Thursday, 26 September 2019

ইবনে জারীর তাবারী (রহ:) রচিত কারবালার ইতিহাস ও শিয়াচক্রের স্ক্রীনশট ধোঁকাবাজি



এডমিন/বঙ্গানুবাদকের আরয

[আহলে বাইত ও আসহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি শীর্ষক বই প্রসঙ্গে]

সম্প্রতি তুরস্কের আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশীক্ব (রহ:)’এর রচিত ও আমার অনূদিত “আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি” পুস্তকটি সম্পর্কে ফেইসবুকে কতিপয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী আপত্তি তুলেছেন। তারা এতে উদ্ধৃত তুর্কী ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার লিখিত “ক্বাসাসুল আম্বিয়া (আ:)” শীর্ষক ইতিহাসগ্রন্থের বক্তব্য এবং পারসিক ইতিহাসবিদদের প্রণীত ইতিহাসবিষয়ক বইপত্রের ভাষ্যের সূত্র ধরে কারবালার ঘটনায় এয়াযীদের দায় নাকি আলোচ্য বইয়ে অস্বীকার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন, যা একেবারেই ভিত্তিহীন। ইতিহাসবিদবৃন্দ এয়াযীদকে দায়মুক্তি দেননি। ফেইসবুকে পুরোটুকু উদ্ধৃত না করে অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কিয়দংশ উদ্ধৃত করা গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। তাই আমি ইসলামী প্রাথমিক যুগের (প্রায় ১২ শ বছর আগের) নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ:) বিরচিত “তাওয়ারিখ” (ইতিহাস) গ্রন্থটি হতে এতদসংক্রান্ত উদ্ধৃতি পেশ করে দেখাবো, আলোচ্য বইয়ে যা আলোচনা করা হয়েছে তা পূর্ববর্তী সময়ের অন্যান্য ইতিহাসবিদও আলোকপাত করেছেন। বিবরণগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আমার নোট/টীকা পেশ করা হবে, ইনশা’আল্লাহ। এখানে উল্লেখ্য যে, কারবালার ময়দানে অসম ও একতরফা যুদ্ধের বিবরণটি আমি দিতে না চাইলেও প্রামাণ্য দলিলের খাতিরে দিতে বাধ্য হলাম। এর জন্যে আমি দুঃখিত ও ব্যথিত।  (‘তাওয়ারিখ’ ১৯তম খণ্ড, এয়াযীদ ইবনে মুআবিয়ার খেলাফত, ১৬৮-১৭৩ পৃষ্ঠা; ইউনেস্কোর অর্থায়নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের অনূদিত ইংরেজি সংস্করণ)

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ১

হিশাম বিন মুহাম্মদ কালবী বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ ইবনে এয়াযীদ ইবনে রাওহ ইবনে যিম্বা’ আল-জুযা’মী হতে, তিনি তাঁর পিতা হিমইয়ার অঞ্চলের আল-গা’য বিন রাবীয়াহ আল-জুরাশী হতে, যিনি বলেন:

আল্লাহর কসম! আমি দামেশকে এয়াযীদ ইবনে মুআবিয়া’র সাথে অবস্থান করছিলাম, যখন যাহর বিন ক্বায়স এয়াযীদের সাথে দেখা করতে আসে। এয়াযীদ বলে, “তোমার জন্যে আফসোস! তুমি পেছনে কী রেখে এসেছো? আর কী নিয়ে এসেছো?” সে উত্তর দেয়, “হে আমীরুল মো’মেনীন! আমি আল্লাহতা’লার বিজয় ও সাহায্যের সুখবর নিয়ে এসেছি। হুসাইন ইবনে আলী (রা:) তাঁর ঘরের ১৮ জন ও শীআ’ (সহায়তাকারী) ৬০ জনকে সাথে নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে এসেছিলেন। আমরা তাঁদেরকে মোকাবেলা করতে অগ্রসর হই এবং তাঁদেরকে হয় আত্মসমর্পণ করে গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের আনুগত্য স্বীকার করতে, না হয় যুদ্ধ করতে বলি। তাঁরা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে যুদ্ধকে বেছে নেন। সূর্যোদয়ের সময় আমরা তাঁদেরকে আক্রমণ করি এবং চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলি। অবশেষে আমাদের তরবারি ওই সব মানুষের শিরের ওপরে জয়ী হতে থাকে, আর তাঁরা কোনো আশ্রয় ছাড়াই পালাতে থাকেন। তাঁরা পাহাড় ও গর্তে গিয়ে আমাদের থেকে আশ্রয় নেন ঠিক ঘুঘু পাখির মতোই, যা বাজপাখি হতে আশ্রয় খোঁজে। আল্লাহর নামে শপথ! হে ঈমানদারদের অধিপতি, এ ছিলো প্রাণি হত্যার সময়, অথবা কোনো ব্যক্তির জন্যে قيلولة (ক্বায়লূলাহ) তথা দুপুরের হাল্কা নিদ্রাসম, যতোক্ষণ না আমরা তাঁদের শেষজন অবধি পৌঁছে যাই। সেখানেই পড়ে ছিলো তাঁদের বিবস্ত্র দেহ, রক্তমাখা জামাকাপড়, তাঁদের মুখগুলো ধূলিতে নিক্ষিপ্ত। সূর্য তাঁদের ওপর তাপ ছড়াচ্ছিলো; বায়ু তাঁদের (দেহের ওপর) বালু ছিটাচ্ছিলো; এই বিরাণ ও নির্জন এলাকায় তাঁদের অতিথি হয়েছিলো ঈগল ও শকুনের দল।” এয়াযীদের দু চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে এবং সে বলে, “আমি তোমার বাধ্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতাম, যদি আল-হুসাইন (রা:)’কে হত্যা ছাড়া তা হতো। ইবনে সুমাইয়াহ (গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ)’এর প্রতি আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত! আল্লাহর কসম! আমি যদি তাঁর (আল-হুসাইনের) সাথে থাকতাম (ওই সময়), তাহলে আমি তাঁকে ছেড়ে দিতাম। আল্লাহ যেনো আল-হুসাইনের প্রতি করুণা করেন।” অতঃপর এয়াযীদ ওই বার্তাবাহককে কিছুই দেয়নি। [বঙ্গানুবাদকের নোট: লক্ষ্য করুন যে, ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার ইতিহাসগ্রন্থেও অনুরূপ বিবরণ বিধৃত হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ:)’র স্রেফ এই উদ্ধৃতিটুকু স্বার্থ হাসিলের জন্যে বাছাই করে সহজেই অপবাদ দেয়া যায় যে এখানে এয়াযীদকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসল চিত্র জানার জন্যে তো বাকি অংশ পড়া দরকার! বস্তুতঃ ফেইসবুকে এভাবেই ধোকাবাজি করা হয়েছে। বি:দ্র: এটা এয়াযীদের অভিনয় হতে পারে। সে ছিলো একজন পলিটিশিয়ান।]

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ২

আবূ মিখনাফ বর্ণনা করেন আল-সাক্বা’ব বিন যুহায়র হতে, তিনি এয়াযীদের জনৈক গোলাম আল-ক্বা’সিম বিন আবদ আল-রাহমান হতে, যিনি বলেন:

ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর পরিবার এবং অনুসারীদের (কর্তিত) শির (মোবারক) যখন এয়াযীদের সামনে রাখা হলো, তখন সে আবৃত্তি করলো:

“(তরবারি) বিচ্ছিন্ন করেছে মানুষের শির যাঁরা আমাদের প্রিয়,
কিন্তু তাঁরা ছিলেন অবাধ্য ও অসহনীয়।” [ভাবানুবাদ]

(অতঃপর সে আরো বলে), “তথাপিও, হে হুসাইন, আপনার সাথে যদি আমায় যুঝতে হতো, তাহলে আমি আপনাকে হত্যা করতাম না।” [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদের কবিতায় দাম্ভিকতা প্রকাশ পেয়েছে]

আবূ মিখনাফ বর্ণনা করেন আবূ জা’ফর আল-আবসী হতে, তিনি আবূ উমা’রাহ আল-আবসী হতে, যিনি বলেন: মারওয়া’ন বিন আল-হাকামের ভাই এয়াইয়া বিন আল-হাকাম আবৃত্তি করে:

“সমভূমিতে শিরগুলো ছিলো আত্মীয়তায় ইবনে যিয়াদের চেয়েও ঘনিষ্ঠ,
যে ছিলো এক গোলাম এবং যার বংশপরিচয় ছিলো দুষ্ট,
উমাইয়া সন্তানের সংখ্যা এখন নুড়িপাথরের মতো অগণিত,
অথচ নবী-নন্দিনী আপন সন্তান হতে হয়েছেন বঞ্চিত।” [ভাবানুবাদ]

এতদশ্রবণে এয়াযীদ নিজ হাত দ্বারা এয়াহইয়া বিন আল-হাকামের বুকে আঘাত করে চিৎকার করে বলে, “চুপ থাকো!” [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদ নিজের তোয়াজ পছন্দ করেনি। অথবা, এটাও তার পলিটিক্যাল চাল হতে পারে। কেননা তার সভাসদদের সামনেই এই ঘটনা ঘটেছিলো]

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৩

এয়াযীদ একটি সভা ডেকে সিরীয় গণ্যমান্যদের তার চারপাশে বসায়। এরপর সে হযরত আলী ইবনে আল-হুসাইন ওরফে ইমাম যাইনুল আবেদীন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে এবং শহীদ হযরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর পরিবারের নারী ও শিশুদেরকে সেখানে এনে বসতে দেয়, আর মানুষেরা তা অবলোকন করেন। এয়াযীদ হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে বলে, “আলী, তোমার বাবা (মানে ইমাম হুসাইন) আমার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছিলেন, আমার অধিকারের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন এবং আমার কর্তৃত্ব হতে আমাকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে এর প্রতিদান দিয়েছেন যা তুমি প্রত্যক্ষ করেছো।” হযরত আলী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) উত্তর দেন:

مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي ٱلأَرْضِ وَلاَ فِيۤ أَنفُسِكُمْ إِلاَّ فِي كِتَٰبٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ

অর্থ: পৌঁছে না কোনো মুসীবত পৃথিবীতে এবং না তোমাদের নিজেদের প্রাণগুলোতে, কিন্তু তা একটা কিতাবের (মানে লওহে মাহফূযের) মধ্যে রয়েছে, এরই পূর্বে যে সেটাকে আমি সৃষ্টি করি। [আল-ক্বুরআন, ৫৭:২২; নূরুল এরফান]

এমতাবস্থায় এয়াযীদ আপন পুত্র খালিদকে এর প্রতি জবাব দেবার জন্যে তাকিদ দেয়। কিন্তু খালিদ কী উত্তর দেবে তা তার জানা ছিলো না। তাই এয়াযীদ বলে:

 وَمَآ أَصَـٰبَكُمْ مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُواْ عَن كَثِيرٍ

অর্থ: এবং তোমাদেরকে যে মুসীবত স্পর্শ করেছে তা তারই কারণে, যা তোমাদের হাতগুলো উপার্জন করেছে এবং বহু কিছু তো তিনি (আল্লাহ) ক্ষমা করে দেন। [আল-ক্বুরআন, ৪২:৩০; নূরুল এরফান]

এতে হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে) চুপ হয়ে যান। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এখানে এয়াযীদের মনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। তার ক্ষমতার প্রতি লোভ ছিলো। হযরত ইমাম (রা:)’এর প্রতি অন্তরে যে ক্ষোভ ছিলো, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। কোনো ঈমানদার-ই এরকম ক্ষোভ লালন করতে পারেন না। তবে এয়াযীদ ক্বুরআন-হাদীস যে পড়তো, তা তার প্রত্যুত্তরে বোঝা যায়]

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৪

এয়াযীদ মহিলা ও শিশুদেরকে সামনে বসতে দেয়। সে এক ভয়ঙ্কর ও অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখতে পায়। সে বলে, “ইবনে মারজানা’র (মানে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের) প্রতি আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত! আপনাদের সাথে যদি তার কোনো আত্মীয়তা থাকতো, তাহলে সে আপনাদের সাথে এরকম (আচরণ) করতে পারতো না; এখানে আপনাদেরকে পাঠাতো না।”

