Thursday, 16 May 2013

হযরত আব্বাস (রা:)-এর মাধ্যমে হযরত উমর (রা:)-এর তাওয়াসসুল



মূল: ড: জি, এফ, হাদ্দাদ

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দিন হোসেন



সহীহ্ আল্ বুখারী নামের হাদীসের গ্রন্থে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যেখানে খলীফা উমর (রা:) আমাদের মহানবী (দ:)-এর রওযা পাকে মুসলিম উম্মাহর পক্ষে বৃষ্টি প্রার্থনা না করে বরং তাঁরই চাচা হযরত আব্বাস (রা:)-এর মাধ্যমে (তাওয়াস্সুল) আল্লাহর দরবারে বৃষ্টি প্রার্থনা করেছিলেন। খলীফা দোয়ার মধ্যে বলেন যে তাঁরা ইতিপূর্বে বিশ্বনবী (দ:)-এর মধ্যস্থতায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন, কিন্তু এখন তাঁর চাচার ওয়াসিলায় তা চাইছেন। এই বিশুদ্ধ বর্ণনাটি  হানাফী  উলামায়ে কেরাম কীভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন তা আমরা এখন জানতে চেষ্টা করবো।


এই বিষয়টি ও এতদসংক্রান্ত প্রশ্ন সাপেক্ষ যুক্তিগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়ার আগে কিছু প্রাথমিক মন্তব্য এখানে লিপিবদ্ধ করা প্রাসঙ্গিক হবে।


প্রথমত: হযরত উমর (রা:) হযরত আব্বাস ইবনে আব্দিল মুত্তালিব (রা:)-এর তাওয়াসসুল করেছিলেন, তাঁর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:)-এর তাওয়াসসুল করেন নি। কিছু দিন আগে ‘হাম্বলী ফোরামে’ এ ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা সঠিক নয়।


দ্বিতীয়ত: খলীফা উমর (রা:)-এর বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ:


“হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করার সময় মহানবী (দ:)-কে ওয়াসিলা (মাধ্যমে) হিসেবে পেশ করতাম, আর আপনি বৃষ্টি দিতেন; এখন আমরা তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (রা:)-কে ওয়াসিলা হিসেবে পেশ করছি, অতএব অনুগ্রহ করে বৃষ্টি দিন”।


এই বর্ণনাটি হযরত আনাস (রা:) হতে আল্ বুখারী (রহ:) তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম আল্ মালেকী (রহ:) বলেন, “যে ব্যক্তি এই বর্ণনা থেকে এ কথা বুঝে নেয় যে হযরত উমর (রা:) হযরত আব্বাস (রা:)-কে ওয়াসিলা করেছেন এবং বিশ্বনবী (দ:)-কে করেন নি কেননা হযরত আব্বাস (রা:) জীবিত এবং মহানবী (দ:) ‘মৃত’, তবে ওই ব্যক্তির উপলব্ধি ক্ষমতাই মৃত।”


ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) নিজ তারিখে খুলাফা (বৈরুত ১৯৯২, আহমদ ফারেস সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ১৪০) গ্রন্থে এই ঘটনার পটভূমি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন: “১৭ হিজরী সালে হযরত উমর (রা:) মসজিদে নব্বী সম্প্রসারণ করেন। ওই বছর হেজায অঞ্চলে খরা দেখা দেয়। সালটিকে ‘অঙ্গারের বছর’ আখ্যা দেয়া হয় (আম আল্ রামাদা)। হযরত উমর (রা:) মানুষের উপকারে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনার সময় হযরত আব্বাস (রা:)-এর ওয়াসিলা গ্রহণ করেন। হযরত ইবনে সা’দ (রহ:) (সাহাবী) হযরত নিয়্যার আল্ আসলামী (রা:) থেকে বর্ণনা করেন যে হযরত উমর (রা:) যখন বৃষ্টির জন্যে খোদার দরবারে প্রার্থনা করতে বেরিয়ে আসেন, ওই সময় তিনি মহানবী (দ:)-এর জুব্বা (বুরদ্) মোবারক পরেছিলেন। হযরত ইবনে আওন ((রা:) বর্ণনা করেছেন যে খলীফা উমর (রা:) হযরত আব্বাস (রা:)-এর হস্ত মোবারক ওপরে তুলে ধরেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ্!  আমরা মহানবী (দ:)-এর সম্মানিত চাচার মধ্যস্থতায় (ওয়াসিলায়) আপনার দরবারে প্রার্থনা করছি যাতে আপনি এই খরা আমাদের কাছ থেকে দূর করে দেন এবং বৃষ্টি মঞ্জুর করেন . . . . . . ”।


এ ঘটনায় নিচের বিষয়গুলো পরিস্ফুট হয়:


(১) এই বর্ণনায় এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে হযরত উমর (রা:)-এর যমানায় কখনোই বিশ্বনবী (দ:)-এর তাওয়াসসুল করা হয় নি। ওই ধরনের অভিমত কেউ নিয়ে থাকলে তা মনগড়া এবং সুস্পষ্ট দলিলের ওপর ভিত্তিশীল নয়।


(২) পক্ষান্তরে, হযরত উমর (রা:) ওই সময়ই হযরত রাসূলে পাক (দ:)-এর তাওয়াসসুল করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যখন তিনি বৃষ্টির জন্যে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর জুব্বা মোবারক পরে বেরিয়ে এসেছিলেন, যা হযরত ইবনে সা’দ বর্ণনা করেছেন। সহীহ্ মুসলিম শরীফ গ্রন্থে হযরত আসমা (রা:) বলেন যে তিনি তাঁর বোন হযরত আয়েশা (রা:)-এর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে মহানবী (দ:)-এর আলখেল্লাটি পেয়েছিলেন এবং তাঁরা সেটি দ্বারা মানুষের রোগ নিরাময় করার উপায় খুঁজতেন।


(৩) হুজুর পূর নূর (দ:)-এর চাচার মধ্যস্থতা পরিস্ফুট করে যে তাওয়াসসুল মূলতঃ মহাবনী (দ:)-এরই! কেননা, হযরত আব্বাস (রা:)-এর গুরুত্ব কেবল মহানবী (দ:)-এর সাথে তাঁর (রক্তের) সম্পর্কের কারণেই হয়েছে যা হযরত উমর (রা:)-এর ভাষায় নিম্নরূপ:


“আপনার নবী (দ:)-এর চাচা” (আল্ বুখারীতে উদ্ধৃত)। আল্ লালিকার সংস্করণে তা এভাবে উদ্ধৃত “আপনার নবী (দ:)-এর সাথে সম্পর্কে হযরত আব্বাস (রা:)-এর মর্যাদা”। হযরত আব্বাস (রা:) এ উপলক্ষে বলেন, “হে আল্লাহ্! কোনো শাস্তিই পাপ ছাড়া অবতীর্ণ হয় না, আর তা তওবা (অনুতপ্ত হওয়া) ছাড়া মোচনও হয় না। মানুষেরা আপনার নবী (দ:)-এর সাথে আমার সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আমার মর্যাদার ওয়াস্তে আপনার করুণাপ্রার্থী। আর এই হলো আমাদের হাত যা আপনার দরবারের দিকে তোলা; যদিও আমাদের অনেক পাপ, তবুও আমাদের কপালের উপরিবর্তী কেশগুচ্ছ অনুতপ্ত; অতএব, আমাদের বৃষ্টি দান করুন এবং আপনার নবী (দ:)-কে তাঁর চাচার সত্তায় অম্লান রাখুন।” অতঃপর আকাশ থেকে রশির মতো মোটা (অর্থাৎ ভারী) বর্ষণ আরম্ভ হলো এবং মানুষেরা হযরত আব্বাসের (রা:) কাছে এসে হাত বুলিয়ে দিয়ে বল্লো, “আপনাকে মোবারকবাদ (অভিনন্দন), মক্কা ও মদীনা (হারামাইন শরীফাইন)-এর সেচকারী।” হযরত উমর ফারুক (রা:) এমতাবস্থায় বলেন, “তিনি হলেন আল্লাহর কাছে মধ্যস্থতাকারী এবং নৈকট্যের মকাম (স্থান)।” এ বর্ণনাটি আল্ আনসাব পুস্তকে আল্ যুবায়ের ইবনে বক্কর (রহ:) থেকে উদ্ধৃত করেছেন ইবনে হাজর (রহ:) তাঁর ফাত্হুল বারী গ্রন্থে (২:৪৯৭)।


অতএব, তাওয়াসসুল মুলতঃ মহানবী (দ:)-এর মধ্যস্থতায়ই হয়েছে, কেননা আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণকারী মানুষের জন্যে তিনিই হলেন চূড়ান্ত ওয়াসিলা, যা তিনি স্বয়ং জনৈক অন্ধ সাহাবীকে শিখিয়েছিলেন- “বলো, ইয়া মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! ইন্নী আতাওয়াজ্জাহু বিকা ইলা রাব্বী - অর্থাৎ, হে রাসূল! আমি আপনার মধ্যস্থতায় আল্লাহর দিকে ফিরলাম।” আর অনেক সাহাবী থেকেই এ মর্মে স্পষ্ট বিবরণ বিদ্যমান যার কয়েকটি নিচে দেয়া হলো:


(ক) এক বেদুঈন আরব আমাদের মহানবী (দ:)-কে বলেন, “আমরা এমন সময় আপনার শরণাপন্ন হয়েছি যখন আমাদের কুমারীদের দুধ শুকিয়ে গেছে, আর মায়েরা আপন শিশুর জীবনের চেয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ওই শিশু ক্ষুধায় হাত নামিয়ে স্থবির বসে আছে; কেননা এই ক্ষিদে জ্বালাময় এবং বিরামহীন। খাওয়ার মতো কিছুই আর আমাদের জনগোষ্ঠির কাছে নেই, কেবল আছে তেতো শশা জাতীয় সবজি এবং রক্তমিশ্রিত উটের পশম। আমাদের আশ্রয় নেয়ার মতো আর কেউ নেই আপনি ছাড়া। কেননা নবী (দ:) ছাড়া মানুষেরা আর কোথায়ই বা আশ্রয় নেবে”?


