে ওই নতুন গোষ্ঠীর অনুসারীরা সীমা লংঘন করে তাদের আধুনিক যুগের গুরুদের ফতোওয়ার ওপর ভিত্তি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করছে। এই সব গোষ্ঠী-প্রধান নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ফতোওয়া প্রদান করে মুসলমানদের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বর্তমানে এরাই সূফীতত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করেছে এবং বিগত ১৪০০ বছর যাবত ইসলাম প্রচার-প্রসারে সূফীদের সমস্ত অবদানকে মুছে ফেলতে চাচ্ছে।
আমাদের মুসলমান ভাই ও বোনদের জ্ঞাতার্থে আমরা বিভিন্ন মুসলমান দেশের অগণিত সূফী তাত্ত্বিকদের মধ্য থেকে কয়েকজনের নাম এখানে উপস্থাপন করছি:
(১) মিসরীয় মূফতী হাস্সানাইন মোহাম্মদ আল্ মুখলুফ, মুসলিম ওয়ার্ল্ডে লীগের সদস্য;
(২) মোহাম্মদ আত্ তাইয়ের আন্ নাজ্জার, সুন্নাহ্ এন্ড শরীয়াহ্ ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি এবং আল্ আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি;
(৩) শায়খ আব্দুল্লাহ্ কানুন আল্ হাসানী, মরক্কোর উলামা সংস্থা প্রধান এবং ওয়ার্ল্ড ইসলামিক লীগের ডেপুটি;
(৪) ডঃ হুসাইনী হাশিম, মিসর আল্ আযহারের ডেপুটি এবং মক্কার রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মহাসচিব;
(৫) সাইয়্যেদ হাশিম আল্ রেফাঈঁ, কুয়েত সরকারের সাবেক ধর্মমন্ত্রী;
(৬) শায়খ সাইয়্যেদ আহমদ আল্ আওয়াদ, সুদানের মুফতী;
(৭) উস্তায আব্দুল গফুর আল্ আত্তার, সৌদি আরবীয় লেখক সমাজের সভাপতি;
(৮) কাযী ইউসুফ বিন আহমদ আস্ সিদ্দিকী, বাহরাইনী হাইকোর্টের জজ;
(৯) মোহাম্মদ খাযরাজী শায়খ আহমদ বিন মোহাম্মদ বিন যাবারা, ইয়েমেনের মুফতী;
(১০) শায়খ মোহাম্মদ শাযিলী নিভার, তিউসিশিয়ার শরীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট;
(১১) শায়খ খাল আল্ বানানী, মৌরিতানিয়ার ইসলামিক লীগের সভাপতি;
(১২) শায়খ মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহিদ আহমদ, মিসরের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী;
(১৩) শায়খ মোহাম্মদ বিন আলী হাবাশী, ইন্দোনেশিয়ার ইসলামিক লীগ সভাপতি;
(১৪) শায়খ আহমদ কোফ্তারো, সিরিয়ার মুফতী;
(১৫) শায়খ আবু সালেহ্ মোহাম্মদ আল্ ফাত্তিহ্ আল্ মালেকী, ওনদুরমান, সুদান;
(১৬) শায়খ মোহাম্মদ রাশিদ কাব্বানী, লেবাননের মুফতী;
(১৭) শায়খ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ মালেকী আল্ হাসানী, শরীয়ার অধ্যাপক এবং মক্কা ও মদীনার দু’টো পবিত্র মসজিদে শিক্ষক;
এবং আরো অগণিত সূফীবাদী হক্কানী উলামায়ে কেরাম।
ওহে আমাদের মুসলমান ভাই ও বোনেরা! ইসলাম হলো সহিষ্ণুতা (হিলম্), ভালবাসা, শান্তি; ইসলাম হলো যুহুদ, এহ্সান; ইসলাম মানে সুসম্পর্ক; ইসলাম মানে পরিবার, ভ্রাতৃত্ব; ইসলাম মানে সাম্য; ইসলাম হলো একটি দেহ; ইসলাম হলো জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা; ইসলামের যাহেরী (প্রকাশ্য) ও বাতেনী (অপ্রকাশ্য) জ্ঞান বিদ্যমান; ইসলামের অপর নাম সূফীবাদ, আর সূফীবাদই হলো ইসলাম।
পরিশেষে বলবো, ইসলাম ধর্ম হলো আমাদের প্রতি আল্লাহ্তা’লার প্রেরিত আলো যা তিনি সর্বশেষ নবী (দ:)-এর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন; এই নবী (দ:) হলেন ভালবাসার ও যাহেরী-বাতেনী জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক; সকল মানবের জন্যে তিনি করুণার প্রতীক। তিনি খোদার কাছে আমাদের মধ্যস্থতাকারী; সবার জন্যে তিনি শাফায়াতকারী, যে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আল্লাহ্ তা’লা আমাদের এ লেখায় ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করুন, আমীন।
[এ লেখাটি As-Sunnah Foundation of America-এর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এর লেবাননী বংশোদ্ভূত লেখক ওই ফাউন্ডেশনেরই সভাপতি। যোগাযোগ: www.sunnah.org]
No comments:
Post a Comment