মিখনাফ বর্ণনা করেন আল-হা’রিস বিন কা’আব হতে, তিনি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কন্যা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে; তিনি বলেন: “আমাদেরকে যখন এয়াযীদের সামনে বসানো হয়, সে আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে; আমাদের জন্যে বিভিন্ন জিনিস আদেশ করে এবং আমাদের প্রতি সদয় হয়। এমতাবস্থায় এক লাল বর্ণের চেহারাবিশিষ্ট সিরীয় লোক এয়াযীদের সামনে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, ‘হে আমিরুল মো’মেনীন, একে আমায় দিন।’ সে আমাকে বুঝিয়েছিলো। আমি ছিলাম এক সুন্দরী তরুণী। (এতদশ্রবণে) ভয়ে আমি কম্পমান হয়ে দূরে সরে যাই, কেননা আমি ভেবেছিলাম তাকে এর অনুমতি বুঝি দেয়া হবে। আমার বোন যায়নাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) জামা ধরি আমি। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং আমার চেয়ে বুদ্ধিমতিও। তিনি বলেন এটা হবে না। সিরীয় লোকটিকে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তুমি একটা মিথ্যুক! আল্লাহর শপথ! তুমি নিচু বংশজাত! এ তোমার জন্যে নয়, তার (মানে এয়াযীদের) জন্যেও নয়।’ এয়াযীদ রাগে চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহর শপথ! আপনি-ই (বরঞ্চ) মিথ্যুক! সে আমার জন্যেই। আমি যদি চাই, আমি তা করতে পারি।’ যায়নাব (রা:) প্রত্যুত্তর দেন, ‘আল্লাহর শপথ! না, আল্লাহ তোমায় তা করতে দেবেন শুধু তখনি, যখন তুমি আমাদের ধর্মত্যাগ করবে এবং অন্য ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ এয়াযীদ রাগে চিৎকার করে বলে, ‘আপনি আমায় মোকাবেলা করার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন? আপনার পিতা-ই তো ধর্মত্যাগ করেছিলেন এবং আপনার ভাই-ও।’ যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তুমি, তোমার পিতা ও দাদা আল্লাহতা’লার দ্বীন দ্বারা হেদায়াতপ্রাপ্ত তথা সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছো, যে দ্বীন আমার বাবার, আমার ভাইয়ের এবং আমার দাদার।’ এয়াযীদ চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহর দুশমন, আপনি মিথ্যে বলছেন!’ এমতাবস্থায় যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) উত্তর দেন, ‘তুমি একজন নেতা, যার এরকম (বড়) কর্তৃত্ব রয়েছে, অথচ তুমি অন্যায়ভাবে অপবাদ দিচ্ছো এবং তোমার কর্তৃত্ব দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে শাসন করছো।’ আল্লাহর কসম! এতদশ্রবণে সে যেনো লজ্জিত হয়ে যায় এবং নিশ্চুপ হয়। ওই সিরীয় লোকটি পুনরায় বলে, ‘হে আমিরুল মোমেনীন, আমায় ওই তরুণীকে দিন।’ এয়াযীদ তাকে বলে, ‘দূর হও! আল্লাহ তোমার বিনাশ সাধন করুন’!”

অতঃপর এয়াযীদ বলে, “আল-নু’মান আল-বশীর, এঁদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস/সাজ-সরঞ্জাম দ্বারা এঁদেরকে সাজিয়ে দাও এবং এঁদের সাথে একজন উত্তম সিরীয় ব্যক্তিকে প্রেরণ করো। তার সাথে অশ্বারোহীদের ও খেদমতকারীদেরও পাঠাও, যাতে সে তাঁদেরকে মদীনায় নিয়ে যেতে পারে।” এরপর সে মহিলাদেরকে একটি পৃথক/নিরিবিলি গৃহে বসবাসের জন্যে (সেবকদের প্রতি) আদেশ করে। তাঁদের সাথে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস সে প্রেরণ করে। তাঁদের ভাই হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)-ও সেই গৃহে অবস্থান করেন। তাঁরা ওই গৃহ হতে বের হয়ে এয়াযীদের ঘরে গেলে হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বংশের এমন কোনো নারী-ই আর বাকি ছিলেন না, যিনি ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র জন্যে কান্নারত অবস্থা ছাড়া তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তা্ঁরা ওই আহাজারি তিন দিনব্যাপী করেছিলেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এই ঘটনায়ও এয়াযীদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। তবে হযরত ইমাম (রা:) পরিবারসদস্যের কড়া প্রতিবাদের মুখে সে নিরুত্তর হয়ে যায়। তবু একটা দিক এখানে লক্ষণীয় যে, ওই পুতঃপবিত্র পরিবারের নারীদেরকে সে হেনস্থা হতে দেয়নি। আর এটাই তার বাবা হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র দেয়া শিক্ষাদীক্ষা ছিলো, যা সে সর্বময় ক্ষমতা পেয়েও লঙ্ঘন করতে পারেনি] 

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে এয়াযীদের প্রাসাদ - ৫

হযরত আলী বিন হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে আমন্ত্রণ ছাড়া এয়াযীদ কখনোই দুপুরের বা রাতের খাবার গ্রহণ করেনি। একদিন সে তাঁকে এবং আমর ইবনে হাসান ইবনে আলী তথা আলীর পুত্র হাসান, তাঁর পুত্র আমর (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে আমন্ত্রণ করে; ওই সময় আমর (রহ:) ছোট্ট বালক ছিলেন। এয়াযীদ তাঁকে বলে, “তুমি কি এই বালকের (মানে তার পুত্র খালিদের) সাথে লড়াই করবে?” আমর (রহমতুল্লাহে আলাইহে) প্রত্যুত্তর দেন, “না। তবে তাকে একটা ছুরি দিন আর আমাকেও একটা ছুরি দিন; তাহলে আমি তার সাথে লড়বো।” এয়াযীদ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে এবং এরপর বলে, “এটাই সেই আচরণ যা আমি চিনি (তার) বাবার কাছ থেকে। সাপের ঘরে কি সাপ ছাড়া অন্য কিছু পয়দা হয়?” যখন তাঁরা (দামেশ্ক) ছেড়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হন, তখন এয়াযীদ হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কে ডেকে বলে, “আল্লাহর লা’নত/অভিসম্পাত ইবনে মারজানাহ’র (মানে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের) প্রতি! আমি যদি তোমার বাবার সাথে থাকতাম, তাহলে তাঁর কোনো অনুরোধই আমি পূরণ না করে থাকতাম না; আমি তাঁকে আমার সর্বশক্তি দিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতাম, এমন কী যদি তাতে আমার নিজের কিছু সন্তানেরও প্রাণহানি ঘটতো। কিন্তু আল্লাহতা’লা (এটাই) ডিক্রি করেছেন যা তুমি প্রত্যক্ষ করেছো। মদীনা হতে আমাকে পত্র লেখো এবং যা যা প্রয়োজন জানিয়ো।” সে তাঁদেরকে জামাকাপড় উপহার দেয় এবং ওই (বিশ্বস্ত) খেদমতগারের দায়িত্বে অর্পণ করে। তিনি তাঁদের সাথে যাত্রা করেন। রাতে সফরকালে তাঁরা তাঁর সামনে থাকতেন, কিন্তু দৃষ্টির বাইরে নয়। তাঁরা থামলে তিনি তাঁদের থেকে এক পাশে চলে যেতেন। তিনি ও তাঁর সহকারীবৃন্দ তাঁদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেন প্রহরী দলের মতো; তিনি এমন-ই এক অবস্থানে থাকতেন, যাতে কেউ গোসল বা প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার সময় কোনো রকম লজ্জাবোধ না করেন। তাঁদের কোনো কিছু প্রয়োজন হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতে তিনি কখনোই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি তাঁদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করেন মদীনা পর্যন্ত গোটা ওই সফরে।

হা’রিস্ বিন কাআব বর্ণনা করেন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’র কন্যা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে, যিনি বলেন: আমি আমার (বড়) বোন যায়নাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে বলি, “বোন, এই সিরীয় লোকটি (মানে এয়াযীদ) আমাদের সাথে সদাচরণ করেছে! আপনি কি মনে করেন না আমাদের পক্ষ থেকে তাকে উপহার দেয়া উচিৎ?” তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহর শপথ! আমাদের কাছে তো কিছুই নেই আমাদের গহনা ছাড়া।” আমি বলি, “চলুন, আমাদের গহনা-ই তাকে উপহারস্বরূপ দেই।” অতঃপর আমি আমার বালা ও বাহুবন্ধ এবং তিনি তাঁর বালা ও বাহুবন্ধ নিয়ে এয়াযীদকে উপহারস্বরূপ দিতে চাই। আমরা তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলি, “আমাদের সাথে যে সদাচরণ করেছো, এগুলো তোমার প্রতি তারই পুরস্কার।” সে উত্তর দেয়, “আমি যা করেছি তা যদি স্রেফ পার্থিব সম্পদের খাতিরে হতো, তাহলে আপনাদের গহনার মাঝে থাকতো সন্তুষ্টি এবং তার চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু, আল্লাহর কসম, আমি এটা করেছি শুধু আল্লাহর খাতিরে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে আপনাদের (আত্মীয়তার) সম্পর্কের খাতিরেই।”

[বঙ্গানুবাদকের নোট: এয়াযীদের এই আচরণটি ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ:) ছাড়াও আরো অনেক ইতিহাসবিদ নিজেদের বইপত্রে আলোকপাত করেছেন (ইবনে ক্বাসীর কৃত বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া দ্রষ্টব্য)। ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাহাদাতের দায়দায়িত্ব সে গ্রহণ করতে চায়নি, বরং ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদেরই প্রতি তা বারবার আরোপ করেছে। আমাদের বিশ্লেষণে এয়াযীদ দায়ী এ কারণে যে, তার শাসনামলেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিলো। কিন্তু সে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলো কি না, তা প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদদের ইতিহাসে স্পষ্ট নয়। এই কারণে ইমামবৃন্দের মধ্যে তার কুফরীর ব্যাপারে পারস্পরিক ভিন্নমত বিদ্যমান। সবাই তার ফাসিক্ব হওয়ার ব্যাপারে একমত, কিন্তু কাফির কি না, সে বিষয়ে তাঁরা একমত নন। ইমামবৃন্দ দুটো মতে বিভক্ত হয়ে পড়লে আমাদের জন্যে তৃতীয় কোনো (নিজস্ব মনগড়া) মত গ্রহণের অবকাশ নেই। এখানে ধর্মতত্ত্বীয় সেই বিষয়টির গভীরে আমরা যাবো না; আমাদের ফোকাস কেবল ইতিহাসের দিকে। তুরস্কের আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:) বিরচিত ও আমার অনূদিত ‘আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি’ শীর্ষক বইটি সম্পর্কে ফেইসবুকে আপত্তির কারণেই ইতিহাসের পাতা হতে এই অনুবাদের অবতারণা হয়েছে। বইটির লেখক উসমানীয় তুর্কী আমলের ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার ‘ক্বাসাসুল আম্বিয়া’ হতে অনুরূপ বৃত্তান্তের উদ্ধৃতি দানশেষে বলেন, “কারণ যা-ই হোক না কেন, এমন কী এয়াযীদ-ও এই হীন বর্বরতার দায়দায়িত্ব নিতে চায়নি। সে ইবনে যিয়াদকে এ জঘন্য কর্মের জন্যে অভিসম্পাত দিয়েছিলো। এয়াযীদের এ অপরাধ যতোই গুরুতর হোক, তার এ অপরাধের জন্যে তার বাবা হযরত আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে দায়ী করার অপচেষ্টা একই পর্যায়ের অন্যায় হবে” (আহলে বায়ত ও আসহাবের প্রতি ভক্তিতে মুক্তি, ১৩৩ পৃষ্ঠা)। অতএব, তিনিও উক্ত পুস্তকে এয়াযীদকে দায়মুক্তি দেননি] 