এমতাবস্থায় মহানবী (দ:) উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর জুব্বা মোবারক টানতে টানতে মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতঃপর আরয করলেন: “হে আল্লাহ্! আমাদের বৃষ্টি মঞ্জুর করুন।” অমনি ভারী বর্ষণ আরম্ভ হলো। এ দেখে তিনি বল্লেন, “আবু তালিব (নবীর চাচা) আজ জীবিত থাকলে এ দৃশ্য দেখে নয়ন জুড়াতেন। ওই বেদুঈন (আবু তালেব) যা বলেছেন কে আছো তা পুনরায় আবৃত্তি করবে আমাদের উদ্দেশ্যে”? এই কথা শুনে হযরত আলী (রা:) উঠে দাঁড়িয়ে আরয করলেন, “হে রাসূল (দ:) আমার মনে হয় আপনি তাঁর এই কথা বোঝাচ্ছেন, “শুভ্র সেই সত্তা যার চেহারা মোবারক দ্বারা মেঘমালা কামনা করা হয়, যিনি এতিম অনাথদের লালন-পালনকারী ও বিধবাদের রক্ষক। তাঁরই মধ্যস্থতায় হাশেম গোত্র দুর্যোগ থেকে আশ্রয় চায়; কেননা তারা তাঁরই মধ্যে খুঁজে পায় মহা অনুগ্রহ ও করুণা . . . . . .”।


এই হাসীসটি আল্ বায়হাকী বর্ণনা করেছেন তাঁর দালাইল আল্ নুবুয়্যত গ্রন্থে (৬:১৪১), ইবনে কাসির তার আল্ বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া পুস্তকে (৬:৯০-৯১) এবং ইবনে হাজর তাঁর ফাত্হুল বারী বইয়ে (১৯৮৯ সংস্করণ, ২:৬২৯)।


(খ) হযরত সাওয়াদ ইবনে কারীব আল্ সাদুসী (রা:) কবিতার আকারে আবৃত্তি করেন-

“সত্যি আপনি হলেন আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তিতে নবীদের মাঝে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম’; মহানতম ও নির্মলতম পিতামাতার পুত্র সন্তান; অতএব, এই সাওয়াদ ইবনে কারীবের জন্যে ওই দিন সুপারিশকারী হোন, যেদিন সুপারিশকারীদের মধ্যে আপনি ছাড়া আর কারো সুপারিশই আমার জন্যে ন্যূনতম উপকারী হবে না।”


এ বক্তব্য শ্রবণে রাসূলে কারীম (দ:) মৃদু হাসলেন এবং বল্লেন, “সাওয়াদ! তুমি সাফল্য অর্জন করেছ।” হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবু ইয়া’লা তাঁর মু’জাম বইয়ে (পৃষ্ঠা ২৬৫), তাবারানী নিজ আল্ কবীর পুস্তকে (৭:৯৪ ৬৪৭৫), আবু নু’য়াইম তাঁর দালাইল্ আল্ নুবুওয়া গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১১৪, অধ্যায় ৬৩), আল্ তায়মী নিজ দালাইল পুস্তকে (পৃষ্ঠা ১৩২), আল্ হাকিম তাঁর মুস্তাদ্রাক গ্রন্থে (৩:৭০৫), আল্ বায়হাকী নিজ দালাইল বইয়ে (২:২৫১), ইবনে আব্দিল বারর তাঁর ইস্তিয়াবা পুস্তকে (২:৬৭৫), ইবনে কাসির নিজ তাফসীর (৪:১৬৯) এবং বেদায়া গ্রন্থে, ইবনে হাজর তাঁর ফাত্হুল বারী (৭:১৮০) ও ইসাবা (৩:২৯৯) পুস্তকে।


(গ) হযরত হাস্সান বিন সাবিত (রা:) পদ্যের আকারে আবৃত্তি করেন-

“আপনার প্রতি যাঁরা আস্থা রাখেন, ওহে তাঁদের ভিত্তি স্তম্ভ, ওহে তাঁদের আশ্রয়স্থল যাঁরা আপনার মাঝে আশ্রয় খোঁজেন, আর যাঁরা  শষ্য ও বৃষ্টি খোঁজেন তাঁদের আশ্রয়দাতা, ওহে আশ্রয় অন্বেষণকারীদের প্রতিবেশী ও রক্ষাকারী, যাঁর মাঝে পূর্ণতা ও চারিত্রিক নির্মলতা সন্নিবেশ করে খোদা তা’লা তাঁর সৃষ্টিকুলের জন্যে মনোনীত করেছেন!”


এ বর্ণনাটি ইবনে আব্দিল বারর তাঁর আল্ ইস্তিয়াব গ্রন্থে (১:২৭৬) এবং ইবনে সাইয়্যেদ আল্ নাস্ নিজ মিনাহ্ আল্ মায পুস্তকে (পৃষ্ঠা ৭৩) লিপিবদ্ধ করেছেন।


(৪) হযরত উমর (রা:) কর্তৃক বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনার প্রেক্ষিত হিসেবে মহানবী (দ:)-এর সুস্পষ্ট তাওয়াসসুল আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, যা সাহাবী হযরত বেলাল ইবনে হারিস্ মুযানী (রা:) রেওয়ায়াত করেছেন এবং যা দু’টি ভাষ্যে পাওয়া যায়।


(ক) ভাষ্য - ১

সাহাবী  হযরত মালেক আল দার (রা:) বর্ণনা করেন-

“হযরত খলীফা উমর (রা:)-এর শাসনামলে মানুষেরা খরাপীড়িত হন। এমতাবস্থায় কেউ একজন মহানবী (দ:)-এর রওযা পাকে আসেন এবং আরয করেন, ‘হে নবী, আপনার উম্মতের জন্যে (আল্লাহর দরবারে) বৃষ্টি প্রার্থনা করুন, কেননা নিশ্চয় তারা নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।’ অতঃপর বিশ্বনবী (দ:) এক রাতে ওই ব্যক্তির স্বপ্নে দেখা দেন এবং তাঁকে বলেন, ‘উমরের কাছে যাও এবং তাকে আমার সম্ভাষণ জানাও। তারপর তাকে বলবে যে বৃষ্টি হবে। তাকে বলবে বিচক্ষণ হতে (শাসনে)’। ওই ব্যক্তি খলীফার কাছ গিয়ে সব ঘটনা জানালেন। এতে খলীফা খুব কাঁদলেন এবং দোয়া করলেন, ‘হে প্রভু! আমি চেষ্টায় ক্রটি করি না, শুধু যা আমার ক্ষমতার বাইরে তা ছাড়া!” ইবনে কাসির তার রচিত আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া পুস্তকে (মা’আরিফ সংস্করণ ৭:৯১-৯২ এবং দার ইহইয়া আল্ তুরাস্ সংস্করণ ৭:১০৫) ইমাম বায়হাকী (রহ:)-এর দালাইল আল নুবুয়্যত (৭:৪৭) থেকে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে বলেন, “ইসনাদুহু সহীহ্” (এর সনদ বিশুদ্ধ); তিনি আরও ঘোষণা করেছেন, “ইসনাদুহু জাইয়্যেদুন কাওয়ী,” অর্থাৎ এর সনদ নির্ভরযোগ্য (জামেউল মাসানিদ, ১:২২৩)। ইবনে আবি শায়বা (৬:৩৫২ এবং ১২:৩১-৩২) সহীহ্ সনদের সাথে এটি বর্ণনা করেছেন যা ইবনে হাজর মক্কী (রহ:) নিজ ফাত্হুল বারী, ইস্তিস্কা পুস্তকের তৃতীয় অধ্যায়ে (১৯৮৯ সংস্করণ, ২:৬২৯-৩০ ও ১৯৫৯ সংস্করণ ২:৮৯৫) সমর্থন করেছেন এ কথা বলে “রাওয়া ইবনে আবি শায়বা বি ইসনাদিন সহীহ্;” তিনি নিজ রচিত আল ইসাবা পুস্তকে (৬:১৬৪ এবং ৩:৪৮৪) বলেন যে এটি ইবনে আবি খায়তামা বর্ণনা করেছেন। এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে আরও আছেন আল খলিলী তাঁর ইরশাদ বইয়ে (১:৩১৩-১৪) এবং ইবনে আব্দিল বারর তাঁর আল্ ইস্তিয়াব গ্রন্থে (২:৪৬৪ এবং ৩:১১৪৯)। আল্ আলবানী তার প্রণীত তাওয়াসসুল পুস্তকে (পৃষ্ঠা ১২০) এ বর্ণনাটিকে দুর্বল প্রমাণ করতে চেয়েছে, কিন্তু তাকে শায়খ মামদুহ্ নিজ রচিত রাফ’আল্ মিনারা গ্রন্থে (২৬২-২৭৮ পৃষ্ঠা) বিস্তারিত খন্ডন করেছেন; ওতে ইবনে বা’য (ফাত্হুল বারীর হাশিয়া), আবু বকর জাযাইরীর ‘ওয়াজাউ ইয়ারকুদুন’, হাম্মাদ আল্ আনসারীর প্রবন্ধ ‘আল্ মাফহুম আল্ সহীহ্ লিল্ তাওয়াসসুল’ যার অপর শিরোনাম ‘তোহ্ফাত আল্ কারী ফী রাদ্দি আ’লাল গুমারী’ এবং অনুরূপ লেখনীর খন্ডন বিধৃত হয়েছে।


ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) মহানবী (দ:)-এর রওযায় গমনকারী সাহাবীকে হযরত বেলাল ইবনে হারিস্ মুযানী (রহ:) বলে সনাক্ত করেছেন। ইমাম বুখারী (রহ:) যে তাঁর সহীহ্ গ্রন্থের ইসতিসকা বাবে (অধ্যায়ে) “খরাপীড়িত হলে ইমামের প্রতি মানুষের অনুরোধ” শিরোনামে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন, তার কারণগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে এই বর্ণনাকে ইমাম ইবনে হাজর গণ্য করেছেন।


(খ) ভাষ্য - ২


আত্ তাবারী (রহ:)-এর তারিখ (ইতিহাস ২:৫০৯) থেকে সংগৃহীত:

আল্ রামাদা নামের খরার বছর যখন হযরত উমর ফারুক (দ:) খলীফা ছিলেন, তখন সাহাবী বিলাল ইবনে হারিস্ (রা:) তাঁর কোনো এক আত্মীয়ের জন্যে ভেড়া জবাই করেন। ওই সময় তিনি দেখতে পান ভেড়ার হাড়গুলো লাল হয়ে গিয়েছে, কেননা ওর মাংস শুকিয়ে হাড়ের সাথে লেগে গিয়েছিল। তিনি নেদা (আহ্বান) দিয়ে বলেন, “ইয়া মোহাম্মাদা” (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! অতঃপর তিনি হুজুর পূর নূর (দ:)-কে স্বপ্নে দেখতে পান, যিনি তাঁকে হযরত উমর (রা:)-এর কাছে গিয়ে আসন্ন বৃষ্টির সুসংবাদ দিতে বলেন এবং খলীফাকে জ্ঞান-প্রজ্ঞা দ্বারা শাসন করতে বলেন। এ কথা শুনে হযরত উমর (রা:) সকলকে সমবেত করেন এবং মহানবী (দ:)-এর শ্রদ্ধেয় চাচা হযরত আব্বাস (রা:)-কে সাথে নিয়ে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করতে বেরিয়ে আসেন।


(৫) হযরত উমর (রা:) অতীতে হযরত রাসূলে কারীম (দ:)-এর মধ্যস্থতা (তাওয়াসসুল) গ্রহণ করেছিলেন, যে কারণে তিনি বলেছেন, “আমরা ইতিপূর্বে আমাদের প্রিয় নবী (দ:)-কে আপনার কাছে প্রার্থনার সময় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করতাম . . . ” অর্থাৎ, ওই সময় যখন হযরত আবু বকর (রা:)-এর খেলাফত আমল চলছিল এবং তাঁর খেলাফত আমলেও বিশ্বনবী (দ:)-এর তাওয়াসসুল হযরত উমর (রা:) করেছিলেন; হুজর পূর নূর (দ:)-এর (প্রকাশ্য) জিন্দেগীর সময়ই কেবল তাওয়াসসুল করা হয়নি, বরং পরবর্তীকালেও তা করা হয়েছে, কেননা উক্ত দু’টি শাসনকালে, অর্থাৎ, সাড়ে আট বছরে তাঁরা আর কখনোই খরাপীড়িত না হওয়ার বিষয়টি অ-সম্ভাব্য। আল্ কাওসারী বলেন, “কিন্তু (হযরত উমরের) এই বাক্যটিকে রাসূলে আকরাম (রা:)-এর যাহেরী (প্রকাশ্য) জিন্দেগীতে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা এমনই একটি ঘাটতি যা নিরর্থক মনের ইচ্ছা থেকে নিঃসৃত, রেওয়ায়াতের মূল বিষয়ের বিকৃতি সাধনের অপচেষ্টা এবং দলিল-প্রমাণ ছাড়া কল্পনাশ্রিত ব্যাখ্যামাত্র।”


(৬) উপরন্তু, অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামই হুজুর পাক (দ:)-এর যাহেরী জীবদ্দশার পরে তাঁর তাওয়াসসুল করেছেন যা আমাদের মা আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেছেন ইমাম দারিমী (রহ:)-এর সুনান গ্রন্থে, ভূমিকার ১৫ অধ্যায়ে (১:৪৩); এর শিরোনাম হলো “নবী করীম (দ:)-এর প্রতি তাঁর বেসালের (আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্তির) পর আল্লাহর অনুগ্রহ”। এই রেওয়ায়াতটি নির্ভরযোগ্য সনদে হযরত আউস্ ইবনে আব্দিল্লাহ্ বর্ণনা করেছেন:


মদীনাবাসী মানুষেরা একবার তীব্র খরাপীড়িত হয়ে হযরত আয়েশা (রা:)-এর কাছে আরয করেন। তিনি তাঁদেরকে বল্লেন, “(হায়াতন্নবীর) পাক রওযায় যাও, আর রওযার ছাদ খুলে দাও যাতে করে তাঁর এবং আকাশের মাঝখানে কিছু না থাকে।” মদীনাবাসীরা তাই করলেন। অতঃপর এমন বর্ষণ আরম্ভ হলো যে ফলে ফসলে মাঠ প্রান্তর ভরে উঠলো এবং উট হৃষ্টপুষ্ট হলো। এই বছরটিকে ‘প্রাচুর্যের বছর’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল।


পাঠকবৃন্দ, এই বর্ণনার ওপর বিস্তারিত দালিলিক প্রমাণাদি পাবেন এনসাইক্লোপেডিয়া অফ ইসলামিক ডক্ট্রিন তথা ইসলামী তত্ত্বের বিশ্বকোষে (৪:৪৭-৫২)। হাদীসের বিশারদ সকল সুন্নী আলেমই এটিকে সহীহ্ বলেছেন যার মধ্যে সর্বশেষ জন হলেন শায়খ নাবিল ইবনে হাশিম আল্ গামরী তাঁরই রচিত ১০ খন্ড বিশিষ্ট দারিমী শরীফের ব্যাখ্যামূলক ফাত্হুল মান্নান (১:৫৬৪-৬৬) গ্রন্থে যেখানে তিনি আল্ আলবানী ও তার মতো ব্যক্তিদের এই রেওয়ায়াতের প্রতি উত্থাপিত আপত্তিসমূহ খন্ডন করেছেন।


(৭) তাবুকের যুদ্ধের সময় হযরত উমর (রা:) হযরত রাসূলে করীম (দ:)-এর তাওয়াসসুল করেছিলেন এবং এর ফলে সরাসরি খোদায়ী অপরিমিত দানশীলতার ও মহানবী (দ:)-এর মহত্ত্বের ছোঁয়া পেয়েছিলেন। বর্ণিত আছে:


“কোনো এক সফরে যখন মানুষদের খাবার ফুরিয়ে যাচ্ছিল তখন তাঁরা নিজেদের উটগুলো জবাই করার কথা ভাবতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় হযরত উমর (রা:) হুজুর পূর নূর (দ:)-এর কাছে গিয়ে আরয করেন, ’হে রাসূলে খোদা (দ:)! উটগুলো ছাড়া তারা কীভাবে টিকবে?’ বিশ্বনবী (দ:) বল্লেন, ‘তাদের বলো অবশিষ্ট খাবারগুলো এখানে আনত ‘। এক টুকরো চামড়া বিছিয়ে দেয়া হলে তাতে মানুষদের অবশিষ্ট খাবার সামগ্রী রাখা হলো। অতঃপর মহানবী (দ:) দাঁড়িয়ে দোয়া করলেন এবং খাবারগুলোতে ফুঁকে দিলেন; এর পর সবাইকে ঝুলি আনতে বল্লেন। মানুষেরা ঐশী প্রাচুর্যময় সমস্ত খাবার সংগ্রহ করে নিলেন, এমন কি শেষটুকুও। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (দ:) এরশাদ করলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য মা’বুদ নেই এবং আমিই তাঁর প্রেরিত রাসূল!’


