Saturday, 4 October 2025

বিভ্রান্তির জবাব

-মওলানা মুহাম্মদ নিজামউদ্দীন


চট্টগ্রাম।

 

ইমাম শে‌রে বাংলা (রহমাতুল্লা‌হি আলাইহ্) তাঁর 'দেওয়া‌নে আযীয'-এ হযরত কেবলা গাওসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (রহমাতুল্লা‌হি আলাইহ্)সহ যাঁ‌দের‌কে গাওসুল আযম খেতা‌বে স‌ম্মোধন ক‌রে‌ছেন, তা বরহক ও স‌ঠিক। কারণ যে সমস্ত ওলীয়া‌য়ে কেরাম কুতু‌বিয়্যা‌তের মহান মর্যাদায় পৌঁ‌ছে‌ছেন, তাঁ‌দের বেলায়ও গাওস‌ুল আযম শব্দের এতলাক করা তরীক‌তের দৃ‌ষ্টি‌কো‌ণে জা‌য়েয। তাঁরা সবাই হুযূর গাওসুল আযম আবদুল কা‌দের জিলানী (রহমাতুল্লা‌হি আলাইহ্)এর না‌য়েব হি‌সে‌বে গাওসুল আযম। এটা হুযূর গাওসুল আযম আবদুল কা‌দের জিলানী (রহমাতুল্লা‌হি আলাইহ্) 'র গাওসিয়া‌তে কুবরাকে অস্বীকার করা নয়।


আমা‌দের জানা উ‌চিত, ইমাম শে‌রে বাংলা (রহমাতুল্লা‌হি আলাইহ্) তাঁর দেওয়া‌নে যাকে যে অ‌ভিধায় খেতাব ক‌রে‌ছেন, তা তি‌নি দে‌খেশু‌নেই ক‌রে‌ছেন। কারণ, তি‌নি শুধুমাত্র একজন উচুমা‌পের আ‌লেম বা আল্লামা ছি‌লেন তা নয়, বরং একজন আ‌রিফ‌বিল্লাহ ওলীও ছি‌লেন। এ প্রকার আ‌রিফ‌বিল্লারাই তাঁদের হাল ও মকাম সম্প‌র্কে অবগত থা‌কেন। যা সাধারণের প‌ক্ষে জানা অসম্ভব।


এসব আধ্য‌াত্মিক ‌বিষ‌য়ে ইমাম শে‌রে বাংলার মত আ‌রিফ‌বিল্লাদের কথাই আমা‌দের জন্য দলীল। এর বাই‌রে যাওয়া বেয়াদবী। এ বেয়াদবী বেঈমানীর প‌থে নি‌য়ে যায়। আল্লাহর পানাহ্।


মা‌সিক তরজুমা‌নে আমার প্রব‌ন্ধে আমা‌দের কোন মুসাল্লাম বুয‌র্গের গাও‌সিয়াত‌কে অস্বীকার করা হয় নি। এখা‌নে হুযূর আযম আবদুল কা‌দের জিলানীর মকাম ও মর্যাদা‌কে ইমাম আলা হযরতের রচনার আ‌লো‌কে তু‌লে ধরা হয়ে‌ছে। আর ইমাম আলা হযরতও তাঁর কোন নিজস্ব মত ব্যক্ত ক‌রেন‌নি, তি‌নিও পূর্ববর্তী শরীয়ত ও তরীক‌তের মহান ইমাম‌দের মতামত‌কে তু‌লে ধ‌রে‌ছেন মাত্র।


এ‌ বিষ‌য়ে আমার অনুদিত ও ২০১০ সা‌লে প্রকা‌শিত "গাওসুল আযম ও গাও‌সিয়াত" বই‌য়ের ভূ‌মিকায় আ‌রো বিস্ত‌ারিত আ‌লোচনা ক‌রে‌ছি। প্রয়োজ‌নে যেখা‌নে দেখা যে‌তে পা‌রে।




Tuesday, 30 September 2025

বড়পীর (রহ.)-এর গেয়ারভী শরীফ মাহফিলে শরীক হয়ে উপলব্ধি



-এডমিন

আজ হযরতে গাউছে পাক বড়পীর সাহেব কেবলা (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর বেসাল বার্ষিকী পালন উপলক্ষে এক মীলাদ মাহফিলে যোগ দিয়েছিলাম। এটা আসলে (চন্দ্র) মাসিক ফাতিহা। যাহোক, যিকর-আযকারের সময় আমার মনে একটা চিন্তার উদয় হয়। এখানে তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।

আমার মনে হয়েছে, দ্বীন-ইসলামে বিশ্বাস পুরোপুরি আধ্যাত্মিকতার উপর নির্ভরশীল। বাহ্যিক শরঈ দলিলপত্র যা কিতাবসমূহে লেখা হয়েছে, তা ওই আধ্যাত্মিকতাকে সমর্থন দেয়ার খাতিরেই লিপিবদ্ধ। কেননা, এ ধর্মপ্রচার প্রথম আরম্ভ করেন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তাঁকে দেখেই মানুষ ধর্মান্তরিত হতে থাকেন। মানে তাঁর মধ্যে বিরাজমান আধ্যাত্মিকতা ও ঐশী ক্ষমতা দেখতে পেয়ে তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের প্রত্যক্ষকৃত ঘটনার অভিজ্ঞতা এরপর বইপত্রে লিপিবদ্ধ বা রেকর্ড হয়। অতএব, ধর্মপ্রচারকের সত্তা মুবারকে নিহিত ঐশী/আধ্যাত্মিক প্রভাব এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ প্রভাব আল্লাহতায়ালার নৈকট্যজনিত, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
একইভাবে, গাউছে পাক বড়পীর সাহেব কেবলা (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-ও বিশাল আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর সূফী-শাইখ হিসেবে সাধারণ মানুষের মাঝে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁকে দেখেই তাঁরা বুঝতে পারেন যে তিনি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ওলী/বন্ধু। সুতরাং তাঁরা দলে দলে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন (মানে মুরীদ হন)। আজমীর শরীফের গরীবে নওয়াজ হযরতে খাজায়ে মুঈনউদ্দীন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-ও তাঁর এলাকার মানুষের মনে একই রকম প্রভাব ফেলেন। আউলিয়া কেরাম (রহ.) যুগে যুগে এভাবেই সর্বসাধারণকে পথের দিশা দিয়েছেন, যা তাঁদের জীবনী রচয়িতাবৃন্দ বইপত্রে লিপিবদ্ধ করেছেন।

এক্ষণে জ্বলন্ত প্রশ্নটি হলো, পুণ্যাত্মা ধর্মপ্রচারকদের সত্তা মুবারকের প্রতি বিশ্বাস আগে, না বইপত্রের দলিলাদি আগে? আমার মনে হয়েছে, কলেমা-আকায়েদ, ফেক্বাহ, হাদীস, তাসাউফ ইত্যাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন জারি রেখেই স্বীকার করতে হবে যে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ধর্মপ্রচারকদের সত্তা মুবারকের সোহবত/সান্নিধ্য এক্ষত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়। দলিলগুলো শুধু মানুষকে সহজভাবে বোঝাবার খাতিরেই। নতুবা বিশ্বাস বিনা দলিলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চাই। ব্যক্তিগত জীবনে সংঘটিত ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকেই তা উৎসারিত। বস্তুতঃ আউলিয়া (রহ.)-এর উপস্থিতি ছাড়া ধর্মের প্রচার-প্রসার অবান্তর, বিশেষ করে বর্তমান যুগে বাতিলপন্থীদের দৌরাত্ম্য যেখানে সাধারণ মানুষকে দিশেহারা করে দিচ্ছে! কেননা তাদের কিতাবী ধর্মচর্চা তো মানুষকে ঐশী আলোর/নূরের দিশা দিচ্ছে না।
আমি সংক্ষেপে আমার উপলব্ধি এখানে ব্যক্ত করলাম। ইসলামী শরীয়তের দলিলাদিকে গৌণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তা চর্চা বাধ্যতামূলক। তবে আমি মনে করি, এসব দলিল বুঝতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও আউলিয়া এজাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-বৃন্দের আধ্যাত্মিক সুনজর একান্ত জরুরি। নইলে বিভ্রান্তি গ্রাস করবে।

আল্লাহ আমাদেরকে উপলব্ধি করার তৌফীক দিন, আমীন।

*সমাপ্ত*

Sunday, 27 July 2025

পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাযার স্থানান্তর প্রসঙ্গে মালয়েশীয় প্রধান সরকারি মুফতীর ফতোয়া

 

-এডমিন

এই শরঈ বিষয়টি বড়ই তত্ত্বগত ও সূক্ষ্ম। মুহাক্কেক উলামাবৃন্দ কর্তৃক বিবেচ্য। আমি মালয়েশিয়ার সরকারি মুফতী সাহেবের ফতোয়া অনলাইনে পেয়ে তা এখানে শেয়ার করলাম। তাঁর ফতোয়ার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