*অতিরিক্ত তথ্য*
*আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’ শীর্ষক বইটি সম্পর্কে বিভ্রান্তি নিরসন*
ফেইসবুকার যাঁরা উপরোক্ত বইটির স্ক্রীনশট-সহকারে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকর পোষ্টের ধোকায় পড়ে গিয়েছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি - এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। আসলে বইটির লেখক আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:) উসমানীয় তুর্কী ইতিহাসবিদ আহমদ জওদাত পাশার ’ক্বাসাসুল আম্বিয়া’ গ্রন্থের রেফারেন্স এখানে দেন নি, বরং দেওবন্দী ওহাবী মাসলাকের হাফেয হাকিম আবদুশ শাকূর এলাহী মীর্যাপুরী (পাকিস্তান)’এর ‘শাহাদাতে হুসাইন (রা:)’ শিরোনামের বই থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন। আমার স্ক্যানকৃত কপির গোটা উদ্ধৃতি-ই ওই দেওবন্দী মৌলভীর, আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ;)’এর বক্তব্য নয়। আমি হাইলাইটার দ্বারা চিহ্নিত করে দিয়েছি। পাকিস্তানী ওই দেওবন্দী আলেমের উর্দূ/ফার্সী বইটি কারো কাছে থাকলে ১১ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার স্ক্যানকৃত কপিতে দেওবন্দী মৌলভী সাহেবের উদ্ধৃতি ১৩৪ পৃষ্ঠা থেকে আরম্ভ হয়ে ১৩৮ পৃষ্ঠার শেষে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। বলা বাহুল্য, দেওবন্দী বইটিতে অনেক শিয়া বইপত্রের রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। সংযুক্ত স্ক্যানকৃত ছবি দেখুন -







*অনূদিত বইয়ের সমালোচনার ব্যাপারে একান্ত ভাবনা*
জনৈক শিয়াপন্থী মৌলভী কর্তৃক তুর্কী আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:)’এর রচিত ও আমার অনূদিত ‘আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি’ শীর্ষক বইয়ের কিছু উদ্ধৃতির ব্যাপারে কয়েকটি স্ক্রীনশট-সম্বলিত একটি হিংসাত্মক পোষ্টের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আমার কয়েকজন ফেইসবুক বন্ধু। ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর লেখা বইটির ব্যাপারে আমি ইতোমধ্যে দুটো পোষ্ট দিয়েছি এবং প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদ ইমামবৃন্দের অনুরূপ লেখনীও উদ্ধৃত করেছি। ইতিহাস লেখা আরম্ভই হয়েছে উমাইয়া-শাসনবিরোধী আব্বাসীয় শাসনামলে। তারপরও ইমামবৃন্দ সত্য প্রকাশে কার্পণ্য করেন নি। সর্ব-ইমাম ইবনে জারীর তাবারী, ইবনে ইসহাক্ব, আবূ ইসহাক্ব প্রমুখের বইপত্রে এসব ঘটনা কম-বেশি আলোকপাত করা হয়। পরবর্তী যুগের ইবনে কাসীর, ইবনে জাওযী প্রমুখও তা তুলে ধরেন।
এখানে আমি অতো বিস্তারিত বিবরণে যাবো না। আগামীতে আল্লামা হুসাইন হিলমী তুর্কী (রহ:)’এর প্রণীত ‘আশীর্বাদধন্য সাহাবা কেরাম (রা:)’ শিরোনামের বইটির অনুবাদের সময় বিস্তারিত আলোকপাত করা যাবে, ইনশা’আল্লাহ।
কোনো ঐতিহাসিক বিষয়ের ওপর লেখা গবেষণামূলক বইয়ের ক্রিটিক তথা গবেষণামূলক সমালোচনা ফেইসবুকে কয়েকটি স্কীনশট সহকারে ফালতু পোষ্ট দিয়ে করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, বাতিল শিয়া মতবাদের দোসরদের কৃত এ সব কর্মকাণ্ড একেবারেই ঠুনকো ও জ্ঞান-পরিপন্থী। ফেইসবুকে যারা এ ধরনের কাজে লিপ্ত, তারা গবেষণাধর্মী সমালোচনা সম্পর্কে ভীষণ অজ্ঞ। ওই ধরনের সমালোচনা (ক্রিটিক) লিখতে পুরো বইটিকে আলোচনায় আনতে হয়; এর ভালো দিক ও সমালোচনার দিকগুলোও পর্যালোচনায় আসে। আফসোস, সে ধরনের কোনো কিছু ফেইসবুকে স্ক্রীনশট কারবারিরা প্রদর্শন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তারা শুধু বইয়ের মাঝখান থেকে আগামাথা নেই এমন কিছু অংশ তুলে ধরে বিভ্রান্তি ছড়াতেই ওস্তাদ।
অপপ্রচারকারীদের চামচারা ফেইসবুকের মন্তব্য ফোরামে এসে বিজ্ঞের মতো অনেক কিছু লিখে। কিন্তু সর্বসাধারণের তো এ বিষয়টি সম্পর্কে জানার কথা নয়। তাঁরা এ ধরনের বিষয়গুলোতে নিজেদের মতামত না দেয়াই উচিৎ। তাঁদের বোঝা উচিৎ, ফেইসবুকে স্ক্রীনশট কারবারিরা পানি ঘোলা করতেই অপতৎপর। তাই এ ধরনের গবেষণাবিহীন হিংসাত্মক পোষ্টের পেছনে ছুটা সাধারণ মানুষের পক্ষে একদম অনুচিৎ। শিয়া এজেন্ডাওয়ালা ফেইসবুকারবর্গ আমার অনূদিত ইতিহাসভিত্তিক ‘আহলে বাইত ও আসহাব (রা.)-এর প্রতি ভক্তিতে মুক্তি’ (৩০ সেপটেম্বর ২০১৭, সাঞ্জেরী পাবলিকেশন) শীর্ষক বইটিতে বারংবার ইসলামী আকীদা ও ফতোয়ার খোঁজ করে। কিন্তু তারা যেটা তালগোল পাকিয়ে ফেলে তা হলো, ঐতিহাসিকবৃন্দ ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনা করেন, যেটা স্রেফ ইভেন্ট বা ঘটনা (বি: দ্র: ইতিহাস গ্রহণ বা বর্জন মানুষের ইচ্ছাধীন। আকীদার নিরিখে পছন্দ হলে গ্রহণ করবেন, পছন্দ না হলে বর্জন করবেন। কিন্তু ঐতিহাসিকদের বর্ণিত ঘটনার ব্যাপারে খোদ-মাতব্বরীপূর্ণ নোট দেবেন কোন্ বিদ্যার বলে? বানিয়ে বানিয়ে ইতিহাস লেখা যায় কি?)। ওর মধ্যে আকীদাহ ও ফতোয়া খোঁজা যায় না। তা পেতে হলে খুঁজতে হবে ইসলামী আকীদার কিতাবে, ইতিহাসগ্রন্থে নয়। দ্বিতীয়তঃ ২০১৯ সালের শেষভাগে যখন প্রথমবার ফেইসবুকে আমার অনূদিত বইটি নিয়ে পারসিক শিয়াদের এদেশীয় এজেন্টগুলো হৈচৈ বাধিয়েছিলো, তখন আমি সবেমাত্র ‘গাদীরে খুম’-বিষয়ক আরেকটি শিয়া-বিরোধী বই অনুবাদ করে পর্ব-ওয়ারী ফেইসবুকে পোষ্ট করছিলাম। সেই আন্তর্জাতিক বইটি সম্পর্কে পারস্যদেশীয় শিয়াচক্র জানতো বিধায় তাদের ওই চেলাদেরকে আমার অনুবাদে বিঘ্ন ঘটাবার অসৎ উদ্দেশ্যে এই স্ক্রীনশট ধোঁকাবাজিপূর্ণ ফেইসবুক পোষ্ট করতে লেলিয়ে দেয়। ফলে একযোগে ‘হুক্কা হুয়া’ রবে সব শিয়া’ল ফেইসবুক গরম করে তোলে। আমি যেহেতু নতুন অনুবাদে মনোনিবিষ্ট ছিলাম, তাই ফেইসবুকের মন্তব্য ফোরামে এসব অ-একাডেমিক বকলম-বাহাদুরদের চিৎকার-চেঁচামেচি বন্ধ করার লক্ষ্যে সবাইকে ব্লক করে দেই। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো। এখনো এই মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করছি। কেননা ফেইসবুকের মন্তব্য ফোরামে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, তা গবেষণামূলক নয়, বরং এজেন্ডাকেন্দ্রিক। প্রকৃত গবেষণা করেছেন সুন্নী আলেম-উলামা। তাই তাঁদের লেখনী ভাষান্তরে ব্যস্ত আমি। ২০১৭ সালে সাঞ্জেরী পাবলিকেশনের প্রকাশিত বই নিয়ে শিয়াচক্র হৈচৈ করেছে ২ বছর পরে অর্থাৎ ২০১৯ সালের শেষভাগে। এতোদিন চুপ করে বসেছিলো। যখনই গাদীরে খুম বইটির অনুবাদকর্ম শুরু করলাম, অমনি ‘হুক্কা হুয়া’ রব তুল্লো শিয়া’ল দল! এটাই বাস্তবতা। বর্তমানে দরবার-দরগাহগুলোতে পারস্যের পেট্রো-ডলারের জোরে শিয়া মতবাদে দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তারা টার্গেট করছে তরীকতপন্থীদের। অসাবধান তরীকতপন্থীরা, বিশেষ করে বিভিন্ন দরবারের অনেক বকলম-বাহাদুর আওলাদ শিয়াদের এ ফাঁদে পা দিচ্ছে। কেবল অর্থলোভ নয়, মোত’আ বেশ্যা নারীর লোভ দেখিয়েও বাতীলপন্থীরা ফাঁদ পেতেছে।
এই পরিস্থিতিতে আমরা দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, অনুগ্রহ করে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুণ্ডি করে যে শিয়া পেট্রো-ডলার আসছে এবং বিভিন্ন দরবারের লোকদের ও মৌ-লোভীদের কাছে যাচ্ছে, সেদিকে নজরদারি বাড়ান এবং ব্যবস্থা নিন। এটা বন্ধ করতে পারলে এক মুহূর্তে শিয়া মতবাদের এই মোহ কেটে যাবে।
শেষ কথা হলো, স্ক্রীনশট-কারবারিদের প্রতি আমার চ্যালেঞ্জ: আমার অনূদিত বইয়ের ক্রিটিক লেখার ও প্রকাশ করার সামর্থ্য থাকলে তা করুন! দেখা যাবে কতোখানি জ্ঞানী আপনারা! আমার বই বাজারে আছে। সানজেরী পাবলিকেশন চট্টগ্রাম থেকে তা ছেপেছে, আর সারা দেশে তা প্রসার লাভ করেছে। শিয়াচক্র ছাড়া কেউই উচ্চবাচ্য করেন নি। বস্তুতঃ শিয়াদের গাত্রদাহের কারণ এ বইটি। তারা অনুবাদককে আক্রমণ করছে, অথচ মূল ইতিহাসবিদ এবং মূল লেখককে কিছুই বলছে না। তারা জানে মুসলিম বিশ্বে এ বই গৃহীত। তারা কেন এ বইয়ের মূল প্রকাশক তুরস্কের হাক্বীক্বত কিতাবেভীর কাছে অভিযোগ দিচ্ছে না? আমি তো স্রেফ এর অনুবাদক মাত্র! মূল জায়গায় আপত্তি উত্থাপনের মুরদ নেই, এসেছে এখানে বাহাদুরি ফলাতে! তবে চূড়ান্তভাবে ইয়াযীদের ব্যাপারে ধর্মীয় (সুন্নী) দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলনকারী আমার অনূদিত বইটি ২০২১ সালে ‘ফাদাক বাগান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। ওতে ‘ইয়াযীদ সম্পর্কে আহলুস্ সুন্নাহর সিদ্ধান্ত’ অধ্যায়টি সবাই পড়ে দেখুন।

লিঙ্ক: আরবী সংস্করণ পিডিএফ ১৬টি ফাইল: https://archive.org/details/tarikhislam-tabari;
উর্দূ সংস্করণ পিডিএফ ৭টি ফাইল: https://archive.org/details/Tareekh-e-Tabri-Urdu;



   

Sunday, 1 September 2019

‘মুসলমান সমাজ শির্কে লিপ্ত হবে না’ মর্মে হাদীসের বিশ্লেষণ


 - এডমিন

আলোচ্য হাদীসটি সম্পর্কে শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদীর ভাই শায়খ সুলাইমান ইবনে আবদিল ওয়াহহাব সাহেব নিজের লিখিত ‘আস্ সাওয়াইকুল ইলাহিয়্যা’ পুস্তকে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা আমার অনূদিত তুর্কী ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ বইটিতে (২৩ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠায়) সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে বাংলায় অনূদিত বইয়ে প্রকাশক সাঞ্জেরী পাবলিকেশন ওই হাদীসের অনুরূপ আরেকটি হাদীসের এবারত নক্বল করেন, যা হয়তো পাঠকের জন্যে পূর্ণ অর্থজ্ঞাপক না-ও হতে পারে। এ কারণেই আমি এখানে আমার বিশ্লেষণ পেশ করছি। তবে শায়খ সুলাইমানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখার জন্যে এখানে বইয়ের স্ক্যানকৃত কপিও যুক্ত করা হয়েছে।

হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে লিপিবদ্ধ। এবারত - عن عقبة بن عامر ان النبى صلى الله عليه وسلم صعد المنبر فقال اني لست اخشى عليكم ان تشركوا بعدي ولكن اخشى عليكم الدنيا ان تنفسوا فيها فتقتلوا فتهلكوا كما هلك من كان قبلكم - অর্থ: “আমার বেসালের (খোদার সাথে পরলোকে মিলিত হবার) পরে তোমাদের মুশরিক (মূর্তিপূজারী) হবার ব্যাপারে আমি শঙ্কিত নই; আমি আশঙ্কা করি যে তোমরা দুনিয়াবী স্বার্থে একে অপরকে হত্যা করবে এবং ফলশ্রুতিতে পূর্ববর্তী গোত্রগুলোর মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।” লক্ষণীয় যে, বর্ণনাকারী হযরত উক্ববা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) শেষবারের মতো নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে মিম্বরে আরোহণ করতে দেখেছিলেন। অতএব, এটা তাঁর হায়াতে জিন্দেগীর সায়াহ্নে হবে। [শায়খ সুলাইমানের বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত যা আরবী বইয়ের স্ক্যানকৃত পৃষ্ঠায় দৃশ্যমান]

আলোচ্য হাদীসে সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) মুরাদ/উদ্দেশ্য নন। কেননা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) অন্যত্র বলেছেন তাঁর ও তাঁর সাহাবাবৃন্দের (রা:) জমানা-ই সেরা। অতঃপর সেরা তাবেঈনমণ্ডলীর সময়কাল; তাঁদের পরে সেরা তাবে’ তাবেঈনবৃন্দের যুগ। বুখারী শরীফে লিপিবদ্ধ হাদীসটির এবারত নিম্নরূপ - خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ - (সহীহ বুখারী ২৬৫২; বই - ৫২, হাদীস - ১৬)

অতএব, হানাহানি ও ধ্বংস ওই আলোকোজ্জ্বল জমানায় আসতে পারে না - শেষোক্ত হাদীসের বাণী মোতাবেক। আমি জানি না কতিপয় আলেম কীভাবে, কিসের ভিত্তিতে সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে আলোচ্য হাদীসের উদ্দেশ্য মনে করলেন! অধিকন্তু, হুজূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মিম্বরে উঠেই উম্মতের ভবিষ্যতের ঘটনাবলী বর্ণনা করতেন। তাই এটা শেষ জমানা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত বলেই সাব্যস্ত হয়। আল্লাহ-ই ভালো জানেন।

[বি:দ্র: প্রথমে শায়খ সুলাইমানের বইয়ের স্ক্যানকৃত কপি এবং শেষে বঙ্গানুবাদের কপি পেশ করা হয়েছে]


*আরবীতে যাঁরা শায়খ সুলাইমানের বইটি পড়তে চান, তাঁদের জন্যে পিডিএফ ডাউনলোড লিঙ্ক: http://www.hakikatkitabevi.net/book.php?bookCode=151
** ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ বইটির বঙ্গানুবাদ যাঁরা পড়তে চান, তাঁদের জন্যে পিডিএফ ডাউনলোড লিঙ্ক: https://drive.google.com/file/d/1GhD_dqjRFnirNmbP2V40UmCG4TUT4koW/view?usp=drive_link

বিস্তারিত ব্যাখ্যা: এতদসংক্রান্ত হাদীসগুলোকে একত্রে নিয়ে বৃহত্তর চিত্র পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মুসলমান সমাজ দুনিয়াবী স্বার্থে পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হবার আশঙ্কা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সাহাবা কেরাম (রা:)’বৃন্দের যুগে হবে বলে ব্যক্ত করেন নি। এটা একমাত্র শেষ জমানাতেই সম্ভব, যখন মুসলমানরা লোভী হয়ে গেছে। ’দুনিয়াবী স্বার্থে পরস্পর হানাহানিতে ধ্বংসের আশঙ্কা’ প্রকাশক হাদীসের বাণী কোনোক্রমেই সাহাবা কেরাম (রা:)’কে উদ্দেশ্য করে না, বরং শেষ জমানার মুসলমান প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে। অপর হাদীসের এবারতে এই বিষয়টি খোলাসা হয় না। তাই বৃহত্তর চিত্রের জন্যে আমার উদ্ধৃত হাদীসটি বিবেচনায় আনতেই হবে। কেননা মুসলমান সমাজ শির্ক (আকবর)-এ লিপ্ত হবে না বলে উভয় হাদীসেই বলা হয়েছে। অধিকন্তু, তাবেঈ ও তাবে’ তাবেঈ (রা:)’মণ্ডলী সেরা সময়ের প্রজন্ম বলে আমার উদ্ধৃত হাদীসে বলা হয়েছে। তাঁরা তো সাহাবা কেরাম (রা:)’এর প্রজন্ম নন! আসলে না বুঝলে যা হয় আর কী! মহানবী (দ;)’এর ওই ভবিষ্যদ্বাণী তিনি মিম্বরে আরোহণ করে উচ্চারণ করেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণতঃ তিনি ক্বেয়ামতের আগে উম্মতের ভাগ্যে যা যা ঘটবে, তা-ই মিম্বরে উঠে বর্ণনা করতেন। ড: জি, এফ, হাদ্দাদ রচিত ও আমার অনূদিত ‘মহানবী (দ:)’এর অদৃশ্য জ্ঞান’ বইটি ভালোভাবে পড়লে এই বিভ্রান্তি হতো না।

সবার জ্ঞাতার্থে: বর্তমানে “মাযার-দরগাহ পূজারী” বলে যে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে, তা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস দ্বারা সমূলে রদ! মুসলমানদের প্রতি এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করা দুশমনে ইসলাম বৃটিশের দুরভিসন্ধি। এ অপবাদ নতুন নয়, বরং ইংরেজ পক্ষীয় আরবের নজদ অঞ্চলের মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাবই সর্বপ্রথম এটা চালু করে। তার এদেশীয় চামচারা যেনো সব শিয়ালের এক রা - মানে তাকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলেছে।

Sunday, 12 May 2019

ইফতার একটি নিখুঁত ইবাদত


 ইমরান বিন বদরী 
══◉◉══

নাহ'মাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মা বা’দ। 

ইফতার (إفطار ) শব্দটি আরবী ‘ফুতুর’ শব্দ থেকে। ইফতার শব্দের অর্থ বিরতি, ভঙ্গ করা বা দিন ও রাতের মধ্যবর্তী সময়ের হালকা খাবার গ্রহণ। শরিয়তের পরিভাষায় সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর রোজা সমাপ্তির জন্য পানাহার করাকে ইফতার বলা হয়। রোজা বা সাওম পালনে ইফতারের ফজিলত অপরিসীম এবং রোজাদারদের জন্য সময়মতো ইফতার করার মধ্যে রয়েছে অশেষ সওয়াব ও কল্যাণ।

মাহে রমজান মুসলিম সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এ মাসের কারণে মানুষ ক্ষুধা ও তৃষ্ণার জ্বালা বুঝতে পারে। এ অনুভূতির ফলে এক মুমিনের হৃদয় ধাবিত হয় অন্য মুমিনের সুখ-দুঃখের খবর সন্ধানে। যার বাস্তব রূপ প্রকাশ পায় রমজানের ইফতারের মাধ্যমে।

🔰রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, রমজান মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহগুলো মাফ হয়ে যাবে। সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে আর সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে, কিন্তু এতে রোজাদারের সওয়াব থেকে কিছুই ঘাটতি হবে না। অর্থাৎ, রোজাদারের সওয়াব কমবে না। এ রকম সওয়াব আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তিকে দেবেন, যে শুধু এক পেয়ালা দুধ অথবা একটি খেজুর বা সামান্য পরিমাণ পানি দ্বারা হলেও কাউকে ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তি মিটিয়ে খাওয়াবে, আল্লাহ তাকে হাউজে কাওসার থেকে এমন শরবত পান করাবেন, যার দরুন সে কখনও তৃষিত হবে না। এভাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বায়হাকী)

 তবে যে ইফতার মাহফিলে ইফতারের পর মাগরিবের নামাজের স্থলে এশার নামাজের সময় চলে আসে, সে ইফতার মাহফিল জানিনা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে কতোটুকু গ্রহণযোগ্য। রাজকীয়ভাবে ইফতার না করে ইফতারের পরপর মাগরিবের নামাজের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। সুন্নাতের পর ফরজ আদায় করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। সম্প্রতি ইফতারকে কেন্দ্র করে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ও ভোজনবিলাসিতা লক্ষ্য করা যায়। ইফতার শুধু খাওয়ার নাম নয়, বরং একটি নিখুঁত ইবাদত।

এ ইবাদতকে রাজনৈতিক কর্মসূচির মতো পালন করা মুসলমানদের জন্যে খুবই দুঃখজনক। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সঙ্গে সেহরি ও ইফতার গ্রহণ করতেন। সময় হওয়া মাত্রই তিনি দেরি না করে ইফতার করতেন। নাসাঈ শরীফের এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে:

🔈 হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আনাস, আমি রোজা রাখতে আগ্রহী, আমাকে আহার করাও।’ আমি তাঁর সামনে কিছু শুকনো খেজুর ও পাত্রে পানি রাখলাম। (হজরত) বেলালের প্রথম আজানের পর তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন।” তিনি কয়েকটি ভেজা খেজুর দিয়ে ইফতার সেরে নিতেন। ভেজা খেজুর না থাকলে সাধারণ শুকনো খেজুরই গ্রহণ করতেন। এই ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইফতার।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে ইবাদত হিসেবে ইফতার করার তাওফিক দান করুন, আমীন।

Tuesday, 7 May 2019

✯শাফা`আতে রাসুল (সঃ)✯


════❖════ ইমরান বিন বদরী

নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মা বা’দ। সমস্ত প্রশংসা পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।

 শাফাআত-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সুপারিশ, মাধ্যম ও দু’আ বা প্রার্থনা। একজন উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এর চেয়ে বড় কী আশা থাকতে পারে যে, কাল ক্বিয়ামতের কঠিনতম সময়ে নবী রাহমাতুল্লীল আলামীনের শাফা`আত প্রাপ্তি হবে ! কতইনা সৌভাগ্যবান ওইসব ব্যক্তি,যাঁদেরকে আল্লাহর হাবীব (দ:) হাশরের মাঠের মহাসংকটের দিনে সুপারিশ করবেন। আখেরাতে অনুষ্ঠেয় শাফাআতের প্রার্থনার বিষয়টি আমাদের অনেকের কাছেই অস্পষ্ট। শাফা`আত নিয়ে লেখার কখনো ইচ্ছা ছিলো না, কারণ সবাই জানি যে আমরা গুনাহগার। কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারে বিচার দিবসে স্ব স্ব অপরাধের কারণে সেই সৎসাহস নেই যে বলবো - হে আল্লাহ আমি পাপমুক্ত, আপনার বিচারে হিসাব ছাড়াই আপনি আমাকে জান্নাত দান করুন। আর আমরা বলতে পারবো না বলেই এই গুনাহগার উম্মতের মুক্তির জন্য ১৪০০ বছর আগে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে 'রাব্বী হাবলী উম্মাাতী' রাব্বী হাবলী উম্মাাতী' বলে বলে কান্নাকাটি করেছিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাললাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম। কিন্তু আজ অনেকে সেই হাবীবুল্লাহ (দ:)’এর শাফা`আতকে পরোক্ষভাবে সুরা যুমার ৪৪ আয়াত দ্বারা অস্বীকার করছে। অথচ এতো এতো সহীহ হাদিস থাকা সত্ত্বেও তারা দেখেও যেন দেখে না।

বন্ধুরা, আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই; আমার লেখাতেও ভুল হতে পারে। আমি চেষ্টা করি সত্যটাকে উপলব্ধি করতে আর তাই মনের অজান্তে জ্ঞানের স্বল্পতায় ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আমরা জানি কিতাবুল্লাহ তথা পবিত্র কুরআনে করীমের বাণীকে প্রাধান্য দিয়েই হাদীসে রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামকে গ্রহণ করতে হবে। এখন যে আয়াতের ভিত্তিতে কাঙ্ক্ষিত শাফা`আতকে অস্বীকার করার চেষ্টা, তা সেই সব (মক্কার) কাফেরদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলো যারা মহান আল্লাহর ওয়াহদানিয়তকে স্বীকার করেনি।

মূলতঃ সৃষ্টিকর্তার হাতেই রয়েছে সবকিছুর ক্ষমতা। সুতরাং শাফাআত-ও মহান আল্লাহর এখতিয়ারে। কিন্তু সেই শাফাআতের অধিকার যদি আল্লাহপাক তার প্রিয় হাবীব (দ:)’কে দেন, তাতে আমাদেরই বেশি আনন্দিত হওয়ার কথা। আল্লাহ পাক বলেন:

أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا

অর্থ: আপনার প্রতিপালক অচিরেই সেইদিন আপনাকে ‘মাক্বামে মাহমূদে’ পৌঁছিয়ে দেবেন’। [(সুরা বনী ইসরাঈল ৭৯]

প্রিয়নবী হাবীবুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন সায়্যিদুশ শুফাআ’ বা শাফাআতকারীদের সর্দার হবেন। এ সত্ত্বেও তিনি সিজদাবনত হবেন আল্লাহর দরবারে এ উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

آتي تَحْتَ الْعَرْشِِ فَأَخِرُّ سَاجِدًا

অর্থ: আমি আরশের নিচে আসবো আর সিজদায় লুটিয়ে পড়বো।

 আসুন দেখি সুরা যুমার আয়াতে আল্লাহ পাক কী বলেন -

أَمِ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ شُفَعَاء قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ

অর্থ: তারা কি আল্লাহকে ছেড়ে সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলুন, তাদের কোনো এখতিয়ার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? (সুরা যুমার ৪৩)

قُل لِّلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَّهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সুরা যুমার ৪৪)

এর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহপাক স্পষ্ট করেন কাদেরকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সুপারিশের আওতাভুক্ত করা হবে না।
এদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন,

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

অর্থ: যখন খাঁটিভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়, আর যখন আল্লাহ ব্যতিরেকে অন্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে। (সুরা যুমার ৪৫)

উপরোক্ত আয়াতে দেখুন যারা মুশরিক, অর্থাৎ, আল্লার নাম ভিন্ন অন্য নাম উচ্চারণে যারা আনন্দিত হয়, তাদের জন্য শাফাআতের দরজা খোলা নেই।
🔰এবার শুনুন কাল-কিয়ামত দিবসে মুমিনদের সুপারিশকারীর প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কী বলেন:

وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُم مِّنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ

অর্থ: তারা শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত।
(সুরা আম্বিয়া ২৮)
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন -
يَوْمَئِذٍ لَّا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا
দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না। (সূরা ত্বোয়া-হা ১০৯)
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন -

وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ

অর্থ: আর আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন, সে ছাড়া তাঁর কাছে কোনো সুপারিশ কারো উপকার করবে না।
(সূরাঃ সাবা ২৩)

সুতরাং কিয়ামত দিবসে নিজেদের জন্য বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাললাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের শাফা‘আত আমরা কামনা করতেই পারি। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ''আমাকে শাফায়াতের অধিকার প্রদান করা হয়েছে।'' সেই সাথে যেন বলি: হে আল্লাহ ! কিয়ামত দিবসে আপনি আমার ভাগ্যে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত নছীব করুন।

🔰 হাদিস শরীফে আল্লার প্রিয় হাবীব ইরশাদ করেন:

جَابِرُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌ مِنَ الأَنْبِيَاءِ قَبْلِي، نُصِرْتُ بِالرُّعْبِ مَسِيرَةَ شَهْرٍ، وَجُعِلَتْ لِيَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا، وَأَيُّمَا رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي أَدْرَكَتْهُ الصَّلاَةُ فَلْيُصَلِّ، وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ، وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ كَافَّةً، وَأُعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ "

অর্থ: হযরত জাবির ইবনুূু আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় প্রদান করা হয়েছে, যা আমার আগে কোনো নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে দেয়া হয়নি:

১। আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যা একমাসের দূরত্ব পর্যন্ত অনুভূত হয়।
২। সমস্ত জমিন আমার জন্য সালাত (নামাজ) আদায়ের স্থান ও পবিত্রতা অর্জনের উপায় করা হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের যে কেউ যেখানে সালাত-এর ওয়াক্ত হয় (সেখানেই) যেন সালাত আদায় করে নেয়।
৩। আমার জন্য গণীমত হালাল করা হয়েছে।
৪। অন্যান্য নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেদের বিশেষ গোত্রের প্রতি প্রেরিত হতেন, আর আমাকে সকল মানবের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে।
৫। আমাকে (ব্যাপক) #শাফায়াতের অধিকার প্রদান করা হয়েছে।
(সহিহ বুখারী/৪২৫ইফা/আহমাদ ১৪২৬৮)
➲ হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: প্রত্যেক নবী (আ:)’কে তাঁর উম্মাতের ব্যাপারে একটি করে এমন দু’আর অনুমতি দেয়া হয়েছে, যা অবশ্যই কবুল করা হবে। আমি সংকল্প করেছি, আমার দু’আটি পরে আমার উম্মাতের #শাফাআতের জন্য করবো।(সহীহ মুসলিম/ইফা৩৮৯)

রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ
আমি আমার দু‘আকে ক্বিয়ামাতের দিনে আমার উম্মাতের শাফা‘আতের জন্য রেখে দিয়েছি।
➲ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

(أَنَا أَوَّلُ شَافِعٍ وَ أَوَّلُ مُشَفَّعٍ (متفق عليه

অর্থ: “আমি-ই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার শাফাআত-ই প্রথম গ্রহণ করা হবে। (বুখারী, মুসলিম)

أَنَا أَوَّلُ النَّاسِ يَشْفَعُ فِى الْجَنَّةِ وَأَنَا أَكْثَرُ الأَنْبِيَاءِ تَبَعًا

অর্থ: হযরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাত সম্পর্কে আমি-ই হবো সর্বপ্রথম #সুপারিশকারী এবং এতো অধিক সংখ্যক মানুষ আমার প্রতি ঈমান আনবে, যা অন্য কোন নবী (আ:)’র বেলায় হবে না। আম্বিয়া (আ:)’দের কেউ কেউ তো এমতাবস্হায়ও আসবেন, যার প্রতি মাত্র এক ব্যক্তি-ই ঈমান এনেছে। (সহীহ মুসলিম/ইফা ৩৮১)
➲ হজরত ইসহাক ইবনু নাসর (রহঃ) আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এক যিয়াফতে উপস্থিত ছিলাম। তাঁর সামনে (রান্না করা) ছাগলের বাহু পেশ করা হল; এটা তাঁর কাছে পছন্দনীয় ছিল। তিনি সেখান থেকে এক টুকরা খেলেন এবং বললেন, আমি কিয়ামতের দিন সমগ্র মানবজাতির সরদার হবো। তোমরা কি জানো, আল্লাহ কীভাবে (কিয়ামতের দিন) একই সমতলে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষকে একত্রিত করবেন? যেন একজন দর্শক তাদের সবাইকে দেখতে পায় এবং একজন আহ্বানকারীর ডাক সবার কাছে পৌঁছোয়। সূর্য তাদের অতি নিকটে এসে যাবে। তখন কোনো কোনো মানুষ বলবে, তোমরা কি লক্ষ্য করো নি, তোমরা কী অবস্থায় আছো এবং কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছো? তোমরা কি এমন ব্যাক্তিকে খুঁজে বের করবে না, যিনি তোমাদের জন্য তোমাদের রবের দরবারে সুপারিশ করবেন? তখন কিছু লোক বলবে, তোমাদের আদি পিতা আদম আলাইহিস্ সালাম আছেন (চলো তাঁর কাছে যাই)। তখন সকলে তাঁর কাছে যাবে এবং বলবে, হে আদম (আলাইহিস সালাম)! আপনি সমস্ত মানব জাতির পিতা। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ আপনার মধ্যে ফুঁকেছেন। তিনি ফিরিশ্‌তাদেরকে (আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের) নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী সকলে আপনাকে সিজ্‌দাও করেছেন এবং তিনি আপনাকে জান্নাতে বসবাস করতে দিয়েছেন। আপনি কি আমাদের জন্য রবের কাছে সুপারিশ করবেন না? আপনি দেখেন না আমরা কী অবস্থায় আছি এবং কী কষ্টের সম্মুখীন হয়েছি? তখন তিনি বলবেন, আমার রব আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, এর আগে এমন রাগান্বিত হননি, আর পরেও এমন রাগান্বিত হবেন না। তিনি আমাকে বৃক্ষটি থেকে (ফল খেতে) নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু আমি তা খেয়েছিলাম। এখন আমি নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। তোমরা আমি ছাড়া অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা নূহের কাছে চলে যাও। তখন তারা নূহ আলাইহিস্ সালামের কাছে আসবে এবং বলবে, হে নূহ (আলাইহিস্ সালাম)! পৃথিবীবাসীর কাছে আপনি-ই প্রথম রাসূল আলাইহিস্ সালাম। আল্লাহ আপনার নাম রেখেছেন কৃতজ্ঞ বান্দা। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন আমরা কী ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছি? আপনি দেখছেন না আমরা কতইনা দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হয়েছি? আপনি কি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করবেন না? তখন তিনি বলবেন, আমার রব আজ এমন রাগান্বিত হয়ে আছেন, যা ইতিপূর্বে হন নাই এবং এমন রাগান্বিত পরেও হবেন না। এখন আমি নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। তোমরা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মুহাম্মদ)–এর কাছে চলে যাও। তখন তারা আমার কাছে আসবে আর আমি আরশের নিচে সিজ্‌দায় পড়ে যাবো। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আপনার মাথা তুলুন এবং #সুপারিশ করুন। আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে, আর আপনি যা চান আপনাকে তাই দেয়া হবে।
(আম্বিআ কিরাম সহীহ বুখারি/ ইফা ৩১০৪)
💚 হে আল্লাহ ! কাল কিয়ামতের কঠিন সময়ে আপনার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের শাফাআত প্রাপ্ত হওয়ার সেই কামীয়াবি হাছিল করার তৌফিক দান করুন। اَللهم لاَتَحْرِمْنِيْ شَفَاعَةَ نَبِيِّكَ আর কিয়ামত দিবসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের জন্য শাফা‘আত করবেন, আমাকে আপনি তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন, আমীন।

*সমাপ্ত*

Saturday, 30 March 2019

প্রিয়নবী (দ:) কি সত্যি নিরক্ষর ছিলেন?

মূল: যোসেফ এ, ইসলাম
অনুবাদ: এডমিন

(১) মহানবী (দ:) নিরক্ষর হওয়ার  (মানে পড়তে/লিখতে না জানার) বিষয়টি আল-ক্বুরআন নিশ্চিত করেছে কি?

উত্তর: না

(২) প্রিয়নবী (দ:) নিরক্ষর মর্মে ধারণাটির পক্ষে দলিলস্বরূপ আল-ক্বুরআন হতে ব্যবহৃত শব্দটি কী?

উত্তর: রাসূল (দ:)’এর প্রতি আরোপিত শব্দটি হচ্ছে ‘উম্মী’, যার দৃষ্টান্ত নিচে রয়েছে:

আল-ক্বুরআন ০৭:১৫৭ (আংশিক উদ্ধৃতি)



ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلأُمِّيَّ
 
অর্থ: যারা আনুগত্য করে রাসূল (দ:)’এর, যিনি ‘উম্মী নবী (দ:)’। [সরাসরি অনুবাদ]

(৩) أُمِّىٌّ - ‘উম্মী’ শব্দটির ক্লাসিকাল/ঐতিহ্যবাহী আরবী সংজ্ঞা কী?

উত্তর: ক্লাসিকাল আরবী ভাষায় ’উম্মী’ শব্দটি ‘অ-ইহুদী’ (Gentile) বা ’পয়গম্বর মূসা (আ:)’র (প্রাপ্ত) ঐশী বিধানের সাথে অপরিচিত কাউকে উদ্দেশ্য করে।’ এটা এমন কেউ নন যিনি অপরিহার্যত নিরক্ষর।

দলিলচিত্র-১


অনুবাদ: ‘উম্মী’ মানে সত্যিকারভাবে অ-ইহুদী। দ্বিতীয় অর্থে অবিশ্বাসী, যা আহলে কেতাব/ইহুদী-খৃষ্টানদের দ্বারা প্রয়োগকৃত। বিশেষ করে আরব বা আল-আম্বর অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট। ‘উম্মী-ইউনাল্ কিতা-বা’ (ক্বুরআন ২: ৭৮) অনুসারে অশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ (বা অবিশ্বাসী), যারা পয়গম্বর মূসা (আ:)’র প্রতি অবতীর্ণ ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে জানে না; প্রিয়নবী (দ:)’কে ‘উম্মী’ (মানে ইসরাঈলীদের থেকে আলাদা করতে অ-ইহুদী) বলা হয়েছে। [Lane. E.W, Edward Lanes Lexicon, Williams and Norgate 1863; Libraire du Liban Beirut-Lebanon 1968, Volume 1, Page 92]

পয়গম্বর মূসা (আ:)’র প্রাপ্ত ঐশী-বিধান সম্পর্কে না জানাটা কেবল সেসব লোকদের বেলাতেই প্রযোজ্য নয়, যারা ইসরাঈলী ঐতিহ্যের নন; বরং আল-ক্বুরআনে কিছু ইসরাঈল বংশীয় লোককেও ‘উম্মী’ বলা হয়েছে, যা তাদের নিজেদের ঐশী শাস্ত্রলিপি সম্পর্কে সামগ্রিক অজ্ঞতার ইঙ্গিত করে।

আল-ক্বুরআন ০২: ৭৮

وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لاَ يَعْلَمُونَ ٱلْكِتَابَ إِلاَّ أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَظُنُّونَ

অর্থ: এবং তাদের মধ্যে এমন কিছু উম্মী-ইউনা লোক আছে, যারা কিতাব সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না, কিন্তু মৌখিকভাবে পড়তে জানে মাত্র, কিংবা নিজেদের কিছু মনগড়া কথাবার্তা; আর তারা নিরেট কল্পনার মধ্যে রয়েছে। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

(৪) ‘Gentile' বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: উক্ত শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন। এটা 'Gentilis' শব্দ হতে এসেছে, যার মানে কোনো বিশেষ গোত্র বা গোষ্ঠীর সাথে জড়িত হওয়া। সুনির্দিষ্টভাবে এর অর্থ অ-ইহুদী গোত্র; আর এর দ্বারা অ-ইহুদীদের বোঝায়।

বর্তমানে উক্ত শব্দটির মৌলিক অর্থ একই আছে, যা এমন অ-ইহুদীদের উদ্দেশ্য করে যাঁরা তৌরীত পাঠ করেননি, কিংবা ইহুদী গোত্রভুক্ত নন।

(৫) ‘উম্মী’ শব্দটি দ্বারা যে ‘নিরক্ষর’ বোঝায় না, আমাদের কাছে  এ মর্মে  অন্যান্য কী কী ক্বুরআনী দলিল আছে?

উত্তর: কেউ যদি ‘উম্মী’ শব্দটির অর্থ ’নিরক্ষর’ (মানে পড়ালেখা জানেন না) বলে অনুবাদ করে, তাহলে নিচের ক্বুরআনের আয়াতটি নিরর্থক সাব্যস্ত হবে:

আল-ক্বুরআন ০৩: ২০

 فَإنْ حَآجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ للَّهِ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِ وَقُلْ لِّلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُواْ فَقَدِ ٱهْتَدَواْ وَّإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ ٱلْبَلَٰغُ وَٱللَّهُ بَصِيرٌ بِٱلْعِبَادِ

অর্থ: অতঃপর হে মাহবূব! যদি তারা (মক্কার কুফফার) আপনার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তবে বলে দিন, ‘আমি আপন চেহারা আল্লাহর সামনে অবনত করেছি এবং যারা আমার অনুসারী হয়েছে;’ আর কিতাবী সম্প্রদায় ও উম্মী-ইউনা লোকদের বলে দিন, ‘তোমরা কি গর্দান অবনত করেছো?’ সুতরাং তারা যদি গর্দান অবনত করে থাকে, তবেই তো সঠিক পথ পেয়ে গেছে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে (হে হাবীব) আপনার কর্তব্য তো এই নির্দেশ পৌঁছে দেয়া মাত্র। এবং আল্লাহ বান্দাদেরকে দেখছেন। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

ওপরে উক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহতা’লা প্রিয়নবী (দ:)’কে আদেশ দিচ্ছেন পূর্ববর্তী কিতাবপ্রাপ্ত ইহুদী ও খৃষ্টানদের এবং ‘উম্মী’দের কাছে ঐশীবাণী ক্বুরআনের ঘোষণা জারি করতে। এখানে ‘উম্মী’ বলতে ‘নিরক্ষর’ অর্থ করলে আয়াতে করীমাটি নিরর্থক হয়ে যায়। কেননা এতে দৃশ্যমান হয় আল্লাহতা’লা প্রিয়নবী (দ:)’কে ঐশীবাণী সেসব লোকের মাঝে ঘোষণা করতে আদেশ করছেন যারা ইতিপূর্বে কেতাবপ্রাপ্ত ‘এবং যারা নিরক্ষর।’ এই অর্থে অনাবশ্যকভাবে তাদেরকে বাদ দেয়া হবে যারা লিখতে ও পড়তে পারেন অথচ যারা ঐশীবাণী প্রাপ্ত হননি। আরবীয়রা সামগ্রিকভাবে নিরক্ষর জাতি ছিলেন না। বরঞ্চ ক্বুরআনে প্রমাণিত হয় যে আরব জাতি বেশ ভালো লিখতে পড়তে জানতেন। যেমন আল-ক্বুরআন ৮০:১৫, যা ক্বুরআন মজীদ কাগজ-কলমে লেখার জন্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। [ بِأَيْدِي سَفَرَةٍ]

আল-ক্বুরআন ৬২: ০২

هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ

অর্থ: তিনি, যিনি উম্মী লোকদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেন যেনো তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে (ঐশী) কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান দান করেন আর নিশ্চয় নিশ্চয় তারা ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলো। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

কেউ আবারো ওপরের আয়াতটিতে উল্লেখিত ‘উম্মী’ শব্দটিকে নিরক্ষর বলে ধরে নিলে তা এই ভ্রান্ত ধারণার দিকে ইঙ্গিত করবে যে খোদাতা’লা লিখতে পড়তে জানেন না এমন লোকদের মাঝে রাসূল (দ:)’কে প্রেরণ করেছেন, যা স্পষ্টতঃ এ আয়াতটিকে নিরর্থক সাব্যস্ত করবে।

আল-ক্বুরআন ০৩: ৭৫

 وَمِنْ أَهْلِ ٱلْكِتَٰبِ مَنْ إِن تَأْمَنْهُ بِقِنْطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَّنْ إِن تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لاَّ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلاَّ مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَآئِماً ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُواْ لَيْسَ عَلَيْنَا فِي ٱلأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ ٱلْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ 

অর্থ: এবং কিতাবীদের মধ্যে কিছু এমন লোক রয়েছে যে, যদি তুমি তার কাছে বিপুল সম্পদ আমানত রাখো, তবে সে তা তোমাকে ফিরিয়ে দেবে। আর তাদের মধ্যে কিছু এমন লোকও রয়েছে যে, যদি একটা স্বর্ণমুদ্রা তার কাছে আমানত রাখো, তবে সে তাও তোমাকে ফেরত দেবে না, কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি তার মাথার ওপর দণ্ডায়মান থাকো (মানে তার পেছনে লেগে থাকো)। এটা এ জন্যে যে, তারা বলে: ‘উম্মীয়্যিনা’ লোকদের মামলায় (তাদের প্রতি) আমাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।’ আর তারা (ওই সমস্ত কিতাবী) আল্লাহ সম্পর্কে জেনে বুঝে মিথ্যে বলে থাকে। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

ওপরের আয়াতটিতে আমরা লক্ষ্য করি যে, ঐশী কিতাবী কিছু লোক ধরে নিয়েছিলো যে কিতাবী নয় এমন মানুষ মানে অ-ইহুদীদের প্রতি তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। অতএব, এ আয়াতেও ‘উম্মী-ঈনা’ শব্দটির অর্থ নিরক্ষর নির্ধারণ করলে তা অর্থবোধক হবে না।

(৬) প্রিয়নবী (দ:) যে একজন ‘উম্মী’ তথা ইতিপূর্বে অবতীর্ণ কোনো ঐশীগ্রন্থের পাঠক নন এবং ইহুদী বংশােদ্ভূত-ও নন, ক্বুরআন মজীদ কি এমন দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন করে?

উত্তর: হ্যাঁ

আল-ক্বুরআন ৪২: ৫২

 وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ رُوحاً مِّنْ أَمْرِنَا مَا كُنتَ تَدْرِي مَا ٱلْكِتَابُ وَلاَ ٱلإِيمَانُ وَلَـٰكِن جَعَلْنَاهُ نُوراً نَّهْدِي بِهِ مَن نَّشَآءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِيۤ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

অর্থ: এবং এভাবে আমি আপনার প্রতি ওহী/ঐশীবাণী (অবতীর্ণ) করেছি, এক প্রাণ-সঞ্চারক বস্তু আপন নির্দেশে; এর পূর্বে আপনি কিতাব জানতেন না, না শরীয়তের বিধানাবলীর বিস্তারিত বিবরণ। হ্যাঁ, আমি সেটাকে (হেদায়াতের) আলো করেছি, যা দ্বারা আমি পথ দেখাই আপন বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করি। এবং নিশ্চয় নিশ্চয় আপনি সোজা পথ বাতলে দেন। [তাফসীরে নূরুল এরফান]

مَا كُنتَ تَدْرِي- মা’ কুনতা
مَا ٱلْكِتَابُ - মা’ল-কিতা’বু
وَلاَ ٱلإِيمَانُ - লা’ ঈমা’নু
[যোসেফ ইসলাম কর্তৃক পেশকৃত উদাহরণ]

আল-ক্বুরআন ২৯: ৪৮

 وَمَا كُنتَ تَتْلُواْ مِن قَبْلِهِ مِن كِتَابٍ وَلاَ تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ إِذاً لاَّرْتَابَ ٱلْمُبْطِلُونَ

অর্থ: এবং এর আগে আপনি কোনো কিতাব/ঐশীগ্রন্থ পাঠ করতেন না এবং আপনি না আপন ডান হাতে কিছু লিখতেন। যদি এমন হতো তাহলে বাতিল সম্প্রদায় অবশ্য সন্দেহ করতো। [নূরুল এরফান]

বিশেষ জ্ঞাতব্য:

এখানে ‘(আপনি) আপন ডান হাতে কিছু লিখতেন না’ বাক্যটি আল-ক্বুরআনকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়নি। এটা স্পষ্টতঃ ইতিপূর্বেকার আসমানী কিতাব বা শাস্ত্রলিপির প্রতি উদ্দেশ্যকৃত, যা প্রসঙ্গের আলোকে বেরিয়ে এসেছে। এই আয়াতটি পাঠকদেরকে জানায় যে মহানবী (দ:) পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর না ছিলেন পাঠক, না লেখক, আর তাই তাঁর কাছে না ছিলো ওগুলোর (কোনো) জ্ঞান; এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তিনি কোত্থেকে তাঁর (এতদসংক্রান্ত) জ্ঞান লাভ করেছিলেন? আর এটা (জনমনে ঠাঁয় পাওয়া বিশ্বাসের বিপরীতে) এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আস্থাশীলতা দেয় যে প্রিয়নবী (দ:) পড়া ও লিখা দুটোই জানতেন।

রাসূলুল্লাহ (দ:) যদি পড়তে বা লিখতে না-ই জানতেন, তাহলে ‘পূর্ববর্তী কিতাবগুলো’ তিনি পড়েননি বা লিখেননি মর্মে  বক্তব্য দ্বারা কেন মানুষকে জানানো হয়েছে? উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বলে ’ক’ নির্দিষ্টভাবে ‘খ’ বইটি পড়েননি, তাহলে এতে প্রতীয়মান হবে যে ‘ক’ প্রকৃতপক্ষেই পড়ার সক্ষমতা বা সামর্থ্য রাখেন। উদাহরণটিতে ব্যতিক্রম শুধু এই যে, ‘খ’ বইটি ‘ক’ পাঠ করেননি।

রাসূল (দ:) যে নবী হবেন এমন কোনো প্রত্যাশাও তাঁর ছিলো না

আল-ক্বুরআন ২৮: ৮৬

وَمَا كُنتَ تَرْجُوۤ أَن يُلْقَىٰ إِلَيْكَ ٱلْكِتَابُ إِلاَّ رَحْمَةً مِّن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُونَنَّ ظَهيراً لِّلْكَافِرِينَ

অর্থ: এবং আপনি আশা করতেন না যে কিতাব আপনার প্রতি প্রেরণ করা হবে। হ্যাঁ, আপনার রব্ব অনুগ্রহ করেছেন; সুতরাং কখনো কাফেরদের সহায়তা করবেন না। [নূরুল এরফান]

(৭) প্রিয়নবী (দ:) যে নিরক্ষর ছিলেন না, এ বিষয়টিকে সমর্থন দানকারী অন্য কোনো দলিল আছে কি?

উত্তর: হ্যাঁ

প্রামাণ্য দলিল-১: (মক্কার) কুফফার/অবিশ্বাসীরা প্রিয়নবী (দ:)’র প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করেছিলো যে তিনি নিজ মোবারক হাতে কিতাবুল্লাহ লিখেছিলেন।

আল-ক্বুরআন ২৫: ০৫

 وَقَالُوۤاْ أَسَاطِيرُ ٱلأَوَّلِينَ ٱكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلَىٰ عَلَيْهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً

অর্থ: এবং (কুফফার) বল্লো, ‘পূর্ববর্তীদের কিচ্ছা-কাহিনি তিনি লিখে নিয়েছেন; অতঃপর সেগুলো তাঁর কাছে সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করা হয়।’ [নূরুল এরফান]

এই আয়াতটি অনুবাদ করার ক্ষেত্রে তাফসীরকারক উলামাবৃন্দ কিছুটা বেগ পেয়ে থাকেন, কেননা এটা ইঙ্গিত করে যে মহানবী (দ:) লিখতে পারতেন। এই আয়াতটি তাঁরই বিরুদ্ধে কুফফারদের উত্থাপিত আরো বড় অভিযোগের অংশবিশেষ (যা ব্যক্ত করে যে তিনি কিচ্ছা লিখেছিলেন)। এমতাবস্থায় অনেক ভিন্ন ভিন্ন (দৃষ্টিভঙ্গির) অনুবাদ পেশ করা হয়েছে। সমস্যাটির গোড়া এই বাস্তবতা যে, একদিকে কিছু আহাদীসে বিবৃত হয়েছে প্রিয়নবী (দ:) নিরক্ষর ছিলেন, আরেক দিকে এই আয়াতে করীমায় ব্যবহৃত আরবী ইঙ্গিত করছে যে (বৃহত্তর অভিযোগের অংশ হিসেবে) তিনি কার্যতঃ লিখতে পারতেন।

আরবীতে ٱكْتَتَبَ ‘একতাতাবা’ শব্দটির মূল كتب কাফ-তা-বা

كتب মানে তিনি লিখেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন, নিয়োগ করেছেন, স্থির করেছেন, লিখতে হুকুম দিয়েছেন, বিচার-বিবেচনা করেছেন, বিধান জারি করেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, একত্র করেছেন, সংগ্রহ করেছেন, যুক্ত করেছেন; এমন একটি বস্তু যার ওপর কেউ লিখেন বা লিপিবদ্ধ করেন, কিংবা নথিভুক্ত করেন।

আরবী كتب - ক্রিয়াপদ 

আরবী ٱكْتَتَبَ হচ্ছে كتب -এর কর্তাবাচ্য অতীতকাল ক্রিয়া। অতএব, এই ক্রিয়ার দ্বারা বোঝা যায় প্রিয়নবী (দ:) হয় ক্বুরআন লিপিবদ্ধ করিয়েছেন, না হয় নিজে লিখেছেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: ইতিহাস প্রথমটি সমর্থন করে। তাঁর কয়েকজন কাতেব তথা ওহী লেখক ছিলেন। তিনি নিজে তা লেখার পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই।]

প্রামাণ্য দলিল-২

আমরা সূরাহ ৯৬:০১ পাঠ করলে বিবেচনা করার মতো কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় তাতে পাওয়া যাবে:

আল-ক্বুরআন ৯৬:০১-৫

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ، خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ، اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ، الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ، عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

অর্থ: পড়ুন! আপনার রব্বের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন- মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ূন! এবং আপনার রব্ব-ই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা, যিনি কলম দ্বারা লিখন শিক্ষা দিয়েছেন - মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না। [নূরুল এরফান]

‘ইক্বরা’ (পড়ুন) শব্দটি ও কলম দ্বারা শিক্ষাদানের মধ্যে সংযোজক অব্যয় পদের প্রতি লক্ষ্য করুন।

(৮) তাহলে কোন্ সূত্র আমাদের জানাচ্ছে প্রিয়নবী (দ:) লিখতে পড়তে জানতেন না?

উত্তর: ইসলামী অমুখ্য উৎসগুলো। যেমন এলম-এ-রেজাল তথা ইসলামী আলেম-উলামার গবেষণাকীর্তি ও ফতোয়া যা মুখ্য ঐশী শাস্ত্রলিপি তথা ক্বুরআন মজীদ নয়।

এই ব্যাখ্যাটি ওই উৎস থেকেই ইসলামী ইতিহাসবিদ ও গবেষকমণ্ডলী বের করেছেন। তবে এসব উৎসের মধ্যেই এ ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। কিছু উৎস বিবৃত করে যে রাসূলুল্লাহ (দ:) পড়তে জানতেন; আবার কিছু উৎস আমাদের জানায় তিনি তা জানতেন না।

ইসলামী অমুখ্য উৎসগুলোর মধ্যকার অসঙ্গতি: (মহানবী সাক্ষর হওয়ার পক্ষে যেসব উৎস)

কেউ যদি আহাদীসকে নিজ যুক্তির পক্ষে ব্যবহার করেন (যেহেতু একমাত্র আমদের ধর্মের আহাদীসেই প্রিয়নবী (দ:)’র নিরক্ষরতার পক্ষে দাবি পাওয়া যায়), তাহলে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদমণ্ডলী (যথা - আল্ বাকাঈ ইবনে হিশাম; সালাম আল-ফযল তাবারী প্রমুখ) যাঁদের থেকে বিদ্যমান মৌলিক জীবনী নেয়া হয়েছে, তাঁরা লিপিবদ্ধ করেন যে ভণ্ড নবী মুসাইলামা কাযযাবের পত্রের জবাব প্রিয়নবী (দ:) স্বয়ং লিখেছিলেন। ওই হাদীস রেকর্ড করে যে তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। ইমাম বুখারী (রহ:)’র দ্বারা হাদীস সংকলনেরও এক শতাব্দী আগে এই ইতিহাসবিদবৃন্দ আহাদীস থেকে সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন।

(ক) প্রিয়নবী (দ:)’র কাছে পড়ার জন্যে জিবরীল (আ:) বুটিদার রেশমি বস্ত্র/চাদর এনেছিলেন 

রমযান মাসে যা’তে আল্লাহতা’লা তাঁর হাবীবের (দ:) বিষয়ে নিজ করুণাস্বরূপ যা যা এরাদা/ইচ্ছা করেছিলেন, তাতে মহানবী (দ:) নিজ স্বভাব অনুসারে সপরিবার হেরা অভিমুখে রওয়ানা হন। রাতে যখন আল্লাহতা’লা তাঁকে তাঁর ঐশী মিশনের দ্বারা সম্মানিত করেন এবং তা দ্বারা আপন সেবকমণ্ডলীর প্রতি করুণা বর্ষণ করেন, তখন জিবরীল আমীন (আ:) তাঁর কাছে খোদার বিধান নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন, “আমি নিদ্রাগত থাকাকালে জিবরীল (আ:) আমার কাছে আসেন একটি বুটিদার রেশমি বস্ত্র/চাদরসহ, যার ওপর কিছু লেখা ছিলো; আর তিনি বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি বলি, আমি কী পড়বো? তিনি তা দ্বারা আমাকে এমন শক্তভাবে চেপে ধরেন যে আমি মনে করেছিলাম আমার বুঝি ইন্তেক্বাল হবে; অতঃপর তিনি আমায় ছেড়ে দেন এবং বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি (আবার) বলি, আমি কী পড়বো? (এমতাবস্থায়) তিনি আবারো তা দ্বারা আমাকে চেপে ধরেন এমনভাবে যেনো আমার ইন্তেক্বাল হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছিলো। তিনি এরপর আমায় ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি (আবার) বলি, আমি কী পড়বো? তিনি তৃতীয়বার তা দ্বারা আমায় চেপে ধরেন, যার দরুন মনে হলো আমার ইন্তেক্বাল হবে; এরপর তিনি আমায় ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন!’ আমি (এমতাবস্থায়) বলি, তাহলে আমি কী পড়বো? আর এ কথা আমি বলেছিলাম তাঁর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে, পাছে তিনি আবার একই রকম করেন। এবার তিনি বলেন:

পড়ুন! আপনার রব্বের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন- মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ূন! এবং আপনার রব্ব-ই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা, যিনি কলম দ্বারা লিখন শিক্ষা দিয়েছেন - মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না।

অতঃপর আমি তা-ই পাঠ করি, আর জিবরীল (আ:) আমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। [Guillaume. A, The Life of Muhammad: A Translation of Ishaq's Sirat Rasul Allah, Oxford University Press, Page 106]

(খ) মুসায়লামা’র পত্র ও মহানবী (দ:)’র উত্তর   

আশজা’র জনৈক শায়খ আমার কাছে বর্ণনা করেন সালামা বিনতে নুয়াইম বিন মাসউদ আল-আশজাঈ হতে, তিনি তাঁর পিতা নুয়াইম হতে; যিনি বলেন: আমি হুজূর পাক (দ:)’কে মুসায়লামা কাযযাবের চিঠি পড়া হলে তাদের (বার্তাবাহকদের) প্রতি জিজ্ঞেস করতে শুনি, “তোমরা এ সম্পর্কে কী বলো?” তারা উত্তর দেয় যে তারা মুসায়লামার মতামত-ই ব্যক্ত করে। এমতাবস্থায় তিনি (দ:) প্রত্যুত্তর দেন, “আল্লাহর শপথ! বার্তাবাহকদের হত্যা না করার ব্যাপারটি যদি না থাকতো, তাহলে আমি তোমাদের দু জনের শিরোচ্ছেদ করতাম।” অতঃপর তিনি মুসায়লামার প্রতি লেখেন: “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে মিথ্যুক মুসায়লামা’র প্রতি লিখিত। হেদায়াত যে ব্যক্তি অনুসরণ করে তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এই জগৎ আল্লাহতা’লার মালিকানাধীন। তিনি যে সব বান্দার প্রতি ইচ্ছা করেন, তাদেরকে এর উত্তরাধিকার দান করেন; আর উত্তম ফলাফল হচ্ছে পুণ্যাত্মাদের জন্যে (বরাদ্দ)।” এই ঘটনা দশম হিজরী সালের। [প্রাগুক্ত Guillaume. A, The Life of Muhammad: A Translation of Ishaq's Sirat Rasul Allah, Oxford University Press, Page 649]

ওপরের বর্ণনাটি, যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে প্রিয়নবী (দ:) বাস্তবিকই লিখতে সক্ষম ছিলেন, তার পরিষ্কার সাংঘর্ষিক বক্তব্যের প্রতি পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদবৃন্দ যে ব্যাখ্যা দেন তা হলো, এটা প্রিয়নবী (দ:) কাউকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা এই লিপি ইঙ্গিত করে না, যেটা ব্যক্ত করে প্রিয়নবী (দ:) লেখা ও পাঠ দুটোই করতে সক্ষম ছিলেন।

(গ) সুনানে আবী দাউদ: বই-১৯, হাদীস নং-২৯৯৩

حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا قُرَّةُ، قَالَ سَمِعْتُ يَزِيدَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ كُنَّا بِالْمِرْبَدِ فَجَاءَ رَجُلٌ أَشْعَثُ الرَّأْسِ بِيَدِهِ قِطْعَةُ أَدِيمٍ أَحْمَرَ فَقُلْنَا كَأَنَّكَ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ ‏.‏ فَقَالَ أَجَلْ ‏.‏ قُلْنَا نَاوِلْنَا هَذِهِ الْقِطْعَةَ الأَدِيمَ الَّتِي فِي يَدِكَ فَنَاوَلَنَاهَا فَقَرَأْنَاهَا فَإِذَا فِيهَا ‏

"‏ مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللَّهِ إِلَى بَنِي زُهَيْرِ بْنِ أُقَيْشٍ إِنَّكُمْ إِنْ شَهِدْتُمْ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَأَقَمْتُمُ الصَّلاَةَ وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَأَدَّيْتُمُ الْخُمُسَ مِنَ الْمَغْنَمِ وَسَهْمَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَسَهْمَ الصَّفِيِّ أَنْتُمْ آمِنُونَ بِأَمَانِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ‏"

‏ ‏.‏ فَقُلْنَا مَنْ كَتَبَ لَكَ هَذَا الْكِتَابَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم 

অর্থ: হযরত এয়াযীদ ইবনে আবদিল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: আমরা মিরবাদে ছিলাম। এমন সময় এলোমেলো চুলবিশিষ্ট এক ব্যক্তি তাঁর হাতে (পশুর) একটি লাল চামড়া নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। আমরা বলি: আপনি দেখতে তো বেদুঈন। তিনি উত্তর দেন: জি হ্যাঁ। আমরা বলি: আপনার হাতে অবস্থিত চামড়ার টুকরোখানি আমাদের দিন। তিনি তা হস্তান্তর করলে আমরা তাতে পাঠ করি নিম্নের লিপি: “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে বনূ যুহায়র ইবনে উক্বাইশের প্রতি (লিখিত)। তোমরা যদি সাক্ষ্য দাও এই মর্মে  যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ/উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, আর যদি নামায আদায় করো, যাকাত দাও, গনীমতের এক-পঞ্চামাংশ ও মহানবী (দ:)’র অংশ (সোয়াফী) পরিশোধ করো, তাহলে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)’এর আমান তথা জিম্মাদারীতে বা সুরক্ষায় থাকবে।” এমতাবস্থায় আমরা তাঁকে (বেদুঈনকে) জিজ্ঞেস করি: এই দলিলটি আপনার জন্যে কে লিখেছিলেন? তিনি উত্তর দেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)।

(ঘ) সহীহ মুসলিম: বই-১৩, কিতাবুল ওয়াসীয়্যা, হাদীস নং-৪০১৬

وَحَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ رَافِعٍ، وَعَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ، ء قَالَ عَبْدٌ أَخْبَرَنَا وَقَالَ ابْنُ رَافِعٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، ء أَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُتْبَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ لَمَّا حُضِرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَفِي الْبَيْتِ رِجَالٌ فِيهِمْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ هَلُمَّ أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لاَ تَضِلُّونَ بَعْدَهُ ‏"‏ ‏.‏ فَقَالَ عُمَرُ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ غَلَبَ عَلَيْهِ الْوَجَعُ وَعِنْدَكُمُ الْقُرْآنُ حَسْبُنَا كِتَابُ اللَّهِ ‏.‏ فَاخْتَلَفَ أَهْلُ الْبَيْتِ فَاخْتَصَمُوا فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ قَرِّبُوا يَكْتُبْ لَكُمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كِتَابًا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ ‏.‏ وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ مَا قَالَ عُمَرُ ‏.‏ فَلَمَّا أَكْثَرُوا اللَّغْوَ وَالاِخْتِلاَفَ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ قُومُوا ‏"‏ ‏.‏ قَالَ عُبَيْدُ اللَّهِ فَكَانَ ابْنُ عَبَّاسٍ يَقُولُ إِنَّ الرَّزِيَّةَ كُلَّ الرَّزِيَّةِ مَا حَالَ بَيْنَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَبَيْنَ أَنْ يَكْتُبَ لَهُمْ ذَلِكَ الْكِتَابَ مِنِ اخْتِلاَفِهِمْ وَلَغَطِهِمْ ‏.

হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র প্রকাশ্য জিন্দেগীর সায়াহ্নে তাঁর ঘরে মানুষজন উপস্থিত ছিলেন, যাঁদের মধ্যে হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও ছিলেন। হুযূর পাক (দ:) এরশাদ ফরমান: “(কাগজ-কলম নিয়ে) এসো, আমি যাতে একটি দলিল লিখতে পারি; ওর পরে তোমরা আর পথভ্রষ্ট হবে না।” অতঃপর হযরত উমর (রা:) বলেন: নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) গভীর বেদনা-ক্লেশ অনুভব করছেন। তোমাদের কাছে রয়েছে ক্বুরআন মজীদ। কিতাবুল্লাহ-ই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। তখন ঘরে উপস্থিতদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। তাঁদের কেউ কেউ বলেন: (কাগজ-কলম) এনে দাও যাতে প্রিয়নবী (দ:) তোমাদের জন্যে একটি দলিল লিখতে পারেন, যার দরুন তোমরা আর কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। অন্যান্যরা অপর দিকে হযরত উমর (রা:) যা বলেছিলেন, তারই পুনরাবৃত্তি করেন। এতে মহানবী (দ:)’র উপস্থিতিতে তর্ক-বিতর্ক ও উচ্চস্বরে আওয়াজ হলে তিনি (সবাইকে) বলেন: উঠে দাঁড়াও (এবং চলে যাও)! হযরত উবায়দুল্লাহ (রা:) বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন: এটা ছিলো বড় একটি ক্ষতি, নিশ্চয় বড় ক্ষতি, তাঁদেরই মতবিরোধ ও আওয়াজের কারণে। রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁদের কারণে দলিলটি লিখতে (বা লেখাতে) পারেননি।

দলিলচিত্র-২




ওপরের দলিলচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো হলুদ ও ছাই বর্ণে চিত্রিত করা হয়েছে।

(৯) এ রকম পরস্পরবিরোধী উৎসের ক্ষেত্রে কোনটি তাহলে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য?

উত্তর: নিঃসন্দেহে মুখ্য উৎস - ক্বুরআন মজীদ; যদি এটাকে প্রাথমিক ঐতিহাসিক উৎস হিসেবে ব্যবহার করাও হয়।

(১০) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে নিরক্ষর হিসেবে প্রতীয়মান করার জন্যে অমুখ্য উৎসগুলো আল-ক্বুরআনের তাফসীর/ব্যাখ্যাকে প্রভাবিত করছে কি?

উত্তর: হ্যাঁ।

শেষ কথা

অতএব, সারসংক্ষেপ হিসেবে আমরা যা দেখতে পাই:

১/- ক্লাসিকাল আরববৃন্দ ‘উম্মী’ বলতে অ-ইহুদী অথবা পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)’র প্রাপ্ত ঐশী বিধান সম্পকে অপরিচিত কাউকে জানতেন/বুঝতেন। [অর্থাৎ, ওই বিধান স্রেফ ইহুদীদের ছিলো ২:৭৮]

২/- ‘উম্মী’ শব্দটিকে ‘নিরক্ষর’ হিসেবে অনুবাদ করলে ক্বুরআনী আয়াতসমূহ নিরর্থক প্রতিপন্ন হয়; কেননা এতে গোটা আরবজাতি বা ক্বুরআন যাঁদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে (অনারবও অন্তর্ভুক্ত), তাঁদের সবাইকে নিরক্ষর বলা হয়। [আল-ক্বুরআন ৩:২০; ৬২:০২]

৩/- মহানবী (দ:)’র সময়কার (মক্কার) কুফফার তাঁর প্রতি নিজ হাতে ক্বুরআন লেখার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলো।তিনি নিরক্ষর হলে এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হতো এবং তা প্রথমাবস্থায় উত্থাপনও করা হতো না।

৪/ - হতে পারে প্রিয়নবী (দ:) লিখতে বা পড়তে জানতেন না। তবে আল-ক্বুরআন তাঁর ‘উম্মী’ হওয়ার প্রসঙ্গ আলোচনাকালে তা নিশ্চিত করে না। বরং সামগ্রিক দলিলাদির আলোকে তাঁর লিখতে ও পড়তে জানার সম্ভাবনা-ই এক্ষেত্রে প্রবলতম।

                                                            *সমাপ্ত*   
   

Tuesday, 19 March 2019

আক্বীদা-বিশ্বাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

- এডমিন

সম্প্রতি আমি সপরিবার রংপুর ও গাইবান্ধা সফরে গিয়েছিলাম। উপলক্ষ মামাতো শ্যালক Asfat Rahman Fuad‘এর বিয়ে। তবে রংপুরে সুন্নী সংগঠক Ridwan Ashrafi ভাইসহ অন্যান্য সুন্নী ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এ্যাডভোকেট রিদওয়ানভাই আমাকে আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:)’র রচিত ‘আশীর্বাদময় সাহাবায়ে কেরাম (রা:)’ বইটি উপহারস্বরূপ দেন। সাড়ে পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই বইটি অনুবাদ করা সম্ভব হলে সুন্নী মুসলিম সমাজ উপকৃত হবেন।

গাইবান্ধায় এসকেএস-ইন ভ্রমণের সময় বগুড়ার Mohammad Shamim ভাই আমাকে তাঁর এলাকা ঘুরে যাবার অনুরোধ জানান। কিন্তু সময়ের সংক্ষিপ্ততার দরুন তা হয়ে ওঠেনি। নিউজিল্যান্ড মসজিদে হামলার ঘটনা তখন সবেমাত্র ঘটেছে। তিনি বল্লেন, শত্রুরা মুসলমান হত্যা করছে; এমতাবস্থায় আক্বীদা’র প্রশ্ন, সুন্নী-ওহাবী-মওদূদী ইত্যাদি বিষয়গুলো উত্থাপন করা কতোখানি সমীচীন। শত্রুরা তো সবাইকেই নিধন করছে। প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক হওয়ায় সংক্ষেপে কিছু কথা বলতে চাই আমি। উলামাবৃন্দ এর ব্যাপক ব্যাখ্যা দেবেন আশা করি।

দেখুন, আক্বীদা-বিশ্বাস হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মূলভিত্তি। এটা সাগরবক্ষে কোনো তরীর হালের মতোই। হাল ছাড়া উত্তাল সাগরে তরী দিশেহারা। মুসলমান সমাজও সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাস জানা ছাড়া গরু/গাধার পালের মতো দিগভ্রান্ত। ফলে মঞ্জিলে মক্বসূদ সুদূর পরাহত। আমার কথায় কেউ আবার রেগে যাবেন না কিন্তু! গরু/গাধার পাল বলাটা মোটেও অত্যুক্তি নয়। আমরা যদি সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করতে না পারি, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কাছে আমাদের মূল্য গরু/গাধার চেয়ে বেশি হবে না; বরঞ্চ নিকৃষ্টতরই হবে। আফসোস এই যে, আমি কোনো ওহাবী/মওদূদী/সালাফী/তাবলীগী/শিয়া/কাদিয়ানীকেই সত্যপন্থী সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাসের প্রতি নিষ্ঠাবান হতে দেখিনি। সদাসর্বদা কূটকৌশল প্রয়োগ করে নিজেদের মনগড়া মতবাদেরই সাফাই গাইতে দেখেছি তাদের। তওবা করে সুন্নী মতাদর্শ তারা গ্রহণ করেনি। এটা তাদের মনের বক্রতা-ই প্রতিফলন করে।

শেষ কথা হলো, একমাত্র সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাস ধারণ করেই বর্তমান যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন মুসলমান সমাজ। ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যাকারীদের মনগড়া মতবাদ বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে না, বরং ম্লান করবে।