Tuesday, 7 May 2019

✯শাফা`আতে রাসুল (সঃ)✯


════❖════ ইমরান বিন বদরী

নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মা বা’দ। সমস্ত প্রশংসা পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।

 শাফাআত-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সুপারিশ, মাধ্যম ও দু’আ বা প্রার্থনা। একজন উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এর চেয়ে বড় কী আশা থাকতে পারে যে, কাল ক্বিয়ামতের কঠিনতম সময়ে নবী রাহমাতুল্লীল আলামীনের শাফা`আত প্রাপ্তি হবে ! কতইনা সৌভাগ্যবান ওইসব ব্যক্তি,যাঁদেরকে আল্লাহর হাবীব (দ:) হাশরের মাঠের মহাসংকটের দিনে সুপারিশ করবেন। আখেরাতে অনুষ্ঠেয় শাফাআতের প্রার্থনার বিষয়টি আমাদের অনেকের কাছেই অস্পষ্ট। শাফা`আত নিয়ে লেখার কখনো ইচ্ছা ছিলো না, কারণ সবাই জানি যে আমরা গুনাহগার। কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারে বিচার দিবসে স্ব স্ব অপরাধের কারণে সেই সৎসাহস নেই যে বলবো - হে আল্লাহ আমি পাপমুক্ত, আপনার বিচারে হিসাব ছাড়াই আপনি আমাকে জান্নাত দান করুন। আর আমরা বলতে পারবো না বলেই এই গুনাহগার উম্মতের মুক্তির জন্য ১৪০০ বছর আগে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে 'রাব্বী হাবলী উম্মাাতী' রাব্বী হাবলী উম্মাাতী' বলে বলে কান্নাকাটি করেছিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাললাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম। কিন্তু আজ অনেকে সেই হাবীবুল্লাহ (দ:)’এর শাফা`আতকে পরোক্ষভাবে সুরা যুমার ৪৪ আয়াত দ্বারা অস্বীকার করছে। অথচ এতো এতো সহীহ হাদিস থাকা সত্ত্বেও তারা দেখেও যেন দেখে না।

বন্ধুরা, আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই; আমার লেখাতেও ভুল হতে পারে। আমি চেষ্টা করি সত্যটাকে উপলব্ধি করতে আর তাই মনের অজান্তে জ্ঞানের স্বল্পতায় ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আমরা জানি কিতাবুল্লাহ তথা পবিত্র কুরআনে করীমের বাণীকে প্রাধান্য দিয়েই হাদীসে রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে গ্রহণ করতে হবে। এখন যে আয়াতের ভিত্তিতে কাঙ্ক্ষিত শাফা`আতকে অস্বীকার করার চেষ্টা, তা সেই সব (মক্কার) কাফেরদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলো যারা মহান আল্লাহর ওয়াহদানিয়তকে স্বীকার করেনি।

মূলতঃ সৃষ্টিকর্তার হাতেই রয়েছে সবকিছুর ক্ষমতা। সুতরাং শাফাআত-ও মহান আল্লাহর এখতিয়ারে। কিন্তু সেই শাফাআতের অধিকার যদি আল্লাহপাক তার প্রিয় হাবীব (দ:)’কে দেন, তাতে আমাদেরই বেশি আনন্দিত হওয়ার কথা। আল্লাহ পাক বলেন:

أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا

অর্থ: আপনার প্রতিপালক অচিরেই সেইদিন আপনাকে ‘মাক্বামে মাহমূদে’ পৌঁছিয়ে দেবেন’। [(সুরা বনী ইসরাঈল ৭৯]

প্রিয়নবী হাবীবুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন সায়্যিদুশ শুফাআ’ বা শাফাআতকারীদের সর্দার হবেন। এ সত্ত্বেও তিনি সিজদাবনত হবেন আল্লাহর দরবারে এ উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

آتي تَحْتَ الْعَرْشِِ فَأَخِرُّ سَاجِدًا

অর্থ: আমি আরশের নিচে আসবো আর সিজদায় লুটিয়ে পড়বো।

 আসুন দেখি সুরা যুমার আয়াতে আল্লাহ পাক কী বলেন -

أَمِ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ شُفَعَاء قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ

অর্থ: তারা কি আল্লাহকে ছেড়ে সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলুন, তাদের কোনো এখতিয়ার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? (সুরা যুমার ৪৩)

قُل لِّلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَّهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সুরা যুমার ৪৪)

এর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহপাক স্পষ্ট করেন কাদেরকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সুপারিশের আওতাভুক্ত করা হবে না।
এদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন,

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

অর্থ: যখন খাঁটিভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়, আর যখন আল্লাহ ব্যতিরেকে অন্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে। (সুরা যুমার ৪৫)

উপরোক্ত আয়াতে দেখুন যারা মুশরিক, অর্থাৎ, আল্লার নাম ভিন্ন অন্য নাম উচ্চারণে যারা আনন্দিত হয়, তাদের জন্য শাফাআতের দরজা খোলা নেই।
🔰এবার শুনুন কাল-কিয়ামত দিবসে মুমিনদের সুপারিশকারীর প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কী বলেন:

وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُم مِّنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ

অর্থ: তারা শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত।
(সুরা আম্বিয়া ২৮)
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন -
يَوْمَئِذٍ لَّا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا
দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না। (সূরা ত্বোয়া-হা ১০৯)
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন -

وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ

অর্থ: আর আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন, সে ছাড়া তাঁর কাছে কোনো সুপারিশ কারো উপকার করবে না।
(সূরাঃ সাবা ২৩)

সুতরাং কিয়ামত দিবসে নিজেদের জন্য বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাললাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের শাফা‘আত আমরা কামনা করতেই পারি। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ''আমাকে শাফায়াতের অধিকার প্রদান করা হয়েছে।'' সেই সাথে যেন বলি: হে আল্লাহ ! কিয়ামত দিবসে আপনি আমার ভাগ্যে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত নছীব করুন।

🔰 হাদিস শরীফে আল্লার প্রিয় হাবীব ইরশাদ করেন:

جَابِرُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌ مِنَ الأَنْبِيَاءِ قَبْلِي، نُصِرْتُ بِالرُّعْبِ مَسِيرَةَ شَهْرٍ، وَجُعِلَتْ لِيَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا، وَأَيُّمَا رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي أَدْرَكَتْهُ الصَّلاَةُ فَلْيُصَلِّ، وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ، وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ كَافَّةً، وَأُعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ "

অর্থ: হযরত জাবির ইবনুূু আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় প্রদান করা হয়েছে, যা আমার আগে কোনো নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে দেয়া হয়নি:

১। আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যা একমাসের দূরত্ব পর্যন্ত অনুভূত হয়।
২। সমস্ত জমিন আমার জন্য সালাত (নামাজ) আদায়ের স্থান ও পবিত্রতা অর্জনের উপায় করা হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের যে কেউ যেখানে সালাত-এর ওয়াক্ত হয় (সেখানেই) যেন সালাত আদায় করে নেয়।
৩। আমার জন্য গণীমত হালাল করা হয়েছে।
৪। অন্যান্য নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেদের বিশেষ গোত্রের প্রতি প্রেরিত হতেন, আর আমাকে সকল মানবের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে।
৫। আমাকে (ব্যাপক) #শাফায়াতের অধিকার প্রদান করা হয়েছে।
(সহিহ বুখারী/৪২৫ইফা/আহমাদ ১৪২৬৮)
➲ হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: প্রত্যেক নবী (আ:)’কে তাঁর উম্মাতের ব্যাপারে একটি করে এমন দু’আর অনুমতি দেয়া হয়েছে, যা অবশ্যই কবুল করা হবে। আমি সংকল্প করেছি, আমার দু’আটি পরে আমার উম্মাতের #শাফাআতের জন্য করবো।(সহীহ মুসলিম/ইফা৩৮৯)

রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ
আমি আমার দু‘আকে ক্বিয়ামাতের দিনে আমার উম্মাতের শাফা‘আতের জন্য রেখে দিয়েছি।
➲ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

(أَنَا أَوَّلُ شَافِعٍ وَ أَوَّلُ مُشَفَّعٍ (متفق عليه

অর্থ: “আমি-ই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার শাফাআত-ই প্রথম গ্রহণ করা হবে। (বুখারী, মুসলিম)

أَنَا أَوَّلُ النَّاسِ يَشْفَعُ فِى الْجَنَّةِ وَأَنَا أَكْثَرُ الأَنْبِيَاءِ تَبَعًا

অর্থ: হযরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত সম্পর্কে আমি-ই হবো সর্বপ্রথম #সুপারিশকারী এবং এতো অধিক সংখ্যক মানুষ আমার প্রতি ঈমান আনবে, যা অন্য কোন নবী (আ:)’র বেলায় হবে না। আম্বিয়া (আ:)’দের কেউ কেউ তো এমতাবস্হায়ও আসবেন, যার প্রতি মাত্র এক ব্যক্তি-ই ঈমান এনেছে। (সহীহ মুসলিম/ইফা ৩৮১)
➲ হজরত ইসহাক ইবনু নাসর (রহঃ) আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এক যিয়াফতে উপস্থিত ছিলাম। তাঁর সামনে (রান্না করা) ছাগলের বাহু পেশ করা হল; এটা তাঁর কাছে পছন্দনীয় ছিল। তিনি সেখান থেকে এক টুকরা খেলেন এবং বললেন, আমি কিয়ামতের দিন সমগ্র মানবজাতির সরদার হবো। তোমরা কি জানো, আল্লাহ কীভাবে (কিয়ামতের দিন) একই সমতলে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষকে একত্রিত করবেন? যেন একজন দর্শক তাদের সবাইকে দেখতে পায় এবং একজন আহ্বানকারীর ডাক সবার কাছে পৌঁছোয়। সূর্য তাদের অতি নিকটে এসে যাবে। তখন কোনো কোনো মানুষ বলবে, তোমরা কি লক্ষ্য করো নি, তোমরা কী অবস্থায় আছো এবং কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছো? তোমরা কি এমন ব্যাক্তিকে খুঁজে বের করবে না, যিনি তোমাদের জন্য তোমাদের রবের দরবারে সুপারিশ করবেন? তখন কিছু লোক বলবে, তোমাদের আদি পিতা আদম আলাইহিস্ সালাম আছেন (চলো তাঁর কাছে যাই)। তখন সকলে তাঁর কাছে যাবে এবং বলবে, হে আদম (আলাইহিস সালাম)! আপনি সমস্ত মানব জাতির পিতা। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ আপনার মধ্যে ফুঁকেছেন। তিনি ফিরিশ্‌তাদেরকে (আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের) নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী সকলে আপনাকে সিজ্‌দাও করেছেন এবং তিনি আপনাকে জান্নাতে বসবাস করতে দিয়েছেন। আপনি কি আমাদের জন্য রবের কাছে সুপারিশ করবেন না? আপনি দেখেন না আমরা কী অবস্থায় আছি এবং কী কষ্টের সম্মুখীন হয়েছি? তখন তিনি বলবেন, আমার রব আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, এর আগে এমন রাগান্বিত হননি, আর পরেও এমন রাগান্বিত হবেন না। তিনি আমাকে বৃক্ষটি থেকে (ফল খেতে) নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু আমি তা খেয়েছিলাম। এখন আমি নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। তোমরা আমি ছাড়া অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা নূহের কাছে চলে যাও। তখন তারা নূহ আলাইহিস্ সালামের কাছে আসবে এবং বলবে, হে নূহ (আলাইহিস্ সালাম)! পৃথিবীবাসীর কাছে আপনি-ই প্রথম রাসূল আলাইহিস্ সালাম। আল্লাহ আপনার নাম রেখেছেন কৃতজ্ঞ বান্দা। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন আমরা কী ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছি? আপনি দেখছেন না আমরা কতইনা দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হয়েছি? আপনি কি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করবেন না? তখন তিনি বলবেন, আমার রব আজ এমন রাগান্বিত হয়ে আছেন, যা ইতিপূর্বে হন নাই এবং এমন রাগান্বিত পরেও হবেন না। এখন আমি নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। তোমরা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মুহাম্মদ)–এর কাছে চলে যাও। তখন তারা আমার কাছে আসবে আর আমি আরশের নিচে সিজ্‌দায় পড়ে যাবো। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আপনার মাথা তুলুন এবং #সুপারিশ করুন। আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে, আর আপনি যা চান আপনাকে তাই দেয়া হবে।
(আম্বিআ কিরাম সহীহ বুখারি/ ইফা ৩১০৪)
💚 হে আল্লাহ ! কাল কিয়ামতের কঠিন সময়ে আপনার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের শাফাআত প্রাপ্ত হওয়ার সেই কামীয়াবি হাছিল করার তৌফিক দান করুন। اَللهم لاَتَحْرِمْنِيْ شَفَاعَةَ نَبِيِّكَ আর কিয়ামত দিবসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের জন্য শাফা‘আত করবেন, আমাকে আপনি তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন, আমীন।

*সমাপ্ত*

Saturday, 30 March 2019

প্রিয়নবী (দ:) কি সত্যি নিরক্ষর ছিলেন?

মূল: যোসেফ এ, ইসলাম
অনুবাদ: এডমিন

(১) মহানবী (দ:) নিরক্ষর হওয়ার  (মানে পড়তে/লিখতে না জানার) বিষয়টি আল-ক্বুরআন নিশ্চিত করেছে কি?

উত্তর: না

(২) প্রিয়নবী (দ:) নিরক্ষর মর্মে ধারণাটির পক্ষে দলিলস্বরূপ আল-ক্বুরআন হতে ব্যবহৃত শব্দটি কী?

উত্তর: রাসূল (দ:)’এর প্রতি আরোপিত শব্দটি হচ্ছে ‘উম্মী’, যার দৃষ্টান্ত নিচে রয়েছে:

আল-ক্বুরআন ০৭:১৫৭ (আংশিক উদ্ধৃতি)



ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلأُمِّيَّ
 
অর্থ: যারা আনুগত্য করে রাসূল (দ:)’এর, যিনি ‘উম্মী নবী (দ:)’। [সরাসরি অনুবাদ]

(৩) أُمِّىٌّ - ‘উম্মী’ শব্দটির ক্লাসিকাল/ঐতিহ্যবাহী আরবী সংজ্ঞা কী?

উত্তর: ক্লাসিকাল আরবী ভাষায় ’উম্মী’ শব্দটি ‘অ-ইহুদী’ (Gentile) বা ’পয়গম্বর মূসা (আ:)’র (প্রাপ্ত) ঐশী বিধানের সাথে অপরিচিত কাউকে উদ্দেশ্য করে।’ এটা এমন কেউ নন যিনি অপরিহার্যত নিরক্ষর।

দলিলচিত্র-১


অনুবাদ: ‘উম্মী’ মানে সত্যিকারভাবে অ-ইহুদী। দ্বিতীয় অর্থে অবিশ্বাসী, যা আহলে কেতাব/ইহুদী-খৃষ্টানদের দ্বারা প্রয়োগকৃত। বিশেষ করে আরব বা আল-আম্বর অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট। ‘উম্মী-ইউনাল্ কিতা-বা’ (ক্বুরআন ২: ৭৮) অনুসারে অশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ (বা অবিশ্বাসী), যারা পয়গম্বর মূসা (আ:)’র প্রতি অবতীর্ণ ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে জানে না; প্রিয়নবী (দ:)’কে ‘উম্মী’ (মানে ইসরাঈলীদের থেকে আলাদা করতে অ-ইহুদী) বলা হয়েছে। [Lane. E.W, Edward Lanes Lexicon, Williams and Norgate 1863; Libraire du Liban Beirut-Lebanon 1968, Volume 1, Page 92]

পয়গম্বর মূসা (আ:)’র প্রাপ্ত ঐশী-বিধান সম্পর্কে না জানাটা কেবল সেসব লোকদের বেলাতেই প্রযোজ্য নয়, যারা ইসরাঈলী ঐতিহ্যের নন; বরং আল-ক্বুরআনে কিছু ইসরাঈল বংশীয় লোককেও ‘উম্মী’ বলা হয়েছে, যা তাদের নিজেদের ঐশী শাস্ত্রলিপি সম্পর্কে সামগ্রিক অজ্ঞতার ইঙ্গিত করে।

আল-ক্বুরআন ০২: ৭৮

وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لاَ يَعْلَمُونَ ٱلْكِتَابَ إِلاَّ أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَظُنُّونَ

অর্থ: এবং তাদের মধ্যে এমন কিছু উম্মী-ইউনা লোক আছে, যারা কিতাব সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না, কিন্তু মৌখিকভাবে পড়তে জানে মাত্র, কিংবা নিজেদের কিছু মনগড়া কথাবার্তা; আর তারা নিরেট কল্পনার মধ্যে রয়েছে। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

(৪) ‘Gentile' বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: উক্ত শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন। এটা 'Gentilis' শব্দ হতে এসেছে, যার মানে কোনো বিশেষ গোত্র বা গোষ্ঠীর সাথে জড়িত হওয়া। সুনির্দিষ্টভাবে এর অর্থ অ-ইহুদী গোত্র; আর এর দ্বারা অ-ইহুদীদের বোঝায়।

বর্তমানে উক্ত শব্দটির মৌলিক অর্থ একই আছে, যা এমন অ-ইহুদীদের উদ্দেশ্য করে যাঁরা তৌরীত পাঠ করেননি, কিংবা ইহুদী গোত্রভুক্ত নন।

(৫) ‘উম্মী’ শব্দটি দ্বারা যে ‘নিরক্ষর’ বোঝায় না, আমাদের কাছে  এ মর্মে  অন্যান্য কী কী ক্বুরআনী দলিল আছে?