এই হাদীসটি বোখারী ও মুসলিম হযরত সালামা ইবনে আল্ আকওয়া’ থেকে এবং মুসলিম ও ইমাম আহমদ হযরত আবু হোরায়রা (রা:) থেকে বর্ণনা করেছেন।


(৮) হযরত উমর (রা:) হযরত আব্বাস (রা:)-এর তাওয়াসসুল করে সমাজে রাসূলে পাক (দ:)-এর উঁচু পারিবারিক মর্যাদা মানুষদের সামনে তুলে ধরেছেন এবং তাদেরকে নবী বংশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন শিক্ষা দিয়েছেন, যেমনিভাবে ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) হযরত আনাস্ (রা:) বর্ণিত আলোচ্য রেওয়ায়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন: “মহানবী (দ:)-এর আত্মীয় স্বজন ও বযুর্গানে দ্বীনের শাফায়াত বা সুপারিশ প্রার্থনা করা একান্ত কাম্য; আর এই ঘটনা হযরত আব্বাস (রা:)-এর মাহাত্ম্য ও উচ্চ মকাম এবং হযরত উমর (রা:)-এরও মাহাত্ম্য প্রতিভাত করে, যেহেতু তিনি হযরত আব্বাসের (রা:) প্রতি বিনয়ী হয়েছিলেন এবং তাঁর হক্ক তথা অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।”


এটি ’আল্ শরীয়া’র ব্যাখ্যামূলক পুস্তকে আল্ আজিউররী এবং ফাযাইল আল্ সাহাবী গ্রন্থে (২:৯৩৭ # ১৮০২) ইমাম আহমদ সমর্থন করেছেন অপর এক বর্ণনা দ্বারা, যেখানে হযরত কা’আব আল্ আহবার (রা:) হযরত আব্বাস (রা:)-এর হাত মোবারক নিজ হাতে নিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “আমি এই করমর্দন লুকিয়ে রাখাবো আমার পক্ষে আপনার সুপারিশের (শাফায়াতের) জন্যে।” হযরত আব্বাস (রা:) উত্তর দেন, “কেন, আমি কি শাফায়াত করতে পারবো (অর্থাৎ, শাফায়াতের ক্ষমতা আমার থাকবে কিনা)”? কা’আব উত্তর দিলেন, “বিশ্বনবী (দ:)-এর আহল তথা ঘরের মানুষ বা পরিবার সদস্যদের এমন কেউই হবেন না যাঁর শাফায়াতের ক্ষমতা থাকবে না!” কা’আব আল্ আহবার (রা:) হযরত উমর ফারুক (রা:)-কে আরও বলেন, “বনী ইসরাইল গোত্রের মানুষেরা যখনই খরাপীড়িত হতো, তখনই তারা তাদের নবী (মূসা-আ:)-এর পরিবার সদস্যদের সুপারিশ কামনা করতো”। (২:৮১৪)


(৯) এ কথা সর্বজন জ্ঞাত যে আহলে বায়তের তথা নবী পরিবারের প্রতি হযরত উমর (রা:)-এর এক বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ ছিল যা নিচের কয়েকটি রেওয়ায়াতে প্রতিভাত হয়: (ক) আল্ শা’বী এবং আল্ হাসান থেকে ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন যে একদিন হযরত আব্বাস (রা:)-এর খলীফা উমর (রা:)-কে কোনো এক কাজে প্রয়োজন হলে তিনি তাঁকে বলেন, “আমিরুল্ মো’মেনীন! ধরুন, মূসা (আ:)-এর চাচা আপনার কাছে মুসলমান হয়ে এসেছেন। আপনি তাঁর সাথে কেমন আচরণ করবেন? হযরত উমর (রা:) উত্তরে বল্লেন, “আল্লাহর শপথ (কসম)! আমি তাঁর সাথে ভাল আচরণ করবো!” অতঃপর হযরত আব্বাস (রা:) বল্লেন, “তাহলে আমি তো হলাম বিশ্বনবী (দ:)-এর চাচা!” হযরত উমর (রা:) বল্লেন, “হে আবুল ফযল (হযরত আব্বাস রা:)! আপনি কী ধারণা করেন? আল্লাহর শপথ, আপনার পিতা (আব্দুল মোত্তালিব) আমার কাছে নিশ্চয় আমার আপন পিতার চেয়েও বেশি প্রিয়!” হযরত আব্বাস (রা:) জিজ্ঞেস করলেন, “আল্লাহর কসম”? হযরত উমর (রা:) উত্তর দিলেন, “আল্লাহর শপথ! কেননা, আমি জানি আব্দুল মোত্তালিব মহানবী (দ:)-এর কাছে আমার বাবার চেয়েও প্রিয়; তাই আমি আমার নিজস্ব পছন্দের চেয়ে রাসূলুল্লাহ্ (দ:)-এর পছন্দকে বেশি ভালবাসি।”


(খ) জনৈক ব্যক্তি একবার হযরত উমর (রা:)-এর উপস্থিতিতে হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (রা:)-এর প্রতি মর্যাদাহানিকর কিছু কথা বলেছিল। এতে হযরত উমর (রা:) ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বলেন, “তুমি জানো এই রওযায় কে শায়িত আছেন? ইনি মোহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ্ ইবনে আব্দিল মোতালিব (দ:)! আর আলী (ক:) হলেন আবু তালেব ইবনে আব্দিল মোত্তালিবের পুত্র। অতএব হযরত আলী (ক:) সম্পর্কে কথা বলতে হলে ভালোভাবে বলবে, নইলে তুমি যদি তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাব প্রকাশ করো, তবে এই রওযা পাকে যিনি শায়িত আছেন তাঁর অন্তরে তুমি আঘাত করবে।” এই রেওয়ায়াতটি নির্ভরযোগ্য সনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) তাঁর ফাযাইল আল্ সাহাবা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন (২:৬৪১ # ১০৮৯)।


(গ) ইমাম হুসাইন ইবনে আলী এবনে আবি তালেব (রা:)-কে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখে হযরত উমর ফারুক (রা:) তাঁকে বলেন, “এ ঘরে প্রবেশ করার অনুমতির ক্ষেত্রে আপনি (আমার ছেলে) আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের (রা:) চেয়েও বেশি হকদার! আপনি আমাদের কপালে (তকদীরে) যা লেখা হয়েছে তা দেখতে পান; অতএব, প্রথমে আল্লাহ্ তার পরে আপনি!” এই কথা বলার সময় হযরত উমর (রা:) ইমাম হোসাইনের (রা:) হাত মোবারক নিজ কপালে রাখেন। রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন ইবনে সা’দ, ইবনে রাহুইয়া এবং আল্ খতীব।


(ঘ) হযরত জাবের (রা:) বলেন যে তিনি হযরত উমর (রা:)-কে মিম্বরে উঠে বলতে শুনেছেন, একজন তরুণীকে (হযরত আলী ও মা ফাতেমার কন্যা উম্মে কুলসুমকে) বিয়ে করার জন্যে আমাকে অপমান করো না, কেননা আমি হুজুর পূর নূর (দ:)-কে বলতে শুনেছি - ‘শেষ বিচার দিবসে সকল উপায় বন্ধ হয়ে যাবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক কাটা পড়বে, কেবল আমারটা ছাড়া’। এটি বর্ণনা করেছেন তাবারানী। ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী (রহ:) বলেছেন যে এর বর্ণনাকারীরা হলেন আল্ বুখারী ও মুসলিমেরই বর্ণনাকারী।


ওই বিয়ের মাধ্যমে হযরত উমর ফারুক (রা:) রাসূলে পাক (দ:)-এর আহল্ বা আত্মীয় হতে অভিলাষী হয়েছিলেন, যেহেতু আহলে বায়তের অগ্রাধিকার রয়েছে মহানবী (দ:)-এর শাফায়াতের ক্ষেত্রে।


(১০) এই শাফায়াত কোনোক্রমেই শুধু নবী করীম (দ:)-এর বা হযরত আব্বাস (রা:)-এর দোয়া করা নয়, যা বাতিলপন্থীরা দাবি করছে বা আলোচ্য ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছে; বরং এই শাফায়াত ছিল তাঁদের যাত বা সত্তা এবং দোয়ার মাধ্যমে, যা অসংখ্য বিবরণের মধ্য হতে নিম্নের কয়েকটিতে আক্ষরিকভাবে বলা হয়েছে:


(ক) হযরত ইবনে উমর (রা:)-এর ভাষ্যানুযায়ী মহানবী (দ:)-এর যাত মোবারকের মাধ্যমে শাফায়াত: সহীহ্ বোখারী শরীফে আব্দুল্লাহ্ ইবনে দিনার (রা:) বলেন, ‘আমি হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা:)-কে আবু তালেবের কবিতা আবৃত্তি করতে শুনলাম - ‘শুভ্র সেই সত্তা যার চেহারা মোবারক দ্বারা মেঘমালা কামনা করা হয়; যিনি এতিম-অনাথদের লালন-পালনকারী ও বিধবাদের রক্ষক।’


উমর ইবনে হামযা বলেন, সেলিম তাঁর বাবা হযরত ইবনে উমর (রা:)-এর কথা উদ্ধৃত করেন যিনি বলেন, ‘মহানবী (দ:) বৃষ্টির জন্যে দোয়ারত অবস্থায় তাঁর চেহারা মোবারকের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় কবির সেই দুটো পংক্তি আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। আর তিনি (মিম্বর থেকে) নেমে আসেন নি যতোক্ষণ না প্রতিটি ছাদ থেকে মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয়েছিল’।


কোনো এক বর্ণনাকারী ওই দুটি পংক্তিকে আবু তালেবের রচিত বলেছেন।


এখানে উল্লেখ্য যে, মোহাম্মদ মোহ্সিন খান বোখারী শরীফ (৩২:৬৫)-এর নিজস্ব ব্যাখ্যায় হাদীসের বাণী পরিবর্তন করে অর্থ লিখেছেন, ‘একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি যাঁকে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করা হয়েছিল।’ এখানে ‘যাঁর চেহারা মোবারক দ্বারা মেঘমালা কামনা করা হয়’ - বাক্যটি পরিবর্তিত হয়েছে। আর এটাই হলো তাহরিফ, অর্থাৎ, আল্ কুরআনের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী দলিলের বিকৃতি সাধন এবং বাক্-কসরতের মাধ্যমে ওর উদ্দেশ্যের মধ্যে বিচ্যুতি সৃষ্টি।


(খ) হযরত উমর ফারুক (রা:)-এর ভাষ্যানুযায়ী হযরত আব্বাস (রা:)-এর যাত মোবারকের মাধ্যমে শাফায়াত প্রার্থনা:

“ওহে মানুষেরা! রাসূলে খোদা (দ:) হযরত আব্বাস (রা:)-কে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার মতো বিবেচনা করতেন; তাঁকে সম্মান করতেন এবং তাঁর অধিকারকেও। অতএব, ওহে মানুষেরা, হুজুর পাক (দ:)-এর চাচার সত্তা মোবারকের আকৃতিতে নবী করীম (দ:)-এর হুকুম মান্য কর এবং হযরত আব্বাস (রা:)-কে তোমাদের এই দুর্যোগের সময় মহাপরাক্রমশালী খোদা তা’লার দরবারে প্রার্থনাকালে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ কর!”


এই বর্ণনাটি হযরত উমর ফারুক (রা:) হতে আল্ বালাযিরী নির্ভরযোগ্য সনদে লিপিবদ্ধ করেছেন; আর দুর্বল সনদে ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণনা করেছেন আল্ যুবায়র ইবনে বাক্কার নিজ ’আল্ ‘আনসাব’ পুস্তকে এবং ইবনে আসাকির তাঁর তারিখে দিমাশক্ গ্রন্থে (৮:৯৩২), যা ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) কর্তৃক প্রণীত ফাত্হ পুস্তকে উদ্ধৃত হয়েছে (১৯৫৯ সংস্করণ, ২:৪৯৭)। শায়খ মাহমুদ মামদুহ্ তাঁর রাফ’আল মিনারা (১২০ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে আল্ আলবানীর ‘তাওয়াসসুল’ পুস্তকে উত্থাপিত দাবির খন্ডন করেছেন এই মর্মে যে, ওই পুস্তকের ৬৭-৬৮ পৃষ্ঠায় আলোচ্য রেওয়ায়াতটিকে ‘মুদতারিব’ বা তালগোল পাকানো বলাটা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।


আপত্তি:


শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ তাঁর প্রণীত আল্ বালাগ-উল-মুবীন বইয়ে লিখেছেন যে, পরলোকগত কারো শাফায়াত কামনা কিংবা অনুপস্থিত কারো তাওয়াসসুলকে খলীফা উমর (রা:) জায়েয মনে করেন নি।


জবাব: এই বক্তব্য শাহ্ ওযালিউল্লাহর লিখিত ফুয়ুয-উল-হারামাইন গ্রন্থে প্রদত্ত অভিমতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর ব্যাখ্যায় শুধু এতটুকুই বলা যায়, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর অনেক বইপত্র বাতেলপন্থীদের হাতে বিকৃত হয়েছে।


এ কথা সর্বজন জ্ঞাত যে, বিভিন্ন প্রাণী ও কীট-পতঙ্গ নিজেরাই বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করে থাকে, যেভাবে নবী করীম (দ:)-এর পিঁপড়া সংক্রান্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছে। এই হাদীস্ রেওয়ায়াত করেছেন হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে দারু কুতনী, তাঁর ছাত্র আল্ হাকিম ও নিম্নবর্ণিত হাদীসবেত্তাগণ: ইবনে আবি শায়বা (৬:৬২, ৭:৭১), আবু আল শায়খ তাঁর আল্ আযামা পুস্তকে (৫:১৫৭২), তফসীরে ইবনে কাসীর (৩:৩৬০), ইমাম ইবনে হাজর তাঁর তালাখিস্ ও আল্ হাবীর গ্রন্থ দু’টোতে (২:৯৭ # ৭১৮), ইবনে আল্ মুলাক্কিন স্বরচিত খোলাসাতুল বদর বইয়ে (১:২৫০), আল্ সান’আনী নিজ সুবুলুস্ সালাম গ্রন্থে (২:৮৩), আলা শওকানী স্বরচিত নায়ল্ আল্ আওতার পুস্তকে (৪:২৭), এবং থানভী নিজ “ইলা আল্ সুনান” বইয়ে (৪:১৯৩)।


এস্তেস্কা তথা বৃষ্টির জন্যে নামাযের সময় আমাদের প্রতি সুন্নাহের বিধান হলো গবাদি ও উট-ঘোড়া ইত্যাদি পশুগুলোকেও খোলা ময়দানে বের করে আনতে হবে। কেননা, মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন- “(যাকাত প্রদান থেকে বিরত) ব্যক্তিদের প্রতি বৃষ্টি মঞ্জুর করা হতো না, যদি না গবাদি পশুরা থাকতো।” এ হাদীস বর্ণনা করেছেন ইবনে মাজাহ্ (রহ:)। অন্যত্র তিনি এরশাদ ফরমান- “চরে খাওয়া গবাদি পশু না হলে তোমাদের প্রতি আক্ষরিক অর্থেই শাস্তি নেমে আসতো।” এ হাদীস্ রেওয়াযাত করেছেন আবু ইয়ালা, আল্ বাযযার এবং অন্যান্যরা।


এখন আমাদের জিজ্ঞাস্য, গবাদ পশুর মধ্যস্থতা মেনে নেয়া যায়, অথচ আমাদের প্রিয়নবী (দ:)-এর শাফায়াত/ তাওয়াসসুল মানা যায় না কেন? এ কেমন আচরণ?


প্রকৃত বিষয় হলো, খলীফা উমর (রা:) কখনোই এ কথা মনে করেন নি যে আমাদের রাসূল (দ:) ‘মরে’ গিয়েছেন বা অনুপস্থিত আছেন। নইলে তিনি কেন মহানবী (দ:) ও হযরত আবু বকর (রা:)-কে তাঁদের রওযা পাকে নিম্নে বর্ণিত ঘটনায় সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন, যা বিশ্বাসভাজন বর্ণনাকারীদের বরাত দিয়ে রেওয়ায়াত করেছেন তাবারানী (রহ:)? আর কেনই বা মহানবী (দ:) ও হযরত আবু বকর (রা:)-এর রওযার পাশে সমাহিত হওয়ার আকুতির চেয়ে তাঁর কাছে ‘অন্য কোনো কিছু এতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়’ বলেছিলেন তিনি, যা সহীহ্ বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে?