১/ বিনা কারণে বা প্রয়োজনে এ কাজ করা না-জায়েয/অবৈধ।

২/ জায়েয হবে জরুরি পরিস্থিতিতে - যেমন, পানিতে ডুবে গেলে, মাটি ধ্বস, অসম্মান হবার আশঙ্কা ইত্যাদিতে। [মুগনী আল-মুহতাজ, ১/৪৯৬; বুসায়রা আল-করীম, ২/৩৯; এবং সাবিল আল-মুহতাদিন ৮৫]

৩/ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাঁদের শহীদানের মাযার স্থানান্তর করেছেন পানিতে ভেজার কারণে।

৪/ আবূ আবদুল্লাহ আল-জুবাইরীর মতামত, যা’তে তিনি বলেছেন যে কবর যদি জলপ্রবাহের পথে, সেচের পথে থাকে অথবা মাটি স্যাঁতসেঁতে থাকে তবে স্থানান্তর করা জায়েয, তার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন:
قول الزُبيرِي أَصحُ فقدْ ثبتَ فِي صحيحِ البخارِي عَن جابرِ بن عبدِ الله رَضِى الله عنهما أنهُ دَفنَ أباهُ يومَ أحدٍ معَ رجلٍ آخرٍ في قبرٍ قالَ ثُمَّ لَمْ تَطِبْ نفسِي إن أتركَهُ مع آخرٍ فاستخرجتُهُ بعدَ ستةٍ أشهرٍ فَإِذَا هوَ كَيومٍ وضعتُهُ هُيئةٍ غيرَ اذنِهِ وفِى روايةٍ للبخارِي أيضًا اخرجتُهُ فجعلتُهُ فيِ قبرٍ علي حدةٍ وذكرَ ابنٌ قتيبةَ فِي المعارفِ وغيرِهِ ان طلحةَ بن عبدِ اللهِ أحد العشرةَ رضي الله عنهُمْ دُفنَ فرأتْهٌ بنتُهُ عائشةٌ بعدَ دفنِهِ بثلاثينَ سنةً فِي المنامِ فشكَا إليهَا النَزَّ فأمرتْ بِهِ فاستخرجَ طريًّا فدُفنَ فَي دارِهِ بالبصرةِ.

অর্থ: “আল-জুবাইরীর মতামত সবচেয়ে শক্তিশালী; এই বিষয়ে বুখারীতে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, যেখানে উহুদ যুদ্ধের সময় তাঁর বাবাকে একই কবরে আরও দুজন ব্যক্তির সাথে দাফন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “তাঁকে অন্যদের সাথে দাফন করতে দিতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, তারপর ছয় মাস পর আমি তাঁকে কবর থেকে বের করে আনলাম। আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে তাঁর অবস্থা যখন তাঁকে দাফন করা হয়েছিল তখনকার মতোই, তাঁর কান ছাড়া।” (ইমাম আল-বুখারীর আরেকটি বর্ণনায় এসেছে), ”আমি তাঁকে কবর থেকে বের করে তাঁর নিজের কবরে স্থানান্তরিত করেছি।” আল-মা’আরিফ গ্রন্থে ইবনু কুতাইবা এবং অন্যান্যরা বলেছেন, "হযরত আবূ তালহা বিন কুতাইবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা (দশজন সাহাবীর মধ্যে একজন যাঁদের জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে)-কে দাফন করা হয়েছিলো ত্রিশ বছর আগে। তারপর একদিন তাঁর মেয়ে আয়েশা একটি স্বপ্ন দেখেন, যেখানে তিনি হযরত তালহা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে অভিযোগ করতে দেখেন যে তাঁর মাযার স্থির থাকা পানিতে ভরা। পরে আয়েশা তাঁর বাবার জিসম মুবারক মাযার থেকে বের করে আনলেন, আর জিসম মুবারক তখনও ভালো অবস্থায় ছিল এবং তারপর বসরায় তাঁর নিজের শহরে দাফন করা হলো।” [ইমাম আন্-নববী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর কৃত আল-মজমুআ’ ৫/২৭৩ দেখুন]
ছবি: ইমাম নববী (রহ.)-এর মাযার শরীফ, নওয়া শহর, দারা অঞ্চল, সিরিয়া:



Friday, 25 July 2025

সুন্নীয়ত প্রচার ও রাফেযী বদ-নজর/বান-টোনা


- এডমিন

দ্বীনী (ফেসবুক) বন্ধুরা, জি, উপরের শিরোনামটি সঠিক পড়েছেন। আমাদের মুফতী মওলানা শহিদুল্লাহ বাহাদুর ভাই সুন্নীয়ত প্রচারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষে একটি চমৎকার বই লিখেছেন। কিন্তু এর জন্যে তিনি রাফেযী বদ-নজরে পড়েছেন। বান-টোনা (voodoo/black magic) রাফেযীচক্র চর্চা করে থাকে - এটা আমি জানি নিশ্চিত। অনেক দরবারিও এতে জড়িত। তবে তাদেরকে চিহ্নিত করার কোনো প্রয়োজন মনে করি না।
আমিও রাফেযী গোষ্ঠীর আক্রমণ থেকে মুক্ত নই। অর্থাৎ এসব কুফরী কালাম চালাচালি হচ্ছে। কিন্তু আমি ভয় পাই না। কেননা আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ আমারই পীর ও মুর্শীদ কেবলা (রহমতুল্লাহি আলাইহি)। বুমেরাংয়ের মতো প্রত্যাঘাতপ্রাপ্ত হবে! অতএব, সাবধান! তবে সুন্নীয়ত প্রচারে যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদেরকে বলবো নিচের দোয়াটি ঘনঘন পাঠ করতে - لاَ حَولَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ الْعَلِيِّ الْعَظِيمِ لاَ مَنْجَأ وَلاَ مَنْجَأ مِنَ اللهِ إِلاَّ إِلَيْهِ - অর্থ: "আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (কোনো) অবলম্বন নেই, কোনোরূপ শক্তি নেই, যিনি সমুন্নত, মহান। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো আশ্রয়স্থল বা মুক্তির পথ নেই।”
আমার দাদাপীর সাহেব কেবলা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ১৯৭৫ সালে একটি ওয়াজে বলেছিলেন, “যাদু সত্য, বদ-নজরও সত্য; জীবিত মানুষকে কবরে পৌঁছে দেয়।” অতএব, আমি তাঁরই শরণাপন্ন হলাম, যাতে তিনি আমাকে সুরক্ষিত রাখেন, আমীন।

Friday, 9 May 2025

উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে আউলিয়া-ই-কেরাম (রহ.)-এর ভূমিকা

লেখক: মরহূম হাফিজ মওলানা মঈনুল ইসলাম

সম্পাদনা: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বসৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী। সৃষ্টির আদিতে তাঁরই পবিত্র সত্তায় নবূয়্যতের সূচনা এবং তাঁরই পবিত্র সত্তায় সেটার পরিসমাপ্তি। এ অর্থে তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশ্য এবং তিনিই প্রচ্ছন্ন। হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) তাঁর উম্মত হিসেবে কিয়ামতের পূর্বে আবির্ভূত হবেন, নবী হিসেবে নন। এ জন্যেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম) এ পার্থিব জগতে জীবিত থাকতেন, তাহলে আমার অনুসরণ ব্যতিরেকে তাঁর কোনো গত্যন্তর ছিলো না” [আল-হাদীস]। নবুয়্যত ও রিসালাতের ক্রমধারার পরিসমাপ্তি ঘটলেও বেলায়াতের দ্বার রুদ্ধ হয়নি। এ কারণেই যুগে যুগে আল্লাহর আউলিয়ায়ে কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) আল্লাহর বান্দাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকীম তথা (ঐশী) সহজ-সরল রাস্তায় প্রতিষ্ঠিত রাখবার মহৎ উদ্দেশ্যে এ ধরাধামে আগমন করে থাকেন। তাঁরা আম্বিয়া-ই-কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁদের প্রচারিত ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে থাকেন এবং কুসংস্কারমুক্ত করে খাঁটি ধর্মের স্বরূপ জগদ্বাসীর সামনে তুলে ধরেন; আর ধর্মীয় আলোড়নের মাধ্যমে নবজাগরণের সৃষ্টি করেন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রতিটি শতাব্দীতে একজন মুজাদ্দেদ তথা ধর্ম-সংস্কারক আগমন করবেন, যিনি ধর্মকে কুসংস্কারমুক্ত করে নবজীবন দান করবেন” [আল-হাদীস]। মনুষ্যকুলের আদি পিতা হযরত আদম (আলাইহিস্ সালাম) হতে হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম) পর্যন্ত বহু নবী এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। তাঁদের প্রচারিত ধর্ম হচ্ছে দ্বীন-ইসলাম। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা চিরন্তন ও আদি এবং এটা পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হয়েছে নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে। পবিত্র কুর’আনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” এই ঘোষণার মাধ্যমে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রচারিত ও প্রবর্তিত দ্বীন পূর্ণাঙ্গ ইসলাম, যা আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের ধারক ও বাহক আল্লাহর আউলিয়ায়ে কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-ও আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুগ্রহ ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত। শ্রেষ্ঠ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বদৌলতে তাঁরাও শ্রেষ্ঠ। এ জন্যেই কালামে পাকে (ঐশীবাণীতে) তাঁদের শানে একাধিকবার অভয়বাণী উচ্চারিত হয়েছে। তাঁরাই মহিমাময়ের মহিমার বিকাশ বা প্রকাশস্থল; (আল্লাহর) প্রিয়ভাজন বান্দা; সৃষ্টিজগতের জন্যে ঐশী করুণা ও কল্যাণ; নিপীড়িত মানবতার মুক্তিদাতা; সত্য ও ন্যায়ের দিশারী; সর্বোপরি, সৃষ্টিকুলের কৃতজ্ঞতাভাজন। 


ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস অতি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ ভারতের রাজা পেরুমল প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র হাতে ইসলামের বাইআত গ্রহণ করেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ভারতের কালিকট, সুরাট মালাবার, গুজরাট, কচ্ছ প্রদেশ (বর্তমানে জেলা), সিন্ধু, মুলতান, বেলুচিস্তান এমন কী বঙ্গের সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইসলামের আলো পৌঁছে গিয়েছিলো।


বিগত ৭১২ খ্রীষ্টাব্দ সালে মুহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতের মুসলিম শাসনের ভিত্তিস্থাপন করেন। তিন বছর পর খলীফার নির্দেশক্রমে তিনি দামেস্কে ফিরে যান। তাঁর সঙ্গী-সাথীবৃন্দের মধ্যে হাজারেরও অধিক এবং ত্রিশ হাজারেরও অধিক ভারতীয় নও-মুসলিম তিনি এদেশে রেখে যান। এভাবে পশ্চিম ভারতে মুসলিম বসতি গড়ে উঠে। এই সমস্ত মুসলিমের তা’লিম-তরবীয়তের (তথা শিক্ষা-দীক্ষার) জন্যে সর্ব-শাইখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়্যা মুলতানী, সাইয়্যেদ আলী হিজবিরী লাহোরী (দাতা গঞ্জেবখশ্), আবূল হাসান খিরকানী কাবুলী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) প্রমুখ সূফীয়ায়ে কেরামের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শ্রম-সাধনার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ভারতের সর্বত্র ইসলামের প্রচার-প্রসার তাঁদেরই সাধনার ফসল।


ভারতীয় মুসলিমদের সাথে ভারতীয় অ-মুসলিম/মুশরিকদের সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপনের যাবতীয় প্রচেষ্টা এক সময় ব্যর্থ হয়। কেননা ইসলামের প্রচার-প্রসার দেখতে পেয়ে এতদঞ্চলের রাজা-বাদশাহ গং এ ধর্মকে এখান থেকে বিদায় করার অভিপ্রায়ে তৎপর হন। এতে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি নিপীড়ন-নির্যাতন আরম্ভ হয়। সে সময় সুলতান গাজী মাহমূদ গযনবী গযনী শাসন করছিলেন। তিনি মুসলমানদের করুণ দশা সম্পর্কে অবহিত হয়ে ১০০১ খ্রীষ্টাব্দ সাল হতে ১০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সতেরো বার ভারতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং মুসলমানদের কষ্ট অনেকাংশে লাঘব করেন। গোয়ালিওর, উজ্জয়িনী, নগরকোট, মুলতান, কাশমীর, কনৌজ, দিল্লী, আজমীর, পাঞ্জাব ইত্যাদি এলাকা ও সোমনাথ মন্দির তাঁর আয়ত্তাধীন হয়। কিন্তু কোথাও তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করে শাসন পরিচালনা করেন নি। 


বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করার অনুমোদন ইসলামে নেই। সুলতান মাহমূদ বলপ্রয়োগ করলে অধিকাংশ ভারতীয় অমুসলিমকে তিনি হয়তো ধর্মান্তরিত করতে পারতেন এবং বর্তমান ভারত উপমহাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হতো। তিনি তা করেন নি। সোমনাথ মন্দিরের যুদ্ধে তিনি হযরতে বায়েযীদ বোস্তামী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর রূহানী খিলাফতপ্রাপ্ত শাইখ আবূল হাসান খিরকানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) প্রদত্ত খিরকাহ পরিধান করে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এরপর থেকেই ভারতে আউলিয়ায়ে কেরাম (রহ.)-এর ইসলাম প্রচার-প্রসার ও শাসন প্রতিষ্ঠার আন্তরিক আগ্রহ দেখা দেয়। বস্তুতঃ হযরতে খাজা আবূ মুহাম্মদ চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) গায়েবী/ঐশী নির্দেশে সত্তর বছর বয়সে সোমনাথের যুদ্ধে শরীক হন। ওই বিজয়ের পর চিশ্তীয়া তরীকার আউলিয়ায়ে কেরাম (রহ.) নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া শুরু করেন এবং রূহানী শক্তির মাধ্যমে ভারতের আনাচে-কানাচে ইসলামের শাশ্বত বাণী পৌছে দেন। সুলতানুল হিন্দ হযরতে খাজা গরীবে নওয়াজ মুঈনউদ্দীন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর দাদাপীর হযরতে খাজা জিন্দানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার শরীফ কারো কারো মতে উত্তর ভারতের কনৌজ শহরে অবস্থিত। যদি তা-ই হয়, তবে পারস্যের চিশত্ হতে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি তথায় আগমন করেছিলেন।


হযরত খাজা উসমান হারূনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে এবং নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশে ঈসায়ী/খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ভারতে আগমন করেন। সেই সময় গজনীর সুলতান মুয়ীযুদ্দীন মুহাম্মদ শিহাবুদ্দীন ঘোরী ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে ভারতীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। খ্রীষ্টাব্দ ১১৯১ সালে তরাইন বা সিরহিন্দের (প্রথম) যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যের মোকাবিলায় পরাজিত হয়ে বিফল মনোরথে মুহাম্মদ ঘোরী গজনী ফিরে যান। ভারতের রূহানী বাদশাহ (সুলতানুল হিন্দ্) হযরতে খাজায়ে মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তখন দিল্লী ও আজমীরের চৌহান-রাজ যোগী সম্রাট পৃথ্বীরাজের রাজধানী দখল করে ইসলামী ঝাণ্ডা বুলন্দ্ তথা উড্ডীন করে দিয়েছেন। দলে দলে যোগী সন্যাসী ও সম্রাট পৃথ্বীরাজের উৎপীড়িত হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রজা সাধারণ হযরতে খাজা আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর হাতে বাইয়াত হয়ে ইসলামী ঝাণ্ডার সুশীতল ছায়ায় সমবেত হতে থাকেন। এতে পৃথ্বীরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে যাদু-টোনা তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা হযরতে খাজা আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর প্রতি অসদাচারণ শুরু করেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই এ মহান ওলীকে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখতে না পেরে চৌহানরাজ নবদীক্ষিত মুসলমানদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। হযরতে খাজায়ে আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এতে খুবই ব্যথিত হন। তাঁর পবিত্র জবান হতে উচ্চারিত হয়, “আমি পৃথ্বীরাজকে সুলতান শিহাবুদ্দীন ও মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে জীবন্ত ছেড়ে দিলাম।” যেদিন তিনি এ কথা বলেন, সেই দিনগত রাতে সুলতান ঘোরী স্বপ্নে দেখতে পান যে, একজন দরবেশ তাঁকে ভারতে বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছেন। অতঃপর তিনি সসৈন্যে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। খ্রীষ্টীয় ১১৯২ সালে পাঞ্জাবের তরাইন বা সিরহিন্দ নামক স্থানে আবারো পৃথ্বীরাজের সাথে তুমূল যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এবার রাজা বন্দী ও নিহত হন। আল্লাহর ওলী হযরতে খাজায়ে আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর দোয়ার বদৌলতে ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কুতুবুদ্দীন আইবেককে ভারতের শাসনভার অর্পণ করে সুলতান ঘোরী গজনীতে ফিরে যান।


খ্রীষ্টাব্দ ১২৩৬ সালে প্রায় একশত বছর বয়সে সুলতান শামসুদ্দীন আল-তামাশের (ইলতুৎমিশের) শাসনকালে প্রায় এক কোটি ভারতীয় অমুসলিমকে দ্বীন-ইসলামে দীক্ষিত করে হযরতে খাজায়ে আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) জান্নাতবাসী হন।