উত্তর: কেউ যদি ‘উম্মী’ শব্দটির অর্থ ’নিরক্ষর’ (মানে পড়ালেখা জানেন না) বলে অনুবাদ করে, তাহলে নিচের ক্বুরআনের আয়াতটি নিরর্থক সাব্যস্ত হবে:

আল-ক্বুরআন ০৩: ২০

 فَإنْ حَآجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ للَّهِ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِ وَقُلْ لِّلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُواْ فَقَدِ ٱهْتَدَواْ وَّإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ ٱلْبَلَٰغُ وَٱللَّهُ بَصِيرٌ بِٱلْعِبَادِ

অর্থ: অতঃপর হে মাহবূব! যদি তারা (মক্কার কুফফার) আপনার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তবে বলে দিন, ‘আমি আপন চেহারা আল্লাহর সামনে অবনত করেছি এবং যারা আমার অনুসারী হয়েছে;’ আর কিতাবী সম্প্রদায় ও উম্মী-ইউনা লোকদের বলে দিন, ‘তোমরা কি গর্দান অবনত করেছো?’ সুতরাং তারা যদি গর্দান অবনত করে থাকে, তবেই তো সঠিক পথ পেয়ে গেছে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে (হে হাবীব) আপনার কর্তব্য তো এই নির্দেশ পৌঁছে দেয়া মাত্র। এবং আল্লাহ বান্দাদেরকে দেখছেন। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

ওপরে উক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা প্রিয়নবী (দ:)’কে আদেশ দিচ্ছেন পূর্ববর্তী কিতাবপ্রাপ্ত ইহুদী ও খৃষ্টানদের এবং ‘উম্মী’দের কাছে ঐশীবাণী ক্বুরআনের ঘোষণা জারি করতে। এখানে ‘উম্মী’ বলতে ‘নিরক্ষর’ অর্থ করলে আয়াতে করীমাটি নিরর্থক হয়ে যায়। কেননা এতে দৃশ্যমান হয় আল্লাহতা’লা প্রিয়নবী (দ:)’কে ঐশীবাণী সেসব লোকের মাঝে ঘোষণা করতে আদেশ করছেন যারা ইতিপূর্বে কেতাবপ্রাপ্ত ‘এবং যারা নিরক্ষর।’ এই অর্থে অনাবশ্যকভাবে তাদেরকে বাদ দেয়া হবে যারা লিখতে ও পড়তে পারেন অথচ যারা ঐশীবাণী প্রাপ্ত হননি। আরবীয়রা সামগ্রিকভাবে নিরক্ষর জাতি ছিলেন না। বরঞ্চ ক্বুরআনে প্রমাণিত হয় যে আরব জাতি বেশ ভালো লিখতে পড়তে জানতেন। যেমন আল-ক্বুরআন ৮০:১৫, যা ক্বুরআন মজীদ কাগজ-কলমে লেখার জন্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। [ بِأَيْدِي سَفَرَةٍ]

আল-ক্বুরআন ৬২: ০২

هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ

অর্থ: তিনি, যিনি উম্মী লোকদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেন যেনো তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে (ঐশী) কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান দান করেন আর নিশ্চয় নিশ্চয় তারা ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলো। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

কেউ আবারো ওপরের আয়াতটিতে উল্লেখিত ‘উম্মী’ শব্দটিকে নিরক্ষর বলে ধরে নিলে তা এই ভ্রান্ত ধারণার দিকে ইঙ্গিত করবে যে খোদাতা’লা লিখতে পড়তে জানেন না এমন লোকদের মাঝে রাসূল (দ:)’কে প্রেরণ করেছেন, যা স্পষ্টতঃ এ আয়াতটিকে নিরর্থক সাব্যস্ত করবে।

আল-ক্বুরআন ০৩: ৭৫

 وَمِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَٰبِ مَنْ إِن تَأْمَنْهُ بِقِنْطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَّنْ إِن تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لاَّ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلاَّ مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَآئِماً ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُواْ لَيْسَ عَلَيْنَا فِي ٱلأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ ٱلْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ 

অর্থ: এবং কিতাবীদের মধ্যে কিছু এমন লোক রয়েছে যে, যদি তুমি তার কাছে বিপুল সম্পদ আমানত রাখো, তবে সে তা তোমাকে ফিরিয়ে দেবে। আর তাদের মধ্যে কিছু এমন লোকও রয়েছে যে, যদি একটা স্বর্ণমুদ্রা তার কাছে আমানত রাখো, তবে সে তাও তোমাকে ফেরত দেবে না, কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি তার মাথার ওপর দণ্ডায়মান থাকো (মানে তার পেছনে লেগে থাকো)। এটা এ জন্যে যে, তারা বলে: ‘উম্মীয়্যিনা’ লোকদের মামলায় (তাদের প্রতি) আমাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।’ আর তারা (ওই সমস্ত কিতাবী) আল্লাহ সম্পর্কে জেনে বুঝে মিথ্যে বলে থাকে। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

ওপরের আয়াতটিতে আমরা লক্ষ্য করি যে, ঐশী কিতাবী কিছু লোক ধরে নিয়েছিলো যে কিতাবী নয় এমন মানুষ মানে অ-ইহুদীদের প্রতি তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। অতএব, এ আয়াতেও ‘উম্মী-ঈনা’ শব্দটির অর্থ নিরক্ষর নির্ধারণ করলে তা অর্থবোধক হবে না।

(৬) প্রিয়নবী (দ:) যে একজন ‘উম্মী’ তথা ইতিপূর্বে অবতীর্ণ কোনো ঐশীগ্রন্থের পাঠক নন এবং ইহুদী বংশােদ্ভূত-ও নন, ক্বুরআন মজীদ কি এমন দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন করে?

উত্তর: হ্যাঁ

আল-ক্বুরআন ৪২: ৫২

 وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ رُوحاً مِّنْ أَمْرِنَا مَا كُنتَ تَدْرِي مَا ٱلْكِتَابُ وَلاَ ٱلإِيمَانُ وَلَـٰكِن جَعَلْنَاهُ نُوراً نَّهْدِي بِهِ مَن نَّشَآءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِيۤ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

অর্থ: এবং এভাবে আমি আপনার প্রতি ওহী/ঐশীবাণী (অবতীর্ণ) করেছি, এক প্রাণ-সঞ্চারক বস্তু আপন নির্দেশে; এর পূর্বে আপনি কিতাব জানতেন না, না শরীয়তের বিধানাবলীর বিস্তারিত বিবরণ। হ্যাঁ, আমি সেটাকে (হেদায়াতের) আলো করেছি, যা দ্বারা আমি পথ দেখাই আপন বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করি। এবং নিশ্চয় নিশ্চয় আপনি সোজা পথ বাতলে দেন। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

مَا كُنتَ تَدْرِي- মা’ কুনতা
مَا ٱلْكِتَابُ - মা’ল-কিতা’বু
وَلاَ ٱلإِيمَانُ - লা’ ঈমা’নু
[যোসেফ ইসলাম কর্তৃক পেশকৃত উদাহরণ]

আল-ক্বুরআন ২৯: ৪৮

 وَمَا كُنتَ تَتْلُواْ مِن قَبْلِهِ مِن كِتَابٍ وَلاَ تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ إِذاً لاَّرْتَابَ ٱلْمُبْطِلُونَ

অর্থ: এবং এর আগে আপনি কোনো কিতাব/ঐশীগ্রন্থ পাঠ করতেন না এবং আপনি না আপন ডান হাতে কিছু লিখতেন। যদি এমন হতো তাহলে বাতিল সম্প্রদায় অবশ্য সন্দেহ করতো। [নূরুল এরফান]

বিশেষ জ্ঞাতব্য:

এখানে ‘(আপনি) আপন ডান হাতে কিছু লিখতেন না’ বাক্যটি আল-ক্বুরআনকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়নি। এটা স্পষ্টতঃ ইতিপূর্বেকার আসমানী কিতাব বা শাস্ত্রলিপির প্রতি উদ্দেশ্যকৃত, যা প্রসঙ্গের আলোকে বেরিয়ে এসেছে। এই আয়াতটি পাঠকদেরকে জানায় যে মহানবী (দ:) পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর না ছিলেন পাঠক, না লেখক, আর তাই তাঁর কাছে না ছিলো ওগুলোর (কোনো) জ্ঞান; এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তিনি কোত্থেকে তাঁর (এতদসংক্রান্ত) জ্ঞান লাভ করেছিলেন? আর এটা (জনমনে ঠাঁয় পাওয়া বিশ্বাসের বিপরীতে) এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আস্থাশীলতা দেয় যে প্রিয়নবী (দ:) পড়া ও লিখা দুটোই জানতেন।

রাসূলুল্লাহ (দ:) যদি পড়তে বা লিখতে না-ই জানতেন, তাহলে ‘পূর্ববর্তী কিতাবগুলো’ তিনি পড়েননি বা লিখেননি মর্মে  বক্তব্য দ্বারা কেন মানুষকে জানানো হয়েছে? উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বলে ’ক’ নির্দিষ্টভাবে ‘খ’ বইটি পড়েননি, তাহলে এতে প্রতীয়মান হবে যে ‘ক’ প্রকৃতপক্ষেই পড়ার সক্ষমতা বা সামর্থ্য রাখেন। উদাহরণটিতে ব্যতিক্রম শুধু এই যে, ‘খ’ বইটি ‘ক’ পাঠ করেননি।

রাসূল (দ:) যে নবী হবেন এমন কোনো প্রত্যাশাও তাঁর ছিলো না

আল-ক্বুরআন ২৮: ৮৬

وَمَا كُنتَ تَرْجُوۤ أَن يُلْقَىٰ إِلَيْكَ ٱلْكِتَابُ إِلاَّ رَحْمَةً مِّن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُونَنَّ ظَهيراً لِّلْكَافِرِينَ

অর্থ: এবং আপনি আশা করতেন না যে কিতাব আপনার প্রতি প্রেরণ করা হবে। হ্যাঁ, আপনার রব্ব অনুগ্রহ করেছেন; সুতরাং কখনো কাফেরদের সহায়তা করবেন না। [নূরুল এরফান]

(৭) প্রিয়নবী (দ:) যে নিরক্ষর ছিলেন না, এ বিষয়টিকে সমর্থন দানকারী অন্য কোনো দলিল আছে কি?

উত্তর: হ্যাঁ

প্রামাণ্য দলিল-১: (মক্কার) কুফফার/অবিশ্বাসীরা প্রিয়নবী (দ:)’র প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করেছিলো যে তিনি নিজ মোবারক হাতে কিতাবুল্লাহ লিখেছিলেন।

আল-ক্বুরআন ২৫: ০৫

 وَقَالُوۤاْ أَسَاطِيرُ ٱلأَوَّلِينَ ٱكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلَىٰ عَلَيْهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً

অর্থ: এবং (কুফফার) বল্লো, ‘পূর্ববর্তীদের কিচ্ছা-কাহিনি তিনি লিখে নিয়েছেন; অতঃপর সেগুলো তাঁর কাছে সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করা হয়।’ [নূরুল এরফান]

এই আয়াতটি অনুবাদ করার ক্ষেত্রে তাফসীরকারক উলামাবৃন্দ কিছুটা বেগ পেয়ে থাকেন, কেননা এটা ইঙ্গিত করে যে মহানবী (দ:) লিখতে পারতেন। এই আয়াতটি তাঁরই বিরুদ্ধে কুফফারদের উত্থাপিত আরো বড় অভিযোগের অংশবিশেষ (যা ব্যক্ত করে যে তিনি কিচ্ছা লিখেছিলেন)। এমতাবস্থায় অনেক ভিন্ন ভিন্ন (দৃষ্টিভঙ্গির) অনুবাদ পেশ করা হয়েছে। সমস্যাটির গোড়া এই বাস্তবতা যে, একদিকে কিছু আহাদীসে বিবৃত হয়েছে প্রিয়নবী (দ:) নিরক্ষর ছিলেন, আরেক দিকে এই আয়াতে করীমায় ব্যবহৃত আরবী ইঙ্গিত করছে যে (বৃহত্তর অভিযোগের অংশ হিসেবে) তিনি কার্যতঃ লিখতে পারতেন।

আরবীতে ٱكْتَتَبَ ‘একতাতাবা’ শব্দটির মূল كتب কাফ-তা-বা

كتب মানে তিনি লিখেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন, নিয়োগ করেছেন, স্থির করেছেন, লিখতে হুকুম দিয়েছেন, বিচার-বিবেচনা করেছেন, বিধান জারি করেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, একত্র করেছেন, সংগ্রহ করেছেন, যুক্ত করেছেন; এমন একটি বস্তু যার ওপর কেউ লিখেন বা লিপিবদ্ধ করেন, কিংবা নথিভুক্ত করেন।

আরবী كتب - ক্রিয়াপদ 

আরবী ٱكْتَتَبَ হচ্ছে كتب -এর কর্তাবাচ্য অতীতকাল ক্রিয়া। অতএব, এই ক্রিয়ার দ্বারা বোঝা যায় প্রিয়নবী (দ:) হয় ক্বুরআন লিপিবদ্ধ করিয়েছেন, না হয় নিজে লিখেছেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: ইতিহাস প্রথমটি সমর্থন করে। তাঁর কয়েকজন কাতেব তথা ওহী লেখক ছিলেন। তিনি নিজে তা লেখার পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই।]

প্রামাণ্য দলিল-২

আমরা সূরাহ ৯৬:০১ পাঠ করলে বিবেচনা করার মতো কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় তাতে পাওয়া যাবে:

আল-ক্বুরআন ৯৬:০১-৫

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ، خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ، اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ، الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ، عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

অর্থ: পড়ুন! আপনার রব্বের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন- মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ূন! এবং আপনার রব্ব-ই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা, যিনি কলম দ্বারা লিখন শিক্ষা দিয়েছেন - মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না। [নূরুল এরফান]

‘ইক্বরা’ (পড়ুন) শব্দটি ও কলম দ্বারা শিক্ষাদানের মধ্যে সংযোজক অব্যয় পদের প্রতি লক্ষ্য করুন।

(৮) তাহলে কোন্ সূত্র আমাদের জানাচ্ছে প্রিয়নবী (দ:) লিখতে পড়তে জানতেন না?

উত্তর: ইসলামী অমুখ্য উৎসগুলো। যেমন এলম-এ-রেজাল তথা ইসলামী আলেম-উলামার গবেষণাকীর্তি ও ফতোয়া যা মুখ্য ঐশী শাস্ত্রলিপি তথা ক্বুরআন মজীদ নয়।

এই ব্যাখ্যাটি ওই উৎস থেকেই ইসলামী ইতিহাসবিদ ও গবেষকমণ্ডলী বের করেছেন। তবে এসব উৎসের মধ্যেই এ ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। কিছু উৎস বিবৃত করে যে রাসূলুল্লাহ (দ:) পড়তে জানতেন; আবার কিছু উৎস আমাদের জানায় তিনি তা জানতেন না।

ইসলামী অমুখ্য উৎসগুলোর মধ্যকার অসঙ্গতি: (মহানবী সাক্ষর হওয়ার পক্ষে যেসব উৎস)

কেউ যদি আহাদীসকে নিজ যুক্তির পক্ষে ব্যবহার করেন (যেহেতু একমাত্র আমদের ধর্মের আহাদীসেই প্রিয়নবী (দ:)’র নিরক্ষরতার পক্ষে দাবি পাওয়া যায়), তাহলে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদমণ্ডলী (যথা - আল্ বাকাঈ ইবনে হিশাম; সালাম আল-ফযল তাবারী প্রমুখ) যাঁদের থেকে বিদ্যমান মৌলিক জীবনী নেয়া হয়েছে, তাঁরা লিপিবদ্ধ করেন যে ভণ্ড নবী মুসাইলামা কাযযাবের পত্রের জবাব প্রিয়নবী (দ:) স্বয়ং লিখেছিলেন। ওই হাদীস রেকর্ড করে যে তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। ইমাম বুখারী (রহ:)’র দ্বারা হাদীস সংকলনেরও এক শতাব্দী আগে এই ইতিহাসবিদবৃন্দ আহাদীস থেকে সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন।

(ক) প্রিয়নবী (দ:)’র কাছে পড়ার জন্যে জিবরীল (আ:) বুটিদার রেশমি বস্ত্র/চাদর এনেছিলেন 

রমযান মাসে যা’তে আল্লাহতা’লা তাঁর হাবীবের (দ:) বিষয়ে নিজ করুণাস্বরূপ যা যা এরাদা/ইচ্ছা করেছিলেন, তাতে মহানবী (দ:) নিজ স্বভাব অনুসারে সপরিবার হেরা অভিমুখে রওয়ানা হন। রাতে যখন আল্লাহতা’লা তাঁকে তাঁর ঐশী মিশনের দ্বারা সম্মানিত করেন এবং তা দ্বারা আপন সেবকমণ্ডলীর প্রতি করুণা বর্ষণ করেন, তখন জিবরীল আমীন (আ:) তাঁর কাছে খোদার বিধান নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন, “আমি নিদ্রাগত থাকাকালে জিবরীল (আ:) আমার কাছে আসেন একটি বুটিদার রেশমি বস্ত্র/চাদরসহ, যার ওপর কিছু লেখা ছিলো; আর তিনি বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি বলি, আমি কী পড়বো? তিনি তা দ্বারা আমাকে এমন শক্তভাবে চেপে ধরেন যে আমি মনে করেছিলাম আমার বুঝি ইন্তেক্বাল হবে; অতঃপর তিনি আমায় ছেড়ে দেন এবং বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি (আবার) বলি, আমি কী পড়বো? (এমতাবস্থায়) তিনি আবারো তা দ্বারা আমাকে চেপে ধরেন এমনভাবে যেনো আমার ইন্তেক্বাল হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছিলো। তিনি এরপর আমায় ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি (আবার) বলি, আমি কী পড়বো? তিনি তৃতীয়বার তা দ্বারা আমায় চেপে ধরেন, যার দরুন মনে হলো আমার ইন্তেক্বাল হবে; এরপর তিনি আমায় ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি (এমতাবস্থায়) বলি, তাহলে আমি কী পড়বো? আর এ কথা আমি বলেছিলাম তাঁর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে, পাছে তিনি আবার একই রকম করেন। এবার তিনি বলেন:

পড়ুন! আপনার রব্বের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন- মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ূন! এবং আপনার রব্ব-ই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা, যিনি কলম দ্বারা লিখন শিক্ষা দিয়েছেন - মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না।

অতঃপর আমি তা-ই পাঠ করি, আর জিবরীল (আ:) আমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। [Guillaume. A, The Life of Muhammad: A Translation of Ishaq's Sirat Rasul Allah, Oxford University Press, Page 106]

(খ) মুসায়লামা’র পত্র ও মহানবী (দ:)’র উত্তর   

আশজা’র জনৈক শায়খ আমার কাছে বর্ণনা করেন সালামা বিনতে নুয়াইম বিন মাসউদ আল-আশজাঈ হতে, তিনি তাঁর পিতা নুয়াইম হতে; যিনি বলেন: আমি হুজূর পাক (দ:)’কে মুসায়লামা কাযযাবের চিঠি পড়া হলে তাদের (বার্তাবাহকদের) প্রতি জিজ্ঞেস করতে শুনি, “তোমরা এ সম্পর্কে কী বলো?” তারা উত্তর দেয় যে তারা মুসায়লামার মতামত-ই ব্যক্ত করে। এমতাবস্থায় তিনি (দ:) প্রত্যুত্তর দেন, “আল্লাহর শপথ! বার্তাবাহকদের হত্যা না করার ব্যাপারটি যদি না থাকতো, তাহলে আমি তোমাদের দু জনের শিরোচ্ছেদ করতাম।” অতঃপর তিনি মুসায়লামার প্রতি লেখেন: “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে মিথ্যুক মুসায়লামা’র প্রতি লিখিত। হেদায়াত যে ব্যক্তি অনুসরণ করে তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এই জগৎ আল্লাহতা’লার মালিকানাধীন। তিনি যে সব বান্দার প্রতি ইচ্ছা করেন, তাদেরকে এর উত্তরাধিকার দান করেন; আর উত্তম ফলাফল হচ্ছে পুণ্যাত্মাদের জন্যে (বরাদ্দ)।” এই ঘটনা দশম হিজরী সালের। [প্রাগুক্ত Guillaume. A, The Life of Muhammad: A Translation of Ishaq's Sirat Rasul Allah, Oxford University Press, Page 649]

ওপরের বর্ণনাটি, যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে প্রিয়নবী (দ:) বাস্তবিকই লিখতে সক্ষম ছিলেন, তার পরিষ্কার সাংঘর্ষিক বক্তব্যের প্রতি পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদবৃন্দ যে ব্যাখ্যা দেন তা হলো, এটা প্রিয়নবী (দ:) কাউকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা এই লিপি ইঙ্গিত করে না, যেটা ব্যক্ত করে প্রিয়নবী (দ:) লেখা ও পাঠ দুটোই করতে সক্ষম ছিলেন।

(গ) সুনানে আবী দাউদ: বই-১৯, হাদীস নং-২৯৯৩

حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا قُرَّةُ، قَالَ سَمِعْتُ يَزِيدَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ كُنَّا بِالْمِرْبَدِ فَجَاءَ رَجُلٌ أَشْعَثُ الرَّأْسِ بِيَدِهِ قِطْعَةُ أَدِيمٍ أَحْمَرَ فَقُلْنَا كَأَنَّكَ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ ‏.‏ فَقَالَ أَجَلْ ‏.‏ قُلْنَا نَاوِلْنَا هَذِهِ الْقِطْعَةَ الأَدِيمَ الَّتِي فِي يَدِكَ فَنَاوَلَنَاهَا فَقَرَأْنَاهَا فَإِذَا فِيهَا ‏

"‏ مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللَّهِ إِلَى بَنِي زُهَيْرِ بْنِ أُقَيْشٍ إِنَّكُمْ إِنْ شَهِدْتُمْ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَأَقَمْتُمُ الصَّلاَةَ وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَأَدَّيْتُمُ الْخُمُسَ مِنَ الْمَغْنَمِ وَسَهْمَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَسَهْمَ الصَّفِيِّ أَنْتُمْ آمِنُونَ بِأَمَانِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ‏"

‏ ‏.‏ فَقُلْنَا مَنْ كَتَبَ لَكَ هَذَا الْكِتَابَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم 

অর্থ: হযরত এয়াযীদ ইবনে আবদিল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: আমরা মিরবাদে ছিলাম। এমন সময় এলোমেলো চুলবিশিষ্ট এক ব্যক্তি তাঁর হাতে (পশুর) একটি লাল চামড়া নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। আমরা বলি: আপনি দেখতে তো বেদুঈন। তিনি উত্তর দেন: জি হ্যাঁ। আমরা বলি: আপনার হাতে অবস্থিত চামড়ার টুকরোখানি আমাদের দিন। তিনি তা হস্তান্তর করলে আমরা তাতে পাঠ করি নিম্নের লিপি: “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে বনূ যুহায়র ইবনে উক্বাইশের প্রতি (লিখিত)। তোমরা যদি সাক্ষ্য দাও এই মর্মে  যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ/উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, আর যদি নামায আদায় করো, যাকাত দাও, গনীমতের এক-পঞ্চামাংশ ও মহানবী (দ:)’র অংশ (সোয়াফী) পরিশোধ করো, তাহলে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)’এর আমান তথা জিম্মাদারীতে বা সুরক্ষায় থাকবে।” এমতাবস্থায় আমরা তাঁকে (বেদুঈনকে) জিজ্ঞেস করি: এই দলিলটি আপনার জন্যে কে লিখেছিলেন? তিনি উত্তর দেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)।

(ঘ) সহীহ মুসলিম: বই-১৩, কিতাবুল ওয়াসীয়্যা, হাদীস নং-৪০১৬

وَحَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ رَافِعٍ، وَعَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ، ء قَالَ عَبْدٌ أَخْبَرَنَا وَقَالَ ابْنُ رَافِعٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، ء أَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُتْبَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ لَمَّا حُضِرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَفِي الْبَيْتِ رِجَالٌ فِيهِمْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ هَلُمَّ أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لاَ تَضِلُّونَ بَعْدَهُ ‏"‏ ‏.‏ فَقَالَ عُمَرُ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ غَلَبَ عَلَيْهِ الْوَجَعُ وَعِنْدَكُمُ الْقُرْآنُ حَسْبُنَا كِتَابُ اللَّهِ ‏.‏ فَاخْتَلَفَ أَهْلُ الْبَيْتِ فَاخْتَصَمُوا فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ قَرِّبُوا يَكْتُبْ لَكُمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كِتَابًا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ ‏.‏ وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ مَا قَالَ عُمَرُ ‏.‏ فَلَمَّا أَكْثَرُوا اللَّغْوَ وَالاِخْتِلاَفَ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ قُومُوا ‏"‏ ‏.‏ قَالَ عُبَيْدُ اللَّهِ فَكَانَ ابْنُ عَبَّاسٍ يَقُولُ إِنَّ الرَّزِيَّةَ كُلَّ الرَّزِيَّةِ مَا حَالَ بَيْنَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَبَيْنَ أَنْ يَكْتُبَ لَهُمْ ذَلِكَ الْكِتَابَ مِنِ اخْتِلاَفِهِمْ وَلَغَطِهِمْ ‏.

হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র প্রকাশ্য জিন্দেগীর সায়াহ্নে তাঁর ঘরে মানুষজন উপস্থিত ছিলেন, যাঁদের মধ্যে হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও ছিলেন। হুযূর পাক (দ:) এরশাদ ফরমান: “(কাগজ-কলম নিয়ে) এসো, আমি যাতে একটি দলিল লিখতে পারি; ওর পরে তোমরা আর পথভ্রষ্ট হবে না।” অতঃপর হযরত উমর (রা:) বলেন: নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) গভীর বেদনা-ক্লেশ অনুভব করছেন। তোমাদের কাছে রয়েছে ক্বুরআন মজীদ। কিতাবুল্লাহ-ই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। তখন ঘরে উপস্থিতদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। তাঁদের কেউ কেউ বলেন: (কাগজ-কলম) এনে দাও যাতে প্রিয়নবী (দ:) তোমাদের জন্যে একটি দলিল লিখতে পারেন, যার দরুন তোমরা আর কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। অন্যান্যরা অপর দিকে হযরত উমর (রা:) যা বলেছিলেন, তারই পুনরাবৃত্তি করেন। এতে মহানবী (দ:)’র উপস্থিতিতে তর্ক-বিতর্ক ও উচ্চস্বরে আওয়াজ হলে তিনি (সবাইকে) বলেন: উঠে দাঁড়াও (এবং চলে যাও)! হযরত উবায়দুল্লাহ (রা:) বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন: এটা ছিলো বড় একটি ক্ষতি, নিশ্চয় বড় ক্ষতি, তাঁদেরই মতবিরোধ ও আওয়াজের কারণে। রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁদের কারণে দলিলটি লিখতে (বা লেখাতে) পারেননি।

দলিলচিত্র-২




ওপরের দলিলচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো হলুদ ও ছাই বর্ণে চিত্রিত করা হয়েছে।

(৯) এ রকম পরস্পরবিরোধী উৎসের ক্ষেত্রে কোনটি তাহলে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য?

উত্তর: নিঃসন্দেহে মুখ্য উৎস - ক্বুরআন মজীদ; যদি এটাকে প্রাথমিক ঐতিহাসিক উৎস হিসেবে ব্যবহার করাও হয়।

(১০) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে নিরক্ষর হিসেবে প্রতীয়মান করার জন্যে অমুখ্য উৎসগুলো আল-ক্বুরআনের তাফসীর/ব্যাখ্যাকে প্রভাবিত করছে কি?

উত্তর: হ্যাঁ।

শেষ কথা

অতএব, সারসংক্ষেপ হিসেবে আমরা যা দেখতে পাই:

১/- ক্লাসিকাল আরববৃন্দ ‘উম্মী’ বলতে অ-ইহুদী অথবা পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)’র প্রাপ্ত ঐশী বিধান সম্পকে অপরিচিত কাউকে জানতেন/বুঝতেন। [অর্থাৎ, ওই বিধান স্রেফ ইহুদীদের ছিলো ২:৭৮]

২/- ‘উম্মী’ শব্দটিকে ‘নিরক্ষর’ হিসেবে অনুবাদ করলে ক্বুরআনী আয়াতসমূহ নিরর্থক প্রতিপন্ন হয়; কেননা এতে গোটা আরবজাতি বা ক্বুরআন যাঁদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে (অনারবও অন্তর্ভুক্ত), তাঁদের সবাইকে নিরক্ষর বলা হয়। [আল-ক্বুরআন ৩:২০; ৬২:০২]

৩/- মহানবী (দ:)’র সময়কার (মক্কার) কুফফার তাঁর প্রতি নিজ হাতে ক্বুরআন লেখার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলো।তিনি নিরক্ষর হলে এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হতো এবং তা প্রথমাবস্থায় উত্থাপনও করা হতো না।

৪/ - হতে পারে প্রিয়নবী (দ:) লিখতে বা পড়তে জানতেন না। তবে আল-ক্বুরআন তাঁর ‘উম্মী’ হওয়ার প্রসঙ্গ আলোচনাকালে তা নিশ্চিত করে না। বরং সামগ্রিক দলিলাদির আলোকে তাঁর লিখতে ও পড়তে জানার সম্ভাবনা-ই এক্ষেত্রে প্রবলতম।

                                                            *সমাপ্ত*   
   

Tuesday, 19 March 2019

আক্বীদা-বিশ্বাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

- এডমিন

সম্প্রতি আমি সপরিবার রংপুর ও গাইবান্ধা সফরে গিয়েছিলাম। উপলক্ষ মামাতো শ্যালক Asfat Rahman Fuad‘এর বিয়ে। তবে রংপুরে সুন্নী সংগঠক Ridwan Ashrafi ভাইসহ অন্যান্য সুন্নী ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এ্যাডভোকেট রিদওয়ানভাই আমাকে আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:)’র রচিত ‘আশীর্বাদময় সাহাবায়ে কেরাম (রা:)’ বইটি উপহারস্বরূপ দেন। সাড়ে পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই বইটি অনুবাদ করা সম্ভব হলে সুন্নী মুসলিম সমাজ উপকৃত হবেন।

গাইবান্ধায় এসকেএস-ইন ভ্রমণের সময় বগুড়ার Mohammad Shamim ভাই আমাকে তাঁর এলাকা ঘুরে যাবার অনুরোধ জানান। কিন্তু সময়ের সংক্ষিপ্ততার দরুন তা হয়ে ওঠেনি। নিউজিল্যান্ড মসজিদে হামলার ঘটনা তখন সবেমাত্র ঘটেছে। তিনি বল্লেন, শত্রুরা মুসলমান হত্যা করছে; এমতাবস্থায় আক্বীদা’র প্রশ্ন, সুন্নী-ওহাবী-মওদূদী ইত্যাদি বিষয়গুলো উত্থাপন করা কতোখানি সমীচীন। শত্রুরা তো সবাইকেই নিধন করছে। প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক হওয়ায় সংক্ষেপে কিছু কথা বলতে চাই আমি। উলামাবৃন্দ এর ব্যাপক ব্যাখ্যা দেবেন আশা করি।

দেখুন, আক্বীদা-বিশ্বাস হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মূলভিত্তি। এটা সাগরবক্ষে কোনো তরীর হালের মতোই। হাল ছাড়া উত্তাল সাগরে তরী দিশেহারা। মুসলমান সমাজও সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাস জানা ছাড়া গরু/গাধার পালের মতো দিগভ্রান্ত। ফলে মঞ্জিলে মক্বসূদ সুদূর পরাহত। আমার কথায় কেউ আবার রেগে যাবেন না কিন্তু! গরু/গাধার পাল বলাটা মোটেও অত্যুক্তি নয়। আমরা যদি সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করতে না পারি, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কাছে আমাদের মূল্য গরু/গাধার চেয়ে বেশি হবে না; বরঞ্চ নিকৃষ্টতরই হবে। আফসোস এই যে, আমি কোনো ওহাবী/মওদূদী/সালাফী/তাবলীগী/শিয়া/কাদিয়ানীকেই সত্যপন্থী সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাসের প্রতি নিষ্ঠাবান হতে দেখিনি। সদাসর্বদা কূটকৌশল প্রয়োগ করে নিজেদের মনগড়া মতবাদেরই সাফাই গাইতে দেখেছি তাদের। তওবা করে সুন্নী মতাদর্শ তারা গ্রহণ করেনি। এটা তাদের মনের বক্রতা-ই প্রতিফলন করে।

শেষ কথা হলো, একমাত্র সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাস ধারণ করেই বর্তমান যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন মুসলমান সমাজ। ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যাকারীদের মনগড়া মতবাদ বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে না, বরং ম্লান করবে।

Friday, 25 January 2019

‘মাওলানা’ শব্দের ব্যবহার শিরক নয়


 - ড: এ. এস. এম. ইউসূফ জিলানী

কিছু কিছু লা-মাযহাবী ভাই ‘মাওলানা’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে সমাজে নতুন করে ফেতনার জাল সৃষ্টি করে চলছে। তারা বলে, আলেমদের নামের পূর্বে ‘মাওলানা’ শব্দ ব্যবহার করা শিরক!! অথচ যুগ যুগ ধরে উলামায়ে কেরাম নামের পূর্বে ‘মাওলানা’ শব্দ ব্যবহার করে আসছেন। কেউ কোনদিন আপত্তি করেন নি। অনেক সময় সাধারণ মুসলমানও তাদের বিভ্রান্তির শিকার হয়। নিচে লা-মাযহাবী ভাইদের ভ্রান্তির কিছু দলিল পেশ করা হলো:
‘মাওলানা’ শব্দটি আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত। তাই নিম্নে আসমাউল হুসনা সম্পর্কে শরীয়তের হুকুম উল্লেখ করা হলো:
আল্লাহ শব্দের গুণবাচক নাম দুই ধরনের:
প্রথমতঃ
যে সকল নাম শুধু আল্লাহ তায়ালার সাথে নির্দিষ্ট। যেমন, القيوم,البارى,الخالق,الرحمان,الله ইত্যাদি শব্দে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম রাখা জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা المسمى(মুসাম্মা) তার জন্যই নির্দিষ্ট; যা অংশীদারিত্বকে গ্রহণ করেনা।
দ্বিতীয়তঃ
আল্লাহ পাকের নাম সমূহের মধ্যে যে সকল নামের ব্যাপক অর্থ রয়েছে; অবস্থাভেদে যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। যেমন- মালিক, আযীয, জাব্বার, মুতাকাব্বির ইত্যাদি শব্দ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার জায়েয আছে। এ সকল শব্দ আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে কোথাও নিজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, আবার কোথাও বা বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণগুলোর প্রতি লক্ষ করুন:
১. বান্দার ক্ষেত্রে الْعَلِيمُ শব্দের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ অর্থাৎ, ‘নিশ্চয়ই তিনি সকল কথা শোনেন, সকল কিছু জানেন।’(সূরা-আনফাল-৬১)
উক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে الْعَلِيمُ (তথা সর্বজ্ঞ) ব্যবহার করেছেন, আবার নিম্নোক্ত আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রেও الْعَلِيمُ শব্দ ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন: وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ অর্থাৎ ‘অতঃপর তারা তাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিল, যে বড় জ্ঞানী হবে।’ (সূরা- যারিআত -২৮)
এখানে বড় জ্ঞানী বলতে হযরত ইসহাক (আ:)’কে বুঝানো হয়েছে। তবে আল্লাহ তাআলার ইলম আর বান্দার ইলমের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আল্লাহ তাআলার ইলম হচ্ছে পরিপূর্ণ ও অসীম। আদিতেই তার ইলম ছিল, কখনো অজ্ঞতা ছিল না। আর তিনি কখনো বিস্মৃত হন না এবং তার ইলমে কখনো কমতি ও ত্রুটি দেখা দেয় না। এর বিপরীত হলো মানুষের জ্ঞান, কেননা তা ত্রুটিপূর্ণ। মানুষের ইলমের আগের অবস্থা হলো মূর্খতা ও অজ্ঞতা। আর মানুষদেরকে যে জ্ঞান দান করা হয়েছে তা স্বল্পই।
২. বান্দার ক্ষেত্রে الْعَزِيزُ, الْجَبَّارُ, الْمُتَكَبِّرُ শব্দের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাআলা ক্ষমতাবান, সকল দোষ-ত্রুটি হতে সংশোধনকারী, গৌরবান্বিত।’ (সূরা-হাশর-২৩)
উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে ‘আযীয’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার সূরা ইউসূফে বান্দার ক্ষেত্রেও ‘আযীয’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে- قَالَتِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ অর্থাৎ, ‘আযীযের স্ত্রী বলল, এবার সত্য কথা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ (সূরা ইউসুফ-৫১)
অন্য আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রেও الْجَبَّارُ ও الْمُتَكَبِّرُ শব্দ দু’টি ব্যবহার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- كَذَلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَى كُلِّ قَلْبِ مُتَكَبِّرٍ جَبَّارٍ অর্থাৎ, ‘এভাবেই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তির অন্তরে মোহর করে দেন।’ (সূরা মুমিন-৩৫)
৩. বান্দার ক্ষেত্রে حَلِيمًا শব্দের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا অর্থাৎ ‘তিনি সহনশীল, ক্ষমাশীল।’ (সূরা ফাতির-৪১)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে حَلِيمًا শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার তিনি অন্যত্র বান্দার ক্ষেত্রেও حَلِيمًا শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন, ইরশাদ হয়েছে- فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ অর্থাৎ, ‘সুতরাং আমি তাকে (ইব্রাহীম আ:’কে) এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’
(সূরা আস-সফফাত-১০১)
৪. বান্দার ক্ষেত্রে سَمِيعًا ও بَصِيرًا শব্দের ব্যবহার:
মহান আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا অর্থাৎ, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সব কিছু শোনেন, সব কিছু দেখেন।’ (সূরা নিসা-৫৮)
উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে سَمِيعًا ওبَصِيرًا শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার সূরা দাহরে আল্লাহ তাআলা বান্দার ক্ষেত্রেও উক্ত শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন।
মাওলানা’ উপাধি মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘মাদরাসা স্নাতকোত্তর পাস করা ব্যক্তিকে ‘মাওলানা’ বলা হয়ে থাকে।
প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। ‘মাওলানা’ শব্দটি আরবি, তবে আরব থেকে ইরান, তুর্কি, আফ্রিকা ও ভারত উপমহাদেশ ঘুরে নানা অর্থ পরিগ্রহ করেছে। যেমন—ইরানের প্রখ্যাত কবি রুমির নামের আগে ‘মওলানা’ ব্যবহৃত হয়। ‘মাওলানা’ শব্দটির তুর্কি উচ্চারণ হলো ‘মেভলানা’।
‘মাওলানা’ শব্দটি মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাপূর্ণ অর্থ বহন করে। অন্যদিকে সাধারণ ধর্মীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে উপাধি হিসেবে ‘মৌলভি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
‘মাওলানা’ বা ‘মওলানা’ শব্দটি আরবি। এটি ‘মাওলা’ ও ‘না’ দুটি শব্দে গঠিত। ‘না’ একটি সর্বনাম। এর অর্থ আমরা বা আমাদের। আর ‘মাওলা’ শব্দের প্রায় ৩০টি অর্থ আছে। যেমন—প্রভু, বন্ধু, সাহায্যকারী, মনিব, দাস, চাচাতো ভাই, প্রতিনিধি, অভিভাবক, নিকটবর্তী, আত্মীয়, নেতা, গুরু, প্রতিপালক, সর্দার, প্রেমিক, প্রতিবেশী, আনুগত্য, প্রার্থনা, নীরবতা, ইবাদত, দণ্ডায়মান ইত্যাদি। (লিছানুল আরব : ৮/৪৫২, আল-মিসবাহুল মুনির, পৃষ্ঠা ৫৯১)
পবিত্র কুরআন শরিফে প্রায় ৪টি অর্থে মাওলা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:
১.সূরা বাকারার ২৮৫ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: ﺍﻧﺖ ﻣﻮﻻﻧﺎ ﻓﺎﻧﺼﺮﻧﺎ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻘﻮﻡ ﺍﻟﻜﺎﻓﺮﻳﻦ’ এখানে শব্দটি অভিভাবক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
২.সূরা হাদীদের ১৫ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: ﻓَﺎﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻟَﺎ ﻳُﺆْﺧَﺬُ ﻣِﻨﻜُﻢْ ﻓِﺪْﻳَﺔٌ ﻭَﻟَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭﺍ ﻣَﺄْﻭَﺍﻛُﻢُ ﺍﻟﻨَّﺎﺭُ ﻫِﻲَ ﻣَﻮْﻟَﺎﻛُﻢْ ﻭَﺑِﺌْﺲَ ﺍﻟْﻤَﺼِﻴﺮُ এখানে শব্দটি আবাসস্থল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৩.সূরা মুহাম্মাদের ১১ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: ذلك بأن الله مولى الذين ..آمنوا. এখানে শব্দটি বন্ধু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪.সূরা তাহরীমের ৪ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: والله مولاكم... এখানে সহযোগী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অনেকে না জেনে বলে ফেলেন যে ‘মাওলানা’ শব্দটি আল্লাহর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট। তাই মানুষের জন্য এ শব্দ ব্যবহার করা ‘শিরক’! প্রমাণ হিসেবে তারা বলেন, পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আনতা মাওলানা ফানছুরনা—অর্থাৎ আপনিই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আপনি আমাদের সাহায্য করুন। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
এ আয়াতে ‘মাওলানা’ বলে আল্লাহকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই কোনো মানুষকে ‘মাওলানা’ বলে সম্বোধন বা বিশেষিত করা জায়েজ নয়, বরং শিরক!
আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘মাওলানা’ শব্দকে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, আলেমদের ক্ষেত্রে সে অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘মাওলানা’ অর্থ হলো আমাদের প্রভু বা প্রকৃত অভিভাবক; আর আলেমদের ক্ষেত্রে তার অর্থ হচ্ছে আমাদের ধর্মীয় অভিভাবক। (সূত্র : কিতাবুল ফাতাওয়া : ১/২২৮, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল : ২/৬৩৮)
যদি শুধু শব্দগত রূপের ক্ষেত্রে মিল থাকার ফলে কোনো শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ঈমানদারদের জন্য ‘মুমিন’ শব্দ ব্যবহারও ‘নাজায়েজ’ হতে বাধ্য। কেননা আল্লাহ তাআলার ৯৯ নামের একটি হচ্ছে ‘মুমিন’। অথচ কোরআন ও হাদিসে বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ‘মুমিন’ বলে বিশেষিত করা হয়েছে। এর কারণ হলো, বান্দার ক্ষেত্রে ‘মুমিন’ শব্দ এক অর্থে আর আল্লাহর ক্ষেত্রে অন্য অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। একই কথা ‘মাওলানা’ শব্দটার বেলায়ও প্রযোজ্য।
ইতিহাসে দেখা যায়, প্রখ্যাত তাবেয়ি হজরত হাছান বসরিকে লোকেরা ‘মাওলানা’ বলে ডাকত।(সূত্র : তাহজিবুত তাহজিব : ২/২৬৩, আলবেদায়া ওয়ান্নেহায়া : ৬/২৬৬)
তাছাড়া আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উর্দু ভাষায় ‘মাওলানা’ শব্দটি উস্তাদ ও আলেমে দ্বিন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। (সূত্র : আল-হাদিয়্যাতুল মারযিয়্যা, পৃষ্ঠা ১১৭, ফিরুজুল লুগাত, পৃষ্ঠা ৬৬৪)
আমরা যেহেতু এই শব্দের ব্যবহার উর্দুভাষীদের থেকে পেয়েছি, তাই মাওলানা দ্বারা এই দুই অর্থই উদ্দেশ্য।
কাজেই না জেনে এ শব্দ ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করা বা বিভ্রান্তি ছড়ানো অনুচিত।

                   *সমাপ্ত*

Monday, 24 September 2018

‘এহইয়া’র প্রতি নির্লজ্জদের অপবাদের জবাব

মূল: ড: জি, এফ, হাদ্দাদ
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Dr GF Haddad's online article "Defending the Ihyaa' from those devoid of shame;" translator: Admin]

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

ইমাম গাযযালী (রহ:)’র প্রণীত “এহইয়াও উলুমিদ্দীন” গ্রন্থটি ইসলামে সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর একটি হিসেবে পরিগণিত, যা (যুগে ‍যুগে) উলামাবৃন্দের প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং মুসলমান সমাজের কাছেও সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে। এর প্রশংসাকারী অগণিত আলেম-উলামার একজন ইমাম সাফাদী (রহ:) বলেন: “এটা সবচেয়ে অভিজাত ও সেরা (ইসলামী) গ্রন্থগুলোর একটা; তা এমনই এক পর্যায়ের যে এর সম্পর্কে কথিত আছে, ইসলামের সমস্ত বই-ও যদি হারিয়ে যায় কিন্তু ‘এহইয়া’ টিকে থাকে, তাহলে এটা হারানো সব কিছুর জন্যে যথেষ্ট হবে।” [ নোট-১: ইমাম ইবনে সুবকী কৃত ‘তাবাক্বাত আল-শা’ফিইয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৩]

বিভিন্ন কারণে ‘এহইয়া’ পুস্তকটি সমালোচিতও হয়েছে; এগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল ও জাল হাদীস/রওয়ায়াত উদ্ধৃত করার অভিযোগ। এর একটি তালিকা পেশ করেছেন ইমাম ইবনে সুবকী, যিনি গুরুত্বারোপ করেন যে ইমাম গাযযালী (রহ:) কখনোই হাদীসশাস্ত্রে উৎকর্ষ সাধন করেননি [নোট-২: প্রাগুক্ত ‘তাবাক্বাত,’ ৬: ২৮৭-৩৮৯]। আবূ আবদিল্লাহ মা’যারী মালেকী ভুলভাবে ‘আল-কাশফ ওয়াল-ইনবা’আ ‘আন কিতা’ব আল-এহইয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে ‘এহইয়া’ পুস্তকটিতে উদ্ধৃত বেশির ভাগ বর্ণনা-ই নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্নে ‘ওয়া’হিন’ তথা ত্রুটিপূর্ণ। অপর দিকে আরেক সমালোচক মালেকী আলেম আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে আল-ওয়ালীদ আল-তুরতূশী (ইন্তেক্বাল: ৪২০ হিজরী) ইবনে জা’ফির আবূ আবদিল্লাহ ‍মুহাম্মদ ইবনে আবদির রহমান ইবনে আতিয়্যা’কে লেখা পত্রে বিস্ময় প্রকাশ করেন: “তিনি (আল-গাযযালী) তাঁর বইটি জাল বর্ণনা দ্বারা পরিপূর্ণ করেছেন!” ইমাম ইবনে সুবকী (রহ:) প্রত্যুত্তর দেন:

আল-মা’যারী ছিলেন আশআরী মতবাদের একজন আবেগপ্রবণ প্রবক্তা - কর্তৃত্বশীল ও মাঝারি, বড় ও ছোট উভয় ক্ষেত্রেই; যে ব্যক্তি এগুলোকে অতিক্রম করতেন, তাঁকেই অাল-মা’যারী বেদআতী ঘোষণা করতেন। অধিকন্তু, তিনি নিজের মালেকী মাযহাবের প্রতি ছিলেন পক্ষপাতিত্বপূর্ণ, যে পক্ষ তিনি তেজোদ্দীপ্তভাবে সমর্থন করতেন। পক্ষান্তরে, আল-জুওয়াইনী (রহ:) ও আল-গাযযালী (রহ:) এমন এক জ্ঞান ও দক্ষতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যে প্রত্যেক নিরপেক্ষ গবেষক/পর্যবেক্ষক-ই এ কথা স্বীকার করতে সক্ষম যে তাঁদের পরে ওই ক্ষেত্রে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার; আর তাঁরা কালা’মশাস্ত্রের প্রশ্নে ইমাম আবূল হাসান আশআরী (রহ:)’র সাথে ভিন্নমত পোষণ করাকে হয়তাে যথাযথ বিবেচনা করে থাকতে পারেন (এর দরুন)। আশআরীবৃন্দ, বিশেষ করে ওই মাযহাবের মরক্কোবাসী অনুসারীবৃন্দ এটাকে সহজভাবে নেন না এবং তাঁরা কাউকেই ইমাম আবূল হাসান (রহ:)’এর মতাদর্শের সামান্যতম লঙ্ঘনও করতে দিতে চান না [নোট-৩: দেখুন ইমাম গাযযালী (রহ:)’র ‘ফায়সাল আল-তাফরিক্বা’ {রাসা’ইল ৩:৭৫-৯৯} শীর্ষক পত্র, যেটা সেসব আশআরী’র জবাবে লেখা হয়েছে যারা ইমাম অাবূল হাসানের এমন কী এজতেহাদ-সহ সকল নীতিমালা হতে বিচ্যুত যে কারো প্রতি তাকফির/ধর্মচ্যুতির ফতোয়া জারি করেন। এই পত্রে ইমাম গাযযালী (রহ:) লেখেন: “জেনে রেখো, ইসলামী জ্ঞানের শাখাগুলোতে কোনো তাকফির নেই স্রেফ একটি বিষয় ব্যতিরেকে, আর তা হলো অামাদের কাছে ব্যাপক (জনশ্রুত) বর্ণনার মাধ্যমে আগত ধর্মের উসূল/মূলনীতিমালার যে কোনো একটির অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান। অন্যান্য বিষয়গুলোর বেলায় ’ফিক্বীয়্যা’ তথা শরঈ বিধানশাস্ত্রে ‘তাখতিয়া’ তথা অসত্যতা বা ভুলভ্রান্তির ফতোয়া হতে পারে; আর অন্য ক্ষেত্রে ‘তাবদী’ (বেদআত/নতুন প্রচলন) হতে পারে; যেমনটি ইমাম পদবীর ব্যাপারে ভ্রান্তি সম্পর্কিত হওয়া {মানে চার খলীফা (রা:)-বিষয়ক ভ্রান্তি ও হুযূরের (দ:) সাহাবাবৃন্দের (রা:) অবস্থা সম্পর্কে ভ্রান্তি}]। আরো জটিলতা সৃষ্টি করেছে আল-জুওয়াইনী (রহ:) ও আল-গাযযালী (রহ:) কর্তৃক কিছু বিষয়ে ইমাম মালেক (রহ:)’এর সিদ্ধান্তকে দুর্বল করে ফেলা, যেমন - জনকল্যাণ বিষয়ে দেয়া রায়গুলো [নোট-৪: হানাফী ও মালেকী ফক্বীহ-মণ্ডলী কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে জনকল্যাণ (আল-মাসা’লিহ আল-মুরসালা) ক্ষেত্রে নেয়া এসতেহসা’ন (সুবিবেচনাপূর্ণ বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত) ও রায়কে ইসলামী বিধানের বৈধ উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা ওই সব বিষয়ে নস (শরঈ দলিল), এজমা’ (উলামাবৃন্দের ঐকমত্য) ও ক্বেয়াসের (গবেষণামূলক সিদ্ধান্তের) অনুপস্থিতিতে গৃহীত হতো। দেখুন - আবূ এসহা’ক্ব আল-শীরা’যী কৃত ‘অাল-লুমা’আ ফী উসূল আল-ফেক্বাহ (১২১ পৃষ্ঠা), আল-শা’তিবী প্রণীত ‘আল-মুওয়া’ফাক্বাত ফী উসূল আল-ফেক্বাহ’ (৩:৭৫-৭৭), আল-আমিদী রচিত ‘আল-এহকা’ম ফী উসূল আল-আহকা’ম’ (৪:৩২f, ৪:১৬৭f), আল-রা’যী লিখিত ‘আল-মাহসুল ফী ’এলম আল-উসূল’ (৬:২১৮-২২৫) এবং ইবনে বাদরান কৃত ‘আল-মাদখাল ইলা’ মাযহাব আল-ইমাম আহমদ’ (২৯৫-২৯৬ পৃষ্ঠা)। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আল-হাসান আল-শায়বানী (রহ:) একটি বই রচনা করেন ‘আল-এসতেহসা’ন’ শিরোনামে যা ইমাম শাফেঈ (রহ:) খণ্ডন করেন তাঁর প্রণীত ‘এবতাল আল-এসতেহসা’ন’ পুস্তকে], অথবা কোনো মাযহাবের চেয়ে অন্য আরেকটি মাযহাবকে বেশি পছন্দ করা......আর আল-মা’যারী’র ব্যক্ত “ইমাম গাযযালী (রহ:) কালা’মশাস্ত্রে কোনো মুতাবাহহির তথা অগ্রগণ্য পণ্ডিত নন” মর্মে কথাটির সাথে আমি একমত; তবে আমি আরো যোগ করবো: এতে নিশ্চয়ই তাঁর ছিলো সুদৃঢ় দখল/পদচারণা, যদিও আমার মতে অন্যান্য বিদ্যাশাস্ত্রে তাঁর দখলের তুলনায় এটা তেমন দৃঢ় ছিলো না। আর আল-মা’যারীর ব্যক্ত “উসূলের শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনের আগে ইমাম গাযযালী (রহ:) দর্শনশাস্ত্রে প্রবৃত্ত হন” মর্মে কথাটি প্রসঙ্গে বলতে হয়, ঘটনা তা নয়। তিনি উসূল-শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরই কেবল দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন আরম্ভ করেন; এবং তিনি তাঁর ‘আল-মুনক্বিয মিন আল-দালা’ল’ পুস্তকে এটা উল্লেখও করেছেন এ কথা যোগ করে যে, তিনি কালা’ম-শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেই দর্শনশাস্ত্রের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন।....আর ইবনে সীনা’র ক্ষেত্রে আল-গাযযালী (রহ:) তাঁকে অবিশ্বাসী ঘোষণা করেন; এমতাবস্থায় তাঁর (ইবনে সীনার) ওপর কীভাবে তিনি নির্ভর করতে পারেন? ‘এহইয়া’ গ্রন্থে কিছু বর্ণনা উদ্ধৃত করার ব্যাপারে ইমাম গাযযালী (রহ:)’র প্রতি দোষারোপ প্রসঙ্গে জানা যায় যে তাঁর হাদীসশাস্ত্রে কোনো দক্ষতা ছিলো না, আর অধিকাংশ বর্ণনা ও ঘটনা তিনি তাঁর পূর্বসূরী সূফীবৃন্দ ও ফক্বীহ-মণ্ডলী হতে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বয়ং একটি এসনাদ/সনদ-ও পেশ করেননি; কিন্তু আমাদের একজন সাথী (ইমাম যাইনউদ্দীন এরাক্বী) যত্নসহকারে ‘এহইয়া’র বর্ণনাগুলোর এসনাদ সপ্রমাণ করেছেন; স্রেফ কিছু সংখ্যক বিবরণকে শা‘যয তথা ত্রুটিপূর্ণ অভিহিত করা হয়েছে। আমি উপকারার্থে সেগুলো উদ্ধৃত করবো....আল-গাযযালী (রহ:)’র কথিত ‘রাসূল (দ:) এরশাদ ফরমান’ বাক্যটিও তাঁর (হুযূরের) প্রতি নিশ্চিতভাবে অারোপিত অর্থে নয়, বরঞ্চ তা এমন এক আরোপিত কথা যা নিশ্চিত বলে দৃশ্যমান হয়। কেননা তিনি যদি এটাকে সত্য বলে ধরে না নিতেন, তাহলে তিনি তা বলতেন না। বিষয়টি তিনি যেভাবে ভেবেছিলেন, সে মোতাবেক ছিলো না; আর এটাই মোদ্দা কথা। ’এহইয়া’ গ্রন্থে প্রাপ্ত বানোয়াট বিবরণ সম্পর্কে তুরতূশী’র অভিযোগ প্রসঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করি, ইমাম গাযযালী (রহ:)-ই কি সেগুলো বানিয়েছেন যে তাঁকে এর জন্যে দোষারোপ করা যাবে? সেগুলোর জন্যে তাঁকে দোষারোপ করা নিশ্চিতভাবে অসার উগ্রতা ছাড়া কিছু নয়। এটা এমনই এক বিরুদ্ধাচরণ যা কোনো চিন্তাশীল গবেষক গ্রহণ করবেন না। [নোট-৫: প্রাগুক্ত ‘তাবাক্বা’ত আল-শা’ফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৪৪-, ২৪৯, ২৫২]

ইমাম যাহাবী ইমাম আল-হা’রিস্ আল-মুহা’সেবী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে, যেখানে তিনি ওই ইমামের প্রতি মুহাদ্দীস আবূ যুর’আ’র আরোপিত কুৎসার উদ্ধৃতি দেন, সেখানে তিনি নিজেও কিছু সূফীবিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং বিস্ময়ভরে উচ্চারণ করেন:

আল-হা’রিস্ অাল-মুহা’সেবীর মতো লোকেরা কোথায়? কী হতো যদি আবূ যুর’আ হযরত আবূ তালেব (আল-মক্কী)’এর লেখা ‘ক্বূত আল-ক্বুলূব’ বইটির মতো পরবর্তীকালের সূফীদের বইপত্র দেখতে পেতেন? অার ’ক্বূত’ বইটির মতো বইপত্র কোথায়? কী হতো যদি তিনি (অাবূ যুর’আ) আবূ জাহদামের ‘বাহজাত আল-আসরা’র’ ও আল-সুলামী’র ‘হাক্বায়েক্ব আল-তাফসীর’ পুস্তকগুলো দেখতে পেতেন? তিনি নিশ্চয় ছাদ পর্যন্ত লাফিয়ে উঠতেন! কী হতো যদি তিনি আবূ হা’মিদ আল-তূসী (ইমাম গাযযালী)’র কিতা’বগুলো দেখতে পেতেন? শায়খ আবদুল ক্বা’দির (আল-জীলা’নী)’এর ‘গুনইয়া’.... (ইবনে অারবীর) ‘ফুসূস আল-হিকাম’ ও ‘ফুতূহাত আল-মক্কীয়া’ দেখতে পেতেন?! [নোট-৬: আল-যাহাবী কৃত ‘মীযা’ন’, ১:৪৩০ #১৬০৬]

ইমা’ম আল-সৈয়ূতী (রহ:) তেজোদ্দীপ্তভাবে আল-যাহাবীর প্রতি জবাব দেন:

আল-যাহাবীর মিন মিন যেনো আপনাদের ধোকা না দেয়। কেননা তার মিন মিন ইমাম ফখরুদ্দীন ইবনে আল-খতীব (আল-রা’যী) এবং ওই ইমামের চেয়েও মহান ‘ক্বূত আল-ক্বুলূব’ গ্রন্থপ্রণেতা হযরত আবূ তা’লেব মক্কী (রহ:)’র বিরুদ্ধে গিয়েছে; আর তা হযরত আবূ তা’লেব মক্কীর চেয়েও মহান শায়খ আবূল হাসান আল-আশআরী, যাঁর প্রসিদ্ধি আসমান (জমিন) পর্যন্ত ছড়িয়েছে, তাঁরও বিরুদ্ধে গিয়েছে! উপরন্তু, তার লেখা ‘আল-মীযা’ন’, ‘আল-তা’রীখ’ ও ‘সিয়্যার আল-নুবালা’ বইগুলো ওরকম সমালোচনায় পরিপূর্ণ। আপনারা কি উক্ত ইমামবৃন্দের মোকাবেলায় তার কথাকে মানবেন? আল্লাহর শপথ, কখনোই নয়! তাঁদের ব্যাপারে তার কথা গ্রহণীয় নয়। বরঞ্চ আমাদের ওপর তাঁদের হক্ব/অধিকারকে আমরা সম্মান করি এবং তাঁদের প্রতি তা পরিপূর্ণভাবে আদায়ও করি। [নোট-৭: আল-সৈয়ূতী, ‘ক্বাম’ আল-মু’আরিদ বি-নুসরাত ইবনে আল-ফা’রিদ’ (আল-ফারিদের সত্যতা প্রতিপাদন দ্বারা আপত্তিকারীকে বশীভূতকরণ) যা তাঁরই ‘মাক্বা’মাত’ গ্রন্থে (২:৯১৭-১৮) বিদ্যমান; আল-লাখনৌভীও নিজ ‘আল-রাফ’ ওয়াল-তাকমীল ফীল-জারহ ওয়াল-তা’দীল’ (৩১৯-৩২০ পৃষ্ঠায়) পুস্তকে এটা উদ্ধৃত করেন।]

সূফীদের প্রতি কুৎসা রটনাকারী ইবনে আল-জাওযীও একইভাবে ‘এহইয়া’কে নিজের রচিত নিম্নোল্লিখিত চারটি বইয়ে প্রত্যাখ্যান করেন: ‘এ’লাম আল-আহএয়া’ বি-অাগলা’ত আল-এহইয়া’ (এহইয়া’র ভ্রান্তি সম্পর্কে জীবিতদেরকে অবহিতকরণ), ‘তালবীস-এ-ইবলীস’, ‘আল-ক্বুসসা’স’ [নোট-৮: ইবনে আল-জাওযী, ‘আল-ক্বুসসা’স ওয়াল-মুযাককেরীন’, ২০১ পৃষ্ঠা] এবং তার ইতিহাস পুস্তক ‘আল-মুনতাযাম ফী তা’রীখ আল-মুলূক ওয়াল উমাম’ [নোট-৯: ইবনে আল-জাওযী, ‘আল-মুনতাযাম’, ৯:১৬৯]। তার এসব মতামত ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্যদের প্রভাবিত করেছিলো। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি এও ছিলো যে ইমাম গাযযালী (রহ:) অত্যধিক পরিমাণ দুর্বল ও ভিত্তিহীন হাদীস ব্যবহার করেছিলেন। আবদুল ফাত্তা’হ আবূ গুদ্দা বলেন:

আমাদের আস্থাশীলতা আল্লাহর প্রতি! ইবনে আল-জাওযী জাল হাদীস-বিষয়ক একটি বিশালাকৃতির গ্রন্থ লেখেন যেনো ফক্বীহ, ধর্মপ্রচারক ও অন্যান্যরা সেগুলো এড়াতে পারেন। অতঃপর আপনারা তাকে নিজের উপদেশমূলক বইপত্রে জাল হাদীস ও প্রত্যাখ্যাত বর্ণনাগুলো সম্পর্কে আগামাথা ছাড়া, শরমহীনভাবে কিংবা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখা ব্যতিরেকেই উদ্ধৃতি দিতে দেখবেন। পরিশেষে প্রত্যেক পাঠক অনুভব করবেন যে ইবনে আল-জাওযী দু জন ব্যক্তি, একজন নন! ....এ কারণেই ইবনে আল-আসীর নিজস্ব ‘আল-কা’মিল’ ইতিহাসগ্রন্থে তাকে দোষারোপ করেন এই বলে: ইবনে আল-জাওযী অনেক কিছুর জন্যে ইমাম গাযযালী (রহ:)’কে দোষারোপ করেন, যেগুলোর মধ্যে হযরত ইমামের উপদেশে নিহিত অ-সহীহ হাদীসসমূহের বর্ণনা। কী আজব যে ইবনে আল-জাওযী এর জন্যে তাঁর সমালোচনা করতে পেরেছেন! কেননা তার নিজের বইপত্র ও উপদেশমূলক লেখালেখিতেই ওই রকম জাল হাদীস ভরপুর [নোট-১০: ইবনে আল-আসীর, ‘আল-কা’মিল ফীল-তা’রীখ’ (দা’র সা’দির সংস্করণ, ১০:২২৮; ইলমিয়্যা সংস্করণ ৯:২৪০]! অধিকন্তু , হাদীস-শাস্ত্র বিশারদ আল-সাখাভী (রহ:) ‘শরহ আল-আলফিয়্যা’ পুস্তকে বলেন: “ইবনে আল-জাওযী নিজের উপদেশমূলক বইপত্রে প্রচুর পরিমাণে জাল ও অনুরূপ হাদীস উদ্ধৃত করেন।” [নোট-১১: আবদ আল-ফাত্তা’হ আবূ গুদ্দা, ‘আল-লাখনৌভীর আল-রাফ’ ওয়াল-তাকমিল পুস্তকের টীকা’, ৪২০-৪২১ পৃষ্ঠা]       

অন্যান্য মধ্যমপন্থী মুহাদ্দীস-ইমাম ‘এহইয়া’ পুস্তকের প্রতিটি হাদীসকে (এসনাদ-সহ) সপ্রমাণ করেছেন, আর এর সামগ্রিক উপকারিতার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলেননি; তাঁরা মুসলমানদের মাঝে বইটির অসীম গুরুত্ব স্বীকার করেছেন এবং এর সৌন্দর্য বর্ধনে ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের সারগ্রন্থ হিসেবে এর প্রচার-প্রসারে অবদান রেখেছেন। এই আলেম-উলামার মধ্যে রয়েছেন:

* ইমাম যাইন আল-দ্বীন আল-এরাক্বী (বেসাল: ৮০৬ হিজরী): ‘এখবা’র আল-আহইয়া’ বি-আখবা’র আল-এহইয়া’, যেটা চার খণ্ডে সমাপ্ত; এতে তিনি ইমাম গাযযালী (রহ:) ও তাঁর বইয়ের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন; এটা ছিলো বিশ হতে ত্রিশ বছরের মধ্যবর্তী বয়সী আল-এরাক্বীর কৃত ‘এহইয়া’র বিবরণগুলোর ওপর সর্ববৃহৎ প্রামাণিক দলিল, যা তিনি মধ্যম আকৃতির ‘আল-কাশফ আল-মুবীন ‘আন তাখরীজে এহইয়া’ উলূম আল-দ্বীন’ বইয়ে এবং ক্ষুদ্রাকৃতির ‘অাল মুগনী ‘আন হামল আল-আসফা’র’ পুস্তিকায় সংস্কৃত করেন। [নোট-১২: ‘লাহয আল-আলহা’য বি-দায়ল তাযকিরাত আল-হুফফা’য’ (২২৮ পৃষ্ঠায়) বর্ণিত ইবনে ফাহদের ভাষ্যানুযায়ী; আল-যাহাবীর মূল ‘তাযকিরাত আল-হুফফায’ পুস্তকের পঞ্চম খণ্ড];

* ইমাম এরাক্বী (রহ:)’র ছাত্র ইমাম ইবনে হাজর (রহ:): ‘আল-এসতেদরা’ক ‘আলা তাখরিজ আহা’দীস আল-এহইয়া’;

* আল-ক্বা’সিম ইবনে ক্বুতলূবাগা’ আল-হানাফী: ‘তোহফাত আল-আহএয়া ফী মা’ ফা’তা মিন তাখরীজ আহা’দীস আল-এহইয়া’;

* সাইয়্যেদ মুরতাদা’ আল-যাবীদী আল-হুসাইনী (বেসাল: ১২০৫ হিজরী): ‘এখতেলা’ফ আল-সা’দাত আল-মুত্তাক্বীন ফী শারহ আসরা’র এহইয়া’ উলূম আল-দ্বীন’; (এখানে উল্লেখিত) প্রত্যেক আলেম তাঁর পূর্ববর্তী আলেমের প্রামাণিক দলিলকে সুসম্পন্ন করেন।

অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, হাদীস-শাস্ত্রবিশেষজ্ঞ উলামাবৃন্দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই শরঈ-বিধান প্রণয়নমূলক বিষয়াদি ভিন্ন অপরাপর বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে যয়ীফ/দুর্বল হাদীসের ব্যবহারকে জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত বিবেচনা করেন; উদাহরণস্বরূপ, উত্তম বিষয়কে উৎসাহদান ও মন্দ বিষয়কে নিরুৎসাহিত করা (আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব), যেমনটি অগণিত মুহাদ্দেসীন ও ইমাম সাফাদী (রহ:)’র মতো অন্যান্য উলামা ইঙ্গিত করেছেন [নোট-১৩: দেখুন আল-হা’কিম কৃত ‘আল-মাদখাল লি-ইলম আল-হাদীস (অবতরণিকা); আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘দালা’য়েল আল-নুবুওয়া’ (ভূমিকা); আল-নববী রচিত ‘আল-তিবএয়া’ন ফী আদব হামালাত আল-ক্বুরআন’ (১৭ পৃষ্ঠা); ইমাম নববী বলেন, ‘নেক আমল তথা পুণ্যদায়ক কর্মের অনুশীলনের পক্ষে দুর্বল হাদীস ব্যবহারের বৈধতার ব্যাপারে উলামাবৃন্দ একমত।’ ইমাম সাখাভী উলামাদের এতদসংক্রান্ত সর্বসম্মতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন তাঁরই ‘আল-ক্বাওল আল-বদী’ (২৪৫-২৪৬ পৃষ্ঠা) গ্রন্থের উপসংহারে]। এটা বোঝা উচিত যে ইমাম গাযযালী (রহ:) তাঁর নীতি-শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যের জন্যে উপকারী হিসেবে যেসব উপকরণকে বিবেচনা করেছিলেন, সেগুলো তিনি বেছে নিয়েছিলেন সারমর্মের ভিত্তিতেই, বর্ণনার উৎস বা এসনাদ/পরম্পরার ভিত্তিতে নয়; ‘এহইয়া’ পুস্তকের বৃহত্তর অংশ গঠিত হয়েছে ক্বুরঅান, হাদীস ও আল-গাযযালী (রহ:) ছাড়া অন্যান্যদের বাণীর উদ্ধৃতি দ্বারা; তাঁর নিজের লেখনী মূল বইয়ের ৩৫%-এর চেয়েও কম অংশ জুড়ে বিরাজমান [নোট-১৪: টি, জে, উইনটার, Ghazali's "Remembrance of Death" অনুবাদগ্রন্থ, ক্যামব্রিজ ইসলামিক টেক্সট্ সোসাইটি, ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দ) পরিচিতি (xxixn. ৬৩ পৃষ্ঠা)]; আর এই বিশাল সংখ্যক উদ্ধৃত হাদীসের মাঝে তিন-চতুর্থাংশই মূলতঃ সহীহ [নোট-১৫: ইমাম ইবনে সুবকী (রহ:)’র দুর্বল, অতি দুর্বল অথবা জাল হাদীসের তালিকায় বিরাজমান এক সহস্রেরও কম বর্ণনা, অথচ ‘এহইয়া’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে চার সহস্রাধিক হাদীস]

হানাফী মুহাদ্দীস ও অগ্রবর্তী অভিধান রচয়িতা মুরতাদা’ আল-যাবীদী (রহ:) ‘এহইয়া’র ওপর তাঁর কৃত বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থের সূচনা করেন একটি ব্যাখ্যা দিয়ে, যা’তে তিনি বিবৃত করেন যে ইমাম গাযযালী (রহ:) কর্তৃক হাদীসের কথা হুবহু বর্ণনার পরিবর্তে সেটার সাধারণ অর্থ উদ্ধৃত করার পদ্ধতিটি সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও সালা’ফবৃন্দের আচরিত রীতিরই ওপর ভিত্তিশীল ছিলো। তিনি বলেন:

রওয়ায়াত/বিবরণগুলোর হুবহু কথাসমূহ যাচাই করা ইমাম গাযযালী (রহ:)’র জন্যে বাধ্যতামূলক ছিলো না। তিনি  সাধারণ অর্থ বিবৃত করেছেন বাণীগুলোর বিভিন্ন ইপ্সিত অর্থ ও সেগুলোর পারস্পরিক বিরোধ সম্পর্কে সচেতন হয়েই এবং সেগুলোর মধ্যে যাতে পরস্পরবিরোধী অর্থ সংযোজন না হয় তা এড়িয়েই।

কিছু সংখ্যক সাহাবা (রা:) প্রিয়নবী (দ:)’র হুবহু আহাদীস/বাণী (রেওয়া’য়া বিল-আলফা’য)’র পরিবর্তে সেগুলোর অর্থ (রেওয়া’য়া বিল-মা’আনা’) বিবৃত করার পক্ষে অনুমতি দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছেন: সর্ব-হযরত আলী (ক:), ইবনে অব্বাস (রা:), আনাস বিন মালেক (রা:), আবূদ্ দারদা (রা:), ওয়া’সিলা ইবনে আল-আক্বসা (রা:) ও আবূ হুরায়রাহ (রা:) [নোট-১৬: আল-খতীব তাঁর ‘আল-জামে’ ফী আখলা’ক্ব আল-রা’ওয়ী’ (২:২৪, ২:২৬-২৮) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (রা:), আবূদ্ দারদা (রা:), আনাস (রা:), আয়েশা (রা:), আমর ইবনে দীনা’র (রা:) আমির আল-শা’বী (রা:), ইবরা’হীম আল-নাখাঈ (রা:), ইবনে আবী নুজায়হ (রা:), আমর ইবনে মুর্রা (রা:), জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী (রা:), সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রা:) ও এয়াহইয়া ইবনে সাঈদ অাল-ক্বাত্তা’ন (রা:) ওই পন্থায় হাদীস বর্ণনার অনুমতি দিয়েছিলেন। লেখক সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (# ১১১৩), আবূদ্ দারদা (# ১১১৪-১১১৫) ও আনাস (# ১১১৬-১১১৭) হতে এর সপক্ষে উদাহরণ পেশ করেন। তিনি আরো বর্ণনা করেন ইমাম ওয়াকী’ (২:২৪ # ১১১০৮) ও ইমাম মালেক (২:২৫ # ১১১০-১১১১) হতে আহাদীসের মূল শব্দচয়ন ব্যতিরেকে অন্য শব্দচয়নে তা বর্ণনার ওপর নিষেধাজ্ঞার কথাও। আল-খতীব এ বিষয়টির বিস্তারিত প্রামাণ্য দলিল পেশ করেন ‘আল-কেফা’য়া’ গ্রন্থে (২০৩-২১১ পৃষ্ঠা)]। এছাড়াও তাঁদের বৃহত্তর সংখ্যক উত্তরসূরী ওই মত গ্রহণ করেন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন: ইমামবৃন্দের ইমাম হযরত হাসান আল-বসরী (রহ:), সর্ব-হযরত আল-শা’বী (রা:), আমর ইবনে দীনা’র (রা:), ইবরাহীম আল-নাখাঈ (রা:), মুজাহিদ (রা:) ও একরিমা (রা:) প্রমুখ.....ইবনে সীরীন (রা:) বলেন, “আমি দশজন পৃথক পৃথক ব্যক্তি হতে কোনো একটি হাদীস শুনতাম, যার অর্থ একই কিন্তু শব্দচয়ন একে অপর থেকে ভিন্ন” [নোট-১৭: আবূল আহওয়াস্ মুহাম্মদ ইবনে আল-হায়তাম হতে আল-খতীব কর্তৃক ‘আল-জামে’ লি-আখলাক্ব আল-রা’ওয়ী’ (২:২১ # ১০৯৯) গ্রন্থেও উদ্ধৃত]। অনুরূপভাবে, সাহাবাবৃন্দের (রা:) মধ্যেও মহানবী (দ:)’র হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে শব্দচয়নের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তাঁদের কেউ কেউ পুরোটুকু বিবরণ হুবহু উদ্ধৃত করেছেন; কেউ কেউ শুধু সারমর্ম বর্ণনা করেছেন; অপরাপর সাহাবাবৃন্দ (রা:) সংস্কৃত অংশ পেশ করেছেন; অন্যরা আবার নির্দিষ্ট কিছু শব্দের সমার্থক শব্দ দ্বারা পরিবর্তন সাধন করেছেন এই বিবেচনায় যে মূল অর্থের বিকৃতি এতে সাধিত হবে না। তাঁদের কেউই মিথ্যে আরোপকে উদ্দেশ্য করেননি, বরঞ্চ সত্যবাদিতাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন; আর তাঁরা বর্ণনা করেছেন যা শুনেছিলেন। সে কারণেই তাঁদের তা করার অবকাশ ছিলো। তাঁরা বলতেন: “অসত্য বিবরণ প্রদান তখন-ই হবে, যখন কেউ ইচ্ছাকৃকভাবে মিথ্যেকে উদ্দেশ্য করে” [নোট-১৮: দেখুন আল-খতীব, ‘আল-কেফা’য়া’, ১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩৯-২৪৭ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ২০৪-২১১ পৃষ্ঠা]

ইমরা’ন ইবনে মুসলিম (আল-ক্বাসীর) বর্ণনা করেন যে জনৈক ব্যক্তি ইমাম হাসান আল-বসরী (রহ:)’কে বলেন: “হে আবূ সাঈদ! আপনি যখন কোনো হাদীস বর্ণনা করেন, তখন আমাদের কারো দ্বারা ওই হাদীস বর্ণনার চেয়ে আপনি আরো শ্রেয়তর ও প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত করেন।” তিনি উত্তরে বলেন: “তাতে কোনো ক্ষতি নেই যতোক্ষণ না তুমি তার অর্থ পুরোপুরি ব্যক্ত করেছো” [নোট-১৯: আল-খতীব কর্তৃক ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৪৩ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ ২০৭ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে ও ‘আল-জামে’ (২:২২ #১১০১-১১০২) পুস্তকে বর্ণিত। তুলনা করুন আল-শাফেঈ (রহ:)’র পুস্তক ‘আল-রেসা’লা’ (২৭৫ পৃষ্ঠা) যা’তে আল-হাসান বসরী (রহ:) বা আল-যুহরী’র নামের উল্লেখ নেই]। আল-নাদর ইবনে শুমায়ল (বেসাল: ২০৮ হিজরী) বলেন: “হুশায়ম (বেসাল: ১৮৩ হিজরী) অারবীতে অনেক ভুল করতেন, তাই আমি তাঁর করা বর্ণনাগুলোকে তোমাদের জন্যে সুন্দর বস্ত্রাবৃত করেছি” - এ কথার অর্থ হলো, তিনি সেগুলোকে উন্নত আরবী ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন, কেননা নাদর ছিলেন একজন ‘নাহউয়ী’ তথা ভাষাতত্ত্ববিদ [নোট-২০: ইসমাঈল ইবনে উমাইয়া বলেন: “আমরা (উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মুক্ত করা গোলাম) না’ফীর ভাষাগত ভুল শুধরে দিতাম, যখনই তিনি (বর্ণনাগুলোতে) তা সংঘটন করতেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলতেন, ‘এটা আমি হুবহু যা শুনেছিলাম, তা ছাড়া কিছু নয়’।” আল-যাহাবীও ‘সিয়্যার’ পুস্তকে এর উদ্ধৃতি দেন (৫:৫৬৭)]। হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:) বলতেন: “তোমরা যখন হাদীসের শব্দের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন করতে কাউকে দেখতে পাও, তখন জানবে যে ওই লোক নিজের প্রদর্শনী দিচ্ছে।” তিনি বর্ণনা করেন যে একবার এক ব্যক্তি হযরত এয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-ক্বাত্তা’ন (বেসাল: ১৯৮ হিজরী)’কে একটি হাদীসের কোনো এক নির্দিষ্ট শব্দের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে। এয়াহইয়া তাকে বলেন: “এয়া ফুলা’ন! সারা পৃথিবীতে আল্লাহর কিতা’বের মতো শ্রেষ্ঠ আর কোনো কিছু নেই, অথচ তিনি সাতটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানিক বাচনে এর (পঠনের) অনুমতি দিয়েছেন। অতএব, অতোটা কঠোর হয়ো না” [নোট-২১: মিলিয়ে দেখুন আল-শাফেঈ, ‘আল-রেসা’লা’, (২৭৪ পৃষ্ঠা)]!

হাদীস-শাস্ত্রবিশারদ আল-সৈয়ূতী (রহ:) তাঁর কৃত (ইমাম নববী’র) ‘আল-তাক্বরীব’ গ্রন্থের ব্যাখ্যামূলক পুস্তকের ৪র্থ খণ্ডের ২৬তম শিরোনামে [নোট-২২: আল-সৈয়ূতী, ‘তাদরীব আল-রা‘ওয়ী ফী শারহ তাক্বরীব আল-নববী (১:৫৩২-৫৩৯)] যা বলেছেন, তার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

কোনো বর্ণনাকারী (হাদীসের) শব্দের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ না হলে এবং শব্দের অর্থ অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হলে স্রেফ অর্থের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন, তা বর্ণনা করার কোনো অনুমতি তার নেই। এ বিষয়ে (উলামাদের মাঝে) কোনো মতপার্থক্য নেই। তাকে অবশ্যই তিনি যা শুনেছেন হুবহু তা-ই (শাব্দিকভাবে) বর্ণনা করতে হবে। তিনি যদি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন, (মতান্তর বিদ্যমান) তাহলে হাদীস, ফেক্বাহ ও উসূল-শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের একটি বড় দল অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে হুবহু শব্দচয়ন ছাড়া অন্য কোনোভাবে হাদীস বর্ণনার অনুমতি তার নেই। এই মত ব্যক্ত করেন ইবনে সীরীন, তা’লাব ও হানাফী পণ্ডিত আবূ বকর রা’যী [নোট-২৩: মিলিয়ে দেখুন আল-খতীব কৃত ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ ২৪২ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ ২০৭ পৃষ্ঠা); তিনি তাতে আরো উল্লেখ করেন ইবরা’হীম ইবনে মায়সারা, আল-ক্বাসেম ইবনে মুহাম্মদ, রাজা ইবনে হায়এয়া ও ইবনে তাউসের নাম]। হযরত ইবনে উমর (রা:)-ও এই মত পোষণ করেন।

{তাবেঈ উবায়দ ইবনে উমাইর আল-মারওয়াযী একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:)’এর উপস্থিতিতে মদীনাবাসীদের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন: “মোনাফেক্বের উপমা হলো দুটো ভেড়ার খোঁয়াড়ের (রাবীদাইন) মধ্যখানে একটা ভেড়ার মতো; যখন সেটা একটা খোঁয়াড়ে যায়, ওই ভেড়ার দল ঢুঁ মারে (মানে তাড়িয়ে দেয়); আবার যখন সেটা অপর খোঁয়াড়ে যায়, সেখানেও ভেড়ার দল ঢুঁ মারে (তাড়িয়ে দেয়)।” হযরত ইবনে উমর (রা:) বাধা দিয়ে বলেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) এ কথা বলেননি। তিনি যা বলেছিলেন তা হলো, ‘দুটো ভেড়ার পালের (গানামাইন) মাঝখানে একটা ভেড়ার মতো।’ শায়খ (মারওয়াযী) এতে রাগান্বিত বোধ করেন। হযরত ইবনে উমর (রা:) তা দেখে অতঃপর বলেন, “নিশ্চয় আমি যদি তা না শুনতাম, তাহলে তুমি যা বলেছো তা শুধরে দিতাম না।” [নোট-২৪: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বর্ণিত] (আরবী দলিলচিত্র - ১)

ইমাম মুহাম্মদ আল-বাক্বের (রহ:) হতে বর্ণিত আরেকটি ভাষ্যে এসেছে যে উবায়দ ইবনে উমাইর আল-মারওয়াযী বলেছিলেন, “দুটো ভেড়ার পালের (গানামাইন) মাঝখানে একটা ভেড়া,” আর হযরত ইবনে উমর (রা:) বাধা দিয়ে বলেন যে সঠিক বিবরণটি ছিলো “দুটো ভেড়ার খোঁয়াড়ের (রাবীদাইন) মাঝখানে একটা ভেড়া।” আবদুল্লাহ ইবনে সাফওয়া’ন যখন হযরত ইবনে উমর (রা:)’কে জানান যে দুটো বাক্য একই অর্থবোধক, তখন তিনি উত্তর দেন, “আমি এটাই শুনেছিলাম।” তৃতীয় আরেকটি ভাষ্যে তাঁর আরো কিছু কথা যুক্ত হয়: “আফসোস তোমার জন্যে! রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর ব্যাপারে মিথ্যে বোলো না!” এই তিনটি সংস্করণ-ই সহীহ সনদে ইমাম আহমদ (রহ:)’এর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। (আরবী দলিলচিত্র-২)}

এতদসত্ত্বেও ‘সালাফ’ (পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মাবৃন্দ) ও ‘খালাফ’ (তৎপরবর্তী পুণ্যাত্মাবৃন্দ)‘এর বিভিন্ন দল, যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন (চার মাযহাবের) চার ইমামমণ্ডলীও, তাঁদের একচেটিয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বর্ণনাসমূহের অর্থগত বিষয়ে উপরোল্লিখিত সকল ক্ষেত্রকেই অনুমতি দেন, শুধু শর্ত এই যে প্রত্যেককে বর্ণনার (হুবহু) অর্থ তুলে ধরতে হবে [নোট-২৫: আল-সৈয়ূতী লিখিত ‘তাদরীব আল-রা’উয়ী’ (১:৫৩২-৫৩৩, মিলিয়ে দেখুন ‘তাক্বরীব’, ৭৭-৭৮ পৃষ্ঠা); আল-নববী নিজ ‘তাক্বরীব’ পুস্তকে বলেন: “এটা হাদীস সংকলন (মুসান্নাফা’ত) ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোনো হাদীস সংকলনের পরিবর্তন অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, এমন কী তা একই অর্থের হলেও। অধিকন্তু, যে ব্যক্তি অর্থের দিক থেকে বর্ণনা পেশ করেন, তাঁর জন্যে বর্ণনার শেষে অত্যাবশ্যক হবে এ কথা বলা: ‘অথবা অনুরূপ কোনো কথা’ (أو كما قال، أو نحوه، أو شبهه) কিংবা এ ধরনের অন্য কোনো অভিব্যক্তি।” ইমাম সৈয়ূতী (রহ:) প্রামাণ্য দলিল পেশ করেন যে এর অনুশীলন করতেন সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (রা:), আবূদ্ দারদা (রা:) ও আনাস বিন মালেক (রা:)। এই ব্যাপারে অতিরিক্ত দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করেন ইমাম তিরমিযী (রহ:) তাঁর ‘অাল-’এলাল আল-কবীর’ পুস্তকে এবং ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (রহ:) কৃত উক্ত পুস্তকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘শারহ ‘এলাল অাল-তিরমিযী (১:১৪৫-১৫২); আল-খতীব আপন ‘অাল-কেফা’য়া’ কিতাবে (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩২-২৪৭ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ১৯৮-২১১ পৃষ্ঠা) এবং ইমাম কাজী আয়ায (রহ:) তাঁর ‘আল-’এলমা’ (১৭৪-১৭৮ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে। এছাড়াও দেখুন ইমাম ইবনে হাজর (রহ:)’এর এতদসংক্রান্ত আলোচনা এবং তার ওপর মোল্লা আলী ক্বা’রীর ব্যাখ্যামূলক ’শরহু শরহে নুখবাত আল-ফিকার’ কিতা’বটি (৪৯৭-৫০২ পৃষ্ঠা)]। এই প্রয়োগ পদ্ধতি সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও সালাফ-মণ্ডলীর (রহ:) আচরিত রীতির মাঝে প্রত্যক্ষ করা হয়েছিলো, যা তাঁদের দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট একটি বর্ণনার বিভিন্ন বাক্যবিন্যাসে প্রদর্শিত হয়েছিলো।

প্রিয়নবী (দ:)’এর এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস বিরাজমান, যা আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইমা’ন ইবনে আকতাম [নোট-২৬: আল-যাবীদী’র লিপিতে এটা একটা ভুল বানান] আল-লায়সী {অাবদুল্লা’হ ইবনে সুলাইম ইবনে উকায়মা[নোট-২৭: ইমাম ইবনে হাজরের ‘আল-এসা’বা’ ও ‘তা’জীল আল-মানফা’আ’ গ্রন্থ দুটোতে যেমনটি উদ্ধৃত হয়েছে, আল-হুসাইনী ‘আল-একমাল’ (৫৬৫ পৃষ্ঠা #১২১১) পুস্তকে ভুল করেছিলেন যখনই তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)’এর ‘মুসনাদ’ কিতাবে উদ্ধৃত ইবনে উকায়মা’কে আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম ইবনে উকায়মা হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন; কেননা ‘সুনান’, ‘মুওয়াত্তা’ ও ইমাম আহমদ (রহ:)’এর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থগুলোতে উল্লেখিত ইবনে উকায়মা’কে ইমাম তিরমিযী (রহ:) নিজ ‘সুনান’ গ্রন্থে এবং অন্যান্য পণ্ডিতবৃন্দ উমারা অথবা ‘আম্মার ইবনে উকায়মা আল-লায়সী বলে চিহ্নিত করেন। উপরন্তু, তাঁকে ইমাম মুসলিম নিজ ‘সহীহ’ গ্রন্থে (৩:১৫৬৬), ইবনে হিব্বা’ন (৫:১৫৮, ১৩:২৩৮-২৩৯), আবূ এয়া’লা আপন ‘মুসনাদ’ বইয়ে (১২:৩৪৮) এবং ইবনে ‘আবদিল বার্র ’আল-তামহীদ’ কিতাবে (১৭:২৩৭) ’আমর ইবনে মুসলিম ইবনে আম্মা’র ইবনে উকায়মা আল-লায়সী বলে চিহ্নিত করেন। তাঁরা সবাই একমত হন যে তিনি কোনো সাহাবী ছিলেন না, বরঞ্চ উত্তরসূরী ছিলেন, যিনি সর্ব-হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা:) ও সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (রা:) উভয়ের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছিলেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম (-য়ান) ইবনে উকায়মা যিনি আল-তাবারা’নী (রহ:)’র কাছ থেকে বর্ণনা করেছিলেন, তিনি এক অপরিচিত জন]}হতে বর্ণনা করেছেন ইবনে মানদাহ নিজ ‘মা’রেফাত আল-সাহা’বা’ পুস্তকে এবং ইমাম তাবারা’নী আপন ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে, যিনি বলেন: আমি আরয করলাম, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! নিশ্চয় আমি যখন আপনার কাছ থেকে কোনো হাদীস শুনি, তখন তা যেভাবে আপনার কাছে শুনেছিলাম সেভাবে আবার বর্ণনা করতে পারি না।” অর্থাৎ, তিনি তাতে সংযোজন বা বিয়োজন করেন। প্রিয়নবী (দ:) উত্তর দেন: “যতোক্ষণ তুমি হারাম/অবৈধকে হালাল/বৈধ না করো, বা হালালকে হারাম সাব্যস্ত না করো, আর যতোক্ষণ এর অর্থকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করো, ততোক্ষণ এতে কোনো ক্ষতি নেই” [নোট-২৮: আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইমা’ন ইবনে উকায়মা হতে ইমাম তাবারা’নী তাঁর ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে (৭:১০০ #৬৪৯১, ১১৭) এবং ইবনে ক্বা’নী (ইন্তেক্বাল: ৩৫১ হিজরী) নিজ ‘মু’জাম আল-সাহা’বা’ বইয়ে (৩:১৭) বর্ণিত; উভয়ের সনদেই দু জন অপরিচিত বর্ণনাকারী আছেন - এয়া’ক্বূব ইবনে অাবদিল্লাহ ইবনে সুলাইম (-য়ান) ইবনে উকায়মা ও তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম (-য়ান), যেমনটি বিবৃত করেছেন আল-হায়তামী (১:১৫৪); মিলিয়ে দেখুন আল-সাখাভী কৃত ‘ফাতহুল মুগীস’ (৩:১৪৫)। ইমাম জু’রাক্বা’নী (ইন্তেক্বাল: ৫৪৩ হিজরী)-ও নিজ ‘আল-আবা’তীল’ পুস্তকে (১:৯০-৯৭) এটা বর্ণনা করেছেন, যা’তে তিনি বলেন: “এই হাদীস বা’তেল, আর এর সনদের মধ্যে এদতেরা’ব তথা বিভ্রান্তি বিদ্যমান।” তথাপিও আল-খতীব তাঁর ‘আল-কেফা’য়া’ গ্রন্থে (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩৪ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ১৯৮ পৃষ্ঠা) অর্থগতভাবে হাদীস বর্ণনার অনুমতি প্রসঙ্গে দুটি অনুরূপ এসনাদ দ্বারা এটা পেশ করেছেন; এর পাশাপাশি মোল্লা আলী ক্বারীও ‘শরহ শরহে নুখবাত আল-ফিকার’ (৪৯৮ পৃষ্ঠা) কিতাবে তা উপস্থাপন করেন। হযরত সালামা ইবনে অাল-আকওয়া হতেও এটা বর্ণনা করেন ইবনে আসাকির (রহ:), যেমনটি বিবৃত করেন ইবনে হামজা আল-হুসাইনী নিজ ‘আল-বয়া’ন ওয়াল-তা’রিফ’ পুস্তকে (২:৭৭-৭৮)। ইবনে হাজর (রহ:) এটা বর্ণনা করেন ‘আল-এসা’বা গ্রন্থে (৩:১৬৬ #৩৪৩৬, ৬:৩৪১ #৮৫৩২) এবং বলেন: “ইবনুল জাওযী এটাকে জাল হাদীসগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এর জন্যে আল-ওয়ালীদ ইবনে সালামা’কে দোষারোপ করেন; কিন্তু তিনি যে দাবি করেছিলেন, বিষয়টি তা নয়। কেননা ইবনে মানদাহ এটা বর্ণনা করেন (’মা’রেফাত আল-সাহা’বা’ পুস্তকে) আরেকটি এসনাদে, যা বর্ণনা করেছেন উমর ইবনে ইবরাহীম, তিনি মুহাম্মদ ইবনে এসহা’ক্ব ইবনে উকায়মা হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর পিতামহ হতে - এই জাতীয় বাক্যের সমর্থন দিয়ে। তবে উমর হলেন আল-ওয়ালীদেরই সমসাময়িক। ইবনে মানদাহ এটা আরেকটা সনদে উমর ইবনে ইবরাহীম হতে বর্ণনা করেন এবং বলেন: ‘মুহাম্মদ ইবনে এসহাক্ব ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে সুলাইম হতে বর্ণিত।’ তিনি তাঁর বংশে আবদুল্লাহ’কে যোগ করেন। অতঃপর তিনি আবদুল্লাহ’র নামে এই এসনাদ-টি বর্ণনা করেন।এটা আবূল ক্বা’সেম ইবনে মানদাহ-ও বর্ণনা করেন তাঁর ‘আল-ওয়াসিয়্যা’ পুস্তকে, যা দুটি এসনাদে ফেরত গিয়েছে আল-ওয়ালীদ ইবনে সালামা পর্যন্ত; তিনি এসহাক্ব ইবনে এয়াক্বূব ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে উকায়মা হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর পিতামহ হতে।’ অন্যান্য অসঙ্গতিও এতে বিরাজমান....আবূ মূসা ‘আল-দায়ল’ পুস্তকে এবং ইবনে মারদূএয়াহ-ও ‘কিতা’ব আল-এলম’ গ্রন্থে আবদা’ন আল-মারওয়াযী হতে এটা বর্ণনা করেছেন...আমার বিশ্বাস কিছু অদল-বদল সাধিত হয়েছে এবং সঠিক এসনাদ হলো: মুহাম্মদ ইবনে এসহা’ক্ব, হতে অাবদুল্লাহ ইবনে সুলাইম ইবনে উকায়মা, হতে তাঁর পিতা, হতে তাঁর পিতামহ।” ‘তা’জিল আল-মানফা’আ’ (৫৩১ পৃষ্ঠা #১৪৪০) কিতাবে ইবনে হাজর (রহ:) ইবনে মানদাহ’র এসনাদকে ওয়া’হিয়্যা তথা হাল্কা বা নড়বড়ে ঘোষণা করেন। ফলে তিনি এই হাদীসকে যয়ীফ/দুর্বল বিবেচনা করেন, কিন্তু জাল নয়। এর মূলপাঠ মহানবী (দ:)’র অন্য দুটি হাদীস দ্বারা তুলে ধরেন আল-খতীব, যার প্রথমটি ঘোষণা করে: “যতোক্ষণ কেউ অর্থ (যথাযথভাবে) প্রকাশ করে থাকে, ততোক্ষণ যেনো সে বর্ণনা করে।” দ্বিতীয় হাদীসটি ফরমায়: “আমি নিষেধ করিনি তা (মানে হুবহু বর্ণনা), বরং স্রেফ এই কারণে (করেছি) যে কেউ আমি যা বলিনি তা আমি বলেছি মর্মে মিথ্যে দাবি করে বসে, আর তার উদ্দেশ্য হয় আমাকে শরমিন্দায় ফেলা এবং ইসলামকে খাটো করা, বা আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করে ইসলামকে শরম দেয়া।” এটা যথাক্রমে বর্ণিত হয়েছে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) ও অজ্ঞাতনামা এক সাহাবী হতে আল-খতীব কৃত ‘আল-কেফা’য়া’ বইয়ে (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৩৪-২৩৫ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ১৯৮ পৃষ্ঠা)। হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা:) হতে বর্ণিত: “মহানবী (দ:)’কে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যিনি বাক্যের বিন্যাস পরিবর্তন করেন (হাদীসের বর্ণনাকালে)। হুযূর করীম (দ:) উত্তর দেন: ‘যতোক্ষণ সে অর্খ তুলে ধরতে সক্ষম, ততোক্ষণ এতে কোনো ক্ষতি নেই’।” এটা আল-হাকিম আল-তিরমিযী (রহ:) তাঁর ‘নওয়া’দির আল-উসূল’ পুস্তকে উদ্ধৃত করেন (৩৮৯ পৃষ্ঠা)। অতএব, সহীহ অাল-বুখারী (কিতাবুল এলম) গ্রন্থে উদ্ধৃত হযরত সালামা ইবনে আল-আকওয়া (রা:) কর্তৃক ব্যাপকভাবে বর্ণিত (মোতাওয়াতের) হাদীস - “আমি যা বলিনি তা যে ব্যক্তি উচ্চারণ করে, সে যেনো জাহান্নামের আগুনে বসতির জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়” মর্মে সতর্কবাণীটিকে অবশ্যঅবশ্য অন্যান্য ওই সব (ওপরে উদ্ধৃত) হাদীসের আলোকে উপলব্ধি করতে হবে। এটা আল-যাবীদী বর্ণিত সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীদের বক্তব্য এবং আল-হাকিম আত্ তিরমিযী কৃত ‘নওয়া’দির আল-উসূল’ পুস্তকে (৩৮৯-৩৯০ পৃষ্ঠা, আসল #২৬৮) ব্যক্ত সালাফবৃন্দের আচরিত প্রথা দ্বারা সমর্থিত; যেমনটি পুরোপিুরিভাবে উদ্ধৃত হয়েছে আল-ক্বা’সেমী’র রচিত ‘ক্বাওয়াইদ আল-তাহদীস’ (২২৩-২২৪ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে। আর আল্লাহতা’লাই সবচেয়ে ভালো জানেন]। এই ব্যাপারে যখন ইমাম আল-হাসান (রা:)’এর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি বলেন: “এটা যদি না হতো, তাহলে আমরা কোনো কিছুই বর্ণনা করতাম না” [নোট-২৯: আল-খতীব প্রণীত ‘আল-জামে’ (২:২১-২২ #১১০০) ও ‘আল-কেফা’য়া’ (মদীনা সংস্করণ, ২০৭ পৃষ্ঠা]। 

ইমাম শাফেঈ [নোট-৩০: ‘আল-রেসা’লা’, ২৭৪ পৃষ্ঠা] এই বিষয়ের পক্ষে নিজ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন নিম্নোক্ত হাদীসখানা: “ক্বুরআন মজীদ প্রকাশিত হয়েছে সাতটি স্থানিক বাচনে” [নোট-৩১: সর্ব-হযরত উমর (রা:) ও ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আল-বুখারী (রহ:), মুসলিম (রহ:) ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:); এছাড়াও ‘সুনান’ পুস্তকে হযরত উবাই ইবনে কা’আব (রা:) হতে বর্ণিত]

আল-বায়হাক্বী (রহ:) বর্ণনা করেন মাখূল হতে, যিনি বলেন যে তিনি ও আবূ আল-আযহার দেখা করতে গিয়েছিলেন হযরত ওয়া’সিলা ইবনে আল-আসক্বা (রা:)’র সাথে; তাঁকে তাঁরা বলেন: “মহানবী (দ:)’র এমন একটি হাদীস আমাদের কাছে বর্ণনা করুন যার মধ্যে নেই কোনো বিয়োজন, সংযোজন ও বিস্মৃত অংশ।” তিনি উত্তর দেন: “তোমাদের কেউ কি ক্বুরআন মজীদ হতে কোনো কিছু তেলাওয়াত করেছো?” তাঁরা বলেন: “জি, কিন্তু আমরা তা খুব ভালোভাবে হেফয্ তথা মুখস্থ করিনি। আমরা কখনো কখনো ‘এবং’ অথবা ‘আলিফ’ অক্ষরটি যোগ করি, কিংবা কোনো কিছু বিয়োজন করে ফেলি।” তিনি উত্তরে বলেন: “তোমরা যদি তোমাদের সামনে লিপিবদ্ধ ক্বুরআন-ই মুখস্থ করতে না পারো, আর তাতে সংযোজন বা বিয়োজন করে থাকো, তাহলে মহানবী (দ:) হতে আমাদের শ্রুত আহাদীসের বেলায় কী হতে পারে, যার কোনো কোনোটি আবার স্রেফ একবার শুনেছিলাম? অতএব, আমরা যখনই সেগুলো তোমাদের কাছে বর্ণনা করি, তখন সেগুলোর সাধারণ অর্থ গ্রহণেই তোমরা সন্তুষ্ট থেকো” [নোট-৩২: আল-খতীব কর্তৃক ‘আল-জামে’ (২:২০-২১ #১০৯৮) ও ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ ২৩৯ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ ২০৪ পৃষ্ঠা) গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত; তিনি ক্বুতায়বা (রা:) হতেও অনুরূপ কিছু বর্ণনা করেছেন। হা’কিম তিরমিযী’র কৃত ‘নওয়া’দিরুল উসূল’ (৩৮৯ পৃষ্ঠা) সংস্করণে মাখূল জিজ্ঞেস করেন: “আপনাদের কেউ কি রাতে দীর্ঘ নামাযে দণ্ডায়মান হয়েছিলেন?”]! ইমাম বায়হাক্বী ‘আল-মাদখাল’ পুস্তকে হযরত জা’বের ইবনে আবদিল্লাহ (রা:) হতেও অনুরূপ কিছু বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “হুযায়ফা (রা:) আমাদের বলেন, ‘আমরা হলাম বেদুঈন আরব; আমরা যথাযথ ক্রম ব্যতিরেকেই কোনো বাণী উদ্ধৃত করতে পারি’।” আল-বায়হাক্বী আরো বর্ণনা করেন শু’য়াইব ইবনে আল-হাজ্জা’ব হতে, যিনি বলেন: আমি আবদানকে সাথে নিয়ে ইমাম আল-হাসান (রা:)’এর সাথে দেখা করতে যাই। আমরা তাঁকে বলি: ‘হে আবূ সাঈদ! কেউ হয়তো এমন কোনো হাদীস বর্ণনা করতে পারেন, যার মধ্যে তিনি কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করেছেন।’ তিনি উত্তর দেন: ‘মিথ্যে হলো যখন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এটাকে উদ্দেশ্য করে’” [নোট-৩৩: আল-খতীব প্রণীত ‘আল-কেফা’য়া’ (১৯৮৬ সংস্করণ, ২৪৪ পৃষ্ঠা; মদীনা সংস্করণ, ২০৮ পৃষ্ঠা]। {তিনি এ ছাড়াও অনুরূপ কিছু বর্ণনা গ্রহণ করেন হতে ইবরাহীম আল-নাখাঈ [নোট-৩৪: দেখুন নোট-১৬], আল-শা’বী [নোট-৩৫: দেখুুন নোট-১৬], আল-যুহরী [নোট-৩৬: আল-খতীব, ‘আল-জামে’, ২:২২ #১১০৩], সুফিয়া’ন [নোট-৩৭: আল-খতীব, ‘আল-জামে’, ২:২৩ #১১০৪-১১০৬], আমর ইবনে দীনা’র [নোট-৩৮: দেখুন নোট-১৬] এবং ওয়াকী [নোট-৩৯: এছাড়াও আল-হাম্মা’দ ইবনে যায়দ, যেমনটি বর্ণনা করেছেন আল-খতীব নিজ ‘আল-জামে’ পুস্তকে (২:২৩-২৪ #১১০৭; তবে বর্ণনাসমূহ ইঙ্গিত করে যে ইমাম মালেক (রহ:)’এর মতো ওয়াকী-ও ‘আল-রিওয়া’য়া বিল-লাফয’কে বারণ করেছিলেন এবং সুনির্দিষ্ট মূল কথার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন; মিলিয়ে দেখুন নোট-১৬]}। [নোট-৪০: অাল-যাবীদী রচিত ‘এসা’ফ আল-সা’আদত আল-মুত্তাক্বীন’, ১:৪৮-৪৯]   

মুহাদ্দেসীন উলামাবৃন্দ ‘অর্থের ভিত্তিতে বর্ণনা’ গ্রহণের ব্যাপারে সর্বসম্মতি পোষণ করেন, তবে শর্ত স্রেফ এই যে আরবীতে বর্ণনাকারীর দক্ষতা থাকতে হবে এবং অন্যান্য শর্তের মাঝে এ-ও শর্ত থাকবে যে তাঁর বিবরণে যেনো কোনো বিচ্যুতি কিংবা শুযূয/ভুলভ্রান্তি না থাকে [নোট-৪১: এতর কৃত ‘মানহাজ আল-নাক্বদ’ ২২৭-২৩০ পৃষ্ঠা]। প্রিয়নবী (দ:)’র আহাদীস/বাণী হুবহু বর্ণনার পরিবর্তে সেগুলোর অর্থগত বর্ণনা জায়েয/বৈধ মর্মে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-উলামার
মতামতকে সপ্রমাণকারী আল-যাবীদীর মতো একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন ইবনে আল-সালাহ-ও নিজ ‘মুক্বাদ্দামা’ গ্রন্থে; তবে তিনি তা ফিরিয়ে নেন এই কারণে যে এ প্রয়োগ-পদ্ধতি আর বর্তমান সময়ে প্রযোজ্য নয়, কেননা সমস্ত হাদীস-ই এখন বইপত্রে পাওয়া যাচ্ছে [নোট-৪২: ইবনে আল-সালা’হ, ‘উলূম আল-হাদীস’, ২১৪ পৃষ্ঠা]। শায়খ নূর আল-দ্বীন ’এতর শেষোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে বলেন: “এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, স্রেফ অর্থের ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনাকে (আজকে) নিষেধ করতে হবে, কেননা সমস্ত বর্ণনা হাদীসগ্রন্থগুলোতে সংকলন করা হয়েছে, যা দ্বারা ওই প্রয়োগ-পদ্ধতি অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে [নোট-৪৩: নূর অাল-দ্বীন ’এতর সম্পাদিত ইবনে হাজরের ‘শরহু আল-নুখবা নুযহাত আল-নাযার ফী তাওদিহ নুখবাত আল-ফিকার’, (৯৫ পৃষ্ঠা, নং-১); মিলিয়ে দেখুন আল-ক্বাসেমী’র ‘ক্বাওয়াঈদ আল-তাহদিস্ (২২৩-২২৫ পৃষ্ঠা) এবং তা’হির আল-জাযা’ইরী কৃত ‘তাওজিহ আল-নাযার’ (২৯৮-৩১২ পৃষ্ঠা)]

ইমাম গাজ্জালী (রহ:)’র বেসালপ্রাপ্তির মাত্র কয়েকদিন আগে ৫০৩ হিজরী সালের শুরুতে মুরা’বিত সুলতান (স্পেনের মুসলিম রাজা) অালী ইবনে ইঊসুফ ইবনে তা’শফীন (ইমাম গাজ্জালীর) ‘এহইয়া’ গ্রন্থটিকে কর্ডোবার ক্বা’জী আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হামদাইন (মৃত্যু: ৫০৮ হিজরী) ও অন্যান্য ফক্বীহ উলামার সর্বসম্মত রায় অনুযায়ী কর্ডোবায় পুড়িয়ে ফেলেন। ইবনে আল-ক্বাত্তা’ন আল-মার্রাকেশী (বেসাল: ৬৪৮ হিজরী) নিজ ’নুযূম আল-জুমা’ন’ পুস্তকে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেন এবং আরো যোগ করেন: “ওই গণ্ডমূর্খের দল কর্তৃক এই অতুলনীয় মহান গ্রন্থখানি পোড়ানো তাদের শাসনের ইতি, পতন ও মূলোৎপাটনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়” [নোট-৪৪: ইবনে অাল-ক্বাত্তা’ন, ‘নুযূম আল-জুমা’ন, ৭০-৭২ পৃষ্ঠা]। কপট লোকেরা অবশ্য ওই বই থেকে তাঁর কোনো উদ্ধৃতি দেয়ার সময় এ কথা যে তিনি বলেছিলেন, তা সযত্নে এড়িয়ে যায়! ইবনে আল-ক্বাত্তা’ন এবং অন্যান্য উলামা আরো বর্ণনা করেন যে বাগদাদে ইবনে তূমা’র্তের উপস্থিতিতে [নোট-৪৫: উদ্ধৃত পুস্তকের ৭৩ পৃষ্ঠা; আল-হিলা’ল আল-মূশিয়া’, ১০৪-১০৫ পৃষ্ঠা; এবং আল-ওয়ানশারীসী কৃত ‘আল-মিয়্যা’র আল-মু’আর্রাব, ১২:১৮৫] ইমাম গাজ্জালী (রহ:) হাত উত্তোলন করে জালিমদের শাসনের পতন কামনা করে দোয়া করেন, যখনই তাদের (বই পোড়ানোর) দুষ্কর্মের সংবাদটি তাঁর কাছে পৌঁছে। এর অল্প কিছু কাল পরেই মরক্কোবাসী মুসলমানবৃন্দ বইটির পুনঃপ্রচলন করেন, যেমনটি বিবৃত করেছেন শায়খুল ইসলাম তক্বীউদ্দীন আল-সুবকী (রহ:) তাঁরই দীর্ঘ এক কবিতায় যার সূচনা হয়েছে এ কথা দ্বারা - “আবূ হা’মিদ! আপনি সত্যি সে (সৎ) জন, যিনি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য” [নোট-৪৬: ‘তাবাক্বা’ত আল-শা’ফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৪]

ইবনে আল-সুবকী নিজ এসনাদে বর্ণনা করেন ইমাম আবূল হাসান শা’যিলী (রহ:) হতে এই মর্মে যে, ইবনে হিরযাহম নামের জনৈক মরোক্কীয় শায়খ ‘এহইয়া’ পুস্তকটি পোড়ানোর ইচ্ছা করেছিলেন; এমতাবস্থায় তিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)’কে স্বপ্নে দেখেন, যিনি ইমাম গাজ্জালী (রহ:)’র সামনে বইটির প্রশংসা করেন এবং ইবনে হিরযাহম’কে কুৎসা রটনার দায়ে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন। পাঁচটি আঘাতের পরে তাঁকে ক্ষমা করা হয় এবং তিনি জেগে ওঠে বেত্রাঘাতের চিহ্নস্বরূপ (শরীরে) ব্যথা অনুভব করেন। অতঃপর তিনি (’এহইয়া’) বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।[নোট-৪৭: ‘তাবাক্বা’ত আল-শাফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৮-২৬০]   

’এহইয়া’ গ্রন্থটির সমালোচকদের আরেকটি হৈচৈয়ের বিষয় হলো, এতে জ্বেহাদের প্রসঙ্গে কোনো উপদেশ নিহিত নেই; আর এর লেখক (ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহে আলাইহে) ৪৮৮-৪৯৯ হিজরী সালে নির্জনবাসে ছিলেন; এটা ঠিক এমনি এক সময়ে ঘটেছিলো যখন ক্রুসেডার বাহিনী এনটিওক ও আল-কুদস্ বিধ্বস্ত করেছিলো এবং সহস্র সহস্র মুসলমানকে করেছিলো শহীদ। এই সমালোচকেরা ভুলে যান যে আল-ক্বুরআনে বিধৃত বৃহত্তর জ্বেহাদের (আল-জ্বিহা’দ আল-আকবর) মৌলিক মর্মবাণী হলো, যারা ধর্মকে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রথমতঃ এবং সর্বাগ্রে ক্বুরআনকে সাথে নিয়ে সংগ্রাম করা:

فَلاَ تُطِعِ ٱلْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُمْ بِهِ جِهَاداً كَبيراً

অর্থ: “সুতরাং তুমি কাফেরদের কথা মান্য কোরো না এবং এ ক্বুরআনের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জ্বিহাদ করো - বড় জ্বিহাদ” (আল-ক্বুরআন, ২৫:৫২)। ড: ইঊসুফ কারাযা‘ভী সমালোচকদের এসব কটাক্ষের জবাবে বলেন:

মহান ইমাম গাজ্জালী (রহ:)’র ওজর হতে পারে এই যে, তাঁর সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিলো সর্বপ্রথমে তাঁর নিজের সত্তার পরিশুদ্ধি লাভ করা; কেননা কারো ব্যক্তিগত দুর্নীতি-ই বাহ্যিক দূষণের পথ খুলে দেয়, যেমনটি ইঙ্গিত করা হয়েছে সূরা ইসরা’র প্রারম্ভে। ইসরাঈলী জাতি যখনই দুর্নীতিগ্রস্ত হতো এবং দুনিয়ার বুকে দুর্নীতি ছড়াতো, তৎক্ষণাৎ তাদের ওপর তাদের শত্রুরা আধিপত্য বিস্তার করতো। আবার যখনই তারা ভালো কাজ করতো এবং নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করতো, অমনি তারা তাদের শত্রুদের ওপর আধিপত্য ফিরে পেতো। ব্যক্তিসত্তা যা সমাজের মর্মবস্তু গঠন করে থাকে, তার পরিশুদ্ধির প্রতি ইমাম গাজ্জালী (রহ:) সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন। কোনো ব্যক্তির পরিশুদ্ধি কেবল তার অন্তর ও চিন্তা-মননের পরিশুদ্ধি দ্বারাই অর্জন করা সম্ভব। স্রেফ ওই পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই তার কর্ম ও আচরণ এবং তার গোটা জীবন উন্নত করা সম্ভব। এটাই সামাজিক পরিবর্তনের ভিত্তি, যার প্রতি আল-ক্বুরঅান আমাদেরকে পরিচালিত করে এই ঘোষণা দ্বারা:

  إِنَّ ٱللَّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ

অর্থাৎ, “নিশ্চয় আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তাঁর নেআমতের পরিবর্তন করেন না যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে না” (আল-ক্বুরআন, ১৩:১১)। [নোট-৪৮: আল-ক্বারাযা’ভী প্রণীত ‘আল-ইমা’ম আল-গাজ্জা’লী, ১৭৪ পৃষ্ঠা] 

ওপরে প্রদত্ত বক্তব্যের চেয়েও স্পষ্টভাষী কথা হলো হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:)’র, যাঁকে কিছু লোক জিজ্ঞেস করেছিলো কেন তিনি তাঁর সময়কার দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেননি। তিনি উত্তরে বলেন: “কেননা তারা ইসলামের বাধ্যবাধকতামূলক বিষয়গুলোতে শিথিল বা সেগুলোর অবহেলাকারী” [নোট-৪৯: আল-যাহাবী কর্তৃক নিজ ‘সিয়্যার’ (৭:২০৩) পুস্তকে আল-খুরায়বী হতে উদ্ধৃত]। ইমাম গাজ্জালী (রহ:) স্বয়ং বলেন: “ওযা’য তথা উপদেশের বেলায় আমি নিজেকে এর জন্যে যোগ্য বিবেচনা করি না। কেননা ওয়া’য-নসীহত (উপদেশ) হচ্ছে এক সংশোধন বা পরিশুদ্ধিমূলক কর (যাকা’ত), যার নিসা’ব তথা ন্যূনতম করারোপ-অযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ হলো ‘আল-এত্তে’আয (মানে আত্মোপদেশ)। যে ব্যক্তির কোনো ন্যূনতম করারোপ-অযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ-ই নেই, তিনি আবার তাঁর কর পরিশোধ করবেন কীভাবে? গাছ যদি বাঁকা হয়, তাহলে তার ছায়া কি সরল বা সোজা হবে?” [নোট-৫০: ইবনে আল-মুলাক্কিন কৃত ‘তাবাক্বা’ত আল-আউলিয়া, ১০৪ পৃষ্ঠা] 

এছাড়া আরো স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, ইমাম গাযযালী (রহ:) তাঁর সময়কার মুসলমানদের অধঃপতিত অবস্থার ব্যাপারে নিজেই গভীরভাবে সম্পৃক্ত ও চিন্তিত ছিলেন, যা তাঁর রচিত ‘আল-মুনক্বিয মিনাদ্ দালা’ল’ (ভ্রষ্টতা হতে মুক্তি) পুস্তকের শেষে তিনি আপন ভাষায় ব্যক্ত করেন; নিচে তা উদ্ধৃত করা হলো:

আমি যখন দেখলাম নানা ধরনের মানুষের ঈমান-আক্বীদা সবচেয়ে দুর্বল পর্যায়ে পৌঁছেছে....তখন আমার আত্মা পুরোপুরিভাবে এই ত্রুটির মূল কারণ খোঁজার কাজে প্রবৃত্ত হয়। এমতাবস্থায় এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ করাটা আমার জন্যে পানি পানের চেয়েও সহজতর হয়ে যায়; কেননা আমি তাদের জ্ঞান-বিদ্যা ও পথ সম্পর্কে গভীরভাবে পরিচিত। আমি এখানে বোঝাচ্ছি সূফী-দরবেশবৃন্দ, দার্শনিকবর্গ, আল-তা’লীমিয়্যা তথা বিদ্বান/পণ্ডিত ও সেসব লোক যারা আলেম-উলামা’র বাহ্যিক চিহ্ন বহন করেন। আমি নিশ্চিত হলাম যে এটা (মানে এই দুর্বলতা) নির্দিষ্টভাবে আমাদের যুগেরই এক অবধারিত/অনিবার্য (বাস্তব) পরিস্থিতি। এই অবস্থায় নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা ও নির্জন-বাস (আল-খালওয়া ওয়াল-’উযলা) করাতে আপনাদের কী ফায়দা হবে, যেখানে সংক্রমণ এতোই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে চিকিৎসকরা নিজেরাই অসুস্থ এবং মানবজাতি ধ্বংসের উপক্রম? অতঃপর আমি নিজেকে বল্লাম: তুমি কবে এই মসীবত অপসারণে ও মহা অন্ধকার মোকাবেলায় তোমাকে নিয়োজিত করবে? কিন্তু এ তো হলো দুর্বল মুহূর্ত, যখন মিথ্যের রাজত্ব বহাল। তুমি মানুষদেরকে তাদের মিথ্যে পথগুলো হতে সত্যের দিকে আহ্বান করলে তারা সবাই তোমার বিরোধিতা করবে। তুমি কীভাবে তাদের মোকাবেলা করবে, আবার একই সময়ে তাদের সাথে একত্রে বসবাস করবে? এটা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হতে পারে না, শুধুমাত্র কোনো শুভক্ষণ ও ক্ষমতাবান সুলতান ব্যতিরেকে।

অতঃপর ইমাম গাজ্জালী (রহ:) ‘খালওয়া’য় অবস্থান করেন যতোক্ষণ না তিনি ওই ধরনের সুলতানের আলামত দেখতে পান; এর পরপর-ই তিনি বেরিয়ে আসেন এবং তাঁকে (সুলতানকে) পরামর্শ দিতে যান।

শায়খ তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:) ‘এহইয়া’ গ্রন্থের নিন্দুকদের সম্পর্কে বলেন:

আমি তাদেরকে ধার্মিক ও একান্ত অনুরক্ত মানুষদের একটি দলের মতো বিবেচনা করি [নোট-৫১: তবে বর্তমানের নিন্দুকবর্গ আগের দিনের ‘ধার্মিক ও একান্ত অনুরক্ত’ নয়, বরঞ্চ অলস নিরর্থক শয়তানী কর্মকাণ্ড ও অনুপকারী জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত, আর এই জগতের ময়লা জঞ্জালের জন্যে লালায়িত], যারা মুসলমানদের সারির মধ্যে কোনো মহান যোদ্ধার আবির্ভাব ও তাঁদের শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁর রণমূর্তি দেখেছেন এবং প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর দ্বারা শত্রুদের পরাস্তকরণ ও ধ্বংসসাধন। অতঃপর শত্রুদের রক্ত-মাখা অবস্থায় তিনি বিজয়ীর বেশে নিজেকে ধুয়ে পরিষ্কার হয়েছেন, আর মুসলমানদের সাথে এবাদতগাহে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু ওই দলটি ভেবেছে তাঁর গায়ে তখনো শত্রুদের কিছু রক্ত লেগে আছে, আর তাই তারা এর জন্যে তাঁর সমালোচনামুখর হয়েছে। [নোট-৫২: ‘তাবাক্বা’ত আল-শাফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৪]

তাঁর (ইমাম সুবকীর) পুত্র ইবনে আল-সুবকী বলেন:

এই বইটি (এহইয়া) সেসব বইয়ের সারিতে অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোর প্রতি মুসলমানদের যত্ন নেয়া উচিত এবং যেগুলোর প্রচার-প্রসার করা উচিত এমনিভাবে যাতে প্রচুর মানুষ তা পড়ে হেদায়াত পান। এই বইটি পড়ে এর কল্যাণে তৎক্ষণাৎ জাগ্রত না হওয়ার ঘটনা বিরল। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে সত্যপথে পরিচালিত হবার অন্তর্দৃষ্টি মঞ্জুর করুন এবং সত্য ও আমাদের মাঝে পর্দাস্বরূপ যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তা হতে আমাদের রক্ষা করুন। [নোট-৫৩: ‘তাবাক্বা’ত আল-শা’ফিয়্যা আল-কুবরা’, ৬:২৫৩]    

’এহইয়া’ গ্রন্থখানির সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাখ্যামূলক বইগুলোর মধ্যে রয়েছে:

* মুহাদ্দীস মুরতদা আল-যাবীদী’র ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘এতহা’ফ আল-সাআদাত আল-মুত্তাক্বীন শরহ এহইয়া উলূম আল-দ্বীন’ (খোদভীরু তাপসদের অকাতর দান: আল-গাজ্জালী’র রচিত ধর্মীয় জ্ঞানের পুনরুজ্জীবন সংক্রান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ’), যা’তে অাল-গাজ্জালী (রহ:)’র উদ্ধৃত হাদীসগুলোর সামগ্রিক দলিলাদি সপ্রমাণ করা হয়েছে। {ইরাক্বী ওহাবী মাহমূদ শুকরী আলূসী (মৃত্যু: ১৩৪২ হিজরী)’র কুৎসা দ্বারা আপনারা প্রতারিত হবেন না। কেননা এই লোক একই নামের অধিকারী ক্বুরঅান-তাফসীরকারক মাহমূদ আলূসী, যিনি নিজ ‘রূহুল মা’আনী’ তাফসীরগ্রন্থ লিখতে ‘এহইয়া’র ওপর নির্ভর করেছেন, তিনি নন।}

* আবদুল ক্বা’দির ইবনে আবদিল্লাহ আল-’আয়দারূস্ বা’ আলাউয়ী প্রণীত ‘তা’রীফ আল-আহএয়া’ বি-ফাদা’ইল আল-এয়াহইয়া’ (এহইয়া পুস্তকের জীবন্ত মহা-কল্যাণের মূল্যায়ন)।

* মোল্লা আলী ক্বা’রী লিখিত ‘শরহ আইন আল-এলম ওয়া যাইন আল-হিলম’ (জ্ঞানের ঝর্না ও সৌন্দর্য-অলঙ্করণের উপলব্ধি) যা (এহইয়া’র) সংস্কৃত কপির ওপর লেখা। আলী ক্বারী সূচনায় লেখেন:

আমি এই ব্যাখ্যামূলক বই লিখেছি এহইয়া পুস্তকের সংস্কৃত কপির ওপর, ইসলামের প্রামাণিকতা ও সৃষ্টিকুলের (বিদ্বানদের) প্রত্যয়নের ভিত্তিতেই; তা এই আশায় যে খোদাজ্ঞানীদের বাণী হতে প্রবাহিত কিছু আশীর্বাদের প্রাপক হতে আমি সক্ষম হবো, অার মাশায়েখ ও দরবেশমণ্ডলীর (বইয়ের) পাতাগুলো হতে যে উপহার ঝরে পড়ে তা দ্বারাও লাভবান হবো, যাতে আমাকে তাঁদের সংখ্যা মাঝে উল্লেখ করা হয় এবং তাঁদেরই সমাবেশে পুনরুত্থিত করা হয়; যদিও তাঁদের অনুসরণে ও খেদমতে আমার ঘাটতি বিদ্যমান। কেননা আমি তাঁদের প্রতি আমার ভালোবাসার ওপরই নির্ভর করি এবং তাঁদেরই সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষী হই। [নোট-৫৪: আল-ক্বা’রী রচিত ‘শরহু আইন আল-’এলম’, ১:১]

আল্লাহতা’লা ইমাম গাজ্জালী (রহ:)’র প্রতি করুণাশীল হোন এবং তাঁকে সকল গুণে গুণান্বিত করুন যার সমালোচনায় মুখর তাঁর নিন্দুকবর্গ এবং সেসব লোক, যাদেরকে শয়তান ব্যস্ত রেখেছে আল্লাহর আউলিয়া (রহ:)’র কুৎসা রটনায়; কেননা তারা একেবারে বেহায়া-নির্লজ্জ।

                                           *সমাপ্ত*   


         

Saturday, 19 May 2018

মহানবী (দ:) আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন

- কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


মহানবী (দ:)-কে আমাদের মতো মানুষ প্রমাণ করতে ওহাবীরা যে আয়াতখানা ব্যবহার করে তার সঠিক ব্যাখ্যা তারা দেয় না। এরশাদ হয়েছে,  قُلْ إِنَّمَآ أَنَاْ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ ‘কুল ইন্নামা আনা বাশারুম্ মিসলুকুম’ (সূরা কাহাফ, ১১০ আয়াত)। অর্থাৎ, ”(হে রাসূল - দ:) বলুন, নিশ্চয় আমি তোমাদেরই উপমায় মানব সুরতসম্পন্ন।” আরবী ‘মিসাল’ (উপমা) শব্দটি ব্যবহার করে আল্লাহতা’লা কথার মাঝে হেকমত বা রহস্য রেখে দিয়েছেন! মিসাল বা তুলনা দেয়া হয় দুটো সত্তার মাঝে কোনো সার্বিক গুণ বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে। যেমন - যায়দের সাহস বাঘের মতো। কিন্তু যায়দ ও বাঘ একই ধরনের সত্তা বা জাত নয়। এমতাবস্থায় উক্ত আয়াতে ’মিসাল’ ব্যবহার করাটা আল্লাহতা’লার মহা গূঢ় রহস্য বলে সাব্যস্ত হয়। আমরা মুসলমান সর্বসাধারণকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করার আহ্বান জানাই। কেননা, আয়াতের শেষাংশে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পার্থক্যকারী জাতী সিফাত তথা সত্তাগত গুণ বর্ণনা করা হয়েছে - ‘আমার কাছে ওহী আসে’ (যা তোমাদের কাছে আসে না)। বুখারী শরীফে একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে: “তোমাদের মধ্যে কে আছ আমার মতো?” অর্থাৎ, তিনি কোনোক্রমেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন। এখন মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আরবীতে বলা হয় হাইওয়ানে নাতেক, যার বাংলা হলো বাক্ তথা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী (Man is a rational animal)। এই জাতী সিফাত দ্বারাই আমরা গরু, গাধা, মোষ, উট ইত্যাদি প্রাণী থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কেউ যদি এই জাতী সিফাতকে না মেনে মানুষকে প্রাণীকুলের সাথে একই কাতারবদ্ধ করে, তাহলে তাকে আমরা গণ্ডমূর্খ ছাড়া আর কিছু বলবো না। মহানবী (দ:)-এর রেসালতের সত্তাগত গুণকে যারা অস্বীকার করে তাঁকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাতারবদ্ধ করে, তাদের বেলায়ও একই সূত্র কার্যকর হবে। তাই সহীহ আকীদা হলো, তিনি আমাদের রাসূল, নূরনবী (দ:)। মানুষ বল্লে কুরআনী রায়ের বিরোধিতা হবে, যেমনটি এরশাদ হয়েছে -  يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَرْفَعُوۤاْ أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ ٱلنَّبِيِّ وَلاَ تَجْهَرُواْ لَهُ بِٱلْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لاَ تَشْعُرُونَ “তোমরা একে অপরকে যেভাবে ডেকে থাকো, সেভাবে মহানবী (দ:)-কে ডাকবে না।”(সূরা হুজুরাত, ২য় আয়াত)