কায়স্ ইবনে আবি হাযেম বর্ণনা করেন যে, একদিন খলীফা উমর ফারুক (রা:) মদীনায় অবস্থিত মসজিদে নব্বীর মিম্বরে উঠে মানুষদের উদ্দেশ্যে ফরমান:


“নিশ্চয় আ’দন-এর বাগানে (বেহেস্তে) একটি প্রাসাদ আছে যার ৫’শটি দরজা; প্রতিটি দরজায় ৫ হাজার বেহেস্তী হুর দায়িত্বরত; কেউই ওতে প্রবেশ করতে পারবে না একজন নবী ছাড়া।” অতঃপর তিনি বিশ্বনবী (দ:)-এর রওযা মোবারকের দিকে ফিরে আরয করলেন, “আপনাকে অভিনন্দন, হে রওযা মোবারকে শায়িত নবী” (দ:)! এর পর তিনি আবার বল্লেন, “এবং কেউই ওতে প্রবেশ করতে পারবে না একজন সিদ্দিক (সত্যনিষ্ঠ) ছাড়া।” এ কথা বলে তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)-এর রওযা পাকের দিকে ফিরে সম্ভাষণ জানালেন, “আপনাকে মোবারকবাদ, হে আবু বকর (রা:)।” অতঃপর হযরত উমর (রা:) ফরমালেন, “এবং কেউই ওতে প্রবেশ করতে পারবে না একজন শহীদ (ধর্মযুদ্ধে নিহত) ছাড়া।” এ কথা বলে তিনি নিজের দিকে ইশারা করলেন এবং আপনাআপনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে, “ওহে উমর, কবে তুমি শাহাদাত বরণ করলে”? অতঃপর তিনি আপনাআপনিই বল্লেন, “যিনি আমাকে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের জন্যে বের করে এনেছেন, তিনিই আমাকে শাহাদাত এনে দেবেন।”


তাবারানী (রহ:) নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতকারীদের বরাত দিয়ে এ বর্ণনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর আল্ আওসাত পুস্তকে যা ইমাম ইবনে হাজর হয়তামী (রহ:) উদ্ধৃত করেছেন তাঁর প্রণীত মজমাউল জাওয়াইদ গ্রন্থে (৯:৫৪-৫৫)।


প্রশ্ন: আহনাফ তথা (পূর্ববর্তী) বুযুর্গ আলেম-উলামাবৃন্দ কি মনে করেন যে খলীফা উমর (রা:) এ বিষয়ে এজতেহাদ (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) প্রয়োগ করেছিলেন? আর আহনাফ কি তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন এ ব্যাপারে? অনুগ্রহ করে ব্যাখ্যা করুন।


জবাব: খলীফা উমর ফারুক (রা:)-এর এই কাজ (তাওয়াসসুল) মূলতঃ সুন্নাহ্ হিসেবে পরিগণিত। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া হয় যে তা মৌলিক সুন্নাহ্ নয়, তথাপি এই মহান ধর্মে খুলাফায়ে রাশেদীনের (খলীফাবৃন্দের) ইজতেহাদও সুন্নাহের বৈধ দলিল হিসেবে গৃহীত, যার সাথে কোনো মযহাবেরই ভিন্নমত পোষণ করার অধিকার নেই। বস্তুতঃ আহনাফ কখনোই খলীফার সাথে কোনো বিষয়েই দ্বিমত পোষণ করেন নি, যদিও তা মনগড়াভাবে প্রমাণ করতে অপতৎপর হয়েছে আহলে বেদআত তথা বেদআতীরা।

[ডঃ হাদ্দাদের এই লেখাটি www.livingislam.org থেকে অনূদিত হয়েছে।]

আউলিয়ার মাযার থেকে সাহায্য প্রার্থনা





মূল: মুহাম্মদ আকদাস্ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: মুহাম্মদ রুবাইয়েৎ বিন মূসা

আউলিয়ার মাযার যেয়ারত করে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করা ইসলাম ধর্মে বৈধ কি-না, এ প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিম উম্মাহর উলামায়ে হাক্কানী রব্বানীবৃন্দের আকিদা-বিশ্বাস বিবেচনা করবো।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আক্বীদা-বিশ্বাস

(
১) হযরত বুরায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে খোদা এরশাদ ফরমান,
نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا.
-          ইতিপূর্বে তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে যেয়ারত করো[১]

এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দীসে দেহেলভী লিখেছেন যেঅজ্ঞতার যুগ সবেমাত্র পার হওয়ায় রাসূলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যেয়ারত নিষেধ করেছিলেন এই আশঙ্কায় যে মুসলমানবৃন্দ পুরোনো জীবনধারায় প্রত্যাবর্তন করবেন। তবে মানুষেরা যখন ইসলামী ব্যবস্থার সাথে ভালোভাবে পরিচিত হলেন, তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেয়ারতকে অনুমতি দিলেন। 

(২)হযরত ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا.
-          আমি তোমাদের কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে যেয়ারত করো []

(
৩) মুহাম্মদ বিন নোমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান,
مَنْ زَارَ قَبْرَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدِهِمَا فِي كُلِّ جُمُعَةٍ غُفِرَ لَهُ، وَكُتِبَ بَرًّا.
-          যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবার তার পিতা-মাতার বা তাঁদের যে কোনো একজনের কবর যেয়ারত করে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং পুণ্যবানদের একজন হিসেবে তার নাম লেখা হবে [৪] 

সকল হাদীস থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কবর যেয়ারত বৈধ। উপরস্তু, যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবার তাঁর পিতামাতার কবর যেয়ারত করেন, তাঁর গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এ হাদীস প্রমাণ করে যে বেসালপ্রাপ্ত পুণ্যাত্মাদের যেয়ারত তথা সাক্ষাৎ দ্বারা দুনিয়ার মানুষ কল্যাণপ্রাপ্ত হন। অর্থাৎ, বেসালপ্রাপ্ত পুণ্যাত্মাবৃন্দ জগতবাসী মানুষের মঙ্গল করতে পারেন।]

ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আকীদা-বিশ্বাস

আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন,
قَالَ: إنِّي لَأَتَبَرَّكُ بِأَبِي حَنِيفَةَ وَأَجِيءُ إلَى قَبْرِهِ، فَإِذَا عَرَضَتْ لِي حَاجَةٌ صَلَّيْت رَكْعَتَيْنِ وَسَأَلْت اللَّهَ تَعَالَى عِنْدَ قَبْرِهِ فَتُقْضَى سَرِيعًا.
-          আমি ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর মাযার যেয়ারত করি। আমার যখন কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, তখন আমি দুরাকাত নামায আদায় করে ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযার যেয়ারত করি এবং তৎক্ষণাৎ আমার প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়[৫]

শায়খ আব্দুল হক দেহেলভীও লিখেন: ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে হযরত মূসা কাযেমের (রহমতুল্লাহি আলাইহি) মাযারে তাৎক্ষণিক দোয়া কবুল হয় []

সকল লেখনীতে প্রতিভাত হয় যে, ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি’র এ মর্মে আকিদা-বিশ্বাস ছিল আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারত করে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ এবং মাযারস্থ আউলিয়ায়ে কেরাম বিপদ-আপদ দূর করার একটি মাধ্যম, এ বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করাও বৈধ।

ইমাম সাবী মালেকী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা-বিশ্বাস
وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ.
-          আল্লাহর নৈকট্যের জন্যে অসীলার অন্বেষণ করো []

এই আয়াতটি ব্যাখ্যাকালে ইমাম সাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আল্লাহ্ ভিন্ন অপর কারো এবাদত-বন্দেগী করছেন মনে করে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারতকারী মুসলমানদেরকে কাফের আখ্যা দেয়া স্পষ্ট গোমরাহী। তাঁদের মাযার যেয়ারত করা আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারো এবাদত-বন্দেগী নয়, এটা হলো আল্লাহ্ যাঁদেরকে ভালোবাসেন তাঁদেরকে ভালোবাসার নিদর্শন[]

ইমাম সাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায় যে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার যেয়ারত বৈধ এবং এটা আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারো পূজা-অর্চনা নয়, বরং আল্লাহ্ যাঁদেরকে ভালোবাসেন তাঁদেরকে ভালোবাসার নির্দশন।