হযরত খাজা আজমীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর প্রধান খলীফা ছিলেন হযরত খাজা কুতু্বুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)। তিনি দিল্লীকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রস্থল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দয়ালু-দাতা শাসক কুতুবুদ্দীন আইবেক ও দরবেশ-ফকির বাদশাহ শামসুদ্দীন আলতামাশ ছিলেন হযরত খাজা কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খাস্ মুরীদ ও ভক্ত। উভয়ই উচ্চস্তরের ওলী ছিলেন। দিল্লী কুতুব মিনারের পাশে খাজা কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) মাযারে শায়িত আছেন। ভারতে ইসলাম প্রচারের ধারা হযরত কাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খলীফা হযরত শাইখ ফরীদুদ্দীন মসউদ গঞ্জেশকর (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর আমলে আরো জোরদার হয়। দিল্লীর সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবনের কন্যা শাহজাদী হুযাইরা’র সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি প্রায় সত্তর হাজার খলীফাকে সমগ্র ভারত ও মধ্য এশিয়ায় ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। মাহবুবে ইলাহী নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও খাজা আলাউদ্দীন আলী আহমদ ফুলাইরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর বিশিষ্ট খলীফা। লক্ষ লক্ষ অমুসলিমকে ইসলামে দীক্ষিত করে ৯৩ বছর বয়সে তিনি জান্নাতবাসী হন। লাহোর ও মুলতানের মধ্যবর্তী পাক-পট্টন শহরে তিনি সমাহিত রয়েছেন।


বাবা ফরীদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর নির্দেশে হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহি) দিল্লীতে আস্তানা স্থাপন করেন। দাসবংশ খিলজী ও তুগলুক বংশের শাসনামলে তিনি দিল্লী ও সন্নিহিত এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। তিনি অপর একজন খাজা নাসিরুদ্দীন (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে ‘চেরাগে দিল্লী’ উপাধি দান করে দিল্লীতে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন। তাঁর প্রধান খলীফা হযরত শাইখ সিরাজুদ্দীন উসমান আঁখি সিরাজ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে  ‘আয়নায়ে হিন্দুস্তান’ উপাধি দান করে বঙ্গে ইসলাম প্রচারের জন্যে প্রেরণ করেন। বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের গৌড় বা পাণ্ডুয়ানগরের সাদুল্লাহপুরে তাঁর আস্তানা ছিলো। গৌড়ের তৎকালীন শাসক শ্রেণি, অভিজাতমহল এবং বহু হিন্দু-বৌদ্ধ তাঁর চরিত্র-মাহাত্ম্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পর তাঁরই শ্রেষ্ঠতম খলীফা হযরত শাইখ আলাউল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বঙ্গে ইসলাম প্রচার করেন। বঙ্গের অমুসলিম শাসক তাঁর প্রতাপ-প্রভাবে ভীত হয়ে তাঁকে লক্ষণাবতী হতে সোনারগাঁয়ে নির্বাসন দেন। সোনারগাঁয়ে তিনি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার আরম্ভ করেন। খ্রীষ্টীয় ১৩৯৮ সালে তাঁর বেসালপ্রাপ্তি হলে তাঁরই সুযোগ্য খলীফা নূরুদ্দীন নূর কুতুবে আলম (রহমতুল্লাহি আলাইহি) পীর ও মুর্শীদের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তাঁর অক্লান্ত সাধনায় পূর্ববঙ্গে অসংখ্য মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হন। খ্রীষ্টীয় ১৪৪৭ সালে তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাইখ জাহিদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বঙ্গে ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৪৫৫ খ্রী: সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।


হযরত শাহ জালাল মুজার্রদে ইয়েমেনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই সময়েই দিল্লীর মাহবুবে ইলাহী শাইখ নিযামুদ্দীন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর অনুমতিক্রমে পূর্ববঙ্গে ইসলাম প্রচার করেন। শাইখ ফরীদুদ্দীন গঞ্জেশকর (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর আরেকজন খলীফা শাইখ মখদুম আলাউদ্দীন আলী আহমদ সাবের (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কালিয়ার শরীফে অবস্থান করে ইসলামে প্রচারে ব্যাপৃত হন। শাইখ আবদুল কুদ্দুস গাংগোহী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন চিশ্তী-নিযামী ও চিশ্তী-সাবেরী উভয় তরীকতী সিলসিলায় খেলাফতপ্রাপ্ত। এই সিলসিলা হযরতে ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাধ্যমে আরো শক্তিশালী হয়ে শুধু সমগ্র ভারতবর্ষে নয়, বরং আরব ও আজমে ইসলাম প্রচারে অবদান রেখেছে। 


বাবা ফরীদ গঞ্জেশকর (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর বংশধর খাজা সলীম চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) দিল্লী-আগ্রার অদূরে ফতেহপুর সিক্রির পাহাড়ে ধ্যান-সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। মোঘল সম্রাট আকবর খবর পেয়ে তাঁর সান্নিধ্যে একাধিকবার গমন করেন। এই চিশ্তী দরবেশের কারামত তথা অলৌকিক ক্রিয়ায় আকবর বাদশাহের ঔরশে ১৫৬৭ সালে এক জগদ্বরেণ্য সন্তানের জন্ম হয়। সম্রাট দরবেশের নামানুসারে তাঁর নাম রাখেন সলীম ওরফে জাহাঙ্গীর। খ্রীষ্টীয় ১৫৬৮ সালে দরবেশের বেসালপ্রাপ্তি হয়। সেই বছরই মহামতি আকবর বাদশাহ ফতেহপুর সিক্রিতে মোঘল সাম্রাজ্যের এক মনোরম রাজধানী স্থাপন করেন। 


সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬০৬ সালে হযরত সলীম চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর খান্দানের ইসলাম খাঁন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে পূর্ব-বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করা হয়। তিনি সোনারগাঁও হতে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। ঢাকায় তাঁর এক স্বনামধন্য বংশধর হযরত খাজা শরফুদ্দীন চিশ্তী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) পূর্ব হতেই ইসলাম প্রচার করেন। খ্রীষ্টীয় ১৬৭৮ সালে তিনি বেসালপ্রাপ্ত হন। তাঁর আগে আজমীর শরীফের স্বনামধন্য একজন ওলী ঢাকায় ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর নাম হযরত শাহজালাল দখিনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)। বঙ্গভবন এলাকায় তাঁর পবিত্র মাযার শরীফ রয়েছে। [সম্পাদকের নোট: আমার মরহূম পিতা কাজী মুহাম্মদ মোশার্রফ হোসেন (সি.এস.পি.) ১৯৭২ সালের সেপটেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতির মুখ্যসচিব পদে যোগ দিলে বঙ্গভবনের ভেতরে সচিবের বাংলোয় আমরা দু বছর বসবাস করেছিলাম। প্রধান ফটক হতে বাঁ দিকে ওই বাংলো অভিমুখী রাস্তার বাঁ পার্শ্বে ছিলো মাযারটির অবস্থান। তবে ছোট্ট একটি ঘরে শায়িত ছিলেন এই দরবেশ।]


ভারতীয় উপমহাদেশে আউলিয়ে কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-এর  ইসলাম প্রচারের ইতিহাস সহজলভ্য নয়। ইসলামের প্রথম যুগ হতে প্রতিটি যুগে বহু আউলিয়া এ উপমহাদেশে এসেছেন। এর প্রমাণ বাংলাদেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। এদেশের একটি জেলাও এমন নেই, যেখানে একাধিক ওলীর মাযার শরীফ নেই। সর্ব-হযরত শাহ্ জালাল, শাহ জামাল, শাহ্ পরাণ, শাহ আলী বাগদাদী, শাহ সুলতান মাহী সওয়ার, শাহ শরফুদ্দীন চিশ্তী, শাহ মখদুম, খাঁন জাহান আলী, বদর শাহ, মোহসেন আউলিয়া, গরীবউল্লাহ শাহ, কমরউদ্দীন রূমী, শাহ আহমদুল্লাহ আল-হাসানী, শাহ গোলামুর রহমান আল-হাসানী, শেখ মুহাম্মদ গৌড়ী, সুলতানুল বাগদাদী, কুতুবে জমান জনাব কাজী আসাদ আলী শাহ, মওলানা নূরুল ইসলাম আল-কাদেরী, সৈয়দ মওলানা এ.জেড.এম. সেহাবউদ্দীন খালেদ (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) প্রমুখ এই বাংলাদেশে সমাহিত রয়েছেন। এ কারণে এদেশকে আউলিয়ার দেশ বলা হয়। বস্তুতঃ যুগ যুগ ধরে অসংখ্য আউলিয়া (রহ.) এ উপমহাদেশে আগমন করে এখানকার মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দান করেছেন। আজ আমরা যে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেই এবং গর্ব করি, এ তো আউলিয়া-ই-কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-এরই অবদান। [সম্পাদকের নোট: আফসোস, বর্তমানে এ ঐতিহ্য সম্পর্কে আত্মভোলা একশ্রেণির মুসলমান নামধারী গণ্ডমূর্খ স্বর্ণযুগের ওই আউলিয়া (রহ.)-বৃন্দের মাযার-দরগাহ নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আসলে তারা ইসলামের দুশমনদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।


*সমাপ্ত*              




          


           

Saturday, 28 September 2024

প্রিয়নবী (দ.) কুর’আন ব্যাখ্যাকারী মর্মে কোনো আয়াত আছে কি? - প্রতিক্রিয়া ও জবাব

 -এডমিন


সম্প্রতি ফেইসবুকে উপরোক্ত শিরোনামের গবেষণামূলক লেখাটির অংশবিশেষ প্রকাশের পরে আমার জনৈক তরীক্বতী ভাই ও ফেইসবুক বন্ধু তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাতে তিনি লেখাটির সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। মন্তব্য সেকশনে তাঁর বক্তব্য আমি পুরোটুকু উদ্ধৃত করছি: 


ভাইয়া লিখেছেন খুব ভালো, তথ্যবহুল। তবে আমার কিঞ্চিৎ অমত আছে। যেসব আয়াত দ্বারা লেখক কোরআন ব্যক্ষ্যার দায়িত্ব হুজুপুরনুর(সাঃ) এর দাবী করেছেন; সেগুলি মুলত রুপক। আল্লাহ হুজুরপুরনুর(সাঃ)কে মুহাব্বত করেন তাই এই legacy. ৫৯ঃ৭ পড়লে বুঝবেন এই আয়াত গনিমতের মাল বণ্টনের ক্ষেত্রে নাজিল হয়েছিল। মুলত আল্লাহই কোরআন ব্যক্ষ্যাকারী ৭৫ঃ১৯। কোরআন নিজেই নিজের তাফসীর, তাফসিল (বিশদ বিবরন) ৩ঃ১৩৮, ২৫ঃঃ৩৩। আল্লাহর বিধানে শরিক নাই ১৮ঃ২৬। মুলত কোরআনই হাদিস ৩৯ঃ২৩,৪ঃ৮৭,৪৫ঃ৬-৮। কেননা ভাষ্য যার ব্যক্ষ্যাও তার। মতানৈক্যের জন্য ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, বেয়াদবি নিবেন না।”


আলোচ্য লেখাটির আংশিক পড়ে ওপরের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। কেননা লেখাটির প্রথমাংশে লিপিবদ্ধ আছে:


কিছু লোক সম্প্রতি বলছে, "আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের কাছে এটি পাঠিয়েছেন এবং আমাদেরকে শুধুমাত্র এর উপর নির্ভর করতে বলেছেন; এবং তিনি আমাদেরকে অন্য কিছুর জন্য দায়ী করেননি।" এইভাবে তারা জ্ঞাতসারে বা অজান্তে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ ত্যাগ করার চেষ্টা করে এবং তারা সন্দেহ সৃষ্টির অপপ্রয়াস পায় দ্বীনী ক্ষেত্রে সুন্নতের প্রামাণ্য দলিল হওয়ার ব্যাপারটিতে, এর (মানে সুন্নাতের) নির্ভরযোগ্যতা ও বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততার ব্যাপারটিতেও {নোট-১: এই অপচেষ্টা নতুন নয়। এদের ভিত্তি প্রাথমিক যুগ থেকেই আরম্ভ হয়। তবে আমরা ওই অভিব্যক্তি দ্বারা বর্তমান সময়ের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। দেখুন - আবূ যাহও কৃত ‘আল-হাদীস ওয়াল-মুহাদ্দিসূন’, মিসর, ১৩৭৮ হি:/১৯৫৮ খ্রী:, ২১ পৃষ্ঠা; আল-সিবাঈ, ‘আস্ সুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা ফীত্ তাশরিঈল্ ইসলাম,’ কায়রো, ১৯৬৬, ১১-১৪ পৃষ্ঠা; আবদুল গনী অবদুল খালিক্ব, ‘হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, বৈরুত, ১৪০৭ হি:/১৯৮৬ খ্রী:, ২৭৮ পৃষ্ঠা; ‘কিরবাসোগলু, এম. হায়রি, ‘ক্বুরআনা গোরে সুন্নাতেন কোনুমু’ (অপ্রকাশিত প্রবন্ধ), পৃষ্ঠা ১-৩, একই বিষয়ে।} কিছু লোক প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ’র ব্যাপারে অলসতা দেখায় এবং এমন মনোভাব গ্রহণ করে যেনো “সুন্নাহকে অনুসরণ করা বা না করা দুটোই ঠিক আছে।” প্রকৃতপক্ষে, কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সুন্নাহকে একটি অসাধারণ মর্যাদা দিয়েছেন এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর আনুগত্যকে তাঁরই আনুগত্যের মতো গণ্য করেছেন।


কুর’আনে বলা হয়েছে যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের জন্য, বিশেষ করে ঈমানদার/বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর আশীর্বাদ; তাঁর প্রতি বিশ্বাস আল্লাহর আনুগত্যের সাথে জড়িত; তাঁকে মানুষের জন্য মডেল হিসেবে দেখানো হয়েছে; এটি বিবৃত হয়েছে যে তাঁকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, যার মানে কুরআনের সাথে অনেক জায়গায় সুন্নাহও রয়েছে যাতে তিনি সেগুলি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন; এবং ওহী শুধুমাত্র কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; অধিকন্তু, আল্লাহর আনুগত্যের সাথে নবীর আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে এবং নবীর আনুগত্যের কথা আলাদাভাবেও বলা হয়েছে।


তবে এটা নিঃসন্দেহ যে সুন্নাহ কখনই কুরআনের মতো একই স্তরে মানা হয়নি; কুরআন সর্বদা প্রথম স্থানে রয়েছে এবং সুন্নাহ এটি অনুসরণ করেছে।


প্রকৃতপক্ষে, এটি মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:)-কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রদত্ত নির্দেশে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে, যখন তাঁকে ইয়েমেনে গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় {নোট-২: তিরমিযী, ‘আহকাম,’ ৩; মুসনাদ, ৫:২৩০; আবূ দাউদ, ‘আক্বদিয়া’, ১১}। উপরন্তু, সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’মণ্ডলীর অনুশীলিত রীতিও একই রকম ছিলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগী ও বেসাল শরীফ উভয় সময়কালেই। তাঁরা প্রথমে কুরআন এবং তারপরে সুন্নাহর রেফারেন্স দিতেন {নোট-৩: এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে ’হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, ২৮৩-২৯১ পৃষ্ঠা দেখুন}।


চলুন, দেখা যাক আমরা এইমাত্র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা কীভাবে কুরআনের আয়াতগুলো প্রকাশ করে।


নিঃসন্দেহে এটি একটি মহান আশীর্বাদ যে মহান আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে একজন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে মনোনীত করেছেন এবং তাঁকে আমাদের কাছে এক জীবন্ত আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন।


(১) কুরআনের যেসব আয়াতে বলা হয়েছে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু’মিনদের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর মহান আশীর্বাদ:


 لَقَدْ مَنَّ ٱللهُ عَلَى ٱلْمُؤمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُّبِينٍ.


অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে, তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন, আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিলো। [আল-ক্বুর’আন ৩:১৬৪, নূরুল ইরফান]


لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ،  فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ ٱللهُ لاۤ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْعَظِيمِ.


অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসূল, যাঁর নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, (যিনি) তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু। [আল-ক্বুর’আন, ৯:১২৮/১২৯, নূরুল ইরফান] {নোট-৪: একই বিষয়ে আরো আয়াত সম্পর্কে জানতে বাক্বারা-১৫২, তওবা-৬১, আম্বিয়া-১০৭, জুমুআ-২/৪ দেখুন} 


নিঃসন্দেহে মানুষ হিসেবে আমাদের যা করা দরকার তা হলো, এই মহান নেয়ামতের মূল্য জানা, যেমনটি আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে {নোট-৫: আল-আহযাব, ৬ আয়াত} এই মর্মে যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে আমাদের আত্মার চেয়েও মূল্যবান মনে করা, তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসা এবং তাঁর মহান সত্তাকে অনুসরণ করা, যাঁকে আমাদের কাছে মডেল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি বিশ্বাস মুসলমান হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। কালেমা আশ-শাহাদায় আল্লাহর পবিত্র নামের সাথে তাঁর মোবারক নামও বিদ্যমান। এছাড়া, কুরআন মজীদে তাঁর প্রতি ঈমান আনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে {নোট-৬: দেখুন সূরাহ আ’রাফ, ১৫৮; নিসা, ১৩৬; তওবা ৯১; নূর, ৬২; ফাতহ, ৮-৯, ১৩; হুজুরাত, ১৫; তাগাবুন, ৮}। নিঃসন্দেহে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের এমন এক অর্থ আছে যা তাঁর স্রেফ নবী হওয়ারও ঊর্ধ্বে, যা অপরিহার্য করে তোলে সেসব বিষয়কে গ্রহণ করা যেগুলোকে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ, উপদেশ, অনুশীলিত রীতি, সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সংক্ষেপে, সকল ক্ষেত্রে তাঁকে মডেল হিসেবে বিবেচনার বিষয়াদি। 


ধর্মে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর অসাধারণ মর্যাদা প্রদর্শনকারী আরেকটি পয়েন্ট হলো এই যে, তাঁকে স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই সকল ক্ষেত্রে মডেল তথা অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পেশ করেছেন। 


(২) কুরআনের যেসব আয়াত মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে পেশ করেছে মডেল হিসেবে:


আমরা কুরআনে দেখতে পাই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহতায়ালা একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যা ঈমানদার তথা বিশ্বাসীদের দ্বারা স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে গৃহীত হবে। এটা বোঝা যায় যে, তাঁকে সকল দিক থেকে মানুষের জন্য একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে; কারণ এই বিষয়ে আয়াতে কোনো শর্ত রাখা হয়নি।


এর মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিম্নরূপ:


لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ ٱللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُواْ ٱللهَ وَٱلْيَوْمَ ٱلآخِرَ وَذَكَرَ ٱللهَ كَثِيراً.


অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর অনুসরণ উত্তম, তারই জন্য, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব স্মরণ করে। [আল-ক্বুর’আন, ৩৩:২১, নূরুল ইরফান]


যাঁরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করেন তাঁদের জন্য আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে একটি সুন্দর আচরণের নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তাঁকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসের সাথে জড়িত, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান করে তাঁর সুন্নাহকে কতোখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 


কুরআন কেবল এ কথাই বলে না যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের জন্য একটি আদর্শ, বরঞ্চ এর ওপরও জোর দেয় যে তিনি চরিত্রবৈশিষ্ট্যের এক উচ্চ মানদণ্ড:


نۤ وَٱلْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ، مَآ أَنتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُونٍ، وَإِنَّ لَكَ لأَجْراً غَيْرَ مَمْنُونٍ، وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ.


অর্থ: নূ-ন। কলম ও তাদের লিখার শপথ। আপনি আপনার রবের অনুগ্রহে উন্মাদ নন; এবং অবশ্যই আপনার জন্য অশেষ পুরস্কার রয়েছে; এবং নিশ্চয় আপনার চরিত্র তো মহা মর্যাদারই। [আল-ক্বুর’আন, ৬৮:১-৪, নূরুল ইরফান]


ধর্মে সুন্নাতের মূল্য প্রদর্শনকারী আরেকটি উপাদান হলো এটি সাধারণভাবে ওহীরই একটি ফল। প্রকৃতপক্ষে আমরা যখন কুরআনের দিকে তাকাই, তখন আমরা অনেক নিদর্শন দেখতে পাই যে ওহী কেবল কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এবং নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের বাইরেও ওহী পেয়েছিলেন।


(৩) যেসব আয়াত উল্লেখ করে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনের বাইরেও ওহী পেয়েছিলেন:


এটি কুরআনে বলা হয়েছে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে নিম্নোক্ত উপায়ে ওহী প্রেরণ করেন:


وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ ٱللهُ إِلاَّ وَحْياً أَوْ مِن وَرَآءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولاً فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَآءُ إِنَّهُ عَلِيٌّ حَكِيمٌ.


অর্থ: কোনো মানুষের পক্ষে শোভা পায় না যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন, কিন্তু ওহী রূপে, অথবা এভাবে যে, ওই মানুষ মহত্ত্বের পর্দার অন্তরালে থাকবে অথবা (আল্লাহ) কোনো ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, সে তাঁর নির্দেশে ওহী করবে যা তিনি চান; নিশ্চয় তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল, প্রজ্ঞাময়। [আল-ক্বুর’আন, ৪২:৫১, নূরুল ইরফান]


অতএব, এটি পরিদৃষ্ট হলো যে আল্লাহ ওপরোক্ত আয়াতে করীমায় বিবৃত করেছেন তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে আপন ইচ্ছানুযায়ী কালাম/কথপোকথন করেন, যা ওই সব পন্থার যে কোনোটি হতে পারে, আর তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে নিজ কালামকে কোনো (ঐশী) কিতাবের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ রাখেন না।


উপরন্তু, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্বুর’আনের বাইরেও যে ওহী পেয়েছিলেন তার ইঙ্গিতবহ একটি দিক হলো কুরআন মজীদের বিবৃতি এমর্মে যে,  নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং অন্যান্য কয়েকজন নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)-কে দেওয়া কিতাবগুলোর পাশাপাশি "হিকমাহ (জ্ঞান-প্রজ্ঞা)" দেওয়া হয়েছিল {নোট-৭: দেখুন সূরাহ বাক্বারাহ, ২৫১; আলে ইমরান, ৪৮; নিসা, ৫৪; সা’দ, ২০; যুখরুফ, ৬৩}। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছে:


كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولاً مِّنْكُمْ يَتْلُواْ عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ.


অর্থ: যেমন আমি তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রাসূল তোমাদের মধ্য থেকে, যিনি তোমাদের প্রতি আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ/পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেন। আর তোমাদের ওই শিক্ষা দান করেন, যার জ্ঞান তোমাদের ছিলো না। [আল-ক্বুর’আন, ২:১৫১, নূরুল ইরফান] {নোট-৮: অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন সূরা বাকারা, ১২৯, ২৩১; আলে ইমরান, ১৬৪; নিসা, ১১৩; আহযাব, ৩৪; জুমুআ’, ২} 


এই "হিকমাহ", যা কিতাবের পাশাপাশি নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)’মণ্ডলীকে দেওয়া হবে বলে উপরের আয়াত এবং অনুরূপ আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে সাধারণত আল্লাহর নবী-রসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)’বৃন্দের প্রতি প্রদত্ত "সুন্নাহ" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম শাফেয়ী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এই বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে প্রকাশ করেছেন:


فذكر الله الكتاب، وهو القُرَآن، وذكر الحِكْمَة، فسمعتُ مَنْ أرْضى من أهل العلم بالقُرَآن يقول: الحكمة سنة رسول الله. وهذا يشبه ما قال، والله أعلم. لأن القُرَآن ذُكر وأُتْبِعَتْه الحكمة.


"আল্লাহ এখানে প্রথমে কিতাব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, যা কুরআন মজীদ, এবং এরপরে "হিকমাহ" সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। আমি কুরআনের তাফসীর-শাস্ত্রে বিজ্ঞ আলেমবৃন্দের কাছ থেকে শুনেছি যে, এখানে (হিকমাহ দ্বারা) যা বোঝানো হয়েছে তা হলো আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সুন্নাহ। কেননা, প্রথমে কুরআনকে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারপরে "হিকমাহ" (শব্দটি) যোগ করা হয়েছে" {নোট-৯: ইমাম শাফেঈ (রহ.), ‘আর-রিসালা’, ১/৭৩}। ইমাম আল-আওজাই (বেসাল: ১৫৭ হিজরী/৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) বর্ণনা করেছেন যে হযরত হাসান বি. আতিয়া (রা.) বলেন,


كَانَ جِبْرِيلُ يَنْزِلُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالسُّنَّةِ، كَمَا يَنْزِلُ عَلَيْهِ بِالْقُرْآنِ.


"জিবরীল (আ.) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে সুন্নাহ নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক যেমনিভাবে তিনি কুরআন নিয়ে এসেছিলেন" {নোট-১০: দারিমী, ‘আস্ সুনান,’ ১/৪৭৪; ‘তাউয়ীলু মুখতালিফিল হাদীস’, ১৬৬ পৃষ্ঠা; কুরতুবী (রহ.), ১:৩৩}।


আমরা কুরআনে এমন তথ্য পাই যে অন্যান্য নবী (আলাইহিমুস্ সালাম)’বৃন্দকেও তাঁদের কাছে প্রেরিত আসমানী কিতাবের বাইরে ওহী পাঠানো হয়েছিল। সর্ব-পয়গাম্বর ইব্রাহিম (আলাইহিস্ সালাম) ও লুত (আলাইহিস্ সালাম)’এর প্রতি তাঁদের নিজ নিজ জাতিকে ধ্বংস করার দায়িত্বের কথা জানিয়ে ফেরেশতাদের বিবৃতি ওই ধরনের ওহী ছিলো {নোট-১১: দেখুন সূরা আনকাবুত, ৩১-৩২; হিজর, ৫২-৭৭}। পয়গাম্বর জাকারিয়া (আলাইহিস্ সালাম), যাঁকে কোনো আসমানী কিতাব পাঠানো হয়নি, আল্লাহ কর্তৃক তাঁর একজন পুত্র সন্তান জন্মাবার কথা জানানোও অনুরূপ একটি বিষয় ছিলো {নোট-১২: আলে ইমরান, ৩৮-৪০}; ঠিক যেমনটি ছিলো মরিয়ম (রা.)’এর সাথে আল্লাহর কালাম, যদিও তিনি নবী ছিলেন না {নোট-১৩: আলে ইমরান, ৪২-৪৫}। অনেক আয়াতে বিবৃত হয়েছে যে, আল্লাহর সাথে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ওহীর বাইরেও যোগাযোগ ছিল {নোট-১৪: এরকম দুটো দৃষ্টান্তের জন্য দেখুন - সূরা আনফাল, ৯-১০; তাহরিম, ৩; বাক্বারাহ, ১৪২-১৪৪}।


উপরোক্ত আল্লাহর সাথে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ওহীর বাইরেও যোগাযোগ থাকার বিষয়ে বর্ণিত ক্বুর’আনী আয়াতগুলোর মধ্যে একটি হলো:


حَافِظُواْ عَلَى ٱلصَّلَوَٰتِ وٱلصَّلَٰوةِ ٱلْوُسْطَىٰ وَقُومُواْ للَّهِ قَٰنِتِينَ، فَإنْ خِفْتُمْ فَرِجَالاً أَوْ رُكْبَاناً فَإِذَآ أَمِنتُمْ فَٱذْكُرُواْ ٱللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ.


অর্থ: সজাগ দৃষ্টি রেখো সমস্ত নামাযের প্রতি এবং মধ্যবর্তী নামাযের প্রতি। আর দণ্ডায়মান হও আল্লাহর সম্মুখে আদব সহকারে। অতঃপর যদি আশঙ্কায় থাকো, তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায়, যেমনি সম্ভব হয়। অতঃপর যখন নিরাপদে থাকো, তখন আল্লাহকে স্মরণ করো - যেমন তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যা তোমরা জানতে না। [আল-ক্বুর’আন, ২/১৩৮-১৩৯; নূরুল ইরফান] 


অতএব, প্রতীয়মান হয় যে নামাজ এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী সালাত (অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, বিকালের আসর সালাত) সর্বোত্তম উপায়ে আদায় করার নির্দেশ দেওয়ার পরে আল্লাহ বলেছেন যে নামাজ পদচারণায় বা ঘোড়-সওয়ার অবস্থায় পড়া যায়। ভ্রমণের সময় যদি কেউ বিপদের আশঙ্কা করেন তবে অশ্বারোহণ করা উচিত; তবে বিপদ কেটে যাওয়ার পরে তিনি আপনাকে যেভাবে শিখিয়েছেন সেভাবে সেগুলি অবশ্যই করতে হবে। এখানে "তিনি আপনাকে যেভাবে শিখিয়েছেন" মর্মে বাক্যটি কৌতূহলোদ্দীপক। যেমনটি জানা যায়, কুরআনে নামায বিস্তারিতভাবে শেখানো হয়নি। সেক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত যে, কুরআনের বাইরেও জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম)’এর মাধ্যমে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর কাছ থেকে কিছু তথ্য পেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কিছু বর্ণনা আছে যে জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে এসেছিলেন এবং নিজে নিজে অনুশীলন করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বিস্তারিতভাবে শিখিয়েছিলেন {নোট-১৫: দেখুন - বুখারী, বাদ’উল-খালক্ব, ৬; মুসলিম, মাসাজিদ, ১৬৬; আবূ দাউদ, সালাত, ২; ইবনে মাজাহ, সালাত ১; মুসনাদ, ১/৩৩৩, ১১১, ৩০}। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবীদেরকেও একইভাবে শিক্ষা দিয়ে বলেন - وَصَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي - "তোমরা সেভাবেই নামাজ আদায় করো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখো।" {নোট-১৬: বুখারী, আযান, ১৮ অধ্যায়, বই-১০, হাদীস-২৮}


উপরন্তু, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কুর’আনে প্রায়শই আদেশ করা হয়েছে যে তাঁর প্রতি যা অবতীর্ণ হয় তা অনুসরণ করতে {নোট-১৭: দেখুন - সূরা নিসা, ১০৫; আল-মায়েদা, ৪৮-৪৯, ৬৭; আন’আম, ১০৬; আহযাব, ১-২; জাতিয়্যা, ১৮}। যদি ওহী শুধুমাত্র কুর‘আনেরই সমষ্টি হতো, আর যেহেতু এটা স্পষ্ট যে ইসলাম শুধুমাত্র কুরআন নিয়ে গঠিত নয়, তাই এটা মেনে নিতে হবে যে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহীর বাইরে অনেক কিছু করেছেন। সেক্ষেত্রে কিছু অসম্ভব বিষয়, যেমন নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দ্বারা আল্লাহর আদেশ পালন না করাকে মেনে নিতে হবে, যা তাঁর সম্পর্কে চিন্তা করাও অসম্ভব {নোট-১৮: কেননা আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করেছেন, বলেছেন তিনি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, আর তিনি তাঁকে আপন উম্মতের জন্য সাক্ষী করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দেখুন - সূরা আম্বিয়া, ১০৭; আহযাব, ৪৫-৪৬; বাক্বারা, ১৪৩}। এরকম কিছু হলে আল্লাহ হস্তক্ষেপ করতেন।


পরিশেষে, আল্লাহ তায়ালা এই বিষয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে নিম্নোক্ত কথা বলেছেন:


وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰ، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَىٰ. 


অর্থ: এবং তিনি কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। তা তো ওহীই, যা তাঁর প্রতি (নাযিল) করা হয়। [আল-ক্বুর’আন, ৫৩:৩-৪; নূরুল ইরফান] {নোট-১৯: অনুরূপ আয়াতের জন্য দেখুন - সূরাহ ইঊনুস, ১৫; আহক্বাফ, ৯; বাক্বারা, ১৪২-১৪৪}


উপরের আয়াতে উল্লিখিত ঐশী অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা কিছু অলেমের মতে শুধুমাত্র কুরআন, কিন্তু অন্যান্য আলেম-উলামার মতে কুর’আন এবং কিছু সুন্নাহ। কেননা, হাদীসসমূহ কখনো ওহী এবং কখনো আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ইজতিহাদ (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত)। তবে তাঁর ইজতিহাদে ভুল থাকলেও আল্লাহ তাঁকে সংশোধন করেন {নোট-২০: এ বিষয়ের উদাহরণ - সূরাহ তওবা, ৪৩, ৮৪; আনফাল, ৬৭; ইসরা, ৭৪; আহযাব, ২, ৩৭; আবাসা, ১-১০; ইঊনুস্, ৯৪; আন’আম, ৩৫, ৫২; তাহরিম, ১; নিসা, ১০৫; মুনাফিক্বূন, ৬; আরো দেখুন - আল্ মাতরাফি কৃত ‘আয়াতুল তাবীলিল্ মুস্তফা’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কায়রো, ১৯৭৭}। এভাবে তাঁর সমস্ত কথা, কাজ এবং অনুশীলন আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন {নোট-২১: দেখুন শাতিবী কৃত ‘আল-মুওয়াফাক্বাত,’ ৪/১৫; মুহাম্মদ হামদী এয়াযীর প্রণীত ‘হাক দীনী কুরআন দিলি,’ ইস্তাম্বুল, ১৯৩৫-১৯৩৯, ৪/৪৫৭১}। তাই তাঁর ধর্মীয় আদেশ ও অনুশীলন যা ওহীর উপর ভিত্তি করে নয়, কিন্তু যেগুলোকে ওহী দ্বারা বাতিল বা সংশোধন করা হয়নি তাকে ওহী হিসেবেই গণ্য করা হয়। অধিকাংশ হানাফী আলেম-উলামা এই ধরনের ওহীকে "ওয়াহী বাতিনী" নামে অভিহিত করেছেন। {নোট-২২: ‘হুজ্জিয়্যাতুস্ সুন্নাহ’, ৩৪০ পৃষ্ঠা}


প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ক্বুর’আনের বাইরেও আল্লাহর ওহী পেয়েছিলেন তা প্রতীয়মানকারী একটি প্রমাণ এই যে, তাঁকে কুর’আন প্রচারের পাশাপাশি কুর’আন ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এটা নিশ্চিত, তিনি তা সম্পন্ন করতেন আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা দ্বারা, তাঁর ব্যক্তিগত জ্ঞান ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে নয়।” [প্রিয়নবী (দ.) কুর’আন ব্যাখ্যাকারী মর্মে কোনো আয়াত আছে কি? - শিরোনামের লেখাটির প্রথমাংশ; গুগল ডকস্ লিঙ্ক: https://docs.google.com/document/d/1kMCmG9EcVyZdfozdQVSYBjsNpurHjOeokueMoYX4rkE/edit?usp=sharing ]


আশা করি সমস্ত প্রশ্নের জবাব উপরের অংশে পাওয়া যাবে। মনে রাখা দরকার যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর legacy তথা উত্তরাধিকারসূচক ধারা বলে কিছু নেই। তা কেবল মৃত ব্যক্তির হতে পারে। আমরা তাঁকে হায়াতুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বাস করি যা নিচের লিঙ্কে প্রমাণিত: https://kazisaifuddinhossain.blogspot.com/2019/05/blog-post.html


সবশেষে, আমি একটি হাদীসের রেফারেন্স দিতে চাই যা এ বিষয়ে ফায়সালাকারী:


أَنَّ رَسُولَ الله ﷺ لَمّا بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ قَالَ لَهُ: كَيْفَ تَقْضِي إِنْ عَرَضَ لَكَ قََضَاءٌ؟ قَالَ: أَقْضِي بِكِتَابِ اللهِ، قَال: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي كِتَابِ اللهِ؟ قَالَ:أَقْضِي بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ ﷺ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ؟ قَالَ: أَجْتَهِدُ رَأْيِي لاَ آلُو، قَال: فَضَرَبَ بِيَدِهِ فِي صَدْرِي، وَقَالَ: الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُلَ رَسُولِ اللهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللهِ ﷺ.


অর্থ: ইয়েমেনে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করার পর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে তিনি বিচার কাজ পরিচালনা করবেন। হযরত মু’আয (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উত্তর দেন, “আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী (أَقْضِي بِكِتَابِ اللهِ)।” রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরপর জিজ্ঞেস করেন, “যদি তুমি আল্লাহর কিতাবে (সমাধান) না পাও (فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي كِتَابِ اللهِ؟)?” ওই সাহাবী (রা.) উত্তর দেন, “তাহলে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বাস্তবায়ন করবো (أَقْضِي بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ ﷺ)।” প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার জিজ্ঞেস করেন, “যদি তাতেও (মানে সুন্নাহ’তেও) না পাও ( فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ؟)?” তখন ওই সাহাবী (রা.) উত্তর দেন, “আমি নিজ ইজতিহাদ প্রয়োগ করে রায় দেবো (أَجْتَهِدُ رَأْيِي لاَ آلُو)।” অতঃপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পবিত্র হাতখানি হযরত মু’আয (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর বুকের উপর স্থাপন করে বলেন, “আল-হামদু লিল্লাহ, আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলের রাসূলকে (মানে সহকারী প্রতিনিধিকে) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সন্তুষ্টির সাথে একাত্ম করে দিয়েছেন (الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُلَ رَسُولِ اللهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللهِ ﷺ)।” [ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ (রহ.): আল-মুসান্নাফ, ফীল কাযী আঁই ইয়ানবাগী ৪/৫৪৩, হাদীস-২২৯৮৮; ইমাম আহমদ (রহ.): মুসনাদ, হাদীসু মু’য়ায বিন জাবাল (রা.), ৫/২৩০, হাদীস - ২২০৬০; ইমাম দারিমী (রহ.), আস্ সুনান, ১/২৬৭, হাদীস - ১৭০; ইমাম মুসলিম (রহ.): সহীহ, বাবুত্ তাহরীজ আলাল ক্বতলিল্ খাওয়ারিজ, ২/৭৪৬, হাদীস - ১০৬৬; ইমাম আবূ দাউদ (রহ.): আস্ সুনান, বাবু ইজতিহাদির্ রায়ি, ৩/৩০৩, হাদীস - ৩৫৯২; তিরমিযী: আস্ সুনান, বাবু মা জা’য়া ফীল্ ক্বাদ্বী, ৩/৯, হাদীস - ১৩২৭; ত্ববরানী: আল্ মু’জামুল কবীর, ২০/১৭০, হাদীস - ১৭১১৯; ইমাম বাগাবী: শরহুস্ সুন্নাহ, বাবু ইজতিহাদিল হাকিম, ১০/১১৬; এবং মুশকিলুল  আছার: আশ্ শরাহ, ২/২১২, হাদীস - ৩৫৮২] 


এখানে লক্ষণীয় যে তিনটি আলাদা আলাদা প্রশ্ন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী উত্তর এসেছে। (১) আল্লাহর কিতাব, (২) সুন্নাহ  এবং (৩) সর্বশেষে পুণ্যাত্মাবৃন্দের রায়/সিদ্ধান্ত। হযরতে মুয়ায ইবনে জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীসটিতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “যদি কুর’আনে না পাও?” মানে কুর’আনে সব বিষয় খোলাসা করে বলা হয়নি। তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, “যদি সুন্নাহ’তে (মানে হাদীসে)-ও না পাও?” অর্থাৎ, তাতেও সব বিষয় খোলাসা নেই। তখন ওই সাহাবী (রা.) বলেন, “আমি আমার রায় (ইজতিহাদ) প্রয়োগ করবো।” এ দেশের আহলে হাদীস গোষ্ঠী উপরের হাদীসটিকে যয়ীফ/দুর্বল বল্লেও পূর্ববর্তী যুগের ইমামবৃন্দ এটাকে সমর্থন করেছেন। দ্বীনী জ্ঞান বিশারদবৃন্দ হাদীসটি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল। অনেক আরবী ওয়েবসাইটে এটা বিদ্যমান যা তুর্কী “ওহাবীদের প্রতি নসীহত” গ্রন্থে নক্বল করা হয়েছে। বস্তুতঃ আহলে হাদীস ও আহলে কুর’আন দুটো গোষ্ঠী-ই ধর্মে ফিতনা সৃষ্টিকারী এবং বেয়াদব! আল্লাহ সবাইকে এদের ফিতনা থেকে রক্ষা করুন, আমীন।  


*সমাপ্ত*        



  


  

Saturday, 21 September 2024

হাদীসের আলোকে ফকির-দরবেশের প্রতি বেয়াদবি নিষেধ

 

-এডমিন

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিরোনামের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আউলিয়া (রহ.)’মণ্ডলীর মাযার-দরগাহে হামলার পাশাপাশি ফকির-দরবেশের প্রতি হামলাও হচ্ছে। এ হীন অপকর্ম করছে নজদী-ওহাবীদের অনুসারীচক্র। হযরত শাহ পরাণ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযারে হামলার ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। ফকিরি পথ ও মতের অনুসারীদের মধ্যে কে যে ওলী, তা তো বলতে পারবে না এসব নালায়েক্ব বেয়াদব! পরে এমন বদ দোয়া পড়বে যে গোটা জাতিকেই না গুনতে হয় এর মাশুল! কেননা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন:

হাদীস শরীফ

"‏رب أشعث أغبر مدفوع بالأبواب لو أقسم على الله لأبره ‏"‏ ‏(‏‏(‏رواه مسلم‏)‏‏)‏‏.

অর্থ
(হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন), ’’বহু এমন লোকও আছে যার মাথা উষ্কখুষ্ক ধুলোভরা, যাদেরকে দরজা থেকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। (কিন্তু সে আল্লাহর নিকট এতো প্রিয় যে) সে যদি আল্লাহর নামে কসম খায়, তাহলে আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন।’’ [মুসলিম শরীফ, ২৬২২, ২৮৫৪; রিয়াদুস্ সালেহীন, আন্তর্জাতিক নম্বর ২৫৭]

সারমর্ম
এ হাদীসটি আউলিয়া (রহ.)-বৃন্দের হালত-অবস্থা প্রকাশের পাশাপাশি একটি সতর্কীকরণ বার্তাও। কেননা তাঁদেরকে চেনা যায় না। দরজা থেকে বিতাড়িত তথা সমাজ হতে দূরে হতে পারেন এ সকল দরবেশ। কিন্তু তাঁদের অন্তরে আঘাত করে কিছু করা হলে হয়তো তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়ে বদ দোয়াও করতে পারেন। তাঁরা যা আল্লাহর নামে কসম করবেন, তা-ই তিনি মঞ্জুর করবেন। অতএব, সাবধান! সমাজের সব মানুষের দায়িত্ব ওই সব নালায়েক্ব বেয়াদবদের লাগাম টেনে ধরা! নতুবা বেয়াদবির দরুন মহাবিপদ ডেকে আনা হবে। এ হাদীসের অন্তর্নিহিত বাণী উপলব্ধি করাই হবে সবার জন্যে মঙ্গল। যারা ধর্মের শরঈ দলিল খোঁজে বেশি, হাদীসের এ দলিলটি তাদের বেশি করে পড়া এবং আত্মস্থ করা জরুরি।
আল্লাহতায়ালা সবাইকে বোঝার সামর্থ্য দিন, আমীন।

*****************************************************************************************************