সুলতানুল মাশায়েখ হযরত নিযামউদ্দীন আউলিয়ার আক্বীদা-বিশ্বাস

হযরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে মওলানা কাটহেলী একবার তাঁর নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন: কোনো এক বছর দিল্লীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আমি একটি বাজার এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম আর তখন আমার খিদে পেয়েছিল। আমি কিছু খাবার কিনে মনে মনে বল্লাম, এ খাবার আমার একা খাওয়া উচিৎ নয়; এটা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে হবে। এমতাবস্থায় আমি এক বৃদ্ধ মানুষের দেখা পেলাম যাঁর গায়ে চাদর মোড়ানো ছিল। আমি তাঁকে বল্লাম, ওহে খাজা! আমি গরিব এবং আপনাকেও গরিব মনে হচ্ছে। মওলানা কাটহেলী ওই বৃদ্ধকে খাবার গ্রহণের জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন এবং তিনি তা গ্রহণ করলেন। মওলানা কাটহেলী বলেন, আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখন আমি ওই বয়স্ক মরুব্বীকে জানালাম যে আমি ২০ টাকা (রূপী) ঋণগ্রস্ত। এ কথা শুনে ওই বয়স্ক মরুব্বী আমাকে খাওয়া চালিয়ে যেতে তাগিদ দিলেন এবং ওই ২০ টাকা (রূপী) এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমি আপন মনে ভাবলাম, তিনি ওই টাকা পাবেন কোথায়খাওয়া শেষে সেই বয়স্ক মরুব্বী উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে মসজিদে নিয়ে গেলেন। এই মসজিদের ভেতরে একটি মাযার অবস্থিত ছিল।  তিনি ওই মাযারের কাছে কী যেন চাইলেন। তাঁর হাতে যে ছোট লাঠি ছিল তা দ্বারা দু বার মাযারে আলতোভাবে ছুঁয়ে তিনি বল্লেন, এই লোকের ২০ টাকা প্রয়োজন, তাকে তা দেবেন। অতঃপর বয়স্ক মরুব্বী আমার দিকে ফিরে বল্লেন, ‘মওলানা, ফিরে যান; আপনি আপনার ২০ টাকা পাবেন।

আমি এ কথা শুনে ওই মরুব্বীর হাতে চুমো খেলাম এবং শহরের দিকে ফিরে চল্লাম। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কীভাবে আমি ওই ২০ টাকা খুঁজে পাবো। আমার সাথে একটা চিঠি ছিল যা কারো বাসায় আমাকে পৌঁছে দেবার কথা ছিল। ওই চিঠি যথাস্থানে নিয়ে গেলে আমি জনৈক তুর্কী ব্যক্তির দেখা পাই। তিনি তাঁর গৃহ-ভৃত্যদের বল্লেন আমাকে ওপর তলায় নিয়ে যাবার জন্যে। আমি তাঁকে চেনার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না, কিন্তু তিনি বার বার বলছিলেন কোনো এক সময় নাকি আমি তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। আমি তাঁকে না চেনার কথা বল্লেও তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন বলে জানালেন। আমরা এভাবে কিছুক্ষণ কথাবর্তা বল্লাম। অতঃপর তিনি ভেতর থেকে ফিরে এসে আমার হাতে ২০ টাকা গুজে দিলেন [৯]

হযরত নিযামউদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বর্ণিত এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে তিনি এ মর্মে বিশ্বাস পোষণ করতেন যে আউলিয়ায়ে কেরাম যাহেরী/প্রকাশ্য জিন্দেগীতে থাকাকালীন সময়ে যেভাবে মানুষদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম, ঠিক একইভাবে মাযারস্থ অবস্থায়ও তাঁরা মানুষদেরকে আধ্যাত্মিক সাহায্য দিতে সক্ষম। আর তাঁদের কাছে এই সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। প্রকৃত দাতা হলেন আল্লাহ তালা; আউলিয়ায়ে কেরাম আমাদের সাহায্য করেন আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে; যেমনিভাবে প্রকৃত আরোগ্য দানকারী হলেন আল্লাহ্ পাক, কিন্তু রোগীরা আরোগ্যের জন্যে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।

আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা-বিশ্বাস

আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি শায়খ আবুল হারিস আওলাসী রহমতুল্লাহি আলাইহি-কে উদ্ধৃত করেন,  যিনি বলেন যে, হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শুনেছেন। তাই কিছু মাসআলা সম্পর্কে জানতে আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সাথে দেখা করার কথা মনস্থ করেন। কিন্তু যখন তিনি মিসর পৌঁছেন তখন জানতে পারেন যে হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বেসালপ্রাপ্ত (খোদার সাথে পরপারে মিলিত) হয়েছেন। এমতাবস্থায় আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মাযারে যান এবং মোরাকাবায় বসেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি হয়রান বোধ করেন এবং ঘুমিয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-কে স্বপ্নে দেখেন এবং তাঁর প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন। শায়খ মিসরী তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাঁর কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে দেন [১০]

ঘটনার কথা উল্লেখ করে আল্লামা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর আকীদা-বিশ্বাস স্পষ্ট করলেন এ মর্মে যে, কোনো প্রয়োজন নিয়ে আউলিয়ায়ে কেরামের মাযারে যাওয়া বৈধ। তাঁরা আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমাদেরকে সাহায্য করে থাকেন।

ইমাম ইবনে হাজর মক্কী শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা

ইমাম ইবনে হাজর মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেন,
وَاَنَّ قَبْرَهُ يُزَارُ لِقَضَاءِ الْحَوَائِجِ اِعْلَمْ اَنَّهُ لَمْ يَزَلِ الْعُلَمَاءُ وَذَوو الْحَاجَاتَ قَبْرَهُ وَيَتَوَسَّلُوْنَ عِنْدَهْ فِيْ قَضَاءِ حَوَائِجِهِمْ يَرُوْنَ نَجْحَ ذَلِكَ مِنْهُمْ الْأِمَامُ الشَّافِعِيِ رَحْمَهُ اللهُ لَمَا كَانَ بِبَغْدَادٍ فَأِنَّهُ جَاءَ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ: إنِّي لَأَتَبَرَّكُ بِأَبِي حَنِيفَةَ وَأَجِيءُ إلَى قَبْرِهِ، فَإِذَا عَرَضَتْ لِي حَاجَةٌ صَلَّيْت رَكْعَتَيْنِ وَسَأَلْت اللَّهَ تَعَالَى عِنْدَ قَبْرِهِ فَتُقْضَى سَرِيعًا.

-          উলামা যাদের প্রয়োজন তাঁদের মধ্যে এই আচার সবসময়ই চালু ছিল যে তাঁরা ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযারে যেতেন এবং নিজেদের অসুবিধা দূর করার জন্যে তাঁর মাধ্যমে দোয়া করতেন। এ সকল ব্যক্তি এটাকে সাফল্য লাভের একটা অসীলা মনে করতেন এবং এর অনুশীলন দ্বারা বড় ধরনের পুরস্কার লাভ করতেন। বাগদাদে থাকাকালীন সব সময়েই ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযারে যেতেন এবং তাঁর কাছে আশীর্বাদ তালাশ করতেন। যখন আমার (ইমাম ইবনে হাজর) কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন আমি দুরাকাত নামায আদায় করে তাঁর মাযারে যাই এবং তাঁর অসীলায় দোয়া করি। ফলে আমার অসুবিধা তক্ষণি দূর হয়ে যায় [১১]

লেখনী থেকে পরিস্ফুট হলো যে, ইমাম ইবনে হাজর মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি বুযুর্গানের দ্বীনের মাযার যেয়ারত ও তাঁদের অসীলা গ্রহণকে বৈধ জানতেন এবং ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি-ও এর ওপর আমলকারী  ছিলেন।

শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আক্বীদা

শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেন: কবর যেয়ারত করা মোস্তাহাব (প্রশংসনীয়); এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে[১২]

তিনি আরও লিখেন: যেয়ারতের সময় কবরস্থদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব (অবশ্য কর্তব্য), বিশেষ করে পুণ্যবান বান্দাদের ক্ষেত্রে। তাঁরা যাহেরী জিন্দেগীতে থাকাকালীন তাঁদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা যেমন প্রয়োজনীয় ছিল, একইভাবে তাঁদের মাযারেও তা প্রদর্শন করা জরুরি। কেননা, মাযারস্থ বুযুর্গানে দ্বীন যে সাহায্য করে থাকেন, তা তাঁদের প্রতি যেয়ারতকারীদের  প্রদর্শিত ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মানের ওপরই নির্ভর করে।[১৩]

লেখনী থেকে পরিস্ফুট হয় যে শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি আউলিয়ার মাযার যেয়ারত ও তাঁদের তওয়াসসুল (মধ্যস্থতা) গ্রহণকে শেরক বা বেদআত বলে জানতেন না। উপরন্তু, তাঁর মতে এটা পছন্দনীয় কাজ এবং এর দ্বারা যেয়ারতকারীরা মাযারস্থ বুযুর্গানের দ্বীনের সাহায্য পান ও আশীর্বাদধন্য হন।

শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ দেহেলভীর আকীদা-বিশ্বাস

শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ লিখেন যে তাঁর পিতা শাহ্ আব্দুর রহীম বলেছেনএকবার আমি হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতেয়ার বাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযার শরীফ যেয়ারত করতে যাই। এমতাবস্থায় তাঁর রূহ্ মোবারক আমার সামনে দৃশ্যমান হন এবং আমাকে বলেন যে আমার একজন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, আর আমি যেন ওর নাম রাখি কুতুবউদ্দীন আহমদ। ওই সময় আমার স্ত্রী বয়স্ক হয়ে গিয়েছিল এবং সন্তান ধারণের বয়স পেরিয়েছিল। তাই শায়খের এ কথা শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম সম্ভবত আমার নাতি হতে যাচ্ছে। হযরত বখতেয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি আমার মনের কথা বুঝতে পেরে সন্দেহ দূর করে দিলেন এ কথা বলে যে তিনি নাতির খোশ-খবরী (শুভ সংবাদ) দেন নি, বরং আমার নিজের একজন পুত্র সন্তানের কথা বলেছেন। কিছু কাল পরে আমি আবার বিয়ে করি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে (শাহ্) ওয়ালিউল্লাহর জন্ম হয়।”  শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ বলেন, ’আমার জন্মের সময় আমার বাবা ওই ঘটনার কথা ভুলে গিয়েছিলেন আর তাই আমার নাম রেখেছিলেন ওয়ালিউল্লাহ্। তাঁর যখন এ ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, তখন তিনি আমার দ্বিতীয় নাম রাখেন কুতুবউদ্দীন আহমদ।[১৪]

এ ঘটনা বর্ণনা করে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ তাঁর বিশ্বাস সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা আমাদের দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পুণ্যবান আউলিয়াবৃন্দের মাযারে যাওয়া জায়েয এবং বেসালের পরও আউলিয়ায়ে কেরামের কাছে গায়েবের খবর জানা আছে, যেমনটি হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতেযার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি ওই পুত্র সন্তানের জন্মের এক বছর আগে এ সম্পর্কে জানতেন। উপরস্তু, মাযারস্থ বুযুর্গানে দ্বীন মনের খবরও জানেন।

শাহ্ আব্দুল আযীয দেহেলভীর আক্বীদা-বিশ্বাস

শাহ্ আব্দুল আযীয লিখেন: শরহে মাকাসিদ গ্রন্থে লেখা আছে যে

اَلْأَصْلِيَّةُ أَنَّهَا نَافِعَةٌ. وَحَقَيْقَةُ الْعَوْدِ تَوَجَّهُ الشَّيِّء إِلَىْ مَا كَانَ عَلَيْهِ وَالْمُرَادُ هَهُنَا الرُّجْوْع ُإِلَىْ الْوُجْودِ بَعْدَ الْفَنَاءِ أَوْ رُجُوْع ِأَجْزَاءِ الْبَدَنِ إِلَىْ الْاِجْتِمَاعِ بَعْدَ التَّفَرُّقِ وَإِلَىْ الحْيَاَةِ بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْأَرْوَاحِ إِلَىْ الْأَبْدَانِ بَعْدَ الْمُفَارَقَةِ وَأَمَّا الْمَعَادُ الرُّوْحَانِيْ الْمَحَضُ عَلَىْ مَا يَرَاه الْفَلَاسَفة فَمَعْنَاهُ رُجْوْعُ الْأَرْوَاحِ إِلَىْ مَا كَانَتْ عَلَيْهَ مِنْ التَّجَرُّدِ عَنْ عَلَاقَةِ الْبَدَنِ.

মাযার যেয়ারত করা উপকারী এবং মাযারস্থ আউলিয়ায়ে কেরামের রূহ্ মোবারক উপকার সাধন করতে সক্ষম। বাস্তবিকই বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলিত)-প্রাপ্ত হবার পরে আউলিয়ায়ে কেরামের রূহ্ মোবারক তাঁদের শরীর ও মাযারের সাথে সম্পর্ক রাখেন। তাই কেউ যখন কোনো ওলীর মাযার যেয়ারত করেন এবং ওই ওলীর প্রতি মনোযোগ দেন, তখন উভয় রূহের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। [১৫]

ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করা হয়েছে যে আউলিয়ায়ে কেরাম জীবিতাবস্থায় বেশি সাহায্য করতে সক্ষম, না বেসালপ্রাপ্ত অবস্থায়। কিছু উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে বেসালপ্রাপ্ত আউলিয়া বেশি সাহায্য করতে সক্ষম; আর কিছু উলামা হুজুর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস এ মতের স্বপক্ষে পেশ করে তা প্রমাণ করেছেন; হাদীসটিতে এরশাদ হয়েছে,
إِذَا تَحَيَّرْتُمْ فِي الْأُمُورِ فَاسْتَعِينُوا بِأَهْلِ الْقُبُورِ.
-          যখন তোমরা কোনো ব্যাপারে পেরেশানগ্রস্ত হও, তখন মাযারস্থ (আউলিয়া)-দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।[১৬]

শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি শরহে মেশকাত গ্রন্থে বলেছেন যে এই বিষয়টির পরিপন্থী কোনো দালিলিক প্রমাণ কুরআন ও সুন্নাহ্ কিংবা সালাফবৃন্দের বাণীতে বিদ্যমান নেই।[১]

ফতোওয়ায়ে আযীযিয়ার এই উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে পুণ্যবান আউলিয়ার মাযার যেয়ারত করা উত্তম একটি আমল এবং তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা শরীয়তে জায়েয (বৈধ)।

তথ্যসূত্র:

[১] মুসলিম : আস সহীহ, বাবু ইসতি‘যানিন নবীয়্যি, ২:৬৭২ হাদীস নং ৯৭৭
(ক) ইবনে মাজাহ : আস সুনান, বাবু মা জা‘আ ফি যিয়ারাতিল কুবূর,   ১:৫০১ হাদীস নং ১৫৭১।
(খ) আবু দাউদ : আস সুনান, বাবু ফি যিয়ারাতিল কুবূর, ৩:২১৮ হাদীস নং ৩২৩৫।
(গ) নাসায়ী : আস ‍সুনান, যিয়ারাতুল কুবূর, ৪:৮৯ হাদীস নং ২০৩২।
(ঘ) আব্দুর রাযযাক : আল মুসান্নাফ, ৩:৫৬৯ হাদীস নং ৬৭০৮।
(ঙ) ইবনে আবী শায়বা : আল মুসান্নাফ, ৩:২৯ হাদীস নং ১১৮০৪।
(চ) আহমদ : আল মুসনাদ, ১:১৪৫ হাদীস নং ১২৪৫।
(ছ) ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ৩:২৬১ হাদীস নং ৯৮১।
(জ) তবরানী : আল মু‘জামুল আওসাত, ৩:১৩৩ হাদীস নং ২৭০৯।
(ঝ) দারে কুতনী : আস সুনান, ৫:৪৬৭ হাদীস নং ৪৬৭৯
(ঞ) হাকিম : আল মুস্তাদরাক, ১:৫৩০ হাদীস নং ১৩৮৬।
(ট) বায়হাকী : আস সুনানুস সগীর, ২:৩৬ হাদীস নং ১১৫৩।
(ঠ) বাগাবী : শরহুস সুন্নাহ, ৫:৪৬২ হাদীস নং ১৫৫৩।
[২] আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : আশ্আতুল লোমআত, ১:৭১৭
[৩] ইবনে মাজাহ : আস সুনান, বাবু মা জা‘আ ফি যিয়ারাতিল কুবূর,   ১:৫০১ হাদীস নং ১৫৭১।
[৪] তবরানী : আল মু‘জামুল আওসাত, ৬:১৭৫ হাদীস নং ৬১১৪।
(ক) বায়হাকী : শু‘য়াবুল ঈমান, ১০:২৯৭ হাদীস নং ৭৫২২।
(খ) আল খতিব : মিশকাতুল মাসাবীহ, ১:৫৫৩ হাদীস নং ১৭৬৮।
(গ) হাকিম তিরমিযী : নাওয়াদিরুল উসূল ১:৯৬।
[৫] ইবনে আবিদীন : রাদ্দুল মুহতার আল দুররিল মুখতার, ১:৫৫।
[] আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : আশ্আতুল লোমআত, ১:৭১৫
[] আল্ কুরআন : আল মায়েদা, ৫:৩৫।
[] সাবী : আত তাফসীর, ১:২৪৫
[] ফাওয়াইদ আল ফাওয়াদ, ১২৪ পৃষ্ঠা।
[১০] নাফহাত আল্ উনস্ ১৯৩ পৃষ্ঠা
[১১] ইবনে হাজর মক্কী : খায়রাত আল্ হিসান, ১:৭২
[১২] আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : আশ্আতুল লোমআত, ১:৭১৫
[১৩] প্রাগুক্ত : :৭১০
[১৪] আনফাস্ আল্ আরেফীন, ১১০ পৃষ্ঠা
[১৫] তাফতাযানী : শরহু মাকাসিদ, ২/২০৯।
[১৬] মোল্লা আলী কারী : মিরকাত শরহু মিশকাত, ৪:১২৫৯ হাদীস নং ১৭৫৯।
[১৭] ফতোওয়ায়ে আযীযিয়া : ২য় খণ্ড, ১০৮ পৃষ্ঠা।



[
এ লেখাটি www.aqdas.co.uk শীর্ষক ